সোনার পালক
আকাশ। হঠাৎ সেই আকাশ থেকে কী একটা পাক খেতে খেতে নীচের দিকে নেমে আসছে। ঠক করে বুকে এসে পড়ল। তুলে দেখল, এই এতবড় একটা সোনার পালক। ভীষণ সুন্দর! তার যে কত টাকা দাম হবে, কারও ধারণা নেই।
‘কীসের পালক? কার পালক?’
‘হাঁসের পালক। এক ধরনের স্বর্গীয় হাঁস আছে, যারা আকাশের খুব উঁচুতে, মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে যায়, তারা স্বর্গে থাকে। পৃথিবীর একটা জায়গায় তারা পূর্ণিমার রাতে নামে, সেই জায়গাটার নাম মানস সরোবর। পৃথিবীর মানুষের জন্যে তারা ডানা থেকে একটা করে পালক খসায়। সেই সোনার পালক কে পায় জানিস? যারা সৎ, সুন্দর, জীবনে একটাও মিথ্যে কথা বলে না, লেখাপড়ায় ভালো, ফাস্ট-সেকেন্ড হয়।’
‘তুমি যা বললে, সেই রকম হলে, আমারও বুকে সোনার পালক পড়বে?’
‘আলবাত পড়বে।’
সেই দিনই মনে মনে সংকল্প করলুম, একটাও মিথ্যে কথা বলব না। একটাও বাজে কাজ করব না। লেখাপড়া মন দিয়ে করব। সবাই বলতে লাগল, ‘পিন্টুটা হঠাৎ কীরকম বদলে গেছে। পরীক্ষাতেও ফাস্ট-সেকেন্ড হচ্ছে।’
বড়মামা বলেছিল, ‘দেখ, এসব কথা কারওকে বলবি না, সিক্রেট। সোনার পালকের কথা কারওকে বলবি না। আমি আবার জিগ্যেস করলুম, তোমার পালকটা কোথায়? বড়মামা বললে, সেই পালকটা দিয়ে আমি ভগবানের কাছ থেকে বুদ্ধি কিনেছি। বুদ্ধি তো দোকানে পাওয়া যায় না।’
তখন সবই বিশ্বাস করেছিলুম। বড়মামা, আমি যখন আর একটু বড় হলুম, তখন একদিন বললে, ‘সোনার পালকের রহস্যটা বুঝলি। সোনার পালক হল চরিত্র।’
আমি বললুম, ‘সে আমি অনেক আগেই বুঝেছি বড়মামা। সোনার পালক আমি পেয়েছি।’
বড়মামা বললে, ‘সেই কলমে নিজের জীবনী লিখে যা।’
বড়মামা ছাতের মাঝখানে একটা মাদুর পেতে চিত হয়ে শুয়ে আছে। চোখ দুটো ভোলাই রয়েছে। মাসিমার নির্দেশমতো চুপি চুপি এলেও বড়মামা ধরে ফেলে, ‘কীসের অনুসন্ধান ভাগনে?’
‘না, কোনও অনুসন্ধান নেই। বেড়াতে এসেছি।’
‘তা ভালো। তবে আমি জানি, কী কারণে এসেছিস!’
‘কী কারণে!’
‘কুসী পাঠিয়েছে। দেখে আয় তো কী করছে!’
‘মিথ্যে কথা বলব না, মাসিমা বললে দেখে আয় তো বড়টা অনেকক্ষণ ছাদে একলা রয়েছে, কী আবার অপকর্ম করছে।’
‘এ অপবাদ আমার ঘুচল না রে ভাগনে! এতখানি বয়েস হল আমার। তুই সেই গল্পটা জানিস?’
‘কোনটা?
‘গুড়ের ফোঁটা।’
‘না।’
‘তাহলে শোন। এক মুদিখানার দোকানের বাইরে দুই ভদ্রলোক বাঁশের মাচানে পাশাপাশি বসে আছে। ওদিকে দোকানি বসে আছে টাটে। খুব কেনাবেচা চলছে। সকালের ভিড়। ওই দুই ভদ্রলোকের একজন হল শয়তানের দূত আর একজন দেবদূত, দেবতাদের দূত। শয়তানের দূত খুব দুঃখ করে দেবদূতকে বলছে, ‘দ্যাখো ভাই, পৃথিবীর যেখানে যত গণ্ডগোল, লোকে বলে শয়তানের কারসাজি। আমার প্রভুর এমনই বরাত। আচ্ছা, এই যে গুড়ো টিনটা এইখানে রয়েছে, এর থেকে আঙুলে করে একটা ফোঁটা নিয়ে আমি এই বাঁশের খোঁটায় লাগালুম।’
শয়তানের দূত ছোট্ট একটা ফোঁটা লাগিয়ে দেবদূতের পাশে এসে বসল। দেবদূতকে প্রশ্ন করল, ‘এর মধ্যে তুমি শয়তানের কোনও কারসাজি দেখতে পাচ্ছ?’
দেবদূত বললে, ‘না। অনেকেই অমন করতে পারে। খদ্দেররাও অনেকে আঙুলে কিছু লাগলে বাঁশের গায়ে মুছে দেয়।’
শয়তানের দূত বললে, ‘তবে? সব দোষ আমার প্রভুর ঘাড়ে! আচ্ছা, আমি তবে আসি ভাই। তুমি খানিক বসে যাও।’
শয়তানের দূত চলে গেল। দেবদূত বসে রইল উদাস। দেবদূতদের মাঝে মাঝে অমন হয়, কিছু করতে ইচ্ছে করে না। ঘন ঘন হাই ওঠে। মানুষ হলে চা খেত। দেবদূতদের তো চা খাওয়া বারণ। চা হল শয়তানের আরক। দেবদূত দেখছে, গুড়ের ফোঁটাটা লক্ষ্য করে এক-সার পিপড়ে বাঁশ বেয়ে উঠছে। আর বেশ মোটাসোটা একটা টিকটিকি একেবারে টঙে নীচের দিকে মুখ ঝুলিয়ে স্থির। কোথাও কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নেই। খদ্দেররা আসছে-যাচ্ছে। দাঁড়িপাল্লা, বাটখারার শব্দ। নানা কথা। কখনও বচসা। দেবদূত দেখছে, টিকটিকিটা পিঁপড়ে ধরার লোভে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। তা এগোক। টিকটিকির কাজ টিকটিকি করুক। একটা বেড়াল আধবোজা চোখে থুপ্পি মেরে বসেছিল। বেড়ালটা টিকটিকি দেখে মারলে লাফ। একটা কালো মুশকো কুকুর ঝিমোচ্ছিল এক পাশে। চিরশত্রু বেড়াল। ঝাঁপিয়ে পড়ল বেড়ালটার ঘাড়ে। এইবার বেড়াল আর কুকুর ঝটাপটি করতে করতে দোকানদারের ঘাড়ে। দোকানদার এক লাফ। মাথার কাছে তাকে। তাকে যত কৌটো-ফৌটো ছিল সব পড়তে লাগল শিলাবৃষ্টির মতো। খরিদ্দার ভয়ে ছুটোছুটি। নিমেষে দোকান লন্ডভন্ড! দেবদূতও দৌড় মেরেছে। একটা গাছের তলায় শয়তানের দূত গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে। দেবদূত হাঁপাচ্ছে। শয়তানের দূত বললে, ‘এসো ভাই, বোসো, হাঁপাচ্ছ কেন?’ দেবদূত পাশে বসে বললে, ‘তোমার কেরামতি আছে ভাই।’ দেবদূত তাকিয়ে আছে। শয়তানের দূত বললে, ‘সবই আমার প্রভুর ইচ্ছা ভাই।’
বড়মামা গল্প শেষ করে বললে, ‘জানিস তো, আমার এই গুড়ের ফোঁটা। কুসীর দোষ নেই। সবই আমার বরাত। সেদিন খাটটাকে জানলার দিকে সরাব বলে যেইটানলুম, একটা পায়া মচকে। গেল। খাটটা এখন তোর ইনক্লাইনড প্লেন। এধারে শুলুম তো কিছুক্ষণের মধ্যে গড়িয়ে ওধারে। যেন খাদে পড়ে গেলুম গড়িয়ে। তারপরেই শুরু হল কসরত। গড়িয়ে ওপরে উঠতে হবে। সারারাত ধস্তাধস্তি। রাত ভোর। একে বলে একসারসাইজ অন ইনক্লাইনড প্লেন। এই ব্যায়ামের ফলে আমার ভুঁড়িটা কত উন্নত হয়েছে দ্যাখ।’
‘তাহলে মাসিমাকে কী বলব?’
‘বলবি, এক ভদ্রলোক অতি ভদ্রলোকের মতো ছাতে শুয়ে আছে।’
‘কেন শুয়ে আছ? শুয়ে কেন আছ?’
‘আমার মন খারাপ। আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে। মা ছাড়া পৃথিবীতে মানুষের আর কে আছে! ভাই, বোন, ভাগনে থাকাও যা, না-থাকাও তা। আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন, গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে তোকে পাঠাতেন না, নিজেই চলে আসতেন। আমার মাথার কাছে বসে চুলে হাত বোলাতে বোলাতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনাতেন, কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি, গাড়ি চালায় বংশীবদন, সঙ্গে যে যায় ভাগনে মদন।’
‘তা তুমি আরও কতক্ষণ এইভাবে শুয়ে থাকবে?
‘সে তো বলতে পারছি না, মন ভালো হলেই উঠে পড়ব।’
মাসিমাকে গিয়ে রিপোর্ট করলুম। মাসিমা বললে, ‘মা থাকলে কী করত?
‘মাথার শিয়রে বসে চুলে হাত বোলাতেন আর কুমোরপাড়া শোনাতেন।
‘তাই নাকি! মা যা রাগি ছিলেন! এমন একটা দিন ছিল না, যে বড়দা পেটানি খায়নি। ব্যাপার অন্য, চল তো, আমার সঙ্গে চল।’
মাসিমা ছাতে গিয়েই বললে, ‘এই ওঠো তো। ওঠো, ওঠো।
বড়মামা বললে, ‘অসম্ভব। এখন আমার মায়ের সঙ্গে কমিউনিকেশান চলছে। নানারকম মেসেজ আসছে, ডোন্ট ডিসটার্ব।’
‘তুমি উঠবে, না গায়ে আরশোলা ছাড়ব!’
আরশোলার ভয়ে বড়মামা একবার ভুবনেশ্বরে পালিয়েছিল। সেখান থেকে আবার পালিয়ে। এসেছিল কাঁকড়াবিছের ভয়ে। আরশোলার নাম শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল। মাসিমা বললে, ‘আমার এই কৌটোয় বেশ বড়সড়ো তেলচুকচুকে একটা আছে, পিঠের দিকেই ছাড়ি।’
বড়মামা এক লাফে ছাতের ট্যাংকের কাছে। মাসিমা আমাকে বললে, ‘মাদুরটা তোল।’ এই মাসখানেক আগে প্রচুর খরচ করে ছাতে পাথর বসানো হয়েছিল। একটা পাথর চৌচির। মাসিমা হুংকার করে উঠল।