৫
তেশরা অক্টোবর। বৃহস্পতিবার। বৃষ্টির বিরাম নেই। ক্রমাগত বর্ষণে চরাচর বিলুপ্ত। এদিকে আজ সকাল থেকে ‘দ্য রিপোস’রীতিমত হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে। সকালবেলা আবাসিকেরা যখন প্রাতরাশ টেবিল-এ এসে বসলেন তখন নবাগতদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেবার কথা মনে হল না কৌশিকের। কালীপদ খাড়া হয়েছে। জ্বর নেই তার। ভোরবেলা থেকে সুজাতার হাতে হাতে কাজ করছে। বৃষ্টি সত্ত্বেও কাঞ্চী এসেছে ভিজতে ভিজতে। বর্ষাবিধ্বস্ত বস্তির মর্মন্তুদ বর্ণনা সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু সুস্থির হয়ে শুনবার অবকাশ ছিল না সুজাতার। সে ক্রমাগত টোস্ট-পোচ-অমলেট আর হাফ-বয়েল বানিয়ে চলেছে ফরমায়েস মতো। কাঞ্চী আর কালীপদ পর্যায়ক্রমে পৌঁছে দিয়ে আসছে চা আর কফি। হোটেল জমে উঠেছে।
আবাসিকরা দেখলেন দুটি নতুন মুখ। ডঃ সেন আর সুবীর রায়। মিসেস সেনকে অবশ্য দেখতে পেলেন না ওঁরা। তিনি তাঁর দ্বিতলের কামরা থেকে নামলেন না আদৌ। তাঁর ব্রেকফাস্ট কাঞ্চী পৌঁছে দিয়ে এল দ্বিতলের ছয় নম্বর ঘরে। বোধকরি এই সাতসকালে তাঁর যথোপযুক্ত প্রসাধন সারা হয়নি—তাই তিনি এই শম্বুকবৃত্তি অবলম্বন করলেন।
সকালে উঠে প্রথম সুযোগেই কৌশিক বাসু-সাহেবের সঙ্গে দেখা করে। গতকাল রাত্রে যে তিনজন নবীন অতিথির আবির্ভাব ঘটেছে তাদের সম্বন্ধে যাবতীয় সংবাদ দাখিল করে। বাসু-সাহেব শুনে বলেছিলেন, হ্যাঁ, সুবীর রায় নামটা আমার জানা। তাকে এ ঘরে নিয়ে এস, আর অরূপকেও খবর দাও—সুজাতা বোধকরি রান্নাঘর ছেড়ে আসতে পারবে না, নয়?
কৌশিক বলেছিল, এখন তার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। তা হোক, আমিই তো রইলাম. এখানে যা কিছু আলোচনা হবে তা আমি তাকে জানিয়ে দেব।
মিনিট দশেক পরে বাসু-সাহেবের ঘরে একটি গোপন বৈঠক বসল। অরূপরতন আর সুবীর রায় যোগ দিল তাতে। কৌশিক সুবীরকে পরিচয় করিয়ে দিল ওঁদের সঙ্গে। বেচারি স্থির হয়ে বসতে পারছিল না আলোচনা সভায়। তাকে বারে বারে দেখে আসতে হচ্ছিল ঘরের চারপাশ। কেউ আড়ি পেতে শুনছে কি না। না, শুনছে না। ডঃ সেন তাঁর উত্তমার্ধের সঙ্গে তাস খেলছেন নিজের ঘরে; আলি-সাহেব নিজের ঘরে একটি ইংরেজি ডিটেকটিভ উপন্যাসে বুঁদ। কাবেরী আর অজয়বাবু আছে দোতলার উত্তরের বারান্দায়। কাবেরী বসে আছে একটি টুলে, উদাস ভঙ্গিতে আকাশ পানে তাকিয়ে। অজয়বাবু ক্রেয়নে তার একটি স্কেচ করছেন। দুজনে ভাব হয়ে গেছে বেশ। সুন্দরী তন্বী কাবেরী দত্তগুপ্তা এবং বৃদ্ধ চিত্রকর অজয় চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে।
বাসু-সাহেব বলেন, মিস্টার রায়, আপনার কথা নৃপেন ঘোষাল আমাকে বলেছিল—
বাধা দিয়ে সুবীর বললে, আপনি স্যার আমাকে ‘তুমিই’ বলবেন—
—তা না হল বলব, কিন্তু—
কৌশিক আবার উঠে পড়ে। বলে, আমি বরং বাইরে গিয়ে বসি—
তাকে বাধা দিয়ে রানি বলেন, না। তুমি থাক কৌশিক। আমিই বরং ব্যূহমুখে জয়দ্রথের ভূমিকায় থাকি। তেমন তেমন কাউকে আসতে দেখলেই আমি গান ধরব-
হুইল-চেয়ারে পাক দিয়ে রানি দেবী পার হয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে বারান্দায়। ড্রয়িংরুমে, যেখানে পিয়ানোটা বসানো আছে তার পাশের দরজার কাছে থামলেন তিনি—যাতে দুদিকেই নজর রাখা যায়।
বাসু-সাহেব বললেন, রিপোস্-এর বাসিন্দারা এখন স্পষ্টত দুটি দলে বিভক্ত। প্রথম দলে আছেন একজন ভানারে। তিনি যে কে তা আমরা ঠিক জানি না তবে সে দলের সভ্যসংখ্যা পাঁচ–রানি, সুজাতা, কৌশিক, অরূপ আর আমি। দ্বিতীয় দলের মধ্যে আছেন একজন সুচতুর দক্ষ ক্রিমিনাল—তার রেঞ্জ হচ্ছে আলি, কাবেরী, ডঃ অ্যান্ড মিসেস সেন এবং অজয় চট্টোপাধ্যায়।
—এঁরা সবাই? –অবাক হয়ে প্রশ্ন করে কৌশিক।
—সবাই নয়, এঁদের মধ্যে যে কোনো একজন অথবা দু’জন। নৃপেন এবং সুবীরের ধারণা—এবং আমিও তাদের সঙ্গে একমত—রমেন গুহের মৃত্যুর পিছনে আছে সহদেব হুই-এর হাত। প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ। ইব্রাহিম যদি স্বয়ং সহদেব হয় তবে সন্দেহ করতে হবে আলি এবং ডক্টর সেনকে। আর সহদেব যদি কোন এজেন্ট লাগিয়ে থাকে তবে অজয়বাবুকেও নেড়েচেড়ে দেখতে হবে। অপরপক্ষে মিস্ ডিক্রুজা যদি রমেন গুহর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত থাকে তবে কাবেরী আর মিসেস্ সেনকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া চলে না।
অরূপ প্রশ্ন করে, প্রথমে বলুন তো—আপনারা কেন মনে করছেন রমেন গুহর মৃত্যুতেই ব্যাপারটার যবনিকাপাত ঘটেনি? রিপোস-এ আমাদের মধ্যে ঐ ঘটনার পুনরাভিনয় হবার কথা আশঙ্কা করা হচ্ছে কেন?
বাসু-সাহেব বলেন, কালকে সে কথার কিছুটা ইঙ্গিত আমি দিয়েছি। ইব্রাহিমের পরিত্যক্ত ঘরটা সার্চ করতে গিয়ে নৃপেন একখণ্ড কাগজ পায়, ঐ ঘরের ময়লা-ফেলা কাগজের ঝুড়ি থেকে। কাগজটা আমার কাছে নেই—নৃপেন নিয়ে গেছে, না হলে তোমাদের দেখাতাম—
বাধা দিয়ে সুবীর বলে, কাগজখানা আমার কাছে আছে–
—তোমার কাছে? নৃপেন দিয়েছে?
—হ্যাঁ, এই দেখুন।
অ্যাটাচি কেস খুলে কাগজখানা সে বাসু-সাহেবকে দেয়। সবাই ঝুঁকে পড়ে। হাতে হাতে কাগজখানা ঘোরে। অবশেষে সেটি বাসু-সাহেবের হাতে আসে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাগজটা পরীক্ষা করেন। আলোর সামনে সেটা ধরেন, যেন একশ-টাকার নোট জাল কি না দেখছেন। কৌশিক লক্ষ্য করে দেখল, কাগজটা দলামচা করা হয়েছিল। কোঁচকানোর দাগ আছে। তার উপরপ্রান্তে পারফোরেশনের চিহ্ন—যেন ফুটো-ফুটো করা নোটবইয়ের একটি ছোঁড়া পাতা। একটি প্রান্ত মসৃণ আর দুটি প্রান্তে যেন তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার চিহ্ন। কাগজটায় কালো কালিতে লেখা :
সুবীর বললে, বেশ বোঝা যাচ্ছে—রিপোস-এ দ্বিতীয়বার হত্যা করলেও আততায়ীর প্রতিহিংসাপরায়ণতা নিবৃত্ত হবে না। সে তিন-নম্বর হত্যার কথাও চিন্তা করছে!
কৌশিক বললে, নকুল হুইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধের জন্য যদি এ পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে তবে আমার মনে হয় আততায়ীর দু’নম্বর টার্গেট হচ্ছেন বাসু-সাহেব। তাই নয়? অরূপ বললে, তুমি-আমিও হতে পারি। সুজাতা দেবীই বা কেন বাদ যাবেন? আমরা সকলেই নকুল হুইয়ের ফাঁসির জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
—সে কথা ঠিক। কৌশিক মেনে নেয়।
বাসু-সাহেব চোখ মেলে তাকান। বিচিত্র হাসেন। বলেন, ভাবছি? হ্যাঁ, ভাবছি বইকি! ভাবনার কি অন্ত আছে। কিন্তু আজ এই পর্যন্তই—উঠে দাঁড়ান তিনি, বলেন—দীর্ঘ আলোচনার কিছু নেই, এভাবে আমরা রুদ্ধদ্বার কক্ষে আলোচনা চালালে ওপক্ষ সজাগ হয়ে যাবে। সো উই ডিজল্ভ্!
বেশ বোঝা গেল সকলেই এ সিদ্ধান্তে মর্মাহত। এত সংক্ষিপ্ত অধিবেশন হবে তা কেউ ভাবেনি। কিন্তু রায় দিয়ে বাসু-সাহেব উঠে পড়েছিলেন। গুটিগুটি বেরিয়ে এসে বসলেন বারান্দার একান্তে একটি ইজিচেয়ারে। কৌশিক, অরূপ আর সুবীর একে একে চলে গেল। রানি দেবী তাঁর চাকা-দেওয়া চেয়ারে পাক মেরে ঘনিয়ে এলেন বাসু-সাহেবের পাশে। ধ্যানস্থ বাসু-সাহেব বোধ করি তা টের পাননি। তিনি চমকে উঠলেন রানি দেবীর প্রশ্নে : কী হল? এরই মধ্যে কনফারেন্স শেষ?
—উঁ? হুঁ!—অন্যমনস্কের মতো জবাব দিলেন বাসু। মাঝে মাঝে পাইপে টান দিচ্ছেন। কুণ্ডলী পাকিয়ে যে ধোঁয়াটা উঠছে তারই দিকে তাকিয়ে আছেন। একদৃষ্টে
—কী ভাবছ বলো তো?—আবার প্রশ্ন করেন রানি বাসু।
—ভাবছি? ঐ রমেন গুহর মৃত্যুর রহস্যের কথাই ভাবছি। আর কী ভাবব?
সহানুভূতির সুরে রানি বলেন, কে খুন করেছে তার কোনো কুলকিনারাই করতে পারছ না, নয়?
বিচিত্র হাসলেন বাসু-সাহেব। অনুচ্চকণ্ঠে বললেন, সেইটেই তো ট্রাজেডি রানু। লোকটাকে আমি চিনতে পেরেছি। কে খুন করেছে, কেন করেছে, এখানেই বা কাকে খুন করতে চাইছে তা বোধহয় সব ঠিকমতই জানতে পেরেছি আমি। অথচ আমার হাত-পা বাঁধা। সব জেনেও কিছু করতে পারছি না! ট্রাজেডিটা বুঝতে পারছ?
বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রানি দেবী। স্তব্ধ বিস্ময়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন তাঁর অদ্ভুত-প্রতিভা স্বামীর দিকে! যাঁকে তিনি অত্যন্ত নিবিড় ভাবে চেনেন—অথচ যে লোকটা তাঁর সম্পূর্ণ অপরিচিত! তারপর যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলেন, খুনি কে তা তুমি জান? মুখটা সূচালো করলেন বাসু-সাহেব। সম্মতি-সূচক গ্রীবা সঞ্চালন করলেন শুধু।
—সে এখানে আছে? এই রিপোস-এ?
একই রকম ভঙ্গি করেন উনি।
—আমাকে বলতে পার না?
এবার দুদিকে মাথা নাড়েন উনি।
—আমাকে না পার, অন্তত সুবীরকে বলো, নৃপেনকে কিম্বা বিপুলকে?
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বাসু-সাহেবের। বললেন, উপায় নেই রানু। আমার হাতে যা এভিডেন্স আছে তাতে কনভিকশান হবে না। এখন কেউ আমার কথা বিশ্বাসই করবে না—বলবে পি. কে. বাসু একটা বদ্ধ পাগল! লোকটাকে হাতে-নাতে ধরতে হবে—তার দ্বিতীয় খুনের প্রচেষ্টার পূর্ব-মুহূর্তে।
—ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে না?
—তা কিছুটা যাবে। কিন্তু উপায় কী বল? ওকে গিটি বলে প্রমাণ করব কী ভাবে? ওর দাড়ি, চশমা নেই—বীর বাহাদুর আইডেন্টিফিকেশান্ প্যারেডে ওকে চিনতে পারবে না। তাছাড়া বীর বাহাদুর অথবা মহেন্দ্র ওকে দেখেছে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। একমাত্র যদি মিস ডিক্রুজাকে খুঁজে বার করতে পারি তবে হতে পারে। সে সারাদিন ইব্রাহিমকে দেখেছে। বাট হু নোস্–ডিক্রুজা ওর পাপের সাথী হতেও পারে, আবার নাও পারে!
রানি দেবী ঝুঁকে পড়ে বললেন, কী ক্লু পেয়েছ তুমি?
—নিজেই গোয়েন্দাগিরি করতে চাও? উঁ?
—বলো না?
—সুবীরের হাতে ঐ ‘এক : দুই : তিন’ লেখা কাগজখানায়। প্রথমবার আমি ভাল করে ওটা পরীক্ষা করিনি। এবার তীক্ষ্ণভাবে পরীক্ষা করেছি। ওর ভিতরেই সহদেব ভুল করে রেখে গেছে তার আত্মপরিচয়! বেচারি সহদেব হুই!
—তবে তাকে ধরিয়ে দিচ্ছ না কেন?
—ঐ যে বললাম—যে সূক্ষ্ম যুক্তির বিচারে আমি ইব্রাহিমকে শনাক্ত করছি তাতে খুনি আসামির কনভিকশান হয় না! আমাকে জানতে হবে মিস্ ডিক্রুজা ওর পার্টনার-ই-ক্রাইম ছিল কি না। একমাত্র সেই পারবে ইব্রাহিমকে শনাক্ত করতে। সহদেবকে আমি খুঁজে পেয়েছি; এখন খুঁজছি শুধু মিস্ ডিক্রুজাকে—এই রিপোস হোটেলেই!
—হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে বাহাদুর আর মহেন্দ্রকে আনানো যায় না? এ-প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই বাসু-সাহেব দেখলেন কৌশিক এগিয়ে আসছে ওঁদের দিকে।
—কী ব্যাপার? এমন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন হে তোমাকে?
—কেলেঙ্কোরিয়াস্ কাণ্ড স্যার! এক নম্বর : টেলিফোন লাইনটা সকাল থেকে ডেড হয়ে গেছে। দু-নম্বর : কার্ট-রোডের সঙ্গে এ বাড়িটার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে—প্রকাণ্ড একটা ধস নেমেছে। আর তিন নম্বর—সুজাতা নোটিস দিয়েছে তার ভাঁড়ারে ডিম-মাংস-রুটি-মাখন সব বাড়ন্ত!
বাসু-সাহেব রানি দেবীর দিকে ফিরে বলেন—এই নাও তোমার প্রশ্নের জবাব!
—কী প্রশ্ন?—জানতে চায় কৌশিক।
—উনি দার্জিলিঙ থেকে আজ আবার দু-জনকে নিমন্ত্রণ করো আনতে চাইছিলেন। সে যাক, মন-খারাপ কোরো না। যেমন করে হক এ কদিন চালিয়ে নিতে হবে আমাদের। দু-তিন দিনের মধ্যেই সভ্যজগতের সঙ্গে নিশ্চয় যোগাযোগ করা যাবে।
—রেডিওর খবর—তিস্তা ব্রিজ ভেসে গেছে। মহানন্দা, তোরসা, টাঙ্গন, পুনর্ভবা, আত্রেয়ী সবাই একসঙ্গে খেপে উঠেছে। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদা—এক কথায় গোটা উত্তরবঙ্গে প্রচণ্ড বন্যা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ভেসে গেছে—এতবড় বন্যা নাকি উত্তরবঙ্গে কখনও হয়নি।
.
বেলা নয়টা নাগাদ বৃষ্টি মাথায় করেই কৌশিক বার হয়ে পড়ল। রেন-কোট চড়িয়ে। গাড়ি চলবে না, পায়ে হেঁটে। স্থানীয় বাজারে কিছু পাওয়া যাবে কি না খোঁজ নিতে।
অজয় চাটুজ্জে কাবেরীর স্কেচটা শেষ করে এনেছেন।
আলিও আগাথা ক্রিস্টি শেষ করে আনল প্ৰায়।
ছয় নম্বর ঘরে মিসেস সেন ক্ষুব্ধা। তৃতীয় এক কাপ চা চেয়ে তিনি প্রত্যাখ্যাতা হয়েছেন। কিচেন-ব্লক থেকে কাঞ্চী এসে জানিয়ে গেছে এখন আর চা পাঠানো সম্ভবপর নয়। প্রাতঃরাশের সময়সীমা অতিক্রান্ত। কিচেন এখন লাঞ্চের ব্যবস্থায় ব্যস্ত।
বাসু-সাহেব গুটি গুটি এসে হাজির হলেন রান্নাঘরে : কী সুজাতা? আজ কী রান্না হচ্ছে?
—মাংস যা আছে এবেলা হয়ে যাবে। মাংসই করছি। আলুসেদ্ধ এই নামল।
হঠাৎ ওর কাছে ঘনিয়ে এসে বাসু-সাহেব বলেন, একটা কাজ করো তো সুজাতা। চট করে একবার দোতলার সাত নম্বরে চলে যাও। কাবেরীর ঘরে। কাবেরী এখন ঘরে নেই—কিন্তু ওর ঘর তালাবন্ধও নেই। কাবেরী উত্তরের বারান্দায় বসে ছবি আঁকাচ্ছে। ওর ঘরে গিয়ে চট্ করে ওর অ্যাশট্রেটা নিয়ে এস তো—
—অ্যাশট্রে! অ্যাশট্রে কী হবে?
—তুমি তো আগে এমন ছিলে না সুজাতা! ‘কেন’ এ প্রশ্ন তো আগে করতে না—
—কিন্তু এদিকে আমার তরকারিটা—
—ওটা আমি দেখছি—
ওর হাত থেকে খুন্তিটা নিয়ে বাসু-সাহেব উনুনের উপর বসানো তরকারির ডেক্চিটায় মনোনিবেশ করেন।
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সুজাতা—ওঁর অনভ্যস্ত হাতে খুন্তি নাড়া দেখে
—হাসছ কেন?—রোষষায়িত দৃষ্টিতে বাসু-সাহেব জানতে চান।
হাসি থামিয়ে সুজাতা গম্ভীর হয়ে বলে, অবজেক্শান ইয়োর অনার। ইটস্ ইনকম্পিটেন্ট, ইররেলিভান্ট অ্যান্ড ইম্মেটিরিয়্যাল্!
বাসু-সাহেব হেসে ফেলেন। বলেন, অবজেকশান ওভার রুলড। যাও, ওপরে যাও! সুজাতা দু-মিনিটের মধ্যেই অ্যাশট্রেটা নিয়ে ফিরে এল। বাসু-সাহেব তার ভিতর থেকে গুটিতিনেক সিগারেটের স্টাম্প উদ্ধার করে বললেন, আশ্চর্য! কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এটা শূন্যগর্ভ ছিল! যাও, এটা রেখে দিয়ে এস আবার।
আরও মিনিট পনের পরে। বাসু-সাহেবের প্রস্থানের পরে আলি-সাহেব রান্নাঘরে এসে হাজির। প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে বলে, আসতে পারি? অনধিকার প্রবেশ করছি না তো?
সুজাতা চমকে ওঠে : আসুন, আসুন। কী ব্যাপার? একেবারে হেঁশেলে?
—আপনাকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলাম মহিলাদের হেঁশেল সম্বন্ধে আমার কিছুটা পারদর্শিতা আছে।
—তা বলেছিলেন। ধন্যবাদ। আমার সাহায্যের কোনো দরকার হবে না।
আলি একটা টুল টেনে নিয়ে বসে পড়ে। বলে, চার নম্বরে ঐ যে লম্বামতন ভদ্রলোক এসে উঠেছেন ওঁর নামটা কী বলুন তো?
—মিস্টার রায়।
—কী রায়?
সুজাতা হেসে বললে, তাহলে রেজিস্টার দেখতে হবে। পুরো নামটা মনে নেই।
—কখন এলেন উনি?
—হঠাৎ ওঁর বিষয়ে এত কৌতূহলী হয়ে পড়লেন কেন?—সুজাতা প্রতিপ্রশ্ন করে।
একটু থতমত খেয়ে আলি বলে, না না, শুধু ওঁর সম্বন্ধে নয়, ছয় নম্বর ঘরের দম্পতির বিষয়েও আমার কৌতূহল আছে।
—তা আমার কাছে কেন? ছয় নম্বরে গিয়ে আলাপ জমালেই পারেন।
আলি সে-কথার জবাব দেয় না। আলুর ডেক্চিটা টেনে নেয়। তাতে ছিল সেদ্ধ করা আলু। আপনমনে সে আলুর খোসা ছাড়াতে থাকে। আড়চোখে সুজাতা একবার তাকে দেখে নিল। বোঝা গেল যে কোনো কারণেই হোক, আলি ভাব জমাতে চায়। সুজাতার তাতে আপত্তি নেই। এবার সে নিজে থেকেই বলে ওঠে, মিস্টার আলি, এবার বলুন তো, আপনি প্রথম সাক্ষাতেই কেমন করে বুঝতে পেরেছিলেন যে বাড়িতে আমি একেবারে একা আছি? চাকরটা পর্যন্ত নেই?
আলি-সাহেব জবাব দিল না। আপন মনে আলুর খোসা ছাড়াতে থাকে। সুজাতা একটা প্লেটে কিছু তরকারি তুলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, দেখুন তো নুন-ঝাল ঠিক আছে কি না?
প্লেটে ফুঁ দিতে দিতে আলি বললে, একসঙ্গে এত লোকের রান্নায় আন্দাজ পাচ্ছেন না, তাই নয়? ছিল দু’জনের ছোট্ট সংসার—হয়ে গেল রাবণের গুষ্টি!
—রাবণের গুষ্টি! আপনি হিন্দুদের এপিক পড়েছেন দেখছি।
—তা পড়েছি। ঐ রামায়ণ না মহাভারতেই আছে না আর একটা কথা—শত্রু এবং স্ত্রীর কাছে মিথ্যাভাষণে পাপ নেই।’
—হঠাৎ এ-কথা কেন?
তরকারিটা ইতিমধ্যে ঠান্ডা হয়েছে। আলি পরখ করে বললে, নুন-ঝাল ঠিক আছে।
—তা তো আছে—কিন্তু হঠাৎ ও কথা কেন বললেন?
আলি হেসে বললে, দেখুন, আমি ব্যাচেলর মানুষ। দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি অত জানি না। আচ্ছা, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছে হামেশাই মিছে কথা বলে, তাই নয়?
—কেন ও কথা বলছেন তাই আগে বলুন?
—কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনাদের? সুজাতা রাগ দেখিয়ে বললে, বলব না!
আলি হাসে। বলে, নেহাৎ পীড়াপীড়ি করছেন তাই বলছি—পরশু-রাতে আপনাদের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয়েছিল যে, বিকেলের দিকে দার্জিলিঙ যাবার একটা প্রোগ্রাম আপনাদের করা ছিল, তাই নয়? মিস্টার মিত্র বললেন যে, কাঞ্চন ডেয়ারিতে গিয়ে উনি আটকা পড়েছিলেন। কথাটা উনি সত্য বলেননি। পরশু সকালে উনি দার্জিলিঙেই গিয়েছিলেন।
—আপনি কেমন করে জানলেন?
—পরশু আমি ছিলাম দার্জিলিঙে। বেলা একটার সময় একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ সারছিলাম। আমার থেকে তিন টেবিল দূরে মিস্টার মিত্র দুপুরে ওখানে লাঞ্চ করেন। উনি নিশ্চয় আমাকে লক্ষ্য করেননি—
—দার্জিলিঙ-এ চাইনিস রেস্তোরাঁ? আছে না কি?
—আছে। গ্রেনারির ঠিক উল্টোদিকে। ‘সাংগ্রি-লা’ তার নাম।
—ওখানে বসে সে খাচ্ছিল?
বিচিত্র হাসল আলি। বললে, আপনি রাগ না করেন তো আরও কিছু নিবেদন করি। উনি একা খাচ্ছিলেন না—ওঁকে সঙ্গদান করছিলেন একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা। বিবাহিতা, বয়স বছর ত্রিশ—আর ভয়ে-বলব-না-নির্ভয়ে-বলব? ভদ্রমহিলা রীতিমত সুন্দরী।
সুজাতা আত্মসংবরণ করে কৃত্রিম হাসিতে ভেঙে পড়ে। বলে, ভয়ে বলতে যাবেন কোন দুঃখে? নির্ভয়েই বলুন। আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন মিস্টার আলি, –আমরা- বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে বাস করছি। আমার স্বামী কোনো সুন্দরী মহিলার সঙ্গে লাঞ্চ সেরেছেন শুনলে আমি মুর্ছা যাব না।
আলি একটা মোগলাই-কুর্নিশ ঝেড়ে বলে, বেগমসাহেবা মহানুভব। বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে ঔদার্যটার সম্বন্ধে আমার ধারণা সীমিত। আচ্ছা ধরুন, যদি সংবাদ পান লাঞ্চান্তে আপনার কর্তা সেই সুন্দরী মহিলাটিকে একটা ‘সোনার কাঁটা’ উপহার দিচ্ছেন?
—সোনার কাঁটা? সেটা কী জাতীয় বস্তু?
—ও-বস্তুটা আমিও এর আগে কখনও দেখিনি। একটা অলঙ্কার। মেয়েরা খোঁপায় কাঁটা গোঁজে—লোহার, অ্যালুমিনিয়ামের, প্ল্যাস্টিকের। কবরী-বন্ধন যাতে শিথিল না হয়ে যায় তাই তার ব্যবহার—এই যেমন আপনি এখন কাঁটা গুঁজেছেন আপনার খোঁপায়! সোনার কাঁটার মূল্য কবরীবন্ধনে নয়—
—কৃষ্ণা-কবরী-শোভা বর্ধনে—প্রশ্ন করে সুজাতা।
—অথবা রক্ত-কবরী-সোহাগ-বর্ধনে!—জবাব দেয় আলি।
—সংবাদটা বিচিত্র!
—সন্দেশটা বিস্বাদ না হলেই হল! ভরি-তিনেক ওজনের অমন একটা সোনার কাঁটা মিস্টার মিত্রের পকেট থেকে যাত্রা শুরু করে তাঁর মিত্রাণীর খোঁপা বিদ্ধ করলে বেদনাটা অন্যত্র অনুভূত হবার কারণ নেই! কী বলেন! আফটার অল, আমরা বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে বাস করছি!
সুজাতা এবারও হেসে বলে, মিস্টার আলি, রামায়ণ তো আপনার পড়া। নিশ্চয় জানেন—রাবণের গুষ্টি শেষ হবার পর বিভীষণ সিংহাসনে বসে—কিন্তু কোনো হিন্দুই সত্যবাদী বিভীষণকে শ্রদ্ধা করে না—তার পরিচয় ‘ঘরভেদী বিভীষণ!”
আলি এ জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সামলে নিয়ে কী একটা কথা সে বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দ্বারপথে কে-যেন বলে ওঠে, এক্সকিউজ মি। ভিতরে আসতে পারি?
—কে? ডক্টর সেন! আসুন। এখানে কী মনে করে?
হাসি হাসি মুখে ডঃ সেন ঢুকে পড়েন রান্নাঘরে। অনুনয়ের ভঙ্গিতে সুজাতাকে বলেন, এক কাপ চা কি কিছুতেই হতে পারে না, মিসেস মিত্র? আমার বেটার-হাফ, মানে…
স্ত্রৈণ ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে সুজাতার করুণা হয়। আলি এগিয়ে এসে বলে, আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। আমার নাম এন. আলি–আমি আছি তিন নম্বরে।
—সো গ্ল্যাড টু মিট য়ু। একা আছেন, না সস্ত্রীক?
—আজ্ঞে না। স্ত্রীর বালাই নেই। আমি কনফার্মড ব্যাচেলর!
—শুনে সুখী হলাম। বেঁচে গেছেন মশাই!
সোনার কাঁটা আলি বলে, কেন? আপনি যে মরে আছেন তা তো মনে হচ্ছে না। ‘কপোত-কপোতী যথা’ উচ্চনীড়ে সকাল থেকে তো দিব্যি তাস পিঠছেন!
—আরে তাতেই তো হয়েছে বখেড়া। এ পর্যন্ত আমার বেটার হাফ সাড়ে বাহান্ন টাকা হেরেছেন। মেজাজ খেচুরিয়াস! তাতেই তো চায়ের সন্ধানে এসেছি।
আলি অবাক হয়ে বলে, সাড়ে বাহান্ন টাকা! আপনি কি স্ত্রীর সঙ্গে স্টেকে তাস খেলছেন?
—আলবৎ! স্টেক ছাড়া ‘ফিশ্’ খেলা যায় নাকি!
—তাই বলে স্ত্রীর সঙ্গে?
—কেন নয়? ওঁর রোজগার আর আমার রোজগার আলাদা। জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট নেই। এমনকি I.T.O.-র ফাইল নাম্বার পর্যন্ত পৃথক
—এমনও হয় না কি?
—আজ্ঞে! বে-থা তো করেননি—কী খবর রাখেন!—অম্লানবদনে ডাক্তার-সাহেব ডেক্চি থেকে একটি সিদ্ধ আলু নিয়ে মুখে পুরলেন।
সুজাতা হেসে বললে, ঠিক আছে ডাক্তার-সাহেব, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এক কাপ না দুকাপ?
—বানাতেই যখন হচ্ছে তখন আর এক কাপ কেন? যাহা সাড়ে বাহান্ন তাহা পঁয়ষট্টি। দু-কাপই হোক।—দ্বিতীয় একটি বড়-মাপের আলু তুলে নিয়ে তাতে কামড় বসান ডাক্তার সেন। বাঁ-হাতে এক চিমটে নুনও তুলে নেন।
সুজাতা হেসে বললে, ঠিক আছে ডাক্তার-সাহেব, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
—থ্যাঙ্কু! থ্যাঙ্কু! না, না, কষ্ট করে আর পাঠিয়ে দিতে হবে না। আমি অপেক্ষা করছি। নিজেই নিয়ে যাব।
সুজাতা হাসতে হাসতে বলে, ততক্ষণে বোধহয় আমার আলুসেদ্ধর ডেক্চি খালি হয়ে যাবে।
—আলুসেদ্ধ! ও আয়াম সরি!—এঁটো আলুটা উনি ফেরত দিতে উদ্যত হন।
—এ কী করছেন! ওটা আপনার এঁটো!
—এঁটো! ও আয়াম সরি—আলুটা কোথায় রাখবেন উনি ভেবে পান না।
—একি! তুমি এখানে বসে আলুসেদ্ধ খাচ্ছ!—প্রবেশ করেন মিসেস সেন।
—আমি? না, মানে, ইয়ে—হঠাৎ বাকি আলুটা মুখে পুরে দিয়ে ডাক্তার সাহেব আলি-সাহেবের দিকে ফিরে বলতে চাইলেন—’আমার বেটার হাফ’; কিন্তু মুখে গরম আলুসেদ্ধ থাকায় কথাটা বোঝা গেল না।
—চলে এস উপরে!—রীতিমত ধমকের সুরে ডাকেন মিসেস্ সেন
—না, মানে তোমার চা-টা—
—থাক। চা আর লাগবে না।
সুজাতার গরম জল তৈরিই ছিল। ইতিমধ্যে সে চা ছেড়েছে ‘পট’-এ। বললে, চা যে হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
রুখে ওঠেন মিসেস সেন, বলছি লাগবে না! এক ঘণ্টা আগে চা চেয়েছি, এতক্ষণে শোনাচ্ছেন—হয়ে গেছে!
সুজাতা ডক্টর সেনের দিকে ফিরে বললে, না লাগে পাঠাব না। তবে আপনার অর্ডার অনুযায়ী দু-কাপ চা বানানো হয়েছে। বিল-এ দু-কাপ চায়ের দাম কিন্তু ঠিকই ডঃ সেন! —কারেক্ট! তা তো উঠবেই। তবে এক কাজ করুন—আমার কাপটা দিন, নিয়ে যাই। ওঁর যখন আর লাগবে না—
—থাম তুমি! উঃ কী ডাকাতের রাজ্যে এসে পড়েছি! দাম দেব আর চা খাব না! ইয়ার্কি নাকি! তুমি এস—ওরা বেয়ারা দিয়ে পাঠিয়ে দেবে।
ওয়ার্স-হাফকে উদ্ধার করে উপরে উঠে গেলেন মিসেস সেন।