সোনাগাছির হালচাল
কল্যাণবাবু বাড়ি এসে বসবার ক’দিন পর জিনা কথাটা পাড়ল তাঁর কাছে। এ কদিন সে এ নিয়ে অনেক ভেবেছে। যদি তাদের বাড়িতেই একটা ক্লাস বসানো যায় দুপুরে? তা হলে আর কাউকেই ও পাড়ায় যেতে হয় না। মেয়েরা, যারা তাদের ক্লাস চালিয়ে যেতে চায়, নিজেদের পাড়ার সঙ্গে বোঝাপড়া যারা নিজেরাই করতে পারবে, তারাই শুধু আসবে। মুকুটদের সঙ্গে তেমন কোনও সম্পর্ক থাকবে না এটার।
কথাটা শুনে কল্যাণবাবু বুঝলেন জিনা মনে মনে বেশ জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু তাঁকে তো আর ছেলেমানুষি করলে চলবে না! এমনিতেই বিমান একেবারে নিখিলের উপস্থিতিতেই তাঁকে অনুরোধ করেছে বার বার, এসব গোলমেলে ব্যাপারে তিনি যেন আর জড়িয়ে না পড়েন। কিছু ঘটলে যখন সেই ছেলেদেরই সামলাতে হবে তখন তাদের মতামতের মূল্য তাঁকে দিতেই হয়! মল্লিকারও সায় আছে বিমানের কথায়। তিনি বললেন, কাজটা একেবারেই ঠিক হবে না জিনা।
—আপনিও বলছেন এ কথা?
—শোনো জিনা, ব্যক্তিগত জীবন আর কর্মক্ষেত্র আলাদা রাখতে হয়। দেখো, আমিও তো স্ট্রিট বয়েজদের পড়াতাম। কোনওদিন কি তাদের বাড়িতে এনে তুলেছি? দুটো এক হয়ে যায় কোথায়? সংঘে, সেবাশ্রমে। সেখানেও ব্যক্তিগত আব্রু, ব্যক্তিগত নিভৃতির প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করে না। এভাবে ভেবো না মা, কিছুদিন অপেক্ষা করো, একটা না-একটা উপায় বার হবেই। তা ছাড়া এ বাড়ি তো নিখিলেরও, তাকে না বলে এমন একটা স্টেপ তুমি নিতে পারো না।
—তা হলে যদি একজন-দুজনকে কোচ করার ব্যবস্থা করি।
কল্যাণবাবু হাসলেন, বুঝেছি, ওই পূর্ণিমা আর বনমালার ওপর তোমার বড্ড মায়া পড়েছে, তাই না?
জিনা চুপ করে রইল। সে বলতে চায় না, শুনতে চায়। পূর্ণিমা, বনমালা তার কাছে শুধু দুজন মেয়েই নয়, তার প্রচেষ্টার ফল, তার সাফল্য, তার সৃষ্টিও।
—ওরা যদি নিজেরা আসতে চায়, শুধু ওই মেয়েদুটিই…দেখো ভেবে। তবে জিনা…একটু হার মানতেও কিন্তু শিখতে হয় মা। আমাদের বেশি সামর্থ্য, বীরত্ব নেই। শহিদ হতে তো চাচ্ছি না। যা নেই তা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। তোমার পরিস্থিতিতে তুমি যতটা পেরেছ করেছ, এর পরে… দেখছই তো, তোমার আমার মতো সাধারণ মানুষের সাধ্য নেই এসব ঠেকানোর। কোথায় এখানে কার কী স্বার্থ জড়িয়ে আছে; বাইরে থেকে আমাদের বোঝবার উপায়ই নেই।
তখন জিনা তাঁকে পূর্ণিমার ব্যাপারটা পুরো বলল।
—এই মেয়েটিকে কি আমরা সাহায্য করতে পারি না?
তার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে কল্যাণবাবু বললেন, ও, তাই সেদিন মেয়েটিকে কেমন কেমন দেখলাম! আমি চেষ্টা করব যথাসাধ্য। কথা দিচ্ছি। কিন্তু এবার তুমি আমায় কথা দাও ও জায়গায় তুমি আর যাবে না!
জিনা হতাশ হয়ে বলল—ক্লাসই যদি না নিই, শুধু শুধু আর যাব কেন!
জিনা এখন মনে করবার চেষ্টা করে বছর দুই আগে ঠিক কীভাবে সে সময় কাটাত। কেমন ছিল সে, কী ছিল তার আশা-আকাঙ্ক্ষা? আশ্চর্য হয়ে সে বোঝে তার স্পষ্ট কোনও আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল না কিন্তু। তার মা, কাকিমা, দিদিরা যেভাবে বেঁচেছেন, রান্না করে, খেতে দিয়ে, টি.ভি দেখে, আড্ডা মেরে, দল বেঁধে বেড়াতে গিয়ে সেটাই তার কাছে ছিল বাঁচার মডেল। কিন্তু ভাবেনি, এসব নিয়ে কখনও ভাবেনি। সুখী ছিল কি? হ্যাঁ, খুব হাসিখুশি ছিল। মনের মধ্যে দিয়ে সবসময়ে একটা ফুরফুরে বাতাস বইত। সেটা যে কোন সুখের সমুদ্র থেকে বইত, কেন যে আদৌ বইত অনেক ভেবেও সে স্থির করতে পারল না। কিন্তু গত দেড়-দু’বছর সে এত নিমজ্জিত ছিল কতকগুলো কাজে, কতকগুলো চিন্তায় যে কতটুকু আড্ডা দিয়েছে, নিখিল কতটা মেজাজ খারাপ করল বা বাড়ি ফিরতে কতটা দেরি করল এগুলো নিয়ে মোটে মাথাই ঘামায়নি। উপরন্তু তার আগে মনে হত সে একজন যে-কেউ। জেঠুর জিনপরি ঠিকই। কিন্তু সে-তো একটা অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের নাম ছাড়া কিছু নয়। অথচ এখন তার মনে হয় সে এক জন, এক বিশেষ জন, অনেকের মাঝখানে সে আলাদা, সে জিনা। অন্য কেউ নয়। এখন উদ্দেশ্য ছাড়া, কাজ ছাড়া বাঁচতে তার কেমন লাগবে? ঘরের দেয়ালে দেয়ালে তার চোখ ঘুরে যায়। অপরিচিত লাগে। এইসব দেয়ালের, দেয়ালে লম্বিত ক্যালেন্ডার, ঘড়ি, ছবি এসবের যেন কোনও মানে নেই। তবে কি সে কাজটা সম্পূর্ণ নিজের জন্যেই করতে গিয়েছিল? নিজেরই জন্যে করছিল? পূর্ণিমা বা বনমালাদের জন্যে নয়?
আর একটু পরে তার মনে হল—নিজের ভাললাগার জন্যেই যদি তার কাউকে বাঁচাতে ভাল লাগে তো তাতেই বা দোষের কী আছে? সেভাবে দেখতে গেলে সব দায়বোধ সব ভালবাসাই তো স্বার্থপর! শিশুকে ভাল না লাগলে মা কি তাকে ভালবাসত! শিশু আর মায়ের চিন্তা মাথায় আসতেই তার বনমালার বাচ্চাটার কথা মনে হল। কুটুস। ছোট্ট পুঁচকে। এত মিষ্টি বাচ্চাটা যে বলার নয়। জিনার খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছে কুটুস। গোড়ায় গোড়ায় যখন সে রোববারে ওদের সঙ্গে বেড়াতে যেত, তখন থেকেই কুটুসের প্রতি তার একটু পক্ষপাতিত্ব জন্মেছে। সে কুটুসকে হাত ধরে বাঘের খাঁচার কাছে নিয়ে যাবে, সে কুটুসকে পাখি চেনাবে, সে কুটুসকে কোলে করে ঘরের মধ্যে শুয়ে-থাকা শজারু দেখাবে। ভারী সুন্দর একটা দুধে গন্ধ বেরোয় কুটুসের গা থেকে। অনেকবার চুপিচুপি কুটুসকে পিপারমিন্ট দিয়েছে জিনা। চুপিচুপি গল্প বলেছে। হঠাৎ তার চোখ চকচক করে ওঠে। সে ঋত্বিককে বলবে ‘রোচনা’য় একটা কাজ দিতে। ‘রোচনা’য় অবশ্য এখন সবচেয়ে দরকার সুপারিন্টেন্ডেন্টের। সুপারদের সারা দিনরাত থাকতে হয়। সেটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর কিছু? আর কিছু? যদি টাকা পয়সা না-ও দেয়, সে রাজি আছে, ওরা রাজি হলেই হয়। ওরা। ওদের সিসটেম!
—কী রে ঘুমিয়ে পড়লি? তোর ফোন।—মল্লিকা হ্যান্ড সেটটা জিনার হাতে দিল।
—কে?
—আমি মুকুট বলছি। কী হয়েছে রে মেসোমশাইয়ের?
—কেন, শুনিসনি? তোর লোকেরা বাবাকে মেরেছে!— জিনার গলা ঈষৎ রুক্ষ।
—আমার লোকেরা? —মুকুট অবাক হয়ে বলল—তোরা নাকি পুলিশে এফ. আই. আর. পর্যন্ত করিসনি!
—অত সব জানি না, আমার বর ছিল আর দিদিভাই। তখন বাবাকে সামলাবে না এফ. আই. আর. করবে?
—আশ্চর্য! তক্ষুনি করার তো দরকার ছিল না। কিন্তু পরেও তো করতে পারতিস!
মুকুট বলল, জিনা তোর জানা দরকার সোনাগাছির কোনও গুন্ডার ক্ষমতা নেই যে আমাদের প্রজেক্টের কাউকে মেরে পার পাবে। এদের তুষ্ট করবার জন্যে আমরা যথেষ্ট পয়সা খরচ করি, চাকরি দিই, পুলিশের অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে প্রোটেকশন দিই। কাল তুই একটা নাগাদ প্রস্তুত থাকিস। আমি তোকে নিয়ে ওখানে একবার যাব। একটা মিটিং ডেকেছি। ঋত্বিক, নমিতাদি সবাই থাকবে। প্রজেক্টের আরও অনেকে। সাক্ষী হিসেবে বনমালা থাকবে, কালই একটা হেস্তনেস্ত করব।
—বাবাকে যে কথা দিয়েছি আর ওখানে যাব না।
—ও। ঠিক আছে, সে আমি মেসোমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নেব।
পরের দিন মুকুট আসতে কল্যাণবাবু অবশ্য অনুমতিটা দিলেন, কিন্তু সেটা শুধু সেইদিনের জন্য। ও অঞ্চলে জিনার কাজ করায় তিনি স্পষ্টই আপত্তি করলেন। বললেন, দেখো মুকুট, জিনা অ্যাডাল্ট, কোনও কাজের জন্যেই ওর অনুমতি লাগার কথা নয়। কিন্তু ওর নিরাপত্তার কথা তো আমাদের ভাবতেই হয়। তুমি ওকে আর ও কাজ করার অনুরোধ করো না। তা হলে আমি বিপদে পড়ে যাব।
—তা আমি করছি না মেসোমশাই। কিন্তু নিরাপত্তার ব্যাপারে আপনি যতটা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন তেমন কোনও কারণ নেই, সেটাই আমি বোঝাতে চাইছি। তা ছাড়া এরকম একটা কাণ্ড ঘটে যাওয়ায় আমাদের তো কিছু স্টেপও নিতে হয়।
তখনই জিনা তার নিজের শর্তের কথা বলল, মুকুট আজ আমি যাচ্ছি তোর সঙ্গে, খালি একটা কথা দিতে হবে।
—কী কথা? সর্বনাশ! তুই আবার কথাটথা চাইছিস কেন?
—না, তেমন সর্বনাশের কিছু নেই। তোর জানা দরকার, তোদের না জানিয়েই পূর্ণিমাকে আমি ‘রোচনা’য় আশ্রয় দিয়েছি। ওকে তোরা ভালভাবে বাঁচবার সুযোগ দিতে যা করতে হয় কর। মেয়েটা এখনও পর্যন্ত একরকম লুকিয়ে আছে।
—আচ্ছা সে হবে, এখন তো তুই চল।
পূর্ণিমার কেসটা মুকুট আগেই জানে। মুসোরি থেকে ফিরে এসেই খবরটা ওরা পেয়েছে। এই নিয়ে ঋত্বিক অত্যন্ত বিরক্ত। ঋত্বিক বলে মুকুট, আমার ‘রোচনা’টা বাচ্চাদের হস্টেল, এক ধরনের সর্বোদয় কেন্দ্র। কিন্তু বাচ্চাদের। এটাকে যদি তোরা উদ্ধারাশ্রম বানাতে চাস আমি কিন্তু আপত্তি করব। নষ্ট হয়ে যাবে আমার কাজটা। আজ একটা মেয়ে এসেছে, মেয়েটা সভ্য, ভদ্র আমি ওকে দেখেছি, ওর সম্পর্কে ভাল রিপোর্টই পেয়েছি। কিন্তু ওই পথ ধরে কালকে আরও মেয়ে আসতে শুরু করলে আমি কী করব? মেয়েগুলো আসবে, তাদের পেছনে পেছনে দালালফালাল, বাড়িওয়ালি মাসিফাসি আসতে থাকবে…আর জিনারই বা আক্কেল কী? উদ্ধার করতে চায় সে নিজে করুক, আমার ঘাড়ে বন্দুক রাখাটা আমি মোটেই পছন্দ করছি না।
মুকুট ওকে অনেক করে বোঝায়—জিনার পক্ষে স্বামীকে না বলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। পূর্ণিমার পরিচয়ের কোনও মেয়েকে পরিবারের মধ্যে রাখাও অনেক ঝুঁকি। কিন্তু ঋত্বিকের সেই একই গোঁ। এভাবে সে তার ‘রোচনা’র নিয়মকানুন নিয়ে ছেলেখেলা করতে দেবে না। পৃথিবীতে দুঃস্থ, দুঃখী, অত্যাচারিত, উদ্ধার প্রার্থী কোটি কোটি মানুষ আছে, তাদের সকলের দুর্দশা দূর করার সামর্থ্য ঋত্বিকের নেই। সে একটা বিশেষ শাখা বেছে নিয়েছে। ওভাবে এলোমেলোভাবে এগোনো যায় না।
ঋত্বিক যা বলছে তারও যুক্তি আছে। ঠিকই। আবার পূর্ণিমার কেসটাও অত্যন্ত জরুরি। জিনার যুক্তি, উপরন্তু আবেগও মানবিক। মুকুট কোনদিকে যাবে? অদ্ভুত সংকট। করছে সমাজসেবা, অথচ সমাজ যখন একটি অত্যাচারিত মুক্তিকামী মেয়ের বেশে তার দ্বারস্থ তখন তাকে ফিরিয়ে দেবার কথা ভাবতে হচ্ছে সমাজসেবারই স্বার্থে।
মুকুট নমিতাদি তিন-চারজন ডাক্তার এবং আরও বেশ কয়েকজন অচেনা ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাকে অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটের বান্ধব সমিতির ঘরে মজুত দেখল জিনা। এঁরা সকলেই মুকুটদের সংস্থার। ডাক্তাররা সবাই বিনা দক্ষিণায় চিকিৎসা করেন এদের। রাস্তার মোড়ে, পাশে জায়গা খালি রেখে একটা ছোট অনাড়ম্বর মঞ্চ তৈরি হয়েছে। একজন গম্ভীর দেখতে তরুণ ডাক্তার প্রথম মাইক্রোফোন হাতে নিলেন।
প্রচণ্ড ধমক দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। এই পাড়ার মধ্যে একজন হিতাকাঙক্ষী বয়স্ক ভদ্রলোকের মাথায় লাঠির আঘাত পড়েছে। এর দায়িত্ব গোটা পাড়ার। তাঁদের যেটুকু রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে তা ব্যবহার করে তাঁরা সারা পাড়া রেইড করাতে পারেন ইচ্ছে করলে—এই তাঁর প্রথম ধমক। দ্বিতীয় ধমক হল, তাঁরা এই গোটা পল্লির স্বাস্থ্যের জিম্মাদারি নিয়েছেন। গত তিন বছর ধরে এই পাড়ায় বুড়ো, নারী, পুরুষ এমন কেউ নেই যে এই চিকিৎসার সুফল পায়নি। গোটাটাই প্রায় দাতব্য। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে যা-কিছু ঝামেলা তাঁদের সংস্থাই পোয়ায়। দ্বিতীয়ত, তাঁরা কো-অপারেটিভ ব্যাংকের ব্যবস্থা করেছেন, যার ফলে এলাকার মেয়েরা এখন অনেক সচ্ছল। শুধু মেয়েরা নয়, মাসি-শ্রেণীর মহিলারাও। তাদের একটা ভবিষ্যনিধির মতো ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্ত সুযোগ সম্পূর্ণ বিনা চেষ্টায় বিনা খরচে পাচ্ছে তারা। উপরন্তু প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়া শিখে মেয়েরা নিজেদের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পেয়েছে। —এই সুযোগগুলো সমস্ত বন্ধ করে দেওয়া হবে পত্রপাঠ, যদি তারা এই হামলার প্রতিকার করতে না পারে, এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা সম্পর্কে ষোলোআনা প্রতিশ্রুতি দিতে না পারে।
নমিতাদি উঠে বললেন—আমি খুব ভাল করে জানি এখানে কোন কোন স্বার্থচক্র কাজ করছে। কেন করছে। হয়তো একজনকে আমি শনাক্ত করতে পারব না, কিন্তু কারা কাজটা করে থাকতে পারে—আমি জানি। তাদের কীভাবে টিট করতে হয় তা-ও আমার জানা আছে। আমি এখুনি একটি তালিকা পড়ছি। তাদের ওপরই আমার সন্দেহ। সারা পল্লিকে আমি অনুরোধ করছি এদের বয়কট করতে। মানদা মাসি, কেনারাম আচার্য, রবি গুছাইত। এই তিনটি নাম এখুনি করতে পারি। সামনের শ্রোতাদের মধ্যে থেকে অমনি একটা রই রই রব উঠল,—কী প্রমাণ, এরা কেউ কাজটা করেছে, কোন অধিকারে তিনি পাড়ার মধ্যে বিভেদ ঘটাতে চাইছেন। মানদা মাসি ও কেনা মস্তান কোমর বেঁধে সামনে এগিয়ে আসছিল। ডক্টর সাহা নামে এক ভদ্রলোক তখন বললেন—কল্যাণ সরকারকে কে মেরেছে আমরা ঠিকঠাক না জানলেও পূর্ণিমা দাসীকে কারা মেরেছে, কারা পাচার করেছে তা আমরা জানি। নারী-পাচার চক্রের পাণ্ডা হিসেবে মানদা ও কেনারামের বিরুদ্ধে থানায় এফ. আই. আর. করে এসেছি আমরা। হাতে প্রমাণ মজুত।
প্রচণ্ড একটা হট্টগোল শুরু হল এবার। কেউ বলছে হ্যাঁ, কেউ বলছে না। দু-চারটি বয়স্কা মহিলা অকথ্য গালাগালের স্রোত বইয়ে দিল। কিন্তু তারই মধ্যে বনমালা চেঁচিয়ে আঙুল তুলে তুলে সাক্ষ্য দিল সে কেনারাম, মানদা ও রবিকে পূর্ণিমার ওপর অত্যাচার করতে দেখেছে। সে গিয়ে না থামালে মেয়েটা মরেই যেত। পূর্ণিমার বয়সি অনেকগুলি মেয়ে তখন ক্যাচরম্যাচর করে বনমালাকে সমর্থন করল বটে, কিন্তু গজগজ করতেও ছাড়ল না।
বনোদিদির আর কী! ঘরে বাঁধা বাবু রয়েছে। আমাদের ওপর এরপর হামলা শুরু হবে। তখন যে কী করব?
তিন-চার শ্রেণীর স্ত্রীলোকের অশ্রাব্য গালিগালাজ আর মস্তানদের চেঁচামেচি মুখখিস্তির মধ্যে পুলিশের গাড়ি এসে থামল। মুহূর্তে ফরসা হয়ে যেতে লাগল গলিপথ। টপাটপ কয়েকজনকে গাড়িতে তুলে নিল পুলিশ। মানদা মাসি, কেনারাম উভয়েই উঠে গেল পুলিশের গাড়িতে।
সব ফাঁকা হয়ে গেলে ডক্টর সাহা বললেন, মুকুট এখুনি কিন্তু আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। সত্যিই মেয়েগুলোর ওপর হামলা হতে পারে। আমরা বরং ক্লাবঘরে একটু বসি।
বনমালা বলল, সেই ভাল। দিদিরা আপনারাও তা হলে আমার ঘরে একটু এসে বসুন না! যা ঝামেলা গেল!
নমিতাদি বললেন, সেই ভাল, চলো, এখানে তো আর জায়গাও নেই। ডক্টর সাহা আপনি ওই রবি গুন্ডাকে ডেকে বেশ করে একটু সমঝে দিন। কী মনে করেছে কী?
উঁচু উঁচু সিঁড়ির কোণে কোণে ছত্রিশ দেবতার টালি। তা সত্ত্বেও আশেপাশে পানের পিক। তা সে তো বড় বড় অফিসবাড়িতেও দেখা যায়, আবাসনের ফ্ল্যাটে পর্যন্ত দেখা যায়! সঙ্গে মুকুট এবং নমিতাদি, তার ওপরে সকাল থেকে কুৎসিত ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, পুলিশ, সব মিলিয়ে জিনার মানসিক অবস্থা এমন বিভ্রান্ত ছিল যে খেয়াল ছিল না সে কোথায় যাচ্ছে। বনমালা যখন তালা খুলতে ব্যস্ত হঠাৎ ব্যাপারটা খেয়ালে এল তার। তাকিয়ে দেখল—সরু প্যাসেজের ধারে ধারে ঘর। টানা বারান্দার ওধারে উঠোন, বারান্দার গোঁজের ভেতর পায়রা বকবক করছে, তার কেমন গা ঘিনঘিন করে উঠল। সে একজন বারবনিতার ঘরে যাচ্ছে। এইসব ঘর অবৈধ, বিকৃত, দাম-দিয়ে কেনা যৌনক্রিয়ার জন্য নির্দিষ্ট। তার মনে হল— দরজা খুললেই সে কোনও কুৎসিত দৃশ্য দেখতে পাবে।
বনমালা বলল, মুকুটদিদি এসেছে আগে, নমিতাদিও বোধহয় একবার, না নমিতাদি? আপনি কিন্তু একবারও আসেননি দিদি। তার মুখে খুশির বিগলিত হাসি৷ চোখে মুগ্ধতা। জিনাদিদি তাদের হিরোইন।
দুটো ঘর। প্রথমটা বসার। সোফা-কোচ দিয়ে দিব্যি সাজানো। মাঝখানে আবার একটা কার্পেট। ভারী পরদা ঝুলছে দরজায়। জানলায় ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড। বনমালা বেশ গর্বের সঙ্গে এ. সি. চালিয়ে দিল। তারপর ফ্রিজ থেকে ঠান্ডার বোতল বার করল। ফ্রিজ ভর্তি হুইস্কি, রাম, বিয়ারের বড় বড় বোতল। পরিষ্কার সাদা গ্লাসে তিনজনকে ঠান্ডা পরিবেশন করল বনমালা, নিজেও একটা গ্লাস তুলে নিল। দু চুমুক খেয়েছে কি না খেয়েছে বাইরের দরজা ঠাস করে খুলে ঘরে ঢুকলেন এক উত্তর-চল্লিশ সুপুরুষ ভদ্রলোক। পরনে গ্রে স্যুট।
—কী রে বনো, হঠাৎ আপিসে তলব? তোকে নাকি কারা থ্রেট্ন্ করছে?
কেমন একটা মস্তানি ভঙ্গিতে বললেন ভদ্রলোক। যা তাঁর পোশাক, চেহারা কিছুর সঙ্গেই যাচ্ছিল না। যেন আমের খোসার ভেতর থেকে চালতা বেরিয়ে এসেছে।
ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েই গোঁত্তা খেয়ে থেমে গেলেন ভদ্রলোক। সামনে সারি সারি তিন মহিলা। একজনের হাত থেকে গেলাস পড়ে চুরমার হয়ে গেছে, কার্পেট খাচ্ছে এখন ঠান্ডা পানীয়। অন্য আর একজন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে, হাতে গ্লাস, মুখ হাঁ। বুনো ষাঁড়ের মতো একটা ঝটকা দিয়ে পেছনে ফিরল লোকটি। তারপর সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে যাবার একটা ঝড়ো শব্দ হল।
বনমালা বলল—কী হল? ফটিকবাবুকে দেখে আপনারা অমন ভয় পেলেন কেন? এমনিতে উনি তো খুব ভাল লোক!
জিনা মূর্তির মতো বসেছিল। আপাদমস্তক শক্ত, খাড়া, সাদা। ভারী অথচ পলকা। যেন এক ঘা মারলেই টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাবে।
—জিনা-আ—মুকুট ডাকল একটু পরে, এই জিনা! সে তাকে হাত দিয়ে সামান্য একটু ছুঁল। জিনা হঠাৎ কৌচের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল। বনমালা না ধরলে একেবারে তালগোল পাকিয়ে পড়ত।
কোনওক্রমে কৌচের ওপর তাকে লম্বা করে শুইয়ে বনমালা ব্যস্ত হয়ে বলল—ডাক্তার ডাকব মুকুটদিদি? জিনাদিদির কি ফিটের ব্যারাম আছে নাকি গো?
—তুমি একটু ঠান্ডা জল আনো।
জলের বোতল বার করতে করতে বনমালা বলল, ফটিকবাবুই বা অত ঘাবড়ালেন কেন?
নমিতাদি আস্তে বললেন, সত্যিই! মালটি পালাল কেন? অফিসার লোক। মান গেল নাকি?
বলবে কি বলবে না মুকুট? কিন্তু এ তো চাপা থাকবার নয়, তাই মুকুট চাপা গলায় বলল, নমিতাদি, উনি জিনার স্বামী। নিখিল দে সরকার। নমিতাদি মুখটা হাঁ করেছিলেন কিছু বলবেন বলে, সেই অবস্থাতেই থেকে গেলেন।
বনমালা জলের বোতলটা ধুপ করে নামিয়ে বলল, কী বললে মুকুটদিদি? কী বললে?
—তোমার বাবুটি জিনাদিদির বিবাহিত স্বামী—শুনলে তো। মুকুটের গলার স্বর রুক্ষ।
—কী বলছ? এ হতে পারে না দিদি, তোমাদের ভুল হচ্ছে, উনি ফটিকবাবু। জে. সি.টি-তে মস্ত কাজ করেন।
—হ্যাঁ, তা করেন বোধহয়।
—উনি…উনি যে বলতেন…আধপাগল বউ… দেখতে কুচ্ছিত, ওঁকে খুশি করতে পারে না…ও মা! বলতে বলতে বনমালার মুখ ভেঙেচুরে যাচ্ছিল।
—চুপ করো বনমালা, প্লিজ চুপ করো, যে কোনও মুহূর্তে ওর জ্ঞান ফিরবে।
—কেন চুপ করব মুকুটদিদি? কেন? তোমরা অন্তত শোনো, আমি জেনেশুনে জিনাদিদির সব্বোনাশ করিনি গো! আমার জানতে ইচ্ছে হত বিয়ে-থা হয়েছে, বড়লোকের ছেলে, বড় কাজ করে সে কেন আমার মতো…বললে বিশ্বাস করবে না দিদি আধপাগল বউ সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরলে কী খোয়ার করে সেসব প্রতিদিন আমায় শোনাত! বিছানায় নিতে পারে না বউকে… সে এমন। নানা পাড়ায় ঘুরে তবে আমাকে পছন্দ হয়ে যায়। বলত, সম্পত্তি সব বউয়ের নামে। খান্ডারনি বউ…। ডিভোর্স দিতে পারছে না সেই নিয়ে কত কেচ্ছা… পাগল বউটাকে পার করতে পারলেই আমায় নিয়ে থাকবে…ওমা! কী সব্বনাশের কথা! ও জিনাদিদি গো..। আমায় দোষী ঠাউরো না গো…
—তুমি চুপ করবে বনমালা? এবার কিন্তু তোমায় একটা চড় মারতে হবে আমাকে—
—আমার কী দোষ? আমাকে কেন এতদিন পরে ‘তুমি’ করে বলছ মুকুটদিদি? আমি থাকতুম ঠিক গেরস্তর মাগের মতো গো! আজ ছ বছর অন্য লোক করিনি। জিনাদিদি যে আমাদের সরস্বতী ঠাকুর! হায়! হায়! মারো, মারো, তোমরা আমাকে খুব করে মারো গো—হাঁউমাউ করে কাঁদতে লাগল বনমালা।
জিনা আস্তে আস্তে চোখ মেলল। সামান্য একটু ঠোঁট ফাঁক করে বলল, একটা ট্যাকসি।
ছুটে বনমালা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
জিনার সারা শরীরে বিনবিন করে ঠান্ডা ঘাম। চোখের সামনে হলুদ কালো ফুটকি ফুটকি ফুটকি। অনেক দূর থেকে কার কণ্ঠ ভেসে আসছে… কোন উন্মাদিনীর… আধপাগল বউ… ভীষণ কুচ্ছিত… বিছানায় নিতে পারে না… চুপ করবে বনমালা? চুপ করবে? চুপ করো, চুপ করো, চুপ…চুপ…
ঘোরটা কাটবার পরও সে চোখ খুলতে পারেনি। চিরকালের জন্যে যদি চোখ বুজে থাকা যেত!