সে কান পেতে শোনে

সে কান পেতে শোনে

মূল গল্প  The Listener (Algernon Henry Blackwood)

৪ সেপ্টেম্বর

শেষপর্যন্ত লন্ডন শহরে কম পয়সায় থাকার মতো একটা ঘর খুঁজে পেলাম৷ একবছরের ভাড়া মাত্র ২৫ ডলার৷ শর্ত একটাই৷ গোটা একটা বছর না কাটিয়ে ঘর ছেড়ে দেওয়া যাবে না৷ আমার অবশ্য এতে একেবারেই আপত্তি ছিল না৷ এই পয়সায় এর থেকে ভালো থাকার জায়গা এ শহরে অন্তত পাওয়ার আশা নেই৷

১ অক্টোবর

বাড়িতে দোতলায় দুটো ঘর আমার জন্যে৷ সুখের কথা এ বাড়ি থেকে খানিকটা দূরেই একটা সংবাদপত্রের অফিস৷ ফলে আমার লেখালিখি জমা করার কাজেও খানিকটা সুবিধা হবে৷ তবে বাড়িটা একবার দেখেই বোঝা যায় বেশ পুরনো৷ আমি যে ঘরটায় আছি তার দরজার উপরের দিকটা সিলিংয়ের গায়ে লেগে থাকার বদলে বেশ খানিকটা ভিতরের দিকে বেঁকে গেছে৷ যেন অনেক বছর গায়ে-গায়ে থেকে, ঝগড়া হয়ে দূরে সরে গেছে ওরা৷ ঘরের একদিকের দেওয়ালে একটা ঝুলন্ত আয়না আছে৷ তার মাঝখান থেকে বেশ কিছুটা চির খেয়ে দু-ভাগ হয়ে আছে৷ কী করে ভেঙেছিল তা অবশ্য জানি না৷

২ অক্টোবর

আমার বাড়িওয়ালি মহিলা বয়স্ক৷ নাম মিসেস মন্সন৷ ফ্যাকাসে ধুলো মাখা মুখ৷ মনে হয় কিছু একটা কারণে অসুস্থ৷ সারাক্ষণই কেশে চলেছেন৷ খুব একটা কথাবার্তা বলেন না৷ আমি কয়েকবার প্রশ্ন করে শুধু এটুকু জানতে পেরেছি যে এই মুহূর্তে এ বাড়িতে আমি ছাড়া অন্য ভাড়াটে নেই৷

মহিলার আরেকটা কিম্ভূত স্বভাব আছে৷ কথা বলার সময় একবারও তিনি আমার মুখের দিকে তাকান না৷ একটানা আমার জামার মাঝের বোতামের দিকে তাকিয়ে থাকেন৷

এই মিসেস মন্সনের একটি ছেলে আছে৷ স্বচক্ষে দেখিনি কোনওদিন৷ তবে মাঝেমধ্যে উপরের ঘর থেকে তার চিৎকার কানে আসে৷ ছেলেটা বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকে না৷ ইয়ার-দোস্ত নিয়ে নেশাভাঙ করে৷

সকালের দিকটা আমি লেখালিখি করে কাটাই৷ একটা উপন্যাস দীর্ঘদিন হল শেষ করার তালে আছি, কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও কিছুতেই মন মতো হচ্ছে না৷ দুপুর অবধি সেই চেষ্টায় অব্যাহত থেকে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে আমি একটু হাঁটতে বের হই৷

১০ অক্টোবর

একটা ছোট্ট গোলমালে আজ সারাটা দিন মাটি হল৷ ব্যাপার আর কিছুই না৷ সকালের ব্রেকফাস্টে দুটো ডিম দেওয়া হয়েছিল আমাকে৷ খেতে গিয়ে দেখি তার মধ্যে একটা ডিম খারাপ৷ এমিল নামের চাকরটাকে হাঁক পেড়ে সেটা বলতে সে ক্ষমা-টমা চেয়ে বলল, এক্ষুনি পাল্টে এনে দিচ্ছে৷ আমি কাগজ পড়ছিলাম৷ মিনিট কয়েক পড়ে সে ডিম এনে দিতে দেখি, ওমা! আহাম্মকটা ভালো ডিমটাই তুলে নিয়ে গিয়ে পচা ডিমটা রেখে গেছে৷ আবার হাঁক পাড়তে পাল্টে দিয়ে গেল ডিমটা৷ আমিও খাওয়া-দাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম৷ কিন্তু সারাদিন মনটা খিঁচড়ে থাকল৷ লেখালিখি আর হলই না৷ শেষে রোজকার মতো হাল ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম৷

বাড়ি ফিরতে-ফিরতে প্রায় ন-টা বাজল৷ এর আগে এই রাতের অন্ধকারে দেখিনি বাড়িটাকে৷ কেন জানি না গা-টা ছমছম করে উঠল আমার৷ এতদিনের পুরনো বাড়ি৷ কবে কী ঘটেছে কে জানে৷

ঘরের ভিতরে এসে ঢুকতেই গায়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠল৷ হাঁটতে যাওয়ার সময় ভুল করে ঘরের সব জানলাগুলো খুলে রেখে গেছিলাম৷ এখন সেখান দিয়ে হাওয়া ঢুকে গোটা ঘরটা বরফের মতো হয়ে আছে৷ তড়িঘড়ি হাত চালিয়ে জানলাগুলো বন্ধ করে দিলাম৷

ঘরের মাঝে রাখা চেয়ারটায় বসতেই মনে হল কোথা দিয়ে যেন এখনও হাওয়া ঢুকছে৷ একটু এদিক-ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ল৷ বাঁদিকের দেওয়ালে একটা ছোট চৌকো জানলা আছে৷ সেটার একবারে সামনেই পাশের বাড়ির দেওয়ালের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে৷ দেওয়াল আর জানলার ওই ফাঁকটার ভিতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাওয়ার সময়ই শনশন করে শব্দ হচ্ছে একটা৷ কাছে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম জানলার ঠিক ডানপাশে একটা খুপরি আছে৷ একটা মানুষের ঢুকে দাঁড়ানোর মতো জায়গা৷ মনে হচ্ছে যেন একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে আমার জানলার বাইরে৷ মজার ব্যাপার হল খুপরিটা এমন জায়গায় যে কেউ ওখানে ঢুকে থাকলে বাড়ির ভিতর বা বাইরে কোথাও থেকেই তাকে দেখতে পাবার কোনও উপায় নেই৷

গোটা ঘরটা এমন হাওয়ার শব্দে ভরে উঠেছে যে মনে হল একটা দুলন্ত জাহাজের মাঝে বসে আছি৷

১৪ অক্টোবর

আমার ঘরটা লম্বায় প্রায় দশফুট৷ সারাটা দিন একমাত্র হাওয়ার শব্দ ছাড়া মোটামুটি নিস্তব্ধই থাকে৷ জানলার বাইরে যে কার্নিসটা আছে তার উপরে রাত হলে এই এলাকার সমস্ত বিড়াল একত্রিত হয়৷ তখন তাদের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়৷ আমার নিজের পায়ের আওয়াজ ছাড়া অন্য কারও পায়ের শব্দ এসে থেকে একদিনও পাইনি৷ ও হ্যাঁ, আর বাড়িওয়ালির সেই ছেলের হাঁকডাক কানে আসে মাঝেমধ্যে৷ তার চিৎকারের মধ্যে ‘এ বাড়িতে একবার ঢুকলে আর নিস্তার নেই’ কথাটা কানে এসেছে একবার৷ নিশ্চয়ই পাগলের প্রলাপ৷

মাঝেমধ্যে রাতে বাড়ি ফেরার সময় অলিগলি থেকে বেরিয়ে এসে কয়েকটা বিড়াল আমার পিছু নেয়৷ আমার ঘরের দরজা অবধি আমাকে ফলো করে তারা৷ যেন আমার ঘরে ঢোকার কী আগ্রহ ওদের! এমন কী আছে আমার ঘরে! কে জানে?

২৭ অক্টোবর

বিড়ালদের আগ্রহের একটা কারণ বুঝতে পেরেছি এতদিনে৷ কাল রাতে ঘুম ভাঙতে মনে হয়েছিল ঘরের বাইরে কাঠের মেঝেতে কিচ-কিচ করে কিছু আওয়াজ হচ্ছে৷ বুঝলাম ঘরের কোথাও ইঁদুর লুকিয়ে আছে৷ বিড়ালের আর দোষ কী?

১৯ অক্টোবর

আজ বুঝলাম আমার বাড়িওয়ালির সঙ্গে একটি বাচ্চা ছেলেও থাকে৷ সম্ভবত তার নাতি৷ বাইরে রোদ থাকলে সে বাড়ির লাগোয়া বাগানে একটা ছোট চাকাগাড়ি টেনে খেলা করে৷ সেই চাকা সিমেন্টের উপরে ঘষা খেয়ে-খেয়ে একটা বিকট আওয়াজ আসে তা থেকে৷ বলা বাহুল্য আমার লেখালিখির চূড়ান্ত ব্যাঘাত ঘটে৷

অগত্যা এমিলকে ডাক দিলাম, ‘এরকম আওয়াজের মধ্যে বসে কাজ করা যায়? ওকে থামতে বল৷’

এমিল উপরে চলে গেল৷ উপর থেকে ডাক আসতে ছেলেটাও গাড়ি থামিয়ে চলে গেল৷ মনে-মনে একটু অপরাধবোধও অনুভব করলাম৷ যা হোক, বাচ্চা ছেলে৷

কিন্তু মিনিট দশেক কাটতে না কাটতেই আবার সেই ঘড়-ঘড় আওয়াজ শুরু৷ ছেলেটা আবার গাড়ি টানছে৷ বিরক্ত হয়ে আবার ডাক দিলাম এমিলকে৷ ‘এটা হচ্ছেটা কী? বললাম যে ওকে বারণ কর…’

সে আমতা-আমতা করে বলল, ‘আসলে ওর খেলনা গাড়িটার একটা চাকা ভেঙে গেছে৷ তাই ওরকম শব্দ হয়৷’

‘তো সেটা সারিয়ে দিচ্ছ না কেন?’

‘ও নিজেই সারাতে দেয় না৷ ওইরকম ভাঙা চাকা টানতেই ওর ভালো লাগে৷’

‘সে যাই ভালো লাগুক, শব্দ যেন না হয়৷’

‘আচ্ছা,’ ঘাড় নাড়ে এমিল, ‘আমি দেখছি৷’

সেদিনের মতো শব্দ থেমে গেল৷

২৩ অক্টোবর

গত সপ্তাহের প্রায় প্রতিটা দিন সকালে সেই খেলনা গাড়ি টানার বিরক্তিকর শব্দ শুনতে হয়েছে আমাকে৷ প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে এমিলকে হাঁক পাড়তে হয়৷ শেষ দিন মিসেস মন্সন নিজে নেমে এসেছিলেন৷ আমার কাছে ক্ষমা-টমা চেয়ে বাড়িটা আমার কেমন লাগছে সেই প্রসঙ্গে চলে গেলেন৷ আমি ইঁদুরের ব্যাপারটা জানাতে বললেন বাড়িটা নাকি কয়েকশো বছরের পুরনো৷ কোথায় কোন ফাঁকে ইঁদুর ঢুকে বসে থাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব৷

৩০ অক্টোবর

প্রায় একমাস হয়ে গেল এখানে আছি৷ জায়গাটা আমার সঙ্গে মোটেই খাপ খাচ্ছে না৷ ক’দিন হল বিশ্রী মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে৷

বাড়িওয়ালি মহিলাকে আমার পছন্দ হয়নি৷ খালি মনে হয় এ বাড়ির মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যেটা আমার থেকে লুকিয়ে রাখেন মহিলা৷

আজ সকালে মহিলার গুণধর ছেলেটি বাড়ি থেকে বেরনোর সময় প্রায় আমার মুখোমুখি পড়ে যায়৷ আমাকে দেখে তার মুখে একটা অদ্ভুত ভর্ৎসনার অভিব্যক্তি খেলে যায়৷ যেন আমার এখানে থাকাটা মোটেই পছন্দ হয়নি তার৷ ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাইনি৷ ছেলেটা সুবিধের না৷

মাথাটা ঘামালাম অন্য একটা কারণে৷ দুপুরে যে লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি পড়াশোনা করি সেখানে আজও বসে একটা বই পড়ছিলাম৷ এমন সময় মুখ তুলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি লাইব্রেরি রুমের অন্য সদস্যরাও একইরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ আমি মুখ তুলে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিল তারা৷ সবাই আমাকেই দেখছে কেন?

মনের ভুল ভেবে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম৷ কিন্তু লাইব্রেরি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় অতর্কিতে পিছন ফিরে দেখি আবার একই ভাবে সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার তো! সবাই আমাকে লক্ষ করছে কেন?

২ নভেম্বর

এই গোটা বাড়ির অস্থির নীরবতা অসহ্য লাগতে শুরু করেছে আমার৷ উপরের ঘরগুলো থেকে কোনও আওয়াজ আসে না৷ আমার সামনের সিঁড়ি দিয়ে কেউ নেমে যায় না৷ মাঝে-মাঝে ইচ্ছা করে উপরে গিয়ে একবার দেখে আসি কী আছে ঘরগুলোর মধ্যে৷ কখনও দেওয়ালে ঝুলন্ত ভাঙা আয়নাটার দিকে একটানা তাকিয়ে থাকি৷ কী যেন আছে ওর ভিতরে৷ বিশেষ করে ওই ভাঙা জায়গাটায়…

রাত দশটা৷ অখণ্ড নিস্তব্ধতার মাঝে বসে ডায়েরি লিখছি৷ বহু দূর থেকে গাড়িঘোড়ার মিহি শব্দ ভেসে আসছে৷ সেই সঙ্গে মৃদু হাওয়ার বয়ে যাওয়ার আওয়াজ৷ নীরবতা ছিন্ন করে মাঝে-মাঝে বিড়াল ডেকে উঠছে৷ রাত হলেই ওরা চলে আসে আমার কার্নিসে৷ কী বিষণ্ণ একটা রাত৷ নিজেকে এই জগতের বাইরের কেউ মনে হয় যেন৷

৩ নভেম্বর

পেনগুলো খুঁজে পাই না৷ এমিল রোজ দুপুরের দিকে আমার জিনিসপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে৷ পেনগুলো রাখে এক-একদিন এক-এক জায়গায়৷ সেগুলো খুঁজে না পেলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়৷ যখনই জিজ্ঞেস করি ওই ন্যাকা-ন্যাকা গলায় একই জবাব৷ তুলে রেখেছি৷ ইচ্ছা করে সবক-টা পেন এক সঙ্গে নিয়ে দিই চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে৷

এ বাবা! কী লিখে ফেললাম এসব! এমন ভয়ানক চিন্তা-ভাবনা কোনওদিন তো মাথায় আসেনি আমার৷ মনে হচ্ছে আমাকে দিয়ে জোর করে যেন লিখিয়ে নিচ্ছে কেউ৷ নাহ৷ আরও বেশি করে হাঁটাহাঁটি করতে হবে৷

৪ নভেম্বর

মনটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে আজ পাবলিক থিয়েটারে একটা লেকচার শুনতে গেছিলাম৷ গিয়ে দেখলাম বক্তৃতার বিষয়বস্তু—আত্মহত্যা ও মৃত্যু৷ প্যাকেশ এক ভদ্রলোক আত্মহত্যা নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিলেন৷ যা বললেন তার সারবত্তা মোটামুটি এই—যাঁরা আত্মহত্যা করে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চান তাঁরা মৃত্যুর পর আদৌ মুক্তি পান না৷ শরীরহীন আত্মাকে আবার ফিরে আসতে হয়৷ একই যন্ত্রণা বারবার সহ্য করতে হয়৷ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একটি মাত্র পথ থাকে তাঁদের কাছে৷ নতুন কোনও শরীর খুঁজে নেওয়া৷ এমন কোনও মানুষ যার শরীরের সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছে৷

শুনতে-শুনতে আবার মাথাটা গরম হয়ে উঠল আমার৷ যতসব বুজরুকি৷ ঠিক করলাম চিঠি লিখে এই ধরনের আজগুবি বক্তৃতা বন্ধ করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে৷

সে রাতে বাড়িতে ঢোকার সময় খেয়াল করলাম, একেবারে উপরের তলার জানলায় আলো জ্বলছে৷ জানলায় একটা মানুষের মাথা আর কাঁধের ছায়া দেখা যাচ্ছে৷ বাড়িওয়ালির ছেলে৷ এত রাতে জেগে-জেগে করছেটা কী!

৫ নভেম্বর

আজ সকালে একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল৷ চেয়ারে বসে একমনে লিখছিলাম৷ এমন সময় বাইরের সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ হল৷ তার ঠিক পরেই আমার দরজায় টোকা পড়তে লাগল৷ এমনিতে আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসে না৷ বাড়িওয়ালি ভেবে চেঁচিয়ে বললাম, ‘দরজা খোলা, ভিতরে চলে আসুন৷’

দরজা কিন্তু খুলল না৷ আগের মতোই টোকা পড়তে লাগল৷ মেজাজ খিঁচড়ে গেল আমার, চিৎকার করে বললাম, ‘বেশ, আসতে হবে না ভিতরে৷ টোকা দিয়ে যান৷’

দরজার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে লেখায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু মন বসল না৷ দরজার টোকাটা যেন কানের একেবারে ভিতর অবধি গিয়ে বাজছে৷ পেনটা কাগজের উপরে ছুঁড়ে ফেলে উঠে পড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম৷ পাল্লাটা একহাতে টেনে প্রায় ধমক দিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম কিন্তু আমার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল৷

দরজার বাইরেটা ফাঁকা৷ একখণ্ড ভোরের কুয়াশা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই সেখানে৷ কয়েক সেকেন্ড সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে দরজাটা এক ধাক্কায় বন্ধ করে আবার টেবিলে এসে বসলাম৷

খানিক পরে এমিল এসে ঢুকল ঘরে৷ মুখ তুলে বললাম, ‘মিনিট খানেক আগে তুমি বা মিসেস মন্সন আমার দরজায় টোকা দিচ্ছিলে?’

‘না তো৷’ সে অবাক হয়ে বলল৷

‘সত্যি করে বল৷’

‘মিসেস মন্সন তো বাজারে গেছেন৷ আমি আর বাচ্চাটা ছাড়া অন্য কেউ নেই বাড়িতে৷ আমি তো বাসন ধুচ্ছিলাম এতক্ষণ৷’

‘তাহলে আমার দরজায় টোকা কে দিচ্ছিল?’

চেয়ার থেকে উঠে তার সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ কাঁধে একটা হাত রেখে চাপা গলায় বললাম, ‘এই বাড়িতে কিছু গন্ডগোল আছে, তাই না?’

‘আসলে ওই ইঁদুরগুলো এমন জায়গায়…’

‘ইঁদুর আমার দরজার টোকা দেয়নি এমিল৷ এ বাড়িতে কিছু ঘটেছিল কোনওদিন?’

এমিলের মুখ দেখে মনে হল আমার থেকে কিছু একটা লুকাতে চাইছে সে৷ কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখা দিল তার৷ আশ্বস্ত করে বললাম, ‘যাই ঘটে থাকুক না কেন, আমাকে নিঃসংকোচে বলতে পারো৷’

মিহি অস্পষ্ট স্বরে সে বলতে শুরু করে, ‘উপরতলায় একজন ভাড়াটে এসেছিলেন…’

ঠিক এই সময় নীচ থেকে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়৷ মিসেস মন্সন ফিরে এসেছেন৷ একটা মৃদু উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে তার মুখ জুড়ে৷ কথাটা শেষ না করেই দৌড়ে পালিয়ে যায় সে৷

১০ নভেম্বর

এই ক-দিনে আমার কাজ বেশ কিছুটা এগিয়েছে৷ উপন্যাসটা ছাপানোর জন্যে মনোনীতও হয়ে গেছে৷ ঘুম হচ্ছে ঠিকঠাক৷ বাচ্চা ছেলেটার গাড়ি টানার আওয়াজটাও আর অতটা বিকট লাগছে না৷ এমনকী বাড়িওয়ালির প্রতি রাগটাও কমে এসেছে এই ক-দিনে৷ মহিলাকে দেখেই বোঝা যায়, কম ঝড়-ঝাপটা যায়নি তাঁর উপর দিয়ে৷ আজ ন-টা নাগাদ বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় রোজকার মতো বেড়ালগুলো পিছু নিয়েছিল৷ তাড়িয়ে দেওয়ার বদলে আজ তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি৷ একটা বিড়াল আদরের ঠ্যালায় আঁচড়ে দিয়েছে হাতে৷ কেন যে করতে গেলাম!

ঘরে ঢুকে দেখি ঘর ঠান্ডা হয়ে আছে৷ টেবিলের উপর থেকে দেশলাইগুলো হাতে নিতে গিয়ে কারও সঙ্গে ছোঁয়া লেগে গেল হাতটা৷ মনে হল অন্ধকারে আমার পাশেই কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে৷

‘কে?’ অজান্তেই গলা দিয়ে শব্দ বেরিয়ে গেল৷

কুয়োর মধ্যে ঢিল পড়ার মতো প্রতিধ্বনিত হল শব্দটা৷ কোনও উত্তর এল না৷ শুধু মনে হল আমার পাশ থেকে কেউ যেন দরজার দিকে সরে গেল৷

দ্রুত হাতে আমি দেশলাই জ্বালালাম৷ ভেবেছিলাম এমিল কিংবা মিসেস মন্সনকে দেখতে পাব৷ কিন্তু ঘর ফাঁকা৷ কেউ নেই৷

আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল৷ দেওয়ালে পিঠ রেখে সেঁটে দাঁড়ালাম৷ পরমুহূর্তে মনে খানিকটা জোর এনে একহাতে একটা মোমবাতি ধরে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷

সিঁড়ির উপরে মোমবাতির আলোটা পড়ে অনেকগুলো ধাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ আমার ঘরে যেই এসে থাকুক না কেন সে এই সিঁড়ি দিয়েই উপরে উঠে গেছে৷ সিঁড়ি কিন্তু ফাঁকা৷ এমনকী কারও পায়ের শব্দ অবধি আসছে না সেখান থেকে৷ ফিরেই যাচ্ছিলাম এমন সময় একটা শব্দ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ খুব ক্ষীণ, অনেকটা যেন বাতাস বয়ে যাওয়ার শনশন আওয়াজের মতো৷ কিন্তু আজ তো বাইরে তেমন হাওয়া বইছে না! তাহলে কোথা থেকে আসছে আওয়াজটা?

মনস্থির করে নিলাম৷ উপরে গিয়েই দেখে আসতে হবে ব্যাপারটা৷ শব্দ এবং স্পর্শ, আমার দুটো ইন্দ্রিয়ই একসঙ্গে ভুল করতে পারে না৷ ধীরে- ধীরে সিঁড়ি দিয়ে পা বাড়ালাম৷

প্রথম ল্যান্ডিংয়ে মাত্র একটা দরজা৷ সেটা বন্ধ৷ পরের ল্যান্ডিংয়েও একটাই দরজা চোখে পড়ল৷ কিন্তু এর হাতলে একবার চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল৷ একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝটকা মুখে এসে লাগাতে বুঝলাম দীর্ঘদিন খোলা হয়নি ঘরটা৷ সেই সঙ্গে নাকে এল একটা অবর্ণনীয় গন্ধ৷ যদিও খুব ক্ষীণ তাও মনে হল তেমন কোনও গন্ধ এর আগে নাকে আসেনি আমার৷

ঘরটা চৌকো এবং ছোট৷ সিলিংটা খানিকটা উঁচুতে৷ দু-দিকের দেওয়ালে দুটো জানলা চোখে পড়ল৷ কনকনে ঠান্ডা আর সেই অদ্ভুত গন্ধটা আমার নার্ভগুলোকে অকারণেই সজাগ করে দিল৷ ঘরের ভিতরে কোনও বড়সড় ফার্নিচার নেই৷ অর্থাৎ একটা মানুষ লুকিয়ে পড়ার জায়গা নেই৷ দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিলাম আমি৷

সে রাতে ঘুমিয়ে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখলাম৷ দেখলাম বাড়িওয়ালি এবং তাঁর সঙ্গে অস্পষ্ট আরেকজন হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে আসছে আমার ঘরে৷ তাদের পিছন-পিছন অনেকগুলো বিড়াল৷ সবাই মিলে খুন করল আমাকে৷ তারপর আমার মৃতদেহটা টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখল ওই চৌকো ফাঁকা ঘরটায়৷

১১ নভেম্বর

সেদিনের পর আর এমিলকে দেখতে পাইনি৷ আমার সমস্ত কাজ মিসেস মন্সনই করে দেন৷ ইচ্ছা করেই যেন তাকে আমার সামনে আসতে দেন না৷

১২ নভেম্বর

আজ সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছিল৷ বাইরের ঘর থেকে একটা বই নিতে এসে দেখি এমিল ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে৷ আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, ভালো করে আগুন কর দেখি, ভারী ঠান্ডা লাগছে৷’

গলা শুনে আমার দিকে পিছন ফিরতেই দেখি এমিল নয়৷ অন্য একজন৷ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমিল কই?’

ছেলেটা মাথা নেড়ে দিল৷ বুঝলাম এমিল কোনও কারণে চলে গেছে৷

বইটা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলাম৷ বেশ বুঝতে পারছি আমার সঙ্গে সেদিনে কথাবার্তার জন্যেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে৷

১৩ নভেম্বর

বিড়ালের আঁচড়ের জায়গাটা ফুলে উঠেছে৷ খানিকটা ব্যথাও অনুভব করতে পারছি৷ এতদিনে সেরে ওঠার কথা কিন্তু তার বদলে আরও লাল হয়ে উঠছে জায়গাটা৷ একটা ছুরিকে অ্যান্টিসেপটিক লোশনে চুবিয়ে সেটা দিয়ে পরিষ্কার করলাম জায়গাটা৷ বিড়ালের আঁচড়ে বড়সড় ক্ষতি হতে পারে বলে শুনেছি, কে জানে৷

১৪ নভেম্বর

বাড়িটা কিন্তু খারাপ লাগছে না আমার৷ এখানে লোকজনের হই-হল্লা নেই, চিৎকার নেই৷ অখণ্ড নীরবতার মাঝে লেখালিখির কাজটা দিব্যি এগোয়৷ শুধু ভিতর থেকে ইঁদুর আর বাইরে থেকে বিড়ালগুলোকে যদি কোনওভাবে সরিয়ে দেওয়া যেত… ভাবছি এক বছর শেষ হলে আরেক বছরের একটা কন্ট্রাক্ট করে নেব৷

১৬ নভেম্বর

নার্ভগুলো মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে৷ আজ সকালে ঘুম ভেঙে দেখি আমার জামাকাপড় ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে৷ বেতের চেয়ারটা উল্টে পড়ে রয়েছে মেঝেতে৷ জামাকাপড়গুলো দেখে মনে হল সারারাত কেউ যেন গায়ে দিয়েছিল সেগুলো৷ রাতে কি কেউ আমার ঘরে আসে? নাকি আমি নিজেই ঘুমের ঘোরে… নাহ; আজ রাতে পা বিছানার সঙ্গে বেঁধে শোব…

১৭ নভেম্বর

কাল রাতে আবার একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখলাম৷ মনে হল কেউ সারারাত একটা আলো হাতে আমার ঘরে ঘোরাফেরা করছে৷ আমার উপরে সে নজর রেখে চলেছে একটানা৷ সেই সঙ্গে সেদিনের সেই অচেনা গন্ধটা বেড়ে উঠেছে আবার৷ ভাবছি রাতে দরজা বন্ধ করে শোব এবার থেকে৷

২৬ নভেম্বর

গত এক সপ্তাহ ডায়েরি লিখিনি৷ কারণ মহানন্দে কাজে ডুবে ছিলাম৷ লেখা-লিখি তুমুল বেগে এগিয়েছে আমার৷ শুধু দুটো ছোট-ছোট ঘটনা ঘটেছে৷ চৌঠা নভেম্বর উপরতলার জানলায় যে ঘরে মাথার ছায়াটা আমি দেখেছিলাম সেটা আসলে সেই চৌকো ফাঁকা ঘরটা৷

আর একটা ঘটনা একটু ভূতুড়ে জাতের৷ কাল রাতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম; বরফ পড়ছিল তখন, আমার ছাতাটা বরফের ভারে বেশ কিছুটা মাথার কাছাকাছি নেমে এসেছিল৷ ফলে চোখের দৃষ্টির বেশিরভাগটাই আড়াল হয়েছিল ছাতায়৷ হঠাৎ মনে হল একটা কোট পরা লম্বা লোক আমার বাড়ির দরজার দিকে হেঁটে গেল৷ ছাতাটা তুলে ধরে তাকাতেই কিন্তু আর দেখতে পেলাম না তাকে৷ এমনকী বরফের উপরে আমার ছাড়া আর কারও পায়ের দাগও নেই৷ অথচ স্পষ্ট দেখেছিলাম৷ গেল কোথায় লোকটা?

২৮ নভেম্বর

দরজা বন্ধ করে শোয়াতে রাতে গন্ডগোলটা হয়নি কিছুদিন৷ কিন্তু গতকাল রাতে একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেল৷ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মনে হল আমার দরজার বাইরে কেউ যেন কান পেতে আছে৷ যত বেশি করে চেতনা ফিরে আসতে লাগল তত বেশি মনে হতে লাগল বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে৷ হাওয়ায় কিন্তু মানুষের নিঃশ্বাসের কোনও শব্দ নেই৷ তাও এমন মনে হচ্ছে কেন?

ক্রমে ব্যাপারটা এত বেড়ে উঠল যে আমি আর বিছানায় থাকতে পারলাম না৷ দরজার দিকে এগিয়ে আসতেই কিন্তু মনে হল দরজার উল্টোদিক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেটা৷ পায়ের শব্দ নয়, মনে হল বাইরে হামাগুড়ি দিয়ে দূরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে৷

মুহূর্তে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ যথারীতি ফাঁকা৷ একটা ঠান্ডা হাওয়া স্পষ্ট আমার কানে-কানে বলে গেল, যে জায়গাটায় এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি একটু আগেই সেখানে অন্য কেউ ছিল৷ এখন সে কোন একটা দরজার ভিতরে গিয়ে লুকিয়েছে৷

দ্রুত চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম৷ সিঁড়ি, ল্যান্ডিং, একতলার অন্য সমস্ত ঘর, কোথাও কেউ নেই৷

মনের ভিতরে ভয়ের বদলে একটা অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে এবার৷ কে কান পাতছিল আমার দরজার বাইরে? কেউ কি লুকিয়ে নজর রাখে আমার উপরে? যে করেই হোক তাকে খুঁজে বের করতেই হবে৷

ফাঁকা প্যাসেজের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি ঘরে ঢুকতে যাব, এমন সময় সিঁড়ির উপরে কিছু একটা দেখতে পেয়ে আমার পা আটকে গেল৷ সিঁড়ির একদিকের রেলিংয়ে বেশ কিছুটা অন্ধকার জমা হয়েছে৷ সেই অন্ধকারে ভালো করে লক্ষ করে বোঝা যায় একটা ছায়ামূর্তি যেন লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে৷ মুখ চোখ হাত পা কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না৷ তবে এটুকু বোঝা যায়, আমাকেই দেখছিল সে৷ ‘কে… কে ওখানে?’

আমি ছুটে গেলাম সেই দিকে৷ ছায়ামূর্তি মুহূর্তে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে সরে গেল৷ আমিও আরও দ্রুত পা চালালাম৷ মনে হল হাওয়ায় ভেসে যেন উপরে দিকে উঠে যাচ্ছে সে৷

আমি ল্যান্ডিংয়ের কাছাকাছি পৌঁছতে বুঝতে পারলাম ছায়ামূর্তি গিয়ে ঢুকেছে সেই চৌকো ফাঁকা ঘরটায়৷ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলাম আমি৷ যেন হাওয়া এসে ঠেলছে দরজাটা৷ এক দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই ঘরটার দরজার মুখোমুখি৷

কয়েক পলকের জন্যে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ দরজাটা আধখোলা৷ ছায়ামূর্তি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নিশ্চয়ই দরজার ঠিক উল্টোদিকেই দাঁড়িয়ে আছে৷ ঘরে ঢুকতে গিয়েও আমার পা আটকে গেল৷

পায়ের নীচে কাঠের ফ্লোরবোর্ডের ভিতর থেকে একটা ইঁদুর কিচ-কিচ করে উঠল৷ আমি ভয় পেয়ে শিউরে উঠলাম৷ পরমুহূর্তেই কেটে গেল ভয়টা৷ কিছুটা পিছনে ফিরে এসে ডান পায়ে একটা জোরে লাথি মারলাম দরজার উপরে৷ সেটা সশব্দে হাট হয়ে খুলে গেল৷ আমি ভিতরে ঢুকে এলাম৷ ধমনিতে রক্তের গতিবিধি অনুভব করতে পারছি৷

একটা নিকষ অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরেছে চারিদিক থেকে৷ এতটুকু আলো নেই কোথাও৷ আন্দাজে দেওয়াল ধরে-ধরে আমি ঘরের ভিতরটা অনুভব করতে লাগলাম৷ তবে সবার আগে বন্ধ করে দিলাম দরজাটা৷

এই চৌকো ঘরটার মধ্যে এখন আমরা দু-জন৷ হয়তো কয়েক ফুটের মধ্যেই৷ কিন্তু কে সে?

ঠিক এই সময় একটা অচেনা আতঙ্ক এসে চেপে ধরল আমায়৷ মনে হল আমাকে ভয় দেখাতে নয়—আমার শরীরটা চায় সে৷ আমার শরীরের খোলসের ভিতরে ঢুকতে চায়৷ প্রতিনিয়ত দৃষ্টি রেখে চলেছে আমার উপরে৷ সুযোগ খুঁজছে উপযুক্ত মুহূর্তের৷

কথাটা মাথায় আসতেই এক ঝটকায় দরজা খুলে নীচের দিকে দৌড় দিলাম আমি৷ ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়৷ সারারাত ঘুম এল না আমার৷ সেই গন্ধটা কথা মনে পড়ল৷ ঘরে ঢুকলেই নাকে আসে গন্ধটা৷ কিসের গন্ধ?

৩০ নভেম্বর

সকালে একটা চিঠি এসেছিল৷ আমার এক পুরনো বন্ধু অস্টিন আমার ঠিকানা জানতে চেয়েছে৷ আগের ঠিকানাতেই পাঠিয়েছিল৷ সেখান থেকে ফরওয়ার্ড হয়ে সকালের মেলে এসেছে৷ আমি তাকে এখানকার ঠিকানা পাঠিয়ে দেখা করতে বলেছি৷

আজ দুপুরে আমার মনে হল বাড়ির বাইরে থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে৷ অথচ নীচে নেমে মিসেস মন্সনকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন আমার খোঁজে কেউ আসেনি৷ আশ্চর্য! এবার কি দিনেরবেলাতেও স্বপ্ন দেখা শুরু হল?

২ ডিসেম্বর

এ ক-দিন যা ঘটেছে তার বেশিরভাগটাই আমি এই ডায়েরিতে লিখিনি৷ বলা যায় কিছুটা ভয়েই লিখিনি৷ সেসব ঘটনার স্মৃতি আমার মনের এককোণে পড়ে থাকতে-থাকতে একটা নির্দিষ্ট আকৃতি নিচ্ছে৷ অনুভূতিটা দিনদিন বেড়ে উঠছে৷

এই ক-দিনে কিছু একটা বদলে গেছে আমার মধ্যে৷ আমি যা ভাবি, যা লিখি, তার সব কিছু আমার নিজের ভাবনা-চিন্তা নয়৷ মনে হয় অন্য একটা মানুষ মাঝে-মাঝে চালনা করে আমাকে৷ তার ভাবনা মাঝে-মাঝে এসে বাসা বাঁধে আমার মাথায়৷ বিশেষ করে কাজ না করে চুপচাপ বসে থাকলে আমার মনের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি৷

নার্ভগুলো আগের মতো সবল নেই৷ ভয়াবহ চিন্তাগুলো মনের ভিতরে চেপে থাকে৷ একটু সুযোগ পেলেই বেরিয়ে এসে গ্রাস করে আমাকে৷

যতদূর মনে পড়ে এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে সেদিন চৌকো ঘরটায় সেই অলৌকিক ছায়ামূর্তির মুখোমুখি হবার পর থেকেই৷

৫ ডিসেম্বর

সেদিনের ঘটনার পর থেকে আমি রাতে আমার ঘরে একটা বাতি জ্বালিয়ে রাখি৷ খুব একটা গোলমাল হয় না আর৷ যদিও গতকাল রাতে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা ভেবে আমার বুক কেঁপে উঠছে এখনও৷

রাতে ঘুম ভেঙে দেখি আমার ঘরের সেই ভাঙা আয়নাটার সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে৷ আয়নায় নিজেকে যেন দেখার চেষ্টা করছে সে৷ মুহূর্তে বুঝতে পারি, এই আমার ঘরে আড়ি পাতা সেই আগন্তুক৷ অচেনা সেই গন্ধটা তীব্রভাবে নাকে আসছে আমার৷

ছায়ামূর্তিটা দীর্ঘ৷ আমার দিকে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ মুখের সামনের দিকটা নেমে আসা চুলে ঢাকা পড়ে গেছে৷ সমস্ত গায়ে লাল ছোপ- ছোপ দাগ৷ এক মনে নিজেকে দেখে চলেছে সে৷

আমার গলা দিয়ে অস্ফুটে একটা শব্দে বেরিয়ে আসতেই আমার দিকে ফিরে তাকায় সে৷ সেই বীভৎস চোখের দৃষ্টি এসে পড়ে আমার মুখে৷ একটা আর্ত চিৎকার করে আমি জ্ঞান হারাই৷

ভোর রাতে একটা পরিচিত গলা শুনে আমার ঘুম ভাঙে৷ চোখ খুলে দেখি আমার নিজের ঘরের ইজিচেয়ারে শুয়ে আছি৷ আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে এমিল৷ এতদিন পরে তাকে দেখে মনের উৎকণ্ঠাটা কিছুটা কাটল৷ চারপাশটা একবার দেখে চোখে হাত ঘষতে ঘষতে বললাম, ‘তুমি! তুমি ফিরে এলে কবে?’

‘আমি তো যাইনি স্যার৷’ সে শান্ত গলাতেই বলল৷

‘তবে মিসেস মন্সন…’

‘উনি আপনাকে সত্যিটা জানাতে চাননি৷ তাই আমাকে আপনার সামনে আসতে দেননি৷’

‘কী সত্যি? বলো আমাকে…’

এখনও ভালো করে বাইরের আলো ফোটেনি৷ মিসেস মন্সনের ঘুম হয়তো ভাঙেনি এখনও৷ সেটা মনে করেই মুখ নামিয়ে সে বলে, ‘বছর খানেক আগে আমাদের একেবারে উপরের তলার ঘরে এক ভাড়াটে আসে৷ ভদ্রলোক চুপচাপ থাকতেন৷ দেখা হলে একগাল হাসি আর মাঝে-মাঝে ইঁদুরের উৎপাতের জন্য মিসেস মন্সনের কাছে অভিযোগ করতে আসতেন৷ তো এখানে আসার কিছুদিন পর ভদ্রলোক কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন৷ রোগের প্রকোপে মুখচোখ বিকৃত হয়ে যায় তার৷ দগদগে ঘায়ে গায়ের চামড়া ভরে যায়৷ কিছুদিন পরে আর সোজা হয়ে চলতে পারতেন না৷ বুনো জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেন৷ নাক দিয়ে ক্রমাগত রক্ত বের হত৷ ফলে যেখান দিয়ে হামাগুড়ি দিতেন সেখানেই চাপ-চাপ রক্ত পড়ে থাকত৷

যেহেতু রোগটা ছোঁয়াচে তাই ওনাকে একটা ঘরে তালা চাবি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়৷ আমিই গিয়ে দরজার তলা দিয়ে খাবার দিয়ে আসতাম৷ একটা সময়ের পরে খাবারগুলো অভুক্তই পড়ে থাকত৷

শেষে একদিন খাবার দিতে গিয়ে দেখি ঘরের দরজার বাইরে অনেকগুলো বিড়াল একসঙ্গে জড়ো হয়েছে৷ ভাবলাম পড়ে থাকা খাবারের লোভে৷ কিন্তু সামনে গিয়ে দরজার ভিতর থেকে একটা কিচ-কিচ আওয়াজ পেলাম৷ যেন অনেকগুলো ধেড়ে ইঁদুর এক জায়গায় জড়ো হয়েছে৷ সন্দেহ হতে দরজা খুলে দেখি…’

পরের কথাগুলো বলতে গিয়ে একটু থেমে গেল এমিল; আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম৷ তাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘কী দেখলে?’

‘দেখলাম ঘরের একেবারে মাঝে দু-হাত এবং দু-পায়ে ভর দিয়ে পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে আছে একটা মৃতদেহ৷ আর তার সমস্ত শরীর খুঁটে খাচ্ছে অন্তত শখানেক ধেড়ে ইঁদুর৷ কী বীভৎস সে দৃশ্য তা কল্পনা করতেও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে৷

পরে আমরা জানতে পারি কোনও বিশেষ ধরনের বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন ভদ্রলোক৷ সেই বিষের প্রভাবেই মৃত্যুর পরেও তার শরীরটা ওইভাবে হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থাতেই থেকে যায়৷ এরপর থেকেই এ বাড়িটা আর ভালো নেই স্যার৷’

এমিল থামতে জানি না কেন সেই লেকচারের কথাটা মনে পড়ে যায় আমার৷ আত্মহত্যার পর মৃত মানুষের আত্মা একটা নতুন শরীর খুঁজে বেড়াতে থাকে৷ এমন একটা শরীর যার আত্মা দুর্বল৷

এমিল ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল৷ ঘরের দরজাটা এখন আধখোলা রয়েছে৷ ওপার থেকে একটা আওয়াজ এসেছে এক্ষুনি৷ আমি এগিয়ে গিয়ে হাতের এক টানে খুলে ফেললাম দরজাটা৷ নীচটা ফাঁকা, শুধু কাঠের মেঝের উপরে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ পড়ে আছে…

অনূদিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *