১১
শুধুমাত্র পুরুষকারে আস্থাশীল ছিলেন রূপেন্দ্রনাথ। নিয়তির অমোঘ বিধান মনের জোরে, বিবেকের নির্দেশে অতিক্রম করা যায় কিনা এটা পরীক্ষা করাই ছিল তাঁর সাধনা। বোধকরি তাই এক অলক্ষ্য নাট্যকার কৌতুক করে বারে বারে তাঁকে নাস্তানাবুদ করেন। ক্রমাগত দৈবনির্দেশে পালটে দিতে চেয়েছেন তাঁর জীবনের ছকটা। ‘একবগ্গা পণ্ডিত’ রাতারাতি ‘ধন্বন্তরি’ হয়েছিলেন নিতান্ত আকস্মিকভাবে। ব্রজেন্দ্র তাঁকে ঘটনাচক্রে নাড়ি দেখে নিদান হাঁকতে অনুরোধ করেছিলেন বলে। একবগ্গা সেটাকে দৈবঘটনা বলে স্বীকার করেন না। বড়মা মৃত্যুকামী ছিলেন না—মুখে তিনি যাই বলুন। তাঁর ইচ্ছাশক্তিই তির্যকপথে রূপেন্দ্রনাথকে সুযোগ এনে দিয়েছিল। এই তাঁর বিশ্বাস।
কিন্তু ওঁর সেই সঙ্কল্পটা—আমৃত্যু ব্রহ্মচারী হিসাবে আর্ত সেবার প্রতিজ্ঞাটা যে ভাবে বিলীন হয়ে গেল, সেটাও কি দৈবনির্দেশ নয়?
ব্রাহ্মমুহূর্তে গাত্রোত্থান করেন। সূর্যোদয়ের পূর্বেই প্রাতঃকৃত্যাদি ও সন্ধ্যাহ্নিক সারা। গৃহদেবতার প্রসাদটুকু মুখে দিয়ে রুগী দেখতে বার হয়ে যান অশ্বপৃষ্ঠে। ততক্ষণে সূর্যোদয় হয়েছে, কিন্তু গাছ-গাছালিতে পাখ-পাখালির কলরব থামেনি। ব্রজেন্দ্রনারায়ণের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে। এ গ্রামে না হলেও আশপাশের গ্রামে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে। এ গাঁয়েও অসুখে-বিসুখে আজকাল তাঁর দু-একটি ডাক পড়ছে। রুগী দেখতে দেখতে পাঁচ-দশ ক্রোশ চলে যেতেন। ফিরে আসতেন কখনো দ্বিপ্রহরে কখনো বা পড়ন্ত বেলায়। একাহারী তিনি। আহারান্তে বসতেন স্তূপাকার পুঁথিপত্র নিয়ে। শুধু পড়া নয়। লেখাও। প্রতিদিন যে সব রোগের চিকিৎসা করেন তার বিবরণ লিখে রাখতেন। নিজের এবং ভবিষ্যতের জন্য। ইতিমধ্যেই একটি শিষ্য জুটেছে। স্বগ্রামের, কিন্তু কায়স্থ সন্তান—জীবনকৃষ্ণ দত্ত। প্রতিদিন ওঁর কাছে আসে পাঠ নেয়। অপরাহ্ণে আসেন মৌলবী সা’ব। সন্ধ্যার পর রুদ্ধদ্বারের ওপাশে রূপেন্দ্রনাথ একা বসে কী করেন সে বিষয়ে ধারণা নেই কাত্যায়নীর অথবা জগুপিসির।
ওঁদের দুজনেরই ধারণা তিনি ধ্যান করেন।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় উনি একা বসেছিলেন বাইরের দাওয়ায়। সূর্যাস্ত হয়েছে, সন্ধ্যা লাগেনি। পশ্চিমাকাশে অপূর্ব মেঘের সম্ভার। সারাটা পশ্চিম আকাশ যেন রঙদোলের নেশায় মেতেছে। পিসি আর কাতু গেছে বড়মার কাছে। প্রায়ই যায়। বিকালে। তাদের ফিরে আসার সময় হল। হঠাৎ নজর হল একটি ডুলি আসছে ওঁর বাড়ির দিকে। পিছন পিছন দুর্গা গাঙ্গুলী।
ডুলিটা ওঁর বাড়ির দিকেই আসছে কিনা তা স্থির-নিশ্চয় বুঝতে পারছিলেন না। সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ যখন আর থাকল না তখন যুক্তকরে এগিয়ে আসেন, আসুন, আসুন গাঙ্গুলীকাকা!
নত হয়ে প্রণাম করেন।
—হ্যাঁ, নিজেই চলে এলাম। কই গো, বেরিয়ে এস।
ডুলিটা নামিয়ে বাহকেরা পাগড়ি খুলে কপালের ঘাম মুছছে। দূরে সরে যাচ্ছে। একগলা ঘোমটা দিয়ে নেমে এল মৃন্ময়ী। পাশ কাটিয়ে ঢুকে গেল বাড়ির ভিতর। রূপেন্দ্র ভিতর-বাড়ির দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করেন, বাড়িতে কিন্তু এখন কেউ নেই।
দুর্গা প্রশ্ন করেন, দিদি নেই? কাতু?
—না, এখনি এসে পড়বেন। বসুন—
একটা চৌপায়া এগিয়ে দেন। দুর্গাচরণ পিছন ফিরে একবার দেখে নিলেন ভুলিবাহকেরা শ্রুতিসীমার বাহিরে কি না। নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, তোমাকে একটা উদ্গার করতে হবে, বাবা।
—বলুন?
পিছনের দ্বারে মৃন্ময়ী এসে দাঁড়িয়েছে দেখে থমকে গেলেন। মৃন্ময়ী লজ্জা করল না, মাথার অবগুণ্ঠন কিছু কমিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল, কাকে, তা বোঝা গেল না—আমি কি একটা প্রদীপ জ্বেলে নিয়ে আসব?
রূপেন্দ্র বলেন, কিন্তু চকমকি কোথায় আছে তা কি তুমি খুঁজে পাবে?
—পাব। জানি। ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে।
নিঃশব্দ চরণে আবার সে ভিতরে চলে যায়। দুর্গাচরণ বলেন, তুমি আর একবার তোমার খুড়িকে পরীক্ষা করে দেখ, বাবা।
—কেন? নতুন কোন উপসর্গ হয়েছে?
—না! তা নয়। মানে তোমার সেই যন্ত্রটা দিয়ে ওঁর তলপেটটা একবার বাজিয়ে দেখ।
—কেন? কী হয়েছে?
—হয়নি কিছু। মানে যন্ত্রটা দিয়ে দেখই না—ওর পেটে কী আছে—ছেলে না মেয়ে!
রূপেন্দ্রনাথ বিব্রত বোধ করেন। বলেন, যন্ত্র দিয়ে তা বোঝা যায় না। একটা হৃদস্পন্দন শুধু শুনতে পাব। অজাত ভ্রূণের। তার লিঙ্গ নির্ণয় ওভাবে করা যায় না। যদি ওঁর গর্ভে যমজ সন্তান না থাকে—
—না, না, তা নেই। রাসু দেখে বলেছে।
রাসমণি সোঞাই গ্রামের একমাত্র ধাত্রী।
—তাহলে ওঁর গর্ভস্থ সন্তানের পুত্র হবার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশভাগ।
দুজনের কেউই খেয়াল করেননি। মৃন্ময়ী প্রদীপ না জ্বেলেই পুনরায় নিঃশব্দে ফিরে এসেছে। অন্দরের দিকে অপেক্ষা করছে। চকমকি নির্দিষ্ট স্থানে ছিল না।
বৃদ্ধ বলেন, তুমি আমার উপর রাগ করে আছ বাবা। তাই ওকে পরীক্ষা করতে চাইছ না।
রূপেন্দ্রনাথ বলেন, না। আমি রাগ করিনি। সেদিন যেভাবে আপনি আমাকে অপমান করে ছিলেন তাতে আমার আহত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সেই রাগ পুষে রেখে মৃন্ময়ীর চিকিৎসা করব না…কিছু মনে করবেন না কাকা, ওকে হয়তো খুড়িমাই আমার বলার কথা, কিন্তু…
—না, না, মনে করব কেন? তুমি ওকে কোলেপিঠে করে ঘুরেছ। গ্রামসম্পর্কে খুড়ি হলেও ও তোমার চোখে ছোট বোনের মতো। তাহলে পরীক্ষা করতে চাইছো না কেন?
—ঐ তো বললাম। আপনি যে উদ্দেশ্যে ওকে পরীক্ষা করতে বলছেন তা আমার ক্ষমতার বাহিরে। ভ্রূণের হৃদস্পন্দন শুনে বোঝা যায় না, সে পুত্র অথবা কন্যা।
—চেষ্টা করেই দেখ না। খপরটা যে আমার নিতান্তই জানা দরকার।
হঠাৎ দুরন্ত ক্রোধ হয়ে গেল। বলেন, ধরুন আমি পরীক্ষা করে আপনাকে জানালাম, ওঁর গর্ভে কন্যা সন্তান আছে। তাহলে আপনি কী করতে চান?
—এই ভর সন্ধ্যাবেলায় অমন কথাটা বললে, বাবা?
—কী আশ্চর্য! আপনাকে কেমন করে বোঝাই? আমার কথায় ওর গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ পরিবর্তন হতে পারে না। যা হয়েছে, তাই হবে। আপনি আমার প্রশ্নের জবাবটা দেননি কিন্তু যদি আমি বলি, ওর গর্ভে কন্যাসন্তানই আছে তাহলে কী করবেন?
—কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। আমার সময় কম।
—হ্যাঁ, খুড়ো। আমার তাই আশঙ্কা। আর কয়েক বছর পরেই সন্তান-উৎপাদনের ক্ষমতা আর আপনার থাকবে না।
—থাকবে না? কতদিন সময় আছে আমার?
—তা কি বলা যায়? বয়স বাড়ছে এটা তো জানেন?
—তা তো জানিই। তুমি কি পরামর্শ দাও?
—আমি কি পরামর্শ দেব? আপনি যা বিশ্বাস করেন তাই করুন—যাগ-যজ্ঞ, তুকতাক, কবচ-তাবিজ।
—তুমি ওসব বিশ্বাস কর না?
—আবার কেন ওসব অপ্রিয় আলোচনা তুলছেন?
—হুঁ! তুমি শুধু অপরাবিদ্যায় বিশ্বাসী! তোমার বিদ্যায় এ সমস্যা সমাধানের কোন পথ নেই?
তিক্ত কণ্ঠে রূপেন্দ্রনাথ বলেন, আছে। নিশ্চিত সমাধান নয়, সম্ভাব্যতার বিচারে আছে!
—কী তা?
—আপনি তো কুলীন! সময় থাকতে থাকতে গুটি দশেক কুলীন কন্যাকে বিবাহ করে তাদের গর্ভ-সঞ্চার করুন। পুত্র জন্মানোর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে!
—তুমি আমাকে ব্যঙ্গ করছ?
—না খুড়ো। আপনার প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত প্রত্যুত্তর করছি। এছাড়া এই অপরাবিদ্যায় আর কোন সমাধান আমার জানা নেই।
হঠাৎ নজর পড়ল ভিতর দ্বারে পাষাণপ্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়ী।
বৃদ্ধ প্রশ্ন করেন, কী হল? প্রদীপ জ্বাললে না?
মৃন্ময়ী লোকাচার লঙ্ঘন করল। পরপুরুষের সম্মুখে স্বামী-সম্ভাষণ করে বলল, কই যে-কথা বলবেন বলে আমাকে ধরে নিয়ে এলেন, তা তো ওঁকে বললেন না?
—কী কথা? বাঃ! আমি আবার কী কথা বলব?
মৃন্ময়ী এবার রূপেন্দ্রনাথের দিকে ফিরে বললে, উনি আমাকে বলেছিলেন, আপনার কাছে ক্ষমা চাইতেই আমরা দুজন আসছি। তা উনি যখন বলছেন না, তখন আমিই বলি—সেদিন আমরা যে ব্যবহার করেছি সেজন্য আমরা অনুতপ্ত। আমরা ক্ষমা চাইতেই এসেছিলাম।
রূপেন্দ্রনাথ শশব্যস্তে বলেন, না, না, ভুল ভুলই। আমি কিছু মনে করিনি।
প্রায় একই সঙ্গে বৃদ্ধ বলে ওঠেন, দেখলে? রুপো কিছু মনে করেনি। আমি বলেছিলুম কিনা? যা হোক। আমরা তাহলে চলি, কইরে তোরা কোথায় গেলি?
রূপেন্দ্রনাথ বাধা দিয়ে বলেন, শুনুন গাঙ্গুলীকাকা। ওর প্রসব-বেদনা উঠলে আমাকে সংবাদ দেবেন। না, না, আঁতুড় ঘরে আমি প্রবেশ করব না। বাইরে অপেক্ষা করব; যাতে প্রয়োজনবোধে রাসু-দাই আমার সাহায্য চাইতে পারে, ঔষধ হাতের কাছে পায়। প্রথমবার প্রসবকালে নানান ধরনের জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে তো…
—নিশ্চয়, নিশ্চয় সে আর বলতে!
দুর্গাচরণ ঘর ছেড়ে বাইরের দাওয়ায় বার হয়ে যান। এতক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে, যেন মানুষের লোকলজ্জাকে আড়াল করে দিতে। গাঙ্গুলীমশাই দাওয়া থেকে নেমে পড়েন, ডুলিবাহকদের সন্ধানে।
প্রায়ান্ধকার নির্জন কক্ষ। দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। রূপেন্দ্র কেমন যেন অসোয়াস্তি বোধ করেন। তাঁর দৃষ্টি নেমে যায় সীমন্তিনীর অলক্তকরঞ্জিত চরণপ্রান্তে। মৃন্ময়ীর কিন্তু কোন সঙ্কোচ নেই। এই ঘর, এই ঘরের মানুষজন তার বাল্যস্মৃতিবিজড়িত। অনেকদিন পরে এ বাড়িতে এসেছে। এতক্ষণ ভিতর-বাড়িতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু আবার দেখছিল। পটের ছবি, লক্ষ্মীর ঝাঁপি, কাত্যায়নীর বিবাহের স্মারক মেঠো-দেওয়ালে বসুধারা চিহ্ন। এখন দেখছে গৃহস্বামীকে—সেও তার অতি পরিচিত। এই দুর্লভ মুহূর্তটিকে সে কিছুতেই ব্যর্থ হতে দিতে পারে না। অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে অস্ফুটে বললে, সোনাদা! একটা কথা। শেষ সময়ে আমি যদি তোমার পায়ের ধুলো নিতে হাত বাড়াই, তুমি যেন পিছিয়ে যেও না!
রূপেন্দ্রনাথ চমকে ওঠেন। সোনাদা! এতক্ষণে চোখে চোখে তাকিয়ে দেখেন। মীনু এমন আবেগভরা গলায় তাঁকে কখনো কিছু বলেনি। বরাবর ‘আপনি-র দূরত্বে তাঁকে শ্রদ্ধা-সম্মান জানিয়ে এসেছে। ওর কাজলকালো চোখের তারায় যেন দেখতে পেলেন দৃশ্যটা—প্রসবাগারের প্রায়ান্ধকারে একটি সদ্যজননী একমুঠি প্রাণকে এ দুনিয়ায় পৌঁছে দিতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে বসেছে—একটা শাঁখাপরা হাত সেই অন্তিম মুহূর্তে অন্ধকারে খুঁজছে একমুঠি ধুলি…তার শেষপাড়ানির কড়ি
রূপেন্দ্রনাথ সংযম হারালেন। দক্ষিণহস্তটা প্রসারিত করে দিলেন ওর অবগুণ্ঠনচ্যুত মাথায়। অস্ফুটে বললেন, ছিঃ! ও-কথা বলিস্ না মীনু! আঁতুড়ঘর থেকে সোনার চাঁদ ছেলে নিয়েই ফিরে আসবি তুই! তোর সোনাদার আশীর্বাদ ব্যর্থ হবে না।
উদগত অশ্রুর আবেগকে রুখতে মীনু চোখে আঁচলচাপা দিল।
বাইরে থেকে ভেসে এল, কই গো? এস। ওরা এসে গেছে।