সেশেলস্

সেশেলস্

এমন যে কোনো জায়গা আছে বা থাকতে পারে, তা আমার ধারণা ছিল না৷ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে গেছি আমি; তবুও৷ প্লেনটা যখন নীচে নামতে লাগল তখন জানালা দিয়ে চেয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম সবুজ, নীল, গেরুয়া, হলুদ, সাজিমাটি আর পাটকিলে রঙের যে কী সমারোহ—কী বলব! ছোট্ট-ছোট্ট দ্বীপ৷ কোনো স্বপ্নও বুঝি এমন রঙিন বা সুন্দর হয় না! এমন কোনো দ্বীপের কাছে আমার জাহাজ-ডুবি হলে রবিনসন ক্রুসোর মতো নির্বাসনে থাকতে আমার আপত্তি ছিল না৷

জেট প্লেনটা নীচু হতে হতে যখন এয়ারপোর্টের টারম্যাক ছুঁল, তখন মনে হল এক্ষুনি বুঝি সমুদ্রের জলেই পড়ে যাবে৷ ট্যাক্সিইং করে গিয়ে যেখানে মুখ ঘোরাল সেখানেও মনে হল যেন হাত বাড়ালেই সমুদ্র ছোঁয়া যায়৷

প্লেন থেকে নেমে দেখি এয়ারপোর্টের ডানদিকে, স্টার বোর্ড সাইডে সমুদ্রের সবজে-নীল ধু-ধু জলের মাঠ পেরিয়ে কাছে ও দূরে দিগন্তরেখার উপর ছোট-ছোট তিনটি দ্বীপ দেখা যাচ্ছে৷ এই’ই তাহলে সেশেলস্ দ্বীপপুঞ্জ৷

এয়ারপোর্টের নাম মাহে৷ দ্বীপের নামেই নাম৷ বললে বিশ্বাস করবে না, এই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ মাহে৷ কত বড় এলাকা বলো তো?

মস্ত বড়! সতেরো মাইল লম্বা আর মাইল তিনেক চওড়া—তাও আবার সমতল জমি নয়৷ পাহাড়-টাহাড় সব নিয়ে৷ সেশেলসের বানান Scychelles৷ একটু গোলমেলে৷ তাই না? ফরাসি ভাষায় এমন একটু গোলমাল হয়ই৷

আমারও হয়েছিল৷ ওখানে PRASLIN বলে একটা দ্বীপে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে প্লেনের টিকিট কাটতে গিয়ে বলেছিলাম, প্রাসলিনের টিকিট চাই৷ কাউন্টারের মেয়েরা তো হেসেই বাঁচে না কথা শুনে৷ আমি বোকার মতো চেয়ে থেকে ইংরেজিতে বানান করে লিখলাম PRASLIN, তখন ওরা হেসে উঠে বলল, ওমা! তাই বলুন৷ প্রালেঁ আইল্যান্ড?

কাণ্ড দ্যাখো এদের৷

আমি এয়ারপোর্টের কাছেই একটি বাড়িতে ছিলাম৷ এলাকাটার নাম কাসকাড৷ একপাশে সমুদ্র আর সমুদ্রের প্রায় গা-ঘেঁষে উঠে গেছে খাড়া পাহাড় বনজঙ্গলে ভরা৷ এ দ্বীপে সাপ নেই, কোনো জানোয়ার নেই এক কচ্ছপ ও কাঁকড়া ছাড়া৷ যেখানে খুশি শুয়ে-বসে থাকা যায়৷

আমার দুজন বন্ধু হয়েছিল ওখানে, নাম ভ্যালোরি ও রোজা৷ ওরা আসলে ফরাসিনি, কিন্তু অনেকদিন এখানে থাকার জন্য ক্রেওলও বলতে পারত৷ ক্রেওল ফরাসি ও আফ্রিকান মেশানো ভাষা৷ ওরা না থাকলে সব ঘুরিয়ে কারা দেখাত জানি না! ট্যাক্সিওয়ালারা অবশ্য ইংরেজি শিখে নিয়েছে৷ সেশেলসের অফিসিয়াল ভাষা দুটো—ফরাসি এবং ইংরেজি৷

আমার শোবার ঘরের পাশেই সমুদ্র৷ বাড়িটা আসলে সমুদ্রের মধ্যেই৷ সমুদ্র ভরাট করেই বাড়ির সামনের জায়গাটুকু বের করা হয়েছে৷ তাই জানালা খুললেই সমুদ্র৷ সামনেই ঘেরা বারান্দা৷ তাকালেই দেখা যায় কাছেই সমুদ্রের মধ্যে একটি ছোট্ট দ্বীপ৷ দ্বীপটির নাম ‘অনামা’৷ ইজিচেয়ারে বসে, বই পড়ে আর বালিয়াড়ি, নারকোল-বন আর নীল জলের দিকে চেয়ে দুপুরবেলাটা কেটে যেত৷ সন্ধের সময় পশ্চিমের আকাশে যে কত রং নিয়ে হোলি খেলা চলত, আর ঝকঝকে জলের আয়নায় সেই হোলি খেলার ছায়া পড়ত, তা কী বলব৷

ছোট্ট লাল মিনিমোক গাড়ি করে আমরা বেড়াতে বেরোতাম৷ চারদিক খোলা জিপের মতো গাড়ি৷ হু-হু করে হাওয়া লাগত গায়ে, এলোমেলো হত চুল৷ অনেক জায়গায় রাস্তাটার নীচ দিয়ে চলে গেছে সমুদ্র৷ মানে সমুদ্রের মধ্যের জল জবর-দখল করে কংক্রিটের পিলার তুলে তার উপরে পথ বানানো হয়েছে৷ ফরাসিরা যে স্থাপত্যবিদ্যাতে পারদর্শী, তা বোকারাও বুঝতে পারবে এই স্বপ্নরাজ্যে এলে৷

বোঁভালোতে খুব সুন্দর সমুদ্রতট আছে৷ ভিকটোরিয়াতে অনেক বড়-বড় হোটেল আছে৷ সেখানকার পায়ার থেকে স্টিমার ছাড়ে অন্যান্য নানান দ্বীপে যাওয়ার জন্যে৷ বার্ড আইল্যান্ড, প্রালেঁ সিলহুট আইল্যান্ড, লা-ডিগ ইত্যাদিতে৷ বার্ড আইল্যান্ডে পাখি আছে নানা রকম৷ সব দ্বীপেই সার্ফরাইডিং, স্নরকেলিং সুইমিং, ফিশিং ইত্যাদি চলে৷ মাহে ছাড়া অন্যান্য সব দ্বীপ খুবই ছোট আয়তনে৷ চারদিকে নারকোল বন, নানা রকম ট্রপিকাল গাছ-গাছালি৷ আমাদের কাঁঠাল গাছের পাতার মতো পাতাওয়ালা একরকমের গাছ হয়, ওরা বলে ‘টাকামাকা’৷

একটি বিখ্যাত তট আছে মাহেতেই—নাম টাকামাকা বে৷ যেদিকে তাকাও দেখবে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বোগোনভিলিয়ার সঙ্গে মাথা টান-টান হঠাৎ উঁচু কালো পাহাড় আর নীল সমুদ্রের কোলাকুলি৷ চারধারে কোরাল রীফ থাকায় উপর থেকে তাই এত সুন্দর দেখায় দ্বীপগুলো৷ দ্বীপে বসেও সুন্দর লাগে৷ প্রাকৃতিক অঢেল সৌন্দর্যকে ফরাসিরা নিজের রুচি ও সৌন্দর্য জ্ঞানে আরও সুন্দর করে তুলেছেন৷ এখন কিন্তু সেশেলস্ স্বাধীন দেশ৷ ব্রিটিশ কমোনওয়েলথের সভ্য৷ হয়তো সবচেয়ে ছোট সভ্য৷ ওখানে যেতে ভারতীয়দের ভিসা লাগে না৷ বোমবাই থেকে মোট সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়ান৷ যদি কখনও তোমরা যেতে পারো তো যেও৷ খুবই ভালো লাগবে৷ ওই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস হচ্ছে ‘কোকো-ডে-মেয়্যার’৷ মানে সমুদ্রের নারকোল৷ প্রকাণ্ড বড়ো এই অদ্ভুত-দেখতে নারকোলগুলো পৃথিবীর আর কোথাও নাকি হয় না৷ এই গাছ নাকি সমুদ্রের নীচের গাছ৷ কখনও হয়তো এই সব দ্বীপ জলের তলা থেকে প্রাকৃতিক কারণে জলের উপরে মাথা তুলে ওঠে৷ তখন থেকেই এই কোকো-ডে-মেয়্যারের গাছ আছে এখানের দ্বীপগুলিতে৷ এখান থেকে অন্যত্র গাছ নিয়ে গিয়েও কেউ বাঁচাতে পারেননি৷ কোনো-ডে-মেয়্যারের পরেই হচ্ছে জায়ান্ট টরটয়েজ৷ প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড সব সামুদ্রিক কচ্ছপ৷ তটেও হেঁটে বেড়ায়৷

মাহের মধ্যেই, বোঁভালো ঘুরে যেখানে দারুণ-দারুণ সব হোটেল আছে সমুদ্রতটের কাছাকাছি, আমরা বেলোমে বেড়াতে গেছিলাম একদিন৷ কবে নাকি কোন জলদস্যুরা, পর্তুগিজও হতে পারে, ভারতীয়ও হতে পারে, ইংরেজও হতে পারে, এই বেলোমে তাদের লুঠ-করা ধনরত্ন পুঁতে রেখে গেছিল৷ কয়েকজন লোক মিলে-মিশে সেই গুপ্তধন খুঁড়তে ব্যস্ত৷ গুপ্তধন সত্যি আছে কি না এবং থাকলে কী আছে, এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে৷ কিন্তু যাঁরা সমুদ্রের গায়েই পাথরের বিরাট কুয়ো খুঁড়ে চলেছেন তাঁরা দমবার পাত্র নন৷ অনেক দিন ধরে নাকি চলেছে এই খোঁড়াখুঁড়ি৷ যা পাওয়া যাবে, তার উপর সেশেলস্ সরকারকে ট্যাক্সও দিতে হবে৷ তবুও তারা চালিয়ে যাচ্ছে দারুণ উদ্যমে—কয়েক বছর হল৷

সেশেলস্ ভারতবর্ষ ও আফ্রিকা মহাদেশের মাঝামাঝি৷ উপরে জাঞ্জিবার নীচে মরিশাস৷ আসলে সেশেলস্ এতই ছোট জায়গা যে, খুব কম লোকেই এর খোঁজ রাখেন৷ পৃথিবীর ম্যাপে কয়েক দানা সরষের মতো দেখায় এই দ্বীপপুঞ্জকে৷ যদি লক্ষ করো, তাহলে খুঁজে পাবে৷ মাত্র উনিশশো বাহাত্তর সনে মাহেতে ইন্টার-ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট চালু হয়৷ রানি এলিজাবেথ এসে উদ্বোধন করেন এই বিমান-বন্দরটি৷

একদিন প্রালেঁ আইল্যান্ডে গেছিলাম৷ ছোট্ট প্লেনে করে৷ পাইলটকে নিয়ে ন’জন মাত্র বসতে পারে৷ মাহে থেকে উড়ে ‘অনামা’ দ্বীপের উপর দিয়ে গিয়ে বাঁয়ে লা-ডিগ আইল্যান্ড রেখে যখন ফাঁকা মাঠে নেমে পড়ল প্লেনটা, তখন দেখলাম মাত্র তেরো মিনিট লাগল৷ প্রালেঁ মাহে থেকে মাইল চল্লিশেক৷ সেদিন বড়ই দুর্যোগ ছিল৷ বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া৷ একটা ট্যাক্সি করে গিয়ে পৌঁছোলাম প্রালেঁ গ্রামে৷ সুন্দর নারকোলবীথির মধ্যের লালমাটির কাঁচা পথ দিয়ে বৃষ্টি না হলে হেঁটে যেতে পারতাম সব দেখতে-দেখতে৷

সারা সকাল বেরোতেই পারলাম না৷ সমুদ্রের একেবারে উপরেই শোঁ-শোঁ হাওয়া আর উথাল-পাথাল জলের পাশের এক রেস্তোরাঁতে বসে পর্দার পতপত আওয়াজ শুনতে-শুনতে ডায়েরি আর চিঠি লিখলাম৷

দুর্যোগে আটকে পড়ব ভেবেছিলাম, কিন্তু দুপুরের খাওয়ার পরে আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে এল হঠাৎই৷ তাই সাঁতার কাটলাম বিকেলের সমুদ্রে অনেকক্ষণ৷ তারপর সেই নির্জন নারকোলবীথির মধ্যের লাল মাটির চওড়া পথ ধরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হেঁটে এলাম এয়ার-স্ট্রিপে৷ মাইল দেড়েকের মতো পথ৷ আবার প্লেন ধরে মাহেতে ফিরে এলাম৷ ভয়ে-ভয়ে৷ মনে হচ্ছিল এতটুকু পাখির মতো প্লেন, যদি ধপ করে পড়ে যায় নীচে?

ইন্টার-আইল্যান্ডার প্লেন অনেকগুলো আছে সেশেলসে৷ সবগুলোতেই ন’জন করে বসতে পারে৷ এয়ার মাহের অধীনে৷ তোমরা জেনে খুশি হবে যে, এই এয়ার মাহের চিফ পাইলট একটি ভারতীয় ছেলে৷ তার অধীনেই সব প্লেনগুলো৷ আবার তার বাড়ি দিল্লিতে৷

তাই বলছি, যদি পারো সেশেলস্-এ বেড়িয়ে আসো৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *