সেয়ানে সেয়ানে – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
হনহন করে হাঁটছে মাল্যধর। কোমরে তার দু-খানা কাটারি। একটা নতুন, আরেকটা পুরোনো। একটা ধার দিতে নিয়ে এসেছিল মংলার হাটে রূপেন মিস্তিরির কাছে। অন্যটা নতুন কিনেছে। পিঠের বস্তায় আনাজপাতি আছে কিছু। ডান হাতে প্রায় আড়াই কেজির ভেটকি একটা। মালপত্তরের ভারে কুঁজো হয়ে গিয়েও ছোটতে কমতি নেই। মংলার হাটটা কম বড়ো নয়। লম্বায় কেন-না মাইলটাক হবে। মাল্যধর ছোটে আর হাঁফাতে হাঁফাতে নিজেকেই উৎসাহ দেয়, চালিয়ে চল বাপ, চালিয়ে চল, ভদ্রার ঘাট ওই দেখা যায়, আর দেরি নাই।
অবশ্য অত ছুটেও শেষমেষ লাভ হল না কোনো। নদীর ধারে পৌঁছে টিকিট ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কী দাঁড়ায়নি, ঘাটে ভটভট শব্দ উঠল। টিকেটবাবু তার বাড়িয়ে ধরা এক টাকার কয়েনটা ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘আর টিকেটে কী হবে? শেষ ফেরিটা তো গেল। এখন যান, ঘাটে গিয়া বসেন, যদি কপালগুণে কিছুমিছু পেয়ে যান।’
মাল্যধর হাতে-ধরা মস্তবড়ো মাছটার দিকে করুণ চোখে চাইল একবার। অতবড়ো মাছটা, নিতান্তই সস্তায় পেয়ে গিয়েছিল। গরমের রাত। বেশি দেরি হলে যদি গন্ধ হয়ে যায়, মালতি কী আর আস্ত রাখবে তাকে! রাত পোহালে জামাইষষ্ঠী। বাড়িতে মেয়ে-জামাই গমগম করবে সেই সক্কাল থেকে। ঘাটে বসে বসে নিজেই নিজের কপাল চাপড়ায় মাল্যধর। কেন মরতে বিকেলবেলা রাজেন কপালির নিশানাবাজি খেলার আড্ডায় গিয়ে জমেছিল? সত্তর টাকা বারো আনা লাভ হয়েছে বটে, কিন্তু এখন এই যে বিপদ হল তার কী হবে! হে মা কংকালেশ্বরী, স-পাঁচ আনার বাতাসাভোগ চড়াব মা, এ বিপদে তরিয়ে দাও—
তা মা কংকালেশ্বরীও নিজেরটা ভালোই বোঝেন দেখা গেল। স-পাঁচ আনা থেকে মানত চড়তে চড়তে স-পাঁচ সিকেতে গিয়ে পৌঁছুতে তবে দেখা গেল, গাংপুরের দিক থেকে চার দাঁড়ের একটা নৌকো উজিয়ে আসছে মংলার হাটের ঘাটে। নৌকোর মাথায় রঙিন হেরিকেন দেখেই মাল্যধর জিগির দিয়ে উঠল, ‘জয় মা। দয়া তবে হল তোর!’ এ দিগরে রাতেরবেলায় রঙিন কাচের হেরিকেন লাগিয়ে নবাবপুরের হেমবাবুর কাছারির নৌকো ছাড়া আর কোনো নৌকো ঘুরবে না। আর নবাবপুর মানেই ভদ্রার ওপার!
গাংপুর আর এই মংলার হাটের ঘাট এই দুইয়েরই ইজারা নেওয়া আছে হেমবাবুদের। ছোটো গোমস্তা রামচন্দ্র ঘোষ টিকেটবাবুর ঘরে গিয়ে দিনের হিসেবপত্র বুঝে নিচ্ছেন যতক্ষণে মাল্যধর ততক্ষণে নৌকোয় গিয়ে জুত করে বসে মাঝির সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। সাকিন কোথা, ঘরে ছেলে-মেয়ে ক-টি, এমন সব সাতসতেরো কথা। আধঘণ্টাটাক বাদে ঘোষবাবু ফিরে এসে তার দিকে দেখে বললেন, ‘কে ও, বাউলে যে? তা এত রাত্রে মংলার ঘাটে কী মনে করে?’
আসলে মাল্যধরকে এ দিগরে সকলেই চেনে। সাতপুরুষের বাউলে ওরা। বাঘবন্ধনের নিজস্ব মন্ত্র আছে নাকি মাল্যধরের পরিবারে। সেই মন্ত্রের জোর নিয়ে বাদা আর আবাদে অনেক গল্পকথা চালু আছে। লোকে পাছে জেনে যায় সেই ভয়ে কাগজে পর্যন্ত লেখে না। বাপ মরবার সময় ছেলেকে কানে কানে দিয়ে যায়। উপস্থিত মাল্যধর সেই মন্ত্রের মালিক।
আজকাল অবশ্য মন্ত্রতন্ত্রে অনেকের বিশ্বাস নেই। তবে বিশ্বাস থাক আর-না-থাক, নৌকো নিয়ে বাদাবনে ঢুকতে গেলে বাউলে হিসেবে সঙ্গে যাবার জন্য এ এলাকায় মাল্যধরের বেজায় চাহিদা। আজ অবধি সে যে নৌকোর দলে গিয়েছে তাতে একজন মানুষেরও বলি নিতে পারেননি বাবা দক্ষিণরায়। বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সকলেই এক ডাকে বলে, গোটা বাদা এলাকায় বাঘের মতিগতি, স্বভাব-চরিত্র মাল্যধরের মতো ভালো আর কেউ বোঝে না।
তা মাল্যধরের মুখে সব কথা শুনে ঘোষবাবু বললেন, ‘ওপার অব্দি নয় পার হলে, কিন্তু তারপর এত রাতে চার মাইল পথ পেরিয়ে হার্মাদিচক পৌঁছুবে কী করে? পথে কাঁটাবাড়িতে খাল পেরোতে হবে। ছিটে জঙ্গলও পড়বে বেশ খানিকটা। তার চেয়ে বলি কী, আমার সঙ্গে নবাবপুরের কাছারিতে চলো। সেখেনে রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে না হয়…’
মাল্যধর কাতর গলায় বলল, ‘রাতের বেলা জঙ্গলের রাস্তায় তা-ও গুরুবলে আর আপনাদের আশীর্বাদে প্রাণটা হয়তো বাঁচাতে পারব ঘোষবাবু, কিন্তু এই মাছ নিয়ে আজ রাতে ঘরে না-পৌঁছুলে আমার রায়বাঘিনিটির হাতে যে নিতান্তই বেঘোরে প্রাণটা যাবে। কাল রাত না-পোহাতে মেয়ে-জামাই আসবে। এমনিতে মাছের তো অভাব নেই, কিন্তু ঘরের ওনার হুকুম হয়েছে, বড়ো একখানা ভেটকি তেনার চাই-ই। আপনি ভাববেন না। ও আমি ঠিক চলে যাব।’
নবাবপুরের ঘাটে পৌঁছে মাল্যধর জলের ধারে উবু হয়ে বসে ভালো করে ধুলোপড়ার বন্ধন দিয়ে নিল সারা গায়ে। ফিনফিনে ধুলো। হাওয়ায় ছুড়লে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কিন্তু সঙ্গে মন্ত্রের মিশেল দিলে সেই হয়ে যাবে মহাশক্তিধর বাঘতাড়া বর্ম। তোমার-আমার চোখে পড়বে না, কিন্তু বাঘ দেখবে, মানুষ কোথা? ধুলো আর হাওয়ার ঘূর্ণি একটা যেন হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা বেয়ে!
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে তার কীর্তিকলাপ দেখে ঘোষবাবু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে নিজের পথ ধরলেন। মাল্যধরও অমনি উঠে দাঁড়িয়ে সতর্ক পায়ে হাঁটা দিল। বাপের কাছে চিরকাল এইসব ধুলোপড়া, বাঘতাড়া বর্মের কথা শুনে এলেও মাল্যধরের অবশ্য তাতে খুব একটা বিশ্বাস হয় না। বাঘ যে কী দেখে-না-দেখে সে কথা কেউ কখনও বাঘকে জিজ্ঞেস করে দেখেছে নাকি?
তবে কিনা, ছোটোবেলার অভ্যেস। মনে বল তো আসে একটা! তা ছাড়া লোকজনের সামনে একটা ভড়ং-ও রাখবার দরকার। নইলে পাঁচটা গ্রামের লোকে মানবে কেন? এই যে বাঘবন্ধন দেখে গেল আজ ঘোষবাবু, সে এখন সাতকাহন করে সে কথা পাঁচটা জায়গায় রটাবে। তাতে মাল্যধরেরই লাভ।
মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা তত্ত্বে মাল্যধর বিশ্বাস রাখে। তা হল সাবধানের মার নেই। বাদাবনের বড়োমেঞার স্বভাবচরিত্র সে গুলে খেয়েছে। তাই তেনার মুল্লুকে পথ চলতে গেলে কখন যে কী করতে হবে সেই কান্ডজ্ঞানটাও তার খুব তুখোড়। আর এর জোরেই যে তার বাউলে হিসেবে এত সুনাম সেটা মাল্যধর ভালোই জানে।
নবাবপুরের চৌহদ্দি ছাড়াতে চারদিক একেবারে শুনশান হয়ে এল। খানিক দূর অবধি পথের দু-পাশে চাষের জমি দেখা যাচ্ছিল, তারপর তা-ও শেষ হয়ে গিয়ে ছিটে জঙ্গলের রাজত্ব শুরু হল। পথে একপাশে সে জঙ্গল একেবারে লাগোয়া। অন্যপাশে একটা খাল চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। ভাটার সময়ে খালে জল নেই। হালকা চাঁদের আলোয় ছেয়ে রঙের কাদা দেখা যায় শুধু তার বুকে। সেইদিকে চোখ ফেলে আরও তাড়াতাড়ি পা চালাল মাল্যধর। জোয়ার একবার শুরু হয়ে গেলে ওই কাদার ওপরে ভদ্রার জল এসে ঢুকবে তিন হাত উঁচু হয়ে। খাল পেরোনো দুষ্কর হয়ে যাবে তাহলে।
কাঁটাবাড়ি পৌঁছে খালটা ডানদিকে ঘুরে দক্ষিণমুখো হল। রাস্তা এসে শেষ হয়েছে খালের পাড়ে। থেমে দাঁড়িয়ে মাল্যধর বস্তাটাকে পিঠে বেঁধে নিল উঁচু করে। তারপর মাছটাকে দু-হাতে মাথার ওপর ধরে খালের জমিতে পা দিল। থকথকে আঠালো কাদা। ভালোবেসে একবার গায়ে-পায়ে জড়িয়ে ধরলে সহজে ছাড়ে না। লোকে তাই খালের কাদাকে প্রেমকর্দমে বলে এখানে। তা সেই প্রেমকর্দমে প্রায় হাঁটুর ওপর অবধি ডুবে গিয়ে পা টেনে টেনে এগোচ্ছে মাল্যধর, এমন সময় সামনের জঙ্গলে একটা আওয়াজ পেয়ে কান খাড়া করল সে। ফেউ ডাকছে। একবার, দু-বার, তিনবার—প্রতিবারেই ডাকটা আরও একটুখানি এগিয়ে আসছিল খালের দিকে। শেষ ডাকটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খালের উলটোদিকের জঙ্গলের সুঁদুরি গাছেদের মাথায় হুপহাপ শব্দ তুলে একদল বাঁদর বেজায় লাফঝাঁপ শুরু করে দিতে মাল্যধর প্রমাদ গুনল। এগুলো সবই বাঘ আসবার সংকেত। সামনে এগোনো বন্ধ করে দিয়ে মাঝখালে মাথার ওপর মাছ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এই এক হাঁটু প্রেমকর্দমে বাঘ আসবে না। কাদায় ডুবে গেলে তার জারিজুরি যে সব শেষ, একথা বড়োমেঞা ভালোই জানে।
প্রায় আধঘণ্টাটাক ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবার পর জঙ্গল একটু ঠাণ্ডা হলে মাল্যধর আস্তে আস্তে ওপারে গিয়ে উঠল। নতুন কাটারিটা এইবার সে কোমর থেকে খুলে একহাতে নিয়েছে। জানে, বাঘের সামনে ও কিছুই নয়, তবু মনে বল থাকে একটা। খালের পাড় ছেড়ে উঠেই কয়েকটা ছোটো ছোটো তবলাগাছ আর হেঁতালের ঝোপের সার। তার পেছনদিকে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ফটফটে চাঁদের আলো পড়েছে। সেই আলোয় নরম মাটির ওপর বাঘের পায়ের এলোমেলো খোঁচ চোখে পড়ে। একেবারে সদ্য কাঁচা। ভালো করে থাবার ছাপগুলো নজর করে দেখল সে। বিশাল বড়ো আর পুরোনো বাঘ। পেছনের ডানদিকের পায়ের খোঁচ হালকা আর একটু এতোলবেতোল। ও পা খানায় চোট আছে বড়োমেঞার। এক মুহূর্তের জন্য গা হিম হয়ে গেল মাল্যধরের। চোট খাওয়া বুড়ো বাঘ! এরাই মানুষখেকো হয় বেশি। মানুষের সঙ্গে টক্কর দিতে হয় বলে মাথায় হাজারো ফন্দি খেলে এদের। এত বছর ধরে বাউলেগিরি করে এসে এদের কায়দাকানুন চিনতে আর বাকি নেই তার। নিশ্চয় কাছেপিঠেই কোথাও লুকিয়ে আছে। চলে যাবার ভান করে তাকে পাড়ে টেনে এনেছে। এবার বেড়ালে যেমন ইঁদুর নিয়ে শিকারের আগে খেলা করে তেমনি তাকে নিয়ে প্রথমে লুকোচুরি খেলবে খানিক। তারপর শিকার যখন তার পছন্দসই জায়গায় এসে পড়বে তখন এক লাফে এসে ধরবে। এই অবস্থায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে আর রক্ষা নেই। ফিসফিস করে মন্ত্র পড়তে শুরু করল মাল্যধর। হেই মা বনবিবি। এযাত্রা সন্তানকে তরিয়ে দাও মা!
তা মন্ত্রের জোরেই হোক কিংবা ধুলোপড়ার শক্তিতেই হোক, বাকি মাইলটাক পথ বিশেষ কোনো উৎপাত হল না আর। গোটা পথটা খুব আস্তে, আস্তে, সাবধানে হেঁটেছে মাল্যধর। কাঁটাবাড়ির খাল আগে ছিল বাঁয়ের হাতে, এখন তা তার পাশাপাশি ডানদিকে চলেছে। পথের একেবারে পাশ থেকে কেওড়া আর তবলার জঙ্গলে ঢাকা ঢালু পাড় নেমে গেছে খালের বুকে। খালেও এতক্ষণে জোয়ার এসে গেছে। জল ঢুকছে কলকল করে। তার গায়ে চাঁদের আলো পড়ে ঝকঝক করছে। তার ভরা শরীর দেখে কে বলবে খানিক আগে কাদামাখা একখানা শুকনো নর্দমার মতো হয়ে পড়ে ছিল সে। বাদা অঞ্চলের নদীনালার এই মজা। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় তারা। তা জলভরা খালের ঢালে ঢালে বাঘ হাঁটতে চায় না সচরাচর। ওপাশ থেকে কাজেকাজেই বিপদের ভয় কম। কিন্তু ভয় হল বাঁয়ের দিকের ছিটে জঙ্গলকে। সমতল, ছড়ানো জমির ওপর হেঁতালের ঝোপ ঘন হয়ে রয়েছে ওদিকটায়। বড়োমেঞার লুকোবার প্রিয় জায়গা। বাউলে এক পা দু-পা হেঁটে যায়, আর থেমে থেমে দেখে নেয় বাঁদিকটাকে।
এমনি করে চলতে চলতে একসময় দূরে হার্মাদি গড় নজরে আসতে হাঁফ ছাড়ল মাল্যধর। বাড়ি এসে গেছে। আর ভয় নেই এবারে। হার্মাদি গড়-এ কোনো হার্মাদটার্মাদের বাস নেই অবশ্য। ও চিরটাকালই অমনি ফাঁকা পড়ে থাকে। ভেতরে জায়গায় জায়গায় উঁচু উঁচু ভিটে আর ইটের পাঁজা থেকে বোঝা যায় অনেকগুলো ঘরবাড়ি ছিল এককালে। এখন অবশ্য সেসব কিছু আর নেই। থাকবার মধ্যে আছে শুধু গোটা গড় জুড়ে গহীন জঙ্গল। তবে হ্যাঁ। গোটা ভিটেটাকে ঘিরে জবরদস্ত পাঁচিল একটা আছে। প্রায় হাতছয়েক উঁচু। সিংহদরজার জায়গাটা ভাঙা হা হা করছে। কিন্তু ভিটে ঘিরে তার বাকি অংশটা এতটুকু টসকায়নি। লোকে বলে এ হয়তো এককালে বনের ভেতর হার্মাদ ডাকাতদের লুকোনো ঘাঁটি ছিল। সেজন্যই তার দেয়াল অত মোটা।
অবশ্য গোটা সুন্দরবন জুড়েই অমন অনেক পুরোনো বাড়িঘরের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। সে এক রহস্যময় ব্যাপার। গহীন বনে চলতে চলতে হঠাৎ করেই চোখে পড়বে পোড়ো ভিটের চিহ্ন। ভেতরে গেলে হয়তো দেখা যাবে কেওড়া, গরান, তবলাগাছের পাশাপাশি আম, জাম, কাঁঠালের গাছও হয়ে আছে। এসব মানুষের পোষা গাছ সচরাচর জঙ্গলে নিজে থেকে গজায় না। বোঝা যাবে এককালে সেখানে মানুষের বাস ছিল। কোত্থেকে এসেছে আর কোথায়ই বা গেল তারা কে তার খবর দেবে। লোকে নিজের নিজের মতো গল্প বানিয়ে নেয় ভিটেগুলোকে নিয়ে। এই হার্মাদি গড়ের গল্পটা থেকে তো মাল্যধরের গ্রামের নামটাই লোকের মুখে মুখে হার্মাদিচক হয়ে গেল।
গড়ের সিংদরজার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে এমন সময় হঠাৎ ডাইনের দিকে ঢালের গায়ে মট করে মৃদু একটা শব্দ হল। জঙ্গলে রাতের হাজারো শব্দের মধ্যে মিশে থাকা সে শব্দের সাধারণ মানুষের কাছে কোনো বিশেষত্ব না- থাকলেও বাউলের অভিজ্ঞ কান তাকে অবজ্ঞা করল না। মুহূর্তের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাল্যধর। পিঠের বস্তা আর হাতের মাছ মাটিতে নামিয়ে রেখেছে। দু-হাতে উঠে এসেছে লম্বা চকচকে দা দু-খানা। কিন্তু না! কোথায় কী! নিঝুম বন। প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। একটা শ্বাস ছেড়ে ফের দা দু-খানা কোমরে গুঁজল সে। তারপর বস্তাটা পিঠে তুলে নিয়ে এক হাতে মাছটা তুলে নেবার জন্য নীচু হয়েছে কী হয়নি, ডাইনের জঙ্গল থেকে একটা বনমুরগি কঁক-কঁক শব্দ তুলে ডানা ঝাপটে উড়ে এসে বাঁ-দিকে জঙ্গলে ঢুকে গেল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট এক হুংকারে থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা জঙ্গল, আর চাঁদের আলোয় হলুদ-কালো বিদ্যুতের একটা ঝলক তুলে বাঁ-দিকের জঙ্গল থেকে যেন উড়ে এল জন্তুটা। চোখের পলকে মাটিতে আছড়ে পড়ে একদিকে গড়িয়ে গেল মাল্যধর। আর পরক্ষণেই দম-দেয়া পুতুলের মতো তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ফের। পিঠের বস্তা তার খসে গেছে। একখানা দা-ও ছিটকে পড়েছে পায়ের কাছে। চতুর বাঘ তাকে বোকা বানিয়ে খালের ঢাল ধরেই লুকিয়ে পেছন নিয়েছিল এতক্ষণ। এইবারে সুযোগ বুঝে হামলা করেছে।
অবশিষ্ট দা-খানা হাতে ধরে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বড়োমেঞার চোখে চোখে চাইল। প্রথম ঝাঁপে কাজ না-হতে ভারি রেগে গেছে জন্তুটা। লম্বা জিভটা লকলক করে লালা ছিটোচ্ছে তার। চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে যেন। লোম ফুলে উঠেছে গায়ের। গলায় চাপা গরগর শব্দ। মাল্যধরও ততক্ষণে তৈরি। বাঘ দ্বিতীয়বার লাফ দেবার ঠিক মুখটাতে লাগসই করে হাতের দা-খানা ছুড়ে মেরেছে সে। চাঁদের আলোয় একঝলক রুপোলি বিদ্যুতের মতোই উড়ে গিয়ে সেটা মোক্ষম ঘা দিয়েছে মেঞার নাকে।
ঝাঁপের নিশানায় ওতেই খানিক চুক হয়ে গিয়ে থাকবে হয়তো জীবটার। হুড়মুড় করে এসে পড়ল বটে মাল্যধরের গায়ে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। হাঁ-করা মুন্ডুটা তাকে কামড়ে ধরবার বদলে একখানা মোক্ষম ঢুঁ মেরেই ক্ষান্ত হল। মাটিতে আছড়ে পড়ল ফের মাল্যধর। বাঘটা এসে পড়েছে তার ঠিক পাশে। হাঁ-মুখটা ফের বাড়িয়ে ধরেছে তার দিকে। কিন্তু কামড়টা বসাবার আগেই হাতের কাছে মাছটা পেয়ে গিয়ে সেটাকে দু-হাতে তুলে নিয়েছে মাল্যধর। তারপর সেটাকে একেবারে ঠেসে গুঁজে দিয়েছে বাঘের হাঁড়ির মতো মুখটার ভেতরে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে চিলচিৎকার জুড়ে গালাগাল দিয়ে চলেছে সে বাঘকে। মুখের কষ দিয়ে ফেনা ঝরছে তার, বাঘের চোখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধক ধক করে জ্বলছে দুটো চোখ। বাঘটা একটু থতোমতো খেয়ে গিয়েছিল এহেন আক্রমণে। সেই সুযোগে দ্বিতীয় দা-টা তুলে নিয়ে পাগলের মতো কোপের পর কোপ মারতে শুরু করেছে বাউলে। এইবারে পিছু হটল বাঘ। পিছু ঘুরে উলটোমুখে ছুট দিয়েছে সে। মাছটা তখনও তার মুখে লটকানো। মাল্যধরের তখন মাথায় খুন চেপে গিয়েছে। মাটি থেকে দ্বিতীয় দা-খানাও কুড়িয়ে নিয়ে দু-খানা দা দু-হাতে উঁচিয়ে গালাগাল দিতে দিতে সে-ও ফিরে তাড়া করেছে বড়োমেঞার পেছন পেছন।
বাঘ আর ঘুরে দাঁড়াল না। খানিক ছুটে গড়ের সিংদরজার একেবারে মুখোমুখি পৌঁছে এক লাফে ঢুকে গেল তার ভেতরে। ওদিকে বাউলের চিৎকার আর বাঘের ঘন ঘন গর্জনের শব্দ শুনে গ্রামের লোকজন লাঠিসোঁটা, মশাল-টশাল নিয়ে বের হয়ে এসে দেখে গড়ের সিংদরজার মুখে রক্ত মেখে, দু-হাতে দু-খানা দা নিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে মাল্যধর। লোকজন দেখে বলে, ‘‘আমার কিছু হয় নাই হে। এ বড়োমেঞার রক্ত। ব্যাটা আদমখোর ওই গড়ের মধ্যে ঢুকেছে। আমার জামায়ের মুখের মাছটা নিয়ে গেছে। তবে যাবে কোথা? চাদ্দিকে গড়ের পাঁচিল। আর এই দোরে আমি থানা দিয়ে বসেছি। ওর আর ছাড়ান নাই আজ।’’
ভিড়ের মধ্যে থেকে এতক্ষণে সামনে এগিয়ে এল মাল্যধরের শ্বশুর শ্রীদাম। শ্রীদাম এ চত্বরে বেশ মান্যগণ্য লোক। গোটাতিন মাছমারা নৌকো আছে তার। তা ছাড়া ফরেস্ট অফিসের সঙ্গে ভালো দহরম-মহরমও আছে। নামে-বেনামে কাঠ কাটবার গোটা ছয়েক পাস তার হাতে সবসময়েই থাকে। তবে কিনা জামাইয়ের চড়া মেজাজকে তার মতো জাঁহাবাজ ব্যক্তিও কিঞ্চিৎ সমঝে চলে। কাছে এসে মিনমিন করে বলে, ‘তা বাবাজি কী বাঘ মারবার ফন্দি আঁটতেছ নাকি? ওতে কিন্তু নিঘঘাৎ হাজতবাস। নতুন রেঞ্জারবাবু কড়া মানুষ। বাঘের গায়ে হাত পড়েছে জানতে পারলে….’ কথাটা তার পুরো শেষ হল না আর। তার আগেই বাঘের রক্তমাখা জামাই দা হাতে এমন চোখে ঘুরে চাইল শ্রীদামের দিকে যে সে আর সেখানে দাঁড়াল না। নজরগঞ্জের বিট অফিস এখান থেকে বেশি দূরে নয়। সেখানে রাতে রাতে খবর পাঠিয়ে দিতে হবে একটা। সে নইলে ঢ্যাঁটা জামাইকে আটকাবার আর কোনো রাস্তা নেই।
গ্রামের লোকজন ততক্ষণে কাজে লেগে গিয়েছে। গরমের মরসুম। শুকনো কাঠপাতার অভাব নেই চারপাশে। দশ হাতে তাই টেনে এনে তারা ডাঁই করে গড়ের ভাঙা দরজার মুখে রেখে তাতে আগুন দিয়েছে। লকলকে আগুন উঠেছে দশ হাত উঁচু হয়ে। আগুনের সেই বেড়াজাল পেরিয়ে বাঘ কেন, স্বয়ং দক্ষিণরায়ও বের হয়ে যেতে পারবেন না। সাররাত এ আগুন জ্বলবে এখানে। ভেতরে আটকে থাকুক মানুষখেকো বাঘ। অন্ধকার কাটলে তারপর না-হয় তার একটা গতি করা যাবে’খন।
ভোরের আলো ফুটতে-না-ফুটতে বাঘ শিকারের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। লাঠি, টাঙ্গি, কোঁচ, বল্লম, যার যা সাধ্য অস্ত্রশস্ত্র জুটিয়েছে। চাঁদামারীর ট্যাকের জঙ্গলে একটা গরান গাছের খোঁদলে দু-খানা দিশি বন্দুক আর গোটা দশেক গুলি লুকিয়ে রাখা ছিল। একখানা মাল্যধরের আর অন্যখানা তার প্রাণের স্যাঙাত বিশাই মন্ডলের। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে-চুরিয়ে হরিণের মাংস খাবার শখ মেটাতে কাজে লাগে। তা বাঘ মারবার উৎসাহে বিশাই শেষরাত্রে ডিঙি নিয়ে চাঁদামারীর ট্যাকে গিয়ে সেই জোড়া বন্দুক বের করে এনেছে।
মাল্যধর একপাশে বসে তেলকাগজে মোড়া তার পুঁটুলিটা যত্ন করে খুলছে এমন সময় খালের দিক থেকে হালকা ভটভট শব্দ উঠল একটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিশাই দৌড়ে এসে বলে, ‘খুলো না, খুলো না ওস্তাদ। পিটেল আসছে।’
মাল্যধরের ভুরু কুঁচকে উঠল। পিটেল, মানে ফরেস্ট প্যাট্রোল-এর নৌকো! বেআইনি বন্দুক দেখলেই কেড়ে নিয়ে যাবে ঠিক। কিন্তু, খবর পেল কোত্থেকে? এ নিশ্চয় তার শ্বশুরের কাজ! ‘বুড়াকে আমি পরে দেখছি দাঁড়াও,’ গজগজ করতে করতে তাড়াতাড়ি বন্দুকের পুঁটুলি বেঁধে-ছেদে ফের বিশাইয়ের হাতে তুলে দিল মাল্যধর। গ্রামের অন্যদিকে চাঁদামারীর খাল। তাই বেয়ে সে এখন ফের বন্দুক ফিরিয়ে রেখে আসবে তাদের গোপন আস্তানায়।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভটভটি এসে লাগল খালের ধারে। জনাচারেক লোক নিয়ে রেঞ্জার মধুবাবু নিজেই চলে এসেছেন খবর পেয়ে। জলের ওপর ঝুঁকে থাকা কেওড়ার শেকড় আর হেঁদোর ঝোপ ধরে ধরে সাবধানে উঠতে উঠতেই ওপর থেকে উঁকি দিয়ে থাকা মাল্যধরকে দেখে হাঁক দিয়েছেন, ‘এই যে মাল্যধর। বাঘ ধরেছ শুনে নিজেই চলে এলাম হে!’
তারকাঁটার একখানা বাণ্ডিল সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন মধুবাবু। ওপরে উঠে এসে সঙ্গের লোকগুলোকে সিংহদরজায় তারবেড়ো লাগাবার কাজে লাগিয়ে দিয়ে মাল্যধরকে নিয়ে পড়লেন তিনি, ‘ঠিক কী হয়েছিল কাল রাত্রে ভেঙে বলো দেখি বাউলে?’ মাল্যধর সব কথা খুলে বলে শেষে বলে, ‘এ আদমখোর বাঘ হুজুর। পায়ে চোট আছে। দৌড়ে হরিণ ধরার সাধ্য হবে না এর। একে ছাড়ান দিলে আগামিতে দশটা মানুষের জান যাবে।’
মধুবাবু হেসে বললেন, ‘এ এলাকায় গত তিন বছর বাঘে কোনো মানুষ নেয়নি। কাজেই এ বাঘটাও হয়তো এখনও মানুষের সোয়াদ পায়নি। তবে হ্যাঁ, চোট পাওয়া পুরোনো বাঘ। মানুষখেকো হয়ে যেতে কতক্ষণ! সাবধান তো হতেই হবে।’
চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গলের দিকে চোখ ফেলে মাল্যধর বলল, ‘কিন্তু বাবু, এ যদি ভিন এলাকা থেকে তাড়া খেয়ে সদ্য সদ্য পালিয়ে আসা-মানুষখেকো হয়, তবে? আপনার আপিসের খাতায় তো তার হিসাব থাকবে না।’
‘হতে পারে’, মাথা নাড়লেন মধুবাবু, ‘তবে সেসব ভাববার আগে বাঘটাকে একবার সরেজমিনে দেখবার চেষ্টা তো করা যাক! কী বলো?’
কী আর করা! নিমরাজি হয়ে ঘাড় নাড়ল মাল্যধর। শ্রীমন্তের ওপর রাগে তখন তার গা কশকশ করছে।
ঘণ্টাখানেক বাদে, পায়ে আধলা ইঁট বাঁধা একটা পুরুষ্টু ছাগলকে তারকাঁটার বেড়া অল্প ফাঁক করে গড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বুদ্ধিটা মধুবাবুর। ওতে ছাগল চলেফিরে বেড়াতে পারবে বটে কিন্তু ছুটে পালাবার জো থাকবে না তার। বাঘটার পেটে খিদে ছিল। রাতের শিকার তার ফসকে গেছে। মিনিট দশেকের মধ্যে ছাগলের পরিত্রাহি চিৎকারকে ছাপিয়ে উঠল বাঘের গম্ভীর গর্জন। তারপর ফের সব চুপচাপ।
তারকাঁটার বেড়া ফাঁক করে এইবার প্রথমে ভেতরে পা দিল মাল্যধর। সতর্ক চোখে চারদিক দেখে নিয়ে তারপর পেছন ঘুরে ইশারা করতে নি:শব্দে ভেতরে ঢুকে এলেন মধুবাবু। তাঁর হাতে বিচিত্রদর্শন একটি হাওয়া বন্দুক। তার মাথায় নিদালি ওষুধের ছুঁচওয়ালা কার্তুজ। মাল্যধরের হাতে মধুবাবুর রাইফেলটা। মধুবাবু ওনার ঘুমপাড়ানি বন্দুক দিয়েই যা করবার করবেন, তবে নিতান্তই যদি প্রাণসংশয় হয় তবেই রাইফেল চালাবার হুকুম আছে তার ওপরে। ভারি যন্ত্র। একেবারে নতুন। মাল্যধর তার গায়ে লোভী আঙুল বুলোচ্ছিল। আহা রে, এমন একখানা অস্তর যদি তার নিজের থাকত, তাহলে ফি—হপ্তা হরিণ কী তরখেলের মাংস খাওয়া কে আটকায় তার! আহা, আজ যদি একবারও চালাবার মওকা মিলে যায়…
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এলোমেলো ভাবনাগুলো মাথা থেকে ঠেলে সরিয়ে দিল মাল্যধর। খোলা ময়দানে খিদে-পাওয়া বাঘের চেয়ে ভয়ানক জীব আর হয় না। কাজেই সতর্ক থাকতে হবে এখন। সাতসতেরো ভাবতে বসলে চলবে না। দিনচারেক আগে বৃষ্টি হয়েছিল এদিকে। গাছপালার ছায়ায় থাকায় পায়ের নীচের জমি এখানে এখনও নরম আছে। তার অভিজ্ঞ চোখে সেই নরম মাটিতে ছাগলের ইঁট বাঁধা পা টেনে টেনে চলবার চিহ্ন ধরা পড়ছিল। তাই ধরে ধরে সাবধানে খানিক দূর এগোতে হঠাৎ খানিক দূরে হুড়মুড় করে শব্দ উঠল একটা। তারপরেই আবার সব চুপচাপ। শব্দটা ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছিল তারা দুজন। কয়েক মুহূর্ত মরার মতন শুয়ে থেকে তারপর ফের আস্তে আস্তে বুকে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে গেল তারা।
বড়োসড়ো একটা হেঁদোর ঝাড়কে পাক দিয়ে ঘুরেই মড়ির দেখা মিলল। ছাগলটাকে সবে মেরে খেতে শুরু করেছিল বাঘ। সেই অবস্থায় হঠাৎ মড়ি ছেড়ে উঠে পালিয়েছে। নি:সন্দেহে টের পেয়েছিল যে কেউ আসছে। কিন্তু টেরটা পেল কেমন করে? ব্যাপারটা বুঝতে অবশ্য দেরি হল না মাল্যধরের। হালকা হাওয়া বইছে তাদের পেছনের খালের দিক থেকে সামনের দিকে। ওইতেই শিকারির গায়ের গন্ধ পেয়ে গেছে তাহলে বড়োমেঞা। নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল তার। এই সামান্য ব্যাপারটা খেয়াল রাখা উচিত ছিল।
কিন্তু কথা হল, বাঘ গেল কোথা? সাবধানে, টোটা পুরে নিয়ে বন্দুকের ঘোড়া তুলে দিল মাল্যধর। কাছেপিঠেই কোথাও লুকিয়ে ওঁত পেতে আছে নিশ্চয়। চোখের নাগালে এলে সময় দেবে না মোটে। কাজে কাজেই তৈরি থাকা দরকার। কথায় বলে সাবধানের মার নেই।
নরম মাটিতে বাঘের থাবার ছাপ ধরে ধরে একটু একটু করে এগোয় দুজন, টুঁ শব্দটি না-তুলে। পাকা শিকারি তারা। সে ছাড়া, এ দিগরের জঙ্গলের হালহকিকতও দুজনেরই ভালোভাবে জানা আছে। কাজেই চোখে চোখে ইশারার চালাচালিতেই কথাবার্তার কাজ চলে যায়, কথা বলার দরকার হয় না।
এগোতে এগোতে একসময় হঠাৎ করে থাবার ছাপ শেষ হয়ে গেল। বাঘটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সেখান থেকে। মাথা তুলে তারা দেখল, ঠিক সামনে একটা বাজপড়া পুরোনো কাঁঠাল গাছের গুঁড়ি। তার মাথাটা ছাই হয়ে উড়ে গেছে বহুকাল আগেই। পড়ে আছে শুধু হাত কয়েক উঁচু দশাসই কান্ডটা। পাঁচটা লোকে মিলে হাতের বেড় পাবে না এত মোটা তা।
চোখ টানটান করে এদিক-ওদিক তাকায় মাল্যধর, কোন দিকে গেছে তার কোনো চিহ্ন যদি মেলে। মনের ভেতরে একটা ভয় তার মাথা তুলছিল বারে বারে। গভীর জঙ্গলে নরশার্দূলের গল্প তার অজানা নয়। বাপঠাকুরদার মুখে তাদের গল্প সে ছোটোবেলা থেকে কম শোনেনি। এমনিতে দিব্যি যেন ভালোমানুষের ব্যাটা। খায়দায়, ঘুরে বেড়ায়, জমিতে কাজকম্মও করে। ওদিকে সবার চোখের আড়ালে মন্তর আউড়ে বাঘের রূপ ধরে জঙ্গলে রাজত্ব চালায়, গাঁয়েগঞ্জে ঢুকে মানুষের ঘাড়ও মটকায়। শিকারির হাতে ধরা পড়বার জো হলে চোখের আড়াল খুঁজে উলটে মন্তর পড়ে বাঘের রূপ ছেড়ে ভালো মানুষটি হয়ে যাবে চোখের নিমিষে। শিকারির চোখের সামনে দিয়ে ড্যাংডেঙিয়ে হেঁটে চলে যাবে তাকে বোকা বানিয়ে। আর শিকারি হাঁ হয়ে বসে ভাববে, গেল কোথায় বাঘ! এ-ও যদি তেমন কোনোকিছু হয়…হে মা বনবিবি, সন্তানকে রক্ষা কোরো মা…
ভাবনার সুতোটা তার ছিঁড়ে গেল মধুবাবুর কনুইয়ের গুঁতোয়। একেবারে পাশে চলে এসে তাকে গুঁতো দিয়ে ইশারায় পোড়া গুঁড়িটার মাথার দিকে দেখাচ্ছেন। ওনার আঙুলের ইশারা বরাবর চোখ ফেলে প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না মাল্যধর। কিন্তু একটুক্ষণ খুঁটিয়ে নজর করে দেখে নিয়েই একগাল হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার মুখে। গুঁড়িটার এক্কেবারে মাথার কাছে হালকা রক্তের ছোপ ধরে আছে! আর, গুঁড়ির একেবারে মাথার ওপরে আঙুলের কড়পরিমাণ উঁচু হয়ে আছে…ও দুটো কী!! খানিক ভালো করে ঠাহর করে দেখে আর সন্দেহ রইল না তাদের। বাঘের কানের ডগা দুটোই দেখা যাচ্ছে সেখানে।
ব্যাপারটা বুঝতে আর বাকি রইল না মাল্যধরের। বহুকালের পুরোনো বাজপড়া গাছের গুঁড়ির ভেতরটা ফোঁপরা হয়ে গিয়েছে জল খেয়ে খেয়ে আর উইয়ের আক্রমণে। চালাক বাঘটা নিশ্চয় কিছুকাল ধরেই ঘাঁটি গেড়েছে এই বাগানে। আর তাই তাকে গোটা পথটা তাড়িয়ে এনে ঠিক এইখানে এসেই হামলা করেছিল বড়োমেঞা। মেরে এই বাগানের ঘাঁটিতে নিয়ে এসে আরাম করে খাবে বলে। বাগানের মধ্যে এই লুকোবার জায়গাটাও নিশ্চয় তার আগে থেকে জানা। শিকারির গন্ধ পেয়ে তাই এক লাফে এসে লুকিয়েছে খোঁদলের ভেতরে!
চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল দুই শিকারির। মাল্যধরের উঁচানো ভুরুর ইশারা দেখে পকেট থেকে একটা চকোলেট বোমার বাক্স আর দেশলাই বের করে তার হাতে গুঁজে দিলেন মধুবাবু, তারপর খানিক দূরে দাঁড়িয়ে-থাকা কয়েকটা কেওড়া গাছের দিকে ইশারা করে তাড়াতাড়ি বুকে হেঁটে সেইদিকে চললেন। মাল্যধরও কোনো আওয়াজ না-করে পিছু নিল তাঁর। কী করতে চাইছে মধু রেঞ্জার সেটা বুঝতে আর বাকি নেই তার। পেটের ভেতর গুরগুর করে-ওঠা হাসিটা কোনোরকমে আটকাল সে। যেমন সেয়ানা বাঘ, তেমন বিটলে এই রেঞ্জারবাবু। ভালো ফন্দিই এঁটেছে। একেবারে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।
কেওড়া গাছের মাথায় বেয়ে উঠে ঘোড়া হয়ে বসে মধুবাবু বন্দুক বাগিয়ে ধরে ইশারা দিল। এইখান থেকে, বাজপোড়া গুঁড়ি থেকে মড়ি অবধি গোটা জায়গাটাই একসঙ্গে নজরে পড়ে। একটা দোডালায় সামলে বসে বন্দুকটা হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি রেখে নিয়ে দেশলাই জ্বালাল মাল্যধর। তারপর চকোলেট বোমার পলতেয় ছুঁইয়েই সেটাকে ছুড়ে মারল কাঁঠাল গাছের গুঁড়িটার মাথা লক্ষ করে।
টিপে কখনো ভুল হয় না মাল্যধরের। চিড়বিড়ে আগুনের একটা বাঁকা দাগ তৈরি করে বোমাটা সটান গিয়ে বেরিয়ে- থাকা কানদুটোর মধ্যিখানে পড়ে দুড়ুম করে ফেটে গেল আর তার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ-ফাটানো গর্জন করে হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে গুঁড়ির মাথায় উঠে এল বাঘটা। সার্কাসের খেলার মতো চারটে পা একত্র করে এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়েই শরীরটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে বাতাসে গা ভাসিয়ে উড়ে গেল নীচের দিকে।
একেবারে তার সঙ্গেসঙ্গেই ফুটুস করে একটা শব্দ হল পাশের গাছটার থেকে। মাল্যধর তাকিয়ে দেখে, কাঁধের থেকে হাওয়া বন্দুক নামিয়ে তার মাথায় আর একটা নিদালি ওষুধের ছুঁচ লাগানো টোটা পরাচ্ছে মধুবাবু। বাঘটা ততক্ষণে মাটিতে নেমে এসে একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুট দিয়েছে তার মড়ির দিকে।
কৌতূহলী চোখে মধুবাবুর দিকে মাল্যধর তাকাতে, ছুটন্ত বাঘটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে দেখতেই ফিসফিস করে মধুবাবু বললেন, ‘সাবধানের মার নেই বাউলে। যদি না-লেগে থাকে তাহলে আর একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে তো। তাই আর একটা——বলতে বলতেই হঠাৎ হাসি হাসি মুখে বন্দুক নামিয়ে নিলেন মধুবাবু। বলেন, ‘কাজ হয়েছে। ওই দেখো।’
বাঘটা ছুটতে ছুটতেই হঠাৎ কেমন অবসন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে। মাথাটা তার ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে সামনের পা দুটো ভেঙে সে উবু হয়ে বসে পড়ল মাটির ওপরে, তার মড়ির ঠিক পাশটাতে।
দিন সাতেক পরে আরেকবার ঘুম পাড়ানো হল বড়োমেঞাকে। গোসাবা থেকে ডাক্তারবাবু এসে ততদিনে তার পায়ের ঘা সারিয়ে-সুরিয়ে দিয়েছেন। না-খেয়ে খেয়ে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল বাঘটা। এই ক-দিন সরকারের খরচায় গাদা গাদা মাংস খেয়ে তার গায়ে একটু গত্তিও লেগেছে। ঘুমিয়ে থাকা বাঘকে নৌকোয় তোলা হল যখন, মাল্যধরও তখন মধুবাবুর সঙ্গে চলল। নজরগঞ্জের বিট অফিসে ডি এফ ও সাহেব এসেছেন। মধুবাবুকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি মাল্যধরকে।
পুণ্যি আর বিশলা এই দুই নদী এসে মিলেছে নজরগঞ্জের কাছে। দুই নদীর ফাঁকে বিশাল তেকোনা চর গজিয়েছে একটা। লোকে তাকে বলে নজরগঞ্জের ট্যাক। নতুন পলি পেয়ে ফনফনে জঙ্গল গজিয়েছে সেইখানে। এই জঙ্গলে হরিণ আছে মেলা। ভটভটি নৌকো তার কাছাকাছি যখন এসে পৌঁছেছে ততক্ষণে জালে আটকা বড়োমেঞা একটু একটু নড়তে- চড়তে শুরু করেছে ফের। সেই দেখে মাঝি ডাণ্ডা ঘুরিয়ে ইঞ্জিনের তেজ বাড়িয়ে দুগনো করে দিল। দেখতে দেখতে নৌকো এসে ভিড়ল ট্যাকের পাড়ে। জালসুদ্ধু বাঘকে পাড়ে নামিয়ে ওপর থেকে দড়ির হ্যাঁচকা এক টান দিতেই জাল খসে পড়ল তার শরীর থেকে। অমনি হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল বনবিবির বাহন। নৌকোর দিকে একবার ঘুরে দেখল, তারপর দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ঢুকে গেল তার নিজের রাজত্বে। পায়ের চোট তার সেরে গিয়েছে একেবারে।
সেইদিকে তাকিয়ে মাল্যধর মনে মনে শুধু বলল, ‘ফের দেখা হবে মেঞা। এইবারে তোমার রাজত্বে যখন ফের লোকজন নিয়ে গিয়ে পড়ব পেটের দায়ে, তখন যেন আজকের কথাটা মনে থাকে তোমার!’