সে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পুপে এসে জিগেস করলে, দাদামশাই, তুমি তো বললে শনিবারে সে আসবে তোমার নেমন্তন্নে। কী হল।
সবই ঠিক হয়েছিল। হাজি মিঞা শিককাবাব বানিয়েছিল, তোফা হয়েছিল খেতে।
তার পরে?
তার পরে নিজে খেলুম তার বারো—আনা আন্দাজ, আর পাড়ার কালু ছোঁড়াটাকে দিলুম বাকিটুকু। কালু বললে, দাদাবাবু, এ—যে আমাদের কাঁচকলার বড়ার চেয়ে ভালো।
সে কিছু খেল না?
জো কী।
সে এল না?
সাধ্য কী তার।
তবে সে আছে কোথায়?
কোত্থাও না।
ঘরে?
না।
দেশে?
না।
বিলেতে?
না।
তুমি যে বলছিলে, আণ্ডামানে যাওয়া ওর এক রকম ঠিক হয়ে আছে। গেল নাকি?
দরকার হল না।
তা হলে কী হল আমাকে বলছ না কেন।
ভয় পাবে কিংবা দুঃখ পাবে, তাই বলি নে।
তা হোক, বলতে হবে।
আচ্ছা, তবে শোনো। সেদিন ক্লাস—পড়াবার খাতিরে আমার পড়ে নেবার কথা ছিল ‘বিদগ্ধ— মুখমণ্ডন’। এক সময় হঠাৎ দেখি, সেটা রয়েছে পড়ে, হাতে উঠে এসেছে ‘পাঁচুপাকড়াশির পিসশাশুড়ি’। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, রাত হবে তখন আড়াইটা স্বপ্ন দেখছি, গরম তেল জ্বলে উঠে আমাদের কিনি বামনির মুখ বেবাক গিয়েছে পুড়ে; সাত দিন সাত রাত্তির হত্যে দিয়ে তারকেশ্বরের প্রসাদ পেয়েছে দু’কৌটো লাহিড়ি কোম্পানির মুনলাইট স্নো; তাই মাখছে মুখে ঘ’ষে ঘ’ষে। আমি বুঝিয়ে বললুম, ওতে হবে না গো, মোষের বাচ্ছার গালের চামড়া কেটে নিয়ে মুখে জুড়তে হবে, নইলে রঙ মিলবে না। শুনেই আমার কাছে সওয়া তিন টাকা ধার নিয়ে সে ধর্মতলার বাজারে মোষ কিনতে দৌড়েছে। এমন সময় ঘরে একটা কী শব্দ শোনা গেল, কে যেন হাওয়ার তৈরি চটিজুতো হূস হূস করে টানতে টানতে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠলেম, উসকে দিলেম লণ্ঠনটা। ঘরে একটা—কিছু এসেছে দেখা গেল কিন্তু সে যে কে, সে যে কী, সে যে কেমন, বোঝা গেল না। বুক ধড়ফড় করছে, তবু জোর গলা করে হেঁকে বললুম, কে হে তুমি। পুলিস ডাকব নাকি।
অদ্ভুত হাঁড়িগলায় এই জীবটা বললে, কী দাদা, চিনতে পারছ না? আমি যে তোমার পুপেদিদির সে। এখানে যে আমার নেমন্তন্ন ছিল।
আমি বললুম, বাজে কথা বলছ, এ কী চেহারা তোমার!
সে বললে, চেহারাখানা হারিয়ে ফেলেছি।
হারিয়ে ফেলেছ? মানে কী হল।
মানেটা বলি। পুপেদিদির ঘরে ভোজ, সকাল—সকাল নাইতে গেলেম। বেলা তখন সবেমাত্র দেড়টা। তেলেনিপাড়ার ঘাটে বসে ঝামা দিয়ে কষে মুখ মাজছিলুম; মাজার চোটে আরামে এমনি ঘুম এল যে, ঢুলতে ঢুলতে ঝুপ করে পড়লুম জলে; তার পরে কী হল জানি নে। উপরে এসেছি কি নীচে কি কোথায় আছি জানি নে, পষ্ট দেখা গেল আমি নেই।
নেই!
তোমার গা ছুঁয়ে বলছি—
আরে আরে, গা ছুঁতে হবে না, বলে যাও।
চুলকুনি ছিল গায়ে; চুলকতে গিয়ে দেখি, না আছে নখ, না আছে চুলকনি। ভয়ানক দুঃখ হল। হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলুম, কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যে হাউহাউটা বিনা মূল্যে পেয়েছিলুম সে গেল কোথায়। যত চেঁচাই চেঁচানোও হয় না, কান্নাও শোনা যায় না। ইচ্ছে হল, মাথা ঠুকি বটগাছটাতে ; মাথাটার টিকি খুঁজে পাই নে কোথাও। সব চেয়ে দুঃখ—বারোটা বাজল, ‘খিদে কই’ ‘খিদে কই’ বলে পুকুরধারে পাক খেয়ে বেড়াই, খিদে—বাঁদরটার চিহ্ন মেলে না।
কী বকছ তুমি, একটু থামো।
ও দাদা, দোহাই তোমার, থামতে বোলো না। থামবার দুঃখ যে কী অ—থামা মানুষ সে তুমি কী বুঝবে। থামব না, আমি থামব না, কিছুতেই থামব না, যতক্ষণ পারি থামব না।
এই বলে ধুপধাপ ধুপধাপ করে লাফাতে লাগল, শেষকালে ডিগবাজি খেলা শুরু করলে আমার কার্পেটের উপর, জলের মধ্যে শুশুকের মতো।
করছ কী তুমি।
দাদা, একেবারে বাদশাহি থামা থেমেছিলুম, আর কিছুতেই থামছি নে। মারধোর যদি কর সেও লাগবে ভালো। আস্ত কিলের যোগ্য পিঠ নেই যখন জানতে পারলুম, তখন সাতকড়ি পণ্ডিতমশায়ের কথা মনে করে বুক ফেটে যেতে চাইল, কিন্তু বুক নেই তো ফাটবে কী। কই—মাছের যদি এই দশা হত তা হলে বামুনঠাকুরের হাতে পায়ে ধরত তাকে একবার তপ্ত তেলে এপিঠ ওপিঠ ওলটাতে পালটাতে। আহা, যে পিঠখানা হারিয়েছে সেই পিঠে পণ্ডিতমশায়ের কত কিলই খেয়েছি, ইঁট দিয়ে তৈরি খইয়ের মোয়াগুলোর মতো। আজ মনে হয়, উঃ—দাদা, একবার কিলিয়ে দাও খুব করে দমাদম—
বলে আমার কাছে এসে পিঠ দিলে পেতে।
আমি আঁৎকে উঠে বললুম, যাও যাও, সরে যাও।
ও বললে, কথাটা শেষ করে নিই। একখানা গা খুঁজে খুঁজে বেড়ালুম গাঁয়ে গাঁয়ে। বেলা তখন তিন পহর। যতই রোদে বেড়াই কিছুতেই রোদে পুড়ে সারা হচ্ছি নে, এই দুঃখটা যখন অসহ্য এমন সময় দেখি, আমাদের পাতুখুড়ো মুচিখোলার বটগাছতলায় গাঁজা খেয়ে শিবনেত্র। মনে হল, তার প্রাণপুরুষটা বিন্দু হয়ে ব্রহ্মতালুর চুড়োয় এসে জোনাক—পোকার মতো মিটমিট করছে। বুঝলুম, হয়েছে সুযোগ। নাকের গর্ত দিয়ে আত্মারামকে ঠেসে চালিয়ে দিলুম তার দেহের মধ্যে, নতুন নাগরা জুতোর ভিতরে যেমন করে পা’টা ঠেসে গুঁজতে হয়। সে হাঁপিয়ে উঠে ভাঙা গলায় বলে উঠল, কে তুমি বাবা, ভিতরে জায়গা হবে না।
তখন তার গলাটা পেয়েছি দখলে; বললুম, তোমার হবে না জায়গা, আমার হবে। বেরোও তুমি।
সে গোঁ গোঁ করতে করতে বললে, অনেকখান বেরিয়েছি, একটু বাকি। ঠেলা মারো।
দিলুম ঠেলা, হুস করে গেল বেরিয়ে।
এ দিকে পাতুখুড়োর গিন্নি এসে বললে, বলি, ও পোড়ারমুখো।
কান জুড়িয়ে গেল। বললুম, বলো বলো, আবার বলো, বড়ো মিষ্টি লাগছে, এমন ডাক যে আবার কোনোদিন শুনতে পাব এমন আশাই ছিল না।
বুড়ি ভাবলে ঠাট্টা করছি, ঝাঁটা আনতে গেল ঘরের মধ্যে। ভয় হল, পড়ে—পাওয়া দেহটা খোয়াই বুঝি। বাসায় এসে আয়নাতে মুখ দেখলুম, সমস্ত শরীর উঠল শিউরে। ইচ্ছে করল র্যাঁদা দিয়ে মুখটাকে ছুলে নিই।
গা—হারার গা এল, কিন্তু চেহারা—হারার চেহারাখানা সাত বাঁও জলের তলায়, তাকে ফিরে পাবার কী উপায়।
ঠিক এই সময়ে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর খিদেটাকে পাওয়া গেল। একেবারে জঠর জুড়ে। সব কটা নাড়ি চোঁ চোঁ করো উঠেছে একসঙ্গে। চোখে দেখতে পাই নে পেটের জ্বালায়। যাকে পাই তাকে খাই গোছের অবস্থা। উঃ কী আনন্দ।
মনে পড়ল, তোমার ঘরে পুপুদিদির নেমন্তন্ন। রেলভাড়ার পয়সা নেই। হেঁটে চলতে শুরু করলুম। চলার অসম্ভব মেহন্নতে কী যে আরাম সে আর কী বলব। স্ফূর্তিতে একেবার গলদঘর্ম। এক এক পা ফেলছি আর মনে মনে বলছি, থামছি নে, থামছি নে, চলছি তো চলছিই। এমন বেদম চলা জীবনে কখনো হয় নি। দাদা, পুরো একখানা গা নিয়ে বসে আছ কেদারায়, বুঝতেই পার না কষ্টতে যে কী মজা। এই কষ্টে বুঝতে পারা যায়, আছি বটে, খুব কষ্টে আছি, ষোলো—আনা পেরিয়ে গিয়ে আছি।
আমি বললুম, সব বুঝলুম, এখন কী করতে চাও বলো।