সৈকত সুন্দরী

সৈকত সুন্দরী

গোপালপুর অন সী। নাম শুনলেই অনেকের লালা ঝরে। আমার কিন্তু কেন জানি না খুব ভাল লাগেনি জায়গাটা। পুরী আমাকে যতখানি আকর্ষণ করে, ভারতের আর কোনও সমুদ্রতীর আমাকে সেভাবে আকর্ষণ করতে পারে না।

অবশ্য গোপালপুরের সমুদ্রতীর ভাল না লাগার আরও এক কারণ আছে। আমি যে সময় সেখানে গিয়েছিলাম তখন জায়গাটি ছিল একেবারেই সুনশান। সেটা ছিল ডিসেম্বর মাস। মন্দির মসজিদ প্রসঙ্গ নিয়ে দেশ জুড়ে তখন রীতিমতো দাঙ্গা বেধে গেছে। যখন তখন কার্ফু হয়ে যাচ্ছে, সেই সময়। গোপালপুরে তখন বহিরাগত যাত্রীদের কেউ ছিলেন না।

যাই হোক, বিজওয়াড়া থেকে সারারাত ট্রেনজার্নি করে ভোরবেলা বেরহামপুরে নেমে লোক্যাল বাসে যখন গোপালপুরে এলাম, চারদিকে তখন আতঙ্ক আর আতঙ্ক। মানুষ ঘর থেকেও বেরোতে ভয় পাচ্ছে। ওই অসময়ে তখন আমিই বোধ হয় একমাত্র অতিথি। গোপালপুরে এসে খুঁজেপেতে সমুদ্রতীরে একটি লজে আশ্রয় নিলাম। লজের নামটা মনে পড়ছে না। তবে ব্যবস্থা ভাল ওদের। লজে মালপত্তর রেখে স্বাভাবিক নিয়মে বাহরে এলাম।

সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ বালুচরে আছড়ে পড়ছে। কী সুন্দর! সব সমুদ্রেরই একই রূপ। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। গোপালপুর এমনিতেই নির্জন জায়গা, তার ওপর এই পরিস্থিতিতে একেবারেই জনমানবহীন। বেড়ানোর জায়গায় নির্জনতা ভাল। তবে এইরকম নির্জনতা আবার গভীর বেদনাদায়ক। আমার বারবার মনে হত লাগল, বেড়াতে নয়, আমি যেন দ্বীপান্তরে এসেছি।

কোথাও কোনও খাবারের দোকান নেই কিনে খাওয়ার মতো। এককাপ চা পর্যন্ত নেই। সেসবের জন্য একটু দূরের বাজারে যেতে হবে। সেখানে গেলে অবশ্য পাওয়া যাবে সবকিছুই। আমি চায়ের নেশায় বাজারে গেলাম। শুধু চা নয়, চা-পর্বটাও সেরে নিলাম ওইসঙ্গে। দুপুরে স্নানের পর আহারের জন্য এইখানেই আসতে হবে আবার।

চা খেয়ে নির্জন সমুদ্রতীরে একা-একাই পদচারণা করতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম কেন যে এলাম গোপালপুরে! এর চেয়ে পুরী, চলে গেলেও ভাল হত। যাই হোক, এইভাবে অলস ভ্রমণে একসময় বিরক্তি ধরে গেলে ঠিক করলাম আজকের দিনটা এখানে নিঃসঙ্গভাবে কাটিয়ে কাল সকালেই পুরী রওনা হব। পুরীর কথা মনে হতেই লজে ফিরে এলাম। তারপর স্নানের জন্য তৈরি হয়ে আবার এলাম সমুদ্রতীরে। একা একা এই নির্জন সমুদ্রের ভয়ঙ্কর গর্জনে ভয় ধরে গেল স্নান করতে। তবু কোনওরকমে স্নানপর্বটা শেষ করে বাজারের হোটেলে এলাম দুপুরের খাওয়া খেতে। এখানে বেশ কিছু মানুষজনের দেখা মিলল। সবাই স্থানীয়। টুরিস্টের ভিড় নেই। ফলে দিব্যি মনের আনন্দে সুস্বাদু তরকারি ভাত মাছ খেয়ে নিলাম পেটভরে।

লজে ফিরে দুপুরবেলা তেড়ে ঘুম।

বিকেলে আবার সমুদ্রতীর, একজন ভ্রাম্যমাণ কফিওয়ালারও দেখা পেলাম। তার কাছ থেকে এক কাপ কফি খেয়ে সমুদ্রতীর ধরে এগিয়ে চললাম দূরের দিকে, কী করব একা একা বসে থেকে? বরং সময় কাটানোর জন্য একটু হাঁটা ভাল। ওই তো দূরে একটা লাইটহাউস দেখা যাচ্ছে। ওইদিকেই যাই।

জনহীন বালুচরে এ-বেলায় কিছু ধীবরের সাক্ষাৎ মিলল। তারা গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে ফিরছে সবে। মাছ খুব যে একটা পড়েছে তা নয়। তবু তাকে ঘিরেই ছেলে-বুড়ো অনেকের সমাগম।

আমি খানিকক্ষণ তাই দেখে আপনমনেই এগিয়ে চললাম। নীল আকাশ আর নীল সমুদ্র এখন এক হয়ে গেছে। সন্ধ্যার সূর্য এখন অস্তাচলে। এক জায়গায় এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে সেই অস্তরাগের ছটা দেখতে লাগলাম। সূর্য ডুবে যাওয়ার পরমুহূর্তেই দেখি এক তরুণী আমারই মতো নিঃসঙ্গ অবস্থায় সমুদ্রের কোল ঘেঁষে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে আমি যে পথ ধরে এসেছি সেই পথে।

তরুণীকে দেখে মন আমার আনন্দে ভরে উঠল। তা হলে এই গোপালপুরের সমুদ্রতীরে এখন আর আমি একা নই। আমি এদিক-সেদিক তাকিয়ে একমাত্র ওই তরুণীকে ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলাম না। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর নির্জনে তরুণী কেন যে একাকিনী, তা কিছুতেই ভেবে পেলাম না।

যাই হোক, আমিও নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ওঠার আশায় তরুণীকে অনুসরণ করে ফিরে আসাই স্থির করলাম। শুকনো বালি থেকে নেমে তাই ভিজে বালির পথ ধরলাম। মাঝে মাঝে সফেন ঢেউগুলো টুকরো টুকরো হয়ে তার অশান্ত স্রোতোধারায় আমারও পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিতে লাগল।

তরুণীর সাহস আমার চেয়েও বেশি। সে আরও নেমে সায়া শাড়ি বেশি করে ভিজিয়ে পথ চলতে লাগল। চলার গতিও বেশ দ্রুত। আমিও জেদের বশে ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলতে লাগলাম। একসময় খুব কাছাকাছি এসে বললাম, “আপনি একা বুঝি? এই নির্জনে এইভাবে একা আসতে আপনার ভয় করছে না?”

তরুণী তার চলার গতি না থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। সেই তাকানোর মধ্যে এমন একটা বিরক্তির ভাব ছিল, যার অর্থ এই যে, গায়ে পড়ে আলাপ করতে আসবেন না।

আমি মর্মাহত হয়ে ব্যবধান কমিয়ে দিলাম।

একসময় এসে থামলাম আমার সেই যাত্রা শুরুর কেন্দ্রস্থলে। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম বাজারের দিকে। রাতের খাবার কিনেকেটে একসময় ফিরে এলাম লজে। চারদিকে তখন লোডশেডিং চলছে।

টর্চের আলোয় পথ দেখে আমার ঘরের সামনে এসেই দেখি অন্ধকারে সেই তরুণী দূরের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়।

আমি ওর পাশ কাটিয়েই আমার ঘরে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে মোমবাতিটা ধরালাম। তারপর সশব্দে বন্ধ করে দিলাম দরজাটা।

একটু পরেই টকটক শব্দ।

জানি, ও আসবে। এই অন্ধকারে আমার হাতের টর্চ অথবা একটা দেশলাই কাঠির প্রয়োজন হতেই পারে ওর। কিন্তু আমি সাড়া দিলাম না।

আবার দরজায় শব্দ হল টক টক টক।

আমি দরজা খুলে দিতেই একটা জোরালো সামুদ্রিক বায়ু ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। দমকা হাওয়ায় নিভে গেল বাতির আলো। বাইরে কেউ কোথাও নেই। না তরুণী, না অন্য কেউ। তবে কি হাওয়ায় এইরকম শব্দ হচ্ছিল? তাই বা কী করে হবে? এখানটা তো ঘেরা। সেরকম হাওয়াও তো নেই। ওই একবারই যা দমকা বাতাস একটু ঢুকে পড়েছিল। পরক্ষণেই আলো জ্বলে উঠল।

আমি অনেকক্ষণ ধরে জেমস হেডলি চেজের একটা বই পড়ে রাতের খাওয়া শেষ করে শয্যাগ্রহণ করলাম। ওই তরুণীর মিষ্টি অথচ রাগী মুখখানি বারবার আমার মানসপটে ভেসে উঠতে লাগল।

রাত তখন কত, তা কে জানে?

দরজায় আবার টক টক শব্দ। ব্লু রঙের ডিমলাইটটা জ্বালাই ছিল। তাই উঠে বসে কান খাড়া করে রইলাম। আবার টক টক শব্দ।

আমি আলো জ্বেলে দরজা খুললাম।

সেই তরুণী। দেখলাম ছায়ান্ধকারে সে চকিতে বাথরুমের মধ্যে ঢুকে গেল। এই লজে অ্যাটাচ-বাথ আছে কিনা জানি না, তবে আমারটা কমন। আমি মনে করলাম বাথরুমের দরজা ভেবে ও বোধ হয় ভুল করেই আমার দরজায় টোকা দিয়েছে। যাই হোক, আমি দরজা বন্ধ করে আবার শয্যাগ্রহণ করলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার আর ঘুম এল না। শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম শুধু। আর একভাবে ওই তরুণীর কথা চিন্তা করতে লাগলাম। ও কি সত্যিই ভুল করে আমার দরজায় ধাক্কা দিয়েছে? না কি কোনও বদ উদ্দেশ্য আছে ওর ! আমাকে একা পেয়ে হয়তো কোনও বিপদে ফেলতে চায়। যেহেতু মেয়েটি একা, তাই ওর ওপর এই সন্দেহটাই হল আমার।

খুব ভোরে আমি শয্যাত্যাগ করে চোখেমুখে জল দিয়ে টর্চ হাতে বাইরে এলাম। ইচ্ছেটা এই, নির্জন সমুদ্রতীরে পায়চারি করে সূর্যোদয় দেখব। তারপর এই হিমশীতল নির্জনতা ত্যাগ করে চলে যাব পুরীর দিকে।

সমুদ্রের বেলাভূমিতে না নেমে বিচ-এর পিচঢালা পথ দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ দেখি সেই তরুণীও আনমনা হয়ে একেবারে জলের ধার ঘেঁষে ধীরে ধীরে পথ চলছে। আমি এবার দুর্জয় সাহসে বুক বেঁধে সেই বেলাভূমিতে নেমে এলাম। তরুণী দূর থেকেই হাতছানি দিয়ে ডাকল আমাকে।

আমি সম্মোহিতের মতো তরুণীর দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ কতকগুলো দেশি কুকুর বিকট চিৎকার করে আক্রমণের ভঙ্গিতে ছুটে গেল তরুণীর দিকে। আর তখনই অবাক বিস্ময়ে আমি দেখলাম, তরুণী একটুও ভয় না পেয়ে একটু একটু করে ঢেউ কেটে ছায়ামূর্তির মতো মিলিয়ে গেল সমুদ্রের জলে।

আমার তখন অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। আমি সংজ্ঞাহীন না হলেও দারুণ ভয় পেয়ে আবার এসে বড় রাস্তায় উঠলাম।

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “বাবু, চা।” শিউরে উঠলাম আমি। এই আধো অন্ধকারে এ লোকটাও ভূত নয় তো? আমার হাত পা তখন ঠাণ্ডা হওয়ার উপক্রম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *