সোনার হরিণ নেই – ১৪

চৌদ্দ

দু’তিনখানা চেয়ার পড়ে সামনে সে-রকম চিলতে বারান্দা। মাঝারি সাইজের শোবার ঘর একটা। আর পিছনে পার্টিশন করা দুটো ছোট খুপরি। কিচেন আর বাথ। যেমন কথা হয়েছিল গায়ত্রী রাই তার কিছু বেশিই করে দিয়েছে। নিজের বাংলো থেকে জলের পাইপ আর ইলেকট্রিকের লাইন টেনে দিয়েছে। কাঠের কাজ সব, নগদ টাকা ফেললে এটুকু কনস্ট্রাকশনের জন্য কন্ট্রাক্টারের কত আর সময় লাগতে পারে। রাশভারী মহিলার তাড়ায় দেড় মাসের মধ্যে সব কাজ শেষ। মাঝে মেহেদির পার্টিশন বসানোও। একদিকের বারান্দা বা ঘর থেকে অন্যদিকের বাংলো শুধু দেখা যায়। মানুষ দেখা যায় না।

কর্ত্রীর নির্দেশে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে বাপী তরফদার চা-বাগানের ক্লাব ছেড়ে এই বাসস্থানে উঠে এলো। মহিলাকে এই দু’ মাস ডাটাবাবুর চড়া বিল মেটাতে হয়েছে। এ-সময়টা বাপীকে পঞ্চাশ টাকা করে পকেট খরচ দেওয়া হয়েছে। দু’বেলার চা-জলখাবার পর্যন্ত ব্যবসার অ্যাকাউন্টে গেছে যখন বাপীর পাঁচ টাকারও দরকার হয় নি। অ্যাকাউন্টেন্ট পঞ্চাশ টাকা হাতে তুলে দিতে কর্ত্রীর নির্দেশ বুঝে সে-ও নিয়ে নিয়েছে।

এর মধ্যে আর মাত্র দু’দিন বাপী তরফদার এখানে এসে কর্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিল। অ্যাকাউন্টেন্ট প্রায় রোজই আসে। প্রথমবার তার মারফৎ বাপী খবর পাঠিয়েছিল, দেখা করা দরকার। গায়ত্রী রাই সেই বিকেলেই তাকে যেতে বলেছে। আর বারান্দায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝালো গলায় বলেছে, খবর পাঠানোর মানে কি, দরকার পড়লে নিজে চলে আসতে পারো না?

বাপী তক্ষুনি রাগের হেতু বুঝেছে। অ্যাকাউন্টেন্ট আর টাইপিস্ট দু’জনেই রণজিৎ চালিহার বশংবদ। জানান দিয়ে দেখা করতে আসাটা গোপন না-ও থাকতে পারে। কিন্তু কাজে নামার পর সেই কদিনে বাপীর মনের জোর আর বিশ্বাসও কিছু বেড়েছে। ঠাণ্ডা মুখেই জবাব দিয়েছিল, দরকার পড়লে চলে আসার ব্যাপারে আপনিই একটু অসুবিধের সৃষ্টি করেছেন। কখন এলে অখুশি হবেন না বা তাড়িয়ে দেবেন না আমার পক্ষে বোঝা মুশকিল।

মুখের ওপর কথা বরদাস্ত করার মেজাজ নয় মহিলার। কিন্তু সেই তপতপে চাউনির সবটাই খুব অকৃত্রিম মনে হয় নি বাপীর। গম্ভীর। হুকুম করেছে, বোসো।

দুপুরে রোজই সাইকেল নিয়ে বেরুচ্ছ?

বাপী মাথা নাড়তে আবার বলেছে, দুপুরের দিকে আমি ফ্রি থাকি, দরকার পড়লে তখন এসো।

বাপীর হাতে তার সেই নিজস্ব ফাইল আর সঙ্গে মাঝারি সাইজের একটা ডায়রি। দশ মাইল জুড়ে রোজ ঘোরাঘুরির ফলে ফাইল আরো পুষ্ট হয়েছে। ডায়রিতে প্রতি দিনের কাজের হিসাব। কোন্ তারিখে কোথায় কোন্ পার্টির সঙ্গে দেখা করেছে, তাদের কি অসুবিধা বা অভিযোগ ইত্যাদি।

বাপী ফাইল খুলতেই মহিলা চেয়ার ছেড়ে উঠে ভিতরের ঘরে গেছে। একটু বাদে খাপসুদ্ধু পড়ার চশমাটা নিয়ে এসেছে। সেই ফাঁকে বাপী দেখেছিল পাশের জমিতে তার ঘর উঠছে। আর এদিকে তিন-তিনটে মালী মেহেদির পার্টিশন বসানোর জন্য মাটি খুঁড়ছে। কিন্তু মহিলা এ-সম্বন্ধে সেদিন একটি কথাও তোলেনি। ফলে বাপীও নিরাসক্ত।

শৌখিন সোনার ফ্রেমের চশমা এঁটে ফাইলটা আদ্যোপান্ত পড়েছে। ডায়েরিটাও। মুখ দেখে খুশি অখুশি কিছু বোঝা গেল না। কিন্তু বাপী জানতো অখুশি হবার কোনো কারণ নেই। অঙ্কের মাথা বরাবর সাফ। ছকে বেঁধে কাজে নেমেছে। তিন সপ্তাহ আগের আর তিন সপ্তাহ পরের লেনদেনের চার্ট পাশাপাশি রেখেছে। কি কারণে ক’জন ছোটখাটো পাইকিরি খদ্দের তাদের কাছ থেকে মাল নেওয়া বন্ধ করেছিল, আর কি শর্তে আবার তারা হাত মেলাতে রাজি—ফাইলে তাও লেখা আছে।

ফাইল দেখা আর ডায়রি পড়া শেষ করে মহিলা চশমাটা আবার খাপে পুরে শোনার জন্য প্রস্তুত—বলো।

বাপী জানিয়েছিল, কাছাকাছির এইসব ছোট পাইকিরি খদ্দেরদের বেলায় আসল গলদ সময়ে মাল পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে। মাসে একবার ঝাঁকামুটে দিয়ে বা গোরুরগাড়িতে করে তাদের কাছে মাল যায়। নয়তো লরি যখন দূরে দূরে বড় চালান নিয়ে যায় তখন পথে পড়ে বলে তারা কিছু কিছু পায়। সে-ও ক্বচিৎ কখনো। এখন থেকে পনের দিনে একদিন সে যদি মাল সহ ভ্যান নিয়ে ঘুরে আসতে পারে তাহলে এই সার্কেলের ব্যবসাই যে আরো ছ’আনা বাড়ানো সম্ভব সেই হিসেব ওই ফাইলেই আছে।

গায়ত্রী রাই জিজ্ঞেস করেছিল, মিস্টার চালিহাকে বলেছ?

—বলেছি। তাঁর মতে এত ছোট কাজে লরি দেওয়া সম্ভব নয়, আর ভ্যান আপনার হেপাজতে।

একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করেছে, কমপ্যারেটিভ চার্টে এই তিন সপ্তাহের মধ্যে তুমি যে বাড়তি বিক্রি দেখিয়েছ, সেই মাল তারা পেল কি করে?

এই প্রশ্নটার জন্যই ভিতরে ভিতরে উৎসুক ছিল বাপী। নির্লিপ্ত মুখে জবাব দিয়েছে, খদ্দেরদের চাহিদা জেনে গুদাম থেকে ছালায় মাল বোঝাই করে সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে নিজেই পৌঁছে দিয়েছি। বিক্রি বাড়বে বোঝার পরে আপনাকে ভ্যানের কথা বলতে এসেছি।

গায়ত্রী রাইয়ের চোখে পলকের বিস্ময় দেখেছিল বাপী। এটুকুই কাম্য ছিল। বি.এস.সি পাশ ভদ্রলোকের ছেলে এই মেহনতের কাজও করতে পারে ভাবেনি

—ভ্যান পাবে। কবে চাই?

—কাল একবার পেলে ভালো হয়, চৌদ্দ দিনের মাথায় আর একবার নেব।

—ঠিক আছে।

এই ঠিক আছের অর্থ সে বিদায় হতে পারে। তার দু’দিন বাদে ঊর্মিলা বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর আবার আপিসে হাজির। আগের দিনের পর সতের দিন বাদে এই দেখা। এই দিনেও অ্যকাউন্টেন্ট আর টাইপিস্টের থাকার মেয়াদ পার করে দিয়ে এসেছে। আগের দিন বেলা এগারটা থেকে সন্ধে পর্যন্ত ভ্যানে মাল চালানোর ধকল গেছে বাপীর। পরদিন ছুটির পর নিরিবিলিতে নিজের ফাইলে লেনদেনের হিসেব লিখে রাখছিল।

ঊর্মিলার পরনে প্রথম বিকেলে দেখা সেই রঙিন ঘাগরা, গায়ে লম্বা সাদা ব্লাউস। যা-ই পরুক, মেয়েটাকে ঝকঝকে দেখায়। কিন্তু সেইদিন মুখখানা বিরস। টেবিলের সামনে এসেই বলে উঠেছিল, মা-কে ঘায়েল করে বেশ খুশি মেজাজে আছ—কেমন?

বাপী ভিতরে উৎসুক, বাইরে অবাক।—কি করেছি? বোসো।

—ভদ্রলোকের ছেলে, সাইকেলে মাল বয়েছ, কাজ দেখিয়ে মন কেড়েছ। অসহিষ্ণু হাতে চেয়ার চেনে বসল।—প্রশংসা শুনে তোমার সম্পর্কে কড়া কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, বলার মতো চট করে কিছু পেলাম না।

বাপী হেসে ফেলেছিল।—আমার ভাগ্য। কিন্তু তোমার রাগের কারণ কি?

—তোমার সঙ্গে আমার ফ্রেন্ডশিপ হবে না—সাফ কথা। আর, আমি পিছনে লাগলে তোমার খুব সুবিধে হবে না তাও জেনে রেখে দিও।

—কি মুশকিল, দোষটা কি করলাম?

—দোষ কি তুমি জানো না? রেশমাকে কি বলেছ?

যত রাগই দেখাক, বাপীর মনে হয়েছিল ওর মায়ের খুশির খবর দিয়ে তাকেও একটু খুশি করার তাগিদ আছে। জবাব দিয়েছে, কেন কি বলেছি তা বোধ হয় জানো না…

—তাও জানি। ওটা পাজির পা-ঝাড়া, তোমাকে আগে তোষামোদের খোঁচা দিয়েছিল নিজেই স্বীকার করেছে। তা বলে তুমি ও রকম করে বলবে? আঙ্কলের কাছে অনেকরকম কাজে গিয়ে থাকতে পারে।

—তা পারে তবে ভদ্রলোক তখন ড্রিঙ্ক করছিলেন, তাঁর ভেতরের ঘরে সবুজ আলো জ্বলছিল, রেশমা সেখানে ছিল।

—তোমাকে আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না, মুখ লাল ঊর্মিলার, আমি নব জানি—আমার কোনো কাজেই যদি ও গিয়ে থাকে আর আঙ্কল যদি শয়তানি করে ওকে ভিতরে ডেকে পাঠায়—ও কি করবে?

বাপীর মজাই লাগছিল। কিন্তু গম্ভীর।…রেশমাকে পাজি বললে, আঙ্কলকে শয়তান বললে আর আমাকে তো কতবার সেয়ানা বলেছ—তোমার চোখে ভালো কে?

—কেউ না। মোট কথা তুমি যা ভেবেছ সব বাজে। খবরদার, মায়ের কাছে এ-সম্বন্ধে একটি কথাও নয়।…রেশমার সাপ ধরা তো নিজের চোখেই দেখেছ, ওই মজুরিতে পোষায় না—অন্যের থেকে ওকে কম দেবার কোনো মানে হয়?

—কোনো মজুরিতেই পোষায় না আর কম দেবারও মানে হয় না। আমার হাত থাকলে তোমাদের এ-ব্যবসা আমি বন্ধ করে দিতাম।…তোমার নাম করে রেশমার মজুরি বাড়ানোর কথাও চালিহা সাহেবকে বলেছিলাম—

—তারপর? এবারে উৎসুক।

—উনি ঠাট্টা করে ফিরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার কোনো ইন্টারেস্ট আছে কিনা। আমি বলেছি নেই।

—হাড়ে হাড়ে শয়তানি। ফিক করে হেসেও ফেলেছিল।—একেবারে নেই বলে দিলে কেন, রেশমা খারাপ কি—এবারে চটে যাবার আগে পর্যন্ত দেখেছি তোমাকে ও খুব পছন্দ করত।

ভেতর-বার এক-রকম নয় বাপীর। ভেতরে আঁচড় পড়েছে। নিজেকে চোখ রাঙিয়েছে। এই মেয়ে এমন প্রগল্ভ হতে পারে অবশ্য ভাবেনি। ফাইলটা সামনে টেনে নিয়ে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করেছে, রেশমার সম্পর্কে তোমার এত আগ্রহ কেন?

জবাব দিতে গিয়ে থমকেছিল একটু। তারপর বলেছে, বাঃ, ওই তো একমাত্র সঙ্গী আমার এখন। তারপরেই ঝাঁঝ দেখিয়েছে,—দেখো, ফ্রেন্ড বলে আমার ওপর মাতব্বরি করতে এসো না—আমার আগ্রহ তাতে তোমার কি?

কিন্তু আর না বসে চটপট চলেও গেছে।

পনের দিন আগে গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সাক্ষাৎ বাপীর। নির্দেশ—মতো দুপুরেই এসেছিল। সঙ্গে সেই ফাইল আর ডায়রি। সেদিনও লক্ষ্য করেছে পাশের জমিতে তার ঘরের তিন ভাগ কাজ সারা।

গায়ত্রী রাই তখন তার এখানকার আপিসঘরে। সেখানেই ডাক পড়েছে। দু’বার ভ্যান পাওয়ার ফলে বিক্রির তুলনামূলক চার্ট দাখিল করেছে বাপী। খদ্দেরের লিস্ট-এ তিনটি নতুন নামও দেখাতে পেরেছে।

ফাইল আর ডায়রির পাতায় চোখ বুলিয়ে গায়ত্রী রাই সে-দুটো আবার তার দিকে ঠেলে দিতে বাপী একটা প্রশ্ন করেছিল আর একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রশ্নটা শুনে কর্ত্রীর সতর্ক চাউনিও লক্ষ্য করেছিল।

এরই মধ্যে মোটামুটি দু’জন বড় পাইকেরি খদ্দের কিছু জিনিস চেয়েছে যা এখানকার গোডাউনে নেই বাপী জানে। কিন্তু তারা সেটা মানতে রাজি নয়, তাই বাপীর প্রশ্ন, এখানকার গোডাউনে যে-সব মাল আছে তাছাড়াও মালিকের হেপাজতে আর কোনো জিনিস আছে কিনা।

শুনেই বাঁকা ঠেকেছে।—কি জিনিস চেয়েছে তারা?

—শুখাসিদ্ধি, আফিম আর মিঠা জহর।

গায়ত্রী রাইয়ের গোল দু চোখ তার মুখের ওপর নড়েচড়ে স্থির আবার এসব আমাদের কাছে থাকতে পারে তাদের ধারণা হল কেন?

—ধারণা নয়, তারা আছেই জানে। তাদের দাবী আগে পেয়েছে এখন কেন পাবে না?

গায়ত্রী রাইয়ের চাউনিতে বিস্ময়ের ছোঁয়া।—কত আগে পেয়েছে?

বাপী নির্লিপ্ত খুব।———কারো নামে কিছু বলতে রুচিতে বাধে, ওদের বক্তব্য শুনলে আপনার নালিশের মতো লাগবে।

ধৈর্য কম মহিলার, কড়া গলায় তাগিদ দিয়েছে, আমি শুনতেই চাই!

—তাঁদের অভিযোগ, ওসব জিনিস মিস্টার চালিহা আগে সেধে দিয়ে এসেছেন, আর তার জন্য তারা ভালো দামও দিয়েছে। কিন্তু চালিহা সাহেব এখন এত বড় হয়ে গেছেন তাঁর আর পাত্তাই নেই, ফলে তারা জিনিসও পাচ্ছে না।

মহিলার ঠাণ্ডা মুখভাবে রকমফের ছিল না খুব। তবু বাপীর ধারণা খবরটা তার কাছে নতুন—আর সেই সব মাল বিক্রির ভালো দামও তার হিসেবে আসে নি।

একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, এ ব্যাপারে আমি পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব। মিস্টার চালিহাকে কিছু বলেছ?

—না।

—বলার দরকার নেই।

এরপর সাপ চালানের ব্যবসা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল বাপী। আবু রব্বানী আর দুলারির সঙ্গে পরামর্শ করে মোটামুটি একটা প্ল্যান ছকেই এনেছিল। সাপ ধরার দল পুষ্ট করে তুলতে হলে, অর্থাৎ প্রতি বছর যারা নিয়মিত এই কাজে আসবে এমন একটা দলকে ক্রমে বড় করে তুলতে হলে তাদের মজুরি বাড়াতে হবে, পাওনা-গণ্ডাও নগদ মিটিয়ে দিতে হবে। চালান যদি চাহিদা অনুযায়ী শতকরা পঁচিশ ভাগও বাড়ানো যায়, তাহলেও বাড়তি খরচ পুষিয়ে লাভ বেশি থাকে। তাছাড়া খরচের প্রশ্ন তুলে দালালদের সঙ্গেও দামের নতুন ফয়সলার চেষ্টা করা যেতে পারে। যে রকম চাহিদা, চাপ দিলে তাদের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই।

এই প্ল্যানও খুঁটিয়ে দেখে গায়ত্রী রাই খুব যে খুশি তা নয়। সাপ পিছু আট আনা এক টাকা বা শঙ্খচূড় অথবা অতিকায় ময়াল পাইথন হলে দশ পনের টাকা বেশি মজুরির প্রস্তাব। এছাড়া দল-গড়া আর পাকা তদারকির জন্য দুলারির নামে আবুর মাইনে পঞ্চাশের জায়গায় একশ টাকা আর তার সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য আরো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একজন লোক রাখা, বাড়তি সাপ রাখার সুব্যবস্থা করার জন্য দুলারির ঘরভাড়া কুড়ি টাকা থেকে তিরিশ টাকায় তোলা— এসব তার তেমন ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হলে বাড়তি খরচ পুষিয়েও যে লাভের অঙ্ক বাড়ে, সেই হিসেব তার চোখের সামনেই। তাছাড়া এর ফলে পাহাড়ের বাংলোয় বিষ বার করার পরিমাণও বাড়বেই। তাতেও মোটা লাভ।

মুখে এতটুকু খুশি বা আশার অভিব্যক্তি নেই। উল্টে মন্তব্য করেছিল, তুমি তো দেখি দানছত্র খুলে বসতে চাও।

বাপী জবাব দিয়েছে, আমি আপাতত যা চেয়েছি সেটা মিনিমাম।

সঙ্গে সঙ্গে কড়া চাউনি মহিলার।—তার মানে এটুকু না হলে তুমি কাজে হাত দেবে না?

—না। আমার অসুবিধে হবে।…হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে কি ভয়ঙ্কর সাহসে বুক বেঁধে ওরা এই কাজ করে, জঙ্গলে ঘুরে সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। ভালো লাভ সত্ত্বেও এটুকুও এদের দিতে না পারলে আমার বিবেকে বাধবে।

নিজে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ওদের কাজ দেখার কথা শুনে মহিলার চোখে বিস্ময়ের ছোঁয়া, কি আবেগের কথা শুনে, বাপী ঠাওর করতে পারে নি। এ প্রসঙ্গও গায়ত্রী রাই সেখানেই শেষ করেছিল। প্ল্যানের খসড়া নিজের কাছে রেখে দিয়ে বলেছিল, ভেবে দেখি। তাছাড়া মিস্টার চালিহার সঙ্গেও পরামর্শ করে দেখতে হবে।

কিন্তু মেজাজের কিছু পরিবর্তন দেখাই গেছে। জিগ্যেস করেছিল, চা খাবে?

বাপী মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল।

তারপরেও অনেকটা নির্লিপ্ত মুখেই গায়ত্রী রাই বলেছে, তোমার ঘর তো প্রায় শেষ…দেখেছ?

মনে মনে এইটুকুও অনুগ্রহ ধরে নিয়েছিল বাপী। কারণও আঁচ করতে পেরেছিল। অখুশি নয় বোঝা গেছে। বাপী মাথা নেড়েছে, দেখে নি।

—ইচ্ছে করলে দেখে যেতে পারো।

—দেখবই তো…তাড়া কি! থ্যাঙ্কস—

পনের দিন বাদে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের এই রবিবার সকালে চা-বাগানের ক্লাবঘর ছেড়ে নতুন বাসায় চলে আসার হুকুম হয়েছে।

বাপী এসেছে।

ভাবছিল কিছু। নিজস্ব ঘর হল বটে, এখন তড়িঘড়ি অনেক কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে। আজকের মধ্যেই একটা খাট কেনা দরকার। বিছানা-পত্রের যা অবস্থা সেগুলো ব্যবহার করতে নিজেরই এখন অরুচি। শৌখিন কর্ত্রীটি বা তার মেয়ে দেখলে নাক সিঁটকোবে। সে-সবও নতুন করতে হবে। বারান্দায় পাতার মতো গোটাতিনেক চেয়ার আর একটা ছোট টেবিল অন্তত চাই। যতটা সম্ভব ছিমছাম ভাবেই থাকতে হবে। পাশাপাশি ঘর তোলার কথা বলেছিল যখন, এই বিড়ম্বনার কথা ভাবেনি। এছাড়া রান্নাবান্নার সরঞ্জাম চাই, চায়ের ব্যবস্থা চাই। টুকিটাকি আরো অনেক কিছু চাই। অনেক দিনের অনভ্যাসের দরুন বাপীর হালছাড়া মনের অবস্থা।

—নিজের ঘর দেখে যে মুগ্ধ একেবারে, কোনোদিকে আর হুঁশ নেই দেখছি!

ঊর্মিলা। বাপী এদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। নিশ্চয় পা টিপে এসেছে, নইলে পায়ে ক্যানভাসের চপ্পল হলেও কাঠের মেঝেতে টের পাবার কথা।

ঘুরে দাঁড়াতে ঊর্মিলা বলল, মা ডাকছে—জলদি!

তাড়া দিল কিন্তু নিজে ঘর ছেড়ে বেরুনোর জন্য ব্যস্ত নয় একটুও। খেদের সুরে বলল, ইউ আর ভেরি লাকি। মা রাজি হলে আমি তোমাকে তার সঙ্গে ও—বাড়ি থাকতে পাঠিয়ে আমি এটা দখল করতাম।

বাপী বলল, চলো তাহলে, তাঁকে সেই প্রস্তাব দিয়ে দেখা যাক্

ঊর্মিলা প্রথমে চোখ পাকালো। তারপর হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না!

—কি হল?

হাসি থামার পরেও লাল মুখ। বলল, যে হারে তুমি মায়ের মন কাড়ছ, তার বয়েস আরো বছর বারো কম হলে বা তোমার বেশি হলে ঠিক একটা লটঘট কাণ্ড হয়ে যেত।

বাপীও হেসেই ফেলল। মেয়েটার মুখে কিছুই আটকায় না দেখছে।

মেহেদি পার্টিশনের মাঝখানে যাতায়াতের গেট-টেট কিছু রাখা হয় নি। আসা—যাওয়ার প্রয়োজনে সামনে দিয়েই ঘুরে আসা ঘুরে যাওয়া।

গায়ত্রী রাই বারান্দার চেয়ারে বসে সোনালি চশমা এঁটে কাগজ পড়ছে। ওরা দু’জন উঠে আসতে কাগজ সরালো, চশমা খুলে খাপে ঢোকালো। গম্ভীর, তবে অপ্রসন্ন নয়। গলার স্বরও মোলায়েম। পছন্দ হয়েছে?

বাপী জবাব দিল এত ভালো আশা করি নি।

—বোসো। এত ভালো এমনি হয় নি, অনেক খরচ পড়েছে। সব হিসেব তুমি পাবে। আর—

বাপীর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েও মায়ের পাশের চেয়ার টেনে বসতে যাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, তাহলে আমি সরে পড়ি—

—বোস্। এখানেই ব্রেকফাস্ট দিতে বলেছি। তাছাড়া এই হিসেবের মধ্যে তোর থাকা দরকার। আর কত দিন আমি একলা সব দিক দেখব?

মেয়ে হালছাড়া মুখেই বসল। কিন্তু তারপর জবাবখানা যা দিল রসিয়ে শোনার মতো। বলল, বরাবর একলাই দেখতে হবে, আমাকে তো বিয়ে দিয়ে চটপট শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর মতলবে আছ।

বাইরে বোঝা না গেলেও মহিলার মেজাজ এই সকালে প্রসন্নই বলতে হবে। বাপীর সামনে এই উক্তির দরুন একটুও রাগ করল না। মেয়ের উদ্দেশে হাল্কা জবাব দিল, সে চিন্তা তোকে করতে হবে না, বিয়ে যে করবে তাকেই এসে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হবে।

মেয়ে ওমনি ফোঁস করে উঠল, আই উইল নেভার এগ্রি—দ্যাট পারসন মাস্ট বি এ ভেড়া-মার্কা সামবডি।

বাপীর দিকে চেয়ে গায়ত্রী রাই বলল, সি ইজ্ ইনকরিজিবল।

মেয়েও তক্ষুনি বাপীর দিকে ফিরে চোখ পাকালো। এ ব্যাপারে মায়ের কথায় সায় দিলে ফ্রেন্ডশিপ ঘুচে যাবে মনে রেখো!

কোয়েলা মস্ত একটা ট্রে এনে টেবিলে রাখল—খোসাসুদ্ধ তিনটে বড় কলা, দুটো ডিশে দুটো করে এপোচ, একথাক টোস্ট, বাটির মাখনে বাটার-নাইফ গোঁজা। দুটো জেলি আর জ্যামের শিশি। একটা বড় কাঁচের বাটিতে কর্নফ্লেক্স, পাশে মিল্ক-পট আর সুগার-পট।

ট্রে থেকে কর্নফ্লেক্স-এর বাটিটা তুলে কোয়েলা কর্ত্রীর সামনে রাখল। বিধবা নেপালিনীদের ডিম বা আমিষ চলে কিনা বাপী জানে না। একটা কলা ছাড়িয়ে কোয়েলা ছুরি দিয়ে চাক চাক করে কেটে কর্নফ্লেক্স-এর ওপর ছড়িয়ে দিল। তারপর দুধ আর চিনির পট বাটির সামনে রেখে চলে গেল।

ঊর্মিলা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনের টোস্টে মাখন মাখাচ্ছে। গায়ত্ৰী রাই কর্নফ্লেক্স-এর বাটিতে পটের দুধটা ঢেলে নিয়ে দু’ চামচ চিনি ছড়িয়ে দিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

আর ঠিক তক্ষুনি বাপীর জিভ এমনি সুড়সুড় করে উঠল যে সংবরণ করাই গেল না। কারো দিকে না চেয়ে খুব সাদামাটা সুরে বলল, ব্রেকফাস্টের ব্যাপার দেখেই মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়িতে যে আসবে সে নিজেই আর নড়তে চাইবে না।

গায়ত্রী রাইয়ের ঠোটের ফাঁকে এবারে চুলের তো একটু হাসির রেখা। শোনার পর মেয়ের দিকে চোখ। কিন্তু টোস্টের ওপর ঊর্মিলার বাটার-নাইফ থেমে গেছে। চকিতে একবার ঘাড় ফিরিয়ে ভিতরের দরজার দিকটা দেখে নিল। তারপর ঝকঝকে দু’ চোখ বাপীর মুখের ওপর।—ওই কোয়েলাকে তোমার পছন্দ হয়?

বাপীর নিরীহ আক্রান্ত মূর্তি। গায়ত্রী রাই বলে উঠল, ও ডলি!

কিন্তু মায়ের অনুশাসনে মেয়ে ভ্রুক্ষেপও করল না। ঝাপটা মেরে বলে গেল, কোয়েলার জন্য মা বর খুঁজছে, পেলে সেও এই বাড়িতেই থেকে যাবে আর ভালো ভালো খেতে পাবে——চাও তো লাগিয়ে দিতে পারি।

বলতে বলতে নিজেই হেসে ফেলে ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। নিরুপায় গায়ত্রী রাইকেও এবার হাসতেই দেখল বাপী। তারপর পলকা ধমক, দিনকে দিন ছেলেমানুষি বাড়ছে তোর ডলি!

খেতে খেতে আবার কাজের কথা, অর্থাৎ সেই হিসেবের কথা। আর এসব কথার সময় স্বভাবতই মহিলা বেশ গম্ভীর।—এ বাড়ি আর তোমার ওই ঘর তোলার জন্য মোট যা খরচ হয়েছে তার সব হিসেব রেডি করে অ্যাকাউন্টেন্ট তোমাকে কপি দেবে। খরচ অনেক হলেও বাড়ি ভাড়ার একশ টাকা থেকে মাসে পঞ্চাশ টাকা করেই কাটা হবে, পঞ্চাশ টাকা হাতে পাবে—ও কে?

এ উদারতার কারণ বুঝতেও বাপীর এক মুহূর্ত সময় লাগল না। দখলের দাবী যত দীর্ঘমেয়াদী হয় ততো তার সুবিধে। বাপী ভালো মুখ করে জবাব দিল, পুরো একশ টাকাই কাটতে পারেন।

—না, পঞ্চাশ টাকাই কাটব—মাইনে তো আপাতত বেশি পাচ্ছ না। ক্লাবে থাকার খরচ চালাতে হবে বলে এতদিন পঞ্চাশ টাকা করে পকেট খরচ পেয়েছ, সেটা বড় জোর এখন দু’শ টাকা হবে। এর সঙ্গে বাড়িভাড়া থেকে কিছু না পেলে তোমার চলবে কি করে।

আগে দু’শ টাকা মাইনে শুনলে আনন্দে ভেতরে সাড়া জাগত। কলকাতার লোয়ার ডিভিশন চাকরির মাইনে ছিল সর্বসাকুল্যে আটাত্তর টাকা। কিন্তু এখন কিছুই খুব অপ্রত্যাশিত না। বাপী জানেই এও সবে শুরু। শেষ নয়

চুপচাপ খাওয়া শেষ করে মহিলা বাটিটা পাশে সরিয়ে রাখল। অল্প একটু জল খেল। ভাবছে কিছু। খাট বেডিং টেবিল চেয়ার সবই তো কিনতে হবে তোমাকে?

টোস্ট আর পোচে বাপীর মুখ আটকানো। মাথা নাড়ল, হবে।

—অ্যাডভান্স কত দরকার?

মুখের পদার্থ জঠরস্থ করে বাপী জবাব দিল, মোটামুটি গুছিয়ে নেবার মতো কিছু টাকা হাতে আছে।

এ পাশ থেকে ঊর্মিলা ফস করে বলে বসল, আহা মায়ের কান জুড়িয়ে গেল!

মহিলা এবারে চোখেই ধমকালো মেয়েকে। বাইরের লোকের সামনে এরকম করাটা যে বাড়াবাড়ি তাই বুঝিয়ে দিল। কিন্তু মেয়ের ভ্রুক্ষেপ নেই, অন্যদিকে চেয়ে জেলি রুটি চিবুচ্ছে। ফাঁক পেলেই মেয়ে যে তার মাকে ঠেস দিতে ছাড়ে না, এ বাপী আগেও লক্ষ্য করেছে।

গায়ত্রী রাই জিজ্ঞাসা করল, এখানে তোমার খাওয়া-দাওয়ার কি ব্যবস্থা হবে?

পরিবর্তন ভালোই দেখছে বাপী। ক’দিন আগেও মহিলা ঝাঁঝিয়ে বলেছিল, কাজের বাইরে তোমার সঙ্গে আর সম্পর্ক কি আমার?

জবাব দেবার আগে চায়ের ট্রে হাতে রঙ্গমঞ্চে আবার কোয়েলা। সেটা টেবিলে রেখে আগের ট্রেতে ডিশটিশ সব তুলে নিয়ে গেল। বাপীর দিকে চেয়ে ঊর্মিলা অস্ফুট শব্দ করে হেসে উঠল। অর্থাৎ আবারও মনে করিয়ে দিল, ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা সহজেই হতে পারে।

মেয়ের প্রগল্ভতায় মহিলা এবারে যথার্থ বিরক্ত। তার দিক থেকে বাপীর দিকে চোখ ফেরালো। টেবিল থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে বাপী বলল, কিছু ভাববেন না, আমি ব্যবস্থা করে নেব।

কাগজের দিকে তাকালে এখনো কলকাতার খবরই আগে চোখ টানে। মাঝের এক জায়গায় একটা হেডিংয়ের ওপর দৃষ্টি আটকে গেল। কলকাতার প্লেগ। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি। গায়ত্রী রাই কি বলছে, তার মেয়ে কি করছে কিছুই তার খেয়াল নেই বাপীর। খবরটুকু পড়ে ফেলল। মধ্য কলকাতার কোনো এলাকা থেকে এ পর্যন্ত এগারোজন লোককে প্লেগ রোগাক্রান্ত সন্দেহে হাসপাতালে সরানো হয়েছে। তার মধ্যে তিনজন মারা গেছে। কলকাতা করপোরেশন তাই ওই এলাকাকে প্লেগ এরিয়া বলে ঘোষণা করেছে।

যুদ্ধের সময় বা কলকাতায় বোমা পড়ার সময় ওখানকার যে কোনো খবরের ফাঁক দিয়ে দুনিয়ার সকলকে ছেড়ে একটি মেয়েই তার চোখের সামনে এগিয়ে আসত। আজও তাই। প্লেগ কি, প্লেগ কেমন, বাপীর কোনো ধারণা নেই। শুধু জানে মারাত্মক কিছু, একটা শহরকে শহর উজাড় হয়ে যাবার মতোই কিছু। তবু, যে মেয়ের বাড়ি মধ্য কলকাতার ধারে-কাছেও নয়, দক্ষিণের এক রাস্তার সাতাশি নম্বর বাড়ির সেই মেয়েকেই যেন বিপন্ন দেখার অনুভূতি একটা। এ চিন্তা নিছক পাগলামি জানে। তবু বুকের তলায় কাঁপুনি কিছুক্ষণের—কোনো অঘটনের মধ্য দিয়ে ওপরঅলার হাত কি সব কিছু হঠাৎ মুছে দিয়ে যাবে? যার পর আর কিছু না—কিচ্ছু না?

আত্মস্থ হল। শুধু গায়ত্রী রাই নয়, তার মেয়েও ঈষৎ বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। এই মিনিট কতক তারা কি দেখেছে কি লক্ষ্য করেছে, জানে না।

গায়ত্রী রাই জিগ্যেস করল, কাগজে অত মন দিয়ে কি দেখছিলে আর তারপর কি ভাবছিলে?

মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে কাগজের প্লেগের খবরটা দেখালো। গায়ত্ৰী রাই আরো অবাক।— কলকাতায় তোমার কে আছে?

বাপী চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।—কেউ না। অনেক কাজ আছে, সেরে ফেলিগে।

কাজ কাজ আর কাজ। কাজের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকলে মুক্তি, কাজে ডুবে থাকলে স্বস্তি। ঊর্মিলা যখন তখন এসে ঘরে ঢুকে পড়ে। কখনো হাসে, কখনো রাগ করে, কখনো বা অকারণ ঠেস-ঠিসারায় বিদ্ধ করতে চায়। বাপী তন্ন তন্ন করে নিজের ভেতর দেখে তখন। কোনো-পাতালে প্রবৃত্তিই সেই পশু আজও লুকিয়ে আছেই। লোভের সন্ধান পেলে এখনো ওটা থাবা চাটবে। সেই থাবা বাপীর দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দেওয়ার আক্রোশ। ঊর্মিলার এই সহজ নিঃসঙ্কোচ যাতায়াত ভালো লাগে বলেই বাপী সেটা চায় না।

…রেশমা রাগ ভুলেছে। দেখা হলে মুচকি হাসে। দেখা হলে খুশি হয়ে এগিয়ে আসতে পারে। কথা বলতে পারে। সাপ চালানোর ব্যাপারে বাপীর নতুন বন্দোবস্তের প্ল্যান ওদের মেমসায়েব সবটাই মেনে নিয়েছে। এই ব্যবসায় সেই এখন মুরুব্বি ওদের। পুরুষদের সঙ্গে ওর মজুরি সমান হয়েছে। আবুর হিসেব মতো কাগজে সই করে দিলেই একদিনের মধ্যে অ্যাকাউন্টেন্টের কাছ থেকে নগদ টাকা মেলে। অবশ্য চালান যে হারে বাড়ছে, অ্যাকাউন্টেন্টের হিসেবে খাতায় তার সবটা উঠছে না। এ ব্যাপারে কর্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ। এ নিয়ে মাথা না ঘামালেও বাপীর নিজস্ব একটা পাকা হিসেব আছে। রেশমার রাগ ভোলার আর খুশি থাকার আরো কারণ আছে। তদারকি আর দল বাড়ানোর কাজে আবু রব্বানীর সহকারিণী হিসেবে মাসে বাড়তি পঞ্চাশ টাকা সে-ই পাচ্ছে। আবু ওকেই বাছাই করেছে। আবু দুলারির সামনেই এক চোখ ছোট করে রসিকতা করেছে, রেশমাকে অ্যাসিন্ট্যান্ট পেয়ে কাজের উৎসাহ আমার চারগুণ বেড়ে গেছে— বুঝলে বাপীভাই।

জবাবে হেসে হেসে রেশমা দুলারিকে আশ্বাস দিয়েছে, তুমি ভেবো না ভাবী, আমার সাপের টুটি চেপে ধরা আবু-সাহেব স্বচক্ষে দেখেছে। তারপর বাপীকেই জিগ্যেস করেছে, আমাদের এতবড় মুরুব্বিকে এখনো বাপীভাই বলো না সায়েব—টায়েব বলতে হবে?

বাপী জবাব দিয়েছে, আগে যা বলতে তাই বলবে।

…এই মেয়েরও চটক আছে। চোখের কালোয় আগুন আছে। হেলে দুলে চলে যখন সেই যৌবন-ঢেউয়ের আমন্ত্রণ আছে। নিজের অগোচরে হঠাৎ-হঠাৎ ভালো লাগে বলেই রেশমাকেও কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না।

আবু রব্বানী আর দুলারির খুশির সংসার বলতে গেলে রোজই ওকে আশা করে। একে ভালোবাসে, তায় বাপীর জন্যেই দু’জনারই আয় বেড়েছে। এছাড়া জঙ্গলের নানা জায়গায় মালকানের দরকারী চারা বেড় করা বা দরকারী গাছ—গাছড়া চাষের বাবদ ন্যায্য পারিশ্রমিক যে পাবে—সে সম্বন্ধেও নিশ্চিন্ত। ফলে দু’দিন দেখা না পেলে আবু মুখ ভার করে। আর দুলারি ঘরের লোককে দাবড়ানি দেবার ছলে ওকে কথা শোনায়।—বাপী ভাই এখন কত বড় মানুষ আর কত কাজের মানুষ—তোমার সঙ্গে রোজ এসে আড্ডা দেবার অত সময় কোথায়?

কিন্তু ওদের এই সুখের সংসারে দেখেও ভালো লাগে আর ভিতরে ভিতরে কিন্তু প্রত্যাশা উঁকিঝুঁকি দেয় বলেই বাপী এদেরও এড়াতে চায়। কোনো ভালো লাগার সঙ্গে তার আপোস নেই।

তাই কাজে ডুবে যাওয়া, কাজে ভেসে যাওয়া, আর কাজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। ফলে খুশি যার সব থেকে বেশি হবার কথা সে তো খুশি বটেই। গায়ত্রী রাই। তার গাম্ভীর্য অটুট এখনো। কিন্তু আচরণ বদলেছে। স্টোভে নিজে রান্না করে খায় বাপী। খাওয়ার ফিরিস্তিও মেয়ের কাছে শুনেছে। বাপীর সামনেই সেদিন বলেছিল, ভাতের সঙ্গে সমস্ত রকমের আনাজ সেদ্ধ আর তেল আর নুন আর কাঁচালঙ্কা—তোমার কাজের ছেলে খাসা খানা খেয়ে কাজে ডুবে আছে।

গায়ত্রী রাইকে তাই শুনে ভাবতে দেখেছে। শেষে প্রস্তাব দিয়েছে, মাসে যা হয় ধরে দিও—তোমার দু’বেলার খাবারটা এখান থেকেই যাবে না হয়।

হেসে উঠে ঊর্মিলা বলেছিল, কোয়েলার সম্পর্কে এখনো ভেবে দেখো ফ্রেন্ড—মাসে আর তাহলে কিছু ধরে দিতেও হবে না।

একলা পেলে আর আগের চরিত্রগত মেজাজে থাকলে বাপী জবাব দিতে ছাড়ত না। রসিকতা করে বলে বসত, কোয়েলার বদলে তার মনিবের মেয়ের সম্পর্কে ভাবতে রাজি আছি। ওই জবাব মাথায় এসেছিল বলেই বাপী নিজের ওপর অসহিষ্ণু। এক কথায় মহিলার প্রস্তাব নাকচ করেছে। বলেছে, আপনি আমাকে কাজে এগিয়ে যেতে দিন শুধু, আর কিছু দেখার দরকার নেই।

তা সত্ত্বেও প্রতি রবিবার, অন্য ছুটির দিনের সকালে ওই বাংলো থেকে চায়ের আসরে তার ডাক পড়বেই। দু’ দিন তিন দিন পরে পরে কোয়েলা রান্না-করা মাছমাংসও দিয়ে যাবে। বাপী প্রথম দিনেই বলেছিল, আর এ-রকম কষ্ট করার দরকার নেই—আমার এই খেতেই ভালো লাগে। তা সত্ত্বেও কোয়েলা এটা-ওটা নিয়ে আসে মানেই কর্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করতে পারে না।

গায়ত্রী রাই তার হিসেবমতোই ধীরেসুস্থে কাজে এগিয়ে দিচ্ছে তাকে। মাসে দু’দিন করে ভ্যান ছেড়ে দেওয়ার ফলে স্থানীয় এলাকার গণ্ডী আরো বড় হয়েছে। আর, মোটামুটি বড় এবং বিশ্বস্ত পাইকারি খদ্দেররা গোপনে যা চায়, তাও তার মারফৎ পাচ্ছে। কর্ত্রীর নির্দেশে কোয়েলা মাপা শুখা সিদ্ধি, আফিম, মিঠা জহর ইত্যাদি ঘর থেকেই বার করে দেয়। এ-সব কোথা থেকে আসে, বা কে কখন চালান দেয় বাপী এখনো সে খোঁজ রাখে না। এ-সব বিক্রীর হিসেব যে অ্যাকাউন্টের খাতায় উঠবে না, তাও বলে দিতে হয় নি। এই টাকা গায়ত্রী রাইয়ের হাতেই তুলে দেয়।

তিন মাসের মাথায় গায়ত্রী রাই নিজেই ওকে সঙ্গে করে উত্তর বাংলার নানা জায়গায় বড় বড় পার্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আমাদের রিজিওন্যাল ম্যানেজার। এবার থেকে যোগাযোগ আর সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা তার মারফৎ হবে।

কোন্ রিজিয়নের ম্যানেজার তা নিয়ে বাপী নিজেও মাথা ঘামায়নি। কাজের পরিধি ঢের বেশি বাড়ল, আরো বেশি কাজে ডোবার সুযোগ মিলল, তার এটুকুই লাভ। এই দায়িত্ব পাওয়ার ফলে চিফ একজিকিউটিভ রণজিৎ চালিহাকে সন্দিগ্ধ দেখবে বা অসন্তুষ্ট দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু আদৌ তা না। ওই লোকের সঙ্গে মহিলার হৃদ্যতা আগের থেকে বেশি ছাড়া কম নয়। হয়তো তাকে জানিয়েই সব কিছু করা হচ্ছে।

পরে উত্তর বাংলার দু’জন বেশ বড় খদ্দেরের আচরণে বাপী ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ। আবার একটু অবাকও। বার দুই যোগাযোগের পরে আভাসে ইঙ্গিতে কিছু ব্যক্তিগত লাভের টোপ ফেলতে চেয়েছে ওই দু’জন। মাল সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে কেউ টের পাবে না এমন সামান্য কিছু কারসাজির পথে চললে বাপী তরফদারের নিজের পকেটে অনায়াসে বেশ বাড়তি টাকা আসতে পারে আর তাদেরও কিছু লাভ হয়, তোয়াজের ছলে সেই আভাস, সেই ইঙ্গিত।

বাপী বিরক্ত হয়ে সেই পথ নাকচ করতে তারা আরো অমায়িক। তক্ষুনি সৎ মানুষের সঙ্গে তাদের সৎ ভাবেই কাজ করার প্রতিশ্রুতি। মিস্টার তরফদার যেন কাউকে কিছু না বলেন বা নিজে কিছু মনে না করেন। বাপীর অবাকও লেগেছে, কারণ দীর্ঘকাল ধরে যে মহিলার সঙ্গে ব্যবসায়ে যুক্ত, তাদেরও এ-রকম মতি হয় কি করে! গায়ত্রী রাই সঙ্গে করে যখন নিয়ে এসেছিল, বাপী নিজের চোখেই এদের যত্ন-আত্তি দেখেছে, তোয়াজ তোষামোদ দেখেছে, সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা কইতে দেখেছে। যত ভেবেছে এদের এই ব্যাপারটা কেমন হেঁয়ালির মতো লেগেছে।…রণজিৎ চালিহার সঙ্গে কি এই গোছের ব্যবস্থা কিছু ছিল? নইলে মাত্র দু’বার যোগাযোগের পরেই এরা এমন কথা বলে কি করে?…চালিহা অনেক দিনের লোক। বাপী ক’দিনের? ভালো করে জানা চেনা বোঝার আগেই এত বেপরোয়া?

কি ভেবে গায়ত্রী রাইকে সত্যিই কিছু বলেনি বাপী। রণজিৎ চালিহাকে বলার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু শিলিগুড়ি আর মালদহের এই দুই পাইকিরি রইস খদ্দেরের টোপ ফেলার চেষ্টাটা মনে গেঁথেই থাকল।

.

কখনো সপ্তাহে কখনো পনের দিনে একবার গায়ত্রী রাইকে মেয়েসহ ভ্যানে করে দু’তিন দিনের জন্য বাইরে যেতে দেখে বাপী। কোথায় চলল বা ক’দিনের জন্য চলল, ওকে অন্তত কিছু বলে যায় না। পরে মেয়ের মুখে শুনেছে, ভুটানে পাহাড়ের বাংলোয় যায় তারা। বাপীর ধারণা, বনজ নেশার জিনিস বা গোপন জিনিস যা আসে, ওখান থেকেই আসে। বোতলের জিনিস, অর্থাৎ মদ কিভাবে আসে সে-সম্বন্ধে এখনো সুস্পষ্ট কিছু ধারণা নেই। শুখা সিদ্ধি আফিম ইত্যাদি কোয়েলার মারফৎ এই বাংলো থেকেই বেরুতে দেখেছে বাপী। তাও কাছাকাছির ছোট চালানের সময়। বড় চালান হয়তো ওই পাহাড়ের বাংলো থেকেই সরাসরি চলে যায়। আর মদের পেটি সরাসরি চালিহার হেপাজতে গিয়ে পৌঁছয়। গত ছ’মাসে বাপীর ওপর গায়ত্রী রাইয়ের বিশ্বাস আর নির্ভরতা বেড়েছে এটুকু বুঝতে পারে। কিন্তু ওই সব মাল সম্পর্কে কোনো কথাবার্তা হয় না। এ-দিকটা এখন পর্যন্ত তার এক্তিয়ারের বাইরে। আবু রব্বানীর মুখে কিছু শোনা আছে। জিগ্যেস করলে হয়তো আরো জানা যেতে পারে, বোঝা যেতে পারে। জিগ্যেস করে না। বাপী নিজের কাজ নিয়ে আছে। আর চুপচাপ দেখেও যাচ্ছে।

ঊর্মিলা বলে, তার পাহাড়ে যেতে একটুও ভালো লাগে না। মা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়।

—কেন, ওটা তো দেশ তোমাদের।

—কে বলল? ওটা মায়ের দেশ, আমার বাবা নেপালের মানুষ ছিল।

মায়ের ওপর মেয়ের রাগ কত এই জবাব থেকেই বোঝা যায়। মায়ের কিছুই মেয়ে ভালো চোখে দেখতে রাজি নয়।

ঘরে আলো জ্বলছে দেখে সেদিনও ঊর্মিলা হাজির। গোমড়া মুখ। দিনে বাপীর টিকি দেখা মেলে না। তাই আড্ডা দেবার মেজাজ হলে আর ঘরে আলো দেখলে রাতেই আসে। ওর মা নাকি গোড়ায় গোড়ায় এটা পছন্দ করত না। কিন্তু মেয়ে তার ভ্রুকুটি বা নিষেধ উপেক্ষা করেই চলে আসত। একদিন বেশি বকা—বকি করতে ও মুখের ওপর বলে দিয়েছে, নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার কোনো হাতের মুঠোর ছেলের প্রেমে কস্মিনকালেও আমি পড়ব না—আর ওই ত্যাঁদড় ছেলেও নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার মুখ ছেড়ে আমার মুখের দিকে কখনো তাকাবে না।

সেই থেকে রাতে এখানে আসা নিয়ে মা আর কিছু বলে না। মেয়েটার আসা—যাওয়া যেমন সহজ, তেমনি অকপট। মনের মতো কথা না হলেও ঝগড়াও শুরু হয়ে যায়। তখন যা মুখে আসে তাই বলে বসে। বেশি রেগে গেলে বলে, আমার সঙ্গে লাগতে এসো না, মা-কে তেল দাওগে যাও—সুবিধে হবে।

বাপীর একটুও রাগ হয় না। কিন্তু এই মেয়ে এলে তার মায়ের কারণে হোক বা নিজেকে সংযমে বাধার তাড়নায় হোক, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। একজনের প্রেমে মজে না থাকলে এই মেয়েই হয়তো আবার তাকে কোনো বিপাকের দিকে টেনে নিয়ে যেত। মা-কে জব্দ করার আক্রোশেও কখন কি মতি হয় ঠিক নেই। মায়ের ওপর মেয়ের এত রাগ এত বিতৃষ্ণা দেখেই বাপীর বিশ্বাস, আবুর অনুমান সত্য। এই মেয়ের প্রথম প্রেমের স্রোতে একটুও ভাটা পড়ে নি।

খাটে আধ-শোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিল। রাতে ঘুমের আগে পর্যন্ত এখানে বই সম্বল। পড়ার অভ্যেস আগেও ছিল। ভালো-মন্দ ধর্ম-অধর্ম, হাতের কাছে যা পায়, নির্লিপ্ত মনোযোগে পড়ে ফেলে। চা-বাগানের লাইব্রেরি থেকে বই আনে। সময় কাটানোর তাগিদে ঊর্মিলারও বইয়ের স্টক কম নয়। সে-ও দেয়।

বই বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল বাপী। মুখ দেখে বুঝে নিল মেজাজ সুবিধের নয়। রাতে বাইরের বেতের চেয়ার তিনটে ঘরে এনে রাখা হয়। তার একটা খাটের সামনে টেনে নিয়ে ঊর্মিলা বসল।

—কাল থেকে আমি কাজ শুরু করছি, আমার জন্য তোমাদের ওই আপিসে একটা ঘর ঠিক করবে। কালই চাই

বাপী চুপচাপ চেয়ে আছে। তাতেই অসহিষ্ণু।—এই সাদা কথাও তোমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?

—কি কাজ?

—ব্যবসার কাজ—আবার কি কাজ? এইভাবে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে দিন কাটবে আমার?

ফল কি হবে জেনেও খুব মোলায়েম সুরে বাপী বলল, দিন যাতে ভালো কাটে সে-চেষ্টা তোমার মা হয়তো তলায় তলায় করছেন।

গরম তেলে ফোড়ন পড়ল।—তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে কে বলেছে? মা ইচ্ছে করলেই আমার নাকে দড়ি পরিয়ে ঘোরাতে পারবে ভেবেছ? তোমাকে যা বলছি তুমি তা করবে কি না?

—কি করে করব, আপিসে ঘর তো মাত্র তিনখানা।

ঊর্মিলার মেজাজ আরো তপ্ত।—আমি কোন কথা শুনতে চাই না! তোমার নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে ওই অ্যাকাউন্টেন্টের ঘরে বোসোগে যাও। তুমি কি ভেবেছ আমি তোমার সঙ্গে ইয়ারকি করতে এসেছি?

—তা না, বাপীর নরম মুখ, ইচ্ছে করলে তুমি তো তোমার আঙ্কলের ঘরেই বসতে পারো—তিনি তো সকালে এক-দেড় ঘণ্টার বেশি থাকেন না। ওটাই সব থেকে ভালো ঘর—

অপছন্দ হল না। বলল, এখনকার মতো তাই হতে পারে। ঠাণ্ডা একটু গলার স্বরও অন্যরকম।—একটু আগে মায়ের সঙ্গে আমার একহাত হয়ে গেল। মা তোমাকে ডেকে পাঠাতে পারে।

বাপী ফাঁপরে পড়ল।—সে কি তোমাদের হাতাহাতির মধ্যে আমি কে?

—আঃ! শুনেই ভীতুর মত অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? শোনো—মা কাল সকালে দু’তিন দিনের জন্য পাহাড়ে যাচ্ছে, আমি সঙ্গে যেতে রাজি নই—তাই নিয়ে ঝগড়া। আমি মা-কে বলেছি, তোমার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে কাল থেকে তোমাদের আপিসে আমি কাজে বসব, তাই আমার যাওয়া হবে না। মা তোমাকে ডেকে জিগ্যেস করলে তুমি বলবে কথা হয়েছে।

দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বাপী বলল, দুটো তিনটে দিনের জন্য তুমি যেতে রাজিই বা হচ্ছ না কেন?

সঙ্গে সঙ্গে রাগ। কেন যাব? কি আছে সেখানে?

—এখানে কি আছে?

—এখানে কি আছে সে কৈফিয়ৎ তোমাকে দিতে হবে?

ঠাণ্ডা মুখে বাপী জবাব দিল, আমাকে না জড়ালে কিছুই দিতে হবে না। আরো তেতে উঠতে গিয়েও ঊর্মিলা থমকে দরজার দিকে তাকালো। বারান্দার পায়ের শব্দ। মুখ লাল তক্ষুণি।

ঘরে ঢুকল গায়ত্রী রাই। বাপী এখানে আসার পর এই প্রথম পদার্পণ। বরাবরকার মতোই নির্লিপ্ত গম্ভীর! একটু কঠিনও। বাপী শশব্যস্তে উঠে চেয়ার এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল, বাধা পড়ল।

—বসতে আসি নি। খরখরে চাউনি।—ডলির সঙ্গে কাজ নিয়ে তোমার কি পাকা কথা হয়েছে শুনলাম?

মেয়ে তক্ষুনি ঝাপটা মেরে উঠল, কথা ও বলেনি, আমি বলেছি!

—আমি ওকে জিগ্যেস করছি।

ঊর্মিলার গলার ঝাঁঝ আরো বাড়ল

—আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে?

কেন তুমি মাইনে-করা লোককে

মহিলার দু-চোখ মেয়ের মুখের ওপর স্থির একটু।—মাইনে-করা লোককে তুই এ-সময়ে কি বলতে এসেছিস?

—আমি আমার ঘর ঠিক করার কথা বলতে এসেছি।

—সেটা মাইনে-করা লোক ঠিক করবে না আমি ঠিক করব?

মেয়ে গুম। বাপী নির্বাক দ্রষ্টা এবং শ্রোতা। গায়ত্রী রাই তার দিকে তাকালো।—ডলির কাজ শুরু করতে দুটো-তিনটে দিন দেরি হলে খুব ক্ষতি হবে?

ঊর্মিলার চোখ এড়িয়ে কলের দিকে মুখ করে বাপী জবাব দিল, না ক্ষতি আর কি…ঘুরে এসে শুরু করলেই হল।

চেয়ারটা জোরে ঠেলে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল ঊর্মিলা। তারপর বাপীর মুখের ওপর একপশলা আগুন ছড়িয়ে দুপদাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

গায়ত্রী রাই তেমনি গম্ভীর। কিন্তু ঠোঁটের ফাঁকে চুল-চেরা হাসির আঁচড়। বাপীর বিপাকে পড়া মূর্তি দেখে চোখেই যেন আশ্বাস দিয়ে গেল একটু। তারপর সেও ধীরেসুস্থে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

হাতে কাজ না থাকলে এখনো নিজের মনে জঙ্গলেই ঘোরে বাপী। নিজেদের দরকারের গাছ লতাপাতা চিনতে চেষ্টা করে। ফাঁকা জায়গা দেখলে কোন্ জিনিসের চাষ হতে পারে আবুর সঙ্গে সেই পরামর্শ করার কথা ভাবে। গাছ—গাছড়া লতাপাতা চেনার প্রস্তুতির তাগিদে কর্ত্রীকে একটা প্রস্তাব দেবার কথা অনেকদিন ভেবেছে। দিন-কতকের জন্য একবার গায়ত্রী রাইয়ের পাহাড়ের বাংলোয় গিয়ে থাকার ইচ্ছে। আবুর মুখে শুনেছিল, সেখানে তার স্বর্গত স্বামী বীরেশ্বর রাইয়ের এ-সম্পর্কে অনেক বইপত্র আছে। সে-সব পড়ার ইচ্ছে তারপর সেখান থেকে ঝগড়ুকে নিয়ে পাহাড়ী জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে নিজের চোখে সেগুলো দেখা আর চেনার ইচ্ছে। বীরেশ্বর রাই তাই করত শুনেছে।

কিন্তু বলি-বলি করেও এখন পর্যন্ত বলে উঠতে পারে নি। মহিলা কি সন্দেহ করবে ভেবে দ্বিধা। এবারে পাহাড় থেকে ফিরে এলে বলবে ভাবছে। নিজের প্রয়োজনেই বাপীর ওপর বিশ্বাস তাকে রাখতে হবে।

জঙ্গলের এদিক-ওদিকে এক এক জোড়া বেদে-বেদেনীকে দেখেছে। এক মনে সাপ খুঁজছে তারা। আবার শীত এসে গেল। আর দু’ চার দিনের মধ্যে ওদের এ কাজের পাট এ বছরের মতো শেষ হবে।

আপন মনে বাপী, জঙ্গলের নিরিবিলি দিকটা ধরে এগোচ্ছিল। ওই লোকগুলোর কাছে সে এখন মস্ত মানুষ। ওদের ব্যস্ত করার ইচ্ছে নেই। একটু বাদেই দাঁড়িয়ে পড়তে হল। অদূরের জারুল গাছটার নিচে পাথর মূর্তি মুখখানা খুব চেনা। রেশমার সাপ ধরার সঙ্গী হারমা। একলা দাঁড়িয়ে। সামনের দিকে চেয়ে নিবিষ্ট চিত্তে দেখছে কিছু। তার সামনে মাটিতে সাপ ধরার সরঞ্জাম।

বাপী পায়ে পায়ে সেদিকে এগলো। কিন্তু লোকটা এত তন্ময় যে একেবারে কাছে আসার আগে টেরই পেল না।

—কি ব্যাপার, একলা যে?

হকচকিয়ে গিয়ে লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। তারপরেই কপালে হাত তুলে সেলাম। রেশমার কাছেই শুনে থাকবে সে তাদের কর্তাব্যক্তি।

বাপী জিগ্যেস করল, রেশমা কোথায়?

মুখে জবাব না দিয়ে আঙুল তুলে অদূরের কটা অর্জুন আর শিশু গাছ দেখিয়ে দিল। অদূরে বলতে তিরিশ-চল্লিশ গজ দূরে। সেদিকে তাকাতে বাপীর দু’ চোখ হোঁচট খেল একপ্রস্থ। দুটো গাছের ফাঁকে সাপ ধরার পোশাকে রেশমাকে আধাআধি দেখা যাচ্ছে। আর স্পষ্ট দেখা গেল ওর সামনে যে দাঁড়িয়ে—তাকে। চকচকে কোট প্যান্ট শার্ট টাই পরা চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটি সুশ্রী ছেলে। রেশমার কথা শুনছে আর হাসিমুখে মাথা নাড়ছে।

—হি রেশমা!

কর্তামানুষ খোঁজ করল বলে হোক বা ওই নিরিবিলি আলাপে বিঘ্ন ঘটানোর সুযোগ পেয়ে হোক, গমগমে গলায় হারমা ডেকে বসল। সঙ্গে সঙ্গে গাছের আধখানা আড়াল ছেড়ে রেশমা এদিকে ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গের চকচকে লোকটিও। রেশমা তাকে বলল কিছু, আর চট করে হাতের কিছু একটা জিনিস নিজের বুকের আঁট জামা ফাঁক করে ঢুকিয়ে দিল।

লোকটা বড় বড় পা ফেলে অন্য দিক দিয়ে চলে যাচ্ছে। ঢিমেতালে রেশমা এদিকে আসছে। তার পরনে আগের দিনের মতোই সাপ ধরার পোশাক। যে পোশাকে ওর মতো মেয়ের যৌবন কুলোয় না।

—বাপীভাই, কি হুকুম?

—কিছু না। ওকে একলা দেখে তোমার কথা জিগ্যেস করতে ও ডেকেই বসল।

রেশমার চোখেও পলকা ভ্রুকুটি। হারমাকে বলল, সেয়ানা হয়ে উঠছিস— অ্যাঁ? হাসি চেপে আর গলা খাটো করে বাপীকে বলল, কারো সঙ্গে আমাকে দু’দণ্ড কথা কইতে দেখলে ওর জ্বালাপোড়া শুরু হয়।

—ভদ্রলোক কে?

—ওই যার সঙ্গে কথা বলছিলাম?…কে জানে, গাছের ইজারাদার-টার হতে পারে, জঙ্গলের কোনো কাজ ধরার মতলবে আছে বোধ হয়—আমি আবু সাহেবকে দেখিয়ে দিলাম।

যা বলল, বিশ্বাস করার মতো নয় নিজেই বুঝল হয়তো। চোখেমুখে এক ঝলক হাসি উছলে গেল—ছুতো ধরে আমাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে দুটো কথা বলার লোভ বুঝতেই তো পারছ। হারমার দিকে ফিরে তাড়া দিল, চল্‌ চল্‌ আজ আর কিছু জুটলে হয়—

ওদের ছেড়ে বাপী পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। মুখে ভাববিকার নেই। চোখে হাসির আমেজ। গাছগাছড়ার দিকে আর মন নেই। ভাবছে কিছু।

ওরা দু’জন আড়াল হতে বাপী ফিরল। এ সময়ে আবু রব্বানী চন্দ্রার চারা বেডের কাছাকাছি থাকে। জঙ্গলের হাঁটাপথে সেখানে চলে এলো। চারা বেডের পরিধি আগে যা দেখে গেছল তার থেকে অনেকটা বেড়েছে। অবসর সময়ে আবুর এখন কাজের উৎসাহ খুব। অন্যদের সঙ্গে নিজেও খুরপি হাতে মাটি নিড়োচ্ছে।

ওকে দেখে হাসি মুখে খুরপি ফেলে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে কাছে এলো।—কেমন, খাসা হবে না?

কি-রকম হবে বাপীর খুব ধারণা নেই। তবু সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।

আবু খুশি মুখেই বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা। বলল, সবই হল বাপীভাই, কেবল তোমার সঙ্গে দু’দণ্ড বসে মনের কথা বলার সময় কমে গেল। সমস্ত দিন তোমার কাজ। আর সন্ধের পরেই বই নিয়ে ঘরে সেঁধিয়ে থাকো—

—তুমি গেলেই পারো।

কথার ফাঁকে ওকে সঙ্গে করে বাপী চারা বেডের কাছ থেকে খানিকটা সরে এসে দাঁড়িয়েছে।

—সন্ধের পরে তোমার ঘরে?…যেতে তো ইচ্ছে করেই। কিন্তু তুমি আমাদের মুরুব্বি এখন, নাকের ডগায় তোমার সঙ্গে মাখামাখি করতে দেখলে মেমসায়েবের পছন্দ হবে না।

এ ব্যাপারে আবুর বিবেচনা আছে। জানলে কর্ত্রীটি হয়তো বাপীকেই ঠেস দিয়ে কিছু শোনাবে। কিন্তু এই আবুর জন্যেই জীবনের আর এক বৃত্তে পা ফেলা সম্ভব হয়েছে। বাপী সেটা ভুলবে কি করে?

—তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না, যখন ইচ্ছে হবে চলে যাবে। যাক, ঊর্মিলা রাইয়ের সেই মিরিকের এনজিনিয়ার ছেলেটার নাম যেন কি বলেছিলে—বিজয় মেহেরা?

এই প্রসঙ্গান্তরের জন্য আবু প্রস্তুত ছিল না। প্রথমে অবাক একটু, তারপর উৎসুক।—হ্যাঁ, কেন?

—দেখতে কেমন বলো দেখি?

আবু বলল।

বাপীর সংশয় খুব আগেও ছিল না। শোনার পর একেবারেই থাকল না। আবুর দু’-চোখ কৌতূহলে টুপুটুপু।—কেন, তুমি তাকে দেখেছ নাকি?

—বোধ হয়।

—কবে? কোথায়?

—এদিকেই।

এদিকে বলতে কোন্ দিকে, স্পষ্ট বোঝার কথা নয়। বুঝলও না।—সেই মেয়ে তো তার মায়ের সঙ্গে পাহাড়ে গেছল, ফিরেছে নাকি? কার সঙ্গে দেখলে?

বাপীর এখন জবাব এড়ানোর দায়। বলল, ঊর্মিলার সঙ্গে নয়, আমার দেখে মনে হল। তোমার মেমসায়েব আর মিসি সায়েব আজ সকাল পর্যন্ত ফেরেনি, এখন ফিরে থাকতে পারে। দেখিগে যাই—

ফিরে থাকলেও ওর দেখার কিছু নেই, ছুতো ধরে আবুর কাছ থেকে সরে এলো। আপিস থেকে সাইকেলটা নিয়ে ঘরের দিকেই চলল। বিকেল তখন প্রায় চারটে। কিন্তু এখন আর বাপীর ঘড়ি ধরা আপিস নয়। দু’দিন পেরিয়ে আজ তিনদিন। ওই মা-মেয়েকে আজ হয়তো বাংলোয় দেখা যাবে।

মেয়েকে নয়, মাকে দেখা গেল। কিন্তু সাইকেল না থামিয়ে বাপী সোজা নিজের আঙিনায় ফটকে এসে নামল।

দশ মিনিটের মধ্যে মালী এসে মেমসায়েবের সেলাম জানালো। আরো মিনিট পনের বাদে বাপী হাজির

মিষ্টি কথা মহিলা চেষ্টা করলেও বলতে পারে কিনা সন্দেহ। বারান্দায় উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখেও সোজা চলে গেলে কেন?

—সাইকেলটা রেখে মুখ-হাত ধুয়ে আসব ভাবছিলাম। খিদে পেয়েছিল, কিছু খেয়েও এলাম।

—বোসো। কি খেলে?

এরকম প্রশ্ন আর কি কখনো কোন কর্মচারীকে করেছে! বাপী হাসল, পাঁউরুটি মাখন। চা খেয়ে আসতে গেলে আরো দেরি হবে বলে সাহস পেলাম না।

—যা বলার সোজাসুজি বলবে। দরজার দিকে ঘুরে তাকালো।—কোয়েলা! বিপুলাকায়া দোরগোড়ায় দেখা দিতে হুকুম হল, এক পেয়ালা চা।

বাপী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদেরও ও-পাট শেষ বুঝি?

মাথা নাড়ল কি নাড়ল না।—এদিকের খবর কিছু আছে?

—সে-রকম কিছু না, ছোটখাটো কটা অর্ডার আছে।

তার সাড়া পেয়েই হয়তো ঊর্মিলা রাই একটা চকচকে নতুন বই হাতে পিছনের দরজায় এসে দাঁড়াল। ফর্সা মুখ মেজাজের মেঘে ছাওয়া। বাইরে বসে পড়ার দরকার বোধেই যেন গম্ভীর মুখে বারান্দায় এসে একটা বেতের চেয়ার হাত পাঁচেক দূরে টেনে নিয়ে বসল।

এই মুখ দেখে বাপী আরো একটু তাতিয়ে দেবার লোভ সামলাতে পারল না। ভালো মুখ করে জিগ্যেস করল; পাহাড়ে বেড়ানো কেমন হল?

ঊর্মিলার হাতের বই কোলে নেমে এলো। আর ভিতরের আঁচ চোখে এসে জমতে লাগল। ঝাঁঝালো গলা।—ইয়ারকি পেয়েছ?

বাপীর ভেবাচাকা খাওয়া নিরীহ মুখ। তার মায়ের দিকে ফিরল সে, এমন গরম হাওয়ার কারণ বুঝছে না যেন।

গায়ত্রী রাইয়ের ঠোটের ফাঁকে খুব সূক্ষ্ম হাসির রেখা। কোয়েলা এক পেয়ালা চা এনে বাপীর সামনে রেখে গেল।

—শোনো, যে জন্যে ডেকেছিলাম। গায়ত্রী রাই একটু বেশী গম্ভীর হঠাৎ।— গত জুলাইয়ের মিডল-এ তোমার তো ছ’মাসের ট্রায়েল পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে?

এটা সেপ্টেম্বরের শেষের দিক। মুখের চা-টুকু তল করে বাপী জবাব দিল, শেষ হয়েছে কিনা আপনার বিবেচনা…

—এঃ! সঙ্গে সঙ্গে ও-পাশ থেকে মেয়ের ঠেস।—ভিজে বেড়াল একখানা!

সময়বিশেষে গায়ত্রী রাইও মেয়েকে ঘাঁটায় না হয়তো, তার দিকে তাকালোই না। বাপীর মুখের ওপর চোখ রেখে বলল, এ মাস থেকে পাকা খাতায় নাম উঠবে তোমার আর জুলাই থেকে রেট্রোসপেকটিভ এফেকট-এ তিনশ টাকা করে পাবে তুমি। মিস্টার চালিহাকে জিগ্যেস করেছিলাম, তিনি তাই সাজেস্ট করেছেন।

এখনো চালিহার দেয়াল মাঝখান থেকে সরাতে রাজি নয় মহিলা বোঝা গেল। মুখে কিছু বললে তার মেয়ে পাছে আবার ফোড়ন কাটে সেই ভয়ে বাপী চোখের ভাষাতেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।

গায়ত্রী রাই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।—তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার স‍ই করে রেখেছি, দিয়ে দিচ্ছি—

ভিতরে চলে গেল। সেই ফাঁকে বাপী আস্তে আস্তে তার মেয়ের দিকে চোখ ফেরালো। ঊর্মিলা তার দিকেই চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই চাপা ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, সুখবর পেয়ে মুখখানা যে আরো ওয়েট ক্যাটের মতো হয়ে গেল। এক্ষুনি ছুটে গিয়ে এক ভাঁড় তেল কিনে ঘরে মজুত রাখো!

মেয়েকে পাহাড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মায়ের কথায় সায় দিয়েছিল বলেই এই রাগ। মুখখানা খুব নির্লিপ্ত করে বাপী বলল, আমার ঘরে এলে সুখবর আমিও কিছু দিতে পারি।

গম্ভীর, কিন্তু চোখের তারা উৎসুক। বাপীর নির্বিকার মুখ আবার সামনের দিকে। একটা ফাইল হাতে গায়ত্রী রাই ফিরে এসেছে।

চেয়ারে বসল। ফাইল খুলল। বাপী তার আগেই দেখে নিয়েছে বড় হরফের টাইপে ফাইলের ওপর বাপী তরফদার নামের লেবেল। বাপীর মনে হল তার পোশাকী নাম বিপুলনারায়ণ তরফদার হারিয়েই গেল;চার মাস আগে মহিলার সঙ্গে বাড়ির যে কনট্রাকট্ হয়েছিল তাতেও বাপী তরফদারই ছিল, আর সেও বিনা আপত্তিতে তাই সই করেছিল। রাই অ্যান্ড রাই লেটার হেডে টাইপ-করা আর সই—করা একটা চিঠি তার দিকে বাড়িয়ে দিল। কর্তার আমলে স্বামী-স্ত্রী নামে ব্যবসা চালু ছিল। এখনো ওই নামই আছে। অর্থাৎ মা আর মেয়ে মালিক। পকেটে রাখার উদ্দেশ্যে বাপী চিঠিটা ভাঁজ করতে যাচ্ছিল, বিরক্তির সুরে বাধা পড়ল।

—পড়ে নাও!

পড়ল। মুখে যা বলেছিল তাই। তার সঙ্গে আরো কিছু যোগ করা আছে। রিজিয়ন্যাল ম্যানেজার হিসেবে তাকে বহাল করা হল। কোন্ রিজিয়ন এতেও তার উল্লেখ নেই। মাসমাইনে থোক তিনশ। বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টের ব্যাপারে ফার্মের ব্যবসা আর তার কর্মপটুতা বিবেচনাসাপেক্ষ। বাইরে টুরের প্রয়োজনে যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়ার খরচ দেওয়া হবে। এক মাসের নোটিসে অথবা একমাসের ক্ষতি-পূরণে মালিক কর্মচ্যুতি ঘটাতে পারে। কাজে ইস্তফা দেওয়ারও একই শর্ত।

চিঠিতে চারদিন আগের তারিখ। অর্থাৎ পাহাড়ের বাংলোয় যাবার আগেই ব্যবস্থা পাকা করে রেখে গেছল।

—ঠিক আছে?

বাপী মাথা নেড়ে সায় দিল।

ফাইলসুদ্ধ ওই চিঠির কপিটা তার দিকে এগিয়ে দিল।— রিসিভড্ দি ওরিজিন্যাল লিখে সই করে দাও, আজকের তারিখ দিলেই হবে।

পাকা কাজ। পকেট থেকে কলম বার করে বাপী লিখল। সই করল। গায়ত্রী রাইয়ের দু’-চোখ সেই থেকে তার মুখের ওপর অনড়। সই করা হতে ফাইলটা টেনে নিয়ে বন্ধ করে পাশে সরিয়ে রাখল। তখনো মুখের দিকে চেয়ে নতুন করে কি দেখছে মহিলা বাপী ঠাওর করতে পারল না।

—শীত আসছে, তুমি কি এই পাজামা পাঞ্জাবি পরেই কাটিয়ে দেবে নাকি? বাপী জবাব দিল, গরম জামা আছে, গরম চাদরও আছে।

—ট্রাউজার বা কোট?

—ওসব কখনও পরিনি।

—এখন থেকে পরো। বড় বড় পার্টির সঙ্গে দেখা করতে হবে, ডিল করতে হবে—ইউ আর রিপ্রেজেনটিং এ বিগ ফার্ম। গোড়াতে কিছু আউটফিট্ অ্যালাউয়েন্স গ্র্যান্ট করে দিচ্ছি, যা করার করে নাও।

এতক্ষণে বাপী অনুভব করল মাঝের চালিহা-দেওয়াল কিছুটা সরেছে। দ্বিধাগ্রস্ত মুখে হেসে বলল, এই পোশাকটা বেশ ট্রেডমার্ক হয়ে গেছল…

অনেক দেখা, তবু এই বেশবাস আর এক দফা খুঁটিয়ে দেখে নিল মহিলা। তারপর মন্তব্য করল, ট্রেডমার্ক হয় নি এমন অনেক জায়গায় এরপর তোমাকে যেতে হবে।

—ঠিক আছে। প্রসঙ্গ বাতিল করে মনে যা আছে বলে ফেলার এটাই সময়।—আপাতত দিন কতকের জন্য আমি এখান থেকে ডুব দিচ্ছি।

শোনামাত্র তার সাদাটে দুই ভুরু কুঁচকে গেল। অন্য দিকে কথা আর শেষ হয় না দেখে তার মেয়েও হয়তো বিরক্ত হচ্ছিল। যে মুখ করে বাপী সুখবর দেবার কথা বলেছিল, ওই মেয়ের পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা সহজ নয়। ডুব দেবার কথা শুনে পড়ার ভান ছেড়ে সেও বই নামালো।

প্রস্তাব বাতিল করার মতোই রুক্ষ স্বরে গায়ত্রী রাই জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

—প্রথমে আপনার ভুটান পাহাড়ের বাংলোয়, তারপর পাহাড়ে আর জঙ্গলে। এই জবাব মা বা মেয়ে কেউ আশা করে নি। মহিলার গোল চোখ তার মুখের ওপর স্থির।

বাপী বলল, আবুর মুখে শুনেছি, আপনার পাহাড়ের বাংলোয় মিস্টার রাইয়ের পাহাড় আর জঙ্গলের দরকারি গাছগাছড়া লতাপাতা ফলমূলের ভালো ভালো বই আছে। সেগুলো আগে পড়ে নিতে চাই। তারপর ওইসব গাছগাছড়া লতাপাতা বীজদানা খুব ভালো চেনে এমন একজন লোক যদি সেখানে পাই, তাহলে নিজের চোখে সব দেখা আর বোঝার অভিজ্ঞতা হয়। যে কাজ আমরা করছি তার গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত একজনের অন্তত সব চেনা আর জানা দরকার। বইপত্র ঘাঁটলে আর নিজে যাচাই-বাছাই করতে পারলে ফিল্ড বাড়ানোও সম্ভব। আর, এ অভিজ্ঞতার সব থেকে বেশি দরকার বোধ হয় কাজটাকে ভালবাসার জন্যে।

একসঙ্গে এতগুলো কথা বাপী কমই বলেছে। মহিলার অপলক চাউনি। সাদাটে মুখে লালের আভা। এই প্রথম ওই মুখে বুকের তলার কোনো অনুভূতির প্রতিক্রিয়া দেখল বাপী। তার ধারণা, স্বামীর বইপত্র পড়া, দুষ্প্রাপ্য জিনিসের খোঁজে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘোরা, সব চেনা-জানা-বোঝার তাগিদে আহার-নিদ্ৰা ভুলে বনবাদাড় চষে বেড়ানো ইত্যাদি স্মৃতির কোনো নিঃশব্দ আলোড়ন চলেছে ভিতরে। অনুমান খুব ভুল নয় সেটা একটু বাদেই বোঝা গেল।

গায়ত্রী রাই বলল, বই আছে। সব চেনে জানে এমন লোকও আছে। তুমি কবে যেতে চাও।

—কালও যেতে পারি। এখানকার কাজ মোটামুটি সেরে রেখেছি, তাছাড়া মিস্টার চালিহাও কিছুদিনের মধ্যে টুরে যাচ্ছেন না শুনেছি।

চুপচাপ ভাবল একটু।—কাল হবে না, পরশু সকালে রেডি থেকো।

ওদিক থেকে তার মেয়ে আঁতকে উঠল।—আমি এখন আর এক পা-ও এখান থেকে নড়ছি না বলে দিলাম।

ভিতরে কিছুটা নাড়াচাড়া পড়েছে বলেই হয়তো মেয়ের পলকা দিকটা বেশি চোখে পড়েছে মহিলার। তার দিকে চেয়ে রুষ্ট-গম্ভীর জবাব দিল, তোকে যেতে হবে না! ওকে রেখে আমি দু’ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।

কথা শেষ। বাপী চলে এলো। অনুমতি পেলে আবুকে সঙ্গে করে পাহাড়ের বাংলোয় যাবে ভেবে রেখেছিল—দিন দুই ওকে সেখানে ধরে রেখে ঝগড়ুর সঙ্গে ভাবসাব করে নেবে। কিন্তু তার থেকে এ অনেক ভালো হল। কর্ত্রী নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে।

বাপী এতটা আশা করে নি।

.

নিজের আঙিনার ফটক খুলে ভিতরে পা দিয়েই বাপী অবাক একেবারে। উঠোনে মেহেদী গাছের পার্টিশন ঘেঁষে আবু রব্বানী দাঁড়িয়ে। ওকে দেখামাত্র কেন যেন বাপীর মনে হল, গাছ ফাঁক করে ও-দিকের বাংলোর দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। ওকে উঠতে দেখে ফিরেছে। নইলে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে যাবে কেন।

—কি ব্যাপার?

আবু রব্বানী একটা আঙুল মুখে তুলল। অর্থাৎ অত জোরে কথা নয়। বাপী আরো অবাক, কারণ আবুর মুখে সত্যি উৎকণ্ঠার ছাপ। আজই দুপুরে যখন খুশি ওকে বাংলোয় আসতে বলেছিল বাপী। কিন্তু সেই আমন্ত্রণে আসে নি দেখেই বুঝছে। আর দিনের আলোয় সদর দিয়ে অর্থাৎ ওদের মেমসায়েবের নাকের ডগা দিয়ে আসে নি, বলাই বাহুল্য। জংলা পথ ভেঙে পিছন দিক দিয়ে এসেছে। এত লুকোচুরি করে আসার তাগিদ কেন বা আবুর হঠাৎ এমন শুকনো মুখ কেন বাপী ভেবে পেল না।

আবু গলা খাটো করে জিগ্যেস করল, তুমি মেমসায়েবের সঙ্গে কথা কইছিলে বাপীভাই, না তার মেয়ের সঙ্গে?

—দুজনার সঙ্গেই। কেন?

এই জবাবে আবু নিশ্চিন্ত একটু। তবু আমতা আমতা করে আবার জিগ্যেস করলো, রেশমার সম্পর্কে কোন কথা হয় নি তাহলে?

ভিতরে কৌতূহলের আঁচড় পড়ল এবারে। বাইরে অবাক।— রেশমার সম্পর্কে কি কথা হবে?

—যাক, আবু হাসিমুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল একটা, আমি তো দুলারিকে কতবার বললাম, বাপীভাই যা-ই জানুক বুঝুক ফস করে মেমসায়েবকে কিছু বলে বসে থাকার মতো কাঁচা ছেলে নয়। তবু ভয়ে ভাবনায় জোর করেই আমাকে ঠেলে পাঠালো।…তুমি একবারটি চলো না আমার ওখানে, দুলারি বার বার বলে দিয়েছিল, রেশমাও সেখানে আছে—

বাপী মাথা নাড়ল।—এখন যেতে পারছি না, তোমাদের মেমসায়েবের মেয়ে এক্ষুনি আসবে।

আবু ব্যস্ত হয়ে উঠল, তাহলে আমি চলি, তুমি পরে না-হয় এসো—

বাপী মিথ্যে বলেনি। ঊর্মিলাকে সুখবর দেবার টোপ ফেলে এসেছে। যে কোন মুহূর্তে এসে হাজির হতে পারে। আবুর সঙ্গে সে-ও বেরিয়ে এলো। তারপর বাড়ির পিছনে এসে ওকে দাঁড় করালো।—কি ব্যাপার খোলাখুলি বলো তো?

আবু হাসতেই চেষ্টা করল, কিন্তু ভিতরের উদ্বেগটুকু গোপন থাকল না।— কি আর বলব, তোমার কতদিকে কটা করে চোখ আর কান, আর মগজে কি যে আছে ভেবে তাজ্জব বনে যাই।

কথাগুলোর মধ্যে কৃত্রিমতা নেই। বাপী হাসল।—আচ্ছা, এবার বলো।

আবু যা বলবে এতক্ষণে সেটা মোটামুটি আঁচ করা গেছল। অনেকটা তাই। আজ একটা মাত্র নির্বিষ সাপ ধরে দুলারিকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল রেশমা। হয়তো ঘরে ফেরার তাড়া ছিল। তাই আগে চলে এসেছে। আবুকে পেয়ে কথায় কথায় বলেছিল, বাপীভাই আজ আপিসে না বসে জঙ্গল দেখে বেড়াচ্ছিল, তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আবু জানিয়েছে দেখা তার সঙ্গেও হয়েছে। আর বাপীভাই চলে যাবার পর সারাক্ষণ যে-কথাটা মাথায় ঘুরছিল তাও বলেছে। মেমসায়েবের মেয়ের প্রেমের ব্যাপারটা তিনজনেই জানে, নিজেদের মধ্যে মাঝে—মাঝে কথা হয় তা নিয়ে। দুলারির সামনেই আবু রেশমাকে বলেছে, তোর মেমদিদিকে বলে দিস তার প্রেমিকটিকে যেন একটু সাবধান করে দেয়— বাপীভাইয়ের কাছে ধরা পড়েছে তাই রক্ষে, মেমসায়েব বা তার ম্যানেজারের কাছে ধরা পড়লে খেল খতম হয়ে যাবে।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে রেশমার ছাইবর্ণ মুখ একেবারে! হাঁসফাস করে জিগ্যেস করল, বাপীভাইয়ের কাছে কবে ধরা পড়ল? কি করে ধরা পড়ল?

আবু বা দুলারি তখনো কিছু বুঝতে পারে নি। আবুর সঙ্গে বাপীভাইয়ের কি কথা হয়েছে শোনার পর রেশমা বলেছে, বাপীভাই জঙ্গলে আজ ওর সঙ্গেই বিজয় মেহেরাকে কথা কইতে দেখেছে।

শুনে আবু আর দুলারির মাথায় বজ্রাঘাত। মেমসায়েব জানতে পারলে রেশমার তো হয়েই গেল, ওদেরও গিলে খাবে। সাত-পাঁচ না ভেবে বাপীভাই যদি কথায় বলে ফেলে সেই ভয়েই আবু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছে।

বাপী হাসছে।—তোমারও এত ভয়!

আঁতে লাগল।—ভয়ের নিকুচি করেছে। শুনলে মেমসায়েব আমাকেও নিমকহারাম ভাববে, বুঝলে?

—বুঝলাম। ঊর্মিলার সঙ্গে বিজয় মেহেরার যোগাযোগটা রেশমার যোগসাজসে চলেছে এ তুমি আগে বোঝোনি?

—আল্লার কসম বাপীভাই। আমার সত্যি বকরির মাথা হয়েছে আজকাল, রেশমার এত বুকের পাটা আমি ভাবতেও পারি নি, কিন্তু তোমার কি বিজয় মেহেরাকে ওর সঙ্গে দেখার আগেও সন্দেহ হয়েছিল নাকি?

বাপী হেসেই জবাব দিল, অমন ডাকসাইটে মেমসায়েবের মেয়ের সঙ্গে জঙ্গলের সাপ-ধরা মেয়ের এত গলায় গলায় ভাব খুব সাদা চোখে দেখার মতো কি? ওর মজুরি বাড়ানোর জন্য ঊর্মিলাই সব থেকে বেশি তাগিদ দিয়েছিল।.. যাক, এখন রেশমা কি বলে?

—কি আর বলবে। ঘাবড়েছে ঠিকই কিন্তু মচকাবার মেয়ে নয়। দুলারি বকাঝকা করতে ফোঁস করে উঠেছে, জানলে মেমসায়েব মাথা কাটবে নাকি— না-হয় আগের মতো কষ্ট করে দিন কাটবে—তার বেশি কি হবে? তোমার কাছে ধরা পড়েছে বলে এখন তোমার ওপরেই বেশি রাগ।

হাতঘড়িতে সময় দেখল বাপী। পাঁচটা বাজে। বলল, ঠিক আছে, তুমি চলে যাও—

—তুমি পরে আসছ?

—না। গিয়ে রেশমাকে তার ঘরে পাঠিয়ে দাও। তার মেমদিদি শিগগিরই ওর খোঁজে যাবে।

আবু ভেবাচাকা খেয়ে গেল।—কেন বাপীভাই?

—জানি না। মনে হচ্ছে। বেশি কথা বলার সময় নেই, তুমি তাড়াতাড়ি যাও। বাপী নিজেই তাড়াতাড়ি চলে এলো। ফটকের কাছে বা বারান্দায় কেউ নেই। ঊর্মিলার এত ধৈর্য আশা করে নি। ধীরেসুস্থে বারান্দাতেই চেয়ার টেনে বসল।

তার দু’ মিনিটের মধ্যে ঊর্মিলা বাঁশের ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে ওখান থেকেই দেখে নিল একদফা। তারপর গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকল। বাপীর মনে হল, না এসে পারা গেল না বলেই অমন অসহিষ্ণু হাবভাব।

বারান্দায় ওঠার আগেই তপ্ত প্রশ্ন।—ঘরদোর খোলা রেখে কোথায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলে? আনন্দ বুঝি আর ধরে না?

এরই মধ্যে এসে ফিরে গেছে তাহলে। জিগ্যেস করল, আনন্দ কেন?

মুখোমুখি বসল। তেতেই আছে। গলার স্বরে বক্রাভাস। চাকরি পাকা হল, আর আঙ্কল চালিহারও বারোটা বাজতে খুব দেরি নেই বোঝা গেল—আনন্দ হবে না?

—তোমার দুঃখ হচ্ছে?

—নাঃ, তোমার কেরামতি দেখে হাততালি দিতে ইচ্ছে করছে! কি বলবে বলো—

বাপীর অবাক মুখ।—কি বলব?

—দেখো, চালাকি কোরো না। সুখবর দেবে বলে তুমি আসতে বলোনি?

—ও…! মনে পড়ল যেন। হাসছে অল্প অল্প।—তুমি কি সুখবর আশা করেছিলে?

—তোমার মতো ধড়িবাজকে বিশ্বাস কি যে আশা করতে যাব?

—তাহলে এলে কেন?

—তুমি বলবে, না চলে যাব?

—বলব। বাপী গম্ভীর।—চিঠি এসেছে। নিজের হাতে দিয়ে গেছে। রেশমার সঙ্গে দেখা হলে পাবে।

মাথার ওপর আচমকা ঘা পড়ার মতো মুখ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল খানিক। তারপর শরীরের রক্তকণাগুলো সব মুখের দিকে ধাওয়া করল। চেয়ার ছেড়ে ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বেলা ছোট হয়ে আসছে। বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে বাপীর দু’-কান সজাগ। পাশের বাংলো থেকে ভ্যানটা বেরুলো।

তারপর থেকে বাপী অপেক্ষা করছে। বড় রকমের কিছু বোঝাপড়া করার তাগিদে ঊর্মিলা রাই আজই আবার আসবে। আসবেই। বাপীর নিজের বুকের তলার একটা দিক ঝাঁঝরা। কারো প্রেম-ভীতির ব্যাপারে নাক গলানোর ইচ্ছে ছিল না—এখনো নেই। গায়ত্রী রাইকে যতটা চিনেছে, এই মেয়ে সহায় হলেই ভাগ্যের দরজা খুলে যাবে ভাবে না। কিন্তু মেয়ে এরপর সহায় না হোক শত্রুতা অন্তত করবে না। অস্ত্র হাতে নিয়ে শুধু এটুকু আপোসের দিকেই এগোনোর ইচ্ছে বাপীর।

বাপী বই নিয়ে শুয়ে ছিল। এক পাতাও পড়ছিল না! ঝড়ের জন্য প্রস্তুত। তারপর রামধনু দেখার জন্যও।

ঘণ্টা দেড়েক বাদে ঊর্মিলা রাই এলো। তপতপে লাল মুখ। চাউনিতে রাগ ভয় অবিশ্বাস।

বই হাতে বাপী হাসি মুখে উঠে বসল। জিগ্যেস করল, খুব সুখবর কি না? —খুব। খাতির পাবার জন্য রেশমাই বলেছে ভেবে আমি তার টুটি চেপে ধরতে গেছলাম। পরে বুঝলাম সে নয়। তাহলে আবু রব্বানী বোধ হয়?

বাপীর হাবাগোবা মুখ।—আবুকে নিজের গোপন কথা তুমি বলেছিলে নাকি! সামনের চেয়ারটা পা দিয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঊর্মিলা ঝলসে উঠল।— কে বলেছে তাও আমার বুঝতে বাকি নেই—মদের নেশায় ঝগড়ু তাকে বলেছে—দস্তি বার করছি আমি, ওদের কারো গায়ে আর ছাল-চামড়া থাকবে না তুমি জেনে রেখো!

খুব নির্লিপ্ত গলায় বাপী বলল, ঝগড়ুকে আমি এখন পর্যন্ত দেখি নি। ওদের দু’জনের কারো গায়ে আঁচড় পড়লে সেটা আমার গায়েও এসে লাগবে।

প্রকারান্তরে সতর্ক করার ইঙ্গিতটুকু স্পষ্ট। অর্থাৎ আঁচড় পড়ার কারণ জানলে মা ওদের ওপর অবিচার করা দূরে থাক, উল্টে আগলে রাখবে। খাঁচায় পোরা বাঘিনীর মুখ। ফাঁক পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকেই ফালা ফালা করার আক্রোশ। বাপী আবার বলল, আমারই ভুল হয়েছে, তুমি ফ্রেন্ড বলেছিলে সেটাই সত্যি ভেবেছিলাম। সত্যিকারের বন্ধু দরকার অদরকারে পাশে থাকে, তুমি তা চাও না বুঝিনি। উল্টে আশা করেছিলাম গোপনতা ফাঁস হয়ে গেছে দেখলে তোমার আমার সম্পর্কটা আরো সহজ হবে, সুবিধেরও হতে পারে…।

ওই মুখে রং বদলের সুন্দর একটু কারুকার্য দেখল বাপী। যা শুনল তার অর্থ না বোঝার মতো বোকা নয় এই মেয়ে। তবু এতটা বিশ্বাস করবে কি করবে না সেই সংশয়। দেখছে আর বিশ্বাসের দিকেই ঝুঁকছে। কাছে এসে পাশ ঘেঁষে খাটের ওপর বসে পড়ল। দু’-হাতে বাপী দু’-গাল ধরে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে উঠল, তুমি কক্ষনো কোনো কারণে মাকে কিছু বলছ না, কিচ্ছু জানতে দিচ্ছ না—ঠিক? ঠিক?

—তুমি বাধ্য না করলে এরকম আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।

গাল ছেড়ে খপ করে দু’-হাতে মাথার চুলের মুঠি ধরে দু’বার ঝাঁকিয়ে দিল, মুখে খুশির জেল্লা।—তুমি একটা স্কাউনড্রেল, তুমি একটা শয়তান

—কান জুড়লো।

—দরকার পড়লে তুমি আমাকে সাহায্যও করবে। করবে না?

চুলের মুঠি এখনো ওর হাতে ধরা, গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে আছে, ওর গরম নিঃশ্বাস নাকে মুখে লাগছে। বাপী অস্বস্তি বোধ করছে।—ছাড়ো, তুমি কি চুলের ঝুঁটি ধরে কথা আদায় করবে নাকি?

—আগে বলো, সাহায্য করবে?

—নিজেকে নিরাপদ রেখে যতটা সম্ভব।

হেসে আবারও গোটা দুই ঝাঁকুনি।…সত্যিকারের বন্ধু নিজের কথা ভাবে? ইউ আর মাই ফ্রেন্ড এ জেম অফ এ ফ্রেন্ড! আনন্দের আবেগে এবারে মাথাটা টেনে বাপীর গালের সঙ্গে নিজের গাল ঘষে দিল। তারপর ছেড়ে দিয়ে হাসতে লাগল। বাপী গম্ভীর। সরে বোসো। বিজয় মেহেরা কেমন লোক আমি জানি না। কিন্তু আমি একেবারে ঢেঁাড়া জাতের নই, এতটা প্রশ্রয় সহ্য হবে না।

উঠে চট করে সামনের চেয়ারে বসল। চোখে কোপ, মুখে হাসি।—তুমি একটা হাড় পাজি আমি গোড়া থেকে জানি। নইলে মা এ-ভাবে ঘায়েল হয়— আজ তো একেবারে ট্রাম্প কার্ড ছেড়ে দিয়ে এসেছ!

প্রেমের আবেগে এই মেয়ে কতটা ডুবে আছে বাপী সেটা সহজেই আঁচ করেছে। বিজয় মেহেরার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গলায় দড়ি দিতে হলে দেবে, তবু আর কাউকে বিয়ে করবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাপীর সঙ্গে এবার তার আলাপ করিয়ে দেবে। বাপীরও ভালো না লেগে পারে না।

তেমনি রাগ আঙ্কল চালিহার ওপর। বিজয় মেহেরার সম্পর্কে মায়ের মেজাজ সে-ই আরো বিগড়ে দিয়েছে। কি তার মতলব কে জানে। বাবা মারা যাবার পর মাকে বিয়ে করে সব হাত করার আশায় ছিল। আর দায়ে পড়ে মা—

ও তখন যেভাবে প্রশ্রয় দিয়েছিল ওই লোককে, ঊর্মিলা ধরেই নিয়েছিল বউকে ডিভোর্স করে আঙ্কল সব-কিছুর ওপর দখল নিয়ে বসল বলে। তখন দু’জনের একজনকেও দেখতে পারত না ঊর্মিলা। কিন্তু মা কত ঝানু সেটা পরে বুঝেছে। এদিক থেকে মায়ের ওপর আর রাগ নেই মেয়ের, রাগ অন্য কারণে। নিজেকে ছাড়া আর সক্কলকে বোকা ভাবে মা। তার ধারণা, মেয়ে বাজে লোকের খপ্পরে পড়ে সর্বনাশ ডেকে আনছে। মেয়ের মতিগতি দেখে বিজয় মেহেরা সম্পর্কে আঙ্কলকে খবর নিতে বলেছে। আঙ্কল তার সম্পর্কে যাচ্ছেতাই রিপোর্ট করেছে। মিরিকের এক পার্টিতে তাকে দেদার মদ খেতে দেখেছে বলেছে। বিজয় ঊর্মিলার কাছে সত্যি কথাই বলেছে। অল্প-স্বল্প মদ খেয়েছিল সত্যি কথাই। একলা থাকে, কিছু ভালো না লাগলে একটু-আধটু খায়ও। তাও ছেড়ে দেবে কথা দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে মায়ের আবার আঙ্কলের কথাতেই ধ্রুব বিশ্বাস। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে কম ঝগড়া করে নি ঊর্মিলা। বলেছে, বাবা তো এন্তার মদ খেত—কিন্তু বাবা কি খারাপ লোক ছিল?

—বয়েস আর বারো-চৌদ্দ বছর কম হলেও ওই আঙ্কল মাকে ছেড়ে আমাকেই বিয়ে করার জন্য উঠে-পড়ে লাগত—বুঝলে? এখনো নিজের তাঁবের লোকের কাঁধে আমাকে ঝোলানোর মতলবে মা-কে ফুসলে বেড়াচ্ছে, খুব ভালো ভালো ছেলের খবর দিচ্ছে। ভালো না হাতি—এবারও মা জোর-জার করে আমাকে পাহাড়ে ধরে নিয়ে গেছল তার খবরের এক ছেলেকে দেখার জন্য। মায়েরই পছন্দ হয় নি বলে বাঁচোয়া।

এবারে আর একটা গোপন খবর ফাঁস করল ঊর্মিলা। বিজয় মেহেরার সঙ্গে তার যে যোগাযোগ আছে এটা বাপীর মতো আঙ্কলও জেনে ফেলেছে। পাহাড়ের রাস্তায় এই বানারজুলির জঙ্গল থেকেই দু’জনকে একসঙ্গে দেখে জিপ থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেছল। সে প্রায় আট মাস আগের কথা। কলে পড়ে তাকে খুশি করার জন্য ঊর্মিলা রেশমার মারফৎ তাকে এক বোতল ভালো মদ পাঠিয়ে দিয়েছিল। যে-রাতে বাপী আঙ্কলের মন পাবার জন্য তার বাড়ি গেছল, সেই রাতে। বাপী টের পেয়ে ওর সম্পর্কে যা-তা ভেবেছে, কিন্তু মেমদিদিকে রেশমা দারুণ ভালবাসে—তাই গেছে। আঙ্কল যদি টের পেত এ-ব্যাপারে রেশমার সঙ্গেও যোগসাজশ আছে, মওকা পেয়ে সে তাহলে ভিতরের ঘর ছেড়ে রেশমাকে বিছানাতেই টেনে নিয়ে যেত—এমন চরিত্র তার। জেরার জবাবে রেশমা শুধু বলেছে, কাগজের বাক্সটা মেমদিদি তার কাছে পৌঁছে দিতে হুকুম করেছে তাই নিয়ে এসেছে, আর কিচ্ছু জানে না। ভালো মদের বোতল ভেট দেবার অর্থ আঙ্কল ঠিকই বুঝেছে। মাকে এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি অবশ্য, কিন্তু সেই থেকে ঊর্মিলার ওপরেও তার একটু সর্দারি বেড়েছে। ফাঁক পেলে ভালো মুখ করে বিজয় মেহেরাকে বাতিল করার উপদেশ দেয়, আর মায়ের প্রতি তার নিজের কর্তব্যের কথা বলে ওকে হাতের মুঠোয় রাখতে চায়। আবার ওদের দু’জনকে হাতেনাতে ধরার জন্যে ওত পেতে আছে। রেশমাকে ধরে জেরা করে, শাসায়। ঊর্মিলার তাই নিজের জন্যে চিন্তা, রেশমার জন্যেও চিন্তা। এ অবস্থায় ফ্রেন্ড অর্থাৎ বাপীই একমাত্র সহায় তার।

বুকের তলার চেনা যন্ত্রণাটা থেকে থেকে মোচড় দিয়ে ওঠে। এর নাম ঈর্ষা কি হতাশা বাপী জানে না। নিজের ওপরেই বিরক্ত। কেন সেধে এর মধ্যে নিজেকে জড়াতে গেল। তার সামনে কাজ। কাজে শুদ্ধি। কাজে মুক্তি। এর থেকে ভ্রষ্ট হলে ওই হতাশার দেয়ালে মাথা খোঁড়াই সার হবে এ-কি ও জানে না?

.

গায়ত্রী রাই নিজে সঙ্গে করে বাপীকে তার পাহাড়ের বাংলোয় রেখে গেছে। আর ঝগড়ুকে যা বলার বলে গেছে নিশ্চয়। সমস্ত ব্যবস্থা আর কর্তব্য বুঝিয়ে দিয়ে মালকান চলে যাবার পর লোকটা অনুগত ছায়ার মতোই তার সঙ্গে লেগে আছে।

ঝগড়ু বাড়িয়ে বলেনি। পাহাড়ের ওপর সত্যি ছবির মতো বাংলো। এ তল্লাটে এমন আর দুটি নেই। পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে লাল কাঁকরের রাস্তা বাংলোর মুখে এসে থেমেছে। থাকে থাকে পাহাড় কেটে প্ল্যাটফর্মের মতো করা হয়েছে। সব থেকে উঁচু প্ল্যাটফর্মে তিনটি বড় ঘর। তাকে কাঁচের দরজা জানালা। সামনে প্রশস্ত বারান্দা। ঢোকার পথে দিশি ফুলের বাগান। পিছনে দরকারী এবং দামী গাছ-গাছড়ার বাগান। একদিকে কাঠের সমস্ত স্টোর হাউস। তার পরেই একসারি শিরীষ গাছ। স্টোর হাউসের পাশে সাপ-ঘর। ছোট-বড় গ্লাসকেসে নানা রকমের সাপ। ঝগড়ু এখানে সাপের বিষ বার করে। বাংলোর আর একদিকে একটু তফাতে কিচেন। তার পাশে ছোট ছোট দুটো ঘরে চাকর আর মালি থাকে। পরের ঘরটা ঝগড়ুর। কর্ত্রী বা অন্য লোকজন এলে সে ওই ঘর দখল করে, নয়তো বাংলোতেই থাকে। সবটা জুড়ে চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া—তাতে বুনো ফুল আর লতাপাতা লাগিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়েছে।

পর পর তিনটে ঘরের একটা মেয়ের, মাঝেরটা গায়ত্রী রাইয়ের। শেষেরটা অতিথি-অভ্যাগতর জন্য। ভিতরে ডাইনিং স্পেস। সামনের বারান্দায় বসার ব্যবস্থা।

গায়ত্রী রাই চলে যাবার পর বাপীর প্রথম কাজ ঝগডুর সঙ্গে ভাব করা! ও তাকে মস্ত হোমরাচোমরা কেউ ভেবে বসে আছে। বয়েস শুনেছে সত্তরের কাছাকাছি, কিন্তু জরা এখনো দূরে সরে আছে। শক্তপোক্ত পাকানো চেহারা। লালচে চোখ। প্রথম দিনই বিকেলে পাহাড় থেকে নেমে বাপী ওর জন্য এক বোতল দামী মদ কিনেছে। ওর হাঁসফাঁস দশা দেখে বলেছে, যতদিন আমি এখানে আছি তুমি ভালো জিনিস খাবে—ফুরোলে আবার কিনে দেব। আবু রব্বানীর কাছে আমি তোমার অনেক গল্প শুনেছি, আমাকেও তার মতো কাছের একজন ভাববে।

প্রথম সন্ধে থেকেই ওই পাথুরে মুখ খুশিতে টসটসে সর্বদা। প্রথম পাঁচ ছ’দিন বাপী আর বাংলো ছেড়ে বেরোয়নি। নেশার জিনিস সব এখানেই তৈরি হয়। এর জন্য জনাকতক বাঁধা কর্মচারী আছে। মস্ত স্টোর হাউসের মধ্যেই যাবতীয় ব্যবস্থা। ঝগড়ুকে সঙ্গে নিয়ে বাপী সব খুঁটিয়ে দেখেছে, বুঝে নিয়েছে। পিছনের বাগানের প্রতিটি গাছগাছড়া চিনেছে। সাপ-ঘরে গিয়ে ঝগড়ুর সাপের বিষ বার করা দেখেছে। এও গা ছমছম করার মতো ব্যাপার। গ্রাস-কেস একটু ফাঁক করলেই বিষধর বেরিয়ে আসার জন্য গলা বাড়ায়। ঝগড়ু সেই গলা সাঁড়াশির মতো এক হাতে চেপে ধরে একটা ছোট টেবিলের সামনে নিয়ে আসে। টেবিলে রবারের ক্যাপ আঁটা কাঁচের গেলাস। সাপের মুখ সেখানে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ সাপ তার ওপরেই দাঁত বসায়—ফলে রবার ক্যাপে দাঁত আটকে যায়। ঝগড়ু তখন সাপের চোয়ালের দু’দিকে নির্মমভাবে টিপতে থাকে—গেলাসের মধ্যে তখন টস-টস করে বিষ পড়ে।

বিষ বার করা হয়ে গেলে অতি বিষাক্ত সাপের দশাও নিস্তেজ, কাহিল। মাটিতে ছেড়ে দিলেও কোনরকমে এঁকেবেঁকে পালাবার পথ খোঁজে। তেড়ে আসে না।

.

দুপুরে আর সন্ধ্যার পরে বাপী অনেক রাত পর্যন্ত তন্ময় হয়ে বই পড়ে। সত্যি অনেক রকমের বইয়ের সংগ্রহ ছিল বীরেশ্বর রাইএর। প্রথম রাতে ভালো জিনিস খেয়ে একটু নেশা জমার পর ওকে বই পড়তে দেখে ঝগড়ুর হাপুস কান্না। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সায়েব ওই-রকম করে বই পড়ত। সে চলে যাবার পর ও বইয়ে আর কারো হাত পড়েনি।

এরপর ঝগড়ুকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আর জঙ্গলে ঘোরার পর্ব। এ-কাজেও ঝগড়ুর ভারী উৎসাহ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে তাদের দরকারের গাছগাছড়া ফুল-ফল লতা-পাতা চিনিয়েছে। কোনটার কি কাজ আর কত কদর বুঝিয়েছে। কখনো বা বাপী এ-সব সংগ্রহের বাঁধা লোকদের সঙ্গে সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরেছে। খাওয়া-দাওয়া হয়নি বলে ঝগড়ুর সখেদ অনুযোগ, আবার একই মুখে প্রশংসাও। সায়েবও ওইরকম করত। খাওয়া-দাওয়া ভুলে যেত। ঝগড়ুর মতে সায়েবের অনেক কিছুই বাপীবাবুর মতো। কিন্তু কাজ শেষ হলে দিলদরিয়া সাহেব গেলাস নিয়ে বসত—বাপীবাবু এ-সব ছোঁয় না, এটুকুই তফাৎ।

পনের দিনের মধ্যে বাপী অনেক ঘুরেছে অনেক দেখেছে অনেক চিনেছে। এই ঘোরা দেখা আর চেনাটা নেশার মতো হয়ে উঠেছে। এরপর একলাই বেরুতে শুরু করল। সঙ্গে একটা দুটো বই। ঘোরে দেখে আর বইয়ের সঙ্গে মেলায়। এক—একদিন এত দূরে চলে গেছে, বাংলোয় আর ফেরাই হয়নি। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পথের ধারের ছাপরা ঘরের সরাইখানায় যা জোটে তাই খেয়েছে, আর অক্টোবরের পাহাড়ী শীতের রাত সেখানেই চাদর মুড়ি দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। সকালে আবার পাহাড় আবার জঙ্গল।

এর মধ্যে দু’বার গায়ত্রী রাই পাহাড়ের বাংলোয় এসেছে। কিন্তু বাপীর সঙ্গে একবারও দেখা হয়নি। থাকতে আসা নয়, কাজে আসা। দ্বিতীয় দফায় চালিহা সায়েবও সঙ্গে ছিল শুনেছে। আর, প্রায় বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল মালকান। ঝগড়ু তাকে কি কথা বলেছে সেটা তার উদ্ভাসিত মুখ দেখেই বোঝা গেছে। বাপীবাবুর সম্পর্কে বলতে গিয়ে খুব সম্ভব ওর স্বর্গত সায়েব-এর কথাই টেনে এনেছে ও। মালকান নাকি ওকে এবার থেকে বেরুনোর সময় সঙ্গে শুকনো খাবার দিতে হুকুম করে গেছে। দ্বিতীয় দফায় অনেকক্ষণ ছিল বলে ও বাপীবাবুর সংগ্রহের গাছ-গাছড়া লতা-পাতাও মালকানকে দেখিয়ে ছেড়েছে।

মনে মনে বাপী এই ঝগড়ুর কাছেও কৃতজ্ঞ।

সেদিন চেপে শীত পড়েছিল। আগের রাতে অসময়ে বৃষ্টি হবার ফলে সকাল থেকে কনকনে ঠাণ্ডা। সেই সঙ্গে ঝড়ো বাতাস চলেছে বিকেল পর্যন্ত। জঙ্গলের মধ্যে মাথা কান আলোয়ানে মুড়ি দিয়েও বাপীর কাঁপুনি ধরেছে। তবু পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এগিয়েই চলেছে। আর খানিক এগোলে যদি আরো নতুন কিছু চোখে পড়ে। এ-দিকটা নতুন। আগে আসেনি।

হঠাৎ এক জায়গায় পা থেমে গেল। অদূরে একটা মস্ত দেবদারু গাছের নীচে কে একজন বসে। বাপী চমকেই উঠেছিল। পাহাড় থেকে বুনো আদিবাসী নেমে এসেছে কোনো? এই ঠাণ্ডায়ও সম্পূর্ণ উলঙ্গ। বুক আর পিঠ পর্যন্ত ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল-দাড়ির চট। সর্বাঙ্গে ভস্ম-প্রলেপ। কপালেও। সামনে মাটিতে একটা লম্বা ত্রিশূল পড়ে আছে। নিজেও মাটিতেই বসে আছে, কোনো আসন নেই। হয়তো জনমানবশূন্য জায়গাটা বেছে নিয়ে সাময়িক বিশ্রামে বসেছে।

ঘাড় গুঁজে লতাপাতা গাছগাছড়া দেখতে দেখতে আসছিল। মুখ তুলে হঠাৎ দেখেছে মানুষটাকে। সে বোধ হয় দূর থেকেই লক্ষ্য করছিল তাকে। চোখাচোখি হতে বাপী স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেছে।

পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে চলল। নিজের ইচ্ছেয় যাচ্ছে কি ওই দু’টো অপলক চোখ তাকে টানছে, জানে না। সামনে পাঁচ হাতের মধ্যে এসে দাঁড়াল। ওই দু’টো চোখে হাসি ঠিকরোচ্ছে, কি আলো বাপী ঠাওর করতে পারছে না। সেই হাসি বা আলো যেন তার চুল-দাড়ির ফাঁকে ফাঁকেও লুকোচুরি খেলে গেল।

—আগে বাঢ়। মিল যায়গা।

বাপী চমকেই উঠল। কোনো সাধুসন্তের ধারে-কাছে ঘেঁষেনি কোনো দিন। ভক্তি-বিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু ওই গমগমে গলার স্বর আর কথাগুলো এক রোমাঞ্চকর কাণ্ড ঘটিয়ে দিল। স্নায়ুতে স্নায়ুতে এক অদ্ভুত ঝঙ্কারের মতো বেজে চলল।

ত্রিশূল হাতে মানুষটা উঠে দাঁড়াল। তারপর পলকে জঙ্গলের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল।

তার পরেও ওই গলার স্বর আর ঝঙ্কারের রেশ বাপীর কানের পর্দায় ঘা দিতে থাকল।

আগে বাঢ়। মিল যায়গা!

সামনে এগোও। পেয়ে যাবে।

বাপী কী পেতে চায়? সামনে এগোলে কি পাবে? পাহাড়ের বাংলোর রাতে ঘুমের মধ্যেও ওই কথাগুলো একটা শব্দতরঙ্গের মতো কানে লেগেই থাকল। বার বার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো।

সামনে এগোও। পেয়ে যাবে।

আগে বাঢ়। মিল যায়গা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *