উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

সোনার পালক

সোনার পালক

বড়মামা অনেকক্ষণ ছাদে একা ঘুরছে। সেই বেলা তিনটে নাগাদ উঠেছে, এখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল। আমি স্কুলের হোমটাস্ক করছিলুম। শীত আসছে বলে মাসিমা কোলে সোয়েটার বুনছিল। আমাকে বললে, ‘একবার দেখে আয় তো, বড় কত্তা এতক্ষণ ছাতে কি করছে! নিশ্চয় কোনও অপকর্ম!’

‘সে করলে করুক না। ছাতেও তো একটা বাথরুম আছে?’

‘তোর মাথা। অপকর্ম, দুষ্কর্ম এই সব মিলিয়ে কতরকম কর্ম আছে জানিস?’

‘তা অবশ্য ঠিক।’

‘এই তো মাস তিনেক আগে ওই ছাতে বসে নিজের চুল নিজে কাটছিল, তারপর কি হল?’

‘ন্যাড়া হতে হল।’

‘তারপর, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, কে মারা গেছেন। যেই শোনে কেউ মারা যায়নি, তখন প্রশ্ন, তাহলে কি উকুন! তুই যা, চুপি চুপি একবার দেখে আয়।’

আমার মামার বাড়িটা খুব সুন্দর জায়গায়। কিছু দূরেই একটা সরোবর। ভোরলোয় দিগ্বিদিক থেকে হরেক রকমের পাখি এসে জলে নামে। চারপাশের গাছ নানারকমের পাখিতে ভরে যায়। আর এই সন্ধ্যেবেলায় সব বাসায় ফেরার পালা। ছাতের ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। কত রকমের ডানার শব্দ। হুস হুস, ফটফট, ঝপাস ঝপাস। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে গায়ে ডানার বাতাস লাগে।

বড়মামার যত সব উদ্ভট গল্প। যখন ক্লাস টু-তে পড়তুম, বিশ্বাস করতুম। চোখ বড় বড় হয়ে যেত। একবার এক পূর্ণিমার রাতে ফটফটে চাঁদের আলোয় বড়মামা এই ছাতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। কাচের মতো আকাশ। হঠাৎ সেই আকাশ থেকে কি একটা পাক খেতে খেতে নীচের দিকে নেমে আসছে। ঠক করে বুকে এসে পড়ল। তুলে দেখল, এই এত বড় একটা সোনার পালক। ভীষণ সুন্দর! তার যে কত টাকা দাম হবে, কারো ধারণা নেই।

‘কিসের পালক? কার পালক?’

‘হাঁসের পালক। এক ধরনের স্বর্গীয় হাঁস আছে, যারা আকাশের খুব উঁচুতে, মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে যায়, তারা স্বর্গে থাকে। পৃথিবীর একটা জায়গায় তারা পূর্ণিমার রাতে নামে, সেই জায়গাটার নাম মানস সরোবর। পৃথিবীর মানুষের জন্যে তারা ডানা থেকে একটা করে পালক খসায়। সেই সোনার পালক কে পায় জানিস? যারা সৎ, সুন্দর, জীবনে একটাও মিথ্যে কথা বলে না, লেখাপড়ায় ভালো, ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়।’

‘তুমি যা বললে, সেই রকম হলে, আমারও বুকে সোনার পালক পড়বে?

‘আলবাৎ পড়বে।’

সেই দিনই মনে মনে সঙ্কল্প করলুম, একটাও মিথ্যে কথা বলব না। একটাও বাজে কাজ করব না। লেখাপড়া মন দিয়ে করব। সবাই বলতে লাগল, পিন্টুটা হঠাৎ কি রকম বদলে গেছে। পরীক্ষাতেও ফার্স্ট, সেকেন্ড হচ্ছে। বড়মামা বলেছিল, দেখ, এসব কথা কারোকে বলবি না, সিক্রেট। সোনার পালকের কথা কারোকে বলবি না। আমি আবার জিগ্যেস করলুম, তোমার পালকটা কোথায়? বড়মামা বললে, সেই পালকটা দিয়ে, আমি ভগবানের কাছ থেকে বুদ্ধি কিনেছি। বুদ্ধি তো দোকানে পাওয়া যায় না।

তখন সবই বিশ্বাস করেছিলুম।

বড়মামা, আমি যখন আর একটু বড় হলুম, তখন একদিন বললে, সোনার পালকের রহস্যটা বুঝলি। সোনার পালক হলো চরিত্র। আমি বললুম, সে আমি অনেক আগেই বুঝেছি বড়মামা। সোনার পালক আমি পেয়েছি। বড়মামা বললে, সেই কলমে নিজের জীবনী লিখে যা।

বড়মামা ছাতের মাঝখানে একটা মাদুর পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। চোখ দুটো খোলাই রয়েছে। মাসিমার নির্দেশ মতো চুপি চুপি এলেও বড়মামা ধরে ফেলেছে, ‘কিসের অনুসন্ধান ভাগনে?’

‘না, কোনও অনুসন্ধানই নেই। বেড়াতে এসেছি।’

‘তা ভালো। তবে আমি জানি, কি কারণে এসেছিস!’

‘কি কারণ!’

‘কুসি পাঠিয়েছে। দেখে আয় তো কি করছে!’

‘মিথ্যে কথা বলব না, মাসিমা বললে, দেখে আয় তো বড়টা অনেকক্ষণ ছাতে একলা রয়েছে, কি আবার অপকর্ম করছে।’

‘এ অপবাদ আমার ঘুচল না রে ভাগনে! এতখানি বয়েস হলো আমার। তুই সেই গল্পটা জানিস?’

‘কোনটা?’

‘গুড়ের ফোঁটা।’

‘না।’

‘তাহলে শোন। এক মুদিখানার দোকানের বাইরে দুই ভদ্রলোক বাঁশের মাচানে পাশাপাশি বসে আছে। ওদিকে দোকানি বসে আছে টাটে। খুব কেনাবেচা চলছে। সকালের ভিড়। ওই দুই ভদ্রলোকের একজন হলো শয়তানের দূত, আর একজন দেবদূত। শয়তানের দূত খুব দুঃখ করে দেবদূতকে বলছে, ‘দ্যাখো ভাই, পৃথিবীর যেখানে যত গণ্ডগোল, লোকে বলে শয়তানের কারসাজি। আমার প্রভুর এমনই বরাত। আচ্ছা, এই যে গুড়ের টিনটা এইখানে রয়েছে, এর থেকে আঙুলে করে একটা ফোঁটা নিয়ে আমি এই বাঁশের খোঁটায় লাগালুম।’

শয়তানের দূত ছোট্ট একটা ফোঁটা লাগিয়ে দেবদূতের পাশে এসে বসল। দেবদূতকে প্রশ্ন করল, ‘এর মধ্যে তুমি শয়তানের কোনও কারসাজি দেখতে পাচ্ছ?’

দেবদূত বললে, ‘না। অনেকেই অমন করতে পারে। খদ্দেররাও অনেকে আঙুলে কিছু লাগলে বাঁশের গায়ে মুছে দেয়।’

শয়তানের দূত চলে গেল। দেবদূত বসে রইল উদাস। দেবদূতের মাঝে মাঝে অমন হয়, কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করে না। ঘন ঘন হাই ওঠে। মানুষ হলে চা খেত। দেবদূতের তো খাওয়া বারণ। চা হলে শয়তানের আরক। দেবদূত দেখছে, গুড়ের ফোঁটাটা লক্ষ্য করে এক সার পিঁপড়ে বাঁশ বেয়ে উঠছে। আর বেশ মোটাসোটা একটা টিকটিকি একেবারে টঙে নীচের দিকে মুখ ফুলিয়ে স্থির। কোথাও কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নেই। খদ্দেররা আসছে যাচ্ছে। দাঁড়িপাল্লা, বাটখারার শব্দ। নানা কথা। কখনো বচসা। দেবদূত দেখছে, টিকটিকিটা পিঁপড়ে ধরার লোভে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। তা এগোক। টিকটিকির কাজ টিকটিকি করুক। একটা বেড়াল আধবোজা চোখে থুপ্পি মেরে বসেছিল। বেড়ালটা টিকটিকি দেখে মারলে লাফ। একটা কালো মুশকো কুকুর ঝিমোচ্ছিল এক পাশে। চিরশত্রু বেড়াল। ঝাঁপিয়ে পড়ল বেড়ালটার ঘাড়ে। এইবার বেড়াল আর কুকুর ঝটাপটি করতে করতে দোকানদারের ঘাড়ে। দোকানদার এক লাফ। মাথার কাছে তাকে তাকে যত কৌটো-ফৌটো ছিল সব পড়তে লাগল শিলাবৃষ্টির মতো। খরিদ্দার ভয়ে ছুটোছুটি। নিমেষে দোকান লণ্ডভণ্ড। দেবদূতও দৌড় মেরেছে। একটা গাছের তলায় শয়তানের দূত গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে। দেবদূত হাঁপাচ্ছে। শয়তানের দূত বললে, ‘এসো ভাই, হাঁপাচ্ছ কেন?’ দেবদূত পাশে বসে বললে, ‘তোমার কেরামতি আছে ভাই।’ দেবদূত তাকিয়ে আছে। শয়তানের দূত বললে, ‘সবই আমার প্রভুর ইচ্ছা ভাই।’

বড়মামা গল্প শেষ করে বললে, ‘জানিস তো, আমার এই গুড়ের ফোঁটা। কুসির দোষ নেই। সবই আমার বরাত। সেদিন খাটটাকে জানলার দিকে সরাব বলে যেই টানলুম, একটা পায়া মচকে গেল। খাটটা এখন তোর ইনক্লাইনড প্লেন। এধারে শুলুম তো কিছুক্ষণের মধ্যে গড়িয়ে ওধারে। যেন খাদে পড়ে গেলুম গড়িয়ে। তারপরেই শুরু হল কসরত। গড়িয়ে ওপরে উঠতে হবে। সারা রাত ধস্তাধস্তি। রাত ভোর। একে বলে একসারসাইজ অন ইনক্লাইনড প্লেন। এই ব্যায়ামের ফলে আমার ভুঁড়িটা কত উন্নত হয়েছে দ্যাখ।’

‘তাহলে মাসিমাকে কি বলব?’

‘বলবি, এক ভদ্রলোক অতি ভদ্রলোকের মতো ছাতে শুয়ে আছে।’

‘কেন শুয়ে আছ? শুয়ে কেন আছ?’

‘আমার মন খারাপ। আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে। মা ছাড়া পৃথিবীতে মানুষের আর কে আছে! ভাই, বোন, ভাগনে থাকাও যা, না থাকাও তা। আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন, গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে তোকে পাঠাতেন না, নিজেই চলে আসতেন। আমার মাথার কাছে বসে চুলে হাত বোলাতে বেলোতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনাতেন, কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি, গাড়ি চালায় বংশীবদন, সঙ্গে যে যায় ভাগনে মদন।’

‘তা তুমি আরও কতক্ষণ এইভাবে শুয়ে থাকবে!’

‘সে তো বলতে পারছি না, মন ভালো হলেই উঠে পড়ব।’

মাসিমাকে বললে, ‘মা থাকলে কি করত?’

‘মাথার শিয়রে বসে চুলে হাত বোলাতেন আর কুমোরপাড়া শোনাতেন।’

‘তাই না কি! মা যা রাগী ছিলেন! এমন একটা দিন ছিল না, যে বড়দা পেটানি খায়নি। ব্যাপার অন্য, চল তো, আমার সঙ্গে চল।’

মাসিমা ছাতে গিয়েই বললে, ‘এই ওঠো তো। ওঠো, ওঠো।’

বড়মামা বললে, ‘অসম্ভব। এখন আমার মায়ের সঙ্গে কমিউনিকেশান চলছে। নানারকম মেসেজ আসছে, ডোন্ট ডিসটার্ব।’

‘তুমি উঠবে, না গায়ে আরশোলা ছাড়ব।’

আরশোলার ভয়ে বড়মামা একবার ভুবনেশ্বরে পালিয়েছিল। সেখান থেকে আবার পালিয়ে এসেছিল কাঁকড়াবিছের ভয়ে। আরশোলার নাম শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল। মাসিমা বললে, ‘আমার এই কৌটোয় বেশ বড়সড় তেলচুকচুকে একটা আছে, পিঠের দিকেই ছাড়ি।’

বড়মামা এক লাফে ছাতের ট্যাংকের কাছে। মাসিমা আমাকে বললে, ‘মাদুরটা তোল!’ এই মাসখানেক আগে প্রচুর খরচা করে ছাদে পাথর বসানো হয়েছিল। একটা পাথর চৌচির। মাসিমা হুঙ্কার ছাড়ল, ‘বড়দা, এটা কি?’

বড়মামা সরল বালকের মতো এগিয়ে এসে অবাক হয়ে দেখতে দেখতে বললে, ‘এ কি! ফেটে চৌচির!’

মাসিমা বললে, ‘সে তো আমরা সবাই দেখছি। প্রশ্ন হল, এই অপকর্মটি কার?’

বড়মামা বললে, ‘আশ্চর্য ব্যাপার বটে। যখন মাদুর পাতলুম তখন কিচ্ছু ছিল না। বইয়ে পড়েছিলুম, মানুষের দুঃখে পাথর ফাটে, আজ স্বচক্ষে দেখলুম।’

‘কোন মানুষের দুঃখ?’

‘আমার দুঃখে পাথর ফ্র্যাকচার।’

‘তোমার আবার কিসের দুঃখ!’

‘হঠাৎ মা-র কথা মনে পড়ল। শীতকালে মা আমাদের কতরকম করে খাওয়াতেন। মায়ের কোলে চড়ে ঝুলনের মেলায় গিয়ে কাঠের বাঘ কেনা।’

‘কোলে চড়ার কাল পর্যন্ত মনে আছে! বাব্বা! কি মেমারি!’

আমি থাকতে না পেরে বলে ফেললুম, ‘বড়মামা, তুমি না সোনার পালক পেয়েছিলে!’

বড়মামা থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকাল, ‘তাহলে সত্যি কথাই বলি, এটা কাশ্মীর কেস।’

‘জঙ্গি হানা! তলার দিক থেকে পাথর ফাটিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা।’

বড়মামা বললে, ‘না, আখরোট। হাতুড়ি দিয়ে ঠুকছি। মুখে ফেলছি। এক বেটা এতই নিরেট, ছিটকে বেরিয়ে গেল, ধরে এনে মারলুম এক ঘা। রেগে গেছি তো। রেগে গেলে মানুষের জ্ঞান থাকে না। আর সেই কারণেই আখরোটটা জানে বেঁচে গেল। হাতুড়ি মিস করল। পড়ল পাথরে। কেয়াবাত, ফ্র্যাকচার। সঙ্গে সঙ্গে মাদুর পেতে শয়ন। তবে হ্যাঁ, এইটুকু বলতে পারি, আমি একটা দামী জিনিস পেয়েছি। ফাটা পাথরের উপহার। কাউকে দেখাব না। ইনক্লাব জিন্দাবাদ!’

বড়মামা পাশ কাটিয়ে পালাচ্ছে।

মাসিমা বললে, ‘তুই, বন্দেমাতরম বলে জাপটে ধর।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *