1 of 2

সে আর এক কলকাতার

সে আর এক কলকাতার

‘সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। এ বচনটা আজকের কলকাতা সম্বন্ধে বিশেষভাবে খাটে। আজকের কলকাতা দেখে কেউই অনুমান করতে পারবে না, আমার ছেলেবেলার কলকাতার চেহারা কি রকম ছিল। আমার ছেলেবেলার কথা বলতে আমি ৮০/৮৫ বছর আগেকার কথা বলছি।

আমার ছেলেবেলায় ছেলেরা পড়াশুনায় আজকালকার ছেলেদের চেয়ে বেশী মনোযোগী ছিল। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা পড়াশুনায় মন দিত। সকালে ঘুম থেকে উঠবার জন্য তাদের এলারম ঘড়ির দরকার হত না। ভোরবেলা পথে লোকজন বেরুবার আগেই করপোরেশনের ঝাড়ুদাররা রাস্তা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিত। এই ঝাড়ুদারদের ঝাঁট দেবার শব্দটাই আমাদের কাছে এলারম্ ঘড়ির কাজ করত। রাস্তা দিনে দুবার ঝাঁট দেওয়া হত। একবার ভোরবেলা, আর একবার দুটো/তিনটার সময় ৷ ঝাঁট দিয়ে আবর্জনাগুলো এক নির্দিষ্ট স্থানে জড় করে রাখত।

ঝাড়ুদারদের কাজ শেষ হবার আগেই শব্দ হত আবর্জনা নিয়ে যাবার গাড়ির। এগুলি ছিল ঘোড়ায় টানা লোহার গাড়ি। তবে গলিঘুঁজির ভিতর গাড়িগুলি যেত না। গলিঘুঁজির ভিতর থেকে ঝাড়ুদাররা তিন চাকার ঠেলাগাড়ি করে আবর্জনা বড় রাস্তার নির্দিষ্ট স্থানে এনে রাখত। সেখান থেকে ঘোড়ায় টানা আবর্জনা-বাহী গাড়িগুলি সেগুলিকে উঠিয়ে নিয়ে যেত। আমাদের শ্যামবাজার-বাগবাজার অঞ্চলে আবর্জনা-বাহী ঘোড়ার গাড়িগুলি আবর্জনা দু’জায়গায় নিয়ে গিয়ে জড়ো করত। একটা জায়গা ছিল বাগবাজারে অন্নপূর্ণা ঘাটের সামনে একটা সরু গলির ভিতর। আর একটা ছিল সারকুলার রোড ও উল্টাডাঙ্গা রোডের মোড়ের সামান্য দক্ষিণে। ওখানে একটা উঁচু পাকা প্লাটফরম ছিল, তার দু’দিক ছিল ঢালু, যাতে গাড়ি প্লাটফরমের ওপর উঠে আবার বিপরীত দিক দিয়ে নেমে আসতে পারে। ওই প্লাটফরমের ওপর শহরের যত আবর্জনা জড় করা হত।

শহরের ভিতর দিয়ে করপোরেশনের একটা রেলপথ ছিল। এই রেলপথটা তৈরী করা হয়েছিল ১৮৬৮-৬৯ খ্রীষ্টাব্দে। তার মানে করপোরেশন গঠিত হবার পাঁচ বছর পরে। এটা বাগবাজারের অন্নপূর্ণা ঘাটের সামনে থেকে শুরু করে সমস্ত বাগবাজার স্ট্রীটের উত্তরাংশ দিয়ে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে এসে সারকুলার রোড ধরে ধাপা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আগে সারকুলার রোড ও উল্টাডাঙ্গার মোড়ের কাছে যে প্লাটফরমের কথা বলেছি রেলগাড়িটা ওই প্লাটফরমের গা ঘেঁষে যেত। প্লাটফরমের ওপর থেকে সমস্ত আবর্জনা রেলগাড়িতে ভরতি করে দেওয়া হত। অনুরূপ প্লাটফরম ছিল, রাজাবাজারের কাছে; সেখানেও আবর্জনা ওই রেলের মালগাড়িতে ভরতি করা হত। এ রকম ভাবে আবর্জনা নিতে নিতে রেলগাড়িটা ধাপা পর্যন্ত যেত। সেখানে গাড়িগুলি খালাস করা হত। 

রেলগাড়িটা করপোরেশনের আর এক রকম কাজেও লাগত। রেলপথটার সংযোগ ছিল ইষ্টার্ন রেলের (তখন নাম ছিল ইষ্টার্ন বেঙ্গল স্ট্রেট রেলওয়ে।)চিৎপুর রেল ইয়ার্ডের সঙ্গে। কলকাতার রাস্তাঘাট মেরামতের জন্য ফুটপাতের ধারে ও নর্দমায় বসাবার জন্য করপোরেশনের দরকার হত অনেক পাথরকুচি ও পাথরের থান বা স্ল্যাব (slab)। এগুলি রেলপথে বাইরে থেকে আসত, এবং মালগাড়িগুলি চিৎপুর রেল ইয়ার্ডে এসে পৌঁছলে, এগুলোকে টেনে আনা হত পোর্ট ট্রাস্টের রেলপথ দিয়ে অন্নপূর্ণা ঘাটের সামনে। তারপর করপোরেশনের রেল ওগুলিকে টেনে এনে খালাস করত করপোরেশনের মেটাল ইয়ার্ডে। মেটাল ইয়ার্ড ছিল আজ যেখানে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব হয় সেখানে। প্রথম যখন পুজা হয়, জায়গাটা তখন আরও বিস্তীর্ণ ছিল। এখন এটাকে সঙ্কুচিত করে আনা হয়েছে। এ জায়গাটার একটা ঐতিহাসিক পটভূমিকা আছে। ইংরেজরা যখন প্রথম কলকাতায় আসে, তখন খালধার পর্যন্ত উত্তর পার্শ্বস্থ জমি সমেত ওখানে ছিল পেরিন সাহেবের বাগানবাড়ী ও জাহাজ ঘাটা। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সিরাজদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করে, তখন ইংরেজরা এখানেই স্থাপন করেছিল একটা তোপমঞ্চ (battery), এবং এখানেই হয়েছিল দুই পক্ষের প্রথম সংঘর্ষ। পরে এটা ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর শ্বশুর মহাশয় কিনে নিয়েছিলেন, এবং সেই উপলক্ষ্যে ওয়ারেন হেষ্টিংস মাঝে মাঝে বাগবাজারের ওই বাগানবাড়ীতে এসে বাস করতেন। 

আমার ছেলেবেলার রাস্তাঘাট ঠিক এখনকার মত ছিল না। তবে সে যুগের মান অনুযায়ী রাস্তাঘাট ভালই ছিল। প্রতি বৎসর নিয়মিত সময়ে রাস্তাঘাট মেরামত করা হত। প্রথমে রাস্তার তলায় ঝামা দেওয়া হত, তার ওপর দেওয়া হত পাথরের খোয়া ও তার ওপর ছোট পাথর কুচি। ঝামাই বলুন, আর ছোট বড় পাথর কুচিই বলুন, প্রত্যেক মালটাই ষ্টীম রোলার দিয়ে ভাল করে পেষণ করা হত। করপোরেশনের. অনেকগুলি পেষণকারী ষ্টীম রোলার ছিল। এগুলির চালক বা ড্রাইভাররা ছিল সব ফিরিঙ্গি সাহেব রাস্তা ঠিক ভাবে পেষণ করা হচ্ছে কিনা, তা দেখবার জন্য করপোরেশনে নিযুক্ত ইওরোপীয়ান সাহেব পরিদর্শনকারীরা আসতেন। তাদের মধ্যে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলা আমরা ছেলেবেলায় অবাক হয়ে শুনতাম। পাথর কুচি পেষণ করে যখন রাস্তা একেবারে সমতল ও মসৃণ করা হত, তারপর তাকে আরও মসৃণতর করা হত তার ওপর সুরকি বা রাবিশচূর্ণ দিয়ে। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কাজটাই ষ্টীম রোলার দিয়ে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করা হত। 

রাস্তার একেবারে ওপরটা রাবিশচূর্ণ দিয়ে মসৃণ করা হত বলে, সেগুলো শুকিয়ে গেলে ধুলো হত। যাতে ধুলো না ওড়ে, সেজন্য দিনে দু’তিনবার জল দেওয়া হত রাস্তায় জল দেবার জন্যে ফুটপাতের ধারে গঙ্গাজলের চাপা কল বসান থাকতো। দু’জন লোক রাস্তায় জল দেবার জন্য তাদের সরঞ্জাম নিয়ে একটা চাপা কল থেকে আর একটা চাপা কলে ছুটে যেত। সরঞ্জামের মধ্যে ছিল একটা ক্যানভাসের চার-ইঞ্চি ব্যাস পরিমিত মোটা (hose) পাইপ। তার এক দিকে লাগানো থাকত একটা তামার তৈরী সরু লম্বা- নল, আর অপর দিকে থাকতো প্যাঁচ দিয়ে রাস্তার চাপা কলের সঙ্গে সংযুক্ত করবার জন্য একটা পিতলের প্যাঁচকল। ওই অংশটায় লাগিয়ে দিয়ে, একটা ইংরেজি “T” আকারের রেঞ্চ দিয়ে কলটার চাবি খোলা হত, যাতে কল থেকে খুব তোড়ে জল বেরোয়। তারপর অপর ব্যক্তি লম্বা নলবিশিষ্ট অংশটি ধরে রাস্তাটাকে বেশ করে ভিজিয়ে দিত। কোথাও আগুন লাগলে জলের জন্য দমকল বাহিনী রাস্তার এই কলের জলই ব্যবহার করত। তবে প্রসঙ্গত পাঠকদের জানিয়ে রাখি, তখনকার দিনে দমকলের গাড়ী ঘোড়ায় টানতো কিন্তু তারা খুব তৎপরতার সঙ্গে অকুস্থলে এসে উপস্থিত হত। 

তবে চৌরঙ্গী অঞ্চলে রাস্তায় জল দেওয়া হত না। সেখানে রাস্তা কেরোসিন তেল দিয়ে পালিশ করা হত। (তখনকার দিনে প্রত্যেক সওদাগরী অফিসের সব ঘরও কেরোসিন তেল দিয়ে পালিশ করা হত)। সাহেব পাড়া আর দেশী পাড়ার মধ্যে এই বিষয়েই যে তফাৎ ছিল তা নয়; আর একটা বিষয়েও তফাৎ ছিল। সেটা হচ্ছে ফুটপাতের! কলকাতায় প্রথম ফুটপাত তৈরী হয় ওলড কোর্ট হাউস ষ্ট্রীটে ১৮৬১-৬২ খ্রীষ্টাব্দে। সাহেব পাড়ার ফুটপাতগুলো ঢাকা ছিল বড় বড় চৌকো পাথরের থান* দিয়ে। (যে সময়ের কথা বলছি সেটা আমার ছেলেবেলার, তখনও সিমেন্টের প্রচলন হয় নি)। আর দেশী পাড়ার ফুটপাতগুলি ছিল একেবারে কাঁচা মাটির। তার ফলে বর্ষাকালে ফুটপাত দিয়ে হাঁটলে (না হাঁটলে আদালতে শাস্তি পেতে হত, পরে দেখুন) পায়ে এক গোছ কাদায় ভরে যেত। তখনকার দিনের দেশীপাড়া বলতে বৌবাজার স্ট্রীটের উত্তরাংশ বুঝাতো। দেশী-পাড়ার একমাত্র জায়গা যেখানে ফুটপাত পাথরের থান দিয়ে বাঁধানো ছিল, সেটা হচ্ছে হেদুয়ার ধারে বেথুন কলেজের সামনে ও তার অপর দিকের ফুটপাতে। এটা আমার মনে হয় জেনারেল এমব্লিজ ইনষ্টিটিউশন-(পরে স্কটিশ চার্চেস কলেজ)-এর সাহেব মেমেদের ও বেথুন কলেজের মেয়েদের সুবিধার জন্যে। দেশীপাড়ার ফুটপাতগুলি প্রথম সিমেণ্ট দিয়ে বাঁধানো হয় প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। 

ফুটপাত সম্বন্ধে প্রসঙ্গত আর একটা কথা এখানে বলা দরকার। প্রতি রাস্তার মোড়ে চার ভাষায় লিখিত কমিশনার অফ পুলিশের বিজ্ঞপ্তি ছিল—”যুক্তিযুক্ত কারণ ব্যতীত ফুটপাত ব্যতীত রাস্তা দিয়া চলিলে, অপরাধী অভিযুক্ত হইবে ও শাস্তি পাইবে।” রাস্তা দিয়ে যারা হাঁটতো, পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যেত। সেজন্য সকলকেই ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হত। তখনকার দিনে ফুটপাত ভাড়া দেওয়া করপোরেশন অত্যন্ত গর্হিত ও জঘন্য কাজ বলে মনে করত। 

তবে কলকাতায় তখন এত রাস্তাঘাট ছিল না। গলিঘুঁজি অবশ্য অনেক ছিল। দক্ষিণ থেকে উত্তরে আসতে হলে কলকাতার মাত্র একটা রাস্তাই ব্যবহৃত হত। সেটা হচ্ছে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট (বর্তমান বিধান সরণী) ও তার দক্ষিণে কলেজ স্ট্রীট ও ওয়েলিংটন স্ট্রীট। অবশ্য কলকাতায় আরও দুটি রাস্তা ছিল—সারকুলার রোড যার আধখানা দখল করে রেখেছিল ময়লা ফেলা রেলগাড়ি, আর চিৎপুর রোড যেটা কলকাতার সবচেয়ে পুরানো রাস্তা ও অতি সঙ্কীর্ণ। এর কোনওটাই কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের মত প্রশস্ত ও সুন্দর রাস্তা ছিল না। বস্তুতঃ এ রাস্তটার সৌন্দর্য ছিল অপূর্ব। রাস্তার দুধারে ছিল দশ বিশ হাত অন্তর কৃষ্ণচূড়ার গাছ। গাছগুলিতে যখন ফুল ফুটতো, তখন মনে হত রাস্তার দুধারের মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে লাল ফুলের ঢেউ। 

সেজন্য যখনই ছোটলাট (গভর্ণর) বা বড়লাট। (ভাইসরয় ও গভর্ণর-জেনারেল) কলকাতা (তখন দুজনেই কলকাতায় থাকতেন) থেকে ব্যারাকপুরের লাটবাড়ীতে যেতেন, তখন এই রাস্তা দিয়েই যেতেন। তাছাড়া, এই রাস্তা প্রতি রবিবার কেল্লার (ফোর্ট উইলিয়ামের) গোরা সৈন্যরা দলবদ্ধ হয়ে মার্চ করতে করতে দমদম ও ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে যেত। 

আর পূব থেকে পশ্চিমে যাবার বড় রাস্তাগুলি ছিল যথাক্রমে ধর্মতলা স্ট্রীট, বৌবাজার ষ্ট্রীট, হ্যারিসন রোড, (এটা আমি জন্মাবার কয়েক বছর আগে ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে তৈরী হয়েছিল) বিডন স্ট্রীট, গ্রে স্ট্রীট, বাগবাজার স্ট্রীট ও শ্যামবাজার স্ট্রীট। বিডন স্ট্রীট তৈরী হয় ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ও গ্রে স্ট্রীট ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে। এদের মধ্যে বিডন স্ট্রীট ও শ্যামবাজার স্ট্রীটের একটা ঐতিহ্য ছিল, কেননা এই দুটি রাস্তা দিয়েই রাসপূর্ণিমার দিনে পরেশনাথের মিছিল যেত। (এখন সে মিছিলের আর প্রাচীন সমারোহ নেই)। একবার মিছিলের সময় শ্যামবাজার স্ট্রীট মেরামত হচ্ছিল। সেজন্য পরেশনাথের মিছিল গ্রে স্ট্রীট দিয়ে ঘুরে যায়। তারপর থেকে মিছিলটা ওই রাস্তা দিয়েই যেতে থাকে। 

সাহেব পাড়ার সঙ্গে দেশী পাড়ার রাস্তাঘাটের তফাৎ থাকলেও একথা স্বীকার করতে হবে যে ইংরেজ আমলে, করপোরেশন কলকাতার রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবার জন্য যতটা সচেষ্ট ছিল, পরবর্তী যুগে আর সেটা লক্ষ্য করি নি। আমার ছেলেবেলার যুগে যদি পণ্ডিত নেহেরু কলকাতায় এসে এটাকে “নোংরা শহর” বলতেন, তা হলে বলতে বাধ্য হতাম যে তিনি সত্যের অপলাপ করছেন। 

পাছে লোকে রাস্তার যেখানে সেখানে প্রস্রাব করে, তা নিরোধের জন্য প্রতি ২৫০ গজ অন্তর একটা করে সাধারণের প্রস্রাবাগার ছিল। এ ছাড়া, প্রতি গলির মুখে দুভাষায় লেখা থাকত “Commit No Nuisance, এখানে প্রস্রাব করিও না।” পুলিশও ওঁত পেতে থাকতো; প্রস্রাব করলেই ধরে নিয়ে যেত। সাজা একরাত্রি হাজত বাস ও পরদিন আদালতে তিন টাকা থেকে পাঁচ টাকা জরিমানা। এখন সাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রস্রাবাগারগুলি তুলে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে পথচারী, ফেরিওয়ালা, দোকানদার প্রভৃতি রাস্তাতেই প্রস্রাব করে। একটা দৃষ্টান্ত দিই। আজ শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে যেখানে নেতাজীর অশ্বারোহী মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে, ওখানে আগে ছিল সাধারণের ব্যবহারের জন্য একটা প্রস্রাবাগার। 

এছাড়া শহরের বহু জায়গায় ছিল বড় বড় হামাম। এগুলিকে আমার ছেলেবেলায় ‘হৌস’ বলা হত। এগুলো ছিল সাধারণের স্নান করবার ও কাপড় কাচবার জায়গা। মেয়ে ও পুরুষদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। আমাদের শ্যামবাজারে একটা হৌস ছিল শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর পাশে। ওখানে ছিল একটা বিরাট বস্তি। ওই বস্তিটাকেই উচ্ছেদ করে মল্লিকরা তাদের বিশাল বাড়ী তৈরী করে। 

ওই সময়েই ওই ‘হৌস’টাকে বিলুপ্ত করা হয়। এ রকম ‘হৌস’ কলকাতা শহরে কয়েক শত ছিল। সেগুলি আর নেই। তবে এখনও নজরে পড়ে দু-তিনটা হৌস। একটা শ্যামবাজারের পোস্ট অফিসের সামনে মোহনবাগান লেনে ঢুকতে বাম দিকে, একটা রাজাবাজারের সামনে আর একটা প্রিনসেপ ষ্ট্রীটে। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকে শহরে প্রথম মাটির তলায় জলনিকাশের জন্য ড্রেন পাইপ বসানো হয়। আমি জন্মাবার কয়েক বছর আগে এক ভীষণ ভূমিকম্প হয়েছিল। আমি ছেলেবেলায় শুনেছিলাম যে পানীয় জলের পাইপ ও ড্রেন পাইপ –এদুটো পাশাপাশি থাকার দরুন এই ভূমিকম্পে মাটির তলার দুটি পাইপই চিড় খেয়ে যায়। তার ফলে সেই সময় থেকে একটার জল আর একটাতে অনবরত আনাগোনা করছে। সেটাই নাকি এই শহরে সংক্রামক ব্যাধির কারণ। 

মাটির তলায় জলনিকাশের ব্যবস্থা হবার পর করপোরেশন শহরবাসীদের পাকা পায়খানা নির্মাণ করতে পরামর্শ দেন। তবে আমার ছেলেবেলায় পায়খানার সিস্টার্নের জন্য ব্যবহার করা হত গঙ্গোদক। আর অন্যান্য কাজের জন্য ব্যবহৃত হত পরিশোধিত পানীয় জল। তবে পাকা পায়খানা হওয়া সত্ত্বেও, আমি আমার ছেলেবেলায় বহু বাড়ীতে খাটা পায়খান থাকতে দেখেছি। বিশেষ করে বস্তির বাড়ীগুলোতে তো ছিলই। এ সকল খাটা পায়খানার মল পরিষ্কার করবার জন্য করপোরেশনের বহু মেথর ও মেথরাণী ছিল। তাদের বসবার জন্য করপোরেশন বহু ঘরবাড়ীও তৈরী করে দিয়েছিল। 

শহরে পানীয় জল সরবরাহের জন্য প্রথম কতকগুলি পুষ্করিণী ছিল, যেমন—লালদীঘি, গোলদীঘি, হেদুয়া প্রভৃতি। তবে সে সব একশো বছর আগেকার কথা। তারপর যখন নলের সাহায্যে জল সরবরাহ শুরু হল, তখন করপোরেশন কতকগুলি জলাধার সৃষ্টি করল। শহরের ভিতর এ রকম জলাধার ছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ার ও বিডন স্কোয়ারে। এ দুটি পার্কের মধ্যে এখন যেখানে উঁচু জায়গা দেখতে পাওয়া যায়, জলাধারগুলি সেখানেই ছিল। তারপর ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে টালার ওপর-তলার জলাধার নির্মিত হবার পর, করপোরেশন খুব বৃহদাকার (আট ফুট ব্যাস) নল শহরের রাস্তায় বসালেন। এই বৃহদাকার নল বসান আছে সারকুলার রোডের নীচে। এই বৃহদাকার নল থেকেই অন্য রাস্তার নল শাখা-প্রশাখা হিসাবে বেরিয়ে গেছে। এ সব আমার চোখে দেখা জিনিস। কেননা তখন আমি সারকুলার রোডের ওপর অবস্থিত এক স্কুলে পড়তাম, এবং স্কুলে বসেই এই বৃহদাকার নল বসানো দেখতাম। তারপর ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ পলতার জলাধার ও পাম্পিং ষ্টেশন প্রসারিত করা হল। এই জমিটার ওপরই আমার শ্বশুরদের ১০৮-কামরা বিশিষ্ট বসতবাড়ী ও তৎসংলগ্ন বাগান ছিল। সুতরাং এ সম্বন্ধে আমার জ্ঞান একেবারেই প্রত্যক্ষ। এ ছাড়া শহরের নানা স্থানে ছক্কর গাড়ীর ঘোড়াদের খাবার জন্য ফুটপাতের ধারে অবস্থিত ছিল লোহার তৈরী জলাধার। 

শহরের লোকের আর একটা ভুল ধারণা আমি এখানে দূর করতে চাই। সকলেরই ধারণা যে শহরের জল আসছে টালার ওপরতলার জলাধার থেকে। তা নয়। টালার পাম্পিং ষ্টেশনের উত্তরে মাটির তলায় আছে বহু জলাধার। এগুলি আনুমানিক ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ তৈরী করা হয়েছিল। এগুলির ওপরই টালার পাম্পিং ষ্টেশনের উত্তরে মনীন্দ্র রোড পর্যন্ত বিস্তৃত পার্কটা অবস্থিত। সাম্প্রতিককালে দক্ষিণদিকেও মাটির তলায় কয়েকটি জলাধার তৈরী করা হয়েছে। 

সে যুগে শহরবাসীদের স্বাস্থ্যটার প্রতি করপোরেশন বিশেষভাবে অবহিত ছিল। যাতে শহরে ভেজাল দ্রব্য বা পচা মাছ বা জলমেশানো দুধ না বিক্রয় হয়, তার জন্য ছিল করপোরেশনের ডাক্তার। তারা রাস্তায় রাস্তায় ও বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াত। রাস্তায় গোয়ালাদের ধরে ল্যাকটোমিটার যন্ত্র দুধের মধ্যে ফেলে দিত। তারপর যদি দুধে জল আছে দেখা যেত, তা হলে সে দুধ ফুটপাতের ধারে ফেলে দিত। (আমার ছেলেবেলায় কলকাতায় টাকায় আট-দশ সের দুধ পাওয়া যেত)। এ রকম বাজারসমূহের বাহিরের নর্দমার ধারে গাদা গাদা পচা মাছ হামেশা দেখতে পাওয়া যেত। সবই করপোরেশনের ডাক্তার কর্তৃক বাতিল করা মাছ। এ সব কাজে করপোরেশনের ডাক্তারদের সাহায্য করত করপোরেশনের পুলিশ। হ্যাঁ, করপোরেশনের নিজস্ব পুলিশ ফোর্স ছিল। এদের পোষাক ছিল খাঁকি রঙের ইউনিফরম ও নীল রঙের পাগড়ি। আর সাধারণ পুলিশের পোশাক ছিল সাদা রঙের ইউনিফর্ম ও লাল রঙের পাগড়ি। সকলেরই হাতে থাকত লম্বা লাঠি। করপোরেশনের পুলিশের মুখ্য কাজ ছিল শহরের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা। তারা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখত যানবাহনটানা গরু ঘোড়াকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে কিনা। তখন কলকাতা পুলিশের কোন ট্রাফিক পুলিশ ছিল না। পরে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের পর করপোরেশনের পুলিশ ফোর্স তুলে দেওয়া হয়। করপোরেশনের এই বিভাগের কাজ গ্রহণ করে কলকাতা পুলিশের ভেহিকলস ডিপার্টমেন্ট ও সোসাইটি ফর দি প্রিভেনশন অভ্ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেলস্। 

তখন শহরের যানবাহন বলতে ছিল ঘোড়ার গাড়ি ও পালকি, আর মালবহন করবার জন্য ছিল গরু ও মহিষের গাড়ি। খুব বড়লোকদের দু-চার খানা মোটরগাড়ি ছিল। এই সকল গাড়ি-ঘোড়া ইত্যাদির লাইসেন্স করপোরেশন প্রদান করত। এখনকার মত পুলিশ নয়। সাহেবসুবো ইওরোপীয়নরা ঘোড়ার গাড়িই ব্যবহার করত। 

শহরে স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যে মাত্র করপোরেশনের নিযুক্ত ডাক্তার ছিল, তা নয়। তখন কলকাতা শহরের বহু জায়গায় ছিল গোয়ালাদের খাটাল। বাগবাজারের রাজবল্লভপাড়ায় ও গোয়াবাগানে এ রকম বহু খাটাল ছিল। খাটালসমূহে গরুগুলিকে যাতে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে রাখা হয়, তা প্রদর্শনের জন্য করপোরেশন একটা আদর্শ গোশালা স্থাপন করেছিল। এটা অবস্থিত ছিল বাগবাজারে নন্দলাল বসু লেনে। পরে গোশালাটা উঠে যাবার পর, ওই জমিটাই করপোরেশন লীজ স্বত্বে দেয় মহারাজা কাশিমবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিট্যুটকে। ওইখানেই এখন ওই স্কুলটা অবস্থিত। আমি যখন ওই স্কুলের সেক্রেটারী ছিলাম, তখন সেই গোশালার ঘরটাই ব্যবহৃত হত হাতের কাজ (technical subjects) শিক্ষা দেবার জন্য। এখন এটা তুলে দেওয়া হয়েছে! 

আমার ছেলেবেলায় শহরের বড় রাস্তাগুলোয় ছিল গ্যাসের আলো। গলিঘুঁজির ভিতর তখনও তেলের আলো জ্বলত। আর লোকের বসত বাড়ীতে? তখনও হারিকেন লানটার্ন আমদানী হয় নি। আমরা পড়াশুনা করতম রেড়ির তেলের প্রদীপের আলোতে। আর তখনকার দিনের লেখা-পড়ার সাজসরঞ্জামের বিষয় বললে, এখনকার অনেক ছেলে আশ্চর্য হয়ে যাবে। ফাউনটেন পেনের তো তখন প্রচলন হয়নি। নিব লাগানো কলমে লিখলেও, সেদিন আর অক্ষত হাতে বাড়ি ফিরতে হত না। যতক্ষণ না হাতের পাতা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত মাষ্টারমশাইরা বেত্রাঘাত করে যেতেন। বাংলা লিখতে হত খাগের কলমে, আর ইংরেজি হাঁসের পালকের কলমে। এ সব আজকালকার দিনে অনেকের কাছে রূপকথা বলে মনে হবে। তবে যারা সে যুগের কথা জানতে চান তাঁরা এই লেখকের ‘কালের কড়চা : চন্দ্রাবতী’ বা ‘শতাব্দীর প্রতিধ্বনি’ বই দুটি পড়তে পারেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *