সে

সে

এ গল্পটা ভূতের নয়৷ প্রেমেরও নয়৷ এবং, গল্পটা ভূতের এবং প্রেমের৷ কী? সব গুলিয়ে যাচ্ছে? আসলে, রহস্যের গোপন গুহার পাথরচাপা অন্ধকারে যে অনাস্বাদিত অলৌকিক রূপকথার জন্ম, এ গল্প তারই বহিঃপ্রকাশ৷

এডগার অ্যালেন পো-র উক্তি মনে পড়ছে— The boundaries which divide life from death are at best shadowy and vague. We shall see, where the one ends, and the other begins.

জীবন ও মৃত্যুর সীমারেখাগুলি আসলে অস্পষ্ট, ছায়াময়৷ কে বলতে পারে, কোথায় একটা শেষ হয়ে আরেকটা শুরু হয়ে যাবে?

আমি হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠে পড়তেই একটা শিসের মতো শব্দ করে ট্রেনটা গতি নিল৷ যেন আমার উঠবার জন্যই অপেক্ষা করছিল৷ আমি বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলাম; একটু আগেই গোটা হাওড়া স্টেশন জুড়ে যেরকম ইঁদুরদৌড় দৌড়ালাম তাতে আর একটু হলে প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া হয়ে যাচ্ছিল আর কী! হৃৎপিণ্ডটা এখনও গরম হয়ে আছে৷ দরজার মুখটা ছেড়ে আমি ট্রেনের ভিতরের দিকে চলে এলাম৷ কামরাটা মোটামুটি ফাঁকা৷ এসময় আপের ট্রেন সাধারণত ফাঁকাই থাকে৷ আমার বাঁদিকে জানলার ধারে বছর পঞ্চাশেকের এক বাঙালি ভদ্রলোক বসে আছেন, চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন৷ তার উলটোদিকের জানলার ধারটা ফাঁকা৷ ডানদিকে কতগুলো অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে পা ছড়িয়ে বসে কীসব যেন আলোচনা করছে, তাদের সবার গায়ে ইউনিফর্ম৷ আমি সেদিকে আর না তাকিয়ে বাঁদিকে জানলার ধারে এসে বসলাম৷ বাঙালি ভদ্রলোক একবার আমার দিকে তাকিয়েই আবার মুখ ফিরিয়ে নিলেন, চা-টা এমনভাবে বাগিয়ে ধরলেন যে মনে হল তাঁর হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নেবার মতলবেই আমি এখানে এসে বসেছি৷ লোকটা এত মন দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যে দেখছে কে জানে; ট্রেনটা এখনও গতি নেয়নি, শিস দিতে-দিতে চাকায় খরাং-খরাং আওয়াজ করতে-করতে গড়াচ্ছে৷ ভাব দেখলে মনে হয় যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে৷ দৌড়ানোর ইচ্ছা মোটেও নেই, বরঞ্চ আজ খালি হুইসেল দিয়েই দিন কাটাতে চায় সে৷ পিঠের ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে জল খেলাম৷ সাথে একটা গল্পের বইও এনেছি৷ গল্পে-উপন্যাসে পড়েছি দূরপাল্লার ট্রেনে উঠলে নাকি গোটা রাস্তাটা খোশগল্প করে কাটানোর মতো সহযাত্রী জুটে যায়৷ আমার তো কই একবারও তেমন হয়নি৷ সামনে যদি নিত্যযাত্রী বসে, তাহলে চশমার উপর দিয়ে এমন শ্যেনদৃষ্টিতে তাকায় যে মনে হয় এই বুঝি টিকিট দেখতে চাইবে৷ আর অনিয়মিত যাত্রী বসলে সারাক্ষণ এই টেনশনেই কাটিয়ে দেয় যে এই বুঝি তার স্টেশন এসে চলে গেল৷ আজও সামনে তাকিয়ে খোশগল্পের কোনও আশা দেখলাম না৷ ব্যাগ থেকে বইটা বের করতে যাচ্ছি, এমন সময় সামনে থেকে একটা ভারী গলা ভেসে এল, ‘আপনি কদ্দূর?’

আমি ব্যাগের মুখ অবধি তুলে আনা বইটা আবার ভিতরে চালান করে সামনে তাকিয়ে জবাব দিলাম, ‘শিমুলপাহাড়৷ আপনি?’

‘ওই কাছেপিঠেই৷’

আড় চোখে দেখে নিলাম লোকটার চা শেষ হয়েছে৷ কী আশ্চর্য! সেটার জন্যই এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিল নাকি? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে লোকটা নিজে থেকেই আবার প্রশ্ন করল, ‘এ লাইনে বড় একটা যাওয়া-আসা হয় না, তাই তো?’

আমি মাথা দোলালাম, ‘বছরে একবার৷’

‘হু, ওই জন্যই চেনা মুখ নয়; আরও দু-একজন হলে তাসটা বের করা যেত৷ এখন এতটা রাস্তা, কী করি বলুন তো?’

আমি চারপাশে তাকালাম, কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েগুলো এখন আর গল্প করছে না৷ যে যার নিজের মতো লম্বা খাতা খুলে কোলের উপর রেখে নোট মুখস্থ করছে৷ আমি হাসলাম, ওই বয়সটা পেরিয়ে এসেছি তাই জানি, একটা সময় খাতাগুলো মূল্যহীন হয়ে থেকে যাবে; চারপাশের তাস খেলার বন্ধুরাই মিলিয়ে আসবে৷

‘শিমুলপাহাড় তো গ্রাম মশাই৷ কোনও আত্মীয়ের বাড়ি নাকি?’

লোকটা যে লাইনে প্রশ্ন করছে তাতে একটু পরেই আমাকে একটা গল্প বলতে হবে৷ অবশ্য সেটা যে আমার খারাপ লাগে তাও নয়৷ বললাম, ‘নাহ, একজনের সাথে দেখা করতে৷’

‘প্রতি বছরই যান?’

‘হুম, প্রতিবছর৷ এই আজকের দিনেই৷’

বুঝলাম লোকটার চোখ ছানাবড়া হতে আর বেশি দেরি নেই৷ মোক্ষম প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত করে ফেলবেন কি না ভাবছি, সাথে-সাথেই প্রশ্নটা গুলির মতো ছুটে এল৷

‘কে আছে বলুন তো ওখানে৷ বছরে মাত্র একদিন দেখা করেন!’

‘আমার এক পরিচিতা৷ আজ থেকে পাঁচ বছর আগে সে মারা গেছে৷’

আমার উত্তরের প্রায় সাথে-সাথেই এতক্ষণ দুলকি চালে চলতে থাকা ট্রেনটা গতি নিল আর আমার সামনে বসে থাকা লোকটার চোখও ছানাবড়া হয়ে গেল৷

শীতকাল, তাই দুপুরের রোদ গায়ে এসে পড়লেও একটুও বিরক্তি লাগছে না৷ রেল লাইনের দু-পাশের কয়েকটা সাহসী গাছের ডাল মাঝে-মাঝে জানলার ভিতরে ছোবল মেরে যাচ্ছে৷ আমার সহযাত্রী থেকে-থেকে আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছেন৷ আমি যে তাঁর সাথে মজা করিনি সেটা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন বোধহয়৷ কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কি না ভেবেই ইতস্তত করছেন৷ শেষে থাকতে না পেরে বললেন, ‘আপনি কি তান্ত্রিক নাকি মশাই?’

প্রশ্নটা শুনেই আমি হোহো করে হেসে উঠলাম, বললাম, ‘বলেন কী! একেবারে তান্ত্রিক ভেবে বসলেন! আমি একটা আইটি কোম্পানিতে সফটওয়্যার ডেভলপারের কাজ করি, কম্পিউটার নিয়েই কাজ, তন্ত্র-ফন্ত্রের ধার কাছ দিয়েও যাই না৷’

‘তবে যে বললেন মরা মানুষের সাথে দেখা করেন৷’ ভদ্রলোক এবার বোধহয় আমাকে কাপালিক ছেড়ে পাগল ভাবছেন৷

‘দেখা করি তো বলিনি, বলেছি দেখা করতে যাচ্ছি৷’ আমি হাসি থামানোর চেষ্টা করলাম৷

‘কেন?’

ভদ্রলোকের কৌতূহল এবার বোধহয় আলটাগরা ছেড়ে মাথায় উঠেছে, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের ধারই ধারছেন না৷

‘তাহলে আপনাকে একটা গল্প বলতে হয়৷’

‘ভূতের গল্প?’

এবার আমার ঠোঁটের কোনায় একটা আলগা হাসি ফুটে উঠল, ‘একেবারেই না৷ প্রেমের৷’

সহযাত্রী একটু হতাশ হলেন৷ পানসে মুখে বললেন, ‘বেশ, তাই বলুন৷’

ভাবখানা এমন যেন তাকে গল্প শুনিয়ে মনোরঞ্জন করার জন্যই রেল দপ্তর আমাকে পাঠিয়েছে৷ যাই হোক, আমার চোখের সামনে থেকে তখন ট্রেনের জানলার দ্রুতগামী দৃশ্য মুছে গিয়ে ফুটে উঠছে একটা শান্ত দুপুর৷ আমাদের নতুন কেনা বাড়ির দোতলায় মা ঘুমাচ্ছেন৷ বাইরে একটা অচেনা পাখি চকর-চকর করে ডেকে চলেছে; আমার সামনে খোলা ভূগোল বইটা৷ এ দুপুরটা আমি কোনওদিন ভুলব না৷ আমি ভুলতে পারব না৷ আমি ভুলতে চাই না৷

বইটার দিকে যতবার মন দিতে যাচ্ছি ততই মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠছে৷ কাল সকালেই হিমন স্যার একটা পঞ্চাশ নম্বরের পরীক্ষা নেবে, আর আমি ভূগোল কিছুই জানি না৷ বইয়ের পাতাগুলো জন্মদিনে পাওয়া গিফটের মতোই রহস্যময়৷ কী যে লেখা আছে কিছুই জানি না৷ শুধু এটুকু জানি সেটা আমাকেই খুলতে হবে৷ ওফ! কেউ কি আমার হয়ে একটু পড়ে দিতে পারে না? মাথা কাজ না করলেই এইসব অবান্তর চিন্তা মাথায় আসে৷ পাশেই স্কুলের ব্যাগটা পড়ে ছিল৷ সেটা টেনে নিয়ে তার ভিতরে হাত চালালাম, কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করলাম, অনুভব করলাম৷ তারপর সেটা বের করে নিয়ে বেড়ালের মতো চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে একবার মায়ের ঘরে উঁকি দিলাম৷ নাহ৷ এখনও ঘুমাচ্ছেন৷ বুকের উপর কথামৃতটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে৷ সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে আমি ছাদে চলে এলাম৷ আমাদের ছাদটা খুব একটা বড়সড় নয়৷ ন্যাড়া ছাদ; একধারে ঠিক লাগোয়া পাশের বাড়ির ছাদ, সেটারও এখনও পাঁচিল তোলা হয়নি৷

দুপুরের শান্ত পাড়া যেন ঝিমিয়ে আছে, আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলাম, সাথে দেশলাইটাও৷ যদিও দোতলায় কেউ নেই, তবুও নীচে সিগারেট খেতে ভয় লাগে আমার৷ গন্ধে মা ঠিক বুঝে ফেলবে৷ একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই৷ ছাদের দরজাটা আরেকবার তদন্ত করে নিয়ে সিগারেটটা ঠোঁটের কোণে ধরে সবে দেশলাইটা জ্বালাতে যাচ্ছি, এমন সময় কোত্থেকে একটা মিহি অথচ ভারীক্কি গলা শুনে থমকে গেলাম, ‘এই এই, কী হচ্ছে ওটা?’

সামনে তাকিয়ে দেখি পাশের বাড়ির ন্যাড়া ছাদে একটা বছর পনেরোর মেয়ে কোমরে হাত রেখে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ দেখেই আমার গা-টা রি-রি করে জ্বলে উঠল৷ নেহাত পাশের বাড়ির ছাদে ছিল, না হলে ঠাস করে চড়িয়ে দিতাম৷ গলা উঁচিয়ে বললাম, ‘কিসের কী হচ্ছে?’

‘তুই বিড়ি ফুঁকছিলি?’ সে ছাদের ধারের দিকে খানিকটা এগিয়ে এল৷

‘বেশ করছিলাম, তোর কী তাতে?’ কেন জানি না সিগারেট-সহ হাতটা কোমরের পিছনে লুকিয়ে পড়ল, নিজে থেকেই৷

‘ইহহ, লুকিয়ে-লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকে আবার রোয়াব নেওয়া হচ্ছে! দেব কাকিমাকে বলে৷’

এইটারই ভয় পাচ্ছিলাম৷ মেয়েটার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বলে দেওয়াটা তার পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক কিছু না৷ কিন্তু নিজের দুর্বল জায়গাটা কোনওমতেই শত্রুপক্ষকে দেখানো উচিত না৷ বিশেষ করে এরকম হিংসুটে মেয়েদেরকে৷

‘বিড়ি কোথায়? সিগারেট খাচ্ছিলাম, আর লুকিয়ে খাচ্ছিলাম তোকে কে বলেছে?’

‘তো আমাকে দেখেই ওটা লুকিয়ে ফেললি কেন?’

আমি হাতের কাছেই একটা মোক্ষম উত্তর খুঁজে পেলাম, ‘বাচ্চাদের সামনে সিগারেট খাওয়া ঠিক না৷’

আমার উত্তরটা শুনে মেয়েটার লালচে মুখ আরও লাল হয়ে উঠল; গলাটাকে ভীষণ রকম উপরে তুলে এমন ভাবে ‘দাঁড়া’ বলল যে মনে হল বাংলা বর্ণমালায় ড-য়-শূন্য-র এর থেকে আরও শক্তিশালী র থাকলে ভালো হত৷

‘দাঁড়া, হচ্ছে তোর৷ আজই কাকিমাকে…’

কথাটা কিন্তু পুরোটা শেষ করল না সে৷ আমার শরীরের পাশ দিয়ে কিসের উপর যেন দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে তার, সেটা অনুসরণ করে পিছনে তাকাতেই আমি কারণটা বুঝতে পারলাম৷ আজ সকালেই ছাদে শতরঞ্চি পেতে কাসুন্দি শুকাতে দিয়েছে মা, বয়ামটার দিকে তাকিয়েই থেমে গেছে মেয়েটা৷ তার মুখ দেখে বুঝলাম মনে-মনে কিছু একটা ফন্দি আঁটছে৷ এবার আমার ভুরু কোঁচকানোর পালা৷ ‘কী দেখছিস ওদিকে? অ্যাঁ?’

‘ওটা কি কাসুন্দি?’

‘কোনটা বলত?’ আমি সদ্য ডিম ফুটে বেরনো কাকের ছানার মতো এদিক-ওদিক তাকালাম, ‘ও হ্যাঁ, ওটা তো কাসুন্দিই৷’ একপাশে সরে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ কোমরের পিছন থেকে সিগারেট সহ হাতটা বেরিয়ে এল, নিজে থেকেই৷ জীবন বিজ্ঞান বইতে কী যেন একটা লেখা ছিল, আমি মনে করার চেষ্টা করলাম৷

‘যা তোকে মাফ করে দিলাম৷’ মেয়েটা আমার উপর দয়া দেখাল৷

আমি মনে-মনে জীবন বিজ্ঞান বইয়ের ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করলাম৷ কী যেন একটা নাম, মটর গাছে না কী যেন…

‘এখনও শুকোয়নি?’ মেয়েটা জিজ্ঞেস করল৷

‘কী জানি, চেখে দেখতে হবে৷’ মটর না, সিম নিয়ে কিছু লেখা ছিল মনে হচ্ছে৷ সিম, পেটে আসছে মুখে আসছে না৷

‘ওখান থেকে সরে যা, আমি ঝাঁপাব৷’ কথাটা শুনেই আমার এতক্ষণের ভাবনাচিন্তা গুলিয়ে গেল৷ মেয়েটা বলে কী! দুটো ছাদের মধ্যে অন্তত মিটার দুয়েকের ফাঁক আছে, লাফিয়ে সেটা পেরনো অসম্ভব নয় বটে, কিন্তু মেয়েটার বয়স অল্প, একবার পা পিছলোলে দোতলা ছাদের উপর থেকে নীচে৷ কংক্রিটের মেঝের উপর গিয়ে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না৷ আমি হাঁ-হাঁ করে উঠলাম৷ ‘তুই কি পাগল? নীচে পড়ে মরার শখ হয়েছে?’

সে আমার কথা কানেই নিল না৷ দু-হাতে জামার নীচের দিকটা তুলে হাঁটুর উপরে বেঁধে নিল৷ আমার দিকে হাত নাড়িয়ে এমনভাবে ‘সর, সর’ বলল যেন কাক তাড়াচ্ছে৷ আমার বুকের ভিতর তখন গরম তেলের ফোঁটা পড়ছে, এর থেকে মাকে বলে দিলেই ভালো হত৷ নিঃশ্বাস বন্ধই ছিল, মেয়েটা ঝাঁপ দেবার ঠিক আগের মুহূর্তে চোখটাও বন্ধ করে নিয়েছিলাম৷ খুলতে দেখলাম সে সামনে নেই, পিছন থেকে চাকুম-চুকুম আওয়াজ শুনে বুঝলাম আমাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়েই কাসুন্দি শুকিয়েছে কি না তদন্ত করছে সে৷ তার দিকে তাকাতেই আমার একটু আগের শব্দটা মনে পড়ে গেল৷ সিম্বায়োটিক, Symbiotic৷ কিন্তু সে শব্দটা এই মুহূর্তেই কেন মনে পড়ল জানি না৷ লাইফ সায়েন্স বইতে পড়েছি বটে কিন্তু মানেটা আর মনে নেই৷ আমি শতরঞ্চিতে তার পাশে গিয়ে বসলাম৷ মেয়েটার মুখ রোদের তাপে লাল হয়ে আছে৷ চুলগুলো মুখের সামনে দুলছে, খেতে এতটাই মগ্ন যে সেগুলো সরানোরও সময় পাচ্ছে না৷ আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, ‘মা এখন আসবে না৷ শান্তিতে খা৷’

সে আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল৷ তারপর পা ছড়িয়ে বসে বয়ামটা কোলের উপর তুলে নিল৷ সেই প্রথম ভালো করে দেখেছিলাম তাকে৷ খুব যে সুন্দরী তা নয়৷ ফর্সা গায়ের রং, নাকটা বোঁচাই বলা যায়৷ কপালের একপ্রান্তে চুল শুরু হবার ঠিক আগে একটা সাদা দাগ আছে৷ তার কোনও দিকে না তাকিয়ে একমনে চাকুম-চুকুম চিবানোটা দেখতে ভারী মজা লাগছিল৷ শরীরটা পিছনে হেলিয়ে দুটো হাতে ভর দিয়ে বসে সেটাই দেখছিলাম আমি; জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতটা লাফালি, ভয় করল না?’

সে আমার দিকে তাকিয়ে কৌতুকের গলায় বলল, ‘ধুর, আমি তোর মতো ভীতু নাকি?’

আমার আর তার সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছিল না৷ হয়তো হার মেনে নেবার একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি তখনই হয়ে গেছিল৷ খেয়ে-দেয়ে সে শতরঞ্চির উপরেই শুয়ে পড়ল হাত-পা ছড়িয়ে৷ নীল ভরাট আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বলল, ‘মাঝে-মাঝে জানতে ইচ্ছা করে আকাশটার শেষ কোথায়?’

‘আধ বয়াম কাসুন্দি সাবড়ে দিলে ওরকম অনেক চিন্তা মাথায় আসে৷’ আমি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিলাম৷

সে মুখটা আরেকদিকে ফিরিয়ে নিল৷ একটু থেমে বলল, ‘কাল আমার বিড়ালটা মরে গেছে৷’

‘কোনটা? ওই খয়েরি মোটা হুলোটা?’

‘হুঁ৷’

আমি আর কিছু বললাম না, সে একটানা আকাশের এদিক-ওদিক চাইতে লাগল৷ বোধহয় তার হুলোটাকেই খোঁজার চেষ্টা করছিল৷ প্রায় মিনিট পাঁচেক এভাবে কাটল৷ ঠিক তারপরেই এমন আশ্চর্য একটা ব্যাপার ঘটল যে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল৷ ছাদের ঠিক বাইরের কার্নিস থেকে মোটা গলায় ডেকে উঠল একটা বেড়াল৷ মেয়েটা প্রায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ল শতরঞ্চি থেকে৷ অন্য সময় হলে ব্যাপারটা খেয়ালই করতাম না, কিন্তু ডাকটা এমন আচমকা শোনা গেছে যে আমার মনে হলো এটা সেই মরা বেড়ালটাই, তার মালকিনকে ডাকছে৷ ছাদ থেকে কার্নিসটা দেখা যায় না৷ অবশ্য একটু চেষ্টা করলে লাফিয়ে তার উপর নামা যায়৷

মেয়েটা ছাদের ধারটা ধরে তড়তড় করে নীচে নেমে গেল৷ আমি জানতাম বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও লাভ নেই৷ চারপাশে তাকালাম, পাশের বাড়িগুলোর জানলা বন্ধ৷ রাস্তাঘাটও ফাঁকা৷ হঠাৎ নীচে থেকে একটা হাত উঠে এল, ‘উঠতে পারছি না, ধর আমার হাতটা৷’ আমি একটা হাত ধরে টান দিতে আর একটা পা ছাদের উপর দিয়ে উপরে উঠে এল মেয়েটা৷ উপরে আসতে দেখলাম তার জামার নীচের দিকে কিছু একটা বাঁধা আছে৷ জামার ধুলো ঝেড়ে নিয়ে আস্তে-আস্তে সেটা বার করল সে, একটা সদ্যোজাত বেড়ালের বাচ্চা৷ আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘মা-টা ডাকছিল৷ দেখ, এখনও চোখ ফোটেনি৷’

মেয়েটার হাতের ভিতর শুয়ে খুব মিহি স্বরে মিউ মিউ করে ডাকছে ছানাটা৷ সেটাকে মুখের কাছে এনে তার কানে-কানে কী যেন বলল মেয়েটা৷ আমি ডান হাতের তর্জনীটা বিড়ালছানার মুখের কাছে ধরতেই তার দাঁতটা আমার আঙুলে লেগে গেল৷ আমি হাত সরিয়ে নিলাম৷ মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল, ‘বলেছিলাম তুই ভীতু’৷ তারপর আমার হাতটা টেনে নিয়ে সযত্নে সেটা রাখল বিড়ালের গায়ে, ছোট-ছোট লোমগুলো আমার আঙুলের ডগায় স্পর্শ করতে কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগল৷

‘কী সুন্দর না?’

‘হ্যাঁ৷’

আমার উত্তরটা হয়তো সেদিন সে বোঝেনি৷ আমার শরীরটা শিরশির করছিল, তবে সেটা বেড়ালের লোমে নয়৷ বাচ্চা মেয়েটার কাসুন্দিমাখা তুলতুলে হাতটা তখনও ধরেছিল আমার কবজির কাছটা৷ শক্ত করে৷

ট্রেনটার আজ কী মতলব কে জানে, আমি কথা শেষ করার প্রায় সাথে- সাথেই এত জোরে একটা ঝাঁকুনি দিল যে আমার সামনে বসে থাকা ভদ্রলোক প্রায় ছিটকে আমার গায়ে এসে পড়ল৷ আমার কনুইটা ঠুকে গেল পিছনের দেওয়ালে৷ কোনওরকমে সামলে নিয়ে কনুইটা ঘষতে-ঘষতে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম হুগলি স্টেশন এসেছে৷ প্লাটফর্মে অল্প কিছু ফেরিওয়ালা ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে৷ এই ভরদুপুরে স্টেশনগুলো সাধারণত ফাঁকাই থাকে, তাই চা, কমলালেবু আর ম্যাগাজিনওয়ালাদের মধ্যেও বেশ গল্প করার মেজাজ৷ খানিকটা দূরে একটা জুতোপালিশ মুখ চুন করে একা বসে আছে৷ সম্ভবত সে হিন্দুস্থানি, তাই বাঙালিদের আড্ডায় ঠেক পায়নি৷ আমার এতক্ষণের শ্রোতার সাথে তার মুখের বেশ মিল পেলাম৷ ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ আমি তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল মশাই, বোর হয়ে গেলেন নাকি?’

‘না, তা নয়৷ তবে ভাবছিলাম আমার জীবনটা পানসে হয়েই কেটে গেল৷’ আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রলোক মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিলেন৷ আমি বাইরে তাকিয়ে বললাম, ‘আমারটাও তাই৷ একটু আগে ডোবার উপর একটা লাল রঙের ভাঙা ব্রিজ পড়ল, দেখেছেন? অর্ধেকটা এসে আর নেই৷ ঠিক ওরকমই, একটা সময়ের পর থেকে আর মনে করার মতো কিছু নেই৷’

‘হুমম… আচ্ছা আপনি তারপর বলুন৷’

আমি মুখ খোলার সাথে-সাথে ট্রেনটা আবার গতি নিল, কনুইয়ের ব্যথাটা কাল সকালে ভোগাবে৷

ছাদটা ছিল আমাদের কথা বলার জায়গা৷ দুপুরে মা ঘুমিয়ে পড়লেই আমি উপরে চলে আসতাম৷ কোনওদিন সে আগে আসত; কোনওদিন আমি৷ জানি না কেন আমার সিগারেট খেতে আর ইচ্ছা করত না, ওরও কাসুন্দিতে অরুচি ধরে গেছিল৷ মাঝে-মাঝে মা ঘুম থেকে উঠে পড়লে আমাকে ডাকত৷ কথাবার্তা সেদিনকার মতো সেখানেই ইতি৷ সে বছর বর্ষাটা জাঁকিয়ে এল, মাঝে-মাঝে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালেই টিপটিপ করে বৃষ্টির ছাঁট লাগে গায়ে, সাথে-সাথে নীচ থেকে চিৎকার ভেসে আসে, ‘বাবু বৃষ্টি পড়ছে, জামাকাপড়গুলো তুলে নিয়ে নীচে আয়৷’ আমি ভিজব বলে বায়না করলে মা বলত, ‘এইরকম ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগে৷ সামনে পরীক্ষা’৷ আমি মুষলধারা বৃষ্টির আসায় চাতকের মতো চেয়ে থাকতাম আকাশের দিকে; সেটা কোনওদিন নামেনি৷ বর্ষা পেরিয়ে শরতের একটা ভোর, সকাল থেকে ড্যাং-ড্যাং করে ঢাক বাজছে৷ আমাদের বাড়ির পিছনেই ছোট একটা ডোবা মতো ছিল, সেটার উপর এত কাশফুল ফুটেছিল যে মনে হত শহরের সমস্ত বালিশ-তোশক কেউ ফর্দাফাই করে সেখানে জড়ো করেছে৷ শুধু তাদের জেগে থাকা মাথাগুলো হাওয়ায় দুলে ওই ঢাকের তালের ড্যামকুড়াকুড় নাচত৷ জানলায় দাঁড়িয়ে সেই নাচ দেখছিলাম, এমন সময় দেখি কে যেন সেদিক দিয়ে হেঁটে গেল৷ এপাশটায় সাধারণত কেউ আসা-যাওয়া করে না৷ তাই প্রথমে খানিকটা চমকে গেলেও পরে বুঝলাম এটা অন্য কেউ নয়৷ কিন্তু জলা ডোবাটার কাছে করছেটা কী? আমি যে জানলায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা কীভাবে জানি বুঝে গেল সে, আমার দিকে তাকিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকল৷ হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে গোপন কিছু করতে চলেছে৷ যাই হোক আমি নীচে নেমে এলাম৷ এতক্ষণে সে কিন্তু আমার জন্য দাঁড়িয়ে নেই, বরঞ্চ বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে৷ আমি দৌড়ে তার পাশে চলে এলাম৷ ‘করছিস কী এখানে? জঙ্গল তো চারদিকে…’ আমি বিরক্তি প্রকাশ করলাম৷

‘এখানে একটা ডাইনি থাকে৷’ সে ফিসফিস করে বলল৷

আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম সে ভুরু কুঁচকে তাকাতে থেমে গেলাম৷ এইসময় ছেলেমানুষি আদিখ্যেতা আমার একদম পছন্দ নয়৷ বয়স অনুযায়ী মানুষের বড় হওয়া উচিত, চিন্তাভাবনায় গাম্ভীর্য আসা দরকার৷ বিকেলের সাথে-সাথে আলোটাও কমে আসছে৷ জলার উপরে বেশ খানিকটা অন্ধকার জমা হয়েছে৷ আসার সময় ঘরের জানলাটা বন্ধ করে এসেছি, না হলে এইসময় আমাকে এখানে ঘুরতে দেখলে বাড়ি ফিরে পিঠের হাড়গুলো নিজেই খুঁজে পাব না৷ জলার উপরে খসখস শব্দ হতেই সে দাঁড়িয়ে গেল৷ আগের মতোই ফিসফিসে গলায় বলল, ‘এবার বিশ্বাস হল তো?’

‘এর মধ্যে বিশ্বাসের কী আছে, আওয়াজ কি হতে পারে না?

আমার কথাটার বিশেষ গুরুত্ব দিল না সে৷ কাশবনের ধারে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল৷

‘ডাইনি দেখছি বজ্রাসন ছাড়া পূজা নেন না’ আমি হাসলাম৷

‘আপনি কি এসেছেন?’

ভাগ্যিস মেয়েটা সংস্কৃত বলতে পারে না, না হলে ওই ভাষায় বললে

আমি বুঝতে পারতাম না৷

ডাইনি কিন্তু মূক; খালি কাশের বন থেকে একটা শনশন হাওয়ার স্রোত ভেসে এসে তার কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিল৷

মিনু এখন কোথায় আছে?

ওহো, এখানে বলে রাখি মিনু হল সেই মরা হুলোটা৷ বেচারি এখনও তার শোক ভুলতে পারেনি৷

‘যে মারা যায় সে আর ফেরে না, এটা জানার মতো বয়স হয়েছে তোর৷’

আমি তার পাশে এগিয়ে গেলাম৷ লক্ষ করলাম তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে৷ মুখের কোণে যেন হালকা হাসির ছোঁয়া৷ চোখের জলটা তো বুঝলাম, কিন্তু হাসিটার মানে কী! আমি একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম৷ চোখে পড়ল একটু দূরেই কাশের উপর একটা পুরনো ছেঁড়া কাপড় পড়ে আছে, নরম কাশে মাখামাখি হয়ে অনেকটা মানুষের মতোই দেখাচ্ছে৷ বুঝলাম ডাইনির এখানে বাসা বাঁধার কারণ৷ হঠাৎ আমি চমকে উঠলাম, কাপড়টা নড়ে উঠল না? আমিও ভুল দেখছি নাকি? আমি তার কাঁধ ধরে ঠেলা দিলাম৷ ‘সন্ধে হচ্ছে, উঠে আয়৷ মা বকবে এবার৷’

‘তোর ভয় লাগলে তুই যা, ভীতু একটা৷’

আমি কী করব বুঝতে পারলাম না৷ একটু পরেই এখানে মশার ঝাঁক এসে হানা দেবে, সেই অচেনা হাওয়ার স্রোতটাও শক্তিশালী হচ্ছে, আমাদেরকে ঘিরে যেন পাক খাচ্ছে সেটা৷ এই আদাড়ের ঝোপে এত হাওয়া দেয়? আমি তার কাছে আরও খানিকটা সরে এলাম৷

‘মিনুকে আবার কী করে দেখব?’ এবার তার গলাটা আকুতির মতো শোনাচ্ছে৷ হাওয়ার তেজ ক্রমশ বেড়ে চলেছে৷ আমার মাথা ঘুরতে লাগল, বসে পড়লাম৷ তার প্রশ্নের ঠিক সাথে-সাথে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেল, হাওয়ার টানে কাশের বন থেকে সেই ছেঁড়া কাপড়টা উড়ে এসে পড়ল তার কোলের উপরে৷ তারপর হঠাৎ যেন কোথা থেকে প্রাণ পেল সেটা, তার গোটা শরীরের উপর খেলা করতে লাগল, যেন কানে-কানে কিছু বলতে চায়৷ ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছিল৷ দু-হাতে চোখ ঢেকে ফেললাম, ভাবলাম দৌড়ে পালাই৷ হঠাৎ মনে হল সে খিলখিল করে হাসছে৷ কী ব্যাপার! আমি কি ভুল দেখছি? ভুল শুনছি? স্বপ্ন দেখছি নাকি? হাওয়ার স্রোত এসে আমাকে আছড়ে ফেলতে চাইল, কিন্তু পারল না৷ হঠাৎ খেয়াল হল তার ডান হাতটা সজোরে চেপে ধরেছে আমার বাঁ হাতের কজিটা, অর্থাৎ আমার পালানোর উপায় নেই৷ আমার অসহায় লাগল৷ একটু পরে হাওয়ার তেজ নিজে থেকেই কমে এল, তার গা থেকে খসে পড়ল কাপড়টা৷ সে উঠে দাঁড়াল, তারপর আবার আগের মতো নিরুত্তাপ মুখ করে বলল, ‘চ ভীতু, মশা কামড়াবে এইবার৷’

আমি কোনওরকমে মুখে কথা এনে বললাম, ‘কী হল এতক্ষণ?’

‘দেখতেই তো পেলি৷ ডাইনির সাথে কথা বললাম৷’

সমস্তটা আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, তাও জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বলল ডাইনি তোকে?’

এবার সে আমার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল,

‘ভীতুদের বলতে বারণ আছে৷’

‘কে বলেছে আমি ভীতু?’

‘তুই ভীতু৷’

‘ধুর, বল না৷’

‘বলল মিনুকে আমি আবার দেখতে পাব৷’

‘কী করে?’

তার চোখমুখ থমকে গেল, সে দাঁড়িয়ে গিয়ে ভয়ার্ত মুখে বলল, ‘তোর পিছনে একবার তাকা৷’

‘কেন?’ আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম৷

‘কেউ এসে দাঁড়িয়েছে৷’

নিঃশ্বাস বন্ধ করে পিছনে তাকালাম আমি; কেউ নেই, ফাঁকা৷ সাথে- সাথে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখলাম সে নেই৷ কাশবনের রাস্তা ছেড়ে একটু দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে নূপুরের শব্দ৷ তার কাছেই আমি শিখেছিলাম যে আমাদের জানাশোনা গাণিতিক সূত্রে বাঁধা জগতের বাইরে আরও কিছু আছে, অবশ্য তার চাবিকাঠিটা আমাকে সে দিয়েছিল অনেক পরে৷ হয়তো আমি যোগ্য ছিলাম না৷ তাও…

তো তারপর পুরোদমে স্কুল শুরু হয়ে গেল, আর দেখা হত না৷ গোটা দুপুর স্কুলেই কাটত৷ স্কুল থেকেই টিউশন৷ কখনও তাকে দেখতে না পেলেও তার ছায়াটা দেখতাম৷ যখনকার কথা বলছি তখনও এত ইনভার্টারের ছড়াছড়ি হয়নি৷ সন্ধ্যাবেলা লোডশেডিং হলে আমরা গোটা পাড়ার লোক যে যার ছাদে হাওয়া খেতে চলে আসতাম৷ বাবা-মা আমি মেজকাকা সবাই মিলে ছাদে বসে গল্প করতাম৷ পাড়ার বুড়ো দারোয়ানটা বেসুরো গলায় ভজন গাইত, ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল পার কর আমায়৷’ আমার মন কিন্তু সেদিকে থাকত না, পাশের বাড়ির ছাদেও তখন অনেকের গলা পেতাম৷ আমি তার মাঝেই ঠিক খুঁজে নিতাম তার গলাটা৷ নিজেরটা শোনানোর জন্য ইচ্ছা করে প্রায় চিৎকার করে কথা বলতাম৷ কথা বলতে-বলতে সে উঠে এসে দাঁড়াত ছাদের কিনারায়, চাঁদের অল্প আলোয় দেখতে পেতাম তার ছায়ামূর্তি৷ আমিও উঠে দাঁড়াতাম৷ দুটো অন্ধকার ছায়া একে অপরের অন্ধকারের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকত কিছুক্ষণ৷ যাই হোক, এরকমই একটা লোডশেডিংয়ের রাত৷ আমরাও যথারীতি গল্প করছি ছাদে; পাশের বাড়ির ছাদ থেকে কিন্তু কোনও আওয়াজ আসছে না৷ আমার কেমন যেন একটা আশঙ্কা হল৷ ওরা কি কেউ বাড়ি নেই? কিন্তু তাই বা কী করে হয়! আজ বিকেলেই দোতলার ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছি৷ ব্যাপারটা অবশ্য তেমন বড় কিছু নয়, তাও আমার মনের মধ্যে কেমন যেন অস্থিরতা শুরু হল৷ মা-কে বলে নীচে নেমে এলাম৷ বাড়ির বাইরে এসে রাস্তায় পা রাখলাম, আর সাথে-সাথে দেখতে পেলাম আমার ঠিক হাত দুয়েকের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে সে৷ মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে কী যেন ভাবছে৷

‘আজ উপরে এলি না কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷

সে বোধহয় ভাবেনি আমি নীচে নেমে আসব৷ প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেছিল, একটু চুপ করে থেকে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না, তার বদলে আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এত বড় ছেলে এখনও বাবার সাথে স্কুল থেকে ফিরিস?’

আমি প্রতিবাদ জানালাম, ‘আমি কী করব? বাবা ছাড়তে চায় না৷’

‘কাল থেকে একা ফিরবি৷’

‘একা ফিরব?’ আমার গলায় কৌতুক স্পষ্ট৷ সেটা আমি গোপন করতে চাইনি৷

‘তবে নয়তো কী?’

‘আচ্ছা, দেখা যাক৷’

আবার কয়েক মিনিটের নীরবতা, মনে-মনে ভয় করতে লাগল হঠাৎ যদি কারেন্ট চলে আসে তাহলে এক্ষুনি উপরে চলে যেতে হবে৷ ঠিক এইসময় হাতে যেন কিসের স্পর্শ অনুভব করলাম৷ না, নরম হাতের নয়, নখের৷ দু-হাতে আমার হাতটাকে খামচে ধরেছে সে৷ খুব নীচু গলায় আমাকে কিছু যেন বলতে চায়, আমি তার চোখের দিকে তাকালাম, একফালি তরল জ্যোৎস্না তার মুখটা ভিজিয়ে দিয়েছে৷ তাতে বেশ দেখতে পাচ্ছি তার চোখের দুই কোণে কাজল মেশানো জল টলটল করছে৷ ও কি কাঁদছিল?

‘কী হয়েছে তোর?’ আমি প্রশ্ন করলাম৷ অজানা আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে উঠল৷

সে আমার প্রশ্নটার জবাব দিল না৷ যেটা বলল, সেটাকে উত্তর নয়, অনুরোধ বলা যায়৷

‘আমার সঙ্গে একটু দৌড়বি?’

প্রশ্নটা ভালো করে বুঝে উঠতে আমার পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগল৷ নিজেকে একটু শান্ত করে বললাম, ‘তোর পাগলামি ছাড়, আমাকে উপরে যেতে হবে৷’

সে আমার হাতে হালকা চাপ দিল, ‘না, আয় আমার সাথে৷ দরকার আছে৷’

জানি না সেদিন কেন না বলতে পারিনি৷ আমার মতামতের কোনও ধারই ধারেনি সে৷ কোনওদিন না৷ যেদিন আসবার এসেছে, না হলে৷ আসেনি৷

কতদূর দৌড়াতে হবে?’

এই মাঠটা পর্যন্ত৷’

আমি হিসেব করে দেখলাম মিনিট দশেকের বেশি সময় লাগবে না৷ অগত্যা রাজি হলাম; কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে দু-জনে দৌড়াতে লাগলাম৷ সমস্ত রাস্তাটা আমার অস্বস্তি হচ্ছিল৷ ওর নিঃশ্বাসের শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে৷ যেন এই দৌড়টার শেষেই খারাপ কিছু ঘটবে; থেমে গেলেই যেন একরাশ অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মসাৎ করবে আমাদের৷

মাঠে পৌঁছে আমরা দু-জনেই হাঁফাতে লাগলাম, মাঠের একপাশে আধশোয়া হয়ে বসে পড়ল সে৷

আমি অতটা হাঁফাইনি, জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসবের মানে কী?’

‘বস৷ বলছি৷’

আমি তার পাশে বসে পড়লাম৷ সে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার দৌড়ানো বারণ৷’

‘কেন?’ আমার অস্থিরতা বাড়ছে৷

‘জানি না, কিছু একটা হয়েছে৷’

আমার মনে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসছিল, কিন্তু সেগুলো একটাও তাকে জিজ্ঞেস করতে মন চাইল না৷ আজকে তার জ্যোৎস্না মাখা মুখ আর রাতের হাওয়ায় উড়ন্ত চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার বহুদিনের চেনা সেই পাগলাটে, সেই পেটুক মেয়েটার একটুও মিল পাচ্ছিলাম না৷ মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায় সেটা সেদিনও জানতাম না৷

‘যেটা করতে বারণ করেছে সেটাই করিস৷ তুই এরকম কেন?’

একটু আগেই এই মাঠ থেকে আমি খেলে গেছি, ধুলোগুলো এখনও মাঠের বুকে থিতিয়ে যায়নি৷ দূরে আকাশটাকে একটা বিশাল তিরপলের মতো দেখাচ্ছে, যেন মাঠের একপ্রান্তেই শেষ হয়ে গেছে আকাশটা৷ মনে হচ্ছে এই মস্ত পৃথিবীটা একটা ছোট্ট শামিয়ানা বানিয়ে দিয়েছে আমাদের জন্য৷ একটা আকাশ-আমাদের, একান্ত আমাদের৷

‘কাল থেকে একা ফিরিস৷ এই মাঠেই দাঁড়াস৷’

‘তারপর?’

‘আমি দৌড়াব, তুই টাইম দেখবি৷’

আমি তাকে বহুবার বারণ করেছিলাম জানেন, বহুবার, কিন্তু সে শোনেনি৷ বললাম না, তার কাছে হেরেছিলাম আমি বহু আগে, বাকি দিনগুলো সেই হারেরই মহড়া দিয়ে গেছি৷ আমি রোজ স্কুল ছুটির পর এসে দাঁড়াতাম মাঠের একপাশে, গোটা মাঠ জুড়ে তখন অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের ভীড়৷ আমার কাছে ব্যাগ রেখে সে মাঠের একধার দিয়ে গোল করে দৌড়াত৷ ঘড়িতে সময় দেখতাম আমি৷ দৌড়াতে-দৌড়াতে দম ফুরিয়ে গেলে সে হাঁফাতে-হাঁফাতে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করত সময় কত হল৷ আমি মাঝে-মাঝে বাড়িয়ে বলতাম৷ সে খুশি হয়ে আমাকে দোকান থেকে এক্লেয়ারস কিনে দিত৷ আমি মনে-মনে জানতাম, সময় আস্তে-আস্তে কমছে তার৷ কোনওদিন পাঁচ সেকেন্ড কোনওদিন তিন সেকেন্ড৷ এক্লেয়ারসগুলো আমি খাইনি কোনওদিন, ওগুলোর দিকে তাকালে খুব শান্তি পেতাম৷ জানি মিথ্যে৷ তবু…

পুরনো কথাগুলো বলতে-বলতে খেয়ালই ছিল না৷ আমার ডানপাশের কলেজযাত্রীরা কখন নেমে গেছে৷ কামরায় এখন আমরা দু-জন একা৷ লোকটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি ঠিক কোথায় নামবেন বলুন তো?’

‘আগের স্টেশনে, এই মাত্র চলে গেল৷’

‘সেকি! নামলেন না কেন?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম৷

‘আপনি বলুন না, নেমে আবার ডাউনের ট্রেন ধরলেই হবে৷’

আমি বাইরেটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম, তারপর বললাম, ‘আমার গল্পটা অবশ্য বেশি বাকি নেই, জীবনটা উপন্যাসের মতো হয় না৷ কেন কে জানে! তাকে আমার অনেক কথা বলার ছিল৷ যে কথাগুলো কোনওদিন বলতে পারিনি৷ শেষ কয়েকটা মাস বিছানা থেকে উঠতে পারেনি, শেষ কয়েকটা দিন ভালো জ্ঞান ছিল না৷ নিঃশব্দে কখন হৃৎপিণ্ডটা বন্ধ হয়ে গেছে কেউ বুঝতেই পারেনি৷ আমি খবর পেয়েছিলাম সেদিনই রাতে৷ আমি একটুও কাঁদিনি জানেন? খালি একটা দিনের কথা মনে পড়ছিল৷’

‘সেটাই বলুন৷’

সেদিন আমরা দু-জনে স্কুল থেকে ফিরছিলাম, কয়েকদিন হল আর দৌড়াত না ও৷ হয়তো আর পারত না৷ চুপচাপ দু-জনে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম, বিশেষ কথা বলতাম না৷ হয়তো কী কথা বলব সেটা ভাবতে-ভাবতেই সময়টা কেটে যেত৷ সেদিন মাঠের উপর দিয়ে হাঁটছিলাম৷ বেশ বুঝতে পারছি দৌড়ানো তো দূরের কথা, এতটা রাস্তা হাঁটতেই হাপরের মতো নিঃশ্বাস পড়ছে তার৷ ডান হাতে আমার কনুইটা খামচে ধরে কোনওরকমে এগিয়ে নিয়ে চলেছে শরীরটা৷ হঠাৎ একটু থেমে আমার দিকে ফিরে জোরে-জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে কিছু যেন বলল৷ শীতের বিকেল বলে মাঠটা ফাঁকা ছিল, পুরোটা শুনতে পাইনি, কিন্তু বুঝতে পারলাম সে কী বলতে চাইছে, ‘মানুষ মরে গেলে কোথায় যায় জানিস?’

আমি মাথা দোলালাম৷ সে মুখ নামিয়ে নিল৷ মনে-মনে কিছু যেন হিসেব করে আরও খানিকটা সরে এল আমার দিকে, এখন তার দীর্ঘ যন্ত্রণাময় নিঃশ্বাস পড়ছে আমার বুকে৷ আমি তার মাথায় একটা হাত রাখলাম, সে যতটা পারে একসাথে বলার চেষ্টা করল কথাগুলো, ‘আমাকে একটা কথা দিবি?’

আমি চুপ৷ ‘দেব’ বলতে পারিনি, বিশ্বাস করুন৷

আমার যদি কিছু হয়, মানে যদি আমি না থাকি, তোকে তো কিছু বলতে পারব না৷ প্রতি বছর আমার জন্মদিনের দিন আমার কবরের কাছে আসবি? যদি কোনওভাবে পারি তোর কাছে আসব আমি৷ কথা বলব তোর সাথে৷’

‘সেদিন কাশের বনে সেই উড়ন্ত কাপড়টা তোকে এটাই বলেছিল না?’

‘হ্যাঁ৷’ সে মাথা নাড়ল৷

‘দেখতে পেয়েছিলি আর মিনুকে?’

সে আর কোনও উত্তর দিল না৷ আমার গলা ধীরে-ধীরে বুজে আসছিল৷ চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার মুখে৷ সে আমার দিকে তাকিয়ে যতটা সম্ভব হাসার চেষ্টা করল৷ ‘বাচ্চাদের সামনে কি চোখের জলও লুকাতে হয়?’

আমার হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে তার মাথার চুলগুলো৷ সে ডানহাত দিয়ে আমার চোখের জলটা মুছতে-মুছতে বলল, ‘দেখিস বাবা, তুই আবার যা ভীতু, ভূত দেখে পালিয়ে যাস না৷’

ট্রেনটা যখন শিমুলপাহাড় পৌঁছাল তখন কামরাটা পুরো ফাঁকা৷ আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক একটু আগেই নেমে গেছেন৷ যাবার সময় কেন জানি না আমার মোবাইল নম্বরটা নিয়ে গেলেন৷ কী যে করবেন কে জানে৷

আমি স্টেশনে পা রাখলাম৷ এখান থেকে একটু হাঁটলেই পড়বে কবরস্থানটা৷ ওভারব্রিজ দিয়ে নীচে নেমে এলাম৷ প্রতিবছর এখানে রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে৷ আজ কিন্তু দেখতে পেলাম না৷ অগত্যা হাঁটা দিলাম৷ রাস্তাটা কাঁচা মাটির৷ দু-পাশে ঝাউবন পাতলা হয়ে এসেছে৷ এদিকটায় ঘরবাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে৷ পায়ের তলায় ঝাউয়ের পাতা পড়ে যেন তুলোর চাদর বিছিয়ে দিয়েছে৷ ধীরে-সুস্থে মিনিট পনেরো হাঁটার পর কবরস্থানটা চোখে পড়ল৷ আগের মতোই আছে৷ আগের বছর ঠিক এইসময়ে এখানে কিসের যেন একটা মেলা চলছিল; এখন চারিদিক শান্ত৷ অবশ্য সেটাই ভালো৷ আমি দরজার ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকে এলাম৷ কোথাও কোনও মানুষজন চোখে পড়ছে না৷ চারিদিকটা বুনো গাছের ডালপালায় ঢেকে আছে, তার মধ্যে মাঝে-মাঝে দু-একটা পাথরের বেদি চোখে পড়ছে৷ একটা বুড়ো অশ্বথ গাছের নীচে আছে তার কবরটা৷ সে ঘুমিয়ে আছে, আজ পাঁচ বছর হতে চলল৷ সাদা পাথরের উপর তার নাম খোদাই করা আছে৷ সেটার উপর একবার হাত বোলালাম আমি৷ দু-হাতে এগিয়ে আসা ডালপালা সরিয়ে দিলাম৷ শ্বেতপাথরের উপর ধুলো জমেছে; কবরটার ঠিক পাশে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম৷ এখন আমি কিছু বললে সে কি শুনতে পাবে? যদি সত্যি শুনতে পেত তাহলে এতদিনে একবারও আসত না আমার কাছে? নাহ, এবারও সে আসবে না৷ হয়তো কোনওদিন আসবে না৷ হয়তো মৃত্যুর পরে আর কিছু নেই৷ তবু আমি আসব প্রতিবছর, সেভাবেই বেঁচে থাকব আমি৷ একফোঁটা জল আমার চোখ থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ল৷ আরও বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসে আমি উঠে পড়লাম৷ দিগন্তের একপাশে সূর্যটা তখন ঢলে পড়ছে৷ সন্ধের ট্রেন ধরেই বাড়ি ফিরতে হবে৷ কবরস্থানের প্রায় গেটের কাছে চলে এসেছিলাম, ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা মিহি গলার ধমক শুনতে পেলাম, ‘এই এই, কী হচ্ছে ওটা?’

আমি পিছন ফিরলাম না৷ চোখ বন্ধ করে নিলাম৷ পিছনে ডালপালার উপর পায়ের শব্দ হল৷ তারপরেই একটা নরম হাত এসে স্পর্শ করল আমার পিঠ, ‘কত বড় হয়ে গেছিস৷’

এতদিন শুধু ভেবে এসেছি তার সাথে দেখা হলে অনেক কথা বলব তাকে৷ আজ কিন্তু মনে হল মাত্র একটাই কথা বলার আছে৷ আমি এখনও তাকাইনি তার দিকে, আমার চোখ বন্ধ৷ বললাম, ‘শোন, আমি আর কোথাও যেতে দেব না তোকে৷’

বুঝতে পারলাম সে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ তাও আমি চোখ খুললাম না৷ সে অস্ফুটে একটা শব্দ উচ্চারণ করল, ‘আমিও৷’

আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম তার মুখ৷ সে আমার দিকে আরও খানিকটা সরে এল৷

আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আমি কিন্তু ভূত৷ ভয় লাগছে না তো?’

‘না৷ আমি আর ভীতু নই৷’

তাই তো দেখছি, তাহলে চোখ খোল৷

আমি চোখ খুললাম৷

(আজ সন্ধেয় পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে হাওড়া থেকে শিমুলপাহাড়গামী ট্রেনের একটি বগি হুগলি স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয়৷ ঘটনাস্থলেই ওই বগির সমস্ত যাত্রীর মৃত্যু হয়৷ এধরনের দুর্ঘটনা কেন ঘটল তা নিয়ে এখনই বিশদে কিছু জানা যাচ্ছে না, ঘটনাস্থলে আছে আমাদের প্রতিনিধি…)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *