৩
পরদিন ঘুম ভাঙতে ফ্রান্সিস দেখল হাসান আর তার বন্ধু দুজনেই চলে গেছে! ঘরে শুধু ও একা। শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগল এবার কি করা যায়? কি করে প্রতিদিনের খাবার যোগাড় করবে, অর্থ জমাবে, মকবুলকে খুঁজে বের করবে? দেশে তো ফিরতে হবে? তারপর নিজেদের একটা জাহাজ নিয়ে সোনার ঘণ্টা খুঁজতে আসতে হবে। সঙ্গে আনতে হবে সব বিশ্বস্ত বন্ধুদের। কিন্তু সেসব তো পরের কথা। এখন কিরা যায়? ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ ফ্রান্সিসের একটা বুদ্ধি এল। আচ্ছা মকবুলের সেই মস্ত বড় হীরের গল্পটা বাজারের কুয়োর ধারে বসে লোকদের শোনালে কেমন হয়? কত বিদেশী বণিকই তো বাজারে আসে। এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যে গল্পটা আগে শুনেছে। তাহলেই মকবুলের খোঁজ পাওয়া যাবে। কারণ মকবুল ছাড়া এই গল্প আর কে বলবে? ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। এতক্ষণে বাজারে লোকজন আসতে শুরু করেছে নিশ্চয়ই! কুয়োর ধারে খেজুর গাছটার তলায় বসতে হবে।
সে এক প্রকাণ্ড হীরে! মদিনা মসজিদের গম্বুজের চেয়েও বড়! কি চোখ ধাঁধানো আলো তার! দু’হাতে চোখ ঢেকে আমরা শুয়ে পড়লাম। সমস্ত গুহাটা তীব্র আলোর বন্যায় ভেসে যেতে লাগল। ফ্রান্সিস গল্পটা বলে চলল। লোকেরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল। কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করে গেল গাঁজাখুরী গপ্পো–অত বড় হীরে হয় নাকি? কিন্তু বেশির ভাগ লোকই হাঁ করে গল্পটা শুনল। প্রথম দিন তো। ফ্রান্সিস খুব একটা গুছিয়ে গল্পটা বলতে পারল না। তবু লোকের ভাল লাগল। গল্প বলা শেষ হলে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের হাতে কিছু মুদ্রা দিল। দেখাদেখি আরো কয়েকজন কিছু মুদ্রা দিল। ফ্রান্সিস মনে-মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল। যাক, প্রাণে বেঁচে থাকার একটা সহজ উপায় পাওয়া গেল। গল্প বলে যদি এইরকম রোজগার হয়, তাহলে খাওয়ার ভাবনাটা অন্তত মেটে।
পরের দিন থেকে ফ্রান্সিস আরো গুছিয়ে গল্পটা বলতে লাগল। কয়েকদিনের মধ্যেই সে বেশ ভালো গল্প বলিয়ে হয়ে গেল। গল্পটাকে আরো বাড়িয়ে, আরো নানারকম রোমহর্ষক ঘটনা যোগ করে লোকদের শোনাতে লাগল। রোজগারও হতে লাগল। কিন্তু এতদিনে কি এমন কাউকে পেল না, যে গল্পটা আগে শুনেছে। তবু ফ্রান্সিস হাল ছাড়ল না। প্রতিদিন গল্পটা বলে যেতে লাগল। সেই বাজারের কুয়োটার ধারে, খেজুরগাছটার নীচে বসে।
একদিন ফ্রান্সিস গল্পটা বলছে–সব সময় নয়, যখন সূর্যের আলো সরাসরি গুহাটায় এসে পড়ে, তখন দেখা যায় আলোর খেলা, কত রঙের আলো–
ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন বলে উঠল এ গল্পটা আমার শোনা।
ফ্রান্সিস গল্প বলা থামিয়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিদেশী ব্যবসায়ী। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–কোথায় শুনেছেন গল্পটা?
–হায়াৎ-এর সরাইখানায়।
–যে লোকটা গল্পটা বলেছে, তার নাম জানেন?
–না, সে নাম বলেনি।
–দেখতে কেমন?
–মোটাসোটা গোলগাল, বেশ হাসিখুশী।
ফ্রান্সিসের আর বুঝতে বাকি রইল না–লোকটা আর কেউ নয়, মকবুল। কিন্তু হায়াৎ? সে তো অনেকদূর। তিনদিনের পথ। উটের ভাড়া গুনবে, সে ক্ষমতা তো নেই। এদিকে শ্রোতারা অস্বস্তি প্রকাশ করতে লাগল। গল্পটা শেষ হয় নি। ফ্রান্সিস ফিরে এসে আবার গল্পটা বলতে লাগল।
কিছুদিন যেতেই কিন্তু গল্পটা লোকের কাছে পুরোনো হয়ে গেল। কে আর একই গল্প প্রতিদিন শুনতে চায়? বিদেশী বণিক-ব্যবসায়ী যারা আসত, তারাই যা দু-চারজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে শুনত। ফ্রান্সিস ভেবে দেখল–রোজগার বাড়াতে হলে আরও লোক জড়ো করতে হবে। নতুন গল্প শোনাতে হবে। এবার তাই সে সোনার ঘন্টার পর বলতে শুরু করল। চারিদিকে ভিড় করে দাঁড়ানো শ্রোতাদের উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস সুন্দর ভঙ্গীতে গল্পটা বলতে থাকে–নিশুতি রাত। ডিমেলোর গীর্জার পেছনে ঘন জঙ্গলে আগুনের আভা কিসের? সোনা গলানো চলছে। বিরাট কড়াইতে সোনা গলিয়ে ফেলা হচ্ছে। কেননা সোনার ঘন্টা তৈরী হবে। কবে তৈরী শেষ হবে? ডাকাত পাদরীরা সোনা গলায় আর ছাঁচে ঢালে। খুব জমে যায় গল্পটা। শ্রোতারা অবাক হয়ে সোনার ঘণ্টার গল্প শোনে, কেউ-কেউ মন্তব্য করে যত সব বাজে গল্প। চলেও যায় কেউ-কেউ। কিন্তু নতুন লোক জড়ো হয় আরো বেশী। এক সময় গল্পটা শেষ হয়। শ্রোতাদের উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলে–সোনার ঘণ্টা এখনও আছে, এই সমুদ্রের কোন অজানা দ্বীপে। তোমরা ভাই খুঁজে দেখতে পাব।
গল্প শেষ। শ্রোতাদের ভিড় কমতে থাকে। ফ্রান্সিস হাত পাতে। যাবার আগে অনেকেই কিছু কিছু সুলতানী মুদ্রা হাতে দিয়ে যায়। গল্পটা শুনে সবাই যে খুশী হয়েছে–ফ্রান্সিস বোঝে। ও আরও উৎসাহ পায়, কিন্তু বিপদ হল, এই গল্পটা বলতে গিয়েই।
জোব্বাপরা নিরীহ গোছের লম্বামত চেহারার একজন লোক মাঝে-মাঝে ফ্রান্সিসের পেছনে দাঁড়িয়ে গল্প শুনত। ফ্রান্সিস যেদিন থেকে প্রথম সোনার ঘন্টার গল্প বলতে লাগল, সেদিন থেকে লোকটা প্রত্যেক দিন আসতে লাগল। অনেকেই গল্প শুনতে জড়ো হয়। সবাইকে তো আর মনে রাখা যায় না। ফ্রান্সিস আপন মনে গল্পই বলে যায়।
একদিন ফ্রান্সিস যেই গল্পটা শেষ করেছে, পেছন থেকে লোকটা জিজ্ঞেস করল–তুমি সেই সোনার ঘন্টা দেখেছ?
ফ্রান্সিস পেছনে ফিরে লোকটাকে দেখল। গোবেচারা গোছের চেহারা। রোগা আর বেশ লম্বা। ফ্রান্সিস ওকে আমলই দিল না। হাত বাড়িয়ে শ্রোতাদের দেওয়া মুদ্রাগুলো নিতে লাগল।
–সেই সোনার ঘন্টা তুমি দেখেছ? লোকটা একই সুরে আবার করল প্রশ্নটা।
–না। ফ্রান্সিস বেশ রেগেই গেল।
–সেই ঘন্টার বাজনা শুনেছো?
–তোমার কি মনে হয়?
–আমার মনে হয় তুমি সব জান।
ফ্রান্সিস এবার অবাক চোখে লোকটার দিকে তাকাল। ঠাট্টা করে বলল–সবই যদি জানব, তাহলে কি এখানে গল্প বলে ভিক্ষে করি?
–তুমি নিশ্চয়ই জানো সেই সোনার ঘন্টা কোথায় আছে।
ফ্রান্সিস ওকে থামিয়ে দিতে চাইল। বিরক্তির সুরে বলল–বারে, গল্প গল্পই–গল্পের ঘন্টা সোনাই হোক আর রুপাই হোক, তাকে চোখেও দেখা যায় না তার বাজনাও শোনা যায় না।
হঠাৎ লোকটা পরনের জোব্বাটা কোমরের একপাশে সরাল। ফ্রান্সিস দেখল—তরোয়ালের হাতল। লোকটা একটানে খাপ থেকে খুলে চকচকে তরোয়ালের ডগাটা ফ্রান্সিসের থুতনির কাছে চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বলল–আমার সঙ্গে চলো।
নিরীহ চেহারার মানুষটা যে এমন সাংঘাতিক, ফ্রান্সিস আগে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত ও অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। টুকটাক কথা থেকে একেবারে থুতনিতে তরোয়াল ঠেকান। ফ্রান্সিস ভাবল, আজকে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম।
–চল। লোকটা তাড়া লাগল।
–কোথায়?
–গেলেই দেখতে পাবে।
এ আবার কোন ঝামেলায় পড়লাম। কিন্তু উপায় নেই। লোকটা যেমন তেরিয়া হয়ে আছে, গাঁইগুঁই করলে হয়তো গলায় তরোয়ালই চালিয়ে দেবে।
–বেশ, চল। ফ্রান্সিস লোকটার নির্দেশমত বাজারের পথ দিয়ে হাঁটতে লাগল। লোকটা খোলা তরোয়াল হাতে নিয়ে ওর পেছনে-পেছনে যেতে লাগল।
পথে যেতে-যেতে ফ্রান্সিস কোনদিকে যেতে হবে, তা বুঝতে না পেরে মাঝে-মাঝে থেমে পড়ছিল। লোকটা ওর পিঠে তরোয়ালের খোঁচা দিয়ে পথ দেখিয়ে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস মনে-মনে কেবল পালাবার ফন্দি আঁটতে লাগল। কিন্তু পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারল, লোকটা ভীষণ সতর্ক। একটু এদিক-ওদিক ওর পা পড়লেই লোকটা ধমক দিচ্ছে–সোজা হাঁট। পালাবার চেষ্টা করলেই মরবে। ফ্রান্সিস আবার সহজভাবে হাঁটতে লাগল। এবার খুব সরু গলি দিয়ে যেতে লাগল ওরা।
হাত বাড়ালেই বাড়ির দরজা, এত সরু গলি সেটা। ফ্রান্সিস নজর রাখতে লাগল কোন খোলা দরজা পায় কি না। পেয়েও গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে ফ্রান্সিস বসে পড়ল। লোকটা তরোয়াল নামিয়ে ওর গায়ের ওপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল কি হল?
ফ্রান্সিস এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল, তড়িৎগতিতে মাথা দিয়ে লোকটার পেটে গুতো মারলো লোকটা টাল সামলাতে পারল না, সেই পাথুরে গলিটায় চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। বাঁদিকের খোলা দরজাটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপরেই ছুটল ভিতরের ঘরের দিকে। বোঝাই যাচ্ছে গৃহস্থ বাড়ি, কিন্তু লোকজন কেউ নেই সে ঘরে। পাশের একটা ঘরে লোকজনের কথাবার্তা শোনা গেল, বোধহয় ওঘরে খাওয়া-দাওয়া চলছে। হঠাৎ ফ্রান্সিসের নজরে পড়ল দেয়ালে একটা বোরখা ঝুলছে। যাক আত্মগোপনের একটা উপায় পাওয়া গেল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বোরখাটা পরে নিল, তারপর এক ছুটে ভিতরে উঠোনে চলে এল। দেখল ছাদটা বেশী উঁচু নয়। জানলার গরাদে পা রেখে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠে পড়ল। তারপর ছাদের পর ছাদ লাফিয়ে লাফিয়ে পার হতে হতে বেশ দূরে চলে এল। এবার নামা যেতে পারে। এই জায়গায় ফ্রান্সিস মারাত্মক ভুল করল। আগে থেকে দেখে নিল না গলিটা ফাঁকা আছে কিনা। কাজেই লাফ দিয়ে পড়বি তো পড়, একটা লোকের নাকের ডগায় সে পড়ল। লোকটা বোধহয় গানটান করে। আপন মনে সুর ভাঁজতে-ভাঁজতে যাচ্ছিল। একটা বোরখা পরা মেয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল দেখে তো ওর গান বন্ধ হয়ে গেল। লোকটা হাঁ করে প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। ফ্রান্সিস তার আগেই ওর ঘাড়ে এক রদ্দা মারল। ব্যস! লোকটার মুখ দিয়ে আর টু শব্দটি বেরুল না। সে বেচারা কলাগাছের মত ধপাস করে পড়ে গেল।
ফ্রান্সিস দ্রুতপায়ে ছুটল গলি পথ দিয়ে। একটু পরেই একটা পাতকুয়ো। কুয়োটার ওপরে কপিকল লাগানো। দড়ি দিয়ে চামড়ার থলিতে করে মেয়েরা জল তুলছে। কুয়োটার চারপাশে বোরখা পরা মেয়েদের ভিড়। সবাই জল নিতে এসেছে। ফ্রান্সিসও সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল, কিন্তু হলে হবে কি? সেদিন ফ্রান্সিসের কপালটা সত্যিই মন্দ ছিল। সে তখনও জানত না সমস্ত এলাকাটাই সুলতানের সৈন্যরা ঘিরে ফেলেছে।
বাড়ি-বাড়ি ঢুকে তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। একটু পরেই সুলতানের সৈন্যরা কুয়োতলায় এসে হাজির। কুয়োতলার চারপাশের বাড়িতে তল্লাশি শেষ হল। ঠিক তখনই সৈন্যরা একজন লোককে ধরে নিয়ে এল। লোকটা হাত মুখ নেড়ে কি যেন বলতে লাগল। বোরখার আড়াল থেকে ফ্রান্সিস সবই দেখছিল। সে লোকটাকে চিনতে পারল। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সে এই লোকটার সামনেই পড়েছিল। এবার আর রক্ষে নেই। সৈন্যদের দলনেতা চীৎকার করে কি যেন হুকুম দিল। সব সৈন্য দল বেঁধে তরোয়াল উঁচিয়ে কুয়োতলার দিকে আসতে লাগল। মেয়েরা। ভয়ে তারস্বরে চীৎকার করে উঠল। সৈন্যদের নেতা হাত তুলে অভয় দিল। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। দুতিনজনের জলের পাত্র ভেঙে গেল। যে যেদিকে পারল পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু সৈন্যরা ছুটে গিয়ে ধরে ফেলতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল এই সুযোগ।
ফ্রান্সিস কুয়োতলার পাথর বাঁধানো চত্বর থেকে একলাফ দিয়ে নেমেই ছুটল সামনের বাড়িটা লক্ষ্য করে। দরজার কাছে পৌঁছেও গেল। কিন্তু–শন্ ন্-ন্ একটা ছুরিটা সামনের কাঠের দরজায় লাগল। একটা ছুরি ওর কানের পাশ দিয়ে বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল ও দাঁড়িয়ে পড়ল। ছুরিটা সামনের কাঠের দরজায় গভীর হয়ে বিঁধে গেল। একটুর জন্যে ওর ঘাড়ে লাগেনি।
পালাবার চেষ্টা করো না। পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল। ফ্রান্সিস আর নড়ল না। দাঁড়িয়ে রইল। ওর গা থেকে কেউ যেন বোরখা খুলে নিল। ফ্রান্সিস দেখল সেই রোগা লম্বামত লোকটা।
লোকটা হেসে বলল–আর হেঁটে নয়–এবার ঘোড়ায় চেপে চল।
ফ্রান্সিসের আর পালান হল না। ফ্রান্সিসকে রাখা হল মাঝখানে। চারপাশে সৈন্যদল। ওকে ঘিরে নিয়ে চলল। ওর পাশেই চলল সেই রোগা লম্বামত লোকটা। আমাদের পাথর বাঁধানো রাজপথে অনেকগুলো ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ উঠল। ওরা চলল সদর রাস্তা দিয়ে। ফ্রান্সিস তখনও জানতে পারেনি, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ও সব কিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিল। তবু কৌতূহল যেতে চায় না।
ব্যাপার কি? ওকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন?
সৈন্যদলের সঙ্গে ফ্রান্সিসও এগিয়ে চলল। আড়চোখে একবার লম্বামত লোকটাকে দেখে নিল! লোকটা নির্বিকার। কোন কথা না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্রান্সিস এবার লোকটাকে জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
–গেলেই দেখতে পাবে। লোকটা শান্ত স্বরে বলল।
–তবু আগে থেকে জানতে ইচ্ছে করে।
–সুলতানের কাছে।
ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল। বলে কি? দেশের সুলতান! দোর্দণ্ডপ্রতাপ তার। ফ্রান্সিসের মত নগণ্য একজন বিদেশীর সঙ্গে কি সম্পর্ক তার?
–কিন্তু আমার অপরাধ?
–সোনার ঘন্টার হদিশ তুমি জান।
–আমি কিছুই জানি না।
–সুলতানকে তাই বলো! এখন বকবক বন্ধ কর, আমরা এসে গেছি!
বিরাট প্রাসাদ সুলতানের। ফ্রান্সিস প্রাসাদটা দেখেছে আগে, কিন্তু সেটা বাইরে থেকে। আজকে প্রাসাদে ঢুকছে। স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন সে এই প্রাসাদে ঢুকবে।
মস্তবড় খিলানওলা দেউড়ি পেরিয়ে অনেকক্টা ফাঁকা পাথর বাঁধানো চত্বর। চত্বরটায় ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ উঠল—ঠকঠক্ এক কোণার দিকে ঘোড়াশাল। সেখানে ঘোড়া থেকে নামল সবাই। এবার সামনে সেই লম্বামত লোকটা চলল। তারপর ফ্রান্সিস। পেছনে তরোয়াল হাতে দু’জন সৈন্য। ওরা প্রাসাদের মধ্যে ঢুকল।
বিরাট-বিরাট দরজা–ঘরের পর ঘর পেরিয়ে চলল ওরা। সবগুলো ঘরই সুসজ্জিত দামী কার্পেট মোড়া মেঝে । রঙীন কাঁচ বসানো শ্বেতপাথরের দেয়াল। এখানে-ওখানে সোনালী রঙের কাজকরা লতা-পাতা ফুল। লাল টকটকে গদিতে মোড়া ফরাস, বসবার জায়গায় বড়-বড় ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে ছাদ থেকে। দরজা জানালা মীনে করা। সুন্দর কারুকাজ তাতে। দরজায় দরজায় ঝকঝকে বর্শা হাতে দ্বাররক্ষীরা দাঁড়িয়ে আছে। লম্বামত লোকটাকে কী দেখেই ওরা পথ ছেড়ে দিতে লাগল। একটা লোক ঘরে ঢুকে হাততালি দিল। সৈন্য দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
ঘরটা অন্য ঘরের তুলনায় ছোট। মাঝখানে লাল গদিমোড়া বাঁকানো পায়ার টেবিল দু’পাশের বসবার জায়গাগুলোও লাল গদিমোড়া। দেয়ালে, দরজায়, জানালায় অন্য ঘরগুলোর চেয়ে বেশী কারুকাজ। লোকটা ফ্রান্সিসকে বসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস বসল। লোকটা ভেতরের দরজা দিয়ে কোথায় চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল। কেমন সন্ত্রস্ত ভঙ্গি। ফ্রান্সিসের কাছে এসে মৃদুস্বরে বলল সুলতান আসছেন। উঠে দাঁড়িয়ে আদাব করবে।
ভেতরের দরজা দিয়ে সুলতান ঢুকলেন। ফ্রান্সিস সুলতান রাজা-বাদশাহের কাহিনী শুনেছেই। এতদিন। চোখে দেখেনি কোনদিন। আজকে প্রথম দেখল। সুলতান বেশ দীর্ঘদেহী, গায়ের রঙ যেন দুধে-আলতায় মেশান। দাড়ি-গোঁফ সুন্দর করে ছাঁটা। মাথায় আরবীদের মতই বিড়েবাঁধা সাদা দামী কাপড়ের টুকরো। তবে পরনে জোব্বানয়, একটা আঁটোসাঁটো পোশাক। তাতে সোনা দিয়ে লতাপাতার কাজ করা। বুকে ঝুলছে একটা মস্তবড় হীরে বসানো গোল লকেট। গলায় মুক্তোর মালা। সুলতানকে দেখেই লম্বামত লোকটা মাথা নুইয়ে আদাব করল। লোকটার দেখাদেখি ফ্রান্সিসও আদাব করল। সুলতান ফ্রান্সিসকে বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন–তোমার নাম কি?
–ফ্রান্সিস।
ফ্রান্সিস এতক্ষণে ভাল করে সুলতানের মুখের দিকে তাকাল। সুলতানের চোখের দৃষ্টিটা ফ্রান্সিসের ভাল লাগল না। কেমন ক্রুরতা সেই দৃষ্টিতে। বড় বেশী স্থির, মর্মভেদী।
–তুমি বাজারে যে গল্পটা বল–সোনার ঘন্টার গল্প—
–আজ্ঞে হ্যাঁ–মানে পেটের দায়ে—
–গল্পটা কোথায় শুনেছ?
–দেশে বুড়ো নাবিকদের মুখে।
–তোমার কি মনে হয়? গল্পটা সত্যি না মিথ্যে?
–কি করে বলি? তবে সত্যিও হতে পারে।
সুলতানের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। বললেন–ওকথা বলছ কেন?
–আমি সেই সোনার ঘন্টার বাজনা শুনেছি।
সুলতান ক্রুর হাসি হাসলেন, বললেন–শুধু বাজনা শোনা যায়, একমাত্র তুমিই জানো সেই সোনার ঘন্টা কোথায় আছে, কেমন করেই বা ওখানে যাওয়া যায়।
ফ্রান্সিস সাবধান হল। বেশী কিছু বলে ফেললে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। বলল–বিশ্বাস করুন সুলতান, আমি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানি না।
–তুমি নিজের চোখে সোনার ঘন্টা দেখেছ। সুলতান দাঁত চেপে কথাটা বললেন।
ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বুঝল–ভীষণ বিপদে পড়েছে সে। এমন লোকের খপ্পরে পড়েছে, যার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যে যাই বলুক না কেন, যতই বোঝাবার চেষ্টাই করুক না কেন–সুলতান কিছুতেই সে কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু ফ্রান্সিস বোঝাবার চেষ্টা করল সুলতান আমি বললাম তো সোনার ঘন্টার বাজনা আমি শুনেছি। তখন প্রচণ্ড ঝড়ে আর ডুবো পাহাড়ের ধাক্কায় আমাদের জাহাজ ডুবে যাচ্ছিল। তখন নিজের প্রাণ বাঁচাতেই প্রাণান্তকর অবস্থা। কোত্থেকে বাজনার শব্দটা আসছে, কতদূর সেটা, এসব ভাববার সময় কোথায় তখন?
–মিথ্যেবাদী ফেব্বেবাজ। সুলতান গর্জন করে উঠলেন। তারপর আঙুল নেড়ে লম্বামত লোকটাকে কি যেন ইশারা করলেন। লোকটা দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের পিঠে ধাক্কা দিল চলো।
ঘরের বাইরে আসতেই সৈন্য দুজন পেছনে দাঁড়াল। সামনে সেই লোকটা। ফ্রান্সিস ভেবেই পেল না, তাকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
প্রাসাদের পেছন থেকেই শুরু হয়েছে পাথরে বাঁধানো পথ। দুপাশে উঁচু প্রাচীর টানা চলে গেছে দুর্গের দিকে। কালো থমথমে চেহারার সেই বিরাট দুর্গের দিকে তারা ফ্রান্সিসকে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিসের আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। এই দুর্গেই তাকে বন্দী করে রাখা হবে। কতদিন কে জানে? ফ্রান্সিসের মন দমে গলে। সব শেষ। সোনার ঘন্টার স্বপ্ন দেখতে দেখতেই এই দুর্গের অন্ধকার কোন ঘরে লোকচক্ষুর অন্তরাল অনাহারে অনিদ্রায় তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই তার ভাগ্যের লিখন। আর তার মুক্তি নেই। কডুকডু শব্দ তুলে দুর্গের বিরাট লোহার দরজা খুলে গেল। ফ্রান্সিস বাইরের মুক্ত পৃথিবীর হাওয়া বুক ভরে টানল। তারপর অন্ধকারে স্যাঁতসেতে দুর্গের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল!
যে ঘরে ফ্রান্সিসকে রাখা হল, সেই ঘরটার দেওয়াল এবড়োখেবড়ো পাথর দিয়ে গাঁথা। দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে। তাতে অন্ধকারটা যেন আরো ভীতিকর হয়ে উঠেছে। দেয়ালে দুটো মস্তবড় আংটা লাগানো। তাই থেকে শেকল ঝুলছে। সেই শেকল দিয়ে ফ্রান্সিসের দুহাত বেঁধে রাখা হয়েছে।
সারারাত ঘুমুতে পারেনি ফ্রান্সিস। দুটো হাত শেকলে বাঁধা ঝুলছে। এ অবস্থায় কি ঘুম আসে? তন্দ্রা আসে? শরীর এলিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু লোহার শেকলে টান পড়তেই ঝনঝন শব্দ ওঠে। তন্দ্রা ভেঙে যায়। যে কজন পাহারাদার দরজার কাছে আছে, যে পাহারাদার খাবার দিয়ে গেছে–সবাইকে সে চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করছে আমাকে এই শাস্তি দেবার মানে কি?কিঅপরাধ করেছি আমি? কিন্তু পাহারাদারগুলো বোধহয় বদ্ধ কালা আর বোবা। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে অথবা আপন মনে নিজেদের কাজ করে গেছে। কথাও বলেনি, তার কথা যে ওদের কানে গেছেমুখ দেখেও তা মনে হয়নি। ঘুম হল না। হবার কথাও নয়। শেকলে ঝুলে ঝুলে কি ঘুম হয়? তন্দ্রার মধ্য দিয়ে রাত কাটাল। একসময় ভোর হল। সামনে একটা জানালা দিয়ে ভোরের আলো দেখা গেল। সারারাত ঘুম নেই। চোখ দুটো জ্বালা করছে।
একটু বেলা হয়েছে তখন। হঠাৎ লোহার দরজায় শব্দ উঠল ঝন ঝনাৎ। কাঁচ-কোচ শব্দ তুলে দরজাটা খুলে গেল। ফ্রান্সিস দেখল–সুলতান ঢুকছে। পেছনে সেই লম্বামত লোকটা। তার পেছনে মাথায় কালো কাপড়ের পাগড়ি, কালো আলখাল্লা পরা আর একটা লোক। তার হাতে চাবুক। সে চাবুকটা পেঁচিয়ে মুঠো করে ধরে রেখেছে।
–এই যে সাহেব–কেমন আছো? সুলতান ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞাসা করলেন।
ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না।
–যাক গে, সুলতান ব্যস্তভাবে বললেন–আমার তাড়া আছে। কি ঠিক করলে? সারারাত ভাবার সময় পেলে।
–কোন ব্যাপারে? ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।
সুলতান হো-হো করে হেসে উঠলেন–তুমি তো বেশ রসিক হে সব জেনেশুনে রসিকতা করছো–তাও আমার সঙ্গে।
–আমি যা জানি বলেছি–এর বেশি আমি আর কিছুই জানি না।
সুলতান একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন–সোনার ঘন্টা আমার চাই। তার জন্যে যদি তোমার মত দু চারশ লোকের মৃতদেহ ডিঙিয়ে যেতে হয়
–আমি তাই যাবো। তবু সোনার ঘন্টা আমার চাই।
ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সুলতান আঙ্গুল তুলে ইঙ্গিত করলেন। চাবুক হাতে লোকটা এগিয়ে এল। কপাল পর্যন্ত ঢাকা কালো পাগড়ি। মুখটা দেখা না গেলেও শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। যেন খুশীতে জ্বলজ্বল করছে। কি নিষ্ঠুর! ফ্রান্সিস ঘৃণায় মুখ ফেরাল।
ঝপাৎ–চাবুকের আঘাতটা পেটের কাছ থেকে কাঁধ পর্যন্ত যেন আগুনের ছ্যাকা লাগিয়ে দিল। ফ্রান্সিসের সমস্ত শরীরটা শিউরে উঠল। ঝপাৎ–আবার চাবুক। তার সবটুকু শরীরে লাগল না। তবু হাতটা জ্বালা করে উঠল; সুলতান হাত তুলে চাবুক থামাতে ইঙ্গিত করলেন। বললেন–এখনও বলল কোথায় আছে সেই সোনার ঘন্টা?
–আমি যা জানি বলেছি।
ঝপাৎ–আবার চাবুক। বন্ধ মুখ কি করে খুলতে হয় আমি জানি। কথাটা বলে সুলতান চাবুকওয়ালার দিকে তাকালেন। বললেন, যতক্ষণ না কথা বলতে চায় ততক্ষণ চাবুক চালাবে। কিছু বলতে চাইলে সুলতান আঙ্গুল দিয়ে লম্বামত লোকটাকে দেখালেন–রহমানকে খবর দেবে। কালো পোশাক পরা চাবুকওলা মাথা ঝুঁকিয়ে আদাব করল। সুলতান দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগোলেন। রহমানও পেছনে-পেছনে চলল।
ঝপাৎ–চাবুকের শব্দে ফ্রান্সিস চমকে উঠল।
কিন্তু আশ্চর্য! এবারের চাবুকটা ওর গায়ে পড়ল না–দেয়ালে পড়ল। আবার ঝপাৎ–এবারও দেওয়ালে লাগল। লোকটা কি নিশানা ঠিক করতে পারছে না? ঝপাৎ–ঝপাৎ হঠাৎ কয়েকবার দ্রুত চাবুকটা দেয়ালে মেরে লোকটা চাবুক হাতে ফ্রান্সিসের কাছে। এগিয়ে এল। যেন ফ্রান্সিসকে পরীক্ষা করেছে, অজ্ঞান হয়ে গেছে কিনা–এমনি ভঙ্গিতে ফ্রান্সিসের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। তারপর কপালের কাছ থেকে পাগড়িটা ওপরের দিকে তুলল। কপালে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল–ফজল! এবার ফ্রান্সিস ভালোভাবে লোকটার মুখের দিকে তাকাল। আরে? এ তো সত্যিই ফজল! মুখে ভুযোমত কি মেখেছে তাই চেনা যাচ্ছিল না। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল–ফজল।
ফজল ঠোঁটে হাত রাখল। তারপর ফিসফিস করে বলল–সামনে জানালাটা দেখেছো!
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিসও চাপাস্বরে উত্তর দিলো।
–গরাদ নেই।
–হ্যাঁ।
–সোজা ওখান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। খাড়া পাহাড়ের গা–কোথাও ঘা খাবার ভয় নেই–নীচে সমুদ্রের জল, তারপর ডুব সাঁতার, পারবে তো?
–নিশ্চয় পারবো।
এমন সময় দুজন সৈন্য ঘুরে ঢুকল। ফজল সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে চাবুক চালাল। এবারে চাবুকের ঘাটা ফ্রান্সিসের গায়ে লাগল। ফ্রান্সিসের মুখ দিয়ে কাতরোক্তি বেরিয়ে এল। সৈন্যদের একজন বলল–কি হল এখনও যে মুখ থেকে শব্দ বেরুচ্ছে।
ফজল ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে-চেয়ে চোখ টিপে বলল–এই শেষ ঘা, এটা আর সহ্য করতে হচ্ছে না বাছাধনকে। বলেই চাবুক চালাল–ছপাৎ। ফ্রান্সিসের গায়ে লাগল না। দেয়ালে লেগেই শব্দ উঠল।
ফ্রান্সিস অজ্ঞান হবার ভঙ্গি করল। হাত ছেড়ে দিয়ে শেকলে ঝুলতে লাগল।
–এঃ। নেতিয়ে পড়েছে–একজন সৈন্য ফজলকে লক্ষ্য করে বলল–আর মেরো না। ফজল চটে ওঠার ভান করল–তোমরা নিজেরা নিজেদের কাজ করো গে যাও। আমি এই ভিনদেশীটাকে একেবারে নিঃশেষ করে ছাড়বো।
–তাহলে তোমারই গর্দান যাবে। একজন সৈন্য বলল।
–কেন?
–সুলতান বলেছেন, যে করেই হোক এই ভিনদেশীটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে–নইলে সোনার ঘন্টার হদিশ দেবে কে?
–হুঁ, তা ঠিক। তাহলে এখন থাক, কি বল?
দু’জন সৈন্যই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। ফজল চাবুকটা হাতে পাকাতে-পাকাতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল–যাঃ জোর বেঁচে গেলি।
সবাই চলে গেল। ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ তুলে দরজাটা বন্ধ হল। পাহারাদার দরজায় তালা লাগাল।
ফ্রান্সিস এবার আস্তে আস্তে শব্দ না করে উঠে দাঁড়াল। জানালাটার দিকে ভালো করে তাকাল! ফজল ঠিকই বলেছে। জালানাটায় কোন গরাদ নেই। পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে কেউ নেমে যাবে এটা অসম্ভব। তাই বোধহয় সুলতান জানালাটাকে সুরক্ষিত করবার প্রয়োজন মনে করেননি। জানালার ওপাশে রাত্রির অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস কেবল পালাবার ফন্দি করতে লাগল। যে করেই হোক পালাতেই হবে। পালাতে গিয়ে যদি মৃত্যু হয় আফশোসের কিছু নেই। কারণ না পালালেও তার মৃত্যু অবধারিত।
পরের সমস্তটা দিন কেউ এল না। একজন পাহারাদার শুধু খাবার দিয়ে গেল। সুলতানও এলো না–চাবুক মারতে ফজলও এল না। কি ব্যাপার।
ফ্রান্সিস ভাবল–হয়তো সুলতান সদয় হয়েছে। সে যে সত্যিই সোনার ঘন্টার হদিশ জানে না, এটা বোধহয় সুলতান বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু সন্ধ্যের পরেই ফ্রান্সিসের ভুল ভাঙল। সুলতান যে কত বড় শয়তান, সে পরিচয় পেতে বিলম্ব হল না।
সন্ধ্যের একটু পরে তিন-চারজন পাহারাদার এল ফ্রান্সিসের ঘরটায়। বড়-বড় সাড়াশি দিয়ে একটা গনগনে উনুন ধরাধরি করে নিয়ে এল ওরা। ফ্রান্সিস অবাক। উনুন দিয়ে কি হবে? ফ্রান্সিস দেখল–দুটো লম্বা লোহার শিক উনুনটায় গুঁজে দেওয়া হলে।
একটু পরেই সুলতান এলেন। সঙ্গে রহমান। ফ্রান্সিস রহমানের পেছনে তাকাল। না ফজল আসে নি। ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একমাত্র ভরসা ছিল ফজল। আজকে সেও নেই। ফ্রান্সিস মনকে শক্ত করল। ফজল যা বুদ্ধি দেবার দিয়ে গেছে। এর বেশী ও একা আর কি করতে পারে? এবার বাঁচতে হলে ফ্রান্সিসকে নিজের সাহস, প্রত্যুতপন্নমতিত্ব আর বুদ্ধির ওপর নির্ভর করতে হবে। সারারাত ধরে যে ফন্দিটা মনে মনে এঁটেছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।
–কি হে–চাবুকের মার খেযেও তো বেশ চাগগা আছ দেখছি। সুলতান মুখ বেঁকিয়ে হেসে বললেন।
ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সুলতান বললেন–এবার চটপট বলে ফেল বাছাধন, নইলে—
–সুলতান আপনি মিছিমিছি একটা নির্দোষ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছেন।
–ঠিক আছে সোনার ঘন্টার হদিশ বলে ফেল–আমি এক্ষুণি তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি।
–আমি যা জানি সেটা—
ফ্রান্সিসের কথা শেষও হল না। সুলতান আঙ্গুল নেড়ে ইঙ্গিত করলেন। একজন পাহারাদার গনগনে উনুন থেকে লাল টকটকে শিক দুটো তুলে নিল। তারপর ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
–এখন বলো–নইলে জন্মের মত .খ দুটো হারাতে হবে। সুলতানের চড়া গলা শোনা গেল।
ফ্রান্সিস শিউরে উঠল। মানুষ এমন নৃশংসও হয়? ততক্ষণে লোকটা শিক দুটো ওর চোখের সামনে নিয়ে এসেছে। আগুনের উত্তাপ মুখে লাগছে। চোখের একেবারে কাছে লাল শিক দুটো। লাল টকটকে শিকের মুখ ছাড়া ও আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আর এক মুহূর্ত। পৃথিবীর সমস্ত আলো রং হারিয়ে যাবে চিরদিনের মত। আর দেরি করা যায় না। ফ্রান্সিস চিৎকার করে উঠল নানা সব বলছি আমি। সুলতান ইঙ্গিতে লোকটাকে সরে যেতে বললেন।
–এই তো সুবুদ্ধি হয়েছে। সুলতান হাসলেন।
–সব বলছি সুলতান। কিন্তু তার আগে আমার হাতের শেকল খুলে দিতে বলুন। সুলতান ইঙ্গিত করলেন। একজন পাহারাদার এসে ফ্রান্সিসের হাতের শেকল খুলে দিল। দুহাতে কবজির কাছে লোহার কড়ার দাগ পড়ে গেছে। সেই দাগের ওপর হাত বুলিয়ে ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে একজন পাহারাদারের খাপ থেকে তরোয়ালটা খুলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাহারাদাররা সাবধান হয়ে গেল। সবাই যে যার তরোয়ালের হাতলে হাত রাখল। এমন কি সুলতানও। ফ্রান্সিস সকলের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর তরোয়ালটা দিয়ে পাথরের মেঝেতে দাগ কাটতে লাগল। সবাই দেখলো ফ্রান্সিস একটা জাহাজের ছবির মত কিছু আঁকছে। সুলতানেরও কৌতূহল। সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস বলতে লাগল–সুলতান এই হল আপনার জাহাজ। এখান থেকে সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লক্ষ্য করে আপনাকে যেতে হবে।
সুলতান মাথা ঝাঁকালেন। ফ্রান্সিস এখানে-ওখানে কয়েকটা ঢ্যাঁড়া দিল, বলল–এইগুলো হল দ্বীপ। জনবসতি নেই। সব কটাই পাথুরে দ্বীপ। এসব পেরিয়ে যেতে হবে একটা ডুবো পাহাড়ের কাছে। ডুবো পাহাড়টা উঁচু হবে–এই ধরুন ঐ জানালাটা থেকে–ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে জানালাটার দিকে এগোল। বলতে লাগল–এই জানালাটা থেকে হাত পাঁচেক—বলেই ফ্রান্সিস হঠাৎ তরোয়ালটা দাঁতে চেপে ধরে জানালাটার দিকে তীরবেগে ছুটল এবং কেউ কিছু বোঝবার আগেই জানালার মধ্যে দিয়ে বাইরের অন্ধকারে রাত্রির শূন্যতায় ঝাঁপ দিল। কানের দুপাশে সমুদ্রের মত্ত হাওয়ার শোঁ-শোঁ শব্দ। বাতাস কেটে ফ্রান্সিস নামছে তো নামছেই।
হঠাৎ–ঝপাং। জলের তলায় তলিয়ে গেল ফ্রান্সিস। পরক্ষণেই ভেসে উঠল–জলের ওপর। সমুদ্রের ভেজা হাওয়া লাগছে চোখেমুখে। মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত আকাশ। ফ্রান্সিসের সমস্ত দেহমন আনন্দের শিহরণে কেঁপে উঠল। আঃ–মুক্তি!
ওদিকে দুর্গের জানালায়, জানালায় প্রাচীরের ওপর সৈন্যরা মশাল হাতে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে ফ্রান্সিসকে খুঁজছে। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা কোমরে গুঁজে নিল। তারপর গভীর সমুদ্রের দিকে সাঁতার কাটতে লাগল। চচপ–জল কেটে তীর ঢুকছে। সৈন্যরা আন্দাজে তীর ছুঁড়তে শুরু করেছে। ফ্রান্সিস আর মাথা ভাসিয়ে সাঁতার কাটতে ভরসা পেল না। যদি একবার নিশানা করতে পারে! সে ডুব সাঁতার দিতে লাগল। ডুবসাঁতার দিতে দিতে অনেকটা দূরে চলে এল। পেছন ফিরে দেখল-দুৰ্গটা। এখনও দেখা যাচ্ছে। মশালের ক্ষীণ আলোগুলো নড়ছে। আবার ডুব দিল ফ্রান্সিস। হঠাৎ কিসের একটা টান অনুভব করল। সমুদ্রের নীচের স্রোত ওকে টানছে। একটু পরেই টানটা আরো প্রবল হল আর তাকে মুহূর্তের মধ্যে অনেকদূরে নিয়ে গেল। এবার ভেসে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখল সব অন্ধকার। দুর্গের চিহ্নমাত্রও দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত মনে সাঁতার কাটতে লাগল।
সারারাত সাঁতার কাটল ফ্রান্সিস। অবসাদে হাত নড়তে চায় না। তখন কোনরকমে শুধু ভেসে থাকা। এইভাবে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে সাঁতার কেটে চলল। পূবের আকাশে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। একটু পরেই পূর্বকোণায় লাল সূর্য উঠল। আবার সমুদ্রে সেই সূর্যোদয়ের দৃশ্য। ফ্রান্সিস ভালো করে তাকাতে পারছে না। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সবকিছু যেন ঝাপসা দেখাচ্ছে।
তবু চেয়ে-চেয়ে সূর্য ওঠা দেখল। কত পরিচিত দৃশ্য। তবু ভালো লাগল। আবার নতুন করে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা–আবার এই পুরোনো পৃথিবী আকাশ, সূর্যোদয় দেখা। ফ্রান্সিসের হাত আর চলছেনা। হাত পা ছেড়ে দিয়ে ভেসে চলল অনেকক্ষণ। হঠাৎ সামনেই দেখে একটা পাথুরে দ্বীপ। হোক ছোট দ্বীপ–হাত পা ছড়িয়ে একটু বিশ্রাম তো নেওয়া যাবে। দ্বীপটার কাছাকাছি আসতেই পায়ের নীচে পাথুরে মাটি ঠেকল। শ্যাওলা ধরা পাথরে পা টিপে টিপে দ্বীপটায় উঠল। তারপর একটা মস্ত বড় পাথরের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কানে আসছে সামুদ্রিক পাখির ডাক আর দ্বীপের পাথরে সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ। হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে হল–সামুদ্রিক পাখিরা তো এমনি সব দ্বীপেই ডিম পারে। দেখাই যাক না দুটো একটা ডিম পাওয়া যায় কিনা। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। পাথরের খাঁজে খাঁজে গর্ত খুঁজতে লাগল। প্রথম গর্তটায় কিছুই পেল না। শুধু খড়কুটো শুকনো ঘাস। পরের গর্তটায় ডিমের মস্ত খোল হাতে ঠেকল। দুটো ডিম! ফ্রান্সিস আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ডিম দুটো পাথরে ঠুকে ভেঙে খেয়ে নিল। আঃ কি তৃপ্তি! কিন্তু আর শুয়ে থাকা নয়। এখনও নিরাপদ নয় সে। যদি সুলতানের সৈন্যরা জাহাজ বা নৌকা নিয়ে ওকে খুঁজতে বেরোয়? অনেকক্ষণ তো বিশ্রাম নেওয়া গেল। পেটেও কিছু পড়ল। এবার জলে নামতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা থেকে দূরে পালাতে হবে।
ফ্রান্সিস জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পূর্ণোদ্যমে সাঁতার কাটতে লাগল। সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছে। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। উজ্জ্বল রোদ জলের ঢেউয়ের মাথায় ঝিকিয়ে উঠছে। ফ্রান্সিস এবার ডুব দিল–আশা–যদি জলের তলায় কোন স্রোতের সাহায্য পায়। কিন্তু না। নীচে কোন স্রোত নেই। ওপরে ভেসে ওঠার আগে হঠাৎ দেখল ওর ঠিক হাত পাঁচেক সামনে একটা মাছের লেজের মত কি যেন দ্রুত সরে গেল।
হাঙর! হাঙরের মুখ করাতের দাঁতের মত দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস মনে-মনে সাহস সঞ্চয় করতে লাল। এখন ভয় পাওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। হাঙরটা আর একবার সাঁৎ করে ওর পায়ের খুব কাছ দিয়ে ঘুরে গেল। বোধহয় পরখ করে নিচ্ছে লোকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কিনা হাতে অস্ত্র আছে কিনা।
ফ্রান্সিস ভেবে দেখল–ওটাকে এক আঘাতেই নিকেশ করতে হবে—নইলে–একটু আধটু খোঁচা খেলে সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে যাবে। তখন আর এঁটে ওঠা যাবে না। হাঙরের চলাফেরা জলের ওপর থেকে বোঝা যাবে না। ডুব দিয়ে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস কোমর থেকে তরোয়ালটা খুলল। তারপর ডুব দিল। ঝাপসা দেখল–হাত দশেক দূরে হাঙরটা এক পাক ঘুরেই সোজা ওর দিকে ছুটে আসছে! ফ্রান্সিস তরোয়ালের হাতলটা শক্ত করে ধরল। হাঙরটা কাছাকাছি আসতেই ফ্রান্সিস দু’পায়ে জলে ধাক্কা দিয়ে আরো নিচে ডুব দিল। হাঙরটা তখন ওর মাথার ওপর চলে এসেছে। ফ্রান্সিস শরীরের সমস্তশক্তি দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে তরোয়ালটা হাঙরের বুকে বসিয়ে দিল। হাঙরটা শরীর এঁকিয়ে-বেঁকিয়ে ল্যাজ ঝাঁপটাতে লাগল। ফ্রান্সিস তরোয়াল ছাড়ল না। এখন ঐ তরোয়ালটাই একমাত্র ভরসা। এটাকে কিছুতেই হারানো চলবে না। ফ্রান্সিস তলোয়ালের হাতলটা ধরে জলের ওপরে মুখ তুলল। তখনও হাঁপাচ্ছে। কিন্তু হাঙরটা যেভাবে শরীর মোচড়াচ্ছে–তাতে তরোয়ালটা ধরে রাখাই কষ্টকর।
ফ্রান্সিস আবার ডুব দিল। হাঙরটার পেটে একটা পা চেপে প্রাণপণ শক্তিতে তরোয়ালটা টানল। তরোয়ালটা উঠে এল। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় লাল রক্তে জলটা লাল হয়ে যেতে লাগল। হাঙরটা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি তরোয়ালটা কোমরে গুঁজে পাগলের মত সাঁতার কাটতে লাগল। এই সাংঘাতিক জায়গাটা এখুনিই ছেড়ে যেতে হবে। রক্তের গন্ধ পেলে আরো হাঙর এসে জুটবে তখন?
ফ্রান্সিস আর ভাবতে পারল না। সাঁতারের গতি আরো বাড়িয়ে দিল।
কতক্ষণ এভাবে সাঁতার কেটেছে তা সে নিজেই জানে না, কিন্তু শরীর আর চলছে না চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইছে। ঠিক তখনই ফ্রান্সিস অস্পষ্ট দেখতে পেল বাতাসে ফুলে ওঠা পাল। জাহাজ! ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি জল থেকে মুখ তুলে দু’চোখ কচলে তাকাল। হ্যাঁ–জাহাজই। খুব বেশি দূরে নয়। আনন্দে ফ্রান্সিস চিৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। সে তাড়াতাড়ি গায়ের ঢোলাহাতা জামাটা তরোয়ালের ডগায় আটকে জলের ওপর নাড়তে লাগল। একটুক্ষণ নাড়ে। তারপর তরোয়ালটা নামিয়ে দম নেয়। আবার নাড়ে। জাহাজের লোকগুলো বোধহয় ওকে দেখতে পেয়েছে। জাহাজটা ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
ঝপাং–জাহাজ থেকে দড়ি ফেলার শব্দ হল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি দড়ির ফাঁসটা কোমরে বেঁধে নিল। তারপর দু’হাত দিয়ে ঝোলান দড়িটা ধরল। কপিকলে কাঁচকাঁচ শব্দ উঠল। নাবিকেরা ওকে টেনে তুলতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল–জাহাজের রেলিঙে অনেক মানুষের উৎসুক মুখ। নিচে জলের মধ্যে ল্যাজ ঝাঁপটানোর শব্দে ফ্রান্সিস নিচের দিকে তাকাল। মাত্র হাত সাতেক নিচে জলের মধ্যে হাঙরের পাল অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্রান্সিস শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল।
জাহাজটা ছিল মালবাহী জাহাজ। নাবিকেরা বেশিরভাগই আফ্রিকার অধিবাসী। কালো-, কালো পাথরের কুঁদে তোলা শরীর যেন। ইউরোপীয় সাদা চামড়ার মানুষ যে ক’জন ছিল, ফ্রান্সিস তাদের মধ্যে নিজের দেশের লোক কাউকে দেখতে পেল না।
ফ্রান্সিসের বিছানার চারপাশে নাবিকদের ভিড় জমে গেল। সবাই জানতে চায় ওর কি হয়েছিল, কোথা থেকে আসছিল, যাবেই বা কোথায়? কিন্তু ফ্রান্সিস তাকিয়ে-তাকিয়ে ওদের দেখছিল শুধু। কথা বলার শক্তি ওর অবশিষ্ট নেই। শুধু ইশারায় জানাল–ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। কয়েকজন নাবিক ছুটল খাবার আনতে।
রুটি আর মুরগীর মাংস পেট পুরে খেল ফ্রান্সিস। ওর যখন খাওয়া শেষ হয়েছে তখনই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল জাহাজের ক্যাপটেন। গোলগাল মুখ, পাকানো গোঁফ, ছুঁচালো দাড়ি। ক্যাটেনকে দেখে ভিড় অনেক পাতলা হয়ে গেল। যে যার কাজে চলে গেল। ক্যাপটেন ফ্রান্সিসের বিছানার পাশে বসল। জিজ্ঞেস করল–আপনার কি জাহাজডুবি হয়েছিল?
ফ্রান্সিস ঘাড় কাত করল। ক্যাপটেন বলল–কোথায় যাচ্ছিলেন?–যাবার কথা ছিল মিশরের দিকে। কিন্তু–ফ্রান্সিস দুর্বল কণ্ঠে বলল।
–ও, তা আর কেউ বেঁচে আছে?
–জানি না।
ক্যাপটেন উঠে দাঁড়াল–আপনাকে আর বিরক্ত করব না। আপনি বিশ্রাম করুন, দু’চার দিনের মধ্যেই সেরে উঠবেন।
–এই জাহাজ কোথায় যাচ্ছে?
–পর্তুগাল।
খুশীতে ফ্রান্সিসের মন নেচে উঠল। যাক, দেশের কাছাকাছিই যাবে। তারপর ওখান থেকে দেশে যাওয়ার একটা জাহাজ কি আর পাওয়া যাবে না?
তিন দিন ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে উঠল না। চার দিনের দিন ডেক-এ উঠে এল। এদিক-ওদিক একটু পায়চারি করল। রেলিঙে ভর দিয়ে সীমাহীন সমুদ্রের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দু’একজন নাবিক এগিয়ে এসে ওর শরীর ভালো আছে কিনা জানতে চাইলো! ফ্রান্সিস সকলকেই ধন্যবাদ দিল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ওরা তাকে বাঁচিয়েছে। নানা কথাবার্তা হল ওদের সঙ্গে। কিন্তু ফ্রান্সিস সোনার ঘন্টার কথা, মরু-দস্যুদের কথা, সুলতানের দুর্গে বন্দী হয়ে থাকার কথা–এসব কিছু বললো না। কে জানে আবার কোন বিপদে পড়তে হয়।
কয়েকদিন বিশ্রাম নেবার পর ফ্রান্সিসের শুধু শুয়ে-শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগল না। নাবিকের কাজ করবার অভিজ্ঞতা তো ওর ছিলই। একদিন ক্যাপটেনকে বলল সেকথা! ছুঁচালো দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে ক্যাপটেন বলল এখন তোমার শরীর ভালো সারেনি।
–আমি পারবো।
–বেশ হালকা ধরনের কাজ দিচ্ছি তোমাকে।
এ বন্দরে সে বন্দরে মাল খালাস করতে করতে প্রায় দুমাস পরে জাহাজটা পর্তুগালের বন্দরে পৌঁছল।
যাত্রা শেষ। বন্দরে জাহাজ পৌঁছতেই নাবিকেরা সব শহরে বেরুল আনন্দ হই-হুঁল্লা করতে। ফ্রান্সিস গেল অন্য জাহাজের খোঁজে। ওর দেশের দিকে কোন জাহাজ যাচ্ছে কিনা। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। পেয়েও গেল একটা জাহাজ। ওদের দেশের রাজধানীতে যাচ্ছে। পরদিন ভোর রাত্রে ছাড়বে জাহাজটা। আগের জাহাজে কাজ করে ফ্রান্সিস যা জমিয়েছিল, সবটাই দিল এই জাহাজের ক্যাপটেনকে। ক্যাপটেন ওকে নিতে রাজী হল। জাহাজটা ছোট। মালবাহী জাহাজ। নাবিকের সংখ্যাও কম। অনেকের সঙ্গে আলাপ হল ফ্রান্সিসের। শুধু একজন বৃদ্ধ নাবিকের সঙ্গে ফ্রান্সিসের খুব ভাব হল। ডেক ধোয়া-মোছার সময় ফ্রান্সিস তাকে সাহায্য করত।
একদিন সন্ধ্যেবেলা সেই বৃদ্ধনাবিকটি ডেক-এর রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চুরুট খাচ্ছিল। ফ্রান্সিস তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা একবার ফ্রান্সিসকে দেখে নিয়ে আগের মতই আপন মনে চুরুট খেতে লাগল। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–আপনি কত জায়গায় ঘুরেছেন?
নাবিকটা শূন্যে আঙুলটা ঘুরিয়ে বলল–সমস্ত পৃথিবী।
–সোনার ঘন্টার গল্পটা জানেন?
নাবিকটি ফ্রান্সিসের দিকে ঘুরে তাকাল। এ রকম একটা প্রশ্ন সে বোধহয় আশা করেনি। মৃদুস্বরে জবাব দিল–জানি।
–আপনি বিশ্বাস করেন?
–করি।
–আমি সেই সোনার ঘন্টার খোঁজেই বেরিয়েছিলাম।
–কিছু হদিস পেলে?
–ঠিক বলতে পারছি না, তবে ভূমধ্যসাগরের একটা জায়গায় নাবিকটা ওকে ইঙ্গিতে থামিয়ে দিয়ে ম্লান হাসল কুয়াশা, ঝড় আর ডুবো পাহাড়–তাই কি না?
ফ্রান্সিস আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল–তাহলে আপনি, —
–হ্যাঁ, ভাই–আমাদের জাহাজ প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। তবে আমরা বহু কষ্টে পেছনে। হটে আসতে পেরেছিলাম। তাই জাহাজ ডুবির হাত থেকে বেঁচেছিলাম।
নাবিকটা একটু চুপ করে থেকে বলল–একটা কথা বলি শোন–চারদিকে দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল–তুমি বোধহয় গল্পের শেষটুক জান না।
–জানি বৈকি, ডাকাত পাদরিরা সবাই জাহাজডুবি হয়ে মরে গেল।
–না। নাবিকটি মাথা নাড়ল–একজন বেঁচেছিল। সে পরে নিজের জীবন বিপন্ন করে সোনার ঘন্টার দ্বীপে যাওয়ার একটা পথ আবিষ্কার করেছিল। আসার অন্য একটা পথও আবিষ্কার করেছিল।
–কেন, যাওয়া-আসার একটা পথ হতে বাধা কি?
–নিশ্চয়ই কোন বাধা ছিল। যাকগে যাওয়া আসার দুটো সমুদ্র পথের নকশা সে দুটো মোহরে খুঁদে রেখেছিল। সব সময় নাকি গলায় ঝুলিয়ে রাখত সেই মোহর দুটো, পাছে চুরি হয়ে যায়। হয়তো ডাকাত পাদরিটার ইচ্ছে ছিল দেশে ফিরে জাহাজ, লোকলস্কর নিয়ে যাবে। সোনার ঘন্টা থেকে সোনা কেটে-কেটে আনবে, কিন্তু–ডাকাত পাদরিটা মারা গেল।
তাই নাকি?
–হ্যাঁ, মরু-দস্যুদের হাতে সে প্রাণ হারাল।
ফ্রান্সিস চমকে উঠল। ফজল তো ঠিক এমনি একটা ঘটনাই ওকে বলেছিল। ফ্রান্সিস আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করল–আর সেই মোহর দুটো?
–মরু-দস্যুরা লুঠ করে নিয়েছিল। তারপর সেই মোহর দুটোর হদিস কেউ জানে না।
–আচ্ছা, মরু-দস্যুরা কি জানত, মোহর দুটোয় নকশা আঁকা আছে?
–ওরা তো অশিক্ষিত বর্বর, নকশা বোঝার ক্ষমতা ওদের কোথায়।
এমন সময় কয়েকজন নাবিক কথা বলতে বলতে ওদের দিকে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস আর কোন প্রশ্ন করল না। তার কেবল মনে পড়তে লাগল সেই মোহর দুটোর কথা। আবছা একটা মাথায় ছাপ ছিল, আর কয়েকটা রেখার আঁকিবুকি।
ঘুম আসতে চায় না ফ্রান্সিসের। নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে!ইস-মোহর দুটো একবার ভালো করে দেখেও নি সে। এইবার মকবুলের মোহর চুরির রহস্য ফ্রান্সিসের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মকবুল নিশ্চয়ই জানত মোহর দুটোর কথা। তাই ও সাঙ্গ গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়ে ওকে এতিমখানায় নিয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সিসের মোহরটা চুরি করেছিল। কিন্তু আর একটা মোহর? সেটা হাতে না পেলে তো মকবুল পুরো পথের নকশা পাবে না। হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে পড়ল একটা ঘটনা। আশ্চর্য! সেদিন ঐ ঘটনার গুরুত্ব সে বুঝতে পারেনি। একদিন সকালে বাজারে যাওয়ার পথে দেখেছিল সেই জহুরির দোকানটার কাছে বহুলোকের ভিড়। দোকানটা কারা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশের দোকানগুলোর কোন ক্ষতি হয়নি, অথচ ঐ দোকানটা ভেঙেচুরে একশেষ। ফ্রান্সিস শুনল–গত রাত্রে দোকানটায় ডাকাত পড়েছিল। আজকে ঐ ডাকাতির অর্থ পরিষ্কার হল। আসলে মকবুল তার সঙ্গীদের নিয়ে সেই দোকানটায় হানা দিয়েছিল। লক্ষ্য সেই মোহরটা চুরি করা। তাহলে মকবুলও সোনার ঘন্টার ধান্ধায় ঘুরছে। আশ্চর্য!