সে যে আমি
ওগো দুরন্ত সুন্দর মোর! কার পরে রাগ করি তারার মুক্তা-মালিকা ছিঁড়িয়া ছড়ালে গগন ভরি? কারে তুমি ভালোবাস প্রিয়তম? কার নাহি পেয়ে দেখা চাঁদের কপোলে মাখাইয়া দিলে কালো কলঙ্ক-লেখা? কার অনুরাগ নাহি পেয়ে তুমি লাল হয়ে ওঠ রাগে? প্রভাত-সূর্যে, সৃষ্টিতে সেই রাগের বহ্নি লাগে। কাহার বিরহ-জ্বালায় জ্বালাও বিশ্ব, পরম স্বামী? সে কি আমি? সে কি আমি? বনে উপবনে কুঞ্জে ফোটাও চামেলি চম্পা হেনা, ওগো সুন্দর, ফুল ফুটাইয়া মালা কেন গাঁথিলে না? শ্রাবণ-গগনে মেঘরূপে ওঠে তব রোদনের ঢেউ, ঝুরিয়া ঝুরিয়া ক্ষীণ হল তনু, ভালোবাসিল না কেউ? ওগো অভিমানী! বলো, কেন কোন নির্দয় অভিমানে সৃষ্টিতে দিয়া জীবন, আবার টানিছ মৃত্যু-টানে? গড়িয়া নিমেষে ভেঙে ফেল রূপ, যেন ভালো নাহি লাগে রূপের এ খেলা। কোন অপরূপা স্মৃতিতে তোমার জাগে। তাহারই লাগিয়া জাগিয়া রয়েছ উদাসীন দিবাযামী, সে কি আমি? সে কি আমি? ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমে বসালে ভূতের মেলা, ভূত নিয়ে এ কী অদ্ভুত খেলা, কে হানিয়াছে হেলা? মাধবীলতার কাঁকন পরায়ে সহকার-তরুশাখে রুদ্র ঝড়ের রূপে এসে তুমি কেন ছিঁড়ে ফেল তাকে? তোমার প্রেমের রাখি কে নিল না, কে সেই গরবিনি? আজও সৃষ্টির পিত্রালয়ে কি কাঁদে সেই বিরহিণী? তাই কি যেখানে মিলন, সেখানে নিত্য বিরহ আনো? আপন প্রিয়ারে পেলে না বলিয়া সবার প্রিয়ারে টানো? কার কামনার সৃষ্টিতে তব রূপ চঞ্চলকামী? সে কি আমি? সে কি আমি? কাহারে ভুলাতে ঝর অনন্ত পরম-শ্রীর রূপে, তোমারই গুণের কথা কি ভ্রমর ফুলে কয় চুপে চুপে? মুহু মুহু উহু উহু করে ওঠ কুহুর কন্ঠস্বরে তোমারই কাছে কি শিখিয়া পাপিয়া পিয়া পিয়া রব করে? পদ্মপাতার থালায় তোমার নিবেদিত ফুলগুলি ঝরে ঝরে পড়ে অশ্রুসায়রে, কহ লইল না তুলি! যাহার লাগিয়া ফুলের বক্ষে সঞ্চিত কর মধু, সকলে সে মধু লইল, নিল না তোমারই মালিনীবধূ? যে অপরূপারে খোঁজ অনন্তকাল রূপে রূপে নামি – সে কি আমি? সে কি আমি? সংহারে খোঁজ, সৃষ্টিতে খোঁজ, খোঁজ নিত্য স্থিতিতে, যাহারে খুঁজিছ পরম বিরহে, খুঁজিছ পরম প্রীতিতে, যে অপরূপা পূর্ণা হইয়া আজিও এল না বাহিরে পাইয়া যাহারে বলিছ, এ নয়, হেথা নয় সে তো নাহি রে। সেই কুন্ঠিতা গুন্ঠিতা তব চির-সঙ্গিনী বালিকা অনন্ত প্রেমরূপে অনন্ত ভুবনে গাঁথিছে মালিকা। ভীরু সে কিশোরী তব অন্তরে অন্তরতম কোণে হারাবার ভয়ে তোমারে, লুকায়ে রহে সদা নিরজনে। সকলেরে দেখ, আপনারে শুধু দেখ না পরম উদাসীন, দেখিলে, দেখিতে যেখানে তুমি, সেইখানে সে যে আছে লীন! যত কাঁদে, তত বুকে বাঁধে তোমারেই অন্তর্যামী! সে কি আমি? সে কি আমি? ওগো প্রিয়তম! যত ধরি আমি দু-হাতে তোমারে জড়ায়ে আমারে খুঁজিতে আমারেই তত সৃষ্টিতে দাও ছড়ায়ে। আমারে যতই প্রকাশিতে চাহ বাহিরে ভুবনে আনিয়া, তত লুকাইতে চাহি ; আজিও যে আমি অপূর্ণা জানিয়া। হে মোর পরম মনোহর ! তব প্রিয়া বলে দিতে পরিচয়, ক্ষমা করো, যদি অপূর্ণা এই বালিকার মনে জাগে ভয়! আমার কলহ মান-অভিমান তোমার সহিত গোপনে, জাগ্রত দিনে আজও লাজ লাগে, তাই মিলি আমি স্বপনে। ওগো ও পরম নিলাজ, পরম নিরাবরণ, হে চঞ্চল, আমারে ধরিতে, টানিয়া চলেছ সৃষ্টিতে মোর অঞ্চল। আমারে কাঁদাতে সকলের সাথে দেখাও মিলন-অভিনয়, বাহিরে এনো না, কাঁদিব বক্ষে, রেখো এ মিনতি প্রেমময়। যদি ভালো তুমি বাস অপরেরে, হে পর-পুরুষ সুন্দর, আমি আছি, আমি রব চিরকাল জুড়িয়া তোমার অন্তর। আমি যে তোমার শক্তি হে প্রিয়, প্রকাশ বহির্জগতে, আমারে না পেয়ে দুঃখের রূপে কাঁদিছে স্বর্গে-মরতে। কলঙ্ক দিয়া আমার ধর্মে কলঙ্কী নাম নিলে হে, দুই হয়ে তব রটে অপযশ, একাকী তো বেশ ছিলে হে। তব সুন্দর-ছায়া মায়া রচে, মায়াতীত হয়ে তাহাতে– কেন আসক্ত হলে তুমি, তারে জড়ায়ে ধরিলে বাঁ হাতে? রূপ নাই, তবু রূপের তৃষ্ণা কেন তব বুকে জাগে, এত রূপ রসে ঝরিয়া পড়িছ বলো কার অনুরাগে? খেলা-শেষে মহাপ্রলয়ের বেলা আমার দুয়ারে থামি জানাবে পরম-পতি আমারে কি – আমি, প্রিয়, সে যে আমি!