সে
আজকাল আমি অনেক কিছুই আর অবিশ্বাস করতে পারি না। ছেলেবেলায় আমার বিশ্বাসের অভাব ছিল না; ঠাকুর-দেবতা, মা-বাবার পায়ের ধুলো, মাথার ওপর আকাশে স্বর্গ, পেল্লায় চেহারার যমরাজ— এ সবই বিশ্বাস করতাম। মাঝ রাতে ডোম পাড়ায় নিশি ডাকে, বিসর্জনের দিন মা দুর্গা কাঁদে এইরকম আরও কত কী বিশ্বাস করেছি। ছেলেবেলাটা বোধ হয় ওই রকমই, সব কিছুই সহজে বিশ্বাস করা যায়। যৌবনে এসে দেখলাম, বিশ্বাস বলে বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই, অবিশ্বাসটাই বড়। আবার এখন, যখন পঞ্চাশ ছাড়িয়ে খানিকটা চলে এসেছি তখন যেন এতটা বয়সের দেখাশোনা থেকে কেমন এক অদ্ভুত দ্বিধা এসেছে: সংসারে কোনটা বিশ্বাসযোেগ্য আর কোনটা অবিশ্বাস্য তা ঠিক করতে পারছি না। কোনো কোনো জিনিস এখন আমার কাছে। ভীষণ রহস্যময় মনে হয়। যেমন আজ সকাল থেকেই হচ্ছে।
আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর, চোখের পাতা খোলবার আগেই আমার মনে হল, আমি কী হাসপাতালে? মনে হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোথাও যেন একটু আশা জাগল: যাক্, তা হলে এখনও বেঁচে আছি, মরি নি। এর পর, কী আশ্চর্য, আমার শরীর থেকে কতটা রক্তপাত হয়েছে, বিছানায় ঠিক কতটা রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে— ভাবতে ভাবতে চোখ খুললাম। আমার ঘর, আমারই বিছানা। তবু লেপের তলা থেকে খুব সাবধানে যেন ক্ষত-বিক্ষত ডান হাতটা বের করছি— হাতটা বের করে নিলাম। আমার চোখে ঘুমের রেশ, বা মনের মধ্যে অস্বচ্ছ চেতনা তখন আর থাকার কথা নয়। ছিলও না। তা সত্ত্বেও আমার ডান হাতটা চোখের কাছে রেখে প্রথমে হাতের তালু, পরে উলটো পিঠ ভাল করে লক্ষ করলাম। কোথাও কোনো কাটাকুটি, আঘাত, আঁচড় দেখতে পেলাম না। একবার আমার এমনও মনে হল, হাতের তালুতে অন্তত রক্ত জমে যাবার মতন নীল দাগ কিছু থাকা উচিত ছিল। অথচ তেমন কিছু নেই; রোজ যেমন দেখি— আমার গোটা হাতটা অবিকল সেই রকম রয়েছে। এর পর আমি অনেক সহজে আমার বাঁ হাত বের করে নজর করে দেখলাম। একেবারে পরিষ্কার হাত; সারা রাত লেপের তলায় থাকার দরুন দুটি হাতই বেশ গরম।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিতান্ত যেন অভ্যাসবশে পা নেড়ে, মুখের ওপর হাত বুলিয়ে, আমার সর্বাঙ্গ অক্ষত— এটা অনুভব করে উঠে বসলাম। অথচ, আমার মনে হচ্ছিল, যে অবস্থায় আমি ঘুম থেকে উঠে বসলাম— এই অবস্থায় আমার উঠে বসার কথা নয়। কেননা, কাল একটা ঘটনা ঘটে যাবার কথা। তা হলে কী সেটা ঘটে নি?
বাথরুম থেকে আমি ফিরে এলে ইন্দু চা নিয়ে এল। ইন্দু আমার স্ত্রী।
চা ঢেলে দিতে দিতে ইন্দু বলল, “আজ সকাল থেকেই খুব হাওয়া দিয়েছে।”
ইন্দুর মাথায় আলগা কাপড়…তার সাবেকী কালো রঙের শালটায় মাথা, গা-বুক জড়ানো। চায়ের কাপ এগিয়ে দেবার পর ইন্দ্র তার হাতের উলটো পিঠ দিয়ে কপালের কাছে কয়েকটা অগোছালো চুল সরালো। সিঁথির কাছে বাসী সিদুর বেশ ফিকে দেখাচ্ছিল, যেন খুব তাড়াতাড়ি সাদা হয়ে আসছে।
“মিনু ভবানীপুর যাচ্ছে”, ইন্দু বলল।
“ভবানীপুর!”
“বকুলের বাড়ি থেকে সব দলবেঁধে কোথায় বেড়াতে যাবে—স্টীমারে।”
বকুল ইন্দুর মামাতো বোন। মিনু আজকাল প্রায়ই মাসির বাড়ি বেড়াতে যায়। বকুলের ওপর এতটা টান মিনুর থাকার কথা নয়। ব্যাপারটা অন্য রকম, মেয়ে খোলাখুলি করে না বললেও আমরা তা বুঝতে পারি।
আচমকা আমার কিছু যেন মনে পড়ে গেল। “আচ্ছা, ওই ছেলেটির কী যেন নাম?”
বকুলদের বাড়ির? রঞ্জন।”
“আরে না না, বকুলদের বাড়ির নয়, আশাদের বাড়ির কথা বলছি। সত্যর বন্ধু।”
“সত্যর অনেক বন্ধু। তুমি কার কথা বলছ?”
আমি কার কথা বলছি আমার ভাল মনে পড়ছিল না। তার নাম আমার মনে আসছে না। চেহারাটাও একেবারে ঝাপসা।
“সেদিন আশাদের বিয়ে বাড়িতে দেখেছ বোধ—” হয় অন্যমনস্কভাবে বললাম, “ছেলেটি তাই তো বলল। সত্যর বন্ধু। বড় বড় জুলফিটুলফি আছে।”
ইন্দু আমার মুখের দিকে সামান্য তাকিয়ে থেকে হালকা গলায় বলল, “আজকাল সব ছেলেরই জুলফি থাকে, তোমার নিজেরটিরও। কার কথা বলছ কী করে বুঝব। তোমার ভাগ্নের বন্ধু যখন ভাগ্নেকেই জিজ্ঞেস কর। তা হঠাৎ…”
“না, এমনি—; কিছু নয় তেমন।” ইন্দুর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেবার সময় আমার কেমন অস্বস্তি হল।
ইন্দু আর দাঁড়াল না। সকালে তার নানান কাজ, ব্যস্ততা বেশি। মেয়ে ভবানীপুর যাচ্ছে, ছেলে সম্ভবত ময়দানে যাবে, ছোটটা ছাদে কুকুর নিয়ে রোদ পোয়াচ্ছে বোধ হয়। ঠাকুর, চাকর, ঝি— সংসার এখন ইন্দুকে বসতে দাঁড়াতে অবসর দেবে না।
চা খাবার সময় আমার কয়েকবার হাই উঠল। ঠাণ্ডায় কি না জানি না মাথার মধ্যে সামান্য ভার হয়ে আছে। চোখ কখনো কখনো ছলছল করে উঠছিল। সর্দিটর্দি হতে পারে।
বাতাসের মতিগতি সত্যি আজ ভাল নয়; পৌষ মাস, সকাল থেকেই উত্তরের বাতাস হা-হা করে ছুটে বেড়াচ্ছে। ঠাণ্ডায় কি-না জানি না আমার সার্বাঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে ছিল, যেন জড়তা আমায় হাত পা নাড়তে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে স্বাভাবিকভাবে অনুভব করতে দিচ্ছিল না। কিছু একটা— সেটা কী আমি জানি না, আমাকে কেমন বিমনস্ক করে রেখেছিল। অনেক সময় জ্বর-জ্বালা হবার মুখে এই রকম হয়; কিংবা শরীর থেকে গুরুতর ক্ষয় শুরু হলে এই রকম লাগে। হতে পারে, আমার মধ্যে কোনো রকমের অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়ছে। আমার ভাল লাগছিল না।
ততক্ষণে মুখের সামনে অনেকটা রোদ এসে গেছে আমার। এই জায়গাতুকুতে আমি সকাল-সন্ধ্যে বসি, সকালের দিকটাতেই বেশি: চা খাওয়া, কাগজ পড়া দাঁড়ি কামানো সব এখানে বসে বসেই সেরে ফেলা যায়। আমার শোবার ঘরের গায়ে এই জায়গাটুকু, ঠিক যে ঘর তা নয়, ঘরের মতনই। এধারের টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে ইটের পাতলা দেওয়াল তুলে, খড়খড়ি আর কাচ দিয়ে অনেককাল আগে এটা করা হয়েছিল। এক সময় সংসারের নানা কাজে ব্যবহার হত, আজকাল আমার বিশ্রাম, বসাটসার জায়গা। আসবাবপত্র এখানে খুবই কম: একটা ছোট মতন গোল টেবিল পাথর বসানো; গোটা দুয়েক সাবেকী চেয়ার। ইন্দু অবশ্য এরই মধ্যে তার বিয়ের আমলের একটা সরু দেরাজ ঢুকিয়ে রেখেছে।
চা শেষ করার পর হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিয়ে রাঙতা সরাবার সময় আচমকা আমার মনে পড়ল, কাল ঠিক সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নেবার পর ঘটনাটা ঘটেছিল। আমি যখন নিচু হয়ে, পিঠ নুইয়ে বসার ঘরের সেন্টার টেবিল থেকে প্যাকেটটা তুলে নিচ্ছিলাম তখন বুঝতেই পারি নি তার পর-মুহূর্তেই সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে। দাঁড়ানো অবস্থাতেই ঘাড় পিঠ নুইয়ে টেবিল থেকে প্যাকেটটা তুলে নেবার পর, আমি পিঠ সোজা করতেই দেখলাম, আমার মুখের সামনে তখনও সে দাঁড়িয়ে। কিন্তু একেবারে অন্যভাবে। নিজের চোখকে আমার বিশ্বাস হয় নি। অথচ বিশ্বাস না করার মতন কিছু ছিল না।
পলকের জন্যে দৃশ্যটা এখন আমার মনের ওপর দিয়ে টপকে গেল। অবিকল সেই রকমভাবে, সিনেমায় যেমন দেখেছিলাম একবার, একটা মস্ত ঘোড়া অন্ধকার থেকে এসে বিরাট লাফ দিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল, তার সামনের দুটো পা আমাদের মাথার দিকে লাফ মেরে উঠল, তারপর তার গলা এবং বুকের তলার অন্ধকার আমাদের ভীত, করে কোথায় যেন মিশে গেল।
এমন আচমকা, এত দ্রুত কালকের দৃশ্যটি আমার মনের ওপর দিয়ে লাফ মেরে চলে গেল যে, আমি ছেলেটিকে নজর করতে পারলাম না। সত্যর সে কেমন বন্ধু, কী নাম, তার মুখের চেহারাটি কেমন— এ সব যেন মনে করে নেওয়া খুবই জরুরা ছিল আমার পক্ষে। অথচ কিছুই মনে করা গেল না।
অন্যমনস্কভাবে, যেন সেই ছেলেটিকে— সত্যর বন্ধুকে— প্রাণপণে খুঁজছি, সিগারেটের প্যাকেটটা লক্ষ করতে করতে হঠাৎ আমার মনে হল, আজ সকালে আমার সিগারেট আসেনি; কাল এই প্যাকেটটা সন্ধে থেকে আমার হাতে রয়েছে। তা হলে কাল এই প্যাকেটটাই হাতে থাকার সময় ঘটনাটা ঘটেছিল।
সচরাচর ব্যবহার করা প্যাকেট যেমন হয় সেই রকম মামুলিই মনে হল প্যাকেটটা; চমকে ওঠার মতন কিছু নেই। এক ফোঁটা রক্তের দাগও কোথাও লাগেনি। অথচ এরকম হতে পারে না। খুবই আশ্চর্য !
ধীরে ধীরে খানিকটা বেলা হয়ে গেল। শীত চনচন করে উঠেছে। মিনু এইমাত্র চলে গেল। ছেলে চেঁচামেচি করতে করতে নীচে নেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ, তার স্কুটার খারাপ হয়ে গিয়েছে। ছোটটা নিশ্চয় এতক্ষণে দলবল সমেত পার্কে চলে পিঠ, গেছে ক্রিকেট খেলতে। বাড়িটা অনেকখানি চুপচাপ। কোথাও একটা প্লেন কিছুক্ষণ যাবৎ পাক খাচ্ছে আকাশের তলায়, তার শব্দ কাছে দূরে, দূরে কাছে গোল হয়ে ঘুরছে। যেন। রাস্তার একঘেয়ে হললা আর তেমন আলাদা করে কানে পড়ে না।
ধীরে ধীরে খানিকটা বেলা হয়ে গেল। শীত চনচন করে উঠেছে। মিনু এইমাত্র চলে গেল। ছেলে চেঁচামেচি করতে করতে নীচে নেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ, তার স্কুটার খারাপ হয়ে গিয়েছে। ছোটটা নিশ্চয় এতক্ষণে দলবল সমেত পার্কে চলে পিঠ, গেছে ক্রিকেট খেলতে। বাড়িটা অনেকখানি চুপচাপ। কোথাও একটা প্লেন কিছুক্ষণ যাবৎ পাক খাচ্ছে আকাশের তলায়, তার শব্দ কাছে দূরে, দূরে কাছে গোল হয়ে ঘুরছে। যেন। রাস্তার একঘেয়ে হললা আর তেমন আলাদা করে কানে পড়ে না।
ধীরে ধীরে খানিকটা বেলা হয়ে গেল। শীত চনচন করে উঠেছে। মিনু এইমাত্র চলে গেল। ছেলে চেঁচামেচি করতে করতে নীচে নেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ, তার স্কুটার খারাপ হয়ে গিয়েছে। ছোটটা নিশ্চয় এতক্ষণে দলবল সমেত পার্কে চলে গেছে ক্রিকেট খেলতে। বাড়িটা অনেকখানি চুপচাপ। কোথাও একটা প্লেন কিছুক্ষণ যাবৎ পাক খাচ্ছে আকাশের তলায়, তার শব্দ কাছে দূরে, দূরে কাছে গোল হয়ে ঘুরছে। যেন। রাস্তার একঘেয়ে হললা আর তেমন আলাদা করে কানে পড়ে না।
টেবিল সব কিছু সাজানো, দাড়ি কামাবার যাবতীয় উপকরণ; আয়না, সাবান, গরম জল, ব্রাশ, লোসান, খুর। আমি অনেকদিন থেকে সাবেকী হাতলঅলা খুরে দাড়ি কামাই। নিজের হাতে। মানুষের নানা রকম শখ কিংবা ছোটখাটো বিলাসিতা থাকে। দাড়ি কামানোয় আমার সেই ধরনের বিলাসিতা বরাবর। সব রকম উপকরণ। সাজিয়ে, আস্তে আস্তে, আয়েশ করে, নিজের হাতে লম্বা খুর দিয়ে দাড়ি কামাতে আমার ভাল লাগে। দাড়ি কামাবার সময় একটু আধটু থেমে সিগারেট খাওয়া, সকালের কাগজের ওপর আবার এক আধবার চোখ বোলানো, অকারণে সামনে তাকিয়ে থাকা, কিংবা আয়নায় নিজের মুখ দেখায় আমার খুব আরাম। মানুষ বেশির ভাগ সময় নিজের মুখ দেখে না, দেখতে পায় না। আয়নার সামনে মুখ রাখলে নিজেকে দেখতে পায়। তখন একই মানুষ মুখোমুখি বসে যেন পরস্পরকে দেখছে এইভাবে মনে মনে কথা বলতে পারে, হাসতে পারে, তার কটা চুল সাদা হল, চোখের তলায় কোন ভাঁজটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, দাঁত কি বলছে— এ-সবই দেখাতে পারে।
দাড়ি কামাবার আগে সকালের শেষ চা আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন গালে সাবান মাখাও শেষ। শেভ ক্রীমে ভাল ফেনা হয়েছে। টাটকা প্যাকেটের সিগারেট খানিকটা খেয়ে ছাইদানে রেখে খুরটা তুলে নিয়েছিলাম। হাতলওলা স্ট্র্যাপে খুরের আগাটা বার কয়েক শান দিয়ে নিয়ে আমি ডান গালে খুর তুললাম।
আর সামান্য পরেই সেই সাঙ্ঘাতিক মুহূর্তটি এল, যে মুহূর্তে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যেতে পারত।
কী যে হল, আমি বুঝতে পারলাম না। ডান গালে আমার খুর-সমেত হাতটা হঠাৎ থেমে গেল। সমস্ত হাত অবশ, আড়ষ্ট অনুভূতিহীন। আমার সাধ্য নেই হাত সরিয়ে নিই, বা একটু নাড়া-চাড়া করি; আঙুলগুলো কোনো রকমে খুরের হাতলটা ধরে আছে, ধারালো খুরের আগা আমার গালে, কানের পাশে। সেই মুহূর্ত অবর্ণনীয়। আর তখনই অদ্ভুত এক ব্যথা বুকের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতন বেরিয়ে কাঁধ বুক বেড় দিয়ে হাত বেয়ে একেবারে আঙুলের ডগা পর্যন্ত ছুটে গেল। ব্যথাটা আমায় অস্ফুট শব্দ করতেও দিল না, আমাকে অসাড়, অথর্ব, পঙ্গু, করে দিল যেন। পলকের অন্যে আমার বোধ হয় মনে হয়েছিল, এই আমার শেষ আমার হাতে অত্যন্ত ধারালো খুর, আমার আঙুলে সাড় নেই; এখন এই মুহূর্তে সবকিছু ঘটে যেতে পারে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্য রকম হয়ে গেল। সেই ব্যথার জন্যে হোক, অথবা ভয়ের কোনে অদ্ভুত নাড়া খেয়েই হোক, আমার হাত আবার শক্তি ফিরে পেল; যেন আমচকা তড়িৎ-হীন হয়ে যে বাতি নিবে গিয়েছিল, আবার আশ্চর্যভাবে তা দপ্ করে জ্বলে উঠল। হয়ত ব্যথার বোধই আমার অসাড় আঙুলে আবার সাড় এনে দিয়েছিল। কোনো রকমে, আস্তে আস্তে খুরটাকে নামিয়ে আমি টেবিলে রেখে দিলাম। এটা প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে ঘটে গেল। আঙুল থেকে ব্যথাটা তখন ফিরে আসছে।
যদিও আমার হাতে আর খুর ছিল না, তবু আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি বিহুল হয়ে বসেছিলাম। ডান গালের অর্ধেকটাও কামানো হয়নি বারো আনা গাল সাবানে সাদা হয়ে আছে, শেষ যে জায়গায় খুরের ফলটি ছিল— সেখানে যেন এখনও খুরের চিহ্নটা থেকে গেছে। আর একটু যদি হাতটা থেমে থাকত, বা ওই সময় অবশ, অসাড় আঙুল থেকে খুর ফসকে যেত কী হত বলা যায় না।
ব্যথাটা ততক্ষণে গুটিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এসে আবার বুকের তলায় আসে আস্তে মরে যাচ্ছিল। কেন এ-রকম হল আমচকা আমি বুঝতে পারছিলাম না। সন্দেহ নেই, এই বিশ্রী অবস্থার পর আমার ভয় এবং উৎকণ্ঠা হচ্ছিল। ডান হাতটা নজর করলাম। কাঁপছে কী? না, তেমন কিছু নয়; বুড়ো আঙুলের কাছে,…কব্জি বরাবর একটা শিরা বোধহয় দপদপ করছে। সামান্য ঘাম হয়েছে হাতের তালুতে ঠাণ্ডা লাগছিল। কপালেও হয়ত কয়েক বিন্দু ঘাম জমল।
কাছাকাছি কে যেন এসেছিল, আমি ইন্দুকে ডেকে দিতে বললাম।
আজ পর্যন্ত এ-রকম কখনও হয়নি আমার। কেন আজ হল, কিসের ব্যথা, কেনই বা এই পঙ্গুতা কে জানে!
সামান্য পরে ইন্দু এল। “আমায় বকছ কেন?”
মোটামুটিভাবে নিজেকে তখন সামলে নিয়েছি। তবু সরাসরি ইন্দুকে কিছু বলতে সঙ্কোচ হল।
“তোমার শিবু কী করছে?”
“দোকানে পাঠিয়েছিলাম, ফিরেছে। কেন?”
বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল, তবু বললাম, “নীচে আমাদের পাড়ায় একটা নাপিত ঘোরাঘুরি করে না?”
ইন্দু কিছু বুঝতে পারল না। “নাপিত? কেন?”
বিব্রত বোধ করছিলাম। এলোমেলো করে বললাম, “না, একবার ডেকে আনত। দাড়িটা কামিয়ে নিতাম।”
ইন্দু যে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছে আমার বুঝতে কষ্ট হল না। কিছুক্ষণ থমকে থেকে অবাক গলায় ইন্দু বলল “নাপিত এসে তোমার দাড়ি কামিয়ে দিয়ে যাবে! কেন? কি হয়েছে?” বলতে বলতে ইন্দু আমার সামনে মেলা দাড়ি কামাবার সাজ-সরঞ্জাম, আমার গালে শুকিয়ে আসা সাবানের ফেনা— সবই সবিস্ময়ে লক্ষ করছিল। খুবই স্বাভাবিক। আজ পাঁচ-সাত বছর কিংবা তারও বেশি সে আমাকে অন্যের হাতে দাড়ি কামাতে দেখেনি। আমার এই বিশেষ বিলাসিতাটুকু যে তার স্বামীর স্বভাবের অঙ্গ সে ভালো করেই জানে। তাহলে আজ হঠাৎ এ-রকম কেন? কেন আমি রাস্তা থেকে নাপিত ধরে আনতে বলছি?
কোনো রকমে সামলে নেবার জন্যে ইতস্তত করে বললাম, “না, সে-রকম কিছু নয়। দাড়ি কামাতেই বসেছিলুম…; কী রকম একটা ফিক ব্যথা লাগছে ডান হাতটায়। ভাবলাম—”
‘ব্যথা?” ইন্দু আমার দিকে আরও ঝুঁকে দাঁড়াল।
“শিরাটিরায় টান ধরেছে বোধ হয়।”
“ঠাণ্ডাতেও হতে পারে। বেকায়দা কোথাও লাগিয়েছিলে?”
“না: মনে পড়ছে না।”
“তা হলে নিশ্চয় ঘুমোবার সময় বালিশের ওপর হাত তুলে মাথা দিয়ে শুয়েছ। ওই এক খারাপ অভ্যেস তোমার।” ইন্দু কথা বলতে বলতে আমার কাঁধ এবং হাতের ওপর একটু হাত বুলিয়ে দিল।
“ওই রকম কিছু হবে, তেমন মারাত্মক কিছু নয়।”
“আমি শিবুকে পাঠিয়ে নাপিত ডাকিয়ে আনছি। তুমি বাপু গালের সাবানটা মুছে নাও : শুকিয়ে চড়চড় করছে।”
ইন্দু চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ ডাকলাম, “শোনো।”
কাছে এল ইন্দু।
আমার ডান হাতটা আস্তে করে তুলে ধরে বললাম, “আচ্ছা, দেখো তো, কোনো দাগটাগ দেখতে পাও কি না?”
“দাগ! কিসের দাগ?”
“এমনি বলছি। কোথাও হয়ত লেগে টেগে গিয়েছে, খেয়াল করিনি। শিরাটিরাও অনেক সময় ফুলে যায়…।”
ইন্দু আমার হাতের তালু উলটে পিঠ, কব্জি-টব্জি দেখল ভাল করে! মাথা নেড়ে বলল, “না, কিছু দেখছি না।” বলে একটু থেমে আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার কী শরীরটা ভাল নয়?”
“ভালই; তবে আজ তেমন ভাল লাগছে না।”
“কাল তোমার ভাল ঘুম হয়নি; বার দুই উঠেছ।”
হ্যাঁ, কালকে…”
“ক’দিন ধরে তোমার শরীরটাও কেমন দেখছি!”
“আমারও মনে হচ্ছে; কেমন লাগছে যেন, বুক পিঠে ব্যথা ব্যথাও মনে হয়।”
“আজ একবার অফিস থেকে ফেরার সময় তোমার বন্ধু নরেন-ডাক্তারকে দেখিয়ে এস। এখন বয়েস হচ্ছে…, গাফিলতি করা উচিত নয়। সেদিনও আমি তোমায় বলেছি। বুঝলে?”
“দেখি।”
“দেখি নয়, আজ নিশ্চয় করে ডাক্তার, দেখিয়ে আসবে। …আমি শিবুকে পাঠিয়ে নাপিত ডাকিয়ে দিচ্ছি।”
ইন্দু চলে গেল। গালের সাবান মুছে আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। সত্যি, আমার ভাল লাগছিল না। কী রকম এক অবসাদ, মনমরা ভাব, অন্যমনস্কতা, বিষন্নতা যেন আমায় আরও শূন্য করে তুলছিল।
রোদ আরও অনেকটা এগিয়ে আমার মাথা ডিঙিয়ে গিয়েছিল। বাতাসের মাতগতিতে যা-খুশি বেয়াড়া ভাব আরও বেড়েছে।
শিবু নাপিত ডেকে আনল।
অফিসে আমার কাজকর্ম প্রায় কিছুই হল না। সকালের সেই ব্যথাটা যদিও আর ফিরে আসেনি, তবু সব সময় আমার ভয় হচ্ছিল আবার যে কোনো সময়ে ওটা দেখা দিতে পারে, আর যদি দেখা দেয় হয়ত এবার আমি সঠিক করে সেটা চিনে নিতে পারব। ব্যথাটা কিসের, কোথা থেকে আসছে, কিভাবে ছড়াচ্ছে— এটা আমার ভাল করে জেনে নেওয়া দরকার। নরেনকে অফিস থেকে ফোন করেছি, ছ’টা নাগাদ সে ধর্মতলার চেম্বারে থাকবে, তাকে দেখিয়ে নিয়ে যাব। আমার ডান হাত অবশ্য এখন আর দুর্বল, অবশ লাগছিল না। তবু আমি অনুভব করতে পারছিলাম, বেশ স্বাভাবিকভাবে আমি হাতটা নাড়া-চাড়া করতে ভয় পাচ্ছি। ফলে হয়ত আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে খানিকটা। বাঁ হাতের ব্যাপারেও আমি লক্ষ করলাম, আমার হাতটা মুঠো হয়ে থাকছে বার বার, ফলে তালু ভিজে যাচ্ছে; রুমাল দিয়ে বেশ কয়েকবারই হাত মুছতে হল। দুপুরে চায়ের সময় পারচেজ অফিসার দত্তগুপ্ত এল। দত্তগুপ্তর বয়েস এখনও চল্লিশে পৌছোয়নি, খুব চটপটে, ফিটফাট ছোকরা। আমাদের অফিসে বছর পাঁচেকের মধ্যে অনেক উন্নতি করে ফেলেছে।
“স্যার—” দত্তগুপ্ত টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আজ আমি একটু তাড়াতাড়ি চলে যাব ভাবছি।”
“এখনই?”
“না, আর একটু পরে। আমাদের ওদিকে খুব গোলমাল চলছে কাল বিকেল থেকে। দুটো মারা গেছে; আর-একটা যায় যায় করছে। কাগজে দেখেছেন বোধ হয় আজ।”
“ও! …না, আজ ভাল করে কাগজ দেখা হয়নি।”
“আমাদের ওদিকে কারফুর পসিবিলিটি হয়েছে আজ। সকাল থেকে বনধ্ চলছে।”
“কারা মারা গেল?”
“একজন শুনছি বেশ বুড়ো, ষাটটাট হবে; রাবার ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। এক কোপেই সাবাড় করে দিয়েছে, কসাইয়ের দোকান থেকে চপার এনে মেরেছে। শুনলাম। হরিব্ল্। অন্যটা গিয়েছে ডিরেক্ট বোমার হিটে। বুকের ওপর হিট হয়েছিল। এ বোধ হয় পলিটিকস করত…বেশি বয়স নয়। একজন এ এস আই হাসপাতালে পড়ে আছে, বোমা খেয়েছে।”
আমি কোনো কথা বলছিলাম না; এমন কি দত্তগুপ্তর দিকে আর তাকাচ্ছিলাম না।
আরও দু-একটা কথা বলে দত্তগুপ্ত একটা খাম আমার টেবিলে— প্রায় আমার হাতের কাছে রেখে চলে গেল।
কিছুই ভাল লাগছিল না; কিছু না— কিছুই নয়। বাঁ হাতের মুঠো আর-একবার রুমালে মুছে নিলাম। কপালটা ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে। প্রেসার, না ঠাণ্ডা? চোখের গোলমাল বাড়ছে নাকি?
বেল টিপতেই বেয়ারা এল।
“আমায় দুটো স্যারিডন এনে দাও।”
পয়সা নিয়ে বেয়ারা চলে গেল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমি আশাকে ফোন করলাম। ওদিকে রিং হতে লাগল।
“হ্যালো।” ওপার থেকে।
“কে, বিবি! আমি মামা বলছি, তোর মাকে একবার ডেকে দে।”
“দিচ্ছি। মামা, ফুলদাকে তুমি বড়দিনে পাঠিয়ে দেবে, আমরা কৃসমাস ট্রি সাজাচ্ছি। আজ ট্রি আনতে যাব।…মা, ওমা, মামা ডাকছে—।”
আশা এসে ফোন ধরল ওদিকে। “দাদা?”
“তোদের কী খবর?”
“এই তো। তুমি ফোন করে ভালই করলে। বাড়িতে তোমাদের কী হয়েছে? ফোন পাচ্ছি না।”
“লাইনটা গোলমাল করছে। সারাবার জন্যে তাগাদা দিয়েছি।”
“তাই বলল!…শোনো, বউদিকে বললা— সেই জিনিসটা পাঁচ কমে পাওয়া যেতে পারে।”
“কী জিনিস?”
আশা যেন হাসল একটু। “ও তুমি বুঝবে না মেয়েদের ব্যাপার। বউদিকে বললেই বুঝতে পারবে। তবে একটু বেশি কিনতে হবে, ভরি দশেক মতন। দেরী করলে থাকবে না। বউদি কী বলে আমায় জানিয়ো।”
“বলব। …সত্য আছে?”
“সত্য! সত্যর তো এখন অফিস। …কোনো দরকার আছে? তাহলে অফিসে একটা ফোন করতে পার। নম্বরটা দেব?”
“থাক। …একটা কথা তোকেই জিজ্ঞেস করি। সেদিন তোর ছোট ননদের বিয়েতে একটি ছেলেকে দেখেছিলাম যেন, সত্যর বন্ধু। তার নামটা…”
“তোমার ভাগ্নের তো দেড় হাজার বন্ধু দাদা, তুমি কার কথা বলছ?”
“নামটা আমার মনে পড়ছে না।”
“কেমন দেখতে?”
“কেমন দেখতে! …মানে, আমি তো তেমন করে খুঁটিয়ে দেখিনি; জুলফিটুলফি আছে…।”
আশা হেসে উঠল। “ছেলেগুলোর কার যে জুলফি আর কার যে দাড়ি আমি বুঝতে পারি না। সব ক’টাই সমান। তুমি এখন বিয়ের দিন ভিড়ে কাকে দেখেছ কি করে বলব!” বলে আশা একটু থেমে শুধলো, “তুমি নিজে দেখেছ তো? কী দরকার?”
অগত্যা আমার চুপ করে যেতে হল, বোকার মতন।
“সত্য আসুক, বলব।” আশা বলল।
“থাক্। তোদের খবরটবর তাহলে ভালই। মনোরঞ্জন ভাল আছে?”
“হ্যাঁ, আমরা মোটামুটি। আজকাল যা হয়েছে। আমাদের এদিকে কী কাণ্ড হয়ে গেল পরশু! রুনুদের কলেজে অ্যাসিড ঢেলে একজনের চোখমুখ পুড়িয়ে দিয়েছে তারপর আগুন। কী আগুন! এত ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। …যা দিনকাল একটু সাবধানে থেকো বাপু।”
ফোনটা নামিয়ে রাখলাম।
সুইং ডোর ঠেলে মুখার্জি এল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “শুনেছেন মশাই, যোশীসাহেব ছুটি নিয়ে পালাচ্ছে।”
“না, শুনিনি। কেন?”
“টেররাইজড হয়ে গিয়েছে। বলছে, আর এখানে থাকবে না— নট ইন ক্যালকাটা।” মুখার্জি তার সিগারেটের ছাই অ্যাশট্রেতে আলতো করে ফেলে দিয়ে খানিকটা যেন নিরাসক্ত গলায় বলল, “বেটাকে ভাল কথা বললে শুনত না, খালি পয়সা বাঁচাবার তাল। অনেকবার বলেছি, তোমার ওই পাড়াটা ছাড়ো দমদমের দিকে কেউ থাকে। ওটা একটা ভিয়েৎনাম। কথা শুনবে না। কম ভাড়ায় বেশি ঘর নিয়ে থাকবে; বাসে, শেয়ারের ট্যাক্সিতে অফিস আসবে। এখন মজাটি বোঝো।”
বোঝাই যাচ্ছিল মুখার্জি চা-টা খেয়ে গল্প করতে এসেছে। লোকটা একটু বেশি রকম গল্পবাগীশ কথাবার্তায় ঝরঝরে, মুখে তেমন কিছু আটকায় না। চেহারাটা ভালই, মাথার চুলে অ্যালবার্ট কাটে, পোশাক-আশাকে শৌখিনতা আছে।
বেয়ারা স্যারিডন নিয়ে এল।
“স্যারিডন?” মুখার্জি জিজ্ঞেস করল।
“মাথাটা ধরেছে মনে হচ্ছে।”
“মাথার আর কী দোষ—”
“কী হয়েছে যোশীর?” জিজ্ঞেস করলাম।
“আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা খতম দেখেছে।”
“খতম দেখেছে?”
“মাডার। ক্লীন মাডার। একেবারে ওর বাড়ির কাছেই। কটা ছেলে মিলে আর-একটা ছেলেকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল। ছেলেটার হাতে দুধের বোতল দুধ নিয়ে ফিরছিল। বেচারী শেষ পর্যন্ত চেঁচিয়েছে, বাট নান টু হেলপ। সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ।”
স্যারিডনটা খেয়ে ফেললাম।
মুখার্জি বলল, “যোশী কাঁপতে কাঁপতে অফিসে এসেছে। দেরীতে। পাড়ায় পুলিস ঢোকার পর বেরিয়েছে আর কি। চোখ মুখের চেহারা পালটে গেছে বাবাজীর। বাড়িতে বউ বাচ্চা রাখে নি, বড়বাজারে কার কাছে পাঠিয়ে তবে এসেছে। কাল পরশুই পালাবে বলছে।”
আরও একবার বাঁ হাতের ঘাম মুছতে হল। মাথাটা দপদপ করছিল।
সিগারেটের টুকরোটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে মুখার্জি বলল, “যোশী ট্রান্সফার নেবার জন্যে ছটফট করছে। আমি বললাম তুমি নর্থ ক্যালকাটা ছেড়ে আমাদের দিকে চলে এসো, অনেক পিসফুল।”
“আপনাদের দিকটা ভাল আছে এখনও।”
“অনেক। চারদিকে যা হচ্ছে মশাই তার চেয়ে ফার বেটার, দু পাঁচটা বোমার শব্দ, পটকাফাটা তো নরম্যাল ব্যাপার। পুলিসের ভ্যান কী আর না দেখবেন— তবে বস্তিফস্তি প্রায় নেই বলে আমরা হাঙ্গামাহুজ্জত থেকে বেঁচে গিয়েছি অনেকটা। মুখার্জি পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক মুছল। ওর রুমালে সেন্ট মাখানো থাকে, গন্ধ এল ফিকে।
“আজকাল কোনো জায়গাই সেফ নয়, বুঝলেন পালিতসাহেব—” মুখাজি বলল, “ইভন দিল অফিস। এই অফিসের তারকবাবুর ছেলে পুলিস কাস্টডিতে রয়েছে আপনি জানেন?
“তারকবাবু! আমাদের বিল সেকসানের।”
“তবে আর বলছি কি! …ওই যে নতুন ড্রাইভার ছোকরা— সেটা তো শুনেছি খুব অ্যাকটিভ।” মুখার্জি তার অ্যালবার্ট-কাটা টেরিতে হালকা করে হাত বুলিয়ে নিল। সময় যা পড়েছে পালিতসাহেব, তাতে চারপাশ দেখেশুনে চলতে না পারলে বাঁচা যাবে না। ইউ মাস্ট বি ভেরী ট্যাকট্ফুল, রাগটাগ কক্ষনো করবেন না। পাড়ার চাঁদাফাঁদা। চাইতে এলে পঁচিশ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দেবেন, নেভার আস্ক আনি কোশ্চেন, টাকা। নিয়ে তোরা বোমাই বানাগে যা আর পাইপগান তৈরি করগে যা। গো টু দি হেল, আমার কী! আপনি মশাই পাইপগান দেখেছেন?”
“না।”
“আমি সেদিন কাগজে দেখলাম। …আমার শালা বলছিল তাদের কলেজে প্রায়। রোজই এখন পাইপগান আর বোমা নিয়ে দু’ দলে ওয়ার অফ অক্যুপেশান চালায়, মানে কলেজটা দখলে আনার লড়াই। এই যুদ্ধে সেদিন একটা মেয়ের হাত গিয়েছে— বেচারী এক বিল্ডিং থেকে কলেজের আরেক বিল্ডিংয়ে যাচ্ছিল— অ্যান্ড ইট হ্যাপেনড।”
মিনুর কথা আমার মনে পড়ছিল। মিনুরা স্টীমারে করে কোথায় গেছে আমি জানি না; তবে আজকাল এত ঘোরাফেরা করা উচিত নয়। অন্তত মেয়েদের পক্ষে। ইন্দুর এসব ব্যাপারে আরও নজর দেওয়া উচিত।
এমন সময় মিসেস বাগচী এল। মিসেস বাগচী আমাদের পুরোনো টাইপিস্ট। কোনো সময়ে দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী ছিল, এখন বয়সটাকে নিয়ে রীতিমত উৎকণ্ঠা ভোগ করে। স্বামী নেই, মানে স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছে অনেক দিন হল; বাড়িতে একটি মেয়ে আছে।
কয়েকটা জরুরী চিঠি রেখে দিয়ে মিসেস বাগচী চলে যাচ্ছিল। মুখার্জি বলল, ‘আপনি পার্কসার্কাসে থাকেন না?”
মাথা নুইয়ে সামান্য নাড়ল মিসেস বাগচী।
“ওদিকের অবস্থা কেমন? খুনোখুনি হচ্ছে?”
“আমাদের দিকটায় এখনও হয়নি।”
“অ্যাংলো পাড়া বলে অনেকটা সেফ্।”
“কাল একটা বাস জ্বালিয়েছিল।”
“ওনলি ওআন?” মুখার্জি হাসল, “তা হলে তো খুবই ভাল পাড়া।”
কী ভেবে মিসেস বাগচী বলল, “আজ অফিস আসার সময় আমাদের আগের ট্রামের ওপর বোমা ছুঁড়েছিল।”
“কোথায়?”
“ওয়েলিংটনের একটু আগে।”
“মরেছে ফরেছে?”
“কী জানি। ট্রামটা আর দাঁড়াল না, প্রাণপণে বেরিয়ে গেল সোজা। দাঁড়ালে আগুন ধরিয়ে দিত।”
মিসেস বাগচী চলে গেল। মুখার্জি একবার ঘাড় ফিরিয়ে দরজার পাললাটা বন্ধ হতে দেখল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বাঁ চোখটা সামান্য ছোট করে হেসে বলল, বুঝলেন পালিতসাহেব, বাগচীবিবি আমার হিপ্পি-তত্ত্ব
অস্টিন অফ ইংল্যান্ডের মতন, এখনও বেশ চলছে।”
নিজের রসিকতায় নিজেই যেন মুগ্ধ হয়ে মুখার্জি হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “আপনাদের আর কী, গিন্নীফিন্নি নিয়ে দিব্যি আছেন। আমাদের মতন উইডোমারের অবস্থাটা বুঝতে পারবেন না। ক্লাবে তাস খেলে, আর মদ গিলে কাঁহাতক বেঁচে থাকা যায়। ছেলেটাকে বেনারসে পড়তে পাঠিয়ে আরও ফাঁকা লাগছে। সিচুয়েসান ইমপ্রুভ করলে ছেলেটাকে আনিয়ে নেব ভাবছি।”
মুখার্জি চলে গেল। আরও একটু জল খেলাম। স্যারিডনের স্বাদ যেন গলার কাছে লেগে আছে। ঘড়িতে তিনটে বাজল। স্লিপ প্যাডে অকারণে লাল-নীল পেনসিলটা বোলাতে বোলাতে এমন একটা বিচিত্র ছবি হল যে ‘আমার মনে হচ্ছিল কিম্ভুত কোনো জীবকে আগুনের মধ্যে রেখে ঝলসানো হচ্ছে।
সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরলে ইন্দু আমার শরীর সম্পর্কে জানতে চাইল। আমার বন্ধু নরেনের কাছে গিয়েছিলাম। নরেন কিছু ধরতে পারেনি, ব্লাড প্রেসার সামান্য বেড়েছে, ওটুকু কিছু নয়। ব্যাথাটা অ্যানজিনার কী না— সে বুঝতে পারছে না তার লক্ষণ খানিকটা আলাদা। তবে বয়স হচ্ছে, চারপাশে যেরকম অবস্থা— অশান্তি, উদ্বেগ, আপদ-বিপদ, টেনসান তাতে হুট করে একটা কিছু হয়ে গেলেও অবাক হবার নেই রে ভাই। যাই হোক, পরে একটা ই সি জি করে নেব। আপাতত একটা টনিক খাও, টেক সাম মালটিভিটামিন ট্যাবলেটস। মনে হচ্ছে, ভেগাস্ পেইন্। টায়ার্ডনেস, ফেটিগ কেটে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
“নরেন বলল, তেমন কিছু নয়, কাজকর্মের চাপ থেকে হয়েছে। বিশ্রাম নিতে বলল।”
“তা হলে ছুটি নাও অফিস থেকে”, ইন্দু বলল, “ক’দিন কোথাও বেড়িয়ে এসো; শীতের সময় ভালই হবে।”
“দেখা যাক।”
আজ শীতটা বোধ হয় মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। বাতাস এখন যেন আরও বেপরোয়া, সারা দিনের ধুলো জমে গিয়েছে শূন্যে ধোঁয়া প্রায় স্থির হয়ে আছে, কুয়াশা জমছিল, জমে এমন একটা বুনন তৈরি করে ফেলেছিল যে কোনো কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল না।
মিনু ফিরে এসেছে। মনে হল, তার দিন ভালই কেটেছে, গুনগুন করে গান গাইতে শুনলাম এক আধবার। আমার বড় ছেলে তার ঘরে রেডিও খুলে খবর শুনছিল, এখন বোধহয় বইপত্র খুলে বসল, ম্যানেজমেন্টের শেষ পরীক্ষাটা বাকি। ছোটটা এমন শীতে লেপের তলায় ঢুকে ইন্দ্রজাল কমিকস-এর বই পড়ছে হয়ত।
শোবার ঘরে বসে বসে সন্ধ্যে পার হয়ে গেল। ইন্দু মাঝে মাঝে আসছিল। তার মুখে সব সময়ই সংসারের কথা: বাড়ির প্ল্যানটা অদলবদল করাতে এত দেরি হচ্ছে কেন? মিনুর যেরকম মন পড়ে গিয়েছে ওদিকে তাতে এবার তাড়াতাড়ি বকুলের সঙ্গে বসে কথা বলতে হয়। ঠাকুরঝিকে বলে রেখেছিলাম, দু’দশ টাকা কম করলে ভরি দশ পনেরো নিতে পারি, তা ও যখন খবর দিয়েছে, টাকাটা পাঠিয়ে দিতে হয়। মুশকিলটা কী জানো, খোদ স্যাকরারা পর্যন্ত চোরা সোনা কিনতে ভয় পায়, ঠকে যাবার ভয় রয়েছে; তবে ঠাকুরঝি যেমন চালাকচতুর, ওকে কে ঠকাবে!
আমার কিছুই ভাল লাগছিল না। ইন্দুর কথা আমি মন দিয়ে শুনছিলাম যে তাও নয়। মানুষের মনের মধ্যে অনেক সময় কেমন একটা ঘোলাটে ভাব হয়ে আসে, তখন সবই এত অপরিষ্কার এলোমেলো যে কিছুই ভাবা যায় না, ভাবতে ভাল লাগে না। আমি কোনো কথাতেই উৎসাহ পাচ্ছিলাম না।
ক্রমে রাত হল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পর যে যার ঘরে। সংসারের শেষ কাজটুকু চুকিয়ে ইন্দুও তার ঘরে গেল। আমার শোবার ঘরের পাশে ইন্দু আর ছোট ছেলেটা শোয়, তার পাশের ঘরে মিনু। বড় ছেলে একেবারে শেষের দিকের ঘরটা নিয়েছে। সিঁড়ির এ-পাশে তার ঘর, অন্য পাশে বাইরের লোকজন এলে বসার ঘর। নীচে রান্নাবান্না, ঠাকুর-চাকরের থাকা।
বাড়িটা সাড়া শব্দহীন হল; কোথাও যে বাতি জ্বলছে তাও মনে হল না। পাড়াটাও একরকম নিস্তব্ধ, কদাচিৎ শীতের মধ্যে এক আধটা গাড়ি কিংবা রিকশার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। শেষে অনেকক্ষণ তাও আর শোনা গেল না।
আমার ঘুম আসছিল না। লেপের তলায় শুয়ে শুয়ে শেষ পর্যন্ত আমি এমন একটা ক্লান্তি এবং বিরক্তি বোধ করলাম যে ছেলেমানুষের মতন পা দিয়ে লেপ সরিয়ে হাত দুটো ঠাণ্ডায় মেলে রাখলাম। সামান্য পরেই হাত-পা কনকন করে উঠল। অন্ধকারে. ছুঁচ খোঁজার মতন আমি যে অন্ধ হয়ে কিছু হাতড়ে বেড়াচ্ছি এটা তো বোঝাই যায়। কিন্তু কী? কাকে খুঁজছি? সত্যর বন্ধুকে?
সারা দিন যাকে খুঁজে পেলাম না, এখন আর যে তাকে খুঁজে পাব এমন আশা প্রায় যখন ছেড়ে দিয়েছি, আচমকা তার নাম আমার মনে পড়ে গেল। আদিত্য। হ্যাঁ, নাম বলেছিল আদিত্য।
নামটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার পর পর সবই আশ্চর্যভাবে মনে পড়ে গেল।
কাল সন্ধ্যেবেলায় সে এসেছিল। অফিস থেকে ফিরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে আমি তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। চা-টা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কে যেন এসে বলল একটি ছেলে দেখা করতে এসেছে। বাইরের বসার ঘরে আছে।
বসার ঘরে এসে দেখলাম ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। ছিপছিপে চেহারা, মাথায় সামান্য লম্বা, কোঁকড়ানো বড় বড় চুল, রুক্ষ, গালে লম্বা জুলফি, দাড়িটাড়ি দু চারদিন বোধ হয় কামায়নি। আজকাল ছেলেরা যে ধরনের প্যান্ট পরে সেই রকম প্যান্ট, গায়ে পুরো হাতা কালো সোয়েটার, গলায় একটা স্কার্ফ মাফলারের মতন করে জড়ানো।
ছেলেটি তার পরিচয় দিল। “সত্য আমার বন্ধু। আমার নাম আদিত্য।”
“ও! সত্যর বন্ধু—! বসো বসো।”
আদিত্য বসল।
“তোমায় আগে দেখেছি কী!” বসতে বসতে আমি বললাম।
“বিয়ে বাড়িতে হয়ত।”
“ও! আচ্ছা! …তা কি ব্যাপার বলো?”
আদিত্য আমার দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। ছেলেটিকে দেখতে আমার মন্দ লাগছিল না: নাকটি বেশ ধারালো, লম্বা, থুতনি শক্ত, চওড়া কপাল। তবু ওর চোখ মুখ তেমন স্বাভাবিক, সজীব মনে হচ্ছিল না। কেমন যেন রুগ্ন, দুর্বল। চোখ দুটি অন্তত সামান্য হলুদ, নিষ্প্রাণ, অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। দেখলাম, আদিত্য তার দুটি হাতই প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে। এটা আমার পছন্দ হল না; আমার ভাগ্নের বন্ধু আমার সামনে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বসে থাকবে— আমার চোখ এটা অশালীন মনে হল। তবে, যেরকম শীত, হয়ত তার হাত দুটো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে বলেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে।
“কি ব্যাপার বললা?” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম। আমার সন্দেহ হচ্ছিল ছেলেটি সত্যর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমার কাছে চাকরি-বাকরির খোঁজে এসেছে। এ রকম অনেকেই আসে।
আদিত্য কোনো কথা বলল না, আমার দিকে তাকাবার চেষ্টা করে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।
ছেলেটি লাজুক। হয়ত খানিকটা আত্মসম্মান বোধ করছে চাকরির উমেদারি করতে।
অগত্যা আমিই অন্যভাবে কথাটা পাড়লাম। “তোমার বয়েস কত?”
ঘাড় ঘুরিয়ে আদিত্য তাকাল। চব্বিশ-টবিবশ।”
“সত্যর সঙ্গে পড়তে?”
“না।”
“তা হলে ইউনিভার্সিটি…”
“যাই নি।”
আমার মনে হল, কথাটায় আদিত্য বোধ হয় ক্ষুন্ন হল। ভদ্রতা করে বললাম, “ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া অবশ্য এখন মীনিংলেস, কিছুই হয় না ওখানে; অযথা সময় আর পয়সা নষ্ট। বছরের মধ্যে আট-দশ মাস তো বন্ধই থাকে। খুললেই গণ্ডগোল। “ আদিত্যকে যেন আমি সান্ত্বনা দেবার মতন করে একটু হাসার ভাব করলাম। “প্র্যাকটিক্যালি এখন তো মনে হয় একটা পুরোনো ঠাঁট দাঁড়িয়ে আছে। খুবই খারাপ লাগে বুঝলে আদিত্য, আমাদের খুব দুঃখ হয়। সে একটা সময় গেছে— গোল্ডেন ডেজ। ভাল ভাল ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট বয়েজ, স্কলারস, প্রফেসারস— কী রেপুটেসান্ ছিল; তারপর দেখতে দেখতে সব গেল। এখন হাট-বাজার; অ্যাডমিনিসস্ট্রেসান নেই, ডিসিপ্লিন নেই, পড়াশোনার পাট তো চুকেই গেছে। এক-একটা পরীক্ষা নিয়ে দেখো না কত কেলেঙ্কারী হয় কাগজে বেরোয়। আমাদের কী ট্রাডিসন ছিল— স্যার আশুতোষ, রাধাকৃষ্ণণ, রমন, মেঘনাদ সাহা, রাজেন্দ্রপ্রসাদ…। আর আজ? ছি ছি! ভাবতেই আমাদের মতন আধ-বুড়োদেরও বাস্তবিকই কষ্ট হয়।”
“আপনাদের ইউনিভার্সিটি।” আদিত্য চাপা গলায় বলল, অন্য দিকে তাকিয়ে, যেন আমায় বিদ্রূপের ভঙ্গি এতই অস্পষ্ট যে আমার অসন্তুষ্ট হবার উপায় নেই।
“তুমি নিশ্চয় কলেজে পড়েছ?” ইতস্তত করে বললাম।
আদিত্য অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল।
“বি-এ না বি এস-সি?”
“বি এস-সি হলে?”
“ভালই তো! তা চাকরিবাকরি?”
ঘাড় নাড়ল আদিত্য। চাকরি করে না।
আমার অনুমান মোটামুটি তাহলে ঠিক, আদিত্য বেকার, সত্যর কাছ থেকে খবরটবর নিয়ে চাকরির জন্যে আমার কাছে এসেছে। যারা চাকরিবাকরির জন্যে ধরনা দিতে আসে তাদের সঙ্গে অবশ্য এই ছেলেটির ব্যবহারে মিল নেই। ওর কোনো রকম কাকতি-মিনতি, অনুনয়, হাত পাতার ভাব নেই। একটা চাকরি চাইতে এসে অন্যরা। যেরকম করে, কথা বলে দুঃখকষ্ট জানায়, ব্যাকুলতা প্রকাশ করে— আদিত্যর মধ্যে সব কিছুই দেখছিলাম না। বাস্তবিকপক্ষে এটাই আমার ভাল লাগছিল। কেউ এসে কাঁদাকাটা করলে প্রথমে খারাপ পরে বিরক্তি লাগে। কথাবার্তাও নিজের থেকে বলছে না ও, যেটুকু নিতান্ত না বললে নয় মাত্র সেইটুকু বলছে— তাও আমার কথার জবাবে। অথচ ছেলেটাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। একটু বেশি রকম অন্যমনস্ক, খানিকটা যেন অস্বস্তি রয়েছে। আমার মনে হল, আমার কাছে— এই সাজানো-গোছানো বাইরের ঘরে আদিত্য বেশ আড়ষ্ট, সঙ্কোচ, এবং খানিকটা ভয় ভয় ভাব নিয়ে বসে আছে। হয়ত এই জন্যেই কথাবার্তা বলতে পারছে না।
আমি একটা সিগারেট ধরালাম। ধরিয়ে প্যাকেট আর দেশলাইটা সামনের নীচু সেন্টার টেবিলে রেখে দিলাম। এপাশের বড় সোফায় আমি, সেন্টার টেবিলের ও-পাশে ছোট সোফায় আদিত্য, আমরা মুখোমুখি বসে।
“চাকরিবাকরির অবস্থা খুব খারাপ—” আমার গলা থেকে কথার সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া আস্তে আস্তে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে এল। “আন্এমপ্লয়মেন্ট এখন একটা মেজর প্রবলেম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্যাশনাল প্রবলেম। কাগজে একটা ফিগার দেখছিলাম সেদিন, আই ডোন্ট রিমেমবার এজাক্টলি, বাট ইট মাস্ট বি সাম মিলিয়ানস। ফোর্থ প্ল্যানের আগেই সাম থ্রি পয়েন্ট সামথিং। কত লক্ষ হল যেন? তা লাখ পঁয়ত্রিশ হবে। বাংলা দেশেই দেখো না, সাত আট লক্ষ। আমাদের ছেলেবেলায়, তিরিশ-বত্রিশ সাল নাগাদ এ রকম একবার দেখেছি— মাথা খুঁড়েও চাকরি জুটত না, আই-এ বি-এ পাশ করে ছেলেরা ফ্যাফ্যা করত। অবশ্য তখন এরকম চোখে লাগত না, আজকাল যেমন লাগে, পপুলেসান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেকারের ভল্যুমটাও তো বেড়ে যাচ্ছে, না কী বল হে? তাছাড়া তখন লেখাপড়া জানা ছেলের নাম্বারটাও কম ছিল, এখন স্কুল ফাইন্যান্স আর হায়ার সেকেন্ডারীতেই তো হাজার পঞ্চাশ করে বেরুচ্ছে বছরে। সে টুকে-ফুকে যেমন করেই হোক। তা তুমি স্কুলে চেষ্টা করলে না কেন? শুনেছি সাইন্স টিচারদের ডিম্যান্ড আছে। মাইনেপত্রও এখন ভদ্রলোকের মতন হয়েছে।”
আদিত্য ছোট্ট করে একবার কাশল। কাশল না হাসল। মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। এই যে আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাকরির বাজারের কথা বললাম তাতে ওর বোঝা উচিত ছিল, আমি বাস্তবিক তাকে হতাশ করছি। ছেলেটা বাস্তবিকই অদ্ভুত। কিংবা এমন হতে পারে, সে খুব একটা আশা নিয়ে এখানে আসেনি।
স্কুল তোমার পছন্দ নয়?” সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আমি শুধোলাম।
আদিত্য যেন ম্লান একটু হাসল।
“তোমার পছন্দ নয়? ধরা করার লোক পাচ্ছ না?” আদিত্যর চোখে চোখে তাকাবার চেষ্টা করলাম। “স্কুলের ব্যাপার হলে আমি একবার চেষ্টা করতে পারি; আমার এক বন্ধু কোন্ স্কুলের যেন সেক্রেটারি। তবে, ইস্কুলটিস্কুল কী আর থাকবে হে, তোমরা তো সব তুলেই দিচ্ছ—” বলে একটু হাসলাম, পাছে, আদিত্য ক্ষুণ্ণ হয় সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “আমি তোমাকে মিন্ করছি না। যা দেখছি আজকাল— তাই বলছি। কী যে ব্যাপারটা হচ্ছে— আমাদের বাপু মাথায় ঢোকে না। সব পড়িয়ে দিলেই কী ঝঞ্ঝাট মিটে যাবে। আমি স্বীকার করছি, মোর দ্যা নাইন্টি পার্সেন্ট স্কুল একেবারে রট্ন, গোয়াল, কিচ্ছু হয় না। মাস্টাররা পান চিবোয়, চা খায়, পে-স্কেল করে, স্কুল থেকে বেরিয়ে হিন্দী সিনেমা দেখে ইভন্ কিছু মাস্টারফাস্টার আজকাল দেশী মদের দোকানেও ঢোকে। খুবই খারাপ। আরে, আমার পাশের বাড়িতে জগদীশ মাস্টার থাকে; সে আর তার বউ দুজনেই মাস্টারি করে; তুমি বললে বিশ্বাস করবে না, গত বছর জগা-মাস্টার একটা স্ক্যান্ডাল করেছিল, কাগজে বেরিয়েছিল, সেই থেকে শুনেছি এগজামিনারশিপ গিয়েছে।” সিগারেটের টুকরোটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিলাম।
আদিত্য আবার কাশল। গলার স্বরটা ভাঙা। ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়।
“একটু চা খাও।”
“না না।”
“খাও। খুব ঠাণ্ডা। তুমি আমার ভাগ্নের বন্ধু— ভাগ্নেরই মতন। চা খাও একটু আবার তো ঠাণ্ডায় যেতে হবে।”
চায়ের কথা বলতে আমি ভেতরে গেলাম। আদিত্য বসে থাকল।
ফিরে এসে দেখি আদিত্য সেই একইভাবে বসে আছে সামান্য কাত হয়েছে এই মাত্র; তার হাত দুটো তখনও প্যান্টের পকেটের মধ্যে।
“তুমি কোথায় থাক আদিত্য?”
“তা একটু দূরে।”
“সত্যদের পাড়ায়?”
“না।”
“আমি ভেবেছিলাম সত্যদের ওদিকেই থাকো।”
“পাকা রাস্তা নেই। হেঁটে যেতে হয়।
“হাঁটাই আজকাল ভাল; কলকাতায় ট্রাম-বাসের যা অবস্থা। প্রত্যেকদিন পাঁচ দশটা করে লোক মরছে। এতো লোক, এত্তো ভিড়; আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের গলা বুজে গিয়েছে। কলকাতার জন্যে কিছু হচ্ছে না। কী করেই বা হবে বলো, আমরা কিছু হতেই দেব না; হবার চেষ্টা হলেই বানচাল করার মতলব করছি। ধর, এই স্টেট বাস— বিধানবাবু তো ভালই চেয়েছিলেন— কিন্তু অবস্থাটা দেখ, এখন স্টেট বাস আর মোষের গাড়ি সমান। হাউ ডার্টি, আগলি। ভেঙেচুরে, পুড়িয়ে, শ্লোগান লিখে লিখে কী চেহারা করেছে গাড়িগুলোর। কোনো ভদ্র শহরে এরকম দেখা যায় না। আমরা যে কী হয়ে যাচ্ছি—”।
“গিয়েছি—” আদিত্য যেন বলল।
“বলতে কি, আমাদের তো মাথা গোলমাল হয়ে যায়। কিছু বুঝতে পারি না। সামথিং হ্যাজ্ হ্যাপেন্ড। বাট হোয়াট? তুমি ইয়ংম্যান। আমার ছেলে, ভাগ্নে সত্য, তুমি— তোমরা মোটামুটি সমবয়েসী। আমাদের পরের জেনারেশান। ওয়েল, টেল মী, এটা কী হচ্ছে?”
আদিত্য তার পা জড়াজড়ি করে বসেছিল; এবার পা সরাল। তার মুখ দেখে মনে হল, সে আগের চেয়ে স্পষ্ট করে হাসল একটু।
“আমি দেখছি গ্র্যাজুয়েলি সব কিছু ডিগ্রেড করে যাচ্ছে। ডিসেন্সি নেই, অনেস্টি নেই, লেবার নেই, ধৈর্য নেই। কী যে আছে, ভগবান জানেন। আমি তোমাকে একটু আগে স্কুল কলেজের কথা বলছিলাম। নিন্দে করছিলাম। বাট স্টিল এগুলো একটা সিস্টেম, মানে এই প্রসেস আমরা স্বীকার করে নিয়েছি অনেকদিন ধরে। হাজার দোষ আছে ওর, কিন্তু সত্যি বলল, এর অলটারনেটিভ কী! শুধু পুড়িয়ে দিলেই চলবে। ক্ষেত কুপিয়ে দিলেই ফসল হয়? ডোন্ট টেল মী টু বিলিভ ইট্! মানুষ পাগল হয়ে গেছে। নয়ত এ রকম হয়। সারাটা ওয়েস্ট বেঙ্গলে এখন মারামারি, খুনোখুনি, আগুন জ্বালানো, লুঠতরাজ সকালে কাগজ ছুঁতেই ভয় হয়। রোজই দেখো মার্ডার, ডেথ, কিলিং।”
চা এসে গিয়েছিল। শিবু ট্রে থেকে দু কাপ চা নামিয়ে রাখল, একটা ডিশে কিছু স্ন্যাকস্ফ।
“নাও চা খাও”, আমি বললাম, বলে আমার কাপটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম।
আদিত্য সামান্য পরে তার বাঁ হাতটা বের করল।
“চার পাশ দেখে শুনে এখন তো রীতিমত বুক কাঁপে, বুঝলে—” চায়ের চুমুক দিয়ে বললাম, “যে কোনো দিন আমরা রাস্তায়, পার্কে, অফিসের সিঁড়িতে গড়াগড়ি যেতে পারি। কোনো সিকিউরিটি নেই লাইফের। নাইদার এজ্ নর্ প্রফেসান্ কোনো রকম কনসিডেরাসান দেখছি না। মেয়েটেয়েদেরও ছাড়ছে কোথায়!”
আদিত্য বাঁ হাতে চায়ের কাপ তুলে আস্তে করে চুমুক দিল। তার হাত বেশ কাঁপছিল। কেন কাঁপছিল আমি বুঝতে পারছিলাম না। ঠাণ্ডায়? ওর কী কোনো অসুখ আছে? এই ঘরে এত ঠাণ্ডা নিশ্চয় নেই যে ওর হাত কাঁপতে পারে। ছেলেটির যা বয়েস তাতে ওর হাত কাঁপার রোগ থাকারও কথা নয়। খুব সম্ভব আদিত্য খানিকটা নার্ভাস ধরনের ছেলে; তার হাবভাব আচার আচরণ থেকে সেই রকমই মনে হয়।
“ওকি, তুমি কিছু মুখে দিলে না?”
আদিত্য সামান্য মাথা নাড়ল ও কিছু খাবে না। আমার দৃষ্টি লক্ষ করেই কী না কে জানে চায়ের কাপটা ও আর তুলছিল না। অন্যের দুর্বলতা এভাবে লক্ষ করা অনুচিত, আমারই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
“তোমার দেশ কোথায় আদিত্য?”
“দেশ!”
আদিত্য সাড়া দিল না।
“আমার আদি বাড়ি কুমিল্লা। অবশ্য ওই বাড়িই। ছেলেবেলায় এক আধবার গিয়েছি। আমার আর মনেও নেই। এদিকেই মানুষ। বাবা নন্কোঅপারেশানে ছিল, মাও চরকা কাটত। তারপর একটা দেশী ব্যাঙ্ক নিয়ে পড়ল বাবা। উদয়-অস্ত খাটত। খাটতে খাটতেই মারা গেল। আমাদের একটা সময় বেশ খারাপ গেছে। মানুষের জীবনে ব্যাড ডেজ্ আসেই। তা যেমন করেই হোক সে সব তো আমরা পেরিয়ে এসেছি। বেটার টু ফরগেট দোজ্ স্যাড্ মোমোন্টস। এখন আর কী বলো। আমাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে, দু পাঁচ বছর আর বড়জোর বাঁচতে পারি। তার আগেও যে মরছি না— কে বলতে পারে, যা দিনকাল। আরে, সেদিন দেখি কটা বাচ্চা নীচে টিনের পিস্তল নিয়ে খেলা করতে করতে চেঁচাচ্ছে ‘হেড়ুর মুণ্ডু চাই; মানে হেড্ মাস্টারের মুণ্ডু। জাস্ট ইমাজিন…” বলতে বলতে আমি হেসে উঠলাম।
আদিত্য কোনো কথা বলছে না। আমার মনে হল এবার উঠে পড়তে হয়। খানিকটা রাতও হয়েছে।
আদিত্যর দিকে তাকিয়ে সামান্য বসে থাকলাম। “আজ তা হলে—।”
আদিত্য পিঠ সোজা করল।
“তুমি তো দূরেই যাবে খানিকটা। বেশ শীত। আর-একদিন বরং এসো——” বলতে বলতে আমি উঠে দাঁড়ালাম।
আদিত্যও উঠে দাঁড়াল।
যদিও আমি বুঝেছি, তবু আদিত্য মুখ ফুটে কিছু বলে নি বলেই যেন বললুম, “তুমি কেন এসেছিলে বললে না? তুমি একটু বেশি লাজুক হে। ঠিক আছে— পরে একদিন..” বলতে বলতে আমি পিঠ নুইয়ে সেন্টার টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই তুলে নিচ্ছিলাম। পিঠ সোজা করতেই দেখি আদিত্য আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তার ডান হাতটা আর পকেটের মধ্যে নেই।
একটি কি দুটি মুহূর্ত আমি যেন কিছুই বুঝতে পারলাম না, তার পরেই বুঝতে পারলাম, আদিত্য তার ডান হাতে একটা লম্বাটে ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল ও যেন স্প্রিং টেপার পর ছুরির ফলাটা লাফ মেরে খাপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, অথচ অবিশ্বাসের কিছু ছিল না।
অদ্ভুত একটা আতঙ্ক, বিহুলতা, অবিশ্বাস আমায় পাথর করে দিল। আদিত্যও ডান হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
“তুমি…তুমি..” আমার গলা ভয়ে কাঁপছিল হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে কণ্ঠনালীর কাছে চলে এসেছে। “তুমি কী পাগল নাকি! তোমার মাথা খারাপ! ছুরিটুরি নিয়ে আমার বাড়িতে ঢুকেছো!”
আদিত্য আমার দিকে একটা পা বাড়িয়ে দিল। ওর হাত যেন আঘাত করার আগে হঠাৎ ওপরে উঠল।
“কী সাংঘাতিক! তুমি আমার ভাগ্নের বন্ধু বলে এ বাড়িতে ঢুকে আমায় ছোরা মারতে এসেছ।” বলতে বলতে আমি পাশে সরে যাবার চেষ্টা করলাম, পারলাম না, কেননা ছোরাটার দিকে আমার দৃষ্টি, চোখ সরাবার উপায় নেই।
আদিত্যর হাত কাঁপছিল, বেশ কাঁপছিল। আমার কেন যেন মনে হল, সে ঠিক মতন ছোরা ধরতে পারছে না।
“আশ্চর্য! আমি বুঝতে পারছি না তুমি এটা কী করছ!…উন্মাদ নাকি! ইট ইজ এ ক্রাইম। …কী চাও তুমি? আমার কাছে কেন এসেছ?”
আদিত্য যেন তার কাঁপা হাতটাকে স্থির করার জন্যে দু দণ্ড সময় নিল, তারপর হাত তুলল।
কী আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে আদিত্যর চোখের দিকে আমার নজর পড়ল। ঘৃণায় দুটি চোখ জ্বলে যাচ্ছে। এমন ঘৃণা আমি আর কখনো দেখি নি। অকৃত্রিম পৈশাচিক ঘৃণা। এই ঘৃণার যেন শেষ নেই। কত কাল ধরে জমে জমে যেন পাথরের মতন কঠিন হয়ে গিয়েছে। তার ঘাড় এবং কাঁধ কী শক্ত বেয়াড়া ঘোড়ার ঔদ্ধত্যের মতন দেখাচ্ছিল। আদিত্যর ঠোঁট খুলে দাঁত বেরিয়ে এসেছে ভীষণ নির্মম নিষ্ঠুর দেখাচ্ছে। তার চোখ থেকে আমি দৃষ্টি সরিয়ে ওর হাতের ছোরার দিকে তাকালাম। ভগবান জানেন, এই রকম এক বিপজ্জনক মুহূর্তেও আমার কেন যেন মনে হল, আদিত্যর চোখ ওর হাতের ছোরার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর ধারালো। ওর ঘৃণায় কোনো দ্বিধা নেই, দুর্বলতা নেই, যেন আজন্মকাল নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতন ওটা ওর রয়েছে এবং দিন দিন বেড়ে উঠেছে। অথচ হাতের ছোরাটা হয় কিনে না-হয় কুড়িয়ে এনেছে, তেমন একটা নিশ্চিতভাবে ধরতে পারছে না।
ততক্ষণে আদিত্য আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রথম আঘাত হানল। আমি ডান হাত বাড়িয়ে বাঁচাতে গেলাম। ছোরার ফলা আমার হাতের আঙুলে লাগল। হয়ত আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। আদিত্য আবার মারল। এবারও ডান হাতের তালুতে লাগল। অসহায়ের মতন পিছু সরতে গিয়ে আমি সোফার ওপর বসে পড়লাম। আদিত্য পাগলের মতন তৃতীয়বার মারল। এবার বাঁ হাতে আটকাবার চেষ্টা করলাম। আমার হাত চিরে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল। শেষবারের মতন যখন সে মারছে তখন আমি মুখ বাঁচাবার চেষ্টা করছিলাম।
বোধ হয় আমি তখন আর্তনাদ করে বাড়ির লোকদের ডাকছিলাম। গলা উঠেছিল কি না জানি না, আদিত্য কী একটা বলল, হয়ত গালাগাল দিল : কাওয়ার্ড, ব্যাস্টার্ড, শালা— কী বলল কে জানে, আমার দিকে আর তাকাল না, পেছন ফিরে দ্রুত চলে গেল। তার পিঠ আমি দেখতে পেলাম।
আদিত্য চলে যাবার পর দু-এক মুহূর্ত আমার কোনো চেতনা ছিল না। তারপর ওই অবস্থায় প্রায় ছুটে জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম। জানলার এক দিকের শার্সি খোলা ছিল।
আমি যেন দেখছিলাম আদিত্য কোথায় যায়।
ধোঁয়া, কুয়াশা, খানিক অন্ধকার, খানিকটা টিমটিম আলোর মধ্যে আদিত্য রাস্তা দিয়ে পিঠ বেঁকিয়ে মাথা নীচু করে দ্রুত চলে যাচ্ছিল। রাস্তার আবর্জনা টপকে, একটা কুকুরকে ডিঙিয়ে যেতে যেতে মোড়ের মাথায় সে একটা প্রাইভেট বাসকে থামতে দেখল। বাসটায় ভিড় ছিল। ঠিক বাসটা ছেড়েছে, আদিত্য লাফ মেরে বাসের হ্যান্ডেল ধরে ফেলল। তারপর ঝুলতে ঝুলতে, আড়ালে চলে গেল।
ভগবান জানেন, আমার তখন কী হয়েছিল, আমি কেন বার বার তাকে ডাকতে চাইছিলাম: আদিত্য আদিত্য আদিত্য।
সারাদিন যা আমায় অস্থির, ভীত, ব্যাকুল করে রেখেছিল এখন তা খুঁজে পাওয়া গেল। ছেলেটিকে আমার মনে পড়েছে : আদিত্য। তার চেহারাও আমার কাছে আর অস্পষ্ট নয়। অবশ্য এখন আমার মনে হচ্ছে, সে সত্যর বন্ধু নাও হতে পারে— সুবিধের জন্যে একটা পরিচয় দিয়েছিল। এমন কি তার নামও হয়ত আদিত্য নয়, ওটা মিথ্যেও হতে পারে।
ওর নাম আদিত্য না হয় না হোক, ও সত্যর বন্ধু যদি নাই হল তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। কিছু তাতে আসে যায় না। কিন্তু ও যে সত্যি— এ আমি অনুভব করতে পারছি। আশাদের বিয়ে বাড়িতে গিয়ে সত্যর ওই ধরনের কোনো বন্ধুর মুখ হয়ত দেখেছি, হয়ত নয়। তাতেও কি যায় আসে।
খুবই আশ্চর্য যে, আদিত্য আমায় আহত করে চলে যাবার পর আমি জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখবার এবং ডাকবার চেষ্টা করছিলাম। কেন? আমি কি তাকে ডেকে, বা তার নাম ধরে চেঁচিয়ে পাড়া জাগাবার চেষ্টা করছিলাম? তাকে ধরে ফেলে। পুলিসের হাতে দেবার চেষ্টা করছিলাম? আমার মনে হল না, আমি সে চেষ্টা করেছি। আমার উদ্দেশ্য তা ছিল না।
তা হলে? তা হলে কেন আমি ডাকছিলাম আদিত্যকে?
কেন? কেন? আজ সারা দিন যেন এই কেনর জন্যে আমি মাথা খুঁড়েছি। সারা দিন আদিত্যকে মনে মনে কত খুঁজেছি।।
উলকি পরাবার একটু সরু তীক্ষ্ণ ছুঁচ যেন আমার মাথার মধ্যে, তারপর বুকের মধ্যে,. শেষে অস্তিত্বের মধ্যে বার বার— ফুটতে লাগল কেন? কেন? কেন?
অন্ধকারের কোথাও একটু আলোড়ন আসছিল না। কোথাও কিছু দপ্ করে ফুটে উঠছিল না। হায় ভগবান!
শেষে খুবই আচমকা, প্রায় যেন আদিত্যর ছুরি খাওয়ার সময় আত্মরক্ষার জন্যে যেভাবে আর্তনাদ করে উঠেছিলাম— অনেকটা সেইভাবে বললাম: হ্যাঁ, আমি তোমায় ডাকছিলাম। পুলিসে ধরিয়ে দেবার জন্যে নয়, পাড়ার লোক তোমায় তাড়া করে ধরুক— তার জন্যেও নয়। আমি তোমায় একেবারে অন্য কারণে ডাকছিলাম। আমি তোমায় বলতে চাইছিলাম, আমি তোমার চোখ দেখে বুঝেছি আদিত্য, তোমার ঘৃণায় খাদ নেই, একেবারে খাঁটি, বোধ হয় তার পরিমাপও নেই। তুমি আমায় কাওয়ার্ড বলেছ না? ইউ হ্যাভ কলড় মী এ ব্যাস্টার্ড, সান অফ এ বীচ। ইট ইজ অল রাইট; আই অ্যাম এভরিথিং। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড ইও্র হেটরেড্। জানো আদিত্য, আমি আমার হিসেবপত্র জানি : বাইরের খাতা নয়, ভেতরের খাতার কথা বলছি: আমি বাইরে যা রেখে যাব তাতে আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কষ্ট হবার কথা নয়। আমার নতুন বাড়ি হবে শীঘ্রি রিজেন্ট পার্কে, মিনুর বিয়েতে হাজার পঁচিশ খরচ করব ইচ্ছে আছে, সোনাটোনা বাদ দিয়ে হাজার দশ। ইন্দু খেপে খেপে সোনা কিনছে, চোরাই সোনাও। মিনু এর আগে একটা কেরাণী ছোকরার সঙ্গে মেলামেশা করার পর বুঝেছিল প্রেমট্রেম নিয়ে থাকলে তার কপালে পঁচিশ হাজার নেই। এখন তাই মুখ ঘুরিয়ে বকুলদের দিকে আসা-যাওয়া করছে; রঞ্জন ছেলেটির কেরিয়ার আছে। আমার বড় ছেলে সুহাসকে আমি ভাল জায়গায় দিয়ে যাব। আর ছোটটা— তার কথা আপাতত ভাবছি না। আমার রোজগারপাতি যে খারাপ নয়— বুঝতেই পারছ, মোটামুটি তিরিশ হাজার, ইনকামট্যাক্স রিটার্নে অবশ্য অত থাকতেই পারে না, থাকা উচিত নয়। ধরো পারচেজিং অফিসার দত্তগুপ্ত সপ্তাহে একবার করে খামটা আমার হাতের পাশে রেখে যায় সেটার হিসেব নিশ্চয় আমি দেব না। আমি বাস্তবিক কতটুকু আর বাইরে কাগজে-কলমে দেখাতে পারি বলো? সেটা সম্ভব নয়। ধরো, মিসেস বাগচীর কথা। মুখার্জি যখন মিসেস বাগচীকে নিয়ে রসিকতা করে তখন আমার খারাপ লাগে; মানে আমার খানিকটা ঈষা হয়। আসলে বাগচীর চেহারা-টেহারা নিয়ে যেটুকু সুখ সে আমিই আড়ালে চোখে চোখে অনুভব করতে ভালবাসি। আমাদের মধ্যে একটা আনটোলড স্টোরি আছে। না না, খারাপ কিছু নয়। যাই হোক, এটা সত্যি যে ইন্দুর জন্যে আমার ভালবাসার অভাব নেই।
আমি তোমায় কী যেন বলতে যাচ্ছিলাম, আদিত্য। হ্যাঁ— বলতে চাইছিলাম যে— আমি— আমার যে দিব্যি পায়ের তলায় কবর খুঁড়ে ফেলেছি তাতে সন্দেহ নেই। ইউ হ্যাভ এভরি রাইট টু হেট্ আস্। কিন্তু তোমায় আমি বলছি আদিত্য, তুমি একেবারে অ্যামেচার, তুমি জানোই না কোথায়— ঠিক কোন জায়গায় মারতে হয়। ইউ ডু নট না দি রাইট প্লেস। এ একেবারে যেখানে সেখানে এলোপাথাড়ি মার হচ্ছে। অকারণ, অনর্থক। এভাবে কী আমাদের মারা যায়?
কী জানি! আমি জানি না। আমার তো মনে হয়— তুমি আমার হাত পা জখম করতে, পেট ফাঁসাতে, মাথা ফাটাতে অনায়াসেই পারবে। হয়ত বুকের তলায় এক বিঘত ছুরি ঢুকিয়ে দিতেও পারবে। কিন্তু তুমি একটা জিনিস পারবে না।
সেটা যে কী, তুমি জানো না।
আমি ঠিক জানি না, কেন যেন এক বিশাল কান্না আজ আমার ছাপ্পান্ন বছর বয়সে এসে আমার সমস্ত বুক ভেঙে দিল। হ্যাঁ, আমি ছেলেমানুষের মতন কাঁদছিলাম। ইন্দু, মিনু, সুহাস— ওরা অঘোর ঘুমে।
আদিত্যর জন্যে না আমার জন্যে— কার জন্যে অন্ধকারে এই কান্না এল কে বলবে!