সোনামুখির হাতি ও রাজকুমার

সোনামুখির হাতি ও রাজকুমার

সোনামুখিতে খুব সকাল সকাল বাজার বসে৷ ভোর হতে না হতে কেনাবেচা শুরু হয়ে যায়৷ এ তো আর কলকাতা শহর নয়৷ এখানে বেশিরভাগ মানুষই ঘুমিয়ে পড়ে রাত্তির আটটা-নটার সময়, আর ঘুম ভাঙে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে৷

তপু রোজ তার বাবার সঙ্গে বাজারে যায়৷

বাবা বলেন, আমি আমার বাবার সঙ্গে থেকে থেকে বাজার করা শিখেছি৷ তুইও সেরকম শিখবি৷ লেখাপড়া শেখার মতন বাজার করাও শিখতে হয়৷ কোন জিনিসটা খারাপ আর কোন জিনিসটা ভালো, তা চেনা মোটেই সহজ নয়৷ কত লোক বোকার মতন পচা মাছ কিনে নিয়ে যায়৷

তপুদের বাড়ি থেকে বাজার বেশ খানিকটা দূর৷ কিন্তু বাবা সাইকেল রিকশায় যেতে চান না৷ ভোরবেলা খানিকটা হাঁটা তো ভালোই৷

বাবা রোজ ডেকে তোলেন তপুকে৷ চোখ-মুখ ধুয়ে চটপট তৈরি হয়ে নিতে হয়, দুটো প্লাস্টিকের ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজনে৷ একটা মাছের জন্য, আর একটা তরকারির৷

তপুদের বাড়িতে কাকা-জ্যাঠাদের মিলিয়ে অনেক লোক৷ বাবা ইচ্ছে করে বাজার করার ভার নিজে নিয়েছেন৷ তপু তাঁর একমাত্র ছেলে, তপু সবে মাত্র আট বছরে পা দিয়েছে৷ সে ইংরেজিতে টাইগার আর লায়ন বানান করতে পারে৷ কিন্তু এলিফ্যান্ট বানান ভুল হয়ে যায়৷

বাবার সঙ্গে ভোরবেলা বেরিয়ে পড়তে তপুর বেশ ভালোই লাগে৷ এই সময়টায় রাস্তায় নানারকম সুন্দর গন্ধ থাকে, একটু বেলা হলে সে গন্ধ পাওয়া যায় না৷ ভোরবেলাই তো বেশিরভাগ ফুল ফোটে৷

অনেক পাখিও ডাকে এইসময়৷ সব পাখিই প্রথম সূর্যের আলো দেখে খানিকটা গলা সেধে নেয়৷ দুপুরের দিকে সেই সব পাখিদের আর দেখতেই পাওয়া যায় না৷ শুধু কাক আর শালিক ছাড়া৷

হাঁটতে হাঁটতে বাবা তপুকে অনেক গাছ আর পাখি চিনিয়ে দেন৷ এদিকে অনেক কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে, আর কয়েকটা রাধাচূড়া৷ কৃষ্ণচূড়ার ফুল লালচে আর রাধাচূড়ার হলুদ৷ তপু লক্ষ করেছে, গোলাপি, নীল, বেগুনি, সবুজ সব রঙেরই ফুল হয়, কিন্তু কালো রঙের ফুল দেখতে পাওয়া যায় না৷

বাবাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা, কালো রঙের ফুল হয় না কেন?

বাবা বলেছিলেন, সব ফুলই দেখতে সুন্দর হয়৷ কালো রঙের ফুল কি ভালো দেখাবে? কালো রঙের ফুল হলে ভ্রমর, প্রজাপতি, পাখিরা সে ফুলের কাছে আসবে না৷

পাখিদের মধ্যে কুচকুচে কালো হচ্ছে কাক৷ তাদের কেউ পছন্দ করে না৷ অবশ্য কোকিল আর দোয়েল পাখিও কালো, কিন্তু তাদের ডাক এত মিষ্টি যে সবাই পছন্দ করে৷

বাজারের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তপু এখন অনেক কিছু শিখে গেছে৷

বুড়ো পটল ভালো না, কচি পটল ভালো৷ যে বেগুন টিপলে মনে হয় শক্ত, তার মধ্যে অনেক বিচি থাকে, সে বেগুন কিনতে নেই৷ নরম বেগুনই খুব সুস্বাদু৷ কই মাছ, মাগুর মাছ কক্ষনো মরা কিনতে নেই৷ ইলিশ মাছের পেটটা চ্যাপ্টা কি না দেখে নিতে হয়৷ লম্বা ধরনের ইলিশ ভালো হয় না৷

বাজারের অনেক লোক বাবাকে চেনে৷ এখন তপুকেও চিনে গেছে৷

দোকানদাররা বাবাকে পছন্দ করে, কারণ তিনি কক্ষনো কোনো জিনিসের দরদাম করেন না৷ চেনা দোকানের সামনে গিয়ে বলেন, দাও, ভালো জিনিস তুমি বেছে দাও৷

একদিন একজন দোকানদার দশটা আমের মধ্যে দুটো পচা আম গছিয়ে দিচ্ছিল৷ আমগুলো ঝুড়িতে নেবার পর বাবা হেসে বললেন, শোনো, আমায় হাত দিয়ে দেখতে হয় না, শুধু দেখেই আমি বুঝতে পারি, কোনটা ভালো আর কোনটা পচা৷ আজ দুটো খারাপ আম দিয়েছ তো! দাও! কাল থেকে তোমার দোকানে আর আসব না৷

লোকটি সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা পেয়ে বলেছিল, আমায় মাপ করবেন বাবু! আমার অন্যায় হয়ে গেছে৷

ঝুড়ি থেকে পচা আম দুটো বার করে সে তার বদলে চারটে ভালো আম দিতে চাইল৷

বাবা বললেন, না৷ আমি ভালো জিনিস চেয়েছি৷ তা বলে বেশি নেব কেন? তুমিও ঠকবে না, আমিও ঠকব না, এইটাই তো ভালো৷

লোকটি তখন বলল, এই খোকাকে আমি দুটো আম দিতে চাই, তা আপনি কিছুতেই বারণ করতে পারবেন না৷

বাবা বললেন, কেন, ওকেই বা এমনি এমনি দেবে কেন? আমি তো আম কিনেছি৷

লোকটি বলল, বাবু, আমরা কি শুধু কেনাবেচা করি? ভালোবেসে কারুকে কিছু দিতে পারি না? এই খোকাটি ভারী সুন্দর৷

লোকটি দুটি আম জোর করে তুলে দিল তপুর হাতে৷

তপু তাকাল বাবার দিকে৷

বাবা বললেন, ঠিক আছে নাও৷ কেউ ভালোবেসে দিলে না বলতে নেই৷

দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কটি ছেলে-মেয়ে?

সে বলল, তিনটি৷

পরদিন বাবা আগেই তিনখানা চকোলেট কিনে নিয়ে সেই আমওয়ালাকে বললেন, এগুলো তোমার ছেলে-মেয়েদের দিও৷

বাজারের মধ্যে কোনো দোকানে একটা কিছু ঘটে গেলেই সবাই তা জেনে যায়৷

সেই থেকে কোনো দোকানদার বাবাকে খারাপ জিনিস দেয় না৷ বেশি দাম নেয় না৷ অনেকেই কিছু কিছু জিনিস তপুকে ফাউ দেয়৷ যেমন সবেদা, পেয়ারা, আতা৷ একদিন একটা মাছওয়ালা একটা ছোট ইলিশ মাছ দিয়ে বলল, এটা খোকাবাবুর জন্য৷ এর কোনো দাম লাগবে না৷

বাবা সেটা কিছুতেই নিতে চাইলেন না৷ ইলিশ মাছ বেশি দামি৷ ছোট মাছটারও দাম কম নয়৷

মাছওয়ালা বলল, আমার খুব ইচ্ছে করছে খোকা মহারাজকে দিতে৷ আমার নিজের কোনো ছেলে-মেয়ে নেই স্যার৷ ওকে দেখলেই আমার ভালো লাগে৷

সোনামুখির বাজারে কখনো তেমন ঝগড়া-মারামারি হয় না৷ বেশ শান্ত জায়গা৷ হঠাৎ একদিন একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটল৷

তপুকে নিয়ে বাবা ঘুরে ঘুরে বাজার করছেন, কেনাকাটি প্রায় শেষ, এমন সময় বাজারের গেটের কাছে একটা হৈ হৈ শব্দ শোনা গেল৷

এমনি হৈ হৈ নয়, ভয়ের চ্যাঁচামেচি৷

তারপর অনেক লোক হুড়মুড় করে ছোটাছুটি করতে লাগল এদিক-সেদিক৷

কয়েকজন লোক চিৎকার করে উঠল, হাতি! হাতি! পালাও, পালাও!

বাবা তপুর হাত ধরতে গেলেন, তার আগেই ছুটন্ত লোকের ধাক্কায় ছিটকে গেলেন একদিকে৷ তপু অন্যদিকে৷

এবার দেখা গেল, সত্যিই একটা প্রকাণ্ড হাতি মাথা দোলাতে দোলাতে এগিয়ে আসছে খুব দ্রুত গতিতে৷ আর শুঁড় দিয়ে দু-দিকের দোকানের জিনিসপত্র ভাঙছে৷

এই বাজারে অনেক মাটির জিনিস বিক্রি হয়৷ মাটির হাঁড়ি, গেলাস, আর নানারকম পুতুল৷ বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া যেমন বিখ্যাত, তেমনি সোনামুখির মাটির হাতিও কম বিখ্যাত নয়৷ লোকেরা মন্দিরে পুজো করতে গিয়ে এই মাটির হাতি সাজিয়ে রাখে৷

এই হাতিটা যেন বেছে বেছে হাতি-পুতুলই বেশি ভাঙছে পা দিয়ে৷ অত টুকু টুকু হাতি বানানো হয়েছে বলে কি সে রেগে গেছে?

বিহারের দলমা পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে হাতির পাল নেমে আসে বাঁকুড়া জেলায়৷ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামের ঘর-বাড়ি ভাঙে, খেতের ফসল খেয়ে নেয়, নষ্ট করে৷

ক’দিন ধরে এই রকম হাতির পালের কথা শোনা যাচ্ছিল বটে৷

কিন্তু একেবারে শহরের মধ্যে কোনো হাতির ঢুকে পড়া, এই প্রথম৷

বাজারের মধ্যে কিছু মহিলা এবং শিশুও আছে৷ সকলের ভয়-পাওয়া চিৎকারে যেন আরও খেপে যাচ্ছে হাতিটা৷ হঠাৎ হঠাৎ থমকে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে৷

একজন বুড়িকে শুঁড় দিয়ে শূন্যে তুলে একটা আছাড় মারল৷

বুড়িটির ভাগ্য ভালো, সে একটা দোকানের ত্রিপলের ওপর গিয়ে পড়ল, তাই হাড়-গোড় ভাঙল না৷

হাতিটার মুখের দু-পাশে লম্বা দাঁত৷ তার সঙ্গে আর কোনো হাতি নেই৷ একলা-হাতি অতি বিপজ্জনক৷

বাজারের মেঝেতে বসা দোকানদাররা সবাই পালাবার চেষ্টা করছে৷ যে-কটা পাকা দোকানঘর আছে, তার মধ্যে কিছু লোক ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, ভেতরে আর জায়গা নেই৷ কিছু লোক তবু দুমদাম করে ধাক্কা মারছে দরজায়৷

দোকানগুলোর বারান্দাতেও প্রচুর লোক৷ তারাও ঠেলাঠেলি করছে আর চ্যাঁচাচ্ছে৷ তপু চলে এসেছে একদিকে, বাবা অন্যদিকে৷

তপু ডাকল, বাবা—!

বাবা চিৎকার করে বললেন, তপু, তপু, ওদিকেই থাক৷ রাস্তায় নামিস না!

হাতিটা ইচ্ছে করলে বাঁধাকপি, কুমড়ো, শাকসবজি খেতে পারে৷ কিন্তু খাওয়ার দিকে তার মন নেই৷ সে শুধু ভাঙছে আর সব কিছু নষ্ট করছে৷

সব বাজারেই কিছু কুকুর ঘুরে বেড়ায়৷ সব কটা কুকুর দূরে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছে, হাতিটা এক এক পা এগোতেই তারা ল্যাজ গুটিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে৷

একটা শুধু গ্যাঁট্টাগোঁট্টা সাহসী কুকুর দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে গেল৷ ওটা চায়ের দোকানদার প্রাণকেষ্টর পোষা কুকুর, ওর নাম ভোলা৷ ভিড়ের আড়াল থেকে প্রাণকেষ্ট চেঁচিয়ে বলল, ভোলা, ভোলা, যাসনি৷

ভোলা অনেকটা এগিয়ে গেছে৷

হাতিটা ঠিক ফুটবল খেলার মতন এক পায়ে একটা শট মারল ভোলাকে৷ ভোলা উড়ে গিয়ে মন্দিরের পাশের আমগাছটার ডালের ওপর গিয়ে পড়ল৷ সেখানেই আটকে গিয়ে আর্ত চিৎকার করতে লাগল প্রাণপণে৷

তপু যে দোকানটার বারান্দায় দাঁড়িয়েছে, সেটা একেবারে মানুষে ভর্তি, একটা মাছি ওড়ারও জায়গা নেই৷

হাতিটা একটা সবজির দোকান তছনছ করছে দেখে আরও কিছু লোক দৌড়ে এই বারান্দায় ওঠবার চেষ্টা করল৷ সেই ঠ্যালাঠেলিতে কয়েকজন বারান্দা থেকে পড়ে গেল পথের ওপর৷ কয়েকজন একেবারে চিৎপটাং৷ তাদের মধ্যে তপুও!

যেদিকে গোলমাল হচ্ছে, হাতিটা সেদিকেই ফিরছে৷ এরা ভয়ের চোটে কান্নাকাটি করতেই হাতিটা এদিকে ঘুরে তাকাল৷ মাথাটা দু’বার নেড়ে ছুটে এল এদিকে৷

তার পায়ের চাপে দুজন লোকের হাত ভেঙে গেল৷ তারপর হাতিটা শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে তপুকেই তুলে নিল শূন্যে৷

তারপর আবার অন্যদিকে ফিরল৷

এবার সে তপুকে আছাড় মারবে৷

তা কিন্তু মারল না তক্ষুনি৷ যেতে লাগল বাজারের বাইরের দিকে৷ হয়তো সে তপুকে ছুড়ে মারার জন্য একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজছে৷

ওই দৃশ্য দেখে বাবা পাগলের মতন কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, আমার ছেলে! আমার ছেলে!

তিনি ভিড় ঠেলে হাতিটার দিকে দৌড়ে আসতে চাইলেন৷ ছেলেকে উদ্ধার করতেই হবে৷

কয়েকজন লোক বাবাকে চেপে ধরে বলল, মাস্টারমশাই, করছেন কী! আপনি গেলে, আপনাকেও মারবে! হাতিরা ছোট ছেলেদের মারে না!

বাবা তবু নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেও পারলেন না৷

হাতির শুঁড়ে জড়ানো অবস্থায় তপু ভয় পেয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু মরে যাবার ব্যাপারটা সে ঠিক জানে না৷ এই অবস্থাতে তার মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা এল৷

দু-দিন আগে তাদের ইস্কুলে সে এলিফ্যান্ট বানান ভুল করেছে বলেই কি হাতিটা রেগে গেছে?

সে মনে মনে বলতে লাগল, ই এল ই পি এইচ এ এন টি! ই এল ই পি এইচ এ এন টি! এটা কি ঠিক না ভুল? তারপরই সে মনের চোখে দেখতে পেল, ইস্কুলের ইংরিজির স্যার গৌতমবাবু ব্ল্যাক বোর্ডে ওই বানানটাই লিখে দিচ্ছেন৷

এবার সে হাতিটার চোখের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলে উঠল, ই এল ই পি এইচ এ এন টি!

ঠিক তখনই আর একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল৷

তপুর ইংরেজি বানান শুনে হাতিটা একটুও গ্রাহ্য করল না৷ তপুকে শুঁড়ে জড়িয়ে রেখে এগোতে লাগল দুলকি চালে৷

খুব কাছেই শোনা গেল কপাকপ ঘোড়ার খুরের শব্দ৷

বাজারের সামনের রাস্তাটা একটু দূরেই ঘুরে গেছে ডান দিকে৷ সেই বাঁক থেকে বেরিয়ে এল একটা ঘোড়া, তার পিঠে একজন সওয়ার৷ ঘোড়াটা খুব জোরেই ছুটে আসছে৷

বাজারের লোকেরা আশা করছিল, যদি এর মধ্যে পুলিশ এসে পড়ে৷ কিন্তু পুলিশ তো আসল ঘটনার সময় দেরি করে প্রত্যেকবার৷

এখন কে আসছে? পুলিশ তো ঘোড়ায় চেপে আসে না৷

আর একটু কাছে আসতে দেখা গেল, ঘোড়ার পিঠে যে বসে আছে, তার সারা গায়ে জরির পোশাক, মাথায় একটা মুকুট, তাতে পালক বসানো৷ ঠিক যেন রূপকথার এক রাজকুমার!

আজকাল তো এইরকম রাজকুমার আর নেই৷ এ যেন ঠিক উঠে এসেছে ছবির বই থেকে৷

হাতিটার খুব কাছে এসে পড়তেই রাজকুমার ঘোড়াটার রাশ টানলেন৷ ঘোড়াটা চিঁ হিঁ হিঁ হিঁ করে দু’পা তুলে উঠে দাঁড়াল৷

শুঁড় জড়ানো অবস্থাতেই শূন্যে ঝুলতে ঝুলতে তপু ভাবল, হাতি আর ঘোড়ায় লড়াই হলে কে জিতবে?

অশ্বারোহী রাজকুমার কোমর থেকে টেনে বার করলেন তলোয়ার৷

সেই তলোয়ার উঁচিয়ে রাজকুমার গম্ভীরভাবে বললেন, এই গনশা, ছেলেটাকে নামিয়ে দে! নইলে তুই আর জঙ্গলে ফিরতে পারবি না৷ এখানেই তোর কবর হবে৷

এই প্রথম হাতিটা একবার ডেকে উঠল, তার উত্তরে ঘোড়াটাও একবার ডাকল৷

তপু মনে মনে বলল, ঘোড়ার ডাককে বলে হ্রেষা, আর হাতির ডাককে বলে বৃংহিত৷

এ সবই সে নতুন শিখেছে৷

কিন্তু রাজকুমার জানলেন কী করে যে হাতিটার নাম গনশা?

রাজকুমার বললেন, ঠিক দশ গুনব আমি৷ তার মধ্যে যদি তুই ছেলেটাকে নামিয়ে না দিস, তাহলে শেষ করে দেব তোকে৷ এক, দুই, তিন, চার…

সাত গোনার পরই হাতিটা বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে৷ খুব আলতো করে নামিয়ে দিল তপুকে৷

বাবা তখনও কেঁদে কেঁদে চিৎকার করছেন, তপু! তপু!

তপু ছুটে গেল সেদিকে৷

রাজকুমার তলোয়ার দুলিয়ে বললেন, গনশা, যা! এবার চলে যা!

হাতিটা দৌড়োতে শুরু করল৷

ঠিক তখনই রাজকুমার পড়ে গেলেন ঘোড়া থেকে৷ একেবারে অজ্ঞান৷

এবারে হৈ হৈ করে ছুটে এল অনেকে৷ হাতির ভয় আর নেই, এখন উপকারি বন্ধুকে সেবা করা দরকার৷

কেউ বলল, ওরে জল নিয়ে আয় রে!

কেউ বলল, পাখা আন, বাতাস কর!

রাজকুমারের মাথার মুকুটটা খুলে পড়ে গেছে৷ তার মুখে জলের ছিটে দিতেই গোঁফটাও খসে গেল৷ মুখে দেখা গেল কালো ছিট ছিট৷ আগে তাকে মনে হয়েছিল খুব ফর্সা, আসলে অনেক পাউডার মেখেছিল, ওর মুখের রং কালো৷

একটু বাদে রাজকুমার চোখ মেলল৷

তারপরই ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, হাতিটা? হাতিটা কোথায়? ওরে বাবারে, কত বড় হাতি!

তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ!

একজন লোক বলল, রাজকুমার, আপনার হুকুম শুনে হাতিটা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল৷ উঃ, কী যে কাণ্ড হচ্ছিল! ভয়ে আমাদের প্রাণ উড়ে গিয়েছিল!

লোকটি বলল, রাজকুমার? হুঁঃ! রাজকুমারই বটে!

তপুর হাত ধরে বাবা এখানে এসে বললেন, রাজকুমার, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব! আপনি আমার ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছেন৷

সে এবার ঝুঁকে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, আমায় চিনতে পারলেন না স্যার! আমি শিবু! আপনার কাছে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছি!

বাবা দারুণ অবাক হয়ে বললেন, শিবু!

চায়ের দোকানদার প্রাণকৃষ্ণ বলল, শিবু! তাই তো? তুই রাজকুমার হলি কী করে?

শিবু এবার বলল, খানিক দূরে পায়রাডাঙায় সিনেমার শু্যটিং হচ্ছে, সেখানে আমি পার্ট করছি তো!

প্রাণকৃষ্ণ খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে বলল, তুই রাজকুমারের পার্ট করছিস?

শিবু হেসে বলল, না রে! আমায় কে রাজকুমারের পার্ট দেবে! এই চেহারায়! আমার দূতের পার্ট৷ ঘোড়া ছুটিয়ে এনে একটা চিঠি দেব৷ ব্যস, ওইটুকুই!

প্রাণকৃষ্ণ বলল, তা হলে যে তুই এদিকে আজ এলি, তোকে ঠিক রাজকুমারের মতনই দেখাচ্ছিল৷

শিবু বলল, শোন, তবে বলি৷ শোনেন দাদা, সবাই শোনেন, মাস্টারমশাই, আপনিও শোনেন৷ এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার৷ আমি ছোটবেলায় ঘোড়া চালাতে শিখেছিলাম, তাই ওইটুকু পার্ট পেয়েছি৷ কাল সন্ধ্যাকালেই আমার শু্যটিং শেষ হয়ে গেল৷ খুব খাওয়াদাওয়া হল রাত্তিরে৷ আমি ওখানেই শুয়ে রইলাম সকলের সঙ্গে৷

কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, কেমন খাওয়াদাওয়া হল রে শিবু?

অন্য একজন ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই, চুপ! এখন খাওয়াদাওয়ার কথা নয়, আসল গল্পটা শুনি৷

শিবু বলল, জীবনে তো সিনেমায় পার্ট করা আমার প্রথম৷ তাই সারা রাত ঘুমই হল না৷ ভোরবেলা, সবাই যখন ঘুমিয়ে আছে, তখন আমার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি চাপল৷ যে আসল রাজকুমার হবে, সে ঘোড়া চালাতেই জানে না৷ শুধু ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে কথা বলে৷ সে এখনো ঘুমোচ্ছে৷ আমি ভাবলাম, আমি তা হলে একবার রাজকুমার সেজে ঘুরে আসি না কেন? তাই গোঁফ লাগালাম, গালে পাউডার মাখলাম৷ আর জরির পোশাক আর মুকুট পরে ঘোড়াটার পিঠে চেপে বসলাম৷

প্রাণকৃষ্ণ বলল, শিবু, তোকে তো আমি অনেক দিন চিনি৷ একটু-আধটু ঘোড়া চালাতে দেখেছি বটে, কিন্তু এত জোরে ঘোড়া চালাতে শিখলি কবে?

শিবু বলল, দাদা, সেটাই তো আশ্চর্য ব্যাপার৷ রাজপুত্র সেজে ঘোড়াটার পিঠে ওঠার পর কেমন যেন মনে হল, আমি সত্যিই রাজপুত্র৷ ঘোড়াটা জোরে ছুটছে, আমার ইচ্ছে হল, আরও জোরে ছুটুক! কোমরে তলোয়ার, আমার মনে হল, সামনে শত্রু এলে তাকে কচুকাটা করব৷ হাতিটার সামনে যখন এলাম, তখন একটুও ভয় পেলাম না৷ তখন তো আমি সত্যি রাজপুত্র৷ মনে হল, এরকম অনেক পাগলা হাতির আমি শুঁড় কেটে দিয়েছি তলোয়ারের কোপে৷

শিবু হঠাৎ থেমে গেল৷

অনেক লোক একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, তারপর? তারপর?

শিবু বলল, হঠাৎ একসময় আমার ঘোর কেটে গেল৷ বুঝতে পারলুম, আসলে তো আমি রাজকুমার নই৷ তলোয়ার চালাতেও জানি না৷ তা ছাড়া, এটা টিনের তলোয়ার৷ সামনে এতবড় হাতি৷ এবার বুঝি নির্ঘাৎ আমার প্রাণ যাবে! তাই তো পড়ে গেলাম অজ্ঞান হয়ে!

এতক্ষণ যারা হাতির ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল, এবার তারা হেসে উঠল হো-হো করে৷

বাবা শিবুর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ভাগ্যিস, তোমার মধ্যে আসল এক রাজকুমার ভর করেছিল, তাই তো আজ আমার ছেলেটা বেঁচে গেল৷

আবার বাজারে শুরু হয়ে গেল কেনাবেচা৷

বাবার সঙ্গে তপু ফিরতে লাগল বাড়ির দিকে৷ একটু বাদে সে জিজ্ঞেস করল, বাবা, হাতির ইংরিজি এলিফ্যান্ট, তাই না? ই এল ই পি এইচ এ এন টি?

বাবা বললেন, অ্যাঁ? এতদিন তোর বানানটা কিছুতেই ঠিক হচ্ছিল না৷ আজ ভয় পেয়ে ঠিক হয়ে গেল?

তপু গম্ভীর ভাবে বলল, আমি মোটেই ভয় পাইনি৷

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তুই রাইনোসেরাস বানান জানিস? তপু চুপ করে রইল৷

বাবা বললেন, দাঁড়া, এবার তোর সামনে একদিন একটা রাইনোসেরাস ছেড়ে দিতে হবে৷ তাহলেই তুই বানানটা শিখে যাবি৷ রাইনোসেরাস মানে গন্ডার৷

তপু বলল, বাবা, আমি চকোলেট বানানও জানি না৷ চকলেট, না চকোলেট?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *