সোনার মাছি

সোনার মাছি

‘Teleportation’ শব্দটার সঙ্গে কি আপনি পরিচিত?

না।

‘Talekinetics’ শব্দটা শুনেছেন?

না।

Telepathy?

হ্যাঁ শুনেছি। যতদূর জানি এর মানে হচ্ছে মানসিকভাবে একজনের সঙ্গে অন্য আরেকজনের যোগাযোগ।

মিসির আলি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ঠিকই শুনেছেন। ধারণা করা হয় যখন মানুষ ভাষা আবিষ্কার করে নি তখন তারা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগ করত। মানুষের কাছে ভাষা আসার পর টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা নষ্ট হতে শুরু করে।

আমি বললাম, আপনি কি টেলিপ্যাথির কোনো গল্প শোনাবেন?

মিসির আলি বললেন, না। আমি একটা সোনার মাছির গল্প শোনাব। এই মাছিটার Teleportation ক্ষমতা ছিল।

সেটা কী?

মিসির আলি বললেন, মনে করুন আমার এই চায়ের কাপটা বিছানায় রাখলাম। হাত দিয়ে ধরলাম না। মানসিক ক্ষমতা প্রয়োগ করলাম। কাপটা আস্তে আস্তে আমার দিকে আসতে শুরু করল। একে বলে Telekinetics. আবার মনে করুন কাপটা বিছানাতেই আছে, হঠাৎ দেখা গেল কাপটা টেবিলে। একে বলে Teleportation. সায়েন্স ফিকশনে প্রায়ই দেখা যায় এলিয়েনরা একটা জায়গা থেকে অদৃশ্য হয়ে অন্য জায়গায় উদয় হচ্ছেন। পড়েছেন না এ ধরনের গল্প?

পড়েছি। লেরি নিভানের Window of the Sky বইটিতে আছে।

মিসির আলি বললেন, ম্যাজিশিয়ানরা Telekinetics এবং Teleportation দু’ধরনের খেলাই দেখান। মঞ্চের দু’প্রান্তে দু’টা কাঠের খালি বাক্স রাখা হয়েছে। রূপবতী এক তরুণী একটা বাক্সে ঢুকলেন। বাক্স তালা দিয়ে দেয়া হল। তালা খুলে দেখা গেল মেয়েটি নেই। সে অন্য বাক্সটা থেকে বের হল। চমৎকার ম্যাজিক। কিন্তু কৌশলটা অতি সহজ।

আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, কৌশলটা কী?

মিসির আলি বললেন, সেটা আপনাকে বলব না। আপনাকে কৌশল বলে দেয়ার অর্থ চমৎকার একটা ম্যাজিকের রহস্য নষ্ট করা। কাজটা ঠিক না। বরং সোনার মাছির গল্প শুনুন।

আমি মিসির আলির বাড়িতে এসেছি নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে। রাতে বিশেষ কোনো খাবার খাব। যা খেয়ে মিসির আলি আনন্দ পেয়েছেন। তিনি আমাকেও সেই আনন্দ দিতে চান। তিনি খুলনার একটা কাজের ছেলে রেখেছেন। বয়স তের-চৌদ্দ। নাম জামাল। এই ছেলেটি রান্নায় ওস্তাদ। আজ সে রাঁধবে কলার মোচা এবং চিংড়ি দিয়ে এক ধরনের ভাজি। কাঁচামরিচ এবং পেঁয়াজের রস দিয়ে মুরগি। মিসির আলির ধারণা পৃথিবীর যে কোনো শ্রেষ্ঠ খাবারের তালিকায় এই দু’টি আইটেম আসা উচিত।

আমি বললাম, জামাল ছেলেটাকে বেতন যা দিচ্ছেন তা আরো বাড়িয়ে দিন। যাতে সে থেকে যায়। দু’দিন পরে চলে না যায়।

মিসির আলি বললেন, বেতন যতই বাড়ানো হোক এই ছেলে থাকবে না। আমার টেলিভিশনটা চুরি করে পালাবে।

কীভাবে বুঝলেন?

মিসির আলি বললেন, ওর দৃষ্টিতে চোরভাব প্রবল। সে টেলিভিশনের দিকে তাকায় চোরের দৃষ্টিতে। টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখার প্রতি তার আগ্রহ নেই। বন্ধ টেলিভিশনটা সে প্রায়ই চোখ সরু করে দেখে। চুরি যদি নাও করে। বেতনও যদি বাড়াই তারপরেও সে বেশি দিন থাকবে না। কেন বলব?

বলুন।

খুব ভালো যারা রাঁধুনি তারা রান্নার প্রশংসা শুনতে চায়। এই প্রশংসা তাদের মধ্যে ড্রাগের মতো কাজ করে। তবে একই লোকের প্রশংসা না। তারা নতুন নতুন মানুষের প্রশংসা শুনতে চায়। এই জন্যই এক বাড়ির কাজ ছেড়ে অন্য বাড়িতে ঢোকে। ওর কথা থাক গল্প শুরু করি?

করুন।

গল্পটা আমার না। আমার Ph.D থিসিসের গাইড প্রফেসর নেসার আলিংটনের।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আপনার Ph.D ডিগ্রি আছে নাকি?

হ্যাঁ।

কোনোদিন তো বলতে শুনলাম না।

মিসির আলি বললেন, ডিগ্রি বলে বেড়াবার কিছু তো না। Ph.D দামি কোনো ঘড়ি না যে হাতে পরে থাকব সবাই দেখবে। আপনার নিজেরও তো Ph.D ডিগ্রি আছে। নামের আগে কখনো ব্যবহার করেছেন?

আমি বললাম, করি নি। কিন্তু আমার এই বিষয়টা সবাই জানে। আপনারটা জানে না।

না জানুক। আমার গাইড প্রফেসর নেসার আলিংটনের কথা দিয়ে শুরু করি। বেঁটেখাটো মানুষ। চমৎকার স্বাস্থ্য। হাসি-খুশি স্বভাব। নেশা হচ্ছে কাঠের অদ্ভুত অদ্ভুত আসবাব বানানো। তিনকোনা টেবিল যার এককোনা ঢালু। টেবিলে কিছু রাখলেই গড়িয়ে পড়ে যায়। ৪৫ ডিগ্রি বাঁকা বুকশেলফ। যার মাথায় খুঁটি বসানো। দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটা মানুষ মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছে। একটা চেয়ার বানিয়েছেন যার দু’টা হাতল উল্টোদিকে। আমি একদিন বললাম, এই ধরনের অদ্ভুত ফার্নিচার কেন বানাচ্ছেন স্যার?

তিনি বললেন, মানুষের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য এগুলো বানাই। মানুষের ব্রেইন এমনভাবে তৈরি যে সে কনভেনশনের বাইরে যেতে চায় না। আমার চেষ্টা থাকে মানুষকে কনভেনশনের বাইরে নিয়ে যাওয়া।

আমি বললাম, স্যার চেয়ারে হাতল থাকে হাত রাখার জন্য। এটা প্রয়োজন। আপনি প্রয়োজনকে বাদ দেবেন কেন?

স্যার বললেন, তুমি চেয়ারটায় বস।

আমি বসলাম।

স্যার বললেন, হাত কোথায় রাখবে এই নিয়ে অস্বস্তি বোধ হচ্ছে না?

জি হচ্ছে।

স্যার বললেন, চেয়ারটায় হাতল থাকলে তুমি চেয়ারে বসামাত্র তোমার হাতের অস্তিত্ব ভুলে যেতে। এখন ভুলবে না। যতক্ষণ চেয়ারে বসে থাকবে ততক্ষণই মনে হবে তোমার দু’টা হাত আছে।

আমি স্যারের কথা ফেলে দিতে পারলাম না। অদ্ভুত মানুষটার যুক্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হলাম। তাঁর সঙ্গে অতি দ্রুত আমার সখ্য হল। কাঠের ওপর র‍্যাকা ঘষতে ঘষতে তিনি বিচিত্র বিষয়ে গল্প করতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।

এক ছুটির দিনে তাঁর বাড়িতে গেছি। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে দু’টা বই নেয়া দরকার। স্যার কাঠের কাজ বন্ধ করে সুইমিংপুলের পাশের চেয়ারে শুয়ে আছেন। তাঁকে খানিকটা বিষণ্ন মনে হচ্ছে। আমি বই দু’টির কথা বললাম। তার উত্তরে স্যার বললেন, মিসির আলি চল সুইমিং করি।

আমি দারুণ অস্বস্তিতে পড়লাম। স্যার একা মানুষ। বিশাল বাড়িতে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই। সুইমিংপুলে তিনি যখন নামেন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নামেন। নগ্ন অধ্যাপকের সঙ্গে সাঁতার কাটা সম্ভব না। আমি বললাম, স্যার আমার শরীরটা ভালো না। আজ পানিতে নামব না।

স্যার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, নগ্নতা নিয়ে তোমাদের শুচিবায়ুটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমার স্ত্রী অ্যানি যখন জীবিত ছিল তখন আমরা দু’জন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটতাম। আমার জীবনের অল্প কিছু আনন্দময় মুহূর্তের মধ্যে ঐ দৃশ্যটি আছে। এখন আমি একা নগ্ন সাঁতার কাটি। আমার সঙ্গে সাঁতার কাটে অ্যানির স্মৃতি

আমি বললাম, স্যার আজ কি ম্যাডামের মৃত্যু দিবস?

তিনি বললেন, তোমার বুদ্ধি ভালো। কীভাবে ধরেছ?

আমি বললাম, ম্যাডামের কোনো কথা কখনো আপনার কাছ থেকে আগে শুনি নি। আজ শুনলাম। আপনি হাসিখুশি মানুষ, আজ শুরু থেকেই দেখছি আপনি বিষণ্ণ।

স্যার বললেন, মিসির আলি, আমার স্ত্রী ছিল নর্থ আমেরিকার সবচেয়ে রূপবতী মহিলা এবং নর্থ আমেরিকার সবচেয়ে বোকা মহিলা। ঐ বোকা মহিলা আমাকে পাগলের মতো ভালবাসত। বোকা বলেই হয়তো বাসত। বুদ্ধিমতীরা নিজেকে ভালবাসে অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে না। ভালবাসার ভান করে। তুমি লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে বস। আমি সাঁতার কেটে আসছি। আজ তুমি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে। পিজার অর্ডার দেয়া আছে। পিজা চলে আসবে। পিজা অ্যানির অতি পছন্দের খাবার। আমার না। তবে আজকের দিনে নিয়ম করে আমি পিজা খাই।

.

লাঞ্চপর্ব শেষ হয়েছে। আমি স্যারের সঙ্গে লাইব্রেরির ঘরে বসে আছি। প্রয়োজনীয় দু’টা বই আমার হাতে। বিদায় নিয়ে চলে আসতে পারি। আজকের এই বিশেষ দিনে বেচারাকে একা ফেলে যেতেও খারাপ লাগছে। কী করব বুঝতে পারছি না।

স্যার বললেন, তোমার কাজ থাকলে চলে যাও। আমাকে কোম্পানি দেবার জন্য বসে থাকতে হবে না। নিঃসঙ্গতাও সময় বিশেষে গুড কোম্পানি। আর যদি কাজ না থাকে তা হলে বস। গল্প করি। অ্যানির বোকামির গল্প শুনবে?

স্যার বলুন।

অ্যানির প্রধান শখ ছিল আবর্জনা কেনা। তার শপিংয়ের আমি নাম দিয়েছিলাম গার্বেজ শপিং। এই বাড়ির বেসমেন্টের বিশাল জায়গা তার কেনা গার্বেজে ভর্তি। সময় করে একদিন দেখ, মজা পাবে। কী নেই সেখানে? বাচ্চাদের খেলনা, বাসন, কাচের পুতুল, তোয়ালে, সাবান। সাবান এবং তোয়ালের প্রতি তার ছিল অবসেশন। সাবান দেখলেই কিনবে। মোড়ক খুলে কিছুক্ষণ গন্ধ শুঁকবে তারপর রেখে দেবে। তোয়ালের ভাঁজ খুলে কিছুক্ষণ মুখে চেপে রাখবে। তারপর সরিয়ে রাখবে।

অ্যানিকে নিয়ে আমি প্রায়ই দেশের বাইরে ছুটি কাটাতে যেতাম। বিদেশের নদী, পর্বত, অরণ্য, সমুদ্র কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করত না। সে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে মহানন্দে দোকানে দোকানে ঘুরত।

সেবার গিয়েছি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। আলাদা কটেজ নিয়েছি। সমুদ্রের পানিতে পা ডুবিয়ে বিয়ার খেয়ে সময় কাটাচ্ছি। অ্যানি ঘুরছে দোকানে দোকানে। তার সময় ভালো কাটছে। আমার নিজের সময়ও খারাপ কাটছে না। এক রাতে সে উত্তেজিত গলায় বলল, আজ একটা অদ্ভুত জিনিস কিনেছি, দেখবে?

আমি বললাম, না। তুমি কিনতে থাক। প্যাকেট করে সব দেশে পাঠাও। একসঙ্গে দেখব।

এটা একটু দেখ। একটা সোনার মাছি।

আমি বললাম, সোনার মাছিটা দিয়ে কী করবে? লকেটের মতো গলায় ঝুলাবে? মাছির মতো নোংরা একটা পতঙ্গ গলায় ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে হয়!

অ্যানি বলল, জিনিসটা আগে দেখ। তারপর জ্ঞানী জ্ঞানী কথাগুলো বল।

আমি জিনিসটা দেখলাম। এম্বারের একটা খণ্ড। সিগারেটের প্যাকেটের চেয়ে সামান্য বড়। সেখানে সোনালি রঙের একটা মাছি আটকা পড়ে আছে। এম্বারের নিজের রঙও সোনালি। সূর্যের আলো তার গায়ে পড়লে সে ঝলমল করে ওঠে। মাছিটাও চিকমিক করতে থাকে।

অ্যানি মুগ্ধ গলায় বলল, সুন্দর না?

আমি বললাম, জিনিসটা নকল।

অ্যানি আহত গলায় বলল, মাছিটা নকল?

আমি বললাম, মাছি নকল না। এম্বারটা নকল। চায়নিজরা নকল এম্বার তৈরি করে তার ভেতর কীটপতঙ্গ ভরে আসল বলে বোকা ট্যুরিস্টদের কাছে বিক্রি করে। আসল এম্বারের গুরুত্ব তুমি জানো না। আমি জানি। পৃথিবীর প্রাচীন ফসিলগুলোর বড় অংশ হল এম্বারে আটকা পড়া কীটপতঙ্গ। বিজ্ঞানীদের কাছে এম্বার ফসিল অনেক বড় ব্যাপার।

অ্যানি বলল, এম্বার কী?

আমি বললাম, এক ধরনের গাছের কষ। জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়। পৃথিবীর প্রাচীন সব সভ্যতাতেই এম্বারের গয়নার নিদর্শন পাওয়া গেছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে চীন সম্রাট এম্বারের তৈরি একটা রথ উপহার দিয়েছিলেন।

অ্যানি বলল, জ্ঞানের কথা রাখ। জিনিসটা সুন্দর কি না বল?

আমি বললাম, নকল জিনিস সুন্দর হবেই। এর পেছনে কত ডলার খরচ করেছ?

সেটা বলব না। তুমি রাগ করবে।

অ্যানি এম্বারের টুকরা গালে লাগিয়ে হাসিহাসি মুখে বসে রইল।

মিসির আলি! আমি তোমাকে বলেছি না, আমার স্ত্রী নর্থ আমেরিকার সবচেয়ে রূপবতী মহিলা।

জি স্যার বলেছেন।

ঐ রাতে তাকে দেখে আমার মনে হল সে শুধু নর্থ আমেরিকার না, এই গ্রহের সবচেয়ে রূপবতী তরুণী। কবি হোমার তাঁকে দেখলে আরেকটি মহাকাব্য অবশ্যই লিখতেন। আমি কোনো কবি না। আমি সামান্য সাইকোলজিস্ট। আমি অ্যানির হাত ধরে বললাম, I love you.

অ্যানি বলল, I love my golden fly.

আমি সামান্য চমকালাম। আমেরিকান কালচারে স্বামী I love you বলার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকেও I love you বলতে হয়। অ্যানি তা বলে নি, এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার না। তবে সাইকোলজিস্ট হিসেবে বুঝতে পারলাম অ্যানি সোনার মাছির প্রতি গভীর আসক্তির পথে যাচ্ছে। অবসেশন খারাপ জিনিস। অবসেশন মানুষের চিন্তা- চেতনা, জ্ঞান-বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। পৃথিবীর সবচেয়ে পাওয়ারফুল ড্রাগের চেয়েও অবসেশন শক্তিশালী। তুমি একজন সাইকোলজিস্ট। আমার এই কথা মনে রেখ।

অ্যানির অবসেশন অতি দ্রুত প্রকাশিত হল। আমি ছোট্ট একটা ঘটনা বলে তার অবসেশনের তীব্রতা বুঝাব। এক রাতের কথা, আমি অ্যানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম অ্যানি তার গালে এম্বারের টুকরাটা চেপে ধরে আছে।

আমি অ্যানির হাত থেকে এম্বারটা কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ অ্যানির কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে নিজেকে সামলালাম। অবসেশন সম্পর্কে ছোট্ট বক্তৃতা দিলাম। সে আমার কোনো কথাই মন দিয়ে শুনছিল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার হাতের এম্বারের টুকরাটার দিকে।

আরেক দিনের কথা। হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছি। অ্যানি অতি বিরক্তিকর একটা কাজ করছে, চলন্ত গাড়িতে চোখের পাতায় পেনসিল দিয়ে রঙ ঘষছে। অনেকবার তাকে বলেছি এই কাজটা করবে না। কোনো কারণে গাড়ি ব্রেক করতে হলে চোখ আঁকার পেনসিল ঢুকে যাবে চোখের ভেতর। আমার কথায় লাভ হয় নি। চলন্ত গাড়িতে তার চোখ আঁকা নাকি সবচেয়ে ভালো হয়। আমি অ্যানিকে অগ্রাহ্য করে গাড়ি চালাচ্ছি। সে যা করতে চায় করুক। হঠাৎ অ্যানির বিকট চিৎকার Holy Cow, আমি দ্রুত ব্রেক কষে গাড়ি রাস্তার একপাশে নিয়ে এলাম।

অ্যানি, কী হয়েছে?

অ্যানি বলল, সোনার মাছিটা আমি সব সময় বাসায় রেখে আসি। যদি হারিয়ে যায় সেই ভয়ে। আজো তাই করেছি। এখন ব্যাগ খুলে দেখি এম্বারটা আমার ব্যাগে।

আমি বললাম, তুমি বলতে চাচ্ছ একটা বস্তুর Teleportation হয়েছে। ঘরে অদৃশ্য হয়ে তোমার ব্যাগে আবির্ভূত হয়েছে?

অ্যানি বলল, হুঁ।

আমি বললাম, তোমার ইন্টেলেকচুয়েল লেভেল নিম্ন পর্যায়ের। তাই বলে এতটা নিম্ন পর্যায়ের তা আমি ভাবি নি।

অ্যানি বলল, তা হলে এম্বারটা আমার ব্যাগে কীভাবে এসেছে?

তুমি নিজেই এনেছ। এখন ভুলে গেছ। বস্তুটা বিষয়ে তুমি অবসেড্ বলেই ঘটনাটা ঘটেছে।

অ্যানি বলল, হতে পারে। I am sorry.

সে স্যরি বললেও আমি বুঝতে পারছিলাম, অ্যানি আমার যুক্তি গ্রহণ করে নি। সে ধরেই নিয়েছে সোনার মাছি তার আকর্ষণে আপনাআপনি তার ব্যাগে চলে এসেছে।

কিছুদিন পর আবার এই ঘটনা। অ্যানিকে নিয়ে K Mart-এ গিয়েছি। কাগজ কিনব, পেপার ক্লিপ কিনব। হঠাৎ অ্যানি উত্তেজিত ভঙ্গিতে আমার কাছে উপস্থিত। আমি বললাম, কোনো সমস্যা?

অ্যানি বলল, হুঁ, সমস্যা।

বল কী সমস্যা?

অ্যানি বলল, শুনলে তো তুমি রেগে যাবে।

রাগব না। বিরক্ত হতে পারি। তোমার সেই সোনার মাছি আবার ব্যাগে চলে এসেছে?

অ্যানি নিচু গলায় বলল, হুঁ। আজ আমি নিজের হাতে এম্বারটা ড্রয়ারে রেখে তোমাকে নিয়ে বের হয়েছি। তুমি ঘরে তালা দিয়েছ।

আমি বললাম, ভালো করে মনে করে দেখ। আমি তালা দেবার পরপর তুমি বললে, কিচেনের চুলা বন্ধ করেছ কি না মনে করতে পারছ না। আমি তালা খুললাম, তুমি ঘরে ঢুকলে। ঘর থেকে বের হবার সময় সোনার মাছি নিয়ে এসেছ।

অ্যানি বিড়বিড় করে বলল, আমি শুধু কিচেনেই ঢুকেছি। অন্য কোথাও না। বিশ্বাস কর।

আমি বললাম, তুমি ভাবছ কিচেনে ঢুকেছ। চূড়ান্ত পর্যায়ে অবসেশনে এমন ঘটনা ঘটে।

স্যরি।

আমি বললাম, স্যরি বলার কিছু নেই। তোমাকে সোনার মাছির ব্যাপারটা ভুলে যেতে হবে। পারবে না?

তুমি বললে পারব।

একজন সেনসেবল মানুষ যা করে আমি তাই করলাম, অ্যানির সোনার মাছি লুকিয়ে ফেললাম। অ্যানি তা নিয়ে খুব যে অস্থির হল তা-না। কারণ তখন তার জীবনে মহাবিপর্যয় নেমে এসেছে। তার স্টমাক ক্যানসার ধরা পড়েছে। তাকে ভর্তি করা হয়েছে সেইন্ট লুক হাসপাতালে। ডাক্তার তৃতীয় দফা অপারেশন করেছেন। রেডিও থেরাপি শুরু হয়েছে।

পরীর চেয়েও রূপবতী একটি মেয়ে আমার চোখের সামনে প্রেতের মতো হয়ে গেল। মাথার সব চুল পড়ে গেল। শরীর শুকিয়ে নয়-দশ বছর বয়সী একটা শিশুর মতো হয়ে গেল। শুধু চোখ দু’টা ঠিক রইল। পৃথিবীর সব মায়া, সব সৌন্দৰ্য জমা হল দু’টা চোখে। একদিন ডাক্তার বললেন, স্যরি প্রফেসর। রেডিও থেরাপি আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে কাজ করছে না।

আমি বললাম, আর কিছুই কি করার নেই?

ডাক্তার চুপ করে রইলেন।

এক রাতের কথা। আমি অ্যানির পাশে বসেছি। অ্যানি বলল, অন্যদিকে তাকিয়ে বস। আমার দিকে তাকিও না। আমি দেখতে পশুর মতো হয়ে গেছি। একটা নোংরা পশুর দিকে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। তুমি যখন জ্ঞানের কথা বলতে আমি খুব বিরক্ত হতাম, আজ একটা জ্ঞানের কথা বল।

আমি বললাম, বিজ্ঞান বলছে মহাবিশ্বের entropy বাড়ছে। তাই নিয়ম। বাড়তে বাড়তে entropy তার শেষ সীমায় পৌঁছবে। পুরো universer-এর মৃত্যু হবে। তোমার জন্য আমার ভালবাসা সেদিনও থাকবে। তুমি নোংরা পশু হয়ে যাও কিংবা সরীসৃপ হয়ে যাও। তাতে কিছু যায় আসে না।

অ্যানি আমার হাতে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর বলল, কিছুক্ষণের জন্য আমার সোনার মাছিটাকে কি আমার কাছে দেবে? আমি একটু আদর করে তোমার কাছে ফেরত দেব। কোনোদিন চাইব না। প্রমিজ।

আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কারণ এম্বার খণ্ডটা আমার কাছে নেই। নিতান্তই মূর্খের মতো আমি ফেলে দিয়েছিলাম হাডসন নদীতে। আমি নিশ্চিত জানতাম ঘরে কোথাও লুকিয়ে রাখলে অ্যানি কোনো না কোনোভাবে খুঁজে বের করবে। তার অবসেশন সে শেষ সীমায় নিয়ে যাবে। এখন আমি কী করি? মৃত্যুপথযাত্রীকে কী বলব?

আমি কিছুই বললাম না। মাথা নিচু করে বাসায় ফিরলাম। তার একদিন পর হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এল। অ্যানির অবস্থা ভালো না। তুমি চলে এস। সে তোমাকে খুব চাইছে।

আমি হাসপাতালে ছুটে গেলাম। অ্যানিকে দেখে চমকালাম। হঠাৎ করে তাকে সুন্দর লাগছে। গালের চামড়ায় গোলাপি আভা। চোখের মণি পুরোনো দিনের মতো ঝকঝক করছে।

আমাকে দেখে সে কিশোরীদের মিষ্টি গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু।

আমি বললাম, থ্যাংকস কেন?

অ্যানি বলল, আমি যখন ঘুমুচ্ছিলাম তখন তুমি আমাকে না জাগিয়ে সোনার মাছিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছ এইজন্য ধন্যবাদ।

সে গায়ের চাদর সরাল, আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখি এম্বারের টুকরাটা তার হাতে। প্রফেসর কথা বন্ধ করে চুরুট ধরালেন। চুরুটে টান দিয়ে আনাড়ি স্মোকারদের মতো কিছুক্ষণ কাশলেন। তারপর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এম্বারের টুকরাটা অ্যানির হাতে কীভাবে এসেছে আমি জানি না। জানতে চাইও না। সব রহস্যের সমাধান হওয়ার প্রয়োজনও দেখছি না। রহস্য হচ্ছে গোপন ভালবাসার মতো। যা থাকবে গোপনে।

মিসির আলি বললেন, স্যার, এম্বারের টুকরাটা কি এখন আপনার কাছে আছে?

প্রফেসর বললেন, না। অ্যানির কফিনের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি। অ্যানি তার সোনার মাছি সঙ্গে নিয়ে গেছে।

অ্যানির ছবি দেখবে? দেয়ালে তাকাও। বাসকেট বল হাতে নিয়ে হাসছে। ছবিটা আমার তোলা। ছবিটা প্রায়ই দেখি এবং অবাক হয়ে ভাবি, আমাদের সবার বয়স বাড়বে। আমরা জরাগ্রস্ত হব। কিন্তু ছবির এই মেয়েটি তার যৌবন নিয়ে স্থির হয়ে থাকবে। জরা তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

প্রফেসর চুরুট হাতে উঠে দাঁড়ালেন। দ্রুত ঘর থেকে বের হলেন। তাঁর চোখে পানি চলে এসেছে। তিনি সেই পানি তাঁর ছাত্রকে দেখাতে চান না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *