সোনার আনারস
প্রথম – নূতন অভিযান
জয়ন্ত বিরক্ত স্বরে বলল, ‘আর পড়তে হবে না মানিক, ফেলে দাও, তোমার ওই খবরের কাগজখানা! আমি রাজনীতির কচকচি শুনতে চাই না, আমি জানতে চাই নতুন নতুন অপরাধের খবর! কিন্তু আমি যা চাই, তোমার ওই খবরের কাগজে তা নেই৷ অপরাধীরা কি আজকাল ধর্মঘট করেছে? এ হল কী? এত বড়ো কলকাতা শহর, কিন্তু কেউই অপরাধের মতন অপরাধ করতে পারছে না!’
মানিক কাগজখানা মেঝের উপরে নিক্ষেপ করে হাসতে হাসতে বলল, ‘কারুর পোষ মাস, কারুর সর্বনাশ! তুমি চাও অপরাধীদের, কিন্তু সাধু নাগরিকদের পক্ষে তারা কি দুঃস্বপ্নলোকের জীব নয়?’
জয়ন্ত বলল, ‘অপরাধ হচ্ছে বিচিত্র! সাধুমানুষদের চেয়ে বেশি আকর্ষণ করে অপরাধীরাই৷ মহাভারত পড়বার সময় তুমি কি অনুভব করনি মানিক, যুধিষ্ঠিরের চেয়ে দুর্যোধন আর দুঃশাসনের কথা জানবার জন্যেই আমাদের বেশি আগ্রহ হয়? মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পড়ে দেখো৷ তার মধ্যে রামের চেয়ে বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে রাবণের চরিত্রই! আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন হচ্ছে একেবারেই বেরঙা, কিন্তু রঙের পর রঙের খেলা দেখা যায় অপরাধীদের জীবনেই৷’
মানিক সায় দিয়ে বলল, ‘তা যা বলেছ ভাই, একথা না মেনে উপায় নেই৷ কিন্তু কী আর করবে বলো, কলকাতা পুলিশের সুন্দরবাবুও তিন মাসের ছুটি নিয়ে বসে আছেন, তিনিও যে ‘হুম’ বলে কোনো নতুন মামলা নিয়ে আমাদের এখানে ছুটে আসবেন, তারও আশা নেই৷ অগত্যা আমাদের বাধ্য হয়েই বিশ্রাম গ্রহণ করতে হবে৷’
ঠিক এমনি সময়ে মধু চাকর এসে খবর দিল, একজন লোক নাকি জয়ন্তর সঙ্গে দেখা করতে চায়৷
জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘কীরকম লোক মধু?’
‘একটি ছোকরা বাবু৷ বয়স বোধ হয় বাইশ-তেইশের বেশি হবে না৷ তাঁর মুখ দেখলে মনে হয় তিনি যেন ভারি ভয় পেয়েছেন৷’
‘আচ্ছা মধু, বাবুটিকে এখানেই নিয়ে এসো৷’
তার একটু পরেই সিঁড়ির উপরে দ্রুত পদশব্দ জাগিয়ে একটি লোক ব্যস্তভাবে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘জয়ন্তবাবু কোথায়? আমি এখনই জয়ন্তবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই!’
‘আমারই নাম জয়ন্ত৷ আপনি বড়োই উত্তেজিত হয়েছেন দেখছি, ওই চেয়ারখানার উপরে গিয়ে একটু স্থির হয়ে বসুন৷’
আগন্তুক সামনের চেয়ারখানা টেনে ধপাস করে তার উপরে বসে পড়ে বলল, ‘উত্তেজিত না হয়ে কী করি বলুন দেখি! কাল রাত্রে আর একটু হলেই আমার প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া হয়ে যাচ্ছিল যে!’
জয়ন্ত হাসিমুখে বলল, ‘তাহলে ঘটনাটা নিশ্চয়ই গুরুতর বটে! কিন্তু কী জানেন, শান্তভাবে না বললে কোনো ঘটনার ভিতর থেকেই আমরা সত্যকে আবিষ্কার করতে পারি না৷’
আগন্তুক অল্পক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল৷ তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘জয়ন্তবাবু, এইবার আমার কথা বলতে পারি কি?’
‘বলুন! আপনার কথা শোনবার জন্যে আমাদেরও আগ্রহের অভাব নেই৷’
‘আপনাদের তো আগ্রহের অভাব নেই, কিন্তু কাল আমার ঘাড়ে চেপেছিল মস্ত বড়ো এক কুগ্রহ! আজ যে বেঁচে আছি, সে হচ্ছে ভগবানের দয়া৷’
‘বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো কথা৷ অতএব বেঁচে যখন আছেন, তখন নির্ভয়ে আপনার সমস্ত ইতিহাস আমাদের কাছে বর্ণনা করতে পারেন৷ কিন্তু তার আগে জিজ্ঞাসা করি, আপনার নামটি কী?’
‘সুব্রত সরকার৷’
‘বেশ, এইবার আপনার কী বলবার আছে বলুন৷’
সুব্রত বলল, ‘কাল রাত্রে মশাই, আমার বাড়িতে ভয়ংকর এক কাণ্ড হয়ে গেছে৷ আমি এখনও বিবাহ করিনি, নিজের বাড়িতে একলাই থাকি৷ কাল রাত্রে দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিলাম, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়ে মনে হল অনেকগুলো হাত দিয়ে অন্ধকারে কারা যেন আমাকে চেপে ধরেছে! আমি বাধা দেবার চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারলাম না; কারণ চার-পাঁচখানা হাত দড়ি দিয়ে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল, আমার মুখেও গুঁজে দিল বিছানার চাদরের খানিকটা, আর চোখের উপরও বাঁধল একখানা কাপড়! সেই অবস্থাতেই অনুভব করলাম, সুইচ টিপে কারা আলো জ্বালল৷ তারপর শুনলাম, আমার লোহার সিন্দুক খোলার শব্দ! তার খানিক পরেই ঘরের আলো গেল আবার নিবে৷ কয়েকজনের পায়ের শব্দ বাইরে চলে গেল, তারপর আস্তে আস্তে আমার ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হল, তারপর আর কারুর কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না বটে, কিন্তু আমাকে সেই অবস্থাতেই কানা আর বোবার মতন চুপ করে থাকতে হল৷ সকাল বেলায় চাকর এসে আমাকে মুক্তিদান করল৷’
জয়ন্ত বলল, ‘আপনার ঘরের ভিতরে বাইরের লোক এল কেমন করে?’
‘দরজা দিয়ে মশাই, দরজা দিয়ে! আমার একটি বদ অভ্যাস আছে, গ্রীষ্মকালে আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমোতে পারি না৷’
‘তারপর? বিছানা থেকে নেমে আপনি কী দেখলেন?’
‘দেখলাম, আমার লোহার সিন্দুক খোলা পড়ে রয়েছে৷ তার ভিতরে শ-পাঁচেক টাকার নোট আর কিছু গয়নাও ছিল, কিন্তু সেসব কিছুই চুরি যায়নি৷ চোরেরা নিয়ে গেছে কেবল একটি জিনিস, যা ছিল সোনার আনারসের মধ্যে৷’
জয়ন্ত বিস্মিতকন্ঠে বলল, ‘সোনার আনারস? সে আবার কী?’
মানিক বলল, ‘সোনার পাথরবাটির কথা শুনেছি, কিন্তু সোনার আনারসের কথা শুনলাম এই প্রথম!’
সুব্রত বলল, ‘তাহলে একটু গোড়ার কথা বলতে হয়৷ কোন খেয়ালে জানি না, আমার প্রপিতামহ পিতল দিয়ে গড়িয়েছিলেন এই আনারসটি৷ এই আনারসের উপরে সোনার কলাই করা ছিল বলে আমরা একে সোনার আনারস বলেই ডাকি৷ আমার প্রপিতামহ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে এই সোনার আনারসটি পিতামহের হাতে দিয়ে বলে গিয়েছিলেন-যদি কোনোদিন তোমার বিশেষ অর্থাভাব হয়, তাহলে এই আনারসের মধ্যেই পাবে অর্থের সন্ধান! আমার পিতামহও মৃত্যুকালে আমার বাবাকে ঠিক এই কথাই বলে গিয়েছিলেন৷ বাবাও যখন মৃত্যুন্মুখ, তখন তাঁর মুখেও শুনেছিলাম এই কথাই৷ এই সোনার আনারসটি টানলে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷ আমার পূর্বপুরুষরা ধনী ছিলেন বটে, কিন্তু আমি ধনী নই, তাই সোনার আনারসের ভিতর থেকে অর্থের সন্ধান করতে গিয়ে পেয়েছিলাম খালি এক টুকরো কাগজ, আর সেই কাগজের উপর লেখা ছিল যে কথাগুলো, তা প্রলাপের নামান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়৷’
জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘কথাগুলো কী?’
সুব্রত একটু ভেবে বলল, ‘কাগজে লেখা ছিল একটি ছড়া, কিন্তু তার প্রথম আর শেষ দিকটার কথা ছাড়া আর কিছুই আমার মনে পড়ছে না৷’
‘যেটুকু মনে পড়ছে, বলুন দেখি৷’
সুব্রত বলল, ‘ছড়ার প্রথম দিকটায় আছে এই কথাগুলি-
আয়নাতে ওই মুখটি দেখে
গান ধরেছে বৃদ্ধ বট,
মাথায় কাঁদে বকের পোলা,
খুঁজছে মাটি মোটকা জট৷
বলতে পারেন জয়ন্তবাবু, এর মধ্যে কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় কি? বৃদ্ধ বট নাকি আয়নাতে তার মুখ দেখে গান ধরেছে! এমন কথা শুনলে কি হাসি পায় না?’
জয়ন্ত মাথা হেঁট করে ভাবতে ভাবতে বলল, ‘আমার একটুও হাসি পাচ্ছে না সুব্রতবাবু! ছড়ার শেষ দিকটায় কী আছে?’
সুব্রত বলল, ‘শেষ দিকটায় আছে-
সেইখানেতে জলচারী
আলো-আঁধির যাওয়া-আসা,
সর্পনৃপের দর্প ভেঙে
বিষ্ণুপ্রিয়া বাঁধেন বাসা!
হ্যাঁ জয়ন্তবাবু, এগুলো কি পাগলের প্রলাপ নয়?’
জয়ন্ত প্রায় পাঁচ মিনিটকাল স্তব্ধ ও স্থির হয়ে বসে রইল৷ তারপর হঠাৎ চেয়ারের উপরে সোজা হয়ে উঠে বসে বলল, ‘ছড়ার মাঝখানকার কোনো কথাই আপনার মনে নেই?’
‘এরকম একটা বাজে ছড়ার কথা মনে রাখবার কেউ কি চেষ্টা করে জয়ন্তবাবু? চোর ব্যাটারা কী নির্বোধ! তারা কিনা লোহার সিন্দুক খুলে কেবল এই ছড়ার কাগজখানা নিয়েই সরে পড়েছে!’
জয়ন্ত বলল, ‘চোরেরা বেশি নির্বোধ কি আপনি বেশি নির্বোধ, সেটা আমি এখনই বুঝতে পারছি না৷ কিন্তু ছড়ার কিছু কিছু অর্থ আমি যেন আন্দাজ করতে পারছি৷’
‘পারছেন নাকি? আমি তো কতবার ওই কাগজখানা পড়ে দেখেছি, কিন্তু অর্থ বা অনর্থ কিছুই আন্দাজ করতে পারিনি৷’
জয়ন্ত বলল, ‘এখনও আপনি কিছুই আন্দাজ করতে পারেননি, এটা হচ্ছে আশ্চর্য কথা! আপনার বাড়িতে একদল চোর এল, তারা আপনার লোহার সিন্দুক খুলে মূল্যবান কিছুই নিয়ে গেল না, নিয়ে গেল কেবল এক টুকরো কাগজ, যার উপরে লেখা ছিল এই ছড়াটি, আর আপনার পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন যার মধ্যে পাবেন আপনি দুঃসময়ে অর্থের সন্ধান৷ সর্পনৃপের দর্প ভেঙে বিষ্ণুপ্রিয়া বাঁধেন বাসা৷ এটুকু পড়েও আপনার মনে কোনো সন্দেহের ইঙ্গিত জাগেনি?’
সুব্রত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘কিছু না, কিছু না৷ সর্পনৃপই বা কী, আর তার সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়ার সম্পর্কই বা কী?’
জয়ন্ত গম্ভীরকন্ঠে বলল, ‘একটি সম্পর্ক থাকতে পারে বই কী! মানিক, তুমি কিছু বুঝতে পারছ কি?’
মানিক বলল, ‘পাগল, ধাঁধা নিয়ে আমি কোনোকালেই মাথা ঘামাবার চেষ্টা করি না৷’
জয়ন্ত মৃদু হাস্য করে বলল, ‘কিন্তু ওই চেষ্টাই হচ্ছে আমার জীবনের তপস্যা! চিরদিনই আমি ধাঁধার জবাব খুঁজতে চাই৷ যাক গে সে-কথা৷ সুব্রতবাবু, আপনাকে আমি দু-একটি কথা জিজ্ঞাসা করব৷’
‘করুন৷’
‘এই ছড়ার কথা আপনি আগে আর কারুর কাছে বলেছিলেন কি?’
‘তা বলেছিলাম বই কী৷ অনেক লোকের কাছেই ওই ছড়াটা দেখিয়েছিলাম৷ যে দেখেছে সেই-ই অবাক হয়ে গেছে, ওর মধ্যে কোনো মানেও খুঁজে পায়নি৷ যার মানে নেই, তার মধ্যে আবার মানে খুঁজে পাওয়া যায় কি জয়ন্তবাবু?’
জয়ন্ত সেই জিজ্ঞাসার কোনোই জবাব না দিয়ে বলল, ‘সুব্রতবাবু আপনি বললেন যে, আপনার পূর্বপুরুষরা নাকি ধনী ছিলেন৷ তাঁরাও কি কলকাতাতেই বাস করতেন?’
‘না৷ আমাদের আদি বাস হচ্ছে দক্ষিণ বাংলার কোদালপুর গ্রামে৷ আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার৷ দেশে আজও আমার কিছু জমিজমা আছে, আর তার ব্যবস্থা করতে এখনও আমি মাঝে মাঝে দেশে যাই বটে; কিন্তু নিজেকে আর জমিদার ভেবে আত্মগৌরব লাভ করতে পারি না৷’
‘দেশে আপনাদের বসতবাড়ি আছে তো?’
‘আছে, এইমাত্র৷ প্রকাণ্ড অট্টালিকা, চার-চারটে মহল, তার চারিধার ঘিরে মস্তবড়ো বাগান, কিন্তু সে-সমস্তই আজ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে আর বনজঙ্গলে, বসতবাড়ির একটা মহলের কিছু কিছু সংস্কার করে খান-ছয়েক ঘর কোনো রকমে মানুষের উপযোগী করে নিয়েছি, যখন দেশে যাই, সেই ঘরগুলো ব্যবহার করি৷’
‘আপনাদের দেশের বাগানে পুকুর আছে?’
‘নিশ্চয়ই আছে, প্রকাণ্ড পুকুর-কলকাতার গোলদিঘির চেয়ে প্রায় চার গুণ বড়ো-‘
‘আর সেই পুকুরের ধারে কোনো পুরোনো বট গাছ আছে কি?’
‘ভারি আশ্চর্য তো, আপনি এমন প্রশ্ন করছেন কেন? হ্যাঁ মশাই, পুকুরের দক্ষিণ তীরে আছে একটা মস্ত বটগাছ, তার বয়স কত কেউ তা জানে না৷’
‘আর সেই বট গাছের উপরে বাস করে বকের দল?’
সুব্রত বিপুল বিস্ময়ে দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বলল, ‘এ-কথা আপনি জানলেন কেমন করে?’
‘পরে বলব৷ আপাতত আমার জিজ্ঞাসার জবাব দিন৷’
‘সেই বট গাছের উপরে চিরদিন ধরেই বাস করে আসছে বকের দল, ও-গাছটা হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন তাদের নিজস্ব সম্পত্তি!’
জয়ন্ত কিছুক্ষণ বসে রইল নীরবে৷ তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রুপোর শামুকের ভিতর থেকে এক টিপ নস্যি নিয়ে বলল, ‘মানিক, জাগ্রত হও৷’
‘ব্যাপার কী বন্ধু? খুব খুশি না হলে তুমি নস্য নাও না৷ কিন্তু খুশির কারণটি কী?’
‘আর আমরা অলস হয়ে বসে থাকব না৷ ওঠো, মধুকে পোঁটলা-পুঁটলি বাঁধতে বলো৷ আজ থেকেই শুরু হবে আমাদের নতুন অভিযান৷’
‘কিন্তু যাবে কোন দিকে?’
‘সুব্রতবাবুর দেশে, কোদালপুর গ্রামে৷’
সুব্রত খানিকক্ষণ অবাক হয়ে বসে রইল৷ তারপর বিস্মিত স্বরে বলল, ‘ও জয়ন্তবাবু, ওই ছড়ার প্রলাপের ভিতর থেকে আপনি কোনো অর্থ খুঁজে পেয়েছেন নাকি?’
‘আপনার পূর্বপুরুষেরা বলে গেছেন, ছড়ার মধ্যে অর্থের সন্ধান পাওয়া যাবে৷ তাঁদের কথা মিথ্যা নয়৷ সত্য-সত্যই এই ছড়াটির ভিতরে আছে গভীর অর্থ৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, আপনি সমস্ত ছড়াটার কথা আমাকে বলতে পারলেন না; তাহলে হয়তো এখনই সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত৷’
‘এমন জানলে আমি যে ছড়াটা একেবারে মুখস্থ করে রাখতাম৷’
‘যাক গে, যেটুকু সূত্র পেয়েছি, তাই নিয়েই এখন কাজ আরম্ভ করে দিই৷ মানিক, সুন্দরবাবুকে আমাদের সঙ্গে যাবার জন্যে আমন্ত্রণ করে এসো-তিনি এখন ছুটিতে আছেন৷ সুন্দরবাবু সঙ্গে না থাকলে আমাদের কোনো অভিযানই ভালো করে জমে না!’
দ্বিতীয় – ভূষোপাগলা
জয়ন্তরা কোদালপুর গ্রামে গিয়ে দেখল, সুব্রত কিছুমাত্র অত্যুক্তি করেনি৷ তাদের পৈতৃক অট্টালিকাখানা কেবল প্রকাণ্ড বললেই যথার্থ বলা হয় না, অত বড়ো অট্টালিকা রাজধানী কলকাতাতেও বোধ হয় দু-চারখানার বেশি নেই৷ আর সেই অট্টালিকার চারিপাশ ঘিরে বিরাজ করছে যে উদ্যান, তার সীমানা নির্দেশ করাও হচ্ছে রীতিমতো কঠিন ব্যাপার৷
প্রকাণ্ড অট্টালিকা এবং এক সময়ে যে তার সৌন্দর্যও ছিল অপূর্ব, সে-বিষয়ে নেই কোনোই সন্দেহ৷ কিন্তু তার বর্তমান রূপ দেখলে মন হা-হা করে ওঠে৷
অট্টালিকার কোনো কোনো অংশ ধ্বসে পড়ে রচনা করেছে পাহাড়ের মতন স্তূপ৷ এবং তার কোনো কোনো অংশ কোনোক্রমে এখনও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু তাদের বর্ণহীন, বালুকাহীন ও গঠনহীন বড়ো বড়ো ফাটল-ধরা গায়ের উপরে বিরাজ করছে রীতিমতো বনজঙ্গল৷ মস্ত মস্ত অশথ, বট ও নিমগাছের দল প্রায় তাদের সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন করে আছে, আর সেই সব গাছের ডালে ডালে বাদুড়, প্যাঁচা ও আরও নানা জাতীয় পাখিরা এসে বাসা বেঁধেছে৷ এবং সেইসব গাছের তলদেশ জুড়ে আছে নানা শ্রেণির আগাছার ঝোপঝাপ৷
অট্টালিকার চতুষ্পার্শ্ববর্তী বহুদূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জমি, আগে যার নাম ছিল উদ্যান, এখন তারও অবস্থা ভয়াবহ বললেও চলে৷ আজ কেউ তাকে কল্পনাতেও উদ্যান বলে সন্দেহ করতে পারবে না, কারণ, তার নানা স্থানেই আশ্রয় নিয়েছে এমন গভীর জঙ্গল, যা দেখলে মহা অরণ্য ‘সুন্দরবন’-এর কথাই মনে পড়ে৷ এক সময়ে যখন এখানে ছিল ফুলবাগান আর ফলবাগান, তখন যে চারিদিকেই ছিল উচ্চ ও কঠিন প্রাচীর, নানা জায়গায় আজও তার চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে৷ কিন্তু আজ প্রাচীরের অধিকাংশই ভেঙেচুরে একেবারে হয়েছে ভূমিসাৎ৷
সুন্দরবাবু রীতিমতো ভীতকন্ঠে বললেন, ‘হুম! জয়ন্ত, তুমি কী বলতে চাও, গভীর অরণ্যের মধ্যে এই বিপুল ভগ্নস্তূপের ভিতরেই এখন কিছুকাল ধরে আমাদের বাস করতে হবে? উঁহু, উঁহু, কিছুতেই আমি এখানে থাকব না, কিছুতেই কেউ আমাকে এখানে থাকতে রাজি করাতে পারবে না৷ যত সব পাগলার পাল্লায় এসে পড়েছি! বাব্বাঃ, বেড়াতে এসে শেষটা কি পৈতৃক প্রাণটিকে নষ্ট করব? এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে লক্ষ লক্ষ বিষধর সর্প যে আছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই! তার উপরে এখানে যে বাঘ-ভাল্লুকজাতীয় বদমেজাজি জানোয়াররা নেই, এমন কথাও জোর করে বলা যায় না৷ আমি আজই এখান থেকে সবেগে পলায়ন করতে চাই৷’
সুব্রত বলল, ‘মাভৈঃ সুন্দরবাবু, মাভৈঃ৷ এই ভাঙা অট্টালিকার মধ্যে এমন একটা অংশ আছে, যা ছোট্ট হলেও একেবারে আধুনিক বলেই মনে হবে৷ যে কয়দিন আমরা এখানে থাকব, সেই অংশটাই হবে আমাদের বাসস্থান৷’
জয়ন্ত অধীর কন্ঠে বলল, ‘সুব্রতবাবু, এসব বাজে কথা এখন ছেড়ে দিন৷ আপনি যে বড়ো পুষ্করিণীর কথা বলেছিলেন, আমি আগে সেইখানেই যেতে চাই৷’
সুব্রত অগ্রসর হয়ে বলল, ‘আসুন আপনারা, আমি এখন সেই দিকেই যাত্রা করছি৷’
বহু আগাছার ঝোপ এবং লতাপাতার জাল দিয়ে ঘেরা বনস্পতির মতন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষের ‘জনতা’ ভেদ করে মিনিট-পাঁচেক ধরে অগ্রসর হয়ে খানিকটা খোলা জায়গার উপরে এসে পড়ল তারা৷ সেখানেও ঝোপঝাপ আছে বটে, কিন্তু বড়ো গাছের সংখ্যা অত্যন্ত কম৷ তারই মাঝখানে দেখা গেল যেন ঘাসের সবুজ-মাখা একটা সমতল জমি৷
মানিক বলল, ‘সুব্রতবাবু, আপনাদের বাগানের ভিতরে এত বড়ো একটা সবুজ মাঠ কেন?’
সুব্রত হেসে বললে, ‘ওটা মাঠ নয় মানিকবাবু, ওইটে হচ্ছে আমাদের বাগানের প্রধান পুষ্করিণী৷ ওর অধিকাংশই ভরে গিয়েছে পানায় আর পানায়, তাই ওকে দেখাচ্ছে সবুজ মাঠের মতন৷ ওখানে লাফ দিয়ে পড়লে মোটেই মাটি খুঁজে পাবেন না, তলিয়ে যাবেন একেবারে অতল তলে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম৷ এত বড়ো পুকুর আমি কলকাতাতেও দেখিনি! এ কি পুকুর, এ যে সমুদ্রের ক্ষুদ্র সংস্করণ! উঃ! সুব্রতবাবুর পূর্বপুরুষরা কী ধনীই ছিলেন৷’
এইরকম সব কথা বলতে বলতে সকলে সেই সরোবরের ধারে গিয়ে দাঁড়াল৷
মানিক বলল, ‘দেখছি, পুকুরের ওই ভাঙা ঘাটের কাছে পানার অত্যাচার নেই৷’
সুব্রত বলল, ‘বাগানের পাঁচিলের বেশিরভাগই ভেঙে গিয়েছে, গ্রামের লোকজনরা তাই অবাধে এইখানে এসে ওই পুকুরের জল ব্যবহার করে৷ একটি নয় মানিকবাবু, এই পুকুরের চারিদিকে এখনও আটটি ঘাট বর্তমান আছে৷ সব ঘাটেরই অবস্থা শোচনীয়, তবু দারুণ গ্রীষ্মের সময় যখন এখানকার সব পুকুরই জলশূন্য হয়ে যায়, তখন গাঁয়ের লোকেরা এসে এই পুকুরেরই জল ব্যবহার করে, কারণ, আমাদের এই পুষ্করিণী এত গভীর যে, এখানে কোনোদিনই জলের অভাব হয় না৷’
জয়ন্ত বলল, ‘এটা তো দেখছি পুকুরের উত্তরদিক৷ সুব্রতবাবু, আপনি বলেছেন, এই পুকুরের দক্ষিণ তীরে আছে একটা সেকেলে বট গাছ৷ আমি এখন সেই গাছটার কাছেই যেতে চাই৷’
সুব্রত বলল, ‘তাহলে আসুন আমার সঙ্গে৷’
সরোবরের পূর্ব তীর দিয়ে সকলে বেশ খানিকক্ষণ ধরে অগ্রসর হল৷ তারপর পাওয়া গেল সরোবরের দক্ষিণ প্রান্ত৷
সুব্রত অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, ‘ভাঙা ঘাট আর পুকুরের জলের উপরে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে ওই সেই বুড়ো বট গাছ৷ জয়ন্তবাবু, দেখুন, এর ভিতর থেকে আপনি কোনো রহস্যের চাবি আবিষ্কার করতে পারেন কি না!’
জয়ন্ত সেই বট গাছটার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এ-বটগাছটা দেখছি শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন-এর বিখ্যাত বটগাছটার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে! এর চারদিক দিয়ে যেসব ঝুরি মাটির উপরে এসে নেমেছে, তার প্রত্যেকটাই তো হচ্ছে এক-একটা গাছের গুঁড়ির মতন!’
সুব্রত বলল, ‘শুনতে পাচ্ছেন কি, ওই বট গাছের ভিতর থেকে জেগে উঠছে কত চিৎকার? ও চিৎকার হচ্ছে বক আর তাদের বাচ্চাদের৷ দিনে-রাতে এই অশ্রান্ত চিৎকার কখনো থামে না৷ তাই গাঁয়ের লোকেরা এই গাছটাকে বট গাছ না বলে বকগাছ বলে ডাকে৷’
হঠাৎ শোনা গেল, চিৎকার করে কে যেন একটা কবিতা আবৃত্তি করছে৷
জয়ন্ত সচমকে বলল, ‘কথাগুলো যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে৷ এগিয়ে গিয়ে দেখতে হল!’
তারপরেই শোনা গেল চেঁচিয়ে কে বলছে-
‘আয়নাতে ওই মুখটি দেখে
গান ধরেছে বৃদ্ধ বট,
মাথায় কাঁদে বকের পোলা,
খুঁজছে মাটি মোটকা জট৷’
মানিক সবিস্ময়ে বলল, ‘এ-যে সোনার আনারসের ভিতরে পাওয়া সেই ছড়াটারই গোড়ার দিক৷’
জয়ন্ত বলল, ‘চুপ! ছড়ার পরের অংশ শোনো৷’
শোনা গেল-
‘পশ্চিমাতে পঞ্চ পোয়া,
সুয্যিমামার ঝিকমিকি,
নায়ের পরে যায় কত না,
খেলছে জলদ টিকটিকি৷’
এই পর্যন্ত বলেই কন্ঠস্বর আবার হল স্তব্ধ৷
জয়ন্ত সহাস্যে বলে উঠল, ‘এ-যে দেখছি ছড়ার দ্বিতীয় শ্লোক!’
সুব্রত বলল, ‘হ্যাঁ জয়ন্তবাবু, ছড়াটা আমার মুখস্থ নেই বটে, কিন্তু এখন শুনে বেশ বুঝতে পারছি এটা তার দ্বিতীয় শ্লোকই বটে৷’
জয়ন্ত আবার বলল, ‘চুপ! শোনো!’
অজানা কন্ঠস্বরে আবার শোনা গেল-
‘অগ্নিকোণে নেইকো আগুন,
-কাঙাল যদি মানিক মাগে,
গহন বনে কাটিয়ে দেবে
রাত্রি-দিবার অষ্টভাগে৷’
কন্ঠস্বর আবার স্তব্ধ হল৷
সুব্রত হাসতে হাসতে বলল, ‘ও-ছড়াটা কে বলছে জানেন? ও হচ্ছে গাঁয়েরই একটি লোক৷ ওর নাম হচ্ছে ভূষণ৷ এখানকার লোক ওকে ভুষোপাগলা বলে ডাকে! শুনেছি ওর বাবা ছিলেন আমাদের নায়েব৷ কিন্তু সোনার আনারসের ওই ছড়াটা কী করে যে ওর কন্ঠস্থ হল সে-রহস্য আমি জানি না৷ তবে মাঝে মাঝে যখনই এখানে এসেছি, তখনই ওর মুখে শুনতে পেয়েছি ওই ছড়ার পঙক্তিগুলি৷ লোকে বলে, ওই ছড়া মুখস্থ করতে করতেই ও পাগল হয়ে গিয়েছে৷’
জয়ন্ত উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘কিন্তু আপনাদের ওই ভূষোপাগলা থেমে গেল কেন? আমার মনে হচ্ছে ওই ছড়াটার নতুন কোনো অংশ ওর মুখেই আমরা শুনতে পেতে পারি৷’
ঠিক সেই সময়ে পুষ্করিণীর দক্ষিণ তীরের ঘাটের উপরে দাঁড়িয়ে উঠল একটি মূর্তি! তার একেবারে শীর্ণ দেহ, মাথার চুলে জট বেঁধেছে, মুখে রাশীকৃত দাড়ি-গোঁফ এবং সর্বাঙ্গ প্রায় অনাবৃত, কেবল কটিদেশে একখণ্ড কৌপিনের মতন বস্ত্র তার লজ্জা রক্ষার চেষ্টা করছে৷
ভূষণ উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে জয়ন্তদের দিকে তাকিয়ে রইল৷
পায়ে পায়ে তার কাছে এগিয়ে সুব্রত শুধোল, ‘কী গো ভূষোপাগলা, এই দুপুরের রোদে ঘাটে বসে তুমি কী করছ?’
ভূষণ মাটির দিকে মুখ নামিয়ে যেন আপন মনেই বলল, ‘কিছুই করছি না, কিছুই করছি না, অনেক কিছুই করবার আছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না৷’
‘করতে পারছ না কেন?’
‘করতে পারছি না কেন, করতে পারছি না কেন? ছড়ার সঙ্গে পৃথিবী মিলছে না৷’
‘মিলছে না কেন?’
‘যে পৃথিবীতে সোনার আনারস ফলে, মানুষের পৃথিবীর সঙ্গে কোনোদিনই তার মিল হয় না৷ সোনার আনারস, সোনার আনারস হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ৷’
‘তুমি ও ছড়াটা শিখলে কোথায়?’
‘বাবা শিখিয়েছেন গো, বাবা শিখিয়েছেন-বাপ ছাড়া ছেলেকে আর কে শেখাবে বলো?’
জয়ন্ত বলল, ‘কিন্তু ছড়ার সবটা তো তুমি এখনও আমাদের শোনালে না?’
ভূষণ সে-কথার জবাব না দিয়ে হঠাৎ চমকে উঠল-তার মুখেচোখে ফুটল রীতিমতো ভয়-ভয় ভাব! তারপর চারিদিকে ব্যস্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল৷
সুব্রত বলল, ‘হঠাৎ কী হল ভূষোপাগলা, চারিদিকে অমন করে তাকাচ্ছ কেন?’
সুব্রতের কথা সে শুনতে পেল বলে মনে হল না৷ বিড়বিড় করে কী বকতে লাগল তাও বোঝা গেল না৷
সুব্রত এগিয়ে গিয়ে তার একখানা হাত ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, ‘কী তুমি বিড়বিড় করছ? আমাদের কথার জবাব দাও৷’
ভূষণ একেবারে বোবা হয়ে গেল৷ ভয়-বিস্ফারিত চক্ষে তাকিয়ে রইল এক দিকে৷
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে জয়ন্তও ফিরে দেখতে পেল অল্প দূরেই রয়েছে একটা বড়ো ঝোপ৷
কিন্তু সে ঝোপটা একেবারেই স্থির৷ সেখানে সন্দেহজনক কিছুই নেই৷
হঠাৎ ভূষণ বলে উঠল, ‘দুশমন, দুশমন৷’
সুব্রত বলল, ‘দুশমন আবার কে?’
‘আমি দুশমনের গন্ধ পাচ্ছি!’
‘কোথায়?’
‘এই বাগানে৷’
‘বাগানে খালি তো আমরাই আছি৷’
‘যেখানে ভগবান, সেইখানেই থাকে শয়তান৷’
‘কী পাগলামি করছ!’
ভূষণ গান ধরল-
‘আমার পাগল বাবা, পাগলি আমার মা,
আমি তাদের পাগলা ছেলে-‘
জয়ন্ত বাধা দিয়ে বলল, ‘ভূষণ, ও-গান থামিয়ে তুমি সেই ছড়ার সবটা আমাদের শুনিয়ে দাও৷’
‘সোনার আনারসের ছড়া?’
‘হ্যাঁ৷’
‘সে ছড়া তো তোমাদের শোনাতে পারব না!’
‘কেন বলো দেখি?’
‘তোমরা শুনলে দুশমনরাও শুনতে পাবে৷’
‘দুশমন এখানে নেই৷’
‘আছে গো, আছে গো, আছে৷ আজকাল রোজই এখানে দুশমনদের গন্ধ পাই!’
‘তারা কারা?’
‘জানি না৷ তারা থাকে দূরে দূরে আর আনাচে-কানাচে মারে উঁকিঝুঁকি!’
‘তুমি ভুল দেখেছ!’
‘না গো, না গো, না! আমার চোখ ভুল দেখে না৷’
‘বেশ তো, তুমি চুপিচুপি ছড়াটা আমাদের শোনাও না৷ তাহলে দূর থেকে দুশমনরা কিছুই শুনতে পাবে না৷’
‘তোমরা দুশমন নও৷ ছড়াটা তোমাদের শোনাতে পারি৷’
‘বেশ, তবে শোনাও৷’
ভূষণ শুরু করল-
‘আয়নাতে ওই মুখটি দেখে
গান ধরেছে বৃদ্ধ বট-‘
এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ থেমে পড়ে ত্রস্ত চক্ষে আবার সেই ঝোপটার দিকে তাকাল৷
সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্তেরও দৃষ্টি ফিরল সেই দিকে৷ তার দেখাদেখি আর সকলেও ফিরে দাঁড়াল৷
মুহূর্ত-দুই পরে দেখা গেল, খানিকটা ধোঁয়া ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে উঠে যাচ্ছে উপর দিকে!
প্রায় আধ মিনিট পরে আবার সেই দৃশ্য৷
ভূষণ বলে উঠল, ‘দুশমন!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, ঝোপের ভিতর বসে নিশ্চয় কেউ বিড়ি কি সিগারেট খাচ্ছে!’
ভূষণ আবার বলল, ‘দুশমন!’
জয়ন্ত বলল, ‘এগিয়ে দেখতে হল৷’
জয়ন্তের পিছনে পিছনে আর সকলেও অগ্রসর হল-কেবল ভূষণ ছাড়া৷ সেইখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সে নিজের মনে বিড়বিড় করে কী বকতে লাগল৷
মিনিট খানেকের মধ্যেই সকলে গিয়ে হাজির হল ঝোপের কাছে৷ বিড়ি বা সিগারেটের ধোঁয়া তখন অদৃশ্য৷ ঝোপটা বেশ বড়ো, তার ভিতরে অনায়াসেই দশ-বারো জন লোকের ঠাঁই হতে পারে৷
কিন্তু ঝোপের ভিতরে পাওয়া গেল না জনপ্রাণীকে৷ তবে পাওয়া গেল একটা প্রমাণ৷ সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ!
জয়ন্ত হেঁট হয়ে জমির উপর থেকে কী তুলে নিয়ে সকলকে দেখালে৷ সেটা হচ্ছে একটা জ্বলন্ত সিগারেটের অর্ধাংশ৷
মানিক বলল, ‘তাহলে এখানে বসে নিশ্চয়ই কেউ ধূমপান করছিল৷ এখন আমাদের আসতে দেখে সিগারেট ফেলে লম্বা দিয়েছে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘এটা কী সিগারেট দেখছ?’
‘হুঁ৷ স্টেট এক্সপ্রেস ৯৯৯৷’
‘যে এরকম দামি সিগারেট ব্যবহার করে, তার ধনবান হওয়াই উচিত৷ ঝোপের ভিতর সিগারেটের গন্ধ ছাড়া আর একটা গন্ধও পাচ্ছি৷ এসেন্সের মিষ্টি গন্ধে এখানকার বাতাস এখনও ভারাক্রান্ত হয়ে আছে৷ তাহলে বোঝা যাচ্ছে, যে-ব্যক্তি এতক্ষণ লুকিয়েছিল, সে কেবল ধনবান নয়, রীতিমতো শৌখিনও৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘এই ঝোপটার ফাঁক দিয়েই দেখতে পাচ্ছি, ওদিকে বিশ-পঁচিশ হাত তফাতে আরও একটা বড়ো ঝোপ রয়েছে৷ সেই শৌখিন ধনবান ব্যাটা এখান থেকে পালিয়ে ওইখানে গিয়ে লুকিয়ে নেই তো?’
জয়ন্ত বলল, ‘এখনই সে সন্দেহভাজন করা যেতে পারে৷ চলুন৷’
ঠিক সেই সময়ে আচম্বিতে পুষ্করিণীর দিক থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে এল৷ তারপরেই চারিদিক আবার স্তব্ধ৷
জয়ন্ত এক লাফ মেরে ঝোপের ভিতর থেকে বাইরে গিয়ে পড়ল৷
তারপর চটপট চারিদিকে বুলিয়ে নিল নিজের খরদৃষ্টি৷ কিন্তু কোনো দিকেই কারুকে দেখতে পেল না৷
তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মানিক বলল, ‘কই, কেউ তো কোথাও নেই৷ তবে আর্তনাদ করল কে?’
‘আমার বিশ্বাস আর্তনাদ করেছে ভূষোপাগল৷’
‘কিন্তু সে পাগলাই বা কোথায়? তারও যে টিকি দেখতে পাচ্ছি না৷’
‘এসো, আর একবার ঘাটের কাছে যাওয়া যাক৷’
সুব্রতবাবু জয়ন্তের পিছনে পিছনে অগ্রসর হতে হতে বলেন, ‘এ কীরকম ম্যাজিক বাবা? ঝোপের মাথায় সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ে, কিন্তু ঝোপের ভিতরে মানুষ নেই৷ পুকুরের ধারে আর্তনাদ জাগে, কিন্তু কারুকে দেখতে পাওয়া যায় না৷ এসব তো ভালো কথা নয়৷’
কিন্তু পুকুরের ধারে গিয়েও আর্তনাদের বা ভূষণের অদৃশ্য হওয়ার কোনো কারণই খুঁজে পাওয়া গেল না৷ জয়ন্ত পুকুরের ঘাটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, ‘ঘাটের ধাপে ওটা কী পড়ে রয়েছে?’
মানিক এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে নিয়ে বলল, ‘এ যে দেখছি বাঁশের বাঁশি?’
সুব্রত বলল, ‘ও হচ্ছে ভূষোপাগলার বাঁশি! সে বাঁশি বাজাতে ভারি ভালোবাসে, আর ও-বাঁশিটিকে কখনো কাছছাড়া করে না৷’
জয়ন্ত বলল, ‘যখন অমন প্রিয় বাঁশিকে সে পুকুরঘাটে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য হয়েছে, তখন বুঝতে হবে নিশ্চয়ই এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে৷’
‘দুর্ঘটনা!’
‘হ্যাঁ৷ ভূষোপাগলা হয় ভয়াবহ কিছু দেখে দারুণ আতঙ্কে আর্তনাদ করে বাঁশি ফেলেই বেগে পলায়ন করেছে, নয় কেউ বা কারা তাকে বন্দি করে এখান থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘কোনো অর্থই বোঝা যাচ্ছে না৷ এখানে ভয়াবহ কিছুই তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না৷ আর ভূষণের মতন একটা পাগলাকে বন্দি করে কার কী লাভ হতে পারে?’
জয়ন্ত কেবল বলল, ‘বোধ হয় শীঘ্রই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব৷’
তৃতীয় – তির এবং ধোঁয়া
সুব্রত মিথ্যা বলেনি৷ সেই মস্ত ভাঙা অট্টালিকার একটা মহলকে মেরামত করে সত্যই সে আবার তার পূর্বশ্রী উদ্ধার করেছে৷ এ অংশটা যেন আলাদা একখানা বাড়ি৷
উপরে-নীচে খান ছয়েক বড়ো বড়ো ঘর এবং উপরে-নীচে উঠানের চারিপাশেই আছে বেশ চওড়া দালান৷ কোথাও অযত্ন বা মালিন্যের চিহ্নমাত্র নেই৷
বৈঠকখানা-ঘরটির মধ্যে আসবাবের সংখ্যাধিক্য নেই বটে, কিন্তু তার সাজসজ্জার ভিতরে পরিচয় পাওয়া যায় সুরুচির৷ একদিকে আছে দুখানি কোচ ও একখানি সোফা এবং আর-এক দিকে ধবধবে চাদর-পাতা চৌকি, তার উপরে কয়েকটি মোটাসোটা, শুভ্র ও কোমল তাকিয়া যেন অতিথিদের আহ্বান করছে সাদর মৌন ভাষায়৷
ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি মার্বেল-বাঁধানো গোল টেবিল এবং তার চারিপাশে ঘিরে রয়েছে খান ছয়েক গদি-মোড়া চেয়ার৷ টেবিলের উপর রাখা হয়েছে একটি নীলবর্ণপ্রধান চিনামাটির ফুলদানিতে কয়েকটি রক্তগোলাপ এবং ধুম্রসেবকদের ব্যবহারের জন্যে দুটি কাচের ছাইদান৷
দেয়ালকে অলংকৃত করছে প্রাচ্য চিত্রকলা পদ্ধতিতে আঁকা আটখানি ছবি৷ এখানে বিদ্যুৎ-বাতি নেই বটে, কিন্তু ছাদ থেকে ঝুলছে পেট্রোলের এমন একটি বড়ো লন্ঠন, যা প্রচুর আলোক বিতরণ করে অন্ধকারকে তাড়িয়ে দিতে পারে অনায়াসেই৷
ঘরের তিন দিকের জানলার ভিতর দিয়ে বাইরের পানে তাকালেও এখানকার যা প্রধান বিশেষত্ব, সেই বনজঙ্গল, ঝোপঝাপ বা আগাছাদের ভিড় চোখে পড়ে না৷ দেখা যায় শুধু ঘাসের সবুজ মখমলে মোড়া পরিষ্কার সমতল জমি এবং এখানে-ওখানে ছোটো-বড়ো ফুলগাছদের বর্ণবৈচিত্র্য৷
সুন্দরবাবু ধপাস করে একখানা কোচের উপরে বসে পড়ে বললেন, ‘হুম! এতক্ষণে মনে হচ্ছে, আফ্রিকার নিবিড় অরণ্য ত্যাগ করে আমরা আবার সভ্যজগতে ফিরে এলাম৷ দিব্যি ঘরখানি! চোখ জুড়িয়ে যায়!’
মানিক বলল, ‘সুব্রতবাবু জঙ্গল সাফ করে বাড়ির এই অংশটিকে এমন উপভোগ্য করে তুলতে আপনার তো কম খরচ হয়নি৷ প্রবাদের কথাই সত্যি-মরা হাতিরও দাম লাখ টাকা৷’
সুব্রত এটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল, ‘পৈতৃক ভিটের মায়া ছাড়া বড়োই কঠিন৷ আমি একেলে বাঙালিবাবুদের মতন নই মানিকবাবু৷ কত যুগ ধরে যেখানকার আকাশে-বাতাসে আমার পূর্বপুরুষদের পবিত্র স্মৃতি সঞ্চিত হয়ে রয়েছে, কেমন করে ভুলব সেখানকার মাটির প্রেমকে? তেমন সামর্থ্য থাকলে সমস্ত অট্টালিকা আর উদ্যানের নষ্ট-শ্রী আবার আমি উদ্ধার করতাম, কিন্তু উপায় নেই-উপায় নেই৷ অট্টালিকার ওই একটি অংশকেই বাসোপযোগী করে তুলতে গিয়ে মহাজনের কাছে আমাকে ঋণ স্বীকার করতে হয়েছে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘সুব্রতবাবু, আপনার উপরে আমার শ্রদ্ধা বাড়ল৷ যারা নিজেদের বংশগৌরব আর অতীত মহিমা ভুলে যায়, তারা মানুষ নামের যোগ্য নয়৷ অথচ বাংলাদেশের যে দিকে তাকাই, সেই দিকেই দেখতে পাই এমনই অমানুষের দল৷ তারা আজ নিজেদের গ্রাম ভুলে নব্য আর শহুরে হওয়ার জন্যে কলকাতায় এসে সিনেমা, থিয়েটার, ফুটবল-ক্রিকেট আর হোটেল-রেস্তোরাঁ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে৷ মুখময় তাদের ‘স্নো’ আর ‘পাউডারে’র প্রলেপ, চোখে তাদের শখের চশমা, ওষ্ঠাধরে সিগারেট, হাতে ‘রিস্টওয়াচ’ আর নট-নটীদের ছবি, পরনে ফিরিঙ্গি পোশাক আর পায়ে মেয়েলি চলনের ভঙ্গি৷ অথচ তাদের অবহেলায় তাদের গ্রাম যে অরণ্যের নামান্তর হতে বসেছে, সেদিকে কারুরই খেয়াল-এমনকী করবার ইচ্ছা পর্যন্ত নেই৷ আমি এদের কীটপতঙ্গ বলে মনে করি-এরা নরাধম নয়, পশুরও অধম! আপনি যে এ-জাতীয় জীব নন, আপনার মধ্যে যে যথার্থ মনুষ্যত্ব আছে, তারই প্রমাণ পেয়ে আমি আজ অত্যন্ত আনন্দিত হলাম৷ . . . কিন্তু যাক সে-কথা৷ এখন কাজের কথা হোক৷ কোদালপুরের মধ্যে এখন সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি কে?’
‘বিশিষ্ট ব্যক্তি মানে?’
‘সবচেয়ে ধনী বা প্রতিপত্তিশালী৷’
সুব্রত একটু ভেবে বলল, ‘এখানে এমন কেউ নেই, যাকে খুব ধনী বলা যায়৷ তবে এখানে এমন একজন লোক আছে, স্থানীয় বাসিন্দারা যাকে খুব মানে৷’
‘মানে কেন?’
‘ভয়ে৷’
‘ভয়ে?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ৷ তার নাম প্রতাপ চৌধুরি৷ সে একজন দুর্দান্ত লোক৷ যে তার সঙ্গে শত্রুতা করেছে তাকেই বিপদে পড়তে হয়েছে৷ বার-দুয়েক খুনের মামলাতেও তাকে আসামি হতে হয়েছিল, কিন্তু দুই বারেই প্রমাণ অভাবে সে খালাস পায়৷ এখানকার কোনো লোকই তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস করে না৷’
জয়ন্ত কৌতুহলী কন্ঠে বললে, ‘বটে, বটে? তাহলে আরও ভালো করে লোকটির কথা বলুন তো সুব্রতবাবু৷’
‘প্রতাপকে চোখে দেখে কিছু বোঝবার জো নেই৷ ফরসা রং, নাদুস-নুদুস মাঝারি চেহারা, সর্বদাই মিষ্টি হাসিমাখা মুখ, এক জামা দু-দিন পরে না-এমনই শৌখিন সে৷’
‘তাহলে সে ধনবান?’
‘এখানেই একটা আশ্চর্য রহস্য আছে৷ তার পৈতৃক সম্পত্তি নেই, সে নিজেও কোনো কাজকর্ম করে না, অথচ তার টাকার অভাব নেই৷ মাঝে মাঝে সে বেশ কিছু দিনের জন্যে গ্রাম ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়-কেন যায়, কোথায় যায়, কেউ তা জানে না৷ প্রতাপের সঙ্গে সর্বদাই একদল লোক থাকে, সে গ্রাম থেকে অদৃশ্য হলে তাদেরও আর দেখতে পাওয়া যায় না৷ লোকগুলোর চেহারা ভদ্র না হলেও চাকর-দারোয়ানেরও মতো নয়-কিন্তু তারা সকলেই জোয়ান৷’
জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবু, প্রতাপ কীরকম লোক বলে মনে করেন?’
‘সন্দেহজনক৷’
‘কেন?’
‘যে অর্থবান নয়, অথচ যার অর্থের অভাব নেই, সে লোকের উপর দৃষ্টি রাখা দরকার৷ এখানকার পুলিশের কাছে খবর নিলে প্রতাপ সম্বন্ধে হয়তো আরও নতুন কথা জানতে পারব৷’
‘তার চেয়ে চলুন না, আমরা নিজেরাই গিয়ে প্রতাপবাবুর সঙ্গে একটু আলাপ জমিয়ে আসি৷’
সুব্রত বলল, ‘আপনার এ-আশা আজ সফল হবে না৷ আমি এখানে এসেই খবর পেয়েছি, প্রতাপ এখন কোদালপুরে নেই৷’
জয়ন্ত বলল, ‘যাক, তাহলে আপাতত প্রতাপকে নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে৷ এইবারে স্নানাহারের চেষ্টা করা যাক৷’
সে উঠে দাঁড়াল এবং সেই মুহূর্তেই জানলা-পথ দিয়ে কী একটা জিনিস সাঁ করে তার মাথার পাশ দিয়ে ছুটে দেওয়ালে বাধা পেয়ে ঘরের মেঝের উপরে সশব্দে গিয়ে পড়ল!
জয়ন্ত সচমকে জিনিসটার দিকে তাকিয়েই এক লাফে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷
মানিক তাড়াতাড়ি জিনিসটা মাটির উপর থেকে তুলে নিল৷
সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘হুম! ওটা যে দেখছি তির!’
জয়ন্ত বলল, ‘হ্যাঁ সুন্দরবাবু! ওটা যদি লক্ষ্যভেদ করতে পারত, তাহলে আর আমার স্নানাহারের দরকার হত না৷’
সুব্রত বলল, ‘কে তির ছুড়ল? কেন ছুড়ল?’
‘কে ছুড়ল জানি না৷ জানলার কাছে এসে তো জনপ্রাণীকে দেখতে পেলাম না৷ তবে কেন যে ছুড়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি৷ এই কোদালপুরে এমন কোনো মহাত্মা আছেন, যাঁর ইচ্ছা নয় যে, আমি ধরাধামে বর্তমান থাকি৷’
‘সে কী জয়ন্তবাবু, এখানে তো কারুরই আপনার উপরে রাগ থাকবার কথা নয়! এখানে কে আপনাকে চেনে?’
‘যাদের চেনা উচিত, তারাই চেনে৷ আমি সোনার আনারসের রহস্য উদ্ধার করতে এসেছি, আমাকে আবার তারা চিনবে না?’
‘তারা কারা?’
‘যারা আপনাকে আক্রমণ করে সোনার আনারসের ছড়া চুরি করে নিয়ে গিয়েছে, যারা বাগানের ঝোপে বসে আমাদের গতিবিধির উপরে লক্ষ রেখেছিল, যাদের দেখে ভূষোপাগলা আর্তনাদ করে উঠেছিল, তাদেরই অনুগ্রহ-দৃষ্টি পড়েছে আজ আমার উপরে৷ এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ সুন্দরবাবু, মানিক, আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে-এ শত্রু বড়ো সামান্য শত্রু নয়, এরা এখন আমাদের পিছনে পিছনেই ঘুরবে৷’
সুন্দরবাবু বলল, ‘সুব্রতবাবু, এই বিশ শতাব্দীতেও তির ছোড়ে তো খালি অসভ্য দেশের লোকেরা! আরে ছ্যাঃ, আপনাদের কোদালপুর আমার একটুও ভালো লাগছে না৷’
জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবু, বিশ শতাব্দীতেও সময়ে সময়ে আগ্নেয় অস্ত্রের চেয়ে তির বেশি কাজে লাগতে পারে৷ তির-ধনুক বন্দুকের মতন গর্জন করে পাড়া মাত করে না, কাজ সারে চুপিচুপি৷ . . . আরে আরে সুন্দরবাবু, আঙুল বুলিয়ে তিরের ফলার ধার পরীক্ষা করছেন কেন? ও তির যদি বিষাক্ত হয়?’
সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে তিরটা মাটির উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘ও বাবা, ঠিক তো! এটা তো আমি ভাবিনি! একটু হলেই সর্বনাশ হয়েছিল আর কী, হুম!’
‘যাক, তিরন্দাজের কথা ভুলে এইবার স্নানাহার সেরে নেওয়া যাক৷ বড়োই বেলা হয়েছে৷’
সন্ধ্যার কিছু আগে জয়ন্ত বলল, ‘সুব্রতবাবু চলুন, একটু বেড়িয়ে আসা যাক৷’
বাইরে বেরিয়ে সুব্রত জিজ্ঞাসা করল ‘জয়ন্তবাবু, কোন দিকে যাবেন?’
‘যেদিকে প্রতাপ চৌধুরির বাড়ি৷’
‘কিন্তু সেখানে গিয়ে কী হবে? প্রতাপকে তো পাবেন না৷’
‘প্রতাপকে না পাই, তার বাড়িখানাকে তো পাব৷’
‘প্রতাপ যখন দলবল নিয়ে অদৃশ্য হয়, তখন তার বাড়ি তালাবন্ধ থাকে৷’
‘থাকুক তালাবন্ধ৷ বাড়িখানাকে আমি একবার বাইরে থেকে দেখতে চাই৷ যে-কোনো বাড়ি তার মালিকের অল্পবিস্তর পরিচয় দিতে পারে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘কী যে বলো জয়ন্ত, কিছু মানে হয় না৷’
‘খুব হয়৷ একখানা বাড়ি দেখলেই বোঝা যায় তার মালিক কোন প্রকৃতির লোক! সে ধনী, না মধ্যবিত্ত, না দরিদ্র? সে শৌখিন, না সাদাসিধে? এমন আরও অনেক কিছুই বাড়ি দেখে আমি বলে দিতে পারি৷’
‘ইস, তাহলে আর ভাবনা ছিল না! কারুর বাড়ি দেখেই তুমি বলে দিতে পারো, সে সাধু, না চোর? সে গাঁজা খায়, না চণ্ডু খায়? যত সব বাজে ধাপ্পা৷’
জয়ন্ত হেসে বলল, ‘সুন্দরবাবু, আপনি বড্ড বেশি এগিয়ে যাচ্ছেন, অতটা আমি পারি না৷’
মানিক বলল, ‘সুন্দরবাবু, আপনি ঠিক বলেছেন৷ আপনার বসতবাড়ি দেখে জয়ন্ত কিছুতেই বলতে পারবে না যে, তার মালিকের মাথায় আছে কাচের মতন তেলা টাক আর কোমরে আছে মস্ত বড়ো ঝোঝুল্যমান ভুঁড়ি! হ্যাঁ হে, জয়ন্ত, তুমি তা বলতে পারবে কি?’
জয়ন্ত হেসে ফেলে বলল, ‘মানিক, চিরদিনই কি তুমি সুন্দরবাবুকে চটাবার চেষ্টা করবে?’
সুন্দরবাবু প্রাণপণে মনের রাগ দমন করতে করতে বললেন, ‘হুম, মানিকের মতন ছ্যাঁচড়ার কথায় আমি আবার নাকি রাগ করব! আরে ছোঃ! মানিককে আমি ছুঁচোর মতন বাজে জীব বলে মনে করি৷’
সুন্দরবাবুকে আরও বেশি রাগাবার জন্যে মানিক আবার কী বলবার উপক্রম করছিল, কিন্তু জয়ন্ত বাধা দিয়ে বলল, ‘বাজে কথায় সময় নষ্ট করবার সময় আমার নেই৷ চলুন সুব্রতবাবু, প্রতাপের বাড়ি আমাকে চিনিয়ে দিন৷’
সকলে অগ্রসর হল৷
কোদালপুর গ্রামখানি বিশেষ বড়ো গ্রাম নয়৷ কাঁচা পথ, তার এধারে-ওধারে মাঝে মাঝে দু-চারখানা মেটেঘর এবং মাঝে মাঝে দু-একখানা কোঠাবাড়ি৷
খানিক দূর অগ্রসর হয়ে পাওয়া গেল একখানা লাল রঙের তিনতলা বাড়ি৷ তার চারপাশে আছে পাঁচিল-ঘেরা খানিকটা ন্যাড়া জমি৷
সুব্রত বলল, ‘এই হচ্ছে প্রতাপের বাড়ি৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘জয়ন্ত ভায়া, তুমি বাড়ি দেখে বাড়ির মালিককে নাকি চিনতে পারো? এ বাড়িখানাকে দেখে তোমার কী মনে হয়?’
জয়ন্ত বলল, ‘আমার কী মনে হয়? আমার মনে হয়, এ বাড়ির মালিক অত্যন্ত সাবধানী!’
‘মানে?’
‘মানে ওই বাড়ির দিকে তাকালেই বোঝা যায়৷ প্রত্যেক ভদ্রলোকের বাড়ির জানলায় থাকে সোজা চার কি পাঁচটি গরাদ৷ কিন্তু এ বাড়ির জানলায় দেখছি, সোজা গরাদের সঙ্গে আড়াআড়ি লোহার গরাদ দেওয়া! তার মানে হচ্ছে, এই বাড়ির মালিক চান যে, বাইরের কোনো লোক সহজে যেন বাড়ির ভিতর ঢুকতে না পারে! এতটা সাবধানতার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো অর্থ আছে৷’
সুব্রত বলল ‘জয়ন্তবাবু, প্রতাপের বাড়ি দেখলেন তো?’
জয়ন্ত বলল, ‘দেখলাম বই কী! বাড়ির ফটকে মস্ত এক তালা লাগানো রয়েছে৷ তার মানে হচ্ছে, এই বাড়ির ভিতরে কোনো লোক নেই৷ আচ্ছা, আসুন! যখন বাড়িখানাকে পেয়েছি, তখন এর চারিদিকটা একবার প্রদক্ষিণ করে দেখা যাক!’
‘তাতে আমাদের কী লাভ হবে?’
‘লাভ? হয়তো কিছুই লাভ হবে না, তবু আরও কিছুক্ষণ পদচালনা করলে বিশেষ ক্ষতি হবারও সম্ভাবনা নেই বোধ হয়?’
সকলে বাড়ির চতুর্দিকে একবার ঘুরে এল, কিন্তু উল্লেখযোগ্য আর কিছুই নজরে পড়ল না৷ বাড়ির প্রত্যেক জানলা বন্ধ, কোথাও জীবনের কোনো লক্ষণই নেই৷
গ্রামের উপরে তখন ক্রমেই ঘন হয়ে উঠেছে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া৷ পাখির দল বাসায় ফিরে গিয়েছে, এখানে-ওখানে গাছের ওপর থেকে ভেসে আসছে তাদের বেলা-শেষের কলরব৷
জয়ন্ত একদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আবার থমকে দাঁড়ালে কেন বাপু? শেষটা কি অন্ধের মতো সাপের খপ্পরে গিয়ে পড়বে?’
জয়ন্ত চোখ না ফিরিয়েই বলল, ‘সুব্রতবাবু, আপনি তো বললেন, এ-বাড়ির ভিতরে লোকজন কেউ নেই?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ স্বচক্ষেই তো দেখলেন বাড়ির বাইরে তালা দেওয়া!’
‘তা দেখেছি বটে৷ কিন্তু এখন আর একটা জিনিসও লক্ষ করছি৷’
‘কী?’
‘ধোঁয়া৷’
‘ধোঁয়া আবার কী?’
‘বাড়ির দোতলার কোণের ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখুন৷’
সকলে সেই দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে দেখল, একটা বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়ার পর ধোঁয়া৷
জয়ন্ত বলল, ‘ধোঁয়া কি মানুষের অস্তিত্বই প্রমাণিত করে না?’
মানিক বলল, ‘বোধ হয় ওটা রান্নাঘর৷ কেউ উনুনে আগুন দিয়েছে৷’
‘হুঁ৷ এখন আমাদের কী করা উচিত?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘এখন আমাদের কিছুই না করা উচিত৷ সোজা বাসায় ফিরে চলো৷’
‘তাই যাব৷ কিন্তু তারপর গভীর রাত্রে আবার আমরা এইখানেই ফিরে আসব৷’
‘কেন?’
‘বাড়ির ভিতরটা দেখবার জন্যে আমার আগ্রহ হচ্ছে৷’
‘দেখবে কেমন করে? দরজায় তো তালা বন্ধ! দরজা ভাঙবে?’
‘উঁহু৷ আগে বাইরের প্রাচীর লঙ্ঘন করব৷’
‘তারপর?’
‘তেতলার ছাদ থেকে ওই যে বৃষ্টির জল বেরোবার নলটা মাটির দিকে নেমে এসেছে, ওইটে অবলম্বন করে সোজা ছাদের উপর গিয়ে উঠব৷’
সুন্দরবাবু দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, ‘বলো কী হে? ওসব আমাকে দিয়ে হবে-টবে না বাপু! তারপর যদি ফস করে হাত ফসকেউঃ!’ তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না, শিউরে উঠে দুই চক্ষু মুদে ফেললেন৷
জয়ন্ত বলল, ‘আপনি সুব্রতবাবুর সঙ্গে বাসাতেই থাকবেন৷ আমার সঙ্গে আসবে খালি মানিক৷’
মানিক বলল, ‘রাজি!’
চতুর্থ – সেই রাত্রে
ঢং ঢং ঢং ঢং-
জয়ন্ত প্রথম রাত্রেই শয্যাগ্রহণ করেছিল এবং মানিকও৷ কিন্তু তাদের ঘুম অত্যন্ত সজাগ৷
ঘড়ি বার-চারেক বাজতে না বাজতেই জয়ন্ত বিছানার উপরে ধড়মড় করে উঠে বসে ডাকল, ‘মানিক!’
মানিকও ততক্ষণে বিছানার উপরে উঠে বসেছে৷ দুই হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, ‘শুনেছি৷ রাত বারোটা বাজছে৷’
‘আমাদের পোশাক পরাই আছে৷ উঠে পড়ো৷ ওই ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিতে ভুলো না৷ চলো, আর দেরি নয়৷’ জয়ন্ত গাত্রোত্থান করে নিজের ব্যাগটার দিকে বাহু বিস্তার করল৷
মানিক বলল, ‘সুন্দরবাবুর নাক এখনও গান গাইছে৷ যাবার সময় ওঁকে বলে গেলে হয় না?’
‘হুম! না, আমার নাক এখনও গান গাইছে না! তোমার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি!’
মানিক সবিস্ময়ে ফিরে দেখল, সুন্দরবাবু জুলজুল করে তাকিয়ে আছেন তারই মুখের পানে! বলল, ‘কিমাশ্চর্যতঃপরম৷ স্বচক্ষে দেখলাম আপনার নিদ্রিত চক্ষু, আর স্বকর্ণে শুনলাম আপনার জাগ্রত নাসিকাধ্বনি৷ অথচ আপনি-‘
সুন্দরবাবু উঠে বসতে বসতে বাধা দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! আমার নাক ডাকলেও আর আমার চোখ বুজে থাকলেও আমি নিদ্রায় অচেতন হয়ে পড়িনি৷ তোমরা যাবে হাঁড়িকাঠে মাথা গলাতে আর আমি ঘুমিয়ে অজ্ঞান হয়ে থাকব? আমি কি অমানুষ? আমি কি তোমাদের ভালোবাসি না?’
জয়ন্ত বলল, ‘প্রতাপ চৌধুরির বাড়িখানাকে আপনি হাঁড়িকাঠ বলে মনে করেন নাকি?’
‘নিশ্চয়! প্রতাপ চৌধুরির যেটুকু বর্ণনা শুনেছি, তাই-ই যথেষ্ট! তার উপরে, এই কালো ঘুটঘুটে রাতে, নর্দমার নল বয়ে তোমরা ওঠবার চেষ্টা করবে এক অজানা শত্রুপুরীর তেতলায়! এমন অপচেষ্টার কথা কেউ কখনো শুনেছে নাকি? উঃ! তোমাদের এই মতলব শুনে পর্যন্ত বুক এত ধড়ফড় করছে যে, হয়তো আমার কোনো শক্ত ব্যামো হবে৷ এসব শুনেও কেউ কখনো নাকে সরষের তেল দিয়ে অঘোরে ঘুমোতে পারে?’
মানিক মুখ টিপে হেসে বলল, ‘আপনি নাসিকার জন্যে সরিষার তৈল ব্যবহার করেননি বটে, কিন্তু আপনার নাসিকা যে ভীষণ কোলাহল করছিল, সে-বিষয়ে একটুও সন্দেহ নেই!’
সুন্দরবাবু বিছানার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মারমুখো হয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘আমার নাসিকা কোলাহল করছিল, বেশ করছিল! আমার নাসিকা যত খুশি কোলাহল করতে পারে, তাতে তোমার কী হে বাপু? ফাজিল ছোকরা! খালি খালি আমার পিছনে লাগা?’
জয়ন্ত মৃদু হেসে বলল, ‘শান্ত হোন সুন্দরবাবু, শান্ত হোন৷ মানিক, এখন মশকরা করবার সময় নেই৷ জানো, আমাদের সামনে রয়েছে কী গুরুতর কর্তব্য?’
মানিক বলল, ‘জানি জয়ন্ত, জানি! কিন্তু সুন্দরবাবুর মাথার উপরে ওই লাউয়ের মতন তেলা টাক, আর কাঁকড়ার দাড়ার মতন ওঁর ওই একজোড়া গোঁফ, আর ওঁর ওই থলথলে বিপুল ভুঁড়িটিকে দেখলেই আমার মন যেন অট্টহাস্য না করে থাকতে পারে না৷ বেশ সুন্দরবাবু, আমাকে ক্ষমা করুন! আজকের মতো মৌনব্রত অবলম্বন করলাম৷’
সুন্দরবাবুর সমস্ত রাগ যেন জল হয়ে গেল একেবারে৷ তিনি হঠাৎ এগিয়ে এসে ডান হাতে জয়ন্তের কাঁধ এবং বাম হাতে মানিকের কাঁধ চেপে ধরে করুণ কন্ঠে বললেন, ‘ভাই জয়ন্ত! ভাই মানিক! আমাকে এখানে একলা ফেলে কেন তোমরা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ?’
জয়ন্ত বলল, ‘আমি তো আপনাকে একলা থাকতে বলছি না৷ আপনিও তো অনায়াসেই আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন৷’
সুন্দরবাবু দুই ভুরু উঠে গেল কপালের দিকে এবং তাঁর সর্বাঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল একটা প্রবল উত্তেজনার শিহরন৷ আড়ষ্টভাবে তিনি বললেন, ‘হুম! ছাতের জল বেরোবার নল বেয়ে আমি উঠব তেতলার উপরে? জয়ন্ত, তোমার মাথা কি একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছে? হুম, হুম, হুম! আমার এই শরীরটিকে তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না?’
‘বেশ তো, আপনি না হয় মাটির উপরে দাঁড়িয়ে থেকেই পাহারা দেবার চেষ্টা করবেন৷’
‘পাগল! আজ আমি এখানে এক দিনেই তিন বার তিনটে গোখরো সাপকে স্বচক্ষে দেখেছি! এখানকার মাটি ছাতের জল বেরোবার নলের চেয়েও বিপজ্জনক৷ আমি ভাই ছাপোষা মানুষ-ঘরে আছে স্ত্রী আর আধ-ডজন ছেলেমেয়ে৷ আমার পক্ষে এত তাড়াতাড়ি যমালয়ে যাবার চেষ্টা করা উচিত নয়৷’
জয়ন্ত দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল, ‘বেশ, তাহলে আপনি নিরাপদে এইখানেই অবস্থান করুন৷ আমাদের আর বাধা দেবেন না-আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷’
সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি জয়ন্তের সামনে এসে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তার চেয়ে জয়ন্ত, আমার আর একটা পরামর্শ শোনো৷’
‘কী পরামর্শ?’
‘কালকেই টেলিগ্রাফ করে আমি এখানে একদল পুলিশফৌজ আনাব৷ তারপর সদলবলে গিয়ে ঘেরাও করব প্রতাপ চৌধুরির বাড়ি৷’
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘তা হয় না সুন্দরবাবু৷ হয়তো গ্রামের দিকে দিকে আছে প্রতাপ চৌধুরির চরেরা৷ এখানে হঠাৎ পুলিশফৌজের আবির্ভাব দেখলেই যথাস্থানে সেই খবর গিয়ে পৌঁছোবে৷ তারপর? তারপর আমরা দেখব গিয়ে খাঁচা খালি-পাখিরা কোথায় অদৃশ্য৷ এখন আর কথা-কাটাকাটি করবার সময় নেই৷ এসো মানিক!’
সুন্দরবাবু হতাশভাবে শয্যার উপরে বসে পড়লেন৷ তিনি আর একটিও বাক্যব্যয় করবার অবসর পর্যন্ত পেলেন না৷ জয়ন্ত এবং মানিক ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেল দ্রুতপদে৷
আলো-হারা কালো রাতের বুকে জাগছিল খালি ঝিল্লিদের কন্ঠ এবং থেকে থেকে তিমির-তুলি দিয়ে আঁকা গাছপালার পাতায় পাতায় বাতাস ফেলছিল সুদীর্ঘ নিশ্বাস৷ কোথাও আর কোনো শব্দ নেই৷ রাতের নিজস্ব একটা ঝিমঝিম ধ্বনি আছে বটে, কিন্তু সে-ধ্বনি কানে কেউ শোনে না, প্রাণে করে অনুভব৷
নির্জন পল্লিপথ৷ কাছে বা দূরে কোনো কুটির বা বাড়ির ভিতর থেকে ফুটে উঠছে না এক টুকরো আলোকরেখাও৷
খানিক দূর অগ্রসর হবার পর জয়ন্ত হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷
মানিক শুধোল, ‘দাঁড়ালে কেন?’
‘পিছনে একটা শব্দ শুনলাম৷’
‘কীরকম শব্দ?’
‘শুকনো পাতার উপরে পায়ের শব্দ৷’
‘কুকুর কি শেয়াল যাচ্ছে৷’
‘হতে পারে৷ চলো৷’
কিছু দূর এগিয়ে জয়ন্ত আবার দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আবার পায়ের শব্দ শুনছি৷’
এবারে মানিকও শুনতে পেয়েছিল৷ সে বলল, ‘জয়ন্ত, কেউ কি আমাদের অনুসরণ করছে?’
‘অসম্ভব নয়৷ কেউ হয়তো আমাদের গতিবিধির উপরে লক্ষ রেখেছে৷ টর্চ জ্বালো৷’
জয়ন্ত ও মানিক দুজনেই টর্চ জ্বেলে দিকে দিকে আলোক নিক্ষেপ করল৷ কোনো মনুষ্য-মূর্তির বদলে দেখা গেল, একটা শৃগাল ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে ঊর্ধ্বশ্বাসে৷
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘কিন্তু আমরা যে শব্দ শুনেছি, তা শেয়ালের পায়ের শব্দ নয়৷ চুলোয় যাক৷ এগিয়ে চলো মানিক৷’
‘কিন্তু পিছনে শত্রু নিয়ে কি সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে?’
‘কত ধানে কত চাল দেখাই যাক না৷ এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো৷’
দুজনে অগ্রসর হল৷ কাছে এবং দূরে দুই গাছের ডালে বসে দুটো প্যাঁচা চ্যাঁ-চ্যাঁ ভাষায় পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথন করছিল৷ রাত্রি-জগতের বিপুল কালো প্রজাপতির মতো একটা বাদুড় উড়ে গেল বাতাসকে সশব্দে ডানা দিয়ে আঘাত করতে করতে৷ তারপর আবার নিস্তব্ধতা৷
পিছনে সেই পদশব্দ৷
জয়ন্ত চুপিচুপি বলল, ‘শুনছ?’
‘হুঁ৷’
‘এই ঝোপটার আড়ালে তাড়াতাড়ি বসে পড়ো৷’
দুজনে গা-ঢাকা দিল ঝোপের আড়ালে গিয়ে৷
খানিকক্ষণ কিছু শোনা গেল না৷ তারপর মাঝে মাঝে শোনা যেতে লাগল পায়ের শব্দ৷ বেশ বোঝা গেল, কেউ চলতে চলতে থেমে দাঁড়িয়ে পড়ছে৷ অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল একটা অস্পষ্ট অপচ্ছায়া৷
ঝোপের প্রায় পাশে এসে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে মূর্তি নিজের মনেই বললে, ‘কী আশ্চর্য! এইখানেই তো ছিল, গেল কোথায়?’
জয়ন্ত হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে বাঘের মতন তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং নিজের দুই অতি বলিষ্ঠ বাহু বাড়িয়ে তাকে করল প্রচণ্ড আলিঙ্গন৷
আর্ত, অবরুদ্ধ কন্ঠে লোকটা বলল, ‘ছেড়ে দাও-ছেড়ে দাও-আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!’
বাহুর বন্ধন একটু আলগা করে জয়ন্ত বলল, ‘কে তুই?’
‘আমি এই গাঁয়েই থাকি৷’
‘তুই আমাদের পিছু নিয়েছিস কেন?’
‘না, আমি আপনাদের পিছু নিইনি৷ আমি ভিন গাঁয়ে গিয়েছিলাম, ফিরতে রাত হয়ে গেল৷’
‘তোর নাম কী?’
‘শ্রীমানিকচাঁদ বিশ্বাস৷’
‘আরে, তুমিও মানিক? তাহলে এ যে হয়ে দাঁড়াল মানিক-জোড়! ওহে আমাদের পুরাতন মানিক, এখন এই নতুন মানিকটিকে নিয়ে কী করা যায় বলো দেখি?’
‘আপাতত হাত-পা মুখ বেঁধে ওকে এই ঝোপের ভিতরে ফেলে রেখে যাওয়া যাক৷ তারপর বাসায় ফেরবার সময়ে ওর সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমালেই চলবে৷’
‘উত্তম প্রস্তাব৷ তাহলে এসো, আমাকে সাহায্য করো৷’
‘আমাকে ছেড়ে দিন মশাই, ছেড়ে দিন! আমি নির্দোষ, নিরীহ ব্যক্তি!’
তার পকেট হাতড়ে জয়ন্ত আবিষ্কার করল একখানা মস্ত বড়ো শাণিত ছোরা৷ বলল, ‘তুমি যে কীরকম নিরীহ ব্যক্তি, এই বাঘ-মারা ছোরাখানা দেখেই বেশ বুঝতে পারছি৷ মানিক, চটপট বেঁধে ফেলো এই খুনে গুন্ডাটাকে৷ আমাদের অনেক কাজ বাকি৷’
লোকটার হাত-পা মুখ বেঁধে তাকে ঝোপের ভিতরে নিক্ষেপ করে জয়ন্ত ও মানিক আবার হল অগ্রসর৷
আরও খানিক পরে তারা এসে দাঁড়াল প্রতাপ চৌধুরির বাড়ির সমুখে৷
চারিদিক নিঃসাড় এবং নিবিড় অন্ধকারের কালো বনাত দিয়ে মোড়া৷ বাড়ির কোনোখানেই কোনো জীবনের লক্ষণ নেই৷
অতি অনায়াসেই তারা পাঁচিল টপকে ভিতরে গিয়ে দাঁড়াল৷ কিছুক্ষণ স্থিরভাবে তারা কান পেতে রইল, কিন্তু অন্ধকারের ভিতরে শুনতে পেল না কোনোরকম সন্দেহজনক শব্দ৷
জয়ন্ত ফিসফিস করে বললে, ‘মানিক, আমাদের ছাতে ওঠবার সিঁড়ি-অর্থাৎ বৃষ্টির জল বেরোবার সেই নলটা ওই দিকের কোথাও আছে৷ এখানে টর্চ ব্যবহার করা নিরাপদ নয়৷ বাড়ির দেয়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আমাদের নলটাকে খুঁজে বার করতে হবে৷’
চক্ষু অন্ধকারে অন্ধ, কাজটা খুব সহজ হল না৷ কিন্তু অবশেষে পাওয়া গেল নলটাকে৷
‘মানিক, একসঙ্গে আমাদের দুজনের ভার এই নলটা হয়তো সইতে পারবে না৷ তুমি নীচেই দাঁড়াও৷ আগে আমি ছাতে গিয়ে উঠি-তারপর তুমি৷’
দুজনেই যখন ছাতের উপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন হঠাৎ রাত্রির স্তব্ধতাকে যেন খণ্ড খণ্ড করে দিয়ে কোথা থেকে চিৎকার করে উঠল একটা কুকুর৷ বার-তিনেক কেঁউ কেঁউ করেই আবার সে চুপ করলে৷
জয়ন্ত চিন্তিত স্বরে বললে, ‘মানিক, কুকুরটা হঠাৎ কেন ডাকল?’
‘কুকুর কেন ডাকল, কুকুরই তা জানে৷ কুকুরের ভাষা আমি শিখিনি৷’
‘কিন্তু ওই কুকুরটার ডাক অস্বাভাবিক বলে মনে হল নাকি?’
‘তা হল বটে৷’
‘আমার কী মনে হল, জানো?’
‘কী?’
‘ও যেন নকল কুকুরের ডাক৷’
‘মানে?’
‘কুকুরের স্বরের অনুকরণে চিৎকার করল যেন কোনো মানুষ৷’
‘তুমি কী বলতে চাও জয়ন্ত?’
‘আমি বলতে চাই, ওটা কুকুরের ডাক নয়, মানুষের সংকেত-ধ্বনি, কেউ যেন কাকে কোনো কারণে সাবধান করে দিল৷’
‘তাহলে শত্রুরা কি জানতে পেরেছে যে, তাদের আড্ডায় আবির্ভুত হয়েছে আমাদের মতন দুজন অনাহূত অতিথি?’
‘খুব সম্ভব, তাই৷’
‘এ ক্ষেত্রে আমাদের কী করা উচিত?’
‘এখন উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন ভুলে যাও মানিক৷ এখন ছাতের উপরেই থাকি, আর নল বেয়ে আবার নীচেই নেমে যাই, দুটোই হচ্ছে এক কথা৷ ওই কোণে রয়েছে চিলের ছাত৷ ওর তলায় আছে বাড়ির ভিতরে নামবার সিঁড়ি৷ এসো, মরবার বা বন্দি হবার আগে দেখেনি, এই বাড়ির ভিতরটা কীরকম! কোনো ভয় নেই, বিপদ নিয়েই তো আমাদের কারবার! এরও চেয়ে ঢের বেশি বিপদকে আমরা ফাঁকি দিয়েছি, আজও কি আর পারব না? এসো, দেখি-সাধুর সহায় ভগবান!’
চিলের কুঠুরির তলাতেই ছিল সিঁড়ি৷ জয়ন্ত ও মানিক দ্রুতপদে নীচের দিকে নেমে গেল-টর্চের আলো করল তাদের পথনির্দেশ৷
টর্চের আলো ফেলে ফেলেই খুব তাড়াতাড়ি তারা দেখে নিল, এদিকে বারান্দার কোলে রয়েছে পাশাপাশি তিনখানা ঘর৷ প্রথম এবং দ্বিতীয় ঘরের দরজা তালাবন্ধ, কিন্তু তৃতীয় ঘরখানা তালাবন্ধ নয়-যদিও বাহির থেকে তার শিকল ছিল তোলা৷
দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, তিনতলা থেকে দোতলায় নামবে কি নামবে না, এমন সময় শোনা গেল বোধ হয় একতলার সিঁড়িতে উচ্চ পদশব্দ! এক জনের নয়, দুই জনের নয়-অনেক লোকের পদশব্দ৷ এবং তারা উপরে উঠছে অত্যন্ত দ্রুতপদেই৷
‘মানিক, মানিক!’
‘কী জয়ন্ত?’
‘ফাঁদে পড়েছি-একরকম যেচেই৷ আর ভাববার সময় নেই৷ এই দুটো ঘরই তালাবন্ধ, কিন্তু ও-ঘরটার থেকে কেবল শিকল তোলা আছে৷ চলো, আমরা ওই ঘরেই ঢুকে ভিতর থেকে খিল এঁটে দিই৷’
‘কিন্তু তাহলে যে আমাদের অবস্থা হবে কলে-পড়া ইঁদুরের মতন!’
‘মোটেই নয়৷ অকারণেই আমরা ‘অটোমেটিক’ রিভলভার সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি৷ একটা কোণ পেলে হয়তো আমরা যুদ্ধ করে অনেক শত্রু বধ করতে পারব৷’
চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে জয়ন্ত ও মানিক তৃতীয় ঘরের শিকল খুলে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খিল তুলে দিল৷ বাইরের দ্রুত পদশব্দগুলো তখন হাজির হয়েছে ত্রিতলের বারান্দার উপরে৷
অকস্মাৎ অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকেই বিকট স্বরে হা-হা-হা-হা অট্টহাস্য করে কে বলে উঠল, ‘এসেছ বন্ধুগণ? এসো, এসো, আমি যে তোমাদেরই পথ চেয়ে আছি! হা-হা-হা-হা-হা!’ ঘরের বাইরের এবং ভিতরেও শত্রু৷ জয়ন্ত ও মানিক দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির মতো৷ এতটা তারা কল্পনা করতে পারেনি!
পঞ্চম – তারপর
হা-হা-হা-হা-হা-হা! ঘরের ভিতরে আবার অট্টহাসি৷
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি মানিকের হাত ধরে টেনে পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল যে-দিক থেকে অট্টহাসি আসছিল না সেই দিকে৷ তারপর এমনভাবে দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়াল, যেন পিছন থেকে কেউ তাদের আক্রমণ করতে না পারে৷
ঘরের ভিতরে আবার বিদ্রূপ-ভরা কন্ঠস্বর জাগল-‘এসেছ বন্ধুগণ! এসো, এসো, আমি যে তোমাদেরই জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছি!’ তারপরই শুরু হল গান :
‘এসো এসো বঁধু এসো,
আধ আঁচরে বোসো,
নয়ন ভরিয়া তোমায় দেখি!’
উদভ্রান্ত কন্ঠের এই হাসি, কথা ও গান শুনে সচকিত জয়ন্ত একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কে তুমি? তোমার গলা যে চেনা-চেনা বোধ হচ্ছে৷’
‘হচ্ছে নাকি? হচ্ছে নাকি? হা-হা-হা-হা! বন্ধু আর বন্ধুর গলা চিনবে না?’
‘তুমি হচ্ছ ভূষোপাগলা!’
‘আয়নাতে ওই মুখটি দেখে
গান ধরেছে বৃদ্ধ বট,
মাথায় কাঁদে বকের পোলা,
খুঁজছে মাটি মোটকা জট৷
হা-হা-হা-হা-হা-হা! সোনার আনারসের এই ছড়া তোমরা জানো? তাহলে-‘
কিন্তু ভূষোপাগলার কথা আর শেষ হল না, হঠাৎ বাইরে থেকে ঘরের দরজার উপরে শোনা গেল দমাদ্দম পদাঘাতের শব্দ৷ একসঙ্গে অনেকগুলো পা দরজার পাল্লা ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে৷
ঘরের ভিতরের বিপদ সম্বন্ধে জয়ন্ত তখন নিশ্চিন্ত হয়েছে-কারণ, পাগলা হলেও ভূষো নিশ্চয়ই বিপজ্জনক নয়! জয়ন্ত ছুটে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, ‘দরজা ভাঙবার চেষ্টা কোরো না! আমরা নিরস্ত্র নই!’
বাইরে থেকে হো-হো করে হেসে সচিৎকারে কে বলল, ‘ওরে ছিঁচকে চোর! তুই কি ভেবেছিস আমরাও সশস্ত্র নই?’
‘আমাদের কাছে ‘অটোমেটিক’ রিভলভার আছে-এক মিনিটে তারা কতগুলো গুলিবৃষ্টি করতে পারে তা জানো?’
‘আমাদের দলে লোক আছে পনেরো জন৷ তোমরা দু-একটা গুলি ছুড়তে না ছুড়তেই আমরা তোমাদের দুজনকে কেটে কুচি কুচি করে ফেলব৷’
‘বেশ, চেষ্টা করে দেখতে পারো৷ ব্যাপারটা যা ভাবছ ততটা সহজ নয়৷’
‘দেখ, ভালো চাস তো ভালোমানুষের মতন ধরা দে৷’
‘তারপর?’
‘তারপর আবার কী?’
‘তারপর আমাদের নিয়ে তোমরা কী করবে?’
‘আগে ধরা তো দে, তারপর সেসব কথা নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে৷’
‘চমৎকার! তোমার নাম কী বাছা?’
‘আমার নাম তো একটু আগেই তোরা শুনেছিস!’
‘কীরকম?’
‘আমার নাম মানিকচাঁদ বিশ্বাস৷’
জয়ন্ত হো-হো করে হেসে উঠে সকৌতুকে বলল, ‘আরে, আরে, তুমি সেই ছোরাধারী মানিকচাঁদ-যাকে আমরা ঝোপের ভিতরে ঘাস-বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছিলাম? তোমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল কে হে?’
‘ওহে গঙ্গারাম, তুই কি ভেবেছিস এখানে আমি ছাড়া আর কেউ তোদের ওপরে দৃষ্টি রাখেনি? তোরা চলে আসবার তিন-চার মিনিট পরেই আমি মুক্তি পেয়েছি!’
‘বটে, বটে, বটে! তোমার সৌভাগ্যের কথা শুনে আমার হিংসে হচ্ছে যে!’
‘তার মানে?’
‘তুমি তো দিব্যি চট করে মুক্তি পেয়েছ৷ কিন্তু আমরা কি অত সহজে তোমাদের কদলী প্রদর্শন করতে পারব?’
‘সে আশায় জলাঞ্জলি দে৷ তোরা বাঘের গর্তে ঢুকেছিস৷ আমাদের গুপ্তকথা জানতে পেরেছিস৷ তোরা কি আর কখনো ছাড়ান পাবি বলে আশা রাখিস?’
‘আশা রাখি বই কী মানিকচাঁদ, আশা রাখি বই কী, খুব রাখি! কিন্তু বাপু, ওই যে গুপ্তকথাটা উল্লেখ করলে, ওর অর্থ কী? তোমাদের কোন গুপ্তকথা আমরা জানতে পেরেছি?’
‘ভূষোপাগলা যে এখানে আছে, এ-কথা কি তোরা জানতে পারিসনি?’
‘এও আবার একটা গুপ্তকথা নাকি? ভূষো তো পাগলা মানুষ, ও যেখানেই থাকুক তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে যাব কেন?’
‘তোরা তো ভূষোকে পাবার জন্যেই এখানে এসেছিস রে!’
‘মোটেই নয়৷’
‘তবে কি তোরা এখানে এসেছিস হাওয়া খাবার জন্যে?’
‘আমরা এসেছি অন্য একটা কথা জানবার জন্যে৷’
‘কী কথা?’
‘যে-বাড়ি সবাই জানে খালি বাড়ি, তার ভিতরে মানুষ থাকে কেন?’
‘এ-কথা জেনে তোদের লাভ?’
‘লাভালাভের ধার ধারি না, আমরা এসেছি কৌতূহল চরিতার্থ করতে৷’
‘কৌতুহল চরিতার্থ, না আত্মহত্যা করতে?’
‘আমরা আত্মহত্যা করতে মোটেই রাজি নই৷ যাক, এসব বাজে কথা! মানিকচাঁদ তোমার সঙ্গে তো অনেকক্ষণ আলাপ হল, এই বার আমরা আর একজনের সঙ্গে আলাপ করতে চাই৷’
‘কার সঙ্গে?’
‘তোমাদের কর্তা প্রতাপ চৌধুরিকে ডাকো৷’
‘তিনি তো এখন কলকাতায়!’
‘এটা কি সত্য কথা?’
‘তিনি এখানে থাকলে তোর মতো পাজির পা-ঝাড়ার সঙ্গে কথা কয়ে আমাকে মুখব্যথা করতে হত না৷’
‘ও, আপাতত তুমিই বুঝি এখানকার প্রধানসেনাপতি?’
‘না, আপাতত আমিই এ-বাড়ির মালিক৷’
জয়ন্ত সবিস্ময়ে বলল, ‘তার মানে?’
‘প্রতাপবাবুর সঙ্গে এখন এ-বাড়ির আর কোনোই সম্পর্ক নেই৷’
‘সম্পর্ক নেই! কেন?’
‘বাড়িখানা তিনি আমার কাছে বিক্রি করেছেন৷ প্রতাপবাবু এ-গ্রামে আর থাকতে চান না৷’
‘কেন, এ গ্রামটি তাঁর পক্ষে কি অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে?’
প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল না৷ নতুন এক গলায় শোনা গেল,-‘মানিক, তুমি লোকটার সঙ্গে এত কথা কইছ কেন বলো দেখি? তুমি কি বুঝতে পারছ না, ও তোমার পেটের কথা আদায় করবার চেষ্টা করছে?’
‘ঠিক বলেছিস ভজা! ধড়িবাজটার সঙ্গে আর কোনো কথা নয়৷ ওহে জয়ন্ত, এইবার শেষ বার জিজ্ঞাসা করছি, দরজা তোমরা খুলবে, না আমরা ভেঙে ফেলব?’
‘দরজা আমরা খুলব না, ভাঙতে চাও তো তোমরাই ভাঙো৷…আমরা তোমাদের অভ্যর্থনা করার জন্যে প্রস্তুত৷ মানিক, রিভলবার বার করে দরজার পাশে এসে দাঁড়াও৷ দরজা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দুজনে গুলিবৃষ্টি করব৷ হতভাগারা বোধ হয় ‘অটোমেটিক’ রিভলভারের মহিমা জানে না৷’ শেষের কথাগুলো জয়ন্ত এমন চিৎকার করে বলল যে বাইরের সবাই শুনতে পেল৷
কিন্তু বাইরে থেকে দরজা ভাঙার কোনো চেষ্টাই হল না৷ শোনা গেল, মানিকচাঁদরা পরস্পরের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা কইছে৷ তারপর তাদের কন্ঠস্বর হল একেবারে নীরব৷
জয়ন্ত মুখ ফিরিয়ে ঘরের অন্য দিকের একটা খোলা জানলার ভিতর দিয়ে বাইরেটা একবার দেখবার চেষ্টা করল৷ কিন্তু দেখা গেল কেবল অন্ধকার৷ রাত্রি তখন দিবসের দিকে অগ্রসর হয়েছে বটে, কিন্তু আকাশের কালিমা পাতলা হবার কোনো লক্ষণ নেই৷ পৃথিবীও যেন বোবা হয়ে আছে৷
মানিক চুপিচুপি বলল, ‘জয়ন্ত, ওরা বোধ হয় আজ রাতে কোনো গোলমাল করবে না৷’
‘হুঁ, আমারও তাই বিশ্বাস৷ ওরা ভোরের জন্য অপেক্ষা করছে, রাতের অন্ধকারে ওরা আমাদের গুলি হজম করতে রাজি নয়৷ এখন দেখা যাক, এই অন্ধকারের সুযোগ আমরা গ্রহণ করতে পারি কি না! আস্তে আস্তে একবার জানলার কাছে গিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখো দেখি!’
মানিক জানালার কাছে গিয়ে নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করল৷ তারপর ফিরে এসে বলল, ‘নীচের জমির দিকে তাকিয়ে মনে হল, কারা যেন এদিক-ওদিক চলাফেরা করছে৷’
‘মানিকচাঁদ তাহলে ওদিকেও পাহারা রাখতে ভোলেনি৷ দেখছি আমাদের অদৃষ্ট মন্দ৷ কালকের প্রভাত হয়তো আমাদের পক্ষে সুপ্রভাত হবে না!’
এতক্ষণ পরে ভূষোপাগলা হঠাৎ মুখ খুলে বলে উঠল,-‘সুপ্রভাত! সুপ্রভাত! আমি জানি আমরা জীবনে আর সুপ্রভাত আসবে না৷ কিন্তু তোমরা কে বাপু? তোমরা এখানে কেন?’
জয়ন্ত বলল, ‘মানুষ নিজের বিপদকে কতখানি বড়ো করে দেখে বুঝেছ তো মানিক! ভূষোপাগলা যে আমাদের সঙ্গেই আছে, এ-কথা আমরাও ভুলে গিয়েছিলাম৷ যাক, এ তবু মন্দের ভালো৷ ভূষোর সঙ্গেই কথাবার্তা কয়ে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাক৷’ এই বলে সে টর্চের আলো জ্বেলে দেখল, ঘরের মেঝের উপরে ভূষোপাগলা লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে৷
মানিক বলল, ‘এ কী ভূষণ, তোমার মাথায় আর মুখে যে চাপ চাপ শুকনো রক্ত!’
ভূষো হেসে বলল, ‘দুশমনরা লাঠি মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে আমাকে এখানে ধরে এনেছে৷ এই দেখো না, আমার হাত-পাও বাঁধা!’
জয়ন্ত বলল, ‘আহা, বেচারি! মানিক, ওর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দাও৷’
বাঁধন খুলে দিতে দিতে মানিক বলল, ‘আচ্ছা ভূষণ, তোমার মতন নিরীহ মানুষের উপরে এমন অত্যাচার কেন? তুমি কি ওদের কোনো অনিষ্ট করেছ?’
ভূষো মাথা নেড়ে বলল, ‘কিছু না, কিছু না৷ নিজের উপকার কি পরের উপকার, কিছুই আমি করতে পারি না৷ আমি খালি খাই-দাই, বগল বাজাই আর সোনার আনারসের গান গাই!’
‘তবে ওরা তোমাকে ধরে রেখেছে কেন, সে-কথা কি জানো?’
‘ওদের মুখেই শুনে জেনেছি৷’
‘কী জেনেছ?’
‘আমি সোনার আনারসের ছড়া জানি বলেই ওরা আমাকে ধরে রেখেছে!’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ৷ ওরা আমাকে আরও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করে৷ ওদের বিশ্বাস, আমি আরও অনেক কথা জানি৷’
জয়ন্ত বলল, ‘বটে, বটে? তুমি আরও অনেক কথা জানো নাকি?’
‘অনেক কথা জানি গো, আবার অনেক কথা জানি না৷’
‘তুমি কী কী কথা জানো ভূষণ?’
ভূষোর দুই চক্ষে ফুটল সন্দেহের ভাব৷ সে বলল, ‘আমার কথা তুমি জানতে চাও কেন? ও, তুমিও বুঝি ওই দলে? ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমার মনের কথা জেনে নিতে চাও৷’
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি বলল, ‘না ভূষণ, আমরা তোমার বন্ধু, তোমাকে উদ্ধার করতেই এখানে এসেছি৷’
‘হা-হা-হা-হা! আমরা তিনজনেই যে ইঁদুরকলে ধরা-পড়া ইঁদুর! এখন কে কাকে উদ্ধার করে?’
‘ভূষণ, লোকে তোমাকে পাগল বলে বটে, কিন্তু তোমার কথাবার্তা তো ঠিক পাগলের মতন নয়!’
‘লোকে ঠিক বলে গো, ঠিক বলে! আমি পাগল নই তো কী? ওই সোনার আনারসের ছড়াই আমাকে পাগল করেছে৷’
‘ছড়া আবার কারুকে পাগল করতে পারে নাকি?’
‘সোনার আনারসের ছড়ার মানে বুঝলে পাগল হওয়া ছাড়া উপায় নেই৷ ও বড়ো বিষম ছড়া গো, মানুষকে মত্ত করে তোলে!’
‘কিন্তু ছড়ার শেষটা তো তুমি এখনও আমাদের শোনাওনি!’
‘শুনবে? তা শোনাতে আমার আপত্তি নেই৷ আমার মুখে ছড়াটা তো আরও কত লোকে শুনেছে, কিন্তু কেউ পারেনি এর মানে বুঝতে!’
‘আমিও মানে বুঝতে পারব না, তবু ছড়ার সবটা শুনতে ক্ষতি কী?’
‘তবে শোনো-‘
ভূষোকে বাধা দিয়ে হঠাৎ ঘরের বাইরে থেকে সগর্জনে কে চিৎকার করে উঠল,-‘খবরদার ভূষো, খবরদার! ছড়াটা ওদের কাছে বললে তোকে আমরা এখনই খুন করে ফেলব!’
ভূষো ভয়ে কুঁচকে পড়ে বলল, ‘শুনছ তো? ঘরের বাইরের দুশমনরা আড়ি পেতেছে? আর ছড়া বলে কাজ নেই বাবা!’
জয়ন্ত বলল, ‘কাকে তুমি ভয় করছ ভূষণ? ওদের বিষ নেই, কুলোপানা চক্কর! দেখলে তো, আমাদের ভয়ে ওরা দরজা ভাঙতে সাহসই করল না!’
দরজার দিকে ত্রস্ত চক্ষে বার বার তাকাতে তাকাতে ভূষো বলল-‘তাহলে ছড়ার শেষটা বলব?’
‘নিশ্চয়ই বলবে! দেখি কে তোমার কী করে!’
ভূষো বলল :
‘বাঘরাজাদের রাজ্য গেছে,
কেবল আছে একটি স্মৃতি,
ব্রহ্মপিশাচ পানাই বাজায়,
বাস্তুঘুঘু কাঁদছে নিতি৷
সেইখানেতে জলচারী,
আলো-আঁধির যাওয়া-আসা,
সর্পনৃপের দর্প ভেঙে,
বিষ্ণুপ্রিয়া বাঁধেন বাসা৷’
জয়ন্ত খানিকক্ষণ ধরে লাইনগুলো মনে মনে আউড়ে নিয়ে বলল, ‘ভূষণ, তোমার ছড়ার সবটাই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে৷’
‘মানে বুঝতে পারলে?’
‘পরে সে চেষ্টা করে দেখব বই কী!’
‘পরে কি আর সময় পাবে?’
‘কেন পাব না?’
‘আমরা যে কলে-পড়া ইঁদুর!’
জয়ন্ত উত্তর না দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল৷
বাইরে অন্ধকার তখন আর ততটা নীরন্ধ্র নয়৷ পুবের আকাশে আলোকের প্রথম ইঙ্গিত জাগতে আর বেশি দেরি নেই৷ বাতাসে পাওয়া যাচ্ছে আসন্ন প্রভাতের প্রসন্ন স্নিগ্ধতা৷
আচম্বিতে ওদিককার খোলা জানলাটার ওপাশে হল কালো অপচ্ছায়া মতন একটা মূর্তির আবির্ভাব এবং চোখের পলক পড়বার আগেই মূর্তিটা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল, ঘরের ভিতরে কী একটা জিনিস নিক্ষেপ করে৷
পরমুহূর্তে ভীষণ এক শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভিতরটা ভরে উঠল বিষম তীব্র এক দুর্গন্ধে!
জয়ন্ত প্রায়বদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল, ‘জানলার দিকে চলো-জানলার দিকে চলো! ওরা বিষাক্ত গ্যাসের বোমা ছুড়েছে! উঃ!’
কিন্তু তারা কেউ জানলা পর্যন্ত পৌঁছোতেই পারল না, সবাই মাটির উপরে পড়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেল!
ষষ্ঠ – ‘ডোল ডোল’
জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্ত দেখল, তার বুকের উপরে ঝুঁকে রয়েছে একখানা উদবিগ্ন মুখ! সে মুখ সুন্দরবাবুর৷
সুন্দরবাবু উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন, ‘হুম, বাঁচলাম! জয়ন্তের জ্ঞান হয়েছে!’
জয়ন্ত শান্তস্বরে বলল, ‘আমার কী হয়েছে সুন্দরবাবু? চোখে কেন ঝাপসা দেখছি-মাথার ভিতরে বিষম যন্ত্রণা, নিশ্বাস টানতেও কষ্ট হচ্ছে!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘তোমরা কোথায় গিয়েছিলে তা কি মনে পড়ছে না?’
‘কোথায়?’
‘প্রতাপ চৌধুরির বাড়িতে৷’
ধাঁ করে জয়ন্তের মনের পটে ফুটে উঠল যেন একখানা বিদ্যুতে আঁকা চলচ্চিত্র! দৃশ্যের পর দৃশ্য পরিবর্তন! নিশীথ রাত্রি, মানিকচাঁদের আবির্ভাব, প্রতাপ চৌধুরির বাড়ি, শত্রুদের আক্রমণ, অন্ধকার ঘর, ভূষোপাগলার অট্টহাসি-তারপর বিষাক্ত বোমার বিস্ফোরণ!
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি উঠে বসবার চেষ্টা করতেই সুন্দরবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘না জয়ন্ত, না! ডাক্তারবাবু বলে গিয়েছেন, এখনও দু-তিন দিন তোমাকে বিছানাতেই শুয়ে থাকতে হবে৷’
‘মানিক কোথায়, মানিক?’
ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে ক্ষীণস্বরে জবাব এল, ‘জয়, এই যে আমি! তোমার আগেই আমার জ্ঞান হয়েছে৷ কিন্তু শরীরে যেন আর পদার্থ নেই!’
‘ভগবানকে ধন্যবাদ, মানিকও আমার সঙ্গে আছে! ভূষোপাগলার খবর কী?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘তাকেও এনেছি, তার জ্ঞান হয়েছে সকলের আগে৷’
‘কোথায় সে?’
‘এই বাড়িরই অন্য একটা ঘরে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে৷’
জয়ন্ত অল্পক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগল৷ তারপর বলল, ‘সুন্দরবাবু, ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না৷-কালকের নাট্যাভিনয়ে আপনার আবির্ভাব হল কোন ভূমিকায়, কখন আর কোথায়?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘জয়ন্ত, তুমি বড়ো বেশি বকাবকি করছ৷ আগে আর একটু সুস্থ হও, তারপর কাল সব শুনো৷’
সত্য কথা৷ জয়ন্তের মাথার ভিতরটাও তখনও রীতিমতো ধোঁয়াটে আর ঘোলাটে হয়ে ছিল এবং থেকে থেকে তার দমও যেন বন্ধ হয়ে আসছিল৷ কিন্তু নিজের সমস্ত দুর্বলতাকে প্রবল ইচ্ছাশক্তির দ্বারা দমন করে সে বলল, ‘সুন্দরবাবু, সব কথা না শুনলে মন আমার শান্ত হবে না৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘তা আবার আমি জানি না? ও মন আবার শান্ত হবে? হুম! ও মন যে দুর্দান্ত মন! সব জানি, সব জানি!’
জয়ন্ত হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘জানেন তো কষ্ট দিচ্ছেন কেন? এই আমি দুই চোখ বন্ধ করে খুলে রাখলাম কেবল দুই কান! এখন খুলুন আপনার মুখ!’
ওদিককার বিছানা থেকে মানিক তেমনই ক্ষীণ স্বরেই বলল, ‘কিন্তু সাবধান সুন্দরবাবু, সাবধান!’
সুন্দরবাবু চমকে উঠে ঘরের এদিক-ওদিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, ‘সাবধান হতে বলছ কেন মানিক?’
‘ম্যালেরিয়ার মশা কামড়ালেই ম্যালেরিয়া হয়৷’
‘হোক গে, তাতে আমার কী?’
‘এখানে ম্যালেরিয়ার মশা আছে৷’
‘এই বিশ্রী পাড়াগাঁয়ে যে লাখো লাখো ম্যালেরিয়ার মশা আছে, তা কি আমি জানি না? কিন্তু আচমকা তুমি ধান ভানতে শিবের গান গাইছ কেন?’
‘জয়ন্ত আপনাকে মুখ খুলতে বলছে৷ কিন্তু যে মশারা বাইরে থেকে কুটুস করে কামড়ালেই ম্যালেরিয়ায় ধরে, মুখ খোলা পেয়ে সেই বেপরোয়া মশারা যদি দল বেঁধে আপনার বিপুল ভুঁড়ির অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করে, তাহলে আপনি তাদের হজম করতে পারবেন কি? তারা হুল ফুটিয়ে দেবে আপনার পিলে, লিভার আর হৃৎপিণ্ড প্রভৃতির উপরে! তখন? তখন কী হবে? এইসব ভেবেচিন্তেই আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি! এখানে মুখ খোলা নিরাপদ নয় সুন্দরবাবু! আমি আপনার বন্ধু, আপনার হাপরের মতন মস্ত উদর যে ম্যালেরিয়ার আস্তানায় পরিণত হয়, এটা আমি ইচ্ছা করি না৷ সাবধান!’
সুন্দরবাবু রেগে তিড়বিড় করতে করতে বললেন, ‘মানিক! তুমি হচ্ছ ঝাল ধানি-লঙ্কার মতো অসহনীয়! প্রায় মরতে বসেছ, তবু জোঁকের মতো আমার পিছনে লাগতে ছাড়বে না?’
মানিক ঠোঁট টিপে চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনাকে যে বড্ড ভালোবাসি সুন্দরবাবু৷ আপনাকে কি ছাড়তে পারি?’ এই বলেই সে বিছানার উপরে টপ করে উঠে বসে দুই বাহু বিস্তার করে বলল, ‘আমি আপনাকে ছাড়ব? আমি এখনই শয্যা ছেড়ে আপনাকে পরম শ্রদ্ধাভরে আলিঙ্গন করব!’
সুন্দরবাবু এক লাফে তার কাছে গিয়ে পড়ে চিৎকার করে বললেন, ‘মানিক! আমি নিষেধ করছি-তুমি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না! ডাক্তার বলেছেন, ‘তাহলে তোমার অসুখ বাড়বে৷ শুয়ে পড়ো, এখনই শুয়ে পড়ো!’
মানিক খাট ছেড়ে নামবার চেষ্টা করে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আমি আপনাকে ছাড়ব না! আমি আপনাকে আলিঙ্গন করবই করব!’ সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলেন এবং তারপর তাকে ধীরে ধীরে আবার বিছানার উপর শুইয়ে দিয়ে ভারাক্রান্ত কন্ঠে বললেন, ‘মানিক, অকারণে বাক্য-বিষ ছড়িয়ে কেন আমায় জ্বালাও বলো দেখি? কেন তুমি খালি খালি আমাকে রাগিয়ে দাও? তুমি কি জানো না, জয়ন্ত আর তোমাকে আমি কত ভালোবাসি? হুম!’
জয়ন্ত বিরক্ত স্বরে বলল, ‘মানিক, তোমার এই অসাময়িক প্রহসনের অভিনয় আজ আমার ভালো লাগছে না! যেখানে জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর যুদ্ধ, সেখানে প্রহসন আমি পছন্দ করি না৷ আসুন সুন্দরবাবু, বলুন আপনার কথা৷’
মানিক খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, ‘ভাই জয়, জীবন আর মৃত্যু নিয়ে শখের খেলাই হচ্ছে যে আমাদের ব্যাবসা! প্রহসনের অভিনয় তো এখানেই সাজে!’
‘হাত জোড় করি ভাই মানিক! তোমার দার্শনিকতার লেকচার থামাও, সুন্দরবাবুর কথা শুনতে দাও৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমার কথা বলব কী ভাই জয়ন্ত, সব কথা আমি নিজেই এখনও ভালো করে বুঝতে পারিনি৷’
‘রাত্রিবেলায় তুমি আর মানিক তো প্রতাপ চৌধুরির বাড়ির দিকে যাত্রা করলে, আমি একলা ঘরে বসে বসে ভাবতে লাগলুম কতরকম দুর্ভাবনা৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, শেষ-রাতের অন্ধকার ঠেলে ফুটল সকালের আলো, তবু তোমাদের দেখা নেই!
‘ভেবে ভেবে আমি পাগলের মতন হয়ে উঠলাম৷ বুঝলাম নিশ্চয়ই তোমরা কোনো বিপদে পড়েছ৷ হয়তো তোমরা আর বেঁচে নেই, এমন সন্দেহও হল৷ সুব্রতবাবুও বললেন, মানুষ খুন করতে নাকি প্রতাপ চৌধুরির একটুও বাধে না৷
‘হাজার হোক আমি পুলিশের লোক তো, এই কাজে মাথার চুল পাকিয়ে ফেলেছি-হুম, ভেবে সারা হলেও বুদ্ধি হারিয়ে ফেলি না! দুশ্চিন্তার কালো মেঘের মধ্যে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম একটুখানি আশার আলো!
‘সুব্রতবাবুকে নিয়ে ছুটলাম এখানকার থানায়৷ নিজের আর তোমাদের পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুর কাছে সব কথা খুলে বললাম৷ তিনি তখনই কয়েকজন চৌকিদার নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে পড়লেন৷ তোমাদের খোঁজে সকলে মিলে ছুটলাম প্রতাপ চৌধুরির বাড়ির দিকে৷
‘বাড়ির সদর দরজায় তখন আর বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল না৷ পাল্লা দু-খানা বন্ধ ছিল ভিতর দিক থেকেই৷ কিন্তু যখন ডাকাডাকির পরেও কারুর সাড়া পাওয়া গেল না, তখন দরজা ভেঙেই আমরা বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলাম৷ তারপর দেখলাম, উঠানের উপরে পড়ে রয়েছে তোমাদের তিনজনের অচেতন দেহ৷ তারপর-‘
জয়ন্ত বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাদের দেহ ছিল কোথায়?’
‘বাড়ির একতলার উঠানের উপরে৷’
মানিক বলল, ‘কিন্তু বিষাক্ত গ্যাসের বোমায় আমরা জ্ঞান হারিয়েছিলাম দোতলার একখানা ঘরের ভিতরে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘বোঝা যাচ্ছে শত্রুরা আমাদের দেহগুলোকে একতলায় নামিয়ে এনেছিল৷’
‘কিন্তু কেন?’
‘খুব সম্ভব তারা চেয়েছিল আমাদের দেহগুলোকে স্থানান্তরে সরিয়ে ফেলতে! কিন্তু যথাসময়ে সদলবলে সুন্দরবাবুর আবির্ভাব হয়েছিল তাই রক্ষা, নইলে আমাদের কী দুর্দশা হত কে জানে?’
‘জয়ন্ত, তুমি ‘শত্রু শত্রু’ করছ বটে, আমরা কিন্তু সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো শত্রুর একগাছা টিকি পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারিনি৷’
‘তারা আপনাদের দেখে চম্পট দিয়েছিল৷’
‘তাও সম্ভবপর নয়৷ পাছে তারা পালায় তাই আমরা চারিদিক থেকে বাড়িখানাকে ঘিরে অগ্রসর হয়েছিলুম৷’
‘তাহলে তারা পালাল কেমন করে?’
‘সেইটেই তো সমস্যা! আর একটা কথাও মনে রেখো, বাড়ির সদর দরজা বন্ধ ছিল ভিতর দিক থেকে৷’
জয়ন্ত গম্ভীরভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, এটা একটা ভাববার কথা বটে৷ ও-বাড়ির সদরে বাইরে তালা দেওয়া থাকলেও ভিতরে বাস করে মানুষ৷ আবার ও-বাড়ির সদর ভিতর থেকে বন্ধ থাকলেও ভিতরে ঢুকে মানুষের খোঁজ পাওয়া যায় না৷ এ এক অদ্ভুত রহস্য!’
ঠিক সেই সময়ে একটি নতুন লোক ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ালেন৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘নমস্কার দারোগাবাবু৷ নতুন কোনো খবর আছে?’
‘আছে৷’
‘কী?’
‘প্রতাপ চৌধুরির বাড়িতে আমার এক চৌকিদারকে পাহারায় রেখে এসেছিলাম জানেন তো? আজ সে মারা পড়েছে৷’
‘কেন?’
‘কে তাকে খুন করেছে৷’
‘খুন?’
‘হ্যাঁ৷ আমরা যখন ঘটনাস্থলে যাই, তখনও সে বেঁচেছিল বটে, তবে সেটা না-বাঁচারই সামিল৷ কারণ দু-চার বার অস্ফুট স্বরে ‘ডোল’ ‘ডোল’ বলেই সে মারা পড়ে৷ তার বুকে আর মুখে ছোরা মারার চিহ্ন৷’
জয়ন্ত বলল, ‘ডোল মানে?’
‘চৌকিদার ঠিক কী বলতে চেয়েছিল, আমিও তা বুঝতে পারিনি! তবে এটা দেখেছি, প্রতাপ চৌধুরির বাড়ির একতলায় সিঁড়ির খিলানের তলায় একটা চৌবাচ্চার মতন বড়ো লোহার ডোল বা জলাধার আছে! চৌকিদারের দেহ পাওয়া যায় ঠিক তার পাশেই৷ কিন্তু তার সঙ্গে চৌকিদারের মৃত্যুর কী সম্পর্ক থাকতে পারে?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বোধ হয় মরবার সময়ে লোকটা প্রলাপ বকছিল৷’
‘আমারও তাই বিশ্বাস!’
জয়ন্ত বলল, ‘আমার বিশ্বাস অন্যরকম৷’
‘কীরকম?’
‘আপনারা খুব সহজেই ব্যাপারটাকে হালকা করে ফেলতে চাইছেন৷ কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই হালকা নয়৷’
‘কেন?’
‘চৌকিদার যে প্রলাপ বকছিল, তার কোনো প্রমাণ আছে?’
‘প্রলাপ বলে অর্থহীন কথাকেই৷’
‘কে বলল চৌকিদারের কথা অর্থহীন? আপনারা তার মুখে শুনেছেন ‘ডোল’ শব্দটি৷ আপনারা কি ‘ডোল’ বা জলাধার খুঁজে পাননি?’
‘কিন্তু খুঁজে পেয়েও আপনাদের কোনো সমস্যার সমাধান হয়েছে?’
‘সেইটেই বিবেচ্য৷ অন্তিমকালে চৌকিদারের কথা বলবার শক্তি প্রায় লুপ্ত হয়ে এসেছিল৷ সে-সময়েও সে যখন কোনো রকমে ‘ডোল’ শব্দটি উচ্চারণ করে ওইদিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল, তখন তার কথার ভিতরে নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ অর্থ আছে৷ এই বিশেষ অর্থটি ধরতে পারলেই হত্যা-রহস্যের কিনারা হতে দেরি লাগবে না৷’
দারোগাবাবু বললেন, ‘ডোলটি আমি পরীক্ষা করেছি৷ তার তলায় পড়ে আছে ইঞ্চি পাঁচেক অতি ময়লা পোকা-ভরা জল-ব্যাস, আর কিছুই নেই৷’
‘অতি ময়লা পোকা-ভরা জল? তার মানে সে জল কেউ ব্যবহার করত না?’
‘তাই তো মনে হয়৷’
‘তাহলে খানিকটা অব্যবহার্য জল ভরে ওখানে অত বড়ো একটা ডোল বসিয়ে রাখবার কারণ কী?’
‘কেমন করে বলব?’
জয়ন্ত হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘দারোগাবাবু, এখানে পালকি পাওয়া যায়?’
‘যায়৷ কিন্তু কেন?’
‘আমি এখনই ঘটনাস্থলে যেতে চাই৷’
সুন্দরবাবু হাঁ-হাঁ করে বলে উঠলেন, ‘তোমার দেহের এই অবস্থায়? অসম্ভব, অসম্ভব!’
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বলল, ‘খুব সম্ভব, খুব সম্ভব! আমি তো পায়ে হেঁটে যাচ্ছি না! আমি জানতাম আপনি আপত্তি করবেন, তাই তো পালকিতে চড়ে যাব রুগির মতো৷’
মানিক বলল, ‘আর আমি?’
‘আপাতত তুমি শয্যাগত হয়েই থাকো৷ এক সঙ্গে দু-দুটো রুগিকে সুন্দরবাবু সামলাতে পারবেন কেন?’
আবার প্রতাপ চৌধুরির বাড়ি৷ তার চারিদিকে কড়া পুলিশ পাহারা৷
উঠানের উপর দাঁড়িয়ে দারোগাবাবু বললেন, ‘সিঁড়ির খিলানের তলায় ওই দেখুন সেই ডোলটা৷ ওরই পাশে চৌকিদারের দেহ পাওয়া যায়৷’
জয়ন্ত ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল৷ একটা গোলাকার লোহার জলাধার৷ উচ্চতায় আড়াই হাত এবং চওড়ায় তিন হাত৷ তলার দিকে পড়ে রয়েছে খানিকটা ঘোলা জল৷
দারোগাবাবু কৌতুকপূর্ণ হাসি হেসে বললেন, ‘এর ভিতর থেকে আপনি কোনো বিশেষ অর্থ আবিষ্কার করতে পারলেন কি?’
‘কই, এখনও তো কিছুই আবিষ্কার করতে পারিনি৷’
‘পরেও পারবেন না মশাই, পরেও পারবেন না! আমাদের হচ্ছে পেশাদার শিকারির চোখ, যা দেখবার তা আমরা একদৃষ্টিতে দেখে নিই!’
‘তা আর বলতে? আপনাদের সঙ্গে আবার আমার তুলনা? কিন্তু দারোগাবাবু, আপনার কাছে আমার একটি আরজি আছে৷’
‘বলুন৷’
‘ডোলটার ভিতরে জল আছে অল্পই, ওটা বোধ হয় বেশি ভারী নয়৷ অনুগ্রহ করে আপনার চৌকিদারদের হুকুম দিন, অন্ধকার খিলানের তলা থেকে ডোলটাকে উঠানের মাঝখানে টেনে আনতে৷ আমি ওটাকে আরও ভালো করে দেখতে চাই৷’
‘খুব ভালো করে দেখুন, ভালো করে, প্রাণ ভরে, নয়ন ভরে দেখুন, আমার একটুও আপত্তি নেই৷ ওরে, তোরা ডোলটাকে উঠানের মাঝখানে টেনে আন তো! আমাদের শখের গোয়েন্দামশাই ওটাকে ভালো করে দেখতে চান!’
দারোগাবাবু গলা চড়িয়ে হাসতে লাগলেন, কিন্তু সুন্দরবাবু হাসবার চেষ্টা করলেন না৷ জয়ন্তকে তিনি চিনতেন৷ আগে আগে তাঁকেও হাস্য করে বারংবার ঠকতে হয়েছে৷ জয়ন্ত অকারণে কিছু করে না, দারোগার হাসি বন্ধ হতে আর দেরি নেই বোধ হয়৷ জয়ন্তর কথাবার্তায় পাওয়া যাচ্ছে যেন কী এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত৷ হুম!
চৌকিদাররা ডোলটাকে সশব্দে টানতে টানতে উঠানের মাঝখানে নিয়ে এল৷ জয়ন্ত সেদিকে ফিরেও তাকাল না৷
দারোগাবাবু বললেন, ‘ও মশাই, বলি আপনার হল কী? ডোলটাকে ভালো করে দেখবেন বললেন না? তবে ওদিকে মুখ ফিরিয়ে কী দেখছেন? ডোল তো আর ওখানে নেই৷ . . . আরে, আরে, ও আবার কী!’ তাঁর দুই চক্ষু ছানাবড়ার মতো হয়ে উঠল চরম বিস্ময়ে!
সুন্দরবাবু দুই পদ অগ্রসর হয়ে কেবলমাত্র বললেন, ‘হুম, হুম!’
ঠোঁট টিপে মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে জয়ন্ত বলল, ‘দারোগাবাবু, সিঁড়ির তলায় ডোলটা যেখানে ছিল, সেখানে এটা কী দেখছেন তো?’
হাঁদারামের মতন মুখ করে দারোগা বললেন, ‘একটা বড়ো গর্ত!’
‘খালি গর্ত নয়, গর্তের ভিতর দিকে নেমে গিয়েছে এক সার সিঁড়ি৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘গুপ্তপথ৷’
‘হ্যাঁ৷ যখনই দেখলাম সদর দরজা ভিতর বা বাইরে থেকে বন্ধ থাকলেও বাড়ির লোকেরা ভিতরে বা বাইরে আনাগোনা করতে পারে, তখনই আন্দাজ করলাম, এ-বাড়ির কোথাও-না-কোথাও গুপ্তপথের অস্তিত্ব আছে৷ তারপর শুনলাম চৌকিদারের অন্তিম উক্তি-‘ডোল’ ‘ডোল’! এও শোনা গেল, চৌকিদারের যেখানে মৃত্যু হয় তার পাশেই পাওয়া গিয়েছে একটা মস্ত ডোল৷ অবশ্য গুপ্তপথ পাওয়া যাবে যে ডোলের তলাতেই, তখনও পর্যন্ত সেটা আমি আন্দাজ করতে পারিনি৷ কিন্তু এটুকু আমি নিশ্চিতরূপেই বুঝেছিলাম যে, এই ডোলটাকে অবহেলা করে উড়িয়ে না দিলে কোনো-না-কোনো মূল্যবান তথ্য প্রকাশ পাবেই৷ আমার ধারণা যে ভুল নয়, এটা কি এখন আপনি স্বীকার করেন দারোগাবাবু?’
কিন্তু দারোগার অবস্থা তখন অত্যন্ত কাহিল, তিনি করুণ চোখে জয়ন্তর মুখের পানে তাকিয়ে রইলেন, নীরবে৷
‘আরও একটা কথা আন্দাজ করতে পারছি৷ চৌকিদারের দেহ কেন এইখানে পাওয়া গিয়েছে৷ চোখের সামনে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, একটা ‘ট্র্যাজেডি’র শেষ দৃশ্য! বাড়ির পলাতক লোকগুলো বোধ হয় জানত না, এখানে কোনো চৌকিদার মোতায়েন করা হয়েছে৷ কিংবা জেনেও, বিশেষ কোনো প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই তারা আবার এই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেছিল গুপ্তদ্বার দিয়ে৷ চৌকিদার তাদের দেখতে পায়! তারা পলায়ন করে৷ চৌকিদার তাদের পিছনে পিছনে এখান পর্যন্ত ছুটে আসে৷ পাছে সমস্ত গুপ্তকথা ব্যক্ত হয়ে যায় সেই ভয়ে তারা তখন চৌকিদারকে করে মারাত্মক আক্রমণ! তারপর গুপ্তপথে নেমে ডোলটাকে আবার যথাস্থানে বসিয়ে সরে পড়ে সকলে মিলে৷ আর একটা বিষয় লক্ষ করুন! অত বড়ো ডোলে জল আছে মাত্র ইঞ্চি পাঁচেক৷ অতটুকু জল না রাখলেই চলত, তবু রাখা হয়েছে কেবল দুটি কারণে৷ প্রথমত জল থাকলে বাইরের কোনো অতি কৌতূহলী চক্ষু সন্দেহ করতে পারবে না যে, ডোলটা জলাধার ছাড়া অন্য কোনো কারণে ব্যবহৃত হয়৷ দ্বিতীয়ত অল্প জল না রাখলে ডোলটাকে নীচে থেকে ঠেলে সরাতে বা টেনে গর্তের মুখে আনতে বিশেষ বেগ পেতে হত৷ কিন্তু অতি চালাক লোকেরা অতি বোকা হয় প্রায়ই৷ অত বড়ো ডোলে অত কম জল-তাও পচা, পোকায়-ভরা আর অব্যবহার্য৷ একথা শুনেই আমার মন জাগ্রত হয়ে উঠেছিল এই সন্দেহে যে, ওই ডোলে জল রাখা হচ্ছে একটা লোক-দেখানো কাণ্ড! খুব সূক্ষ্ম সন্দেহ, না দারোগাবাবু? এইরকম সন্দেহের নিশ্চয়ই কোনো মানে হয় না, কী বলেন?’
দারোগা দুই হাত জোড় করে বিনীতভাবে বললেন, ‘আমাকে আর লজ্জা দেবেন না জয়ন্তবাবু৷ আমি মাপ চাইছি৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! জয়ন্তের কাছে যে শেষটায় আপনাকে মাপ চাইতে হবে, এ আমি আগেই জানতাম৷ কিন্তু যাক সেকথা৷ এখন এই গুপ্তপথ নিয়ে কী করা যেতে পারে? হয়তো এই গুপ্ত পথের ভিতরে গেলে আশেপাশে আমরা দেখতে পাব গুপ্তগৃহও, কী বলো জয়ন্ত?’
‘তা আমি জানি না৷’
‘হয়তো কোনো গুপ্তগৃহের ভিতরে আমরা দেখতে পাব অপরাধীর দলকে৷ এখন আমাদের কী করা উচিত? সদলবলে গর্তের ভিতর গিয়ে নামব নাকি?’
দারোগা বললেন, ‘সেইটেই উচিত বলে মনে হচ্ছে৷ আমরা সশস্ত্র, দলেও ভারী৷ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করবার এমন সুযোগ হয়তো আর পাব না৷ আপনার কী মত জয়ন্তবাবু?’
জয়ন্ত রিভলভার বার করে বলল, ‘সুড়ঙ্গের ভিতরে যে আমাদের নামাই উচিত, এ-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই৷ কিন্তু সবাই প্রস্তুত রাখুন নিজের নিজের অস্ত্র৷’
সপ্তম – সুড়ঙ্গ
সকলে সুড়ঙ্গপথের সিঁড়ি দিয়ে নীচের দিকে নামতে লাগলেন৷ সর্বাগ্রে দারোগাবাবু৷
কয়েকটা ধাপের পরেই সোজা পথ-অন্ধকার ও স্যাঁৎসেঁতে৷
টর্চের আলোতে অন্ধকার তাড়িয়ে প্রত্যেকেই যে-কোনো মুহূর্তে রিভলভারের ঘোড়া টেপবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রইল৷
কেবল তাদের জুতোর শব্দগুলোই পাতালের স্তব্ধতা ভেঙে দিতে লাগল, তা ছাড়া অন্য কোনোরকম সন্দেহজনক শব্দ নেই৷
একজায়গায় একটা কুঠুরির মতো ঠাঁই পাওয়া গেল৷ তার তিন দিকে দেয়াল, এক দিক খোলা৷ দরজা-টরজা কিছুই নেই এবং সেখানেও নেই জনপ্রাণীর চিহ্ন৷
আরও একবার এগোবার পর সুড়ঙ্গপথ শেষ হল৷ সেখানেও কয়েকটা ধাপ উঠে গিয়েছে উপর দিকে৷
জয়ন্ত বলল, ‘বোঝা যাচ্ছে এই সুড়ঙ্গটা কেবল লুকিয়ে আনাগোনার জন্যেই ব্যবহার করা হয়৷ কিন্তু সুড়ঙ্গের এই মুখটা ওরা বাইরের চোখের আড়ালে রেখেছে কেমন করে, সেইটেই এখন দ্রষ্টব্য৷’
সে ধাপ দিয়ে উঠে গিয়ে উপর দিকে দুই হাত বাড়াল, হাতে ঠেকল ঠান্ডা ধাতুর স্পর্শ৷ কী এ? লোহার দরজা?
একটু জোর করে ঠেলা দিতেই গঙ্গাজলের ‘সিস্টার্ন’-এর ডালার মতো গোলাকার ভারী জিনিস উলটে বাইরের দিকে গিয়ে পড়ল৷ এবং সুড়ঙ্গের ভিতরে নেমে এল মুক্ত পৃথিবীর আলো৷
সকলে সুড়ঙ্গ ছেড়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল৷
হাত পনেরো-ষোলো চওড়া এবং হাত পঁচিশ-ছাব্বিশ লম্বা ঘাসজমি,-জঙ্গল ও কাঁটা-ঝোপে ঘেরা৷
জয়ন্ত একমনে কিছুক্ষণ লোহার ঢাকনাখানা পরীক্ষা করে বলল, ‘চিত্তাকর্ষক বটে!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘কী?’
‘এই ঢাকনাখানা৷ দেখুন, এটা একটা বড়ো পাত্রের মতো৷ এর ভিতরে মাটি ভরে ঘাস পুঁতে দেওয়া হয়েছে৷ এইবারে দেখুন!’ সে ঢাকনাখানা আবার উলটে সুড়ঙ্গের মুখে স্থাপন করল৷
দারোগাবাবু বললেন, ‘বাঃ, আশপাশের ঘাসজমির সঙ্গে সুড়ঙ্গের মুখটা একেবারে মিলিয়ে গেল যে! একে তো চারিদিকের কাঁটাঝোপের ভয়ে এখানে বাইরের কারুর আনাগোনা নেই-তার উপরে চোখে ধুলো দেবার এই সহজ, কিন্তু চমৎকার ফন্দি৷ কেউ এখানে এলেও কিছুই সন্দেহ করতে পারবে না৷ আমরাও পারতাম না-যদি সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে না আসতাম!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম!’
জয়ন্ত বলল, ‘সুড়ঙ্গের এক মুখে জলের ডোল আর-এক মুখে ঘাস-মাটি ভরা ঢাকনা!
দুই-ই আছে প্রকাশ্য স্থানে, অথচ আসল রহস্য প্রকাশ পাবার সম্ভাবনা কত অল্প!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘এত অনায়াসে যে চোখ ঠকাতে পারে, আমি তাকে মস্ত বড়ো ওস্তাদ বলে মানতে রাজি আছি৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, কে সে?’
জয়ন্ত বলল, ‘নিশ্চয়ই প্রতাপ চৌধুরি!’
দারোগাবাবু বললেন, ‘কিন্তু তার আর নাগাল পাওয়া সহজ নয়৷ আপনাদেরই মুখে শুনলাম, মানিকচাঁদের কাছে বাড়ি বেচে সে এখান থেকে চলে গিয়েছে৷’
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘মানিকচাঁদের কথা তখনও আমি বিশ্বাস করিনি, আর এখন বিশ্বাস না করবার মতো একটা বড়ো সূত্রও পেয়েছি৷’
‘সূত্র? কী সূত্র?’
‘সূত্রটা নতুন নয়, পুরোনো৷ সেই ৯৯৯ স্টেট এক্সপ্রেস সিগারেট!’
‘মানে?’
‘ওই দেখুন৷ শৌখিন প্রতাপ চৌধুরি যে সিগারেট খায়, তারই একটি আধপোড়া নমুনা এখানকার ঘাসজমিকেও অলংকৃত করেছে! সিগারেটটা যদিও এখন নিবে গিয়েছে, কিন্তু ভালো করে দেখলেই বোঝা যায়, ওটা টাটকা৷ খুব সম্ভব কাল রাত্রেই ওটা শোভা পেয়েছিল প্রতাপ চৌধুরির মুখে৷ ওটা যদি বেশি দিন রোদে আর খোলা হাওয়ায় পড়ে থাকত, তাহলে ওর কাগজের উপরে পড়ত দাগ আর সোনালি অংশটার রংও যেত জ্বলে৷ হায় প্রতাপ চৌধুরি, তুমি এত বড়ো ধূর্ত, কিন্তু তুচ্ছ সিগারেট কিনা বারবার তোমাকে ধরিয়ে দিচ্ছে? অবশ্য তোমার পক্ষেও বলবার কথা আছে৷ তুমি বলতে পারো,-‘তোরা যে এত সহজে আমার এত সাধের সুড়ঙ্গ-রহস্য আবিষ্কার করে ফেলবি, সেটা স্বপ্নেও জানলে আমি কি এখানে দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেট টানবার চেষ্টা করতাম?’ কিন্তু ওই তো মুশকিল প্রতাপ চৌধুরি, ওইখানেই তো মুশকিল! অতি ধূর্তরা সেয়ানাপনায় নিজেদের অদ্বিতীয় বলে মনে করে, আর শেষ পর্যন্ত সেই নির্বুদ্ধিতাই তাদের পক্ষে হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক! নয় কি দারোগাবাবু? আমি আপনার কাছে শিক্ষানবিশ মাত্র, কিন্তু আমি কি ভুল বলছি?’
দারোগা লজ্জিত কন্ঠে বললেন, ‘নিজেকে শিক্ষানবিশ বলে জাহির করে আর আমাকে আক্রমণ করবেন না জয়ন্তবাবু! আপনি যদি শিক্ষানবিশ হন, আমাকে তাহলে মানতে হয় যে, আমি এখনও গোয়েন্দাগিরির অ-আ পর্যন্ত শিখিনি৷ যে ছোটো বক্তৃতাটি দিলেন তা অত্যন্ত শিক্ষাপ্রদ; আর আপনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তিও আশ্চর্য! আপনি হয়তো আকাশের শূন্যতার ভিতর থেকেও আসামি আবিষ্কার করতে পারেন৷’
জয়ন্ত হেসে ফেলে বলল, ‘না, অতটা পারি না! আমার ডানা নেই, আকাশের খবর রাখব কেমন করে?’
‘কিন্তু জয়ন্তবাবু, তবে মানিকচাঁদ কেন বলেছে যে প্রতাপ চৌধুরি এই বাড়ি বিক্রি করে স্থানান্তরে গিয়েছে?’
‘মানিকচাঁদ হচ্ছে প্রতাপের প্রধান সাকরেদ, অন্তত আমার তাই বিশ্বাস৷ প্রতাপ নিজে আড়ালে থেকে সুতো টেনে মানিকচাঁদের দলকে পুতুলনাচের পুতুলের মতো অভিনয় করাতে চায়৷ যদি দৈবগতিকে প্রতাপের সব ওস্তাদি ভেস্তে যায়, তাহলে ধরা পড়বে মানিকচাঁদ অ্যান্ড কোম্পানি, কিন্তু সে নিজে থাকবে একেবারে নিরাপদ ব্যবধানে!’
হঠাৎ সুন্দরবাবুর বিপুল ভুঁড়ি উঠল চমকে এবং তাঁর চক্ষে জাগল ত্রস্ততা৷ তিনি তাড়াতাড়ি জয়ন্তের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার কানে কানে বললেন, ‘জয়ন্ত, দেখো, দেখো!’
জয়ন্ত সহজভাবেই বলল, ‘দেখেছি সুন্দরবাবু! এই শত্রুপুরীতে এসে আমার চোখ ঘুরছে চতুর্দিকেই৷ দারোগাবাবু, খানিক তফাতেই একটা ঝোপ কীরকম দুলছে দেখুন৷ বড়োই সন্দেহজনক৷ বাতাসের জোর নেই, ঝোপ কেন দোলে?’
দারোগাবাবু সেই দিকে তাকালেন, ঝোপটা দুলতে দুলতে আবার স্থির হয়ে এল৷ বললেন, ‘মনে হচ্ছে, ওই ঝোপের ভিতরে লুকিয়ে কেউ যেন আমাদের লক্ষ করছে৷’
জয়ন্ত সায় দিয়ে বলল, ‘আমারও সেই সন্দেহ হচ্ছে৷’
‘এখন কী করা উচিত?’
‘দারোগাবাবু, আপনারা হচ্ছেন সরকারের দুলাল, আইন আপনাদের হাত-ধরা৷ আমারও কাছে রিভলভার আছে বটে, কিন্তু সহসা গুলিবৃষ্টি করলে হয়তো সরকারের আইন এই শখের গোয়েন্দাকে ক্ষমা করবে না৷ আপনার উচিত ওই সন্দেহজনক ঝোপটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো৷ তারপর নরহত্যা হলেও একটা ওজর দেখিয়ে আপনি হয়তো আইনের নাগপাশকে ফাঁকি দিতে পারবেন অনায়াসেই!’
দারোগাবাবু বললেন, ‘ব্যাপারটা অত সহজ নয় মশাই! আর কি সে দিন আছে? এখন একটু এদিক-ওদিক হলেই সারা দেশ জুড়ে খবরের কাগজওয়ালারা শেয়ালের মতো একস্বরে কীরকম ‘ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া’ করে চ্যাঁচাতে থাকে তা কি আপনি জানেন না?’
জয়ন্ত হেসে বলল, ‘সব জানি৷ কিন্তু এটা কি আপনি বুঝছেন না, ওই ঝোপের আড়ালে যে আছে সে হয়তো এখন নিস্পন্দ হয়ে আমাদেরই পানে বন্দুক তুলে লক্ষ্য স্থির করছে?’
সুন্দরবাবু চমকে উঠে পায়ে পায়ে পিছিয়ে আবার সুড়ঙ্গের মধ্যে অদৃশ্য হবার চেষ্টা করলেন৷ যতদূর সম্ভব চুপিচুপি বললেন, ‘পালিয়ে এসো জয়ন্ত, তুমিও পালিয়ে এসো!’
দারোগাবাবু ম্রিয়মাণের মতো বাধো-বাধো গলায় বললেন, ‘তাহলে রিভলভার ছুড়ব নাকি?’
জয়ন্ত বলল, ‘নিশ্চয়! আপনি বাঁচলে বাপের নাম, জানেন না?’
সেই বিশেষ ঝোপটির দিকে লক্ষ্য করে দারোগাবাবু রিভলভার তুলে ঘোড়া টিপে দিলেন৷
রিভলভার গর্জন করতেই ঝোপের ভিতর থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে এল মানুষ নয়, একটা শূকর! পরমুহূর্তেই ঘোঁৎঘোঁৎ করতে করতে সে আর একটা ঝোপের মাধ্যে ঢুকে চোখের আড়ালে সরে পড়ল৷
জয়ন্ত সকৌতুকে হাসতে হাসতে বলল, ‘মাভৈঃ মাভৈঃ! শুয়োরটা যখন ওই ঝোপের ভেতর ঢোকে তখনই তাকে আমি দেখতে পেয়েছিলাম৷ আমি জানতাম, ওখানে মানুষজাতীয় কোনো শত্রুই নেই৷’
দারোগাবাবু খাপের ভিতর রিভলভার পুরতে পুরতে অপ্রসন্ন স্বরে বললেন, ‘তাহলে আমাদের মিছে ভয় দেখাবার জন্যে আপনি এতক্ষণ মশকরা করছিলেন?’
সুন্দরবাবু ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন, ‘হুম৷ জয়ন্ত মানিকের দলে ভিড়ল? আমাদের নিয়ে তামাশা? নাঃ, এ অসহনীয়৷’
জয়ন্ত আরও জোরে হেসে উঠে বলল, ‘মানিক যে আজ আমার সঙ্গে নেই সুন্দরবাবু! তাই আমি তারই অভাব পূরণের জন্যে মানিকের ভূমিকায় অভিনয় করবার চেষ্টা করছি! কিন্তু যাক সে-কথা৷ এখানে আর দেরি করে লাভ নেই৷ প্রতাপ চৌধুরি আর তার দলবল আজ বোধ করি রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হবে না৷ চলুন, আমরাও যবনিকার অন্তরালে প্রস্থান করি৷ ….হ্যাঁ, ভালো কথা৷ দারোগাবাবু, সুড়ঙ্গের দুই মুখ যেমন ছিল, সেইভাবেই বন্ধ করে যেতে ভুলবেন না যেন৷’
‘কেন?’
‘শত্রুরা যেন সন্দেহ করতে না পারে যে, আমরা তাদের সব গুপ্তকথা জানতে পেরেছি৷’
‘আপনি কি মনে করেন নরহত্যার পরেও তারা আবার এখানে আসতে সাহস করবে?’
‘না করাই তো উচিত৷ তবু সাবধানের মার নেই৷’
রাস্তায় বেরিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘দেখুন সুন্দরবাবু, ওই প্রতাপ চৌধুরির কথা ভুলে গিয়ে আমাদের এখন কাজ করতে হবে ভূষোপাগলাকে নিয়ে৷’
দারোগাবাবু বললেন, ‘বিলক্ষণ! এত বড়ো একটা খুনের মামলা ভুলে যাব? যা তা খুন নয়, পুলিশ খুন!’
জয়ন্ত বলল, ‘খুনের মামলা নিয়ে মস্তক ঘর্মাক্ত করতে হবে আপনাকেই৷ কোনো খুনের মামলা তদারক করবার জন্যে আমরা এ গ্রামে আসিনি৷’
দারোগাবাবু বিষণ্ণ মুখে বললেন, ‘তাহলে আপনারা আমাকে আর সাহায্য করবেন না?’
জয়ন্ত হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই করব৷ আগে আমার সব কথা শুনুন৷ আমরা এখানে এসেছি সুব্রতবাবুর অনুরোধে৷ তিনি আমাদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন এক রহস্যময় মামলা৷ তার কথা এখানে বলবার দরকার নেই, তবে এইটুকু জেনে রাখুন, তার সঙ্গেও জড়িত আছে ওই প্রতাপ চৌধুরি৷ সুতরাং আসলে প্রতাপ চৌধুরিকে আমরা ছাড়ব না, আর সেও বোধ হয় আমাদের ছাড়বে না- আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘তুমি ভূষোপাগলার কথা কী বলছিলে জয়ন্ত?’
‘এইবারে ভূষোপাগলাকেই আমাদের দরকার৷’
‘একটা বাজে পাগলার জন্যে হঠাৎ তোমার টনক নড়ল কেন?’
‘এ প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি৷ তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন৷’
‘কী?’
‘ভূষোপাগলা বরাবরই সোনার আনারসের ছড়া চেঁচিয়ে আবৃত্তি করতে করতে এখানকার হাটে-ঘাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ায়৷ এত দিন কেউ তাকে গ্রাহ্যের মধ্যেও আনেনি৷ কিন্তু প্রতাপ চৌধুরি আজ হঠাৎ তাকে বন্দি করতে চায় কেন?’
সুন্দরবাবু কোনো জবাব না দিয়ে কেবল মাথার টাক চুলকোতে লাগলেন৷
জয়ন্ত বলল, ‘কেন, তা বুঝতে পারছেন না? প্রতাপের সন্দেহ হয়েছে যে, ভূষো সোনার আনারসের গুপ্তকথা কিছু কিছু জানে৷’
‘প্রতাপ তো এখানকারই লোক৷ এতদিন তার এ সন্দেহ হয়নি কেন?’
‘এতদিন সে সোনার আনারস নিয়ে মাথা ঘামাবার চেষ্টাও করেনি৷ এ-সম্বন্ধে সে হঠাৎ সজাগ হয়েই আগে দিয়েছে সুব্রতবাবুর উপরে হানা৷ তারপরেই তার দৃষ্টি পড়েছে ভূষোপাগলার উপরে৷ বুঝেছেন?’
‘হুম৷ জয়ন্ত তোমার অনুমানই সংগত বলে মনে হচ্ছে৷’
‘তাই আমাদের ওই ভূষোপাগলাকে ছাড়লে চলবে না৷ তার সঙ্গে কথা কয়ে আমার এই বিশ্বাসই দৃঢ় হয়ে উঠেছে যে, সোনার আনারসের অনেক গুপ্তকথাই সে জানে৷ সৌভাগ্যক্রমে সে আছে এখন আমাদেরই হাতে৷ তার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করে দেখা যাক, আমার সন্দেহ সত্য কি না৷’
বাসায় ফিরে এসে দেখা গেল, মানিক বিছানার উপরে বসে সুব্রতর সঙ্গে গল্প করছে৷
জয়ন্ত বলল, ‘কী হে মানিক, এখন কেমন আছ?’
মানিক মুখ ভার করে বলল, ‘যাও, যাও!’
জয়ন্ত হেসে তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘সঙ্গে নিয়ে যাইনি বলে অভিমান হয়েছে? তোমার শরীরের অবস্থা দেখেই নিয়ে যাইনি ভাই, আমার উপর অবিচার কোরো না৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! তুমি সঙ্গে ছিলে না, বেঁচেছিলাম৷ অন্তত খানিকক্ষণ তোমার বাক্যযন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলাম৷’
মানিক ফিক করে হেসে ফেলে বলল, ‘তাহলে বাক্যযন্ত্রণা আবার শুরু হবে নাকি?’
জয়ন্ত বলল, ‘না মানিক, আজকের মতো সুন্দরবাবুকে ক্ষমা করো! সুব্রতবাবু, ভূষোপাগলা কেমন আছে?’
মানিক বলল, ‘নিশ্চয়ই ভালো আছে৷ এই তো পাঁচ মিনিট আগেও সে চিৎকার করে সোনার আনারসের ছড়া আউড়ে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল৷’
জয়ন্ত একখানা চেয়ারের উপরে বসে পড়ে বলল, ‘সুব্রতবাবু, দয়া করে ভূষোকে একবার এখানে নিয়ে আসতে পারবেন কি?’
‘যাচ্ছি’, বলে সুব্রত ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেল৷
মিনিট পাঁচেক পরে সুব্রত ফিরে এসে বলল, ‘ভূষোকে দেখতে পেলাম না৷’
জয়ন্ত চমকে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘মানে?’
‘ভূষো ঘরেও নেই, এই বাড়ির ভিতরেও কোথাও নেই৷ কেবল তার ঘরের দেওয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে-‘সোনার আনারস! সোনার আনারস! আমি চললাম সেই সোনার আনারসের সন্ধানে!’
অষ্টম – জলগ টিকটিকি
গভীর রাত্রে জয়ন্ত হঠাৎ ধাক্কা মেরে ঘুম ভাঙিয়ে দিল মানিকের৷
মানিক ধড়মড় করে বিছানার উপরে উঠে বসে বলল, ‘ব্যাপার কী জয়? আবার কোনো বিপদ ঘটল নাকি?’
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘বিপদ নয় মানিক, বিপদ নয়৷ শোনো-‘
শোনা গেল, খানিক দূর থেকে কে আবৃত্তি করছে-
‘আয়নাতে ওই মুখটি দেখে
গান ধরেছে বৃদ্ধ বট,
মাথায় কাঁদে বকের পোলা,
খুঁজছে মাটি মোটকা জট৷’
মানিক বলল, ‘ওই তো পলাতক ভূষোপাগলার গলা৷’
জয়ন্ত বলল, ‘হ্যাঁ, ভূষো যে এখানকার মাটি ছেড়ে নড়তে পারবে না, সেটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলুম৷ মানিক, তোমার শরীর এখন সুস্থ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ৷ কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’
‘খুব সম্ভব ভূষো বাগানের পুকুরপাড়েই আছে৷ আমি চুপিচুপি গিয়ে দেখতে চাই সেখানে সে কী করছে৷ তুমিও কি আমার সঙ্গে আসবে?’
এক লাফে নীচে নেমে মানিক বলল, ‘সে-কথা আবার বলতে৷’
তাড়াতাড়ি জামা পরে দুজনে বেরিয়ে পড়ল৷
আকাশে একাদশীর চাঁদ৷ রাত্রেও মানুষের দৃষ্টি অচল নয়৷
জয়ন্তর অনুমান সত্য৷ পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে বট গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিল একটা মানুষের মূর্তি৷ নিশ্চয়ই ভূষোপাগলা৷
মিনিট-কয়েক সে নীরবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ তারপর হঠাৎ বট গাছের পশ্চিমদিক ধরে হনহন করে এগিয়ে যেতে লাগল৷
জয়ন্ত বলল, ‘আজ আর ভূষোর সঙ্গ ছাড়া হবে না৷ ও কোথায় যায়, দেখবার জন্যে আমার আগ্রহ হচ্ছে৷’
‘কেন বলো দেখি?’
‘আমি ভূষোকে সাধারণ পাগল বলে মনে করি না৷ আমার বিশ্বাস, ও অকারণে পাগলামির ঝোঁকে ওদিকে যাচ্ছে না, ওর ওই পথ-চলার ভিতর নিশ্চয়ই কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য আছে৷’
‘জয়ন্ত, তোমার এই সন্দেহের কারণ আমি বুঝতে পারছি না৷’
জয়ন্ত জবাব না দিয়ে অগ্রসর হতে লাগল৷ খানিকক্ষণ কেটে গেল৷
মানিক বলল, ‘আমরা বোধ হয় আধ ঘণ্টা ধরে পথ চলছি৷ এইভাবেই আজকের রাতটা পুইয়ে যাবে নাকি?’
জয়ন্ত বলল, ‘যেতে পারে৷ মানিক একটা বিষয় লক্ষ করেছ?’
‘কী?’
‘ভূষো মাঠ ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু একবারও বাঁয়ে কি ডাইনে ফিরছে না, সুব্রতবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে অগ্রসর হয়েছে একেবারের সোজাসুজি৷’
‘তার দ্বারা কী প্রমাণিত হয়?’
‘একটু পরেই বুঝতে পারব৷’
আরও খানিকক্ষণ গেল৷ মানিক বলল, ‘খ্যাপার পাল্লায় পড়ে আমরাও খেপে গেলাম নাকি?’
জয়ন্ত উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘না মানিক, না৷ ওই দেখো, ভূষো দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আমরা আজ এক ক্রোশ পথ পার হয়েছি৷’
‘এতটা নিশ্চিত হলে কেমন করে?’
‘কারণ ভূষোপাগলা এইখানে এসে থেমেছে৷’
‘এ কীরকম হেঁয়ালি?’
‘হেঁয়ালি নয় হে, হেঁয়ালি নয়৷ হেঁয়ালির ভিতরে আমি পেয়েছি অর্থের সন্ধান! দেখো, দেখো, ভূষোর রকম দেখো৷’
ভূষো এইবারে সত্য-সত্যই পাগলের মতো চারিদিকে ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগল- পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে!
মানিক একটা গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে সবিস্ময়ে বলল, ‘ভূষোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, ও যেন কী খুঁজছে, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না!’
‘কিন্তু কী খুঁজছে?’
‘ভগবান জানেন৷ হয়তো পাগলটা ভেবেছিল এখানেই ফলে সোনার আনারস৷’
‘আমিও তো ওই রকমই একটা অসম্ভব আশা করেছিলাম৷’
‘যাও, যাও, বাজে বোকো না!’
‘বাজে নয়, সত্যি বলছি৷ আমার দৃঢ় ধারণা, সুব্রতবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভূষো প্রায়ই এই পর্যন্ত আসে৷ কিন্তু যা পাবার আশায় এত দূর আসে, তা আর খুঁজে পায় না৷ খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর৷! কিন্তু কোথায় পরশপাথর? সেই দুঃখেই বোধ হয় ওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে!’
মানিক একটু ভেবে বলল, ‘কিন্তু কথা হচ্ছে, ভূষো এতখানি পথ পার হয়ে ঠিক এইখানেই বা এসে থামল কেন?’
মানিকের পিঠ চাপড়ে জয়ন্ত বলল, ‘ঠিকই বলেছ৷ তোমার এই প্রশ্ন হচ্ছে একটা প্রশ্নের মতো প্রশ্ন৷ এবারে ওই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে৷’
‘কার কাছে উত্তর খুঁজবে? ভূষোকে কিছু জিজ্ঞাসা করা মিছে, কারণ নিজেই সে কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি৷’
‘ভায়া, উত্তর খুঁজব আমার নিজের মনের ভিতরেই৷ ভূষোর মুখ চেয়ে তো আমরা এখানে আসিনি৷’
হঠাৎ ছুটোছুটি থামিয়ে ভূষো দাঁড়িয়ে পড়ল৷ তারপর ধীরে ধীরে আউড়ে গেল-
‘পশ্চিমাতে পঞ্চ পোয়া,
সূয্যিমামার ঝিকমিকি,
নায়ের পরে যায় কত না,
খেলছে জলগ টিকটিকি৷-
হায় রে হায়, সব গুলিয়ে গেল, সব গুলিয়ে গেল৷ ওরে বাবা জলগ টিকটিকি, কোথায় আছিস তুই, কে তোকে তাড়িয়ে দিলে বাপধন?’
ঠিক সেই সময়ে কাছের একটা ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এল আর-এক মনুষ্যমূর্তি৷ সে খুব সন্তর্পণে পা টিপেটিপে পিছন থেকে ভূষোর দিকে অগ্রসর হতে লাগল৷
জয়ন্ত বলল, ‘প্রতাপ চৌধুরির চর এখনও ভূষোর পিছনে লেগে আছে? নিশ্চয়ই ওকে আবার ধরে নিয়ে যেতে চায়৷ চলো মানিক, আমরাই ওকে গ্রেপ্তার করি!’
জয়ন্ত ও মানিক গাছের আড়াল ছেড়ে বেগে বেরিয়ে পড়ল৷ কিন্তু লোকটা যেমন সাবধানি, তেমনি চটপটে৷ হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তাদের দেখে ফেলল৷ পরমুহূর্তেই সে একটা জঙ্গলের দিকে দৌড় মারল তিরের মতো!
তার পা লক্ষ্য করে জয়ন্ত ছুড়ল রিভলবার৷ কিন্তু রাত্রের ঝাপসা আলোয় লক্ষ্যভেদ করতে পারল না৷ লোকটা জঙ্গলের ভিতরে অদৃশ্য হল৷
জয়ন্ত ও মানিক জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকল, কিন্তু পলাতকের কোনো পাত্তাই মিলল না৷ দেখল খালি চাঁদের আলোর ফিতে দিয়ে গাঁথা অন্ধকারকে৷
তারা বাইরে বেরিয়ে এল৷ সেখানে ভূষোপাগলাকে দেখতে পেলে না৷
মানিক বলল, ‘পাগলা ভয় পেয়ে আবার পালিয়েছে৷ এখন কী করবে?’
অতঃপর ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরব৷ তারপর ঘুমিয়ে পড়ব৷ তারপর সকালে উঠে সুব্রতবাবুকে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করব৷ তারপর সদলবলে আবার এখানে আগমন করব৷’
‘আবার এখানে আসবে?’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়!’
‘কেন?’
‘জলগ টিকটিকি প্রভৃতি আরও অনেক কিছুর সন্ধানে৷’
‘ভূষোর সঙ্গে তুমিও টিকটিকি নিয়ে মাথা ঘামাতে চাও নাকি?’
‘মাথা না ঘামিয়ে উপায় নেই!’
‘বুঝেছি জয়! তুমি একটা কোনো হদিস পেয়েছ৷’
‘রহস্যের সিংহদ্বার খোলবার জন্যে একটা চাবিকাঠি কুড়িয়ে পেয়েছি! কিন্তু অনেক কালের পুরোনো মরচেপড়া চাবি, এখনও কুলুপে ভালো করে লাগছে না৷ অপূর্ব ওই সোনার আনারসের ছড়া! এর প্রত্যেক কথাটির অর্থ যে-কোনো শ্রেষ্ঠ কবিতারও চেয়ে গভীর৷ কিন্তু জেনে রেখো, এ মামলার কিনারা হতে দেরি নেই৷’
নবম – মরা নদীর শুকনো খাত
প্রভাত৷ জানলার বাইরে দুলছে নতুন রোদের স্বচ্ছ সোনার আঁচল এবং তারই ভিতর দিয়ে ফুটে উঠেছে সবুজের দোলনায় দুলদুলে ফলশিশুদের হাসি-রঙিন মিষ্ট মুখগুলি৷
প্রভাতী চায়ের পেয়ালায় প্রথম চুমুক দিয়েই জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা সুব্রতবাবু, এদেশে কখনো বাঘরাজা বলে কেউ ছিলেন কি?’
সুব্রত বলল, ‘বাঘরাজা . . . বাঘরাজা? হ্যাঁ, বাবার মুখে শুনেছি, অনেক কাল আগে এ-অঞ্চলে এক প্রতাপশালী রাজবংশ ছিল, তাদের উপাধি-বাঘ৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! বাঘ আবার মানুষের উপাধি হয় নাকি?’
জয়ন্ত বলল, ‘হয় সুন্দরবাবু, হয়৷ আমার পরিচিতদের মধ্যেই বাঘ উপাধিধারী লোক আছেন৷ হয়তো তাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ একাই কোনো ব্যাঘ্র বধ করেছিলেন, আর তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে লোকে তাঁকে দিয়েছিল ওই উপাধি৷ পরে তাঁর বংশধররাও ওই বাঘ বলেই পরিচিত হয়৷ কেবল বাঘ নয়, বাংলাদেশে হাতি উপাধিধারী লোকও আছে৷ কিন্তু যাক ও-কথা৷ সুব্রতবাবু, আপনার কথায় আমার কৌতূহল প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে৷ আপনি ওই বাঘরাজাদের সম্বন্ধে আর কিছু বলতে পারেন কি?’
সুব্রত বলল, ‘আমি বিশেষ কিছুই জানি না, আর আমার পক্ষে জানবার কথাও নয়৷ কারণ বাঘরাজাদের বংশ নাকি পলাশির যুদ্ধের আগেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল৷ তবে শুনেছি, আমার প্রপিতামহেরও আগে আমাদেরই কোনো পূর্বপুরুষ কোনো এক বাঘরাজার দেওয়ানের পদ লাভ করেছিলেন৷’
‘বাঘরাজাদের কোনো চিহ্নই কি এ-অঞ্চলে বর্তমান নেই?’
‘কিছু না৷ আমার পিতামহ বলতেন, যেখানে বাঘরাজাদের রাজধানী ছিল, এখন সেখানে বিরাজ করছে নিবিড় জঙ্গল৷’
‘সে জায়গাটা কোথায়?’
‘তাও আমি জানি না৷’
জয়ন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল৷ তারপর আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা সুব্রতবাবু, আপনাদের গ্রামের পশ্চিম দিকে কোনো নদী-টদি আছে কি?’
‘কেন বলুন দেখি?’
‘আমি এইরকম একটি নদী খুঁজছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না৷’
সুব্রত একটু বিস্মিত স্বরে বলল, ‘জয়ন্তবাবু, আপনার প্রত্যেক প্রশ্নই কেমন রহস্যময়৷ হঠাৎ নদীর কথা কেন আপনার মনে উঠল?’
‘সেকথা পরে বলব৷ আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন৷’
‘না, আমাদের গ্রামের পশ্চিম দিকে কোনো নদী নেই৷’
জয়ন্ত হতাশভাবে বলল, ‘নেই! তাহলে কি আমি মিছাই এত জল্পনা-কল্পনা করে মরলাম? সোনার আনারসের ছড়াটা কি একেবারেই বাজে?’
সুব্রত প্রায় আধ মিনিট ধরে জয়ন্তর মুখের পানে তাকিয়ে রইল বিস্ময়চকিত চোখে৷ তারপর থেমে থেমে বলল, ‘সোনার আনারসের ছড়া? তার সঙ্গে নদীর সম্পর্ক কী?’
‘সম্পর্ক একটা আছে বলেই অনুমান করেছিলাম৷ কিন্তু এখন দেখছি আমার অনুমান সত্য নয়৷’
সুব্রত বলল, ‘দেখুন জয়ন্তবাবু, আমাদের গ্রাম থেকে কিছু দূরে আগে একটা নদী ছিল বটে৷’
জয়ন্ত অত্যন্ত উৎসাহিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘ছিল নাকি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ এ-অঞ্চলে আগে একটা নদী ছিল, কিন্তু এখন সেটা শুকিয়ে গিয়েছে৷ কেবল মাঝে মাঝে দেখা যায় তার শুকনো খাত?’
‘তারপর, তারপর?’
‘এখনও বর্ষাকালে সেই খাত কিছুদিনের জন্যে জলে ভরে যায়৷ কিন্তু সেটা তো গ্রামের পশ্চিমে নয়-এখান থেকে উত্তর-পশ্চিমদিকে মাইল তিন কি আরও কিছু বেশি পথ পেরিয়ে গেলে তবে সেই খাতটা পাওয়া যায়৷’
জয়ন্ত যেন নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, ‘উত্তর-পশ্চিমদিকে৷ তাহলে আবার যে আমার হিসাব গুলিয়ে যাচ্ছে!’ অল্পক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল৷ তারপর বলল, ‘সুব্রতবাবু, যদিও আমি খেই খুঁজে পাচ্ছি না, তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই৷’
‘মানে?’
‘সেই মরা নদীর শুকনো খাতটা স্বচক্ষে একবার দর্শন করব৷ এখনই চলুন৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আরে ধ্যেৎ! খামখেয়ালের একটা মাত্রা থাকা উচিত৷ কোনো মরা নদীর শুকনো খাত দেখে আমাদের কী ইষ্টলাভ হবে? তার চেয়ে সুব্রতবাবু যদি আরও এক পেয়ালা চা, আরও এক প্লেট চিঁড়ে-আলুভাজা আর বেগুনি-ফুলুরির ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে সেটা হবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার৷’
জয়ন্ত ফিরে বলল, ‘মানিক, তোমারও কি এই মত?’
মানিক এতক্ষণ গভীর মনোযোগের সঙ্গে জয়ন্ত ও সুব্রতর কথাবার্তা শ্রবণ করছিল৷ সে মুখ তুলে বলল, ‘ভাই জয়ন্ত, তোমাদের কথা শোনবার পর আমিও গভীর আঁধারে যেন কিঞ্চিৎ আলোর ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি৷ হুঁ,-নায়ের পরে যায় কত না, খেলছে জলগ টিকটিকি!-এটি একটি মূল্যবান সংকেত৷ কিন্তু, পশ্চিমাতে পঞ্চ পোয়া, সূয্যিমামার ঝিকমিকি-এ লাইনটির কোনোই সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছি না যে!’
‘আগে তো উত্তর-পশ্চিমদিকে যাত্রা করা যাক, তারপর দেখা যাবে কত ধানে কত চাল৷’
‘উত্তম৷ আমি প্রস্তুত৷ সুন্দরবাবু আপাতত চা এবং চিঁড়ে, আলুভাজা এবং বেগুনি-ফুলুরি নিয়ে ব্যস্ত থাকুন, আমরা ততক্ষণে খানিকটা ‘মর্নিং ওয়াক’ করে আসি৷’
সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি যদি এখনই তোমাদের সঙ্গে এই চায়ের আসর ত্যাগ না করি, তাহলে এর পরে মানিকের দুষ্ট জিহ্বা যে কতখানি অসংযত হয়ে উঠবে, তা কি আমি জানি না? হুম, আমি আর চা-টা খেতে চাই না, আমিও সকলের সঙ্গে যেতে চাই৷’
ইতিমধ্যে দারোগাবাবু এসে হাজির৷ জয়ন্ত দলে টেনে নিল তাঁকেও৷
দশম – রহস্যের চাবিকাঠি
সুব্রত বলল, ‘এই সেই মরা নদীর শুকনো খাত৷’
জয়ন্ত বলল, ‘সরস্বতী নদীও শুকিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের নানা জায়গায় ঠিক এই রকমই খাত সৃষ্টি করেছে৷ এই মরা নদীটাও দেখছি আকারে আগে সরস্বতীর মতোই ছিল৷’
খাতটা চওড়ায় কলকাতার আদিগঙ্গার চেয়ে বড়ো হবে না৷ দক্ষিণ থেকে বরাবর উত্তর দিকে চলে গিয়েছে৷ খাতটা মাঝে মাঝে ভরাট হয়ে আছে এবং তার উপর দেখা যাচ্ছে ছোটো-বড়ো ঝোপঝাপ ও জঙ্গল৷
দক্ষিণদিকে খাতটা যেখানে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, সেইখানে দাঁড়িয়ে নীরবে কী ভাবতে লাগল জয়ন্ত৷ তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘মানিক, খাতটা অর্থাৎ নদীটা বোধ হয় দক্ষিণ দিকেও এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা আর দেখা যাচ্ছে না; কারণ, তা একেবারে ভরাট হয়ে সমতল মাঠের সঙ্গে মিলিয়ে আছে৷’
মানিক বলল, ‘তোমার এ অনুমান অসংগত নয়৷’
দারোগাবাবু বিরক্ত কন্ঠে বললেন, ‘একটা খাত নিয়ে এমন গভীর গবেষণার কারণ কী বুঝছি না৷’
সুন্দরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমারও এই মত৷ আমি বাসায় ফিরে যেতে চাই৷’
সুব্রতও বলল, ‘জয়ন্তবাবু, আপনার কী উদ্দেশ্য বলুন দেখি?’
জয়ন্ত কারুর কোনো কথার জবাব না দিয়েই হঠাৎ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘হয়েছে মানিক, হয়েছে! আমি চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছি!’
দারোগাবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘চাবিকাঠি? কীসের চাবিকাঠি মশাই?’
‘রহস্যের৷’
‘রহস্য আবার কী?’
‘যদি জানতে চান, আমার সঙ্গে আসুন৷ এসো মানিক?’ জয়ন্ত দ্রুতপদে দক্ষিণদিকে অগ্রসর হতে লাগল৷
সুন্দরবাবু খানিকটা এগিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘ও জয়ন্ত, একটু আস্তে চলো ভাই, তোমার সঙ্গে আমি পাল্লা দিতে পারব কেন-আমার বপুখানি দেখছ তো?’
জয়ন্ত গতিও কমাল না, উত্তরও দিল না-সমানে এগিয়ে চলল৷
দারোগাবাবু বললেন, ‘এ যেন বুনো হাঁসের পিছনে ছোটা হচ্ছে৷’
সুব্রত বলল, ‘সোনার আনারসের ভিতরে যে ছড়াটা ছিল, জয়ন্তবাবু বোধ হয় তার মানে খুঁজে পেয়েছেন৷’
দারোগাবাবু তপ্তস্বরে বললেন, ‘ওই ছড়াটার কথা শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল৷ ভূষো হচ্ছে আস্ত পাগল, একটা বাজে ছেলেভুলোনো ছড়া নিয়ে তার সঙ্গে মেতে থাকা আমাদের কি শোভা পায়? ছড়া হচ্ছে ছড়া৷ তার মধ্যে কোনো অর্থই থাকে না৷’
সুব্রত বলল, ‘আমারও তো ওই বিশ্বাস ছিল, কিন্তু জয়ন্তবাবুর বিশ্বাস অন্যরকম৷’
‘নিজের বিশ্বাস নিয়ে নিজেই থাকুন, কিন্তু তিনি আমাদের নিয়ে টানাটানি করছেন কেন? ঘাড়ে পড়েছে খুনের মামলা, এখন তার কিনারা করব, না ছড়ার অর্থ খুঁজে মরব? আরে ছিঃ, এ যে দস্তুরমতো ছেলেমানুষি!’
আরও বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে জয়ন্ত বলে, ‘মানিক, কাল রাত্রে ভূষো ঠিক এইখানে এসেই চারদিকে ছুটোছুটি করেছিল না?’
মানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ জয়ন্ত৷’
‘পূর্ব-দক্ষিণদিকে তাকিয়ে দেখো৷’
‘ওদিকে তো দেখছি মাঠের পরে রয়েছে একটা নিবিড় অরণ্য৷’
‘সোনার আনারসের জয় হোক৷ এইবারে আমরা ওই বনের ভিতরে প্রবেশ করব৷ পূর্ব-দক্ষিণদিক ধরেই এগিয়ে চলব-কিন্তু তাড়াতাড়ি নয়, আমাদের পদচালনা করতে হবে স্বাভাবিকভাবেই৷ কতক্ষণ অগ্রসর হতে হবে জানো? ঠিক এক প্রহর৷’
সুন্দরবাবু চোখ পাকিয়ে বলল, ‘অর্থাৎ আরও তিন ঘণ্টা ধরে আমাদের বনে বনে ঘুরতে হবে৷ ওরে বাবা!’
দারোগাবাবু বললেন, ‘আরও তিন ঘণ্টা কী বলছেন মশাই? তিন ঘণ্টা লাগবে তো খালি এগিয়ে যেতেই, ফিরতেও তো লাগবে আরও তিন ঘণ্টা! তার মানে কোদালপুরে ফিরব আমরা রাতের অন্ধকারে!’
‘হুম, তাই নাকি? সারাদিন খালি তবে পথই হাঁটব, দানাপানি কিছুই জুটবে না?’
‘তা ছাড়া আর কী?’
‘আমি কি পাগল? আমাকে কি ভীমরতিতে ধরেছে? আমি পারব না-ব্যাস, আমার এক কথা৷’
জয়ন্ত কোনো রকমে হাসি চেপে বলল, ‘ভয় নেই সুন্দরবাবু, আপনাকে উপোস করতে হবে না৷’
‘উপোস করতে হবে না কীরকম? নিবিড় অরণ্যের মধ্যে হোটেল পাওয়া যায় নাকি?’
‘সুন্দরবাবু, আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি৷ মানিকের কাঁধে ওই যে ব্যাগটি ঝুলছে, ওর ভেতরে খুঁজলে যৎকিঞ্চিৎ খাবার-টাবারও পাওয়া যেতে পারে৷’
প্রবল মস্তক আন্দোলন করে সুন্দরবাবু বললেন, ‘ডবল খাবারের লোভেও আমি আর ছয়-সাত ঘণ্টা ধরে হাঁটতে পারব না৷ এখনই আমার জিভ বেরিয়ে পড়তে চাইছে-হুম!’
দারোগাবাবু বলল, ‘আমিও সুন্দরবাবুর দলে৷ আমি খুনের মামলার আসামি খুঁজছি- সোনার আনারসের ছড়া নিয়ে আমার কী লাভ হবে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘কী লাভ হবে? আপনি কি জানেন, ওই খুনের মামলার আসামি প্রতাপ চৌধুরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়ানো আছে এই সোনার আনারসের রহস্য?’
‘কী সেই রহস্য?’
‘যদি জানতে চান, আসুন আমার সঙ্গে৷ আমাদের আর অপেক্ষা করা চলবে না৷ প্রতাপ চৌধুরিও এই রহস্যের চাবিকাঠি খুঁজছে, কিন্তু আমরা কার্যোদ্ধার করতে চাই তার আগেই৷ আমার কথায় অবিশ্বাস করবেন না-আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজ আপনারা দেখতে পাবেন একটা কল্পনাতীত দৃশ্য!’
একাদশ – মানিকের ব্যাগে অশ্বডিম্ব নেই
গহন বন তো গহন বন! অরণ্যের এমন নিবিড়তা কেউ কল্পনা করেনি৷ এত বুড়ো-বুড়ো গাছ খুব কম বনেই চোখে পড়ে-জন্মেছে তারা কোন মান্ধাতার আমলে, তাও আন্দাজ করবার জো নেই৷ কোথাও কোথাও তারা পরস্পরকে এমন জড়াজড়ি করে আছে এবং তাদের উপর দিকটায় লতাপাতারা এমনভাবে ঘন জাল বুনে রেখেছে যে, দুপুরের রোদও ভিতরে প্রবেশ করবার পথ পায়নি বললেও চলে৷
সর্বত্রই ঝোপঝাপ, কাঁটাজঙ্গল এবং মানুষের মাথা-ছাড়িয়ে-ওঠা আগাছার ভিড়৷ সেইগুলোকে ঠেলে ঠেলে কোনো রকমে পথ করে নিতে হয়৷ গায়ে পটপট করে কাঁটা বেঁধে, আশেপাশে ফোঁসফোঁস করে ভয়াবহ শব্দ শোনা যায়, মাঝে মাঝে হোঁচট খেয়ে পথিকদের দেহ হয় প্রপাতধরণিতলে, কিন্তু তবু নির্বাপিত হল না জয়ন্তর উৎসাহবহ্নি!
সুন্দরবাবু মুখব্যাদান করে বিষম হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘দারোগাবাবু ডানপিটে জয়ন্তটা আজ আমাদের শমন-সদনে প্রেরণ করতে চায় নাকি?’
রুদ্ধ ক্রোধে ফুলতে ফুলতে দারোগাবাবু বললেন, ‘জানি না৷ এমন চূড়ান্ত খ্যাপামি জীবনে আর কখনো দেখিনি৷’
‘হুম! কিন্তু কথা হচ্ছে আমরা কোথায় কোন দিকে যাচ্ছি?’
জয়ন্ত বলল, ‘আমরা যাচ্ছি পূর্ব-দক্ষিণদিকে৷’
‘তাই নাকি? চোখে তো দেখছি খালি ঝোপঝাপ আর অন্ধকার৷ এর মধ্যে এসে তুমি কি দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলোনি?’
‘উঁহু!’
‘কেমন করে জানলে?’
হাত তুলে একটা জিনিস দেখিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘এই আমাদের পথ-প্রদর্শক৷’
‘কী ওটা হে? ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না৷’
‘কম্পাস৷’
‘কিন্তু পূর্ব-দক্ষিণদিকে ঝাড়া তিন ঘণ্টা ধরে এগিয়ে তুমি কী পরমার্থ লাভ করবে?’
‘শুনলে বিশ্বাস করবেন না৷’
‘বিশ্বাস করব না কীরকম?’
‘উঁহু, বিশ্বাস করবেন না৷’
‘আলবত করব, হাজারবার করব৷ তোমার ল্যাজ ধরতে যখন বাধ্য হয়েছি, তখন সোনার পাথরবাটি দেখেও আমার আর অবিশ্বাস করবার উপায় নেই৷’
‘সোনার পাথরবাটি তো একটি অকিঞ্চিৎকর দ্রব্য৷ এ হচ্ছে তারও চেয়ে অবিশ্বাস্য৷’
‘ও বাবা, তাই নাকি? শুনেই যে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাচ্ছে!’
‘তা যাবেই তো!’
‘অত প্যাঁচ কষছ কেন ভায়া? আসল ব্যাপারটা খুলেই বলো না!’
‘শুনবেন তাহলে?’
‘শুনব বলে তো উভয় কান খাড়া করে আছি৷ স্পষ্ট করে বলো, পথের শেষে গিয়ে তুমি কী দেখতে চাও?’
‘একটি প্রকাণ্ড অখণ্ডমণ্ডলাকার, দুগ্ধফেননিভ অশ্বডিম্ব৷’
সুন্দরবাবু খানিকক্ষণ অতি গম্ভীরভাবে অগ্রসর হলেন৷ তারপর আহত কন্ঠে বললেন, ‘জয়ন্ত, তুমিও?’
‘মানে?’
‘তুমিও আমার সঙ্গে বাজে ঠাট্টা শুরু করলে মানিকের মতো?’
‘ঠাট্টা নয় সুন্দরবাবু, ঠাট্টা নয়! পথের শেষে গিয়ে যে কী দেখব, তা নিজেই আমি জানি না৷ কে জানে, আমার সমস্ত জল্পনাকল্পনা শেষটা অশ্বডিম্বের মতোই অলীক বলে প্রতিপন্ন হবে কি না!’
দারোগাবাবু ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘চমৎকার জয়ন্তবাবু, চমৎকার! তাহলে আপনি আমাদের এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করাতে চান কেবল কাদা ঘেঁটে ফিরে আসবার জন্যে?’
জয়ন্ত ঠোঁট টিপে একটুখানি হাসল, কোনো জবাব দেওয়ার দরকার মনে করল না৷
দারোগাবাবু দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে ডাকলেন, ‘সুন্দরবাবু!’
‘হুম, হুম! বড্ড রেগেছেন দেখছি৷’
‘হ্যাঁ, তাই৷’
‘কিন্তু-‘
‘এখন আর কিন্তু-টিন্তু নেই৷’
‘তবে?’
‘আপনি আর আমি দুজনেই পুলিশের লোক৷’
‘বলা বাহুল্য৷’
‘আমরা হচ্ছি কাজের মানুষ!’
‘অত্যন্ত!’
‘আমরা কী পাগলের মতো, গাধার মতো, অন্ধের মতো অশ্বডিম্বের পিছনে ছুটতে পারি?’
‘হুম, হুম, কিছুতেই না!’
মানিক এইবারে মুখ খুলল৷ বলল, ‘এ-কথা আপনি কী করে জানলেন দারোগাবাবু?’
‘কী কথা?’
‘গাধারা আর পাগলরা আর অন্ধেরা অশ্বডিম্বের পশ্চাতে ধাবমান হয়?’
‘মানিকবাবু, আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই৷ সুন্দরবাবু!’
‘উঁ৷’
‘আমাদের এখন কী করা উচিত জানেন?’
‘মোটেই জানি না৷’
‘আমাদের এখন উচিত, এইখান থেকেই ধুলো-পায়ে বিদায় নেওয়া৷’
‘অর্থাৎ আবার কোদালপুরে ফিরে যাওয়া?’
‘ঠিক!’
দারোগাবাবুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সুন্দরবাবু করলেন একবার জয়ন্তর এবং আর একবার মানিকের মুখের উপরে দৃষ্টিপাত৷ তারপর মাথা নেড়ে করুণ সুরে বলল, ‘হুম, অসম্ভব!’
‘কী অসম্ভব?’
‘এখন কোদালপুরে ফিরে যাওয়া৷’
‘কেন?’
‘জয়ন্তর পাগলামি আর মানিকের দুষ্ট রসনাকে আমি সমর্থন করি না বটে, কিন্তু বোধ হয় ওদের আমি কিছু কিছু-ওর নাম কী-ভালোবাসি৷ আমার পক্ষে ওদের ছেড়ে চলে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব৷ নিতান্তই যদি যেতে চান, তাহলে আপনাকে যেতে হবে একলাই৷’
দারোগাবাবুর দুই চক্ষে ফুটল তীব্র ভাব৷ কিন্তু তিনি আর দ্বিরুক্তি না করে অগ্রসর হতে লাগলেন সকলের পিছনে পিছনে৷ বোধ করি তিনি বুঝতে পারলেন যে, একলা এই বন থেকে বেরোবার চেষ্টা করলে পথ হারাবার সম্ভাবনাই হবে বেশি৷
জয়ন্ত নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা প্রায় পথের শেষে এসে পড়েছি- আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই একটা কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যেতে পারে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘শুনলেন তো দারোগাবাবু! এতক্ষণ ধরে এত যমযন্ত্রণা যখন ভোগ করলাম, তখন আর মিনিট পনেরোর জন্যে অশান্তি সৃষ্টি করে লাভ কী? বিশেষ, উদরে হয়েছে এখন দুর্ভিক্ষের ক্ষুধার উদয়-আর খোরাক আছে ওই মানিকেরই ব্যাগের জঠরে! আমরা এখান থেকে বিদায় নিতে চাইলে মানিক কি আর ব্যাগ খুলতে রাজি হবে?’
জোর মাথা নাড়া দিয়ে মানিক বলল, ‘নিশ্চয়ই নয়!’
‘ওরে বাবা, ব্যাস! এর ওপরে আর কোনো কথা বলাই বাতুলতা! হাতের খোরাক পায়ে ঠেলে উপোস করে ধুঁকতে ধুঁকতে আমি যাব কোদালপুরে ফিরে? হুম, হুম, হুম! অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব! অন্তত মানিকের ব্যাগের ভিতরে যে অশ্বডিম্ব নেই, সেটা আমি রীতিমতো হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি!’
দারোগাবাবু নিরুত্তর হয়েই রইলেন৷ তাঁর অবস্থা দেখলে মনে হয় একেবারে যাকে বলে- নাচার আর কি!
তারপর খানিকক্ষণ আর কোনো কথাবার্তা হল না৷ অরণ্যের অবস্থা তখনও একইরকম- আধা আলো আঁধার-মাখা রহস্যময় আবহাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে অগণ্য বনস্পতি মর্মরভাষায় রচনা করছে কোন অজানা পূজার মন্ত্র৷
মানিক দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘পায়ের তলায় মাটি এখানে ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে কেন?’
জয়ন্ত এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘মানিক, মাটি এদিকে ঢালু হয়ে নেমে, ওদিকে আবার উঁচু হয়ে উপর দিকে উঠে গিয়েছে৷ আগে নিশ্চয়ই এখানে একটা জলভরা খাত ছিল৷’
সেই শুকনো খাতের অন্য পাড়ের উপরে রয়েছে একটা জঙ্গলময় উঁচু ঢিপি,-যেন একটা ছোটোখাটো পাহাড়৷ ঢিপিটা দখল করে আছে অনেকখানি জায়গা৷
ঢিপির উপরে উঠে দেখা গেল তার চারিদিকেই ছড়িয়ে পড়ে আছে রাশি রাশি সেকেলে ইট৷ আর একটা দৃশ্য সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল৷ ওপাশে ঢিপিটা যেখানে নীচের দিকে নেমে শেষ হয়ে গিয়েছে, ঠিক সেইখানে রয়েছে প্রকাণ্ড একখানা অট্টালিকার ধ্বংসস্তূপ! একেবারে ধ্বংসস্তূপ বললে ঠিক বলা হয় না, কারণ সর্বাঙ্গে ছোটো-বড়ো অশথ-বট-নিম গাছের ভার বহন করে অট্টালিকার একটা অংশ এখনও দাঁড়িয়েছিল মহাকালের বিরুদ্ধে মূর্তিমান প্রতিবাদের মতো৷
জয়ন্ত উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘সুন্দরবাবু, আমার কল্পনাদেবী মিথ্যে কথা বলেননি৷ এই আমাদের পথের শেষ৷’
সুন্দরবাবু উৎসাহের লক্ষণ প্রকাশ করলেন না৷ বললেন, ‘সমাপ্তিটা আশাপ্রদ বলে মনে হচ্ছে না৷’
জয়ন্ত বলল, ‘আরে মশাই, আমরা কোথায় এসেছি বুঝতে পারছেন না? সুব্রতবাবু, সারা পথটাই আপনি বোবার মতন কাটিয়ে দিয়েছেন৷ এইবারে মুখ খুলুন৷ বলুন দেখি, কোথায় এসেছি আমরা?’
‘আমি কেমন করে বলব?’
‘তাহলে শুনুন৷ এই যে চারিদিকে খাত-ঘেরা উঁচু ঢিপিটা দেখছেন, এটা হচ্ছে কোনো পুরাতন দুর্গের শেষচিহ্ন৷ আর ওই ভাঙাচোরা অট্টালিকা হচ্ছে সেকালকার কোনো রাজার বাড়ি! খুব সম্ভব ওইখানেই বাস করতেন সেই বাঘরাজারা, যাঁদের সম্বন্ধে সোনার আনারসের ছড়ায় বলা হয়েছে-
বাঘরাজাদের রাজ্য গেছে
কেবল আছে একটি স্মৃতি,
ব্রহ্মপিশাচ পানাই বাজায়,
বাস্তুঘুঘু কাঁদছে নিতি৷
বুঝলেন?’
সুব্রত বলল, ‘আপনি কেমন করে এই সিদ্ধান্তে এসে উপস্থিত হয়েছেন, এখনও তা বুঝতে পারছি না৷’
‘যথাসময়ে তা বলব৷ এতক্ষণ পর্যন্ত ছড়া আমাদের ঠিক পথেই নিয়ে এসেছে৷ এইবারে দেখতে হবে ছড়ার শেষ দুই পঙক্তির অর্থ আবিষ্কার করা যায় কি না৷ সুব্রতবাবু, অতঃপর হতভম্ব ভাবটা ত্যাগ করে আপনি কিঞ্চিৎ জাগ্রত হবার চেষ্টা করুন!’
‘কেন বলুন দেখি?’
‘হয়তো আপনার অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হেঁয়ালি ছেড়ে সাদা ভাষায় কথা কও জয়ন্ত! তুমি কী করতে চাও?’
‘ওই ভাঙা অট্টালিকার ভিতরে ঢুকতে চাই৷’
‘কারণ?’
‘কারণ ছড়ার রচয়িতার হুকুম?’
দারোগাবাবু একটা শ্রান্ত, বিরক্তিজনক মুখভঙ্গি করলেন নির্বাকভাবে৷
দ্বাদশ – অন্দরমহলের কূপঘর
অট্টালিকার এ-অংশটাকে বাইরে থেকে যতটা ভাঙাচোরা বলে মনে হচ্ছিল, ভিতরে এসে দেখা গেল তার দুর্দশা হয়নি ততটা৷
মস্ত একটা উঠান-তার সর্বত্র আগাছার রাজত্ব৷ উঠানের চারিদিকেই চকমিলানো ঘর৷ কোনো কোনো ঘরের ছাদ বা দেয়াল ভেঙে পড়েছে এবং কোনো কোনো ঘরের দরজা বা জানলা নেই বটে, কিন্তু কয়েকটা ঘর এখনও অটুট অবস্থাতেই বিদ্যমান আছে৷
এ-ঘর সে-ঘরের মধ্যে বেড়াতে বেড়াতে জয়ন্ত বলল, ‘মনে হচ্ছে এ-অংশে ছিল রাজবাড়ির অন্দরমহল৷ মানিক, এখানকার ভিত আর দরজা-জানলার স্থূলতা দেখো৷ এ-অংশটাকে বোধ হয় সুদৃঢ় আর সুরক্ষিত করবার বিশেষ চেষ্টা করা হয়েছিল৷’
মানিক বলল, ‘হয়তো সেই জন্যেই রাজবাড়ির এদিকটা এখনও ভেঙে পড়েনি৷’
‘খুব সম্ভব তাই৷’
তখনও ভালো করে সন্ধ্যা নামেনি বটে, কিন্তু বাড়ির উঠানে হয়েছে আবছায়ার সঞ্চার৷ এবং নীচেকার ঘরগুলোর ভিতরে ঢুকলে চোখ হয়ে যায় প্রায় অন্ধ৷
জয়ন্ত বলল, ‘আমাদের সঙ্গে একটা পেট্রোলের লন্ঠন আছে৷ মানিক, সেটা জ্বেলে ফেলো তো, ওদিকের ঘরগুলো এখনও পরীক্ষা করা হয়নি৷’
সুন্দরবাবু নীরস কন্ঠে বললেন, ‘সন্ধে না হতেই বাড়িখানাকে হানাবাড়ি বলে সন্দেহ হচ্ছে৷ এখানে এত পরীক্ষা-টরিক্ষার দরকার কী আছে বাপু? এখানে দেখবার কী আছে?’
‘বলেছি তো আমি এখানে এসেছি অশ্বডিম্বের সন্ধানে৷ যতক্ষণ না তা পাই, খুঁজতে হবে বই কী!’ জয়ন্ত বলল গম্ভীর কন্ঠে৷
মানিক আলো জ্বালতে জ্বালতে ততোধিক গম্ভীর স্বরে বলল, ‘অশ্বডিম্বের ওমলেট অতিশয় সুস্বাদু! সুন্দরবাবু যদি ভক্ষণ করতে রাজি হন, আমি স্বহস্তে প্রস্তুত করতে পারি৷’
হ্যাঁ কিংবা না, কিছুই বললেন না সুন্দরবাবু, কেবল মানিকের দিকে নিক্ষেপ করলেন একটি জ্বলন্ত ক্রোধকটাক্ষ৷ বোধ করি এইরকম কোনো কটাক্ষেরই দ্বারা দেবাদিদেব মহাদেব একদা ভস্ম করে ফেলেছিলেন মদন ঠাকুরকে৷ ভাগ্যে সুন্দরবাবু মহাদেব নন, এ-যাত্রায় তাই বেঁচে গেল মানিক৷
পেট্রোলের প্রদীপ্ত লন্ঠনটি তুলে নিয়ে জয়ন্ত একটা ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ তারপর বলল, ‘মানিক!’
‘কী?’
‘ঘরের মাঝখানে কী রয়েছে দেখছ?’
‘হ্যাঁ৷ একটা বড়ো কূপ৷’
‘কিন্তু ঘরের ভিতরে কূপ!’
‘তোমার মতে এদিকটা হচ্ছে রাজবাড়ির অন্দরমহল?’
‘হ্যাঁ৷’
‘হয়তো এই ঘরটা ছিল রাজবাড়ির মেয়েদের স্নানাগার৷ সেকালে তো কলের জল ছিল না, তাই অন্তঃপুরের জন্যে এই কূপ খনন করা হয়েছিল৷’
জয়ন্ত অন্যমনস্কের মতো বলল, ‘মানিক, তোমার অনুমান অসংগত নয়৷ কিন্তু-কিন্তু-‘ বলতে বলতে থেমে গিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ৷
তারপর সে অগ্রসর হয়ে একটা তীব্র শক্তিসম্পন্ন মস্ত টর্চের আলোক-শিখা নিক্ষেপ করল কূপের মধ্যে৷
রীতিমতো গভীর কূপ৷ জল চকচক করে উঠল তার অনেক নীচে৷
জয়ন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবল৷ তারপর হঠাৎ ফিরে বলল, ‘মানিক, বার করো একগাছা লম্বা আর মোটা দড়ি৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! দড়ি নিয়ে কী হবে শুনি?’
‘দড়ি অবলম্বন করে আমি এই কূপের ভিতরে গিয়ে নামব৷’
সুন্দরবাবু শিউরে উঠে বললেন, ‘বাপ রে, কেন?’
‘হয়তো ওইখানেই পাব অশ্বডিম্বের সন্ধান!’
সুন্দরবাবু দুই চক্ষু রসগোল্লার মতন করে তুলে বললেন, ‘জয়ন্ত! ভাই জয়ন্ত! মিনতি করি, ক্ষান্ত হও! ছড়ার কথা তুমি সত্যি বলে মানো, অথচ ভুলে যাচ্ছ কেন যে, ছড়ায় লেখা আছে এখানে ব্রহ্মপিশাচ পানাই বাজায়?’
মানিক বলল, ‘পানাই মানে কি জানেন?’
সুন্দরবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না৷ আর জেনেও দরকার নেই আমার৷ কারণ ব্রহ্মপিশাচ যখন ‘পানাই’ বাজায়, তখন নিশ্চয়ই সেটা হচ্ছে কোনোরকম ভয়ংকর সৃষ্টিছাড়া বাদ্যযন্ত্র- মানুষের পক্ষে যা স্পর্শ করাও অসম্ভব!’
‘মোটেই নয়৷ পানাই বলতে বোঝায়, খড়ম! ব্রহ্মদৈত্যরা পায়ে খড়ম পরে, জানেন তো? এ হচ্ছে সেই খড়ম৷’
‘হুম! ব্রহ্মদৈত্যের পায়ের খড়ম! আমরা যেমন হাততালি দিই, তারা বুঝি তেমনই পা-তালি না দিয়ে পায়ের খড়ম তুলে খটাখট আওয়াজ সৃষ্টি করে? হতে পারে-ব্রহ্মদৈত্যদের পক্ষে অসম্ভব কী বাবা? ভাই জয়ন্ত, দোহাই তোমার! ও পাতকুয়োর ভেতর ঢোকবার চেষ্টা তুমি কোরো না-হুম!’
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বলল, ‘সুন্দরবাবু, ও-কথা যাক৷ কিন্তু এইবারে আপনিও আমাকে কিঞ্চিৎ সাহায্য করুন দেখি!’
সুন্দরবাবু বিস্মিত কন্ঠে বললেন, ‘এরকম ব্যাপারে আমি তোমাকে কী সাহায্য করতে পারি?’
‘দড়ি বেয়ে আমি যখন কূপের ভিতর নামব, তখন আর একগাছা দড়িতে পেট্রোলের লন্ঠনটা বেঁধে ঠিক আমার সঙ্গে সঙ্গেই নীচে নামিয়ে দিতে হবে৷ কেমন, এ কাজটা পারবেন তো?’
‘তা কেন পারব না!’
জয়ন্ত দড়ি ধরে কূপের গহ্বরে প্রবেশ করল৷ পেট্রোলের ঝুলন্ত লন্ঠনটাও চারিদিক আলোকে সমুজ্জ্বল করে নীচের দিকে নামতে লাগল তার সঙ্গে সঙ্গে৷ সেই বহুযুগের পুরাতন ও অব্যবহৃত কূপের জঠরে আচম্বিতে এই অভাবিত আলোক সমারোহে বিস্মিত হয়ে নানা ছিদ্র ও ফাটলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল দলে দলে হিলবিলে বৃশ্চিক ও ঊর্ধ্বপুচ্ছ কাঁকড়াবিছে প্রভৃতি জীব৷ এক জায়গায় মুহূর্তের জন্যে মুখ বাড়িয়ে দুটো অগ্নিময় ক্রুদ্ধ চক্ষে তীব্র ঘৃণা বৃষ্টি করে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল একটা অন্ধকারেরও চেয়ে কালো সাপ৷ কোনো গর্তের মধ্যে হঠাৎ জেগে উঠল একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চকর চিৎকার!
সুন্দরবাবু চমকে বলে উঠলেন, ‘ওরে বাবা, পাতালের ভিতরে ওটা আবার চ্যাঁচায় কে?’
সুব্রত বলল, ‘তক্ষক৷’
কূপের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবু, এইবারে লন্ঠনটা আস্তে আস্তে উপরে তুলে নিন৷’
জয়ন্ত আবার উপরে এসে দাঁড়াল৷ তার চোখে-মুখে পরিতৃপ্ত আনন্দের আভাস৷
মানিক সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী দেখলে জয়ন্ত?’
‘আমার সন্দেহ মিথ্যা নয়৷’
‘অর্থাৎ?’
‘অনেক নীচে, কূপের জল থেকে খানিক উপরে দেয়ালের গায়ে আছে একটা লোহার দরজা৷’
‘লোহার দরজা?’
‘হ্যাঁ৷ বন্ধ দরজা৷ তার বাইরে রয়েছে মস্ত দুটো কুলুপ৷’
সুব্রত অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বলল, ‘এর অর্থ কী জয়ন্তবাবু?’
‘আমার বিশ্বাস, ওই দরজার ও-পাশেই আছে সোনার আনারসের সমস্ত রহস্য!’
‘সোনার আনারসের রহস্য?’
‘হ্যাঁ সুব্রতবাবু৷ বাঘরাজাদের গুপ্তধন!’
পরমুহূর্তেই চারিদিকের স্তব্ধতা চুরমার করে দিয়ে বজ্রস্বরে গর্জে উঠল দু-দুটো বন্দুক! দুটো বুলেট এসে লাগল দেয়ালের উপরে সশব্দে৷
জয়ন্ত বলে উঠল, ‘শত্রুরা আসছে আক্রমণ করতে৷ ওই দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চলো . .. শিগগির!’
কূপঘরের ভিতর দিয়েই পাশের ঘরে যাবার দরজা৷ তার একখানা পাল্লা ভাঙা৷ সে-ঘর থেকেও অন্য ঘরে যাবার আর একটা দরজা৷ তার পাল্লা আছে বটে, কিন্তু অর্গল নেই৷ তারও ওদিকে আছে দরজা দিয়ে ও-পাশের ঘরে যাবার পথ-সকলে দ্রুতবেগে সেই তৃতীয় ঘরের ভিতরে এসে পড়ল৷
জয়ন্ত ভিতর থেকে দরজার অর্গল তুলে দিল৷
খানিকক্ষণ কারুর মুখেই কথা নেই৷ শত্রুরা যে পিছনে আসছে, এমন সাড়াও পাওয়া গেল না৷
হঠাৎ এ-ঘরের দরজার উপরে খট করে একটা শব্দ হল৷ জয়ন্ত তিক্তহাসি হেসে বলল, ‘মানিক, আমরা বন্দি হলাম৷ এ-ঘরের দরজার বাইরে থেকে কে শিকল তুলে দিল৷ সোনার আনারসের স্বপ্ন বুঝি ফুরিয়ে যায়!’
ত্রয়োদশ – ঈশ্বর-প্রেরিত দূত
দারোগাবাবু বললেন, ‘বেশ জয়ন্তবাবু! অকারণে এখানে টেনে এনে আপনি খুব বিপদে ফেললেন যা হোক!’
জয়ন্ত বলল, ‘আমি নই, আমাদের এই বিপদের জন্য দায়ী আপনার আসামি প্রতাপ চৌধুরিই৷’
‘কী বলছেন?’
‘প্রতাপ চৌধুরির কথা বলছি৷ আমরা এখন তারই হাতে বন্দি৷ সুব্রতবাবু, আপনাদের পূর্বপুরুষেরা অন্তিমকালে উত্তরাধিকারীদের কী বলে যেতেন?’
‘বলে যেতেন, ‘যদি কোনোদিন বিশেষ অর্থাভাব হয় তাহলে সোনার আনারসের মধ্যেই পাবে অর্থের সন্ধান’৷’
‘সোনার আনারসের মধ্যে একটা ছড়ায় কৌশলে লেখা ছিল ওই অর্থের ঠিকানা, আজ আমরা যা আবিষ্কার করেছি৷ প্রতাপ চৌধুরিও এত দিন ধরে সেই ঠিকানাটাই আবিষ্কার করবার চেষ্টায় ছিল৷ এখানকার যত হাঙ্গামার আসল কারণই হচ্ছে তাই৷ আজ সে তার দলবল নিয়ে গোপনে আমাদের অনুসরণ করেছিল,-উত্তেজনার মুখে পড়ে যে-সম্ভাবনার কথা ভুলে গিয়ে আমি বোকামি করেছি!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, প্রতাপ চৌধুরি ব্যাটা এখন কী করতে চায়?’
‘নিশ্চয়ই সে আড়াল থেকে আমাদের সব কথা শুনেছে-আমাদের সব কার্যকলাপ লক্ষ করেছে৷ তাই গুপ্তধনের ঠিকানা জানার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের আক্রমণ করেছিল৷ এখন আমরা অসহায়ভাবে বন্দি৷ সে স্বাধীন৷ এইবারে সে গুপ্ত ধনভাণ্ডারের লোহার দরজা খোলবার চেষ্টা করবে৷ হায় রে কপাল, আমাদের নৌকো কিনা ঘাটে এসেও ডুবে গেল!’
মানিক বলল, ‘জয়, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে কি ও-দরজাটা ভেঙে ফেলতে পারব না?’
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘না৷ একেলে দরজা হলে আমার কোনোই ভাবনা ছিল না-আমি একলাই পারতাম ভেঙে ফেলতে৷ কিন্তু এই সেকেলে দরজাটা বিশেষ কারণে বিশেষভাবে তৈরি৷ মত্ত মাতঙ্গও ভাঙতে পারবে না এ-দরজা! নীচেকার এই ঘরটাও অদ্ভুত, একটা জানলা পর্যন্ত নেই-দেয়ালের অনেক উপরে আছে কেবল গোটাকয়েক ফোকর, কিন্তু তাদের ভিতর দিয়ে মানুষের মাথাও গলবে না৷ কে জানে, কী উদ্দেশ্যে এ-রকম ঘর তৈরি করা হয়েছিল৷ আগে কি এখানে থাকত কয়েদিরা? হতে পারে, আশ্চর্য কী!’
সকলে গুম হয়ে বসে রইল বেশ খানিকক্ষণ৷ কারুরই যেন নেই কথা কইবার ইচ্ছা৷
আচম্বিতে বাইরেকার নিস্তব্ধ রাত্রিকে বিদীর্ণ করে জাগ্রত হল বহু কন্ঠস্বরে আনন্দ-কোলাহল!
সুন্দরবাবু চমকে উঠে বললেন, ‘ও আবার কী?’
জয়ন্ত শ্রান্ত, বিষণ্ণ স্বরে বলল, ‘ওই আনন্দ কোলাহল শুনেই বুঝতে পারছি, আজ প্রতাপ চৌধুরির হস্তগত হয়েছে বাঘরাজাদের গুপ্তধন!’
সুব্রত একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল৷
তার একখানা হাত নিজের হাতে নিয়ে মানিক দরদভরা কন্ঠে বলল, ‘সুব্রতবাবু, আপনার মনের কথা আমি বুঝতে পারছি৷’
জয়ন্ত হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠে বলল, ‘ধ্যেৎ! দুঃখের নিকুচি করেছে! মানিক, চটপট বার করো ‘ফ্লাস্কে’র চা আর ডিম৷ দু-একখানা হাতে তৈরি রুটি আর দু-একটা কদলীও বোধ হয় এখনও আমরা প্রত্যেকেই পেতে পারি৷ প্রতাপ চৌধুরি যখন কদলী-প্রদর্শন করল, তখন দু-একটা কদলী আমরাই বা ভক্ষণ করব না কেন? আসুন দারোগাবাবু, আসুন সুব্রতবাবু, আসুন সুন্দরবাবু! এত গোলযোগের পর কিঞ্চিৎ জলযোগ নিশ্চয়ই আপনাদের মন্দ লাগবে না?’
সুন্দরবাবু তৎক্ষণাৎ হলেন উৎফুল্ল৷ বললেন কেবল-‘হুম!’
‘মানিকের ব্যাগে কালকের জন্যে হয়তো আরও কিঞ্চিৎ খাদ্যের অস্তিত্ব থাকবে৷ তারপরে আমাদের ভাগ্যে আছে উপবাস-যত দিন না মরি ততদিন পর্যন্ত নিরম্বু উপবাস! মন্দ কী? এই উপবাসকে আমরা যদি বলি প্রায়োপবেশন, তাহলে তো আমাদের মৃত্যু হবে গৌরবজনক! গ্রিক-বিজয়ী মহাবীর, অখণ্ড ভারতের প্রথম সম্রাট চন্দ্রগুপ্তও তো যেচেই প্রায়োপবেশনে করেছিলেন প্রাণত্যাগ! আমরাই বা পারব না কেন?’
সুন্দরবাবু অভিযোগভরা কন্ঠে বললেন, ‘ওই তো তোমাদের দোষ! খাবার আগেই উপবাস আর মৃত্যুর কথা তুলে মেজাজ খারাপ করে দাও কেন ভায়া! হুম, আমার গলা দিয়ে আর রুটিও গলবে না!’
ঠিক সেই সময়ে বন্ধ দরজা ভেদ করে হঠাৎ জেগে উঠল একটা অস্বাভাবিক অট্টহাস্য!
হাহাহাহা, হাহাহাহা, হাহাহাহা, হাহাহাহা, হাহাহাহা,-সে অট্টহাসি যেন আর থামতেই চায় না!
সকলের দেহ হয়ে উঠল রোমাঞ্চিত! এমন অট্টহাসি কল্পনাতীত!
সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ‘ব্রহ্মপিশাচ, ব্রহ্মপিশাচ-এইবারে আসছে ব্রহ্মপিশাচ!’
দারোগাবাবু অজ্ঞান হয়ে ঘুরে পড়ে গেলেন ঘরের মেঝের উপরে! সুব্রতর মুখ দেখে মনে হয় সেও যেন অজ্ঞান হবার চেষ্টা করছে!
মানিক রিভলভার বার করে দাঁড়িয়ে বিভ্রান্তের মতন বলল, ‘ভূতই আসুক, আর মানুষই আসুক, আমি গুলির পর গুলি ছুড়ে তাকে ছিদ্রময় না করে ছাড়ব না!’
জয়ন্ত নিশ্চল এবং নিস্তব্ধ৷ এমন যুক্তিহীন অট্টহাস্যের অর্থই খুঁজে পেল না৷
তারপরেই হঠাৎ অট্টহাসি থামিয়ে কে বলে উঠল, ‘হায় রে হায়, হায় রে পোড়াকপাল আমার! বাঘরাজাদের রাজ্য গেছে কিন্তু ছিল তাদের গুপ্তধন! তাও নিয়ে গেল দুশমনরা! আমার সুখের স্বপন ভেঙে গেল-এ দুঃখ রাখব কোথায়, রাখব কোথায়? হাহাহাহা, হাহাহাহা, হাহাহাহা!’
জয়ন্তর ছুটে গেল সমস্ত জড়তা! বন্ধ দরজার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে করাঘাতের পর করাঘাত করতে করতে সে বলল, ‘ভূষোপাগলা, ভূষোপাগলা, ভূষোপাগলা!’
দরজার ও-পাশ থেকে শোনা গেল, ‘আমাকে চিনেছ? চিনবেই তো, চিনবেই তো! তোমরা যে আমার বন্ধু! আমি যে এখানে এসেছি তোমাদের মুক্তি দিতেই!’
‘দাও, দাও, আমাদের মুক্তি দাও-তুমি হচ্ছ ঈশ্বর-প্রেরিত দূত!’
শিকল খোলার শব্দ৷ তারপরেই দরজা ঠেলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল ভূষোপাগলা৷ জয়ন্ত সাদরে ভূষোকে আলিঙ্গন করে বলল, ‘তুমি কী করে এখানে এলে?’
‘কী করে এলাম? কী করে এলাম? সে অনেক কথা! এখন খালি একটুখানি শুনে রাখো৷ তোমরাও যে এদিকে এসেছ আমি তা জানতাম না৷ বেড়াতে বেড়াতে দেখলাম, প্রতাপ চৌধুরি দলে বেশ ভারী হয়ে বনের দিকে যাচ্ছে৷ মনে কৌতূহল জাগল৷ লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের পিছু নিলাম৷ সোজা হাজির হলাম এইখানে৷ সন্ধ্যার অন্ধকারে উঠোনের লম্বা আগাছার ভিতরে হুমড়ি খেয়ে বসে এখানকার সব অভিনয় দেখলাম৷ তোমরা বন্দি হবার পরও কত কাণ্ডই যে হল! শেষটা দেখলাম, প্রতাপ চৌধুরির দল আটটা বড়ো ঘড়া আর একটা মাঝারি আকারের সিন্দুক কাঁধে করে এখান থেকে সরে পড়ল! হায় রে হায়, কেমন করে এমন ব্যাপার সম্ভব হল, এখনও আমার মাথায় ঢুকছে না গো! আয়নাতে মুখ দেখে বৃদ্ধ বট এখনও গান গাইছে, কিন্তু একটাও জলগ টিকটিকি দেখা দিল না বলেই তো আমার সব হিসাব একেবারে গুলিয়ে গেল! সোনার স্বপন ভেঙে গেছে, আমি কী নিয়ে বেঁচে থাকব?’
জয়ন্ত তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, ‘কোনো ভয় নেই ভাই, মুক্তি যখন পেয়েছি, তোমার স্বপ্নকে সফল না করে আমরা ছাড়ব না! কিন্তু কী বললে? প্রতাপ চৌধুরির দল কী কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছে?’
‘আটটা ঘড়া আর একটা সিন্দুক!’
‘গুপ্তধন!’
‘হায় হায় হায় হায়-হুম!’
‘এখানে বসে হায় হায় করে কোনোই লাভ নেই সুন্দরবাবু, জাগ্রত হোন-উঠে দাঁড়ান-ছুটে চলুন!’
‘ও বাবা, কোথায়?’
‘প্রতাপ চৌধুরিদের পিছনে৷’
‘বলো কী হে? এমন রাতে, এমন অন্ধকারে, ওই সর্বনেশে বনে?’
‘নিশ্চয়! চলুন, এখন প্রত্যেক মুহূর্তই মূল্যবান!’
‘তারা তো অনেকক্ষণ আগে রওনা হয়ে গিয়েছে, আমরা তাদের পিছু ধরতে পারব কেন?’
‘বাজে কথায় সময় নষ্ট করবেন না৷ প্রতাপ চৌধুরিরা জানে আমরা বন্দি, তারা নিষ্কণ্টক৷ এত পরিশ্রমের পর আজ রাত্রে নিশ্চয়ই তারা কোদালপুর ত্যাগ করবার চেষ্টা করবে না৷ এমন সুযোগ ছাড়া উচিত নয়৷’
‘কিন্তু চা-রুটি-ডিমগুলো খেয়ে একটু চাঙ্গা হতেও কি পারব না?’
দারোগাবাবু বললেন, ‘জয়ন্তবাবুর কথা শুনেই আমি চাঙ্গা হয়ে উঠেছি-চুলোয় যাক চা-রুটি-ডিম! আসামিকে ধরতে হবে আজই৷’
চতুর্দশ – সোনার আনারসের ছড়া
অন্ধকার অরণ্য! আকাশে চাঁদ আছে বটে, কিন্তু দিনের সূর্য যেখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না, সেখানে রাতের চাঁদের কথা না তোলাই ভালো৷ ভয়াবহ বন হয়ে উঠেছে অধিকতর বিভীষণ!
জয়ন্ত বলল, ‘ভাগ্যে সকালে বেরোবার আগে মানিকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম! সঙ্গে পেট্রোলের লন্ঠন আর টর্চ না থাকলে এখানে আমাদের কী দুর্দশাই হত!’
সুন্দরবাবু বলল, ‘সঙ্গে আলো না থাকলে আমি এখানে আসতাম নাকি?’
জয়ন্ত বলল, ‘আচ্ছা পথ চলতে চলতে আমি এইবারে কতগুলো কথা বলব, আপনারা মন দিয়ে শুনুন৷ কথাগুলো আর কিছু নয়, সোনার আনারসের গুপ্তকথা৷
‘সোনার আনারসের ছড়ার কথা মনে করুন৷ সহজভাবে দেখলে ছড়াটাকে অর্থহীন বলে মনে হয়৷ কিন্তু একটা অর্থহীন ছড়াকে বংশানুক্রমে এত যত্নে রক্ষা করা যায় না, আর কেবল সেই ছড়াকেই চুরি করবার জন্যে বাড়িতে চোর আসে না৷ বিশেষ, সুব্রতবাবুর পূর্বপুরুষরা স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন-অর্থাভাবের সময়ে ওই ছড়ার মধ্যেই পাওয়া যাবে অর্থের সন্ধান! এই সব কারণে প্রথমেই করলাম ছড়াটার মানে বোঝবার চেষ্টা৷
‘আয়নাতে ওই মুখটি দেখে
গান ধরেছে বৃদ্ধ বট,
মাথায় কাঁদে বকের পোলা
খুঁজছে মাটি মোটকা জট!
‘আমি যা মানে করলাম তা হচ্ছে : আয়না-অর্থাৎ পুষ্করিণীর ধারে দাঁড়িয়ে এক প্রাচীন বটবৃক্ষ জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে পত্র-মর্মরধ্বনি করছে৷ তার মাথায় আছে বকের বাসা৷ আর তার ডাল থেকে মোটাসোটা জটগুলো নেমে এসেছে মাটি পর্যন্ত৷ সুব্রতবাবুর বাগানে ঠিক এই রকম একটি বটগাছের সন্ধান পেয়ে আমার সকল সন্দেহ ভঞ্জন হল৷
‘ছড়াটার মানে কেবল আমিই বুঝিনি৷ ভূষোপাগলা আর প্রতাপ চৌধুরিও বুঝেছিল৷ কিন্তু বিশেষ এক জায়গায় তারা অর্থের খেই হারিয়ে ফেলে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে বাধ্য হয়েছিল৷ প্রথমে আমিও সেই পর্যন্ত এগিয়ে সমস্ত গুলিয়ে ফেলেছিলাম, তারপর মাথা খাটিয়ে হঠাৎ পাই আলোকের সন্ধান৷ সে-জায়গাটা হচ্ছে এই-
পশ্চিমাতে পঞ্চ পোয়া
সূয্যিমামার ঝিকমিকি,
নায়ের পরে যায় কত না,
খেলছে জলগ টিকটিকি৷’
‘মানে হচ্ছে, বটগাছের পশ্চিমদিকে সোজা পাঁচ পোয়া পথ অগ্রসর হতে হবে৷ সেখানে চারিদিকে ঝিকমিক করছে সূর্যালোক৷ নদীর উপরে ভেসে যাচ্ছে নৌকোর (‘না’ বলে নৌকোকেই) পর নৌকো, আর জলে খেলা করছে কারা? না ‘জলগ টিকটিকি’রা৷ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এখানে জলবাসী টিকটিকি হচ্ছে কুমির-কারণ তাকে দেখতে অনেকটা গৃহবাসী টিকটিকির বৃহৎ সংস্করণের মতো!
‘অর্থ হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গোল বাধল৷ কারণ, বট গাছ পিছনে রেখে পশ্চিমদিকে সোজা পাঁচ পোয়া পথ এগিয়ে কোনো নদী দেখা যায় না৷ এই জন্যেই এই পর্যন্ত এসে ভূষোপাগলা রোজ হতভম্ব হয়ে ঘুরে মরত; আমাকেও প্রথমটা বোকা বনে যেতে হয়েছিল৷
‘কিন্তু আমি এত সহজে হার মানতে রাজি নই৷ মাথা খাটিয়ে সুব্রতবাবুকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, সত্যই এ-অঞ্চলে আগে একটা নদী ছিল কিন্তু এখন তা শুকিয়ে গিয়েছে, কেবল কোদালপুরের উত্তর-পশ্চিমদিকে তিন মাইলের কিছু বেশি দূরে গেলে আজও তার মরা খাত দেখা যায়৷ তারপর যথাস্থানে গিয়ে কী করে আন্দাজ করলাম যে, নদীটার গতি ছিল সেখান থেকে দক্ষিণ মুখে, আপনারা সকলেই তা জানেন৷ তখন নিশ্চিন্ত হয়ে আবার সেইখানে ফিরে এলাম,- বট গাছ থেকে পশ্চিম মুখে সোজা পাঁচ পোয়া পথ পেরোলে যেখানে এসে উপস্থিত হওয়া যায়৷
‘অগ্নিকোণে নেইকো আগুন,
-কাঙাল যদি মানিক মাগে,
গহন বনে কাটিয়ে দেবে
-রাত্রি-দিবার অষ্ট ভাগে৷
‘অর্থ-(পশ্চিমে পাঁচ পোয়া পথ পার হয়ে নদীর ধারে গিয়ে দেখবে) অগ্নিকোণে-অর্থাৎ পূর্ব-দক্ষিণদিকে এক অরণ্য৷ কাঙাল যদি ঐশ্চর্য চায় তাহলে ওই গভীর বনের ভিতর দিয়ে অগ্নিকোণের দিকে লক্ষ রেখে এক প্রহর বা তিন ঘণ্টা (দিন-রাতকে আট অংশে ভাগ করলে এক প্রহর হয়) ধরে অগ্রসর হবে৷
‘বাঘরাজাদের রাজ্য গেছে,
কেবল আছে একটি স্মৃতি,
ব্রহ্মপিশাচ পানাই বাজায়,
বাস্তুঘুঘু কাঁদছে নিতি৷
‘ছড়ার এইখানটায় কিঞ্চিৎ কবিত্ব প্রকাশ করে ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা হয়েছে, এক প্রহর ধরে এগোবার পর পাওয়া যাবে বাঘরাজাদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ৷
‘সেইখানেতে জলচারী
আলো-আঁধির যাওয়া-আসা,
সর্পনৃপের দর্প ভেঙে
বিষ্ণুপ্রিয়া বাঁধেন বাসা৷
‘অর্থ-বাঘরাজাদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এমন একটি ঠাঁই আছে, যেখানে জলের উপর দিয়ে আসা-যাওয়া করে আলো আর আঁধার৷ ‘সর্পনৃপ’ কে? বাসুকি-রাজ্য যাঁর পাতালে৷ বিষ্ণুপ্রিয়া কে? ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী৷ অর্থাৎ বাসুকির রাজ্য জলময় পাতালে লক্ষ্মী বাস করছেন ঐশ্বর্য নিয়ে৷
‘এতক্ষণে আপনারা বুঝেছেন বোধ হয়, ঘরের ভিতর কূপ দেখে আমার সন্দেহ জাগ্রত হয়েছিল কেন? প্রথমত, ঘরের ভিতরে কূপ, বেশ একটু অসাধারণ নয় কি? দ্বিতীয়ত, কূপের তলদেশটাই সর্পরাজ বাসুকির জলময় পাতালের এক অংশ বলে ধরে নেওয়া যায়৷ তৃতীয়ত, মাঝে মাঝে এও শুনেছি যে, কোনো কোনো সেকেলে কূপ আর পুষ্করিণীর ভিতর থেকে পাওয়া গিয়েছে গুপ্তধন৷
‘গুপ্তধনের গুপ্তকথা শুনলেন, এইবার অন্য দু-চারটে কথা শুনুন৷ আমার কী বিশ্বাস জানেন? প্রতাপ চৌধুরির বাড়িতে এখনও পুলিশ পাহারা আছে, সুতরাং সে বাড়ির ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করবে না৷ অন্তত আজকের রাত্রের জন্য তাকে আশ্রয় নিতে হবে সেই সুড়ঙ্গপথের মধ্যেই৷ তারপর কাল সে হয়তো লোকজন আর গুপ্তধন নিয়ে কোদালপুর থেকে হবে অদৃশ্য৷
‘অতএব ভোরের আলো ফোটবার আগেই আমাদের অবতীর্ণ হতে হবে সুড়ঙ্গপথের মধ্যে৷ শত্রুরা দলে হালকা নয়৷ কাজেই আমাদেরও দলে ভারী হতে হবে৷ সঙ্গে যখন দারোগাবাবু আছেন তখন সেজন্যে ভাবনা নেই! সুড়ঙ্গে হানা দেবার আগে থানা থেকে একদল চৌকিদার সংগ্রহ করলে চলবে৷ কিন্তু খুব সম্ভব আমরা সহজেই আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারব৷ প্রতাপের এখন শত্রুভয় নেই৷ সে আর তার দলের লোকরা পথশ্রমে নিশ্চয়ই শ্রান্ত হয়ে পড়েছে৷ হয়তো আমরা গিয়ে দেখব তারা সকলেই করছে নিদ্রাদেবীর আরাধনা৷
‘এই প্রতাপ চৌধুরিকে চোখে দেখবার জন্যে আমার আগ্রহ হচ্ছে৷ সে-ই আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী৷ নাটকের সর্বত্রই সে অভিনয় করছে, বারবার আমাদের নাস্তানাবুদ করে মারছে, অথচ একবারও চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করল না৷ অপরাধীদের জগতে তাকে একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি বলে স্বীকার করতে হয়৷ তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা হচ্ছে৷’
পঞ্চদশ – অন্ধকারের পর আলো
গল্প একরকম ফুরিয়েই গিয়েছে৷ আর বেশি কিছু বলবার নেই৷
জয়ন্তর অনুমানই সত্য হল৷ শেষ-দৃশ্যে বইল না রক্তগঙ্গার ঢেউ! নেই চমকানি, নেইকো রোমাঞ্চ৷
সুড়ঙ্গে চুপিচুপি নেমে জয়ন্তরা দেখল, প্রতাপ চৌধুরি সদলবলে নিদ্রিত৷ প্রত্যেকেই দেখছিল বোধ করি সফল আশার সুখস্বপ্ন৷
কারুর ঘুম ভাঙবার আগেই চৌকিদাররা তাদের উপরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘের মতো৷ ঘুমের জড়তা ছোটবার আগেই প্রত্যেকের হাতে পড়ল দড়ি বা হাতকড়ি৷ যেটুকু ধস্তাধস্তি হল তা মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়৷
রিভলভারটা আবার খাপে পুরে রেখে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘সুব্রতবাবু, কোন মহাত্মার নাম প্রতাপ চৌধুরি?’
সুব্রত অঙ্গুলিনির্দেশে দেখিয়ে দিল৷
সুড়ঙ্গের মধ্যে যে তিনদিক-ঘেরা ও একদিক-খোলা কুঠুরির মতো জায়গা ছিল, সেইখানে একটা খুব সেকেলে পেটিকার উপরে একটি লোক ঘাড় হেঁট করে বসে ছিল৷ হৃষ্টপুষ্ট ভদ্র চেহারা, ধবধবে ফরসা রং, অতি শৌখিন জামাকাপড়৷ দেহে কোথাও এতটুকু শয়তানির ছাপ নেই৷ সে যে-কোনো সম্ভ্রান্ত সমাজে গিয়ে অনায়াসে মেলামেশা করতে পারে৷ অন্যান্য দুশমন চেহারার পাশে তাকে দেখাচ্ছিল কেমন খাপছাড়া৷ যেন বাংলা সাপ্তাহিকের পদ্যগুলোর মাঝখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা!
জয়ন্ত একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল৷
প্রতাপ মুখ তুলল-মিষ্ট হাসিমাখা মুখ৷ বলল, ‘কী দেখছ?’
‘তুমি প্রতাপ চৌধুরি?’
‘আর অস্বীকার করবার উপায় নেই!’
‘সিংহের মতো বিক্রম প্রকাশ করে তুমি কলে পড়লে ইঁদুরের মতো?’
‘কপাল৷’
‘কপাল নয়, নিজের বোকামি৷’
‘কীরকম?’
‘এই সুড়ঙ্গে না এলে তুমি ধরা পড়তে না৷’
‘কেমন করে জানব তোমরা সুড়ঙ্গের খবর রাখো!’
‘গল্পের এক-চক্ষু হরিণও এইরকম বোকামি করেছিল৷’
‘তার উপরে তোমরা ছিলে দূর-বনে বন্দি৷’
‘এক ঈশ্বর-প্রেরিত দূত এসে আমাদের মুক্তি দিয়েছে৷’
‘কে?’
‘ভূষোপাগলা৷’
প্রতাপ মুখ ফিরিয়ে ভূষোর দিকে তাকাল৷ তার হাসিমুখ হল গম্ভীর৷ তার দুই চক্ষে ঠিকরে নিবে গেল দুটো বিদ্যুৎ-কণিকা৷
ভূষো পিছিয়ে গেল তাড়াতাড়ি৷
জয়ন্ত বলল, ‘ভয় কী ভূষো, ভয় কী? পিঞ্জরের সিংহ হয় পরম বৈষ্ণব৷’
প্রতাপ হাসতে লাগল৷ বলল, ‘ঠিক৷ যখন পিঞ্জরের বাইরে ছিলাম তখন আমার উচিত ছিল, ও আপদটাকে পথ থেকে একেবারে সরিয়ে দেওয়া৷ তা দিইনি বলে এখন আমার অনুতাপ হচ্ছে৷’
‘যা গত, তা নিয়ে বুদ্ধিমান শোচনা করে না৷’
‘তাও ঠিক৷ ধন্যবাদ৷ তুমি দেখছি দার্শনিক৷’
‘আপাতত তোমার সঙ্গে আর বেশি আলাপ করবার সময় নেই, এইবার তোমাকে যথাস্থানে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে৷’
‘আমি প্রস্তুত৷ কিন্তু তার আগে দুটো কথা বলে যাই৷ ওই যে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড আটটা ঘড়া দেখছ, ওর প্রত্যেকটার মধ্যেই আছে দুই হাজার করে বাদশাহি মোহর৷ ঘড়াগুলোও পরীক্ষা করেছি৷ প্রত্যেকটাই সোনার ঘড়া৷ আর এই যে পেটিকার উপরে আমি বসে আছি, এর ভিতরে আছে রাশি রাশি জড়োয়া গয়না আর নানারকম রত্ন-তাদের দাম ঠিক করবার সময় এখনও পাইনি৷ তোমরা জানো তো, এই গুপ্তধনের উপরে এখন তোমাদের কোনোই দাবি নেই৷ কারণ, অলিখিত আইনবলে, বেওয়ারিশ গুপ্তধনের অধিকারী হয় আবিষ্কারকর্তাই৷ এই গুপ্তধন আবিষ্কার করেছি আমিই৷ অতএব আমিই এর অধিকারী৷ কেমন, এ-কথা মানো তো?’
‘তারপর?’
‘আপাতত এই গুপ্তধন তোমার জিম্মায় রেখে গেলাম৷ যথাসময়ে তোমাকে এর সঠিক হিসাব দাখিল করতে হবে৷ বুঝলে জয়ন্ত?’
‘হিসাব নেবে কে?’
‘আমি৷’
‘তুমি না তোমার প্রেতাত্মা?’
‘মানে?’
‘তুমি নরহত্যা করেছ৷ তোমার তো শেষ অবলম্বন ফাঁসিকাঠ সম্বল৷’
‘আমিই যে নরহত্যা করেছি, আদালতে সেটা প্রমাণ করতে পারবে তো?’
‘ফাঁসিকাঠকে ফাঁকি দিলেও তোমাকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে বা কারাগারে বাস করতে হবে৷’
‘মূর্খ! কোনো কারাগার বা ফাঁসিকাঠ আমার জন্যে তৈরি হয়নি আজও৷’
‘বেশ, দেখা যাবে৷’
‘হ্যাঁ, সেই কথাই ভালো৷ দেখা যাবে৷’
জয়ন্ত ফিরে বলল, ‘দারোগাবাবু, কয়েদিদের যথাস্থানে প্রেরণ করুন৷’
প্রতাপ চৌধুরি সদলবলে যাত্রা করল চৌকিদার প্রভৃতির সঙ্গে থানার পথে৷
সুন্দরবাবু সাগ্রহে বললেন, ‘এইবার দেখা যাক ঘড়াগুলো আর ওই পেটিকার মধ্যে কী আছে!’
জয়ন্ত বলল, ‘গুপ্তধন সুব্রতবাবুর হাতে তুলে দিয়েই আমার কর্তব্য শেষ করলাম৷ আমার আর মানিকের আর কিছুই দেখবার দরকার নেই৷’
‘হুম, সে কী হে?’
জয়ন্ত সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফিরে বলল, ‘সুব্রতবাবু, এই রইল আপনার গুপ্তধন৷ কিন্তু বিদায় নেবার আগে আপনার কাছে আমার অনুরোধ আছে!’
‘আজ্ঞে, অনুরোধ নয়,-হুকুম!’
‘বেশ, তাই৷ শুনুন৷ ভূষোপাগলা গুপ্তধনের বিফল স্বপ্ন দেখে নিজের জীবনকে প্রায় ব্যর্থ করে দিয়েছিল৷ আজ সে না থাকলে আপনি প্রাণেও বাঁচতেন না, আর গুপ্তধন থেকেও হতেন বঞ্চিত৷ অতএব এই বিপুল ঐশ্বর্যের ষোলো ভাগের মাত্র এক ভাগ তাকে দান করতে কি আপনার আপত্তি আছে?’
‘নিশ্চয়ই নয়, নিশ্চয়ই নয়৷ আজ থেকে ভূষো হবে আমার পরম আত্মীয়ের মতো৷’
‘উত্তম৷ তারপর, ষোলো ভাগের আর এক ভাগ থেকে আপনি যদি সুন্দরবাবু আর দারোগাবাবুকে আধা-আধি বখরা দেন, তাহলে আমি অত্যন্ত বাধিত হব৷’
ঊ’অবশ্যই দেব৷ আপনাদেরও তো এই গুপ্তধনের উপর দাবি আছে৷’
জয়ন্ত হো-হো করে হেসে উঠল৷ বলল, ‘গুপ্ত বা ব্যক্ত কোনো ধনের লোভেই আমরা কোনো কাজ করি না৷ গোয়েন্দাগিরি হচ্ছে শখ৷ ভগবান আমাকে আর মানিককে যা দিয়েছেন, তা আমাদের পক্ষে যথেষ্টরও বেশি৷ তাতেই আমরা খুশি৷ এসো হে মানিক! সুড়ঙ্গের ভিতর আর কীটের মতন বাস করি কেন, বাইরে এতক্ষণে পাখিরা গাইছে প্রভাতী গান-নতুন সূর্য সোনায় মুড়ে দিচ্ছেন পৃথিবীকে৷ চলো, অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আমরাও যোগ দিই শুভ্র আলোকের পবিত্র অভিনন্দনে৷’