সেভেন রুমস
প্রথম দিন : শনিবার
জ্ঞান ফেরার পর প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোথায় আছি। খুব ভয় হচ্ছিল। প্রথম যা মনে পড়ে তা হল একটা দুর্বল হলুদ বা অন্ধকারে মলিন আলো ছড়াচ্ছিল। চারদিকে ধূসর কংক্রিটের দেয়াল। চারকোনা রুমটায় কোন জানালা ছিল না। আমি মেঝেতে পড়ে ছিলাম, যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
হাতে ভর দিয়ে ফ্লোরের উপর উঠে বসলাম। কংক্রিটের মেঝের রুক্ষতা ভালই টের পাচ্ছিলাম। রুমে চোখ বোলাতে গিয়ে মাথার ভেতর ব্যথায় ছ্যাঁত করে উঠল, মনে হল যেন ব্যথায় দুভাগ হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় কোথাও গোঙানির শব্দ পেলাম। আমার বড় বোন দুহাতে মাথা চেপে এক পাশে পড়ে আছে।
“আপু, কি হয়েছে! তুমি ঠিক আছ তো?”
আমার শরীর কাঁপছিল। আপু চোখ খুলল। আমার মত চারদিকে তাকিয়ে দেখল।
“আমরা কোথায়?”
“জানি না,” সাবধানে মাথা নেড়ে বললাম।
ছাদ থেকে ঝুলে থাকা নগ্ন বাটা ছাড়া পুরো রুমে আর কিছু নেই। কিছু না। আমাদের দুজনের কারোরই মনে নেই কিভাবে এখানে এসেছি।
আমার শুধু মনে আছে শহরতলীর একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কাছে দুপাশে গাছে ঢাকা একটা রাস্তা দিয়ে আমি আর আপু হাঁটছিলাম। আম্মু শপিং করছিল, আর আপু আমার দেখাশোনা করছিল। আমরা দুজনেই ব্যাপারটা নিয়ে বিরক্ত ছিলাম। আমার বয়স দশ, আমাকে বেবিসীট করার কিছু নেই। আর আমার বোনেরও ছোট ভাইকে দেখাশোনা করা ছাড়া
জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। কিন্তু আম্মু কিছুতেই আমাদের একা ছাড়তে রাজি ছিলেন না।
তাই আমরা একজন আরেকজনের সাথে কথা না বলে চুপচাপ রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আমার মনে আছে যে রাস্তার চারকোনা ইটগুলো একটা বিশেষ প্যাটার্ন ধরে বসানো ছিল। রাস্তার সাথের গাছগুলো আমাদের মাথার উপর ছাদের মত ছড়িয়ে ছিল।
মাঝে মাঝে আমি আর আপু একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করছিলাম।
“তোর উচিত ছিল বাসায় থাকা!”
“তুমি একটা স্বার্থপর!”
আপু এবার হাইস্কুলে উঠবে। কিন্তু আমি এরইমধ্যে ওর সাথে তর্কে পারদর্শী হয়ে উঠেছি। আমরা যখন তর্ক করতে করতে এগুচ্ছিলাম তখন পেছনে ঝোঁপের মধ্যে নড়াচড়ার শব্দ কানে আসে। ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছিল। ঘুরে তাকিয়ে দেখতে যাচ্ছিলাম এমন সময় মাথায় ভয়াবহ ব্যথা টের পাই। তারপর আর কিছু মনে নেই।
“কেউ নিশ্চয়ই পেছন থেকে আমার মাথায় বাড়ি দিয়েছিল। তারপর অজ্ঞান অবস্থায় আমাদের এখানে বয়ে এনেছে।”
আপু উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘড়ি দেখল।
“শনিবার! তারমানে রাত তিনটা বাজে এখন?”
ওর কব্জিতে একটা রুপালি রঙের এনালগ হাতঘড়ি। ঘড়ির ছোট ডিসেপ্লতে সপ্তাহের কোন দিন তাও দেখা যায়। ও ঘড়িটা এত ভালবাসে যে কখনো আমাকে ছুঁতেও দেয়না।
রুমটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা তিন মিটার করে হবে। একদম নিখুঁত কিউবের মত। বাল্বের মলিন আলো রুমের শক্ত, রুক্ষ তলে অন্ধকার ছায়া ফেলছিল।
এক দেয়ালে একটা লোহার দরজা লাগানো। ভেতর থেকে কোন হাতল বা খোলার জন্য কিছু নেই। দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা ভারি লোহার পাত কংক্রিটের দেয়ালে গেঁথে আছে।
দরজার নিচে পাঁচ সেন্টিমিটারের মত একটা ফাঁক আছে যেটা দিয়ে বাইরের আলো দেখা যায়।
আমি শুয়ে দেখার চেষ্টা করলাম ফাঁক দিয়ে বাইরের কিছু দেখা যায় কিনা।
“কিছু দেখতে পাচ্ছিস?” আপু কাতর গলায় প্রশ্ন করল, কিন্তু আমি মাথা নাড়লাম।
রুমের দেয়াল আর মেঝে বেশ পরিস্কার। কেউ সম্ভবত কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্কার করেছে, কোথাও কোন ধুলো দেখলাম না। আমার মনে হল আমরা যেন একটা ধূসর ঠান্ডা বাক্সের মধ্যে বন্দি হয়ে আছি।
সিলিঙের মাঝখানে লাগানো ইলেকট্রিক বাল্বটা হল আলোর একমাত্র উৎস। আমি আর আপু পুরো রুমটা ঘুরে দেখলাম। আমাদের ছায়াগুলো চার দেয়ালের মধ্যে জেগে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল। বাল্বের আলো খুবই দুর্বল ছিল, রুমের কোনাগুলোতে পুরোপুরি পৌঁছাতে পারছিল না।
রুমটার একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত ছিল। পঞ্চাশ সেন্টিমিটারের মত চওড়া একটা নালা রুমটাকে সমান দুটো ভাগে ভাগ করেছিল। দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, নালাটা বাম দিকের দেয়ালের মাঝখান থেকে এসে ডানদিকের দেয়ালের ভেতর দিয়ে সোজা চলে গিয়েছিল। নালার পানি ছিল ঘোলাটে আর পানিতে বিদঘুঁটে গন্ধ ছিল। বাম থেকে এসে ডানে বয়ে যাওয়া এই পানি জঘন্য রঙের দাগ ফেলেছিল নালার গায়ে।
আপু দরজায় কিল মারছিল আর চিৎকার করছিল। “হ্যালো? কেউ শুনতে পাচ্ছেন?!”
কোন উত্তর নেই। দরজাটা একদম নিরেট, যত কিল ঘুষি মারা যোক, একটুও নড়ল না। ভারি দরজার উপর ওর হাতের বাড়ি রুমের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলল। যেন নিষ্ঠুরভাবে আমাদের বোঝাতে চাইল আমরা এখানে কতখানি একা। আমি তখনো শক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিছুটা বিষণ্ণতাও অনুভব করছিলাম। কি করে আমরা এখান থেকে বের হব? আমার বোনের ব্যাগটা উধাও। ব্যাগে ওর সেল ফোনটা ছিল। তারমানে বাসায়ও ফোন করতে পারব না।
আপু মেঝেতে মুখ চেপে দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে যতটা সম্ভব জোরে চিৎকার করে সাহায্য চাইল। ততক্ষণে ওর পুরো শরীর ঘেমে গোসল হয়ে গিয়েছে, কাঁপছিল।
এমন সময় কিছুটা দূরে কোথাও আমরা মানুষের কণ্ঠের ফিসফিসের মত কিছু একটা শুনতে পেলাম বলে মনে হল। আপু আর আমি একে অপরের দিকে তাকালাম। কাছাকাছি কোন মানুষ আছে বলে মনে হল। কণ্ঠস্বর যেহেতু পরিস্কার নয়, আমরা বুঝতে পারছিলাম না সে কি বলছিল। তারপরেও আমার মনে হল দুশ্চিন্তার ভার কিছুটা কমল।
এরপর বেশ কিছুক্ষণ আমরা দুজনেই পাল্লা দিয়ে দরজায় লাথি ঘুষি চালালাম, কিন্তু কোন কাজ হল না। একসময় দুজনেই হাঁপিয়ে গিয়ে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। মেঝেতে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
***
সকাল আটটার দিকে আমার ঘুম ভাঙল।
আমাদের ঘুমের মধ্যে দরজার নিচ দিয়ে একটা প্লেটে এক স্লাইস পাউরুটি, আর এক বাটি পরিস্কার পানি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আপু রুটিটা দুভাগ করে অর্ধেকটা আমাকে দিল।
কে পাউরুটি রেখে গিয়েছে তা নিয়ে আমরা কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। যে আমাদেরকে এখানে আটকে রেখেছে সেই যে হবে তা নিয়ে আমাদের কোন সন্দেহ হচ্ছিল না। আমরা ঘুমালেও নালা দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছিল অবিরাম। বাজে গন্ধটায় আমার গা গুলিয়ে উঠছিল, মনে হচ্ছিল যেন কোথাও কিছু একটা পঁচে গিয়েছে। পানিতে মরা পোকামাকড় আর খাবারের উচ্ছিষ্টও ভেসে আসছিল।
আমার টয়লেটে যাওয়া দরকার ছিল। আপুকে বলতেই আপু দরজার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।
“মনে হয় না আমাদের এই রুমের বাইরে যেতে দেবে। তোকে এই নালাতেই কাজ সারতে হবে।”
আমরা বসে থেকে অপেক্ষা করছিলাম কখন রুম থেকে ছাড়া পাব। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও কেউ দরজা খুলে আমাদের মুক্ত করতে এল না।
“কে আমাদেরকে এখানে আটকে রেখেছে, এবং কেন?” আপু রুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করল। আমি কোন উপায় না দেখে নালায় বাথরুম সারলাম। কংক্রিটের ধূসর দেয়াল, ইলেকট্রিক বাল্বের মলিন আলো আর অন্ধকার ছায়া, আপুর ক্লান্ত চেহারা…সবকিছু আমাকে বিষণ্ণ করে তুলছিল। আমি এই রুম থেকে বের হতে চাই, যত দ্রুত সম্ভব।
আপু আরো একবার দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করল। আমরা শুনতে পারলাম কোন এক জায়গা থেকে কেউ কিছু একটা জবাব দিল।
“আমি জানতাম, কেউ একজন আছে ওখানে।”
কিন্তু তখনো আমরা কথাগুলো বঝতে পারছিলাম না।
দরজা দিয়ে আর কোন খাবার এলো না। মনে হচ্ছিল আমাদের শুধু সকালে খাবার দেয়া হবে। আপুর কাছে অভিযোগ করলাম কতটা খিদে পেয়েছে আমার। ও শুধু আমার সাথে চিৎকার করল।
রুমে কোন জানালা না থাকায় নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছিল না, কিন্তু আপুর ঘড়ি বলছিল তখন সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। দরজার কাছ থেকে আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম দুর থেকে পায়ের শব্দ কাছে আসছে।
আপু রুমের কোণায় বসে ছিল তখন, মুখ তুলে তাকাল। আমি দরজা থেকে সরে এলাম।
পায়ের শব্দ আরো কাছে এল। আমরা ভেবেছিলাম কেউ একজন আমাদের রুমে আসছে। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম সে এসে পুরো ব্যাপারটা আমাদেরকে ব্যাখ্যা করবে। আমরা দুজনেই দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম কখন দরজাটা খুলবে। কিন্তু পায়ের শব্দ পার হয়ে গেল। মনে হল, আপুর মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। ও দৌড়ে গেল দরজার দিকে।
“দাঁড়ান” ও মরিয়া হয়ে চিৎকার করল। লোটা আপুর অনুরোধ পাত্তা না দিয়ে হেঁটে চলে গেল।
“লোকটা যেই হোক, আমার মনে হয় না আমাদেরকে এখান থেকে বের হতে দেয়ার কোন ইচ্ছা তার আছে।” আমি বললাম।
“কিন্তু সেটা তো ঠিক না,” আপু বলল। ও ঠিক আমার মতই ভয় পেয়েছে।
ঘুম ভাঙার পর একটা পুরো দিন পার হয়ে গিয়েছে। সে সময় আমরা একটা ভারি দরজা খোলার আর বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলাম। সেই সাথে মানুষের কণ্ঠস্বর আর ভারি যন্ত্রপাতির আওয়াজ। কিন্তু কোন আওয়াজই স্পষ্ট ছিল না। মনে হচ্ছিল বিশাল কোন প্রাণীর গর্জনের শব্দ শোনা যাচ্ছে-বাতাসের কম্পনের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
দরজা আর খুলল না। আমরাও একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
দ্বিতীয় দিন : রবিবার
চোখ খুলেই আমি দেখলাম দরজার ফাঁক দিয়ে আবারো এক স্লাইস পাউরুটি দেয়া হয়েছে। এবার কোন পানি দেয়া হয়নি। আগের দিনের খালি বাটিটা সেখানেই পড়ে আছে। আপর ধারণা আমরা বাটিটা ফাঁক দিয়ে ফেরত দেইনি বলে পানি দেয়া হয়নি।
“ধ্যাত!” আপু বাটিটা তুলে নিতে নিতে বলল। বাটিটা ও এমনভাবে তুলল মনে হচ্ছিল যেন ছুঁড়ে ভেঙে ফেলবে। কিন্তু ভেঙে ফেললে আমাদেরকে হয়ত আর কখনোই পানি দেয়া না হতে পারে। আমি নিশ্চিত চিন্তাটা ওর মাথাতেও এসেছিল।
“আমাদেরকে এখান থেকে বের হতেই হবে।”
“তা তো অবশ্যই, কিন্তু সেটা কিভাবে?” আমি আস্তে করে প্রশ্ন করলাম। আপু এক মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে তারপর রুমের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া নালাটার দিকে তাকাল।
“এই নালাটা নিশ্চয়ই আমাদের টয়লেট করার জন্য রাখা হয়েছে।”
নালা দিয়ে অবিরাম পানি বয়ে যাচ্ছিল তখনো।
“নালাটা আমার জন্য অনেক সরু,” সে বলল, “কিন্তু আমার মনে হয় তুই এর মধ্যে দিয়ে যেতে পারবি, তুই শুকনা আছিস।”
আপুর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম তখন প্রায় দুপুর।
আপু যা চাইছে তা হল আমি নালায় নেমে তারপর দেয়ালের নিচে দিয়ে বেরিয়ে যাই। যদি বিল্ডিঙের বাইরে যেতে পারি তাহলে হয়ত কারো সাহায্য চাইতে পারব। যদি বের হতে নাও পারি তাহলেও আশপাশ সস্পর্কে জানা হবে। ওর চিন্তা ভাবনা আমার পছন্দ হল না।
নালা দিয়ে নামতে হলে আমাকে আন্ডারওয়্যার ছাড়া সব খুলতে হবে। তারপর ওই গন্ধ পানির ভেতর না জানি কি লুকিয়ে আছে সেগুলো ঠেলে বের হতে হবে, এই ব্যাপারটাও আমার পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু আপু অনুনয় করছিল।
“প্লিজ! তুই পারবি?”
অগভীর পানিতে এক পা দিয়েও আমি ইতস্তত করছিলাম। পানির তলে আমার পা সহজেই পৌঁছল। তলাটা পিচ্ছিল। নালার পানি আমার হাঁটু পর্যন্তও গভীর না।
দেয়ালের মাথায় যেখান দিয়ে পানি বেরিয়ে যাচ্ছিল, সেখানে অন্ধকার চারকোনা একটা গর্ত। গর্তটা ছোট হলেও আমার মনে হচ্ছিল সেটার ভেতর দিয়ে বের হতে পারব। পুরো ক্লাসের সবার মধ্যে সবচেয়ে ছোট সাইজ আমার।
মাথা নামিয়ে পানির যতটা কাছে যাওয়া সম্ভব গেলাম। বিচ্ছিরি দুর্গন্ধে চোখে পানি চলে এল। খুবই জঘন্য গন্ধ। চারকোনা গর্তের ওপাশে কি আছে তা দেখা যাচ্ছিল না। পানিতে ডুব দেয়া ছাড়া উপায় নেই।
ভয় পাচ্ছিলাম। যদি টানেলের ওপাশে ভয়ানক কিছু থেকে থাকে? বিপদজনক কিছু? তাহলে হয়ত আর ফেরত আসতে পারব না।
আপুকে কথাটা বলতে আপু আমার সব কাপড় চোপড় জোড়া আর আমাদের বেল্টগুলো দিয়ে একটা লাইফ লাইন বানালো। সেটার সাথে জুতার ফিতা দিয়ে আমার এক পায়ে বাধল। যদি আমি কোথাও আটকে যাই তাহলে ও আমাকে টেনে আনতে পারবে।
“কোনদিকে যাব প্রথমে?” ডান-বামে তাকিয়ে বললাম আমি। স্রোতের দিকে না সোতের বিপরীতে?
“যেদিকে তোর খুশি,” আপু বলল। “কিন্তু যদি মনে হয় টানেলটা অনেক লম্বা তাহলে ফেরত চলে আসবি।”
আমি ঠিক করলাম প্রথমে ঘোতের বিপরীত দিকেই যাব। অর্থাৎ দরজা থেকে বাম দিকের গর্তে। চোখ বন্ধ করে ডুব দিলাম। নোংরা পানিতে মনে হচ্ছিল পোকামাকড় সব আমার গায়ে কিলবিল করছে। দম ধরে রেখে চোখ বন্ধ করে গর্ত দিয়ে প্রথমে মাথা ঢুকালাম। টানেলের সিলিংটা খুবই নিচু আর সরু। মাথার পেছনটা সাথে সাথে সিলিঙের সাথে বাড়ি খেল। চারকোনা গর্তটা একদম আমার শরীরটা ঘষটে ঘষটে ঢুকানোর সমান চওড়া ছিল। মনে হচ্ছিল যেন সুইয়ের ফুটো দিয়ে সুতো ঢুকাচ্ছি। পানির মোত তেমন জোরালো ছিল না, যে কারনে আমাকেও খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
দুই মিটারের মত যাওয়ার পর আমি টের পেলাম মাথার সাথে সিলিঙের টোকা লাগছে না। নালাটা আবার চওড়া হয়ে গিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি মাথা তুলে উঠে দাঁড়ালাম।
তারপর একটা চিৎকার শুনতে পেলাম।
চোখে নোংরা পানি ঢুকুক সে ইচ্ছা আমার ছিল না কিন্তু এখন চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। এক মিনিটের জন্য মনে হল আগের রুমেই ফিরে এসেছি। জায়গাটা ঠিক আমাদের রুমটার মতই ধূসর, কংক্রিটের তৈরি একটা কিউব। সেই একই নালা দুই দেয়াল ভেদ করে চলে গিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম আমাদের রুমের একদিকের গর্ত দিয়ে ঢুকে আরেক দিকের গর্ত দিয়ে রুমে ফেরত এসেছি।
আসলে তা নয়। আমার বোনের বদলে এই রুমে অন্য কাউকে দেখতে পেলাম। একটা অল্প বয়সি মেয়ে। আপুর চেয়ে বয়সে একটু বড়ই হবে মনে হয়। আগে কখনো একে দেখেছি বলে মনে হয় না।
“কে তুমি?!” সে চিৎকার করছিল। বোঝা যাচ্ছিল আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে। আমার থেকে যতটা সম্ভব দুরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি আর আমার বোন পাশের রুমে আছি। স্রোত যেদিকে যাচ্ছে সেদিকের রুমে। পায়ের থেকে ফিতাটা খুলে নিয়ে আমি ঠিক করলাম আরো সামনে যাব।
একইভাবে সামনে আরো দুটো রুম আবিষ্কার করলাম।
সুতরাং মূল বক্তব্য হল, আমাদের রুম থেকে স্রোতের বিপরীত দিকে গিয়ে মোট তিনটা রুম পেলাম। প্রত্যেক রুমেই একজন করে মেয়ে ছিল।
প্রথম রুমে ছিল অল্প বয়সি মেয়েটা।
তার পরের রুমে লম্বা চুলের আরেকটা মেয়ে।
সবচেয়ে দূরের রুমের মেয়েটার চুল লাল রঙ করা ছিল।
তারা সবাই আমাদের মতই বন্দি, এবং কেউই জানে না কেন তাদেরকে বন্দি করা হয়েছে। সবার মধ্যে আমি আর আপই সবচেয়ে ছোট। আমার মনে হয় আমাকে আর আপুকে এক রুমে রাখা হয়েছে কারন আমি এখনো অনেক ছোট। আমাকে পুরো একজন মানুষ হিসেবে ধরা হয়নি। আপু আর আমি মিলে একজন মানুষের সমান বা এরকম কিছু।
লাল চুলো মেয়েটার রুমের পর একটা লোহার খাঁচা দিয়ে নালার মখ বন্ধ করা ছিল যে কারনে আর সামনে যেতে পারিনি। রুমে ফিরে এসে আপুকে সব জানালাম।
ভেজা শরীর শুকিয়ে যাওয়ার পরও আমার গায়ে দুর্গন্ধ লেগে থাকল। ধোয়ার জন্য পরিস্কার পানি না থাকায় মনে হল দুর্গন্ধ পুরো রুমে ছড়িয়ে গেল। আপু অবশ্য গন্ধ নিয়ে কোন অভিযোগ করল না।
“তারমানে সোতের দিক থেকে চার নাম্বার রুমে রয়েছি আমরা।” বিড়বিড় করে বলল ও, কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত সে।
এক সারিতে অনেকগুলো রুম প্রত্যেকটায় একজন করে মানুষ বন্দি। ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার আশ্চর্য লাগছিল। আমার মত আরো অনেকে একই অবস্থায় আছে ভেবে একটু স্বস্তি, আবার একটু সাহসও পাচ্ছিলাম যেন।
প্রথম দেখায় মেয়েরা সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপর সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দেখে মনে হচ্ছিল এরা সবাই বেশ কিছুদিন ধরে এখানে বন্দি, আর এতদিন কখনো কোন মানুষের দেখা পায়নি। তাদের কারোরই দরজা কখনো খুলেনি। তারা কোথায় আছে, তাদের দেয়ালের বাইরে কি আছে কিছু জানত না তারা। তাদের শরীর ছোট সাইজের না হওয়ায় কেউই নালায় নেমে অন্য পাশে গিয়ে দেখতে পারেনি।
আমি যখন নালার ভেতর দিয়ে রুমগুলোতে গিয়েছিলাম, প্রত্যেকে আমাকে অনুরোধ করেছে আবারও যেন আসি। এসে ওদেরকে যেন জানাই অন্য রুমগুলোতে আমি কি কি দেখেছি।
কে আমাদেরকে এখানে আটকে রেখেছে? আমরা কেউই এই প্রশ্নের উত্তর জানি না। আমরা জানি না এই জায়গাটা আসলে কি, সবাই শুধু জানতে চাইছিলাম কখন আমরা এখান থেকে মুক্তি পাব।
আপুর কাছে সোতের বিপরীতের রুমগুলো নিয়ে রিপোর্ট করার পর তৈরি হলাম সোতের দিকে গিয়ে দেখার জন্য। আগের মতই আরো কয়েকটা কংক্রিটের রুম আবিষ্কার করলাম।
প্রথম রুমটায় আমার বোনের বয়েসি একটা মেয়ে ছিল। আমাকে দেখে সে চমকে উঠল। কিন্তু সব কথা শোনার পর শান্ত হল। বাকি সবার মতই কেউ একজন তাকে এখানে ধরে এনেছে। ওর কোন ধারণা নেই কেন কেউ সেটা করল।
পরের রুমটায় গেলাম। এই রুমটার সবই এক, শুধু একটা জিনিস অন্য রুমগুলোর চেয়ে আলাদা ছিল। সেটা হল, রুমটায় কেউ ছিল না। একদম শূন্য। আরেকটা মলিন বা ম্লান আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাকি সব রুমগুলোতে কেউ না কেউ ছিল। এই একটা খালি দেখে আমার কাছে অদ্ভুত লাগল।
নালা ধরে পরের রুমটীয় গেলাম। ফিতা ধরে রাখার কেউ ছিল না কিন্তু সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলাম না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আরো কিছু ছোট ছোট রুম পাবো যে কারনে ফিতা আপুর কাছে রেখে এসেছিলাম।
স্রোতের দিকে তৃতীয় রুমে আম্মুর বয়সি একজন মহিলাকে পেলাম।
তিনি আমাকে নালা থেকে উঠতে দেখে অবাক হলেন না। দূর থেকে দেখেই কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল মহিলাটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু একটা রয়েছে। তিনি জড়সড় হয়ে এক কোণায় বসে কাঁপছিলেন। প্রথম দেখায় যে তাকে আম্মুর বয়সি মনে হয়েছিল সেটা সম্ভবত ভুল, তিনি আরো কমবয়সি হবেন হয়ত।
সামনে তাকিয়ে দেখি নালার মাথায় একটা লোহার গেট লাগানো। এর বেশি আর যাওয়া সম্ভব নয়। তারমানে সোতের দিকের শেষ মাথায় চলে এসেছি।
“আপনি…আপনি ঠিক আছেন?” মহিলাটাকে জিজ্ঞেস করলাম। উনি কাঁধ ভাগ করলেন। ভয় মেশানো দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন, “কে..?”
তার কণ্ঠ কেমন মৃত শোনাল, কোন জোর নেই গলায়।
অন্য রুমের মেয়েদের চেয়ে উনি স্পষ্ট আলাদা রকমের। কংক্রিটের মেঝেতে মাথা চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মহিলাটার হাত মুখ ঘর্মাক্ত আর নোংরা হয়ে ছিল। চোখ ভেতরে ঢুকে গিয়েছে, চাপা ভাঙা, দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা কংকাল।
আমি তাকে জানালাম আমি কে আর কি করছি। মনে হল তার অন্ধকার চোখগুলোতে একটু আলোর ফুলকি দেখা দিল।
“তারমানে তুমি বলছ ওদিকে আরো জীবিত মানুষ রয়েছে?!”
জীবিত মানুষ মানে? আমি তার কথার অর্থ বুঝতে পারছিলাম না।
“তুমি তাদের দেখেছ তাই না? না দেখে কিভাবে থাকা সম্ভব! প্রতিদিন, ঠিক সন্ধ্যা ছয়টার সময় এই নালা দিয়ে লাশগুলো ভেসে যায়!।”
***
ফিরে গিয়ে আপুকে সব খুলে বললাম।
“তারমানে সব মিলিয়ে রুমের সংখ্যা সাতটা। হুম…”
আপু যখন বলছিল, আমি তখন রুমগুলোকে নাম্বার দিচ্ছিলাম সহজে ব্যাখ্যা করার জন্য। সোতের শুরু থেকে ধরলে আমি আর আপু যেই রুমে আছি সেটা হল চার নাম্বার। আর শেষ রুম, যেটায় মহিলাটা ছিল সেটা হল সাত নাম্বার।
আমি ভাবছিলাম মহিলা যে পাগলামি কথাগুলো বলেছিল ওগুলো আপুকে বলব কিনা। আমাকে চিন্তা করতে দেখে আপু কিছু একটা আঁচ করতে পারল। কাঁপতে কাঁপতে আপুকে বললাম সাত নাম্বার রুমের মহিলা কি দেখেছে। প্রতিদিন ছয়টার সময় নাকি নালা দিয়ে মানুষের লাশ ভেসে যায়।
কথাগুলো শোনার সময় এরকম ছোট নালা দিয়ে কিভাবে লাশ ভেসে যেতে পারে তা ভেবে আমার আশ্চর্য লাগছিল। তাছাড়া সাত নাম্বার রুমে নালার শেষে একটা লোহার গেট আছে। লাশ যদি কোনভাবে ভেসেও আসে তাহলে গেটে আটকে যাওয়ার কথা না? মহিলা বলেছিল লাশগুলোকে কেটে ছোট ছোট টুকরো করা হয় যাতে গেটের লোহার বারগুলোর ভেতর দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে। মাঝে মধ্যে দু-একটা টুকরো আটকে যায় ঠিকই কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কোন সমস্যা হয় না। একদম প্রথম দিন থেকেই মহিলা নালা দিয়ে লাশগুলোকে ভেসে আসতে দেখছে।
আপু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সব শুনল।
“কাল সন্ধ্যায়ও দেখেছে?”
“হ্যাঁ।”
গত সন্ধ্যায় আমরা কোন লাশ ভেসে যেতে দেখিনি। তাহলে কিভাবে সম্ভব? আমরা তো ছয়টা পর্যন্ত জেগে ছিলাম। রুমের যে অংশেই বসে থাকা হোক না কেন, নালা চোখে পড়বেই। যদি নালা দিয়ে অদ্ভুত কিছু ভেসে যায় সেটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
“আচ্ছা তিন নাম্বার রুমের মেয়েটা কি কিছু বলেছে যে সে এরকম কিছু দেখেছে?”
আমি মাথা নাড়লাম। একমাত্র সাত নাম্বার রুমের মহিলাই লাশের কথা বলেছে আর কেউ না। মহিলা কি কোন ধরনের হ্যালুসিনেসনে ভুগছে বা কিছু?
কিন্তু মহিলাটার চেহারা আমি মাথা থেকে দূর করতে পারছিলাম না। ওই ভাঙা মুখ, চোখের নিচের কালো দাগ। চোখগুলোতে এমন গভীর অন্ধকার ছিল যেন মনে হচ্ছিল সে ইতিমধ্যেই মৃত। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল এমন একজন যে কিনা ভীতিকর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। মহিলা যে সত্যিই খারাপ কিছু একটা দেখেছে তা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
“তোমার কি মনে হয় মহিলা সত্যি বলছে?” আপুকে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু আপু শুধু মাথা নেড়ে বলল, “জানি না।।” আমার এত ভয় লাগছিল বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত।
“যখন সময় হবে আমরা সব জানতে পারব।”
আপু আর আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকলাম। অপেক্ষায় থাকলাম কখন আপুর ঘড়িতে ছয়টা বাজে।
এক সময় ঘড়ির বড় কাটা আর ছোট কাটা মিলে সোজা একটা লাইন তৈরি করল। বাল্বের মলিন আলো পড়ে রুপালি কাটাগুলো চকচক করছিল। যেন আমাদেরকে বলতে চাইছিল যে সময় হয়েছে। আমি আর আপু জোরে দম নিয়ে নালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
দরজার বাইরে মনে হল দূরে কোথাও থেকে কারো যাওয়া কিংবা আসার শব্দ ভেসে এল। সেটা শুনে আমরা দুজনেই উসখুস করছিলাম। ছয়টা বাজার সাথে ওই পায়ের শব্দের কি কোন সংযোগ আছে? আপু কিছু বলল না। হয়ত ও ভাবছিল বলে কোন লাভ নেই।
দুর থেকে মনে হল কোন মেশিনের শব্দ ভেসে এল। কিন্তু নালা দিয়ে কোন লাশ কিংবা লাশের টুকরো ভেসে এল না। স্রেফ আগের সেই ঘোলা পানি আর পানিতে ভেসে থাকা মরা পোকামাকড়।
তৃতীয় দিন : সোমবার
ঘুম ভাঙল যখন তখন ঘড়িতে সকাল সাতটা। আমাদের নাশতা, এক স্লাইস পাউরুটি দরজার ফাঁক দিয়ে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আগেরদিন আমরা পানির বাটিটা ফাঁক দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম। সেটায় পানি ভরে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে। যে লোকটা কিংবা মহিলা আমাদের এখানে আটকে রেখেছে সে সম্ভবত পাউরুটির সাথে পানি জগ নিয়ে আসে। আমি কল্পনা করলাম মুখ-মন্ডলবিহীন একজন লোক এক দরজা থেকে আরেক দরজায় যাচ্ছে আর এক পিস করে রুটি দিচ্ছে, বাটিতে পানি ঢালছে।
আপু পাউরুটিটা দু টুকরো করে আমাকে বড় টুকরোটা দিল।
“তোকে একটা কাজ করতে হবে আমার জন্য,” সে বলল। সে চায় আমি নালা দিয়ে গিয়ে সবাইকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে আসব। আমার ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু ও তাহলে আমার রুটি ফিরিয়ে নেবে বলল। সুতরাং না করে আমার কোন উপায় ছিল না।
“আমি চাই তুই সবাইকে দুটো প্রশ্ন করবি। তারা কতদিন ধরে আটকে আছে আর নালা দিয়ে কোন লাশ ভেসে যেতে দেখেছে কিনা। এই দুটো প্রশ্ন।”
আমি তাই করলাম।
প্রথমে আমি মোতের বিপরীতের রুম তিনটায় গেলাম।
তিনজনই আমাকে দেখে খুশি হল। আমি তাদেরকে আপুর প্রশ্নগুলো করলাম।
রুমগুলোতে কোন জানালা ছিল না। তাই সময়-দিন হিসাব করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তারপরেও সবারই মোটামুটি ধারণা ছিল তারা কতদিন ধরে বন্দি। ঘড়ি না থাকলেও প্রতিদিন একবার খাবার আসে, সেভাবে বলা সম্ভব কত দিন গেল।
তারপর আমি স্রোতের দিকের রুমগুলোতে গেলা, এবং অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখতে পেলাম।
পঞ্চম রুমে আগের দিনের মেয়েটাই ছিল।
কিন্তু ষষ্ঠ রুমে, যেটা কিনা গতকাল খালি ছিল, সেখানে এখন নতুন একজন মেয়ে। সে আমাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। নোরায় মাখামাখি অবস্থায় আমাকে দেখে সে সম্ভবত কোন দৈত্য বা সেরকম কিছু একটা ভেবেছে। তাকে বোঝাতে গিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হল। সব শুনে একসময় সে কিছুটা শান্ত হল।
যা বুঝলাম তা হল গতকালকেই সে এই রুমে এসেছে। রাস্তায় জগিং করছিল। একটা সাদা স্টেশন ওয়াগন কাছেই পার্ক করা ছিল। গাড়িটা তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওর মনে হল কিছু একটা এসে মাথায় লাগল। এরপর সব অন্ধকার। মেয়েটা মাথা টিপে দেখল তখনো ব্যথা করছে কিনা।
আমি সপ্তম রুমে গেলাম। যে রুমে আগেরদিন পাগল মহিলাটা আমাকে লাশগুলোর কথা বলেছিল। কিন্তু রুমে কেউ ছিল না। মহিলা। উধাও। খালি কংক্রিটের রুম আর ম্লান হলুদ বাল্ব।
আরেকটা অদ্ভুত জিনিস আমি খেয়াল করলাম সেটা হল রুমটাকে আগের দিনের চেয়ে পরিস্কার দেখাচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল না এখানে কেউ কখনো ছিল। দেয়ালে কিংবা মেঝেতে এক বিন্ধু ধুলো পড়ে নেই। যে মহিলাটার সাথে কথা বলেছিলাম সে কি তাহলে কল্পনা ছিল নাকি আমি ভুল রুমে এসেছি?
চতুর্থ রুমে ফিরে এসে আপুকে যা যা জেনেছি সব জানালাম।
প্রথম প্রশ্নের উত্তর সবার আলাদা আলাদা ছিল। এক নাম্বার রুমের লালচুলো মেয়েটার আজকে ষষ্ঠ দিন। সে নিশ্চিত যে সে ছয়দিন খাবার খেয়েছে।
দুই নাম্বার রুমের মেয়েটার আজকে পঞ্চম দিন। তিন নাম্বার রুমের মেয়েটার চতুর্থ দিন। চার নাম্বার রুমে আমরা আছি। আমাদের আজকে তৃতীয় দিন। পাঁচ নাম্বার রুমের মেয়েটার আজকে দ্বিতীয় দিন। ছয় নাম্বার রুমের মেয়েটাকে গত রাতে ধরে আনা হয়েছে। তারমানে আজকে তার প্রথম দিন।
সাত নাম্বার রুমের মহিলাটা কতদিন ধরে ছিল তা জানার উপায় নেই কারন সে এখন আর সেখানে নেই।
“হয়ত সে বের হয়ে যেতে পেরেছে?” আমি আপুকে বললাম, কিন্তু আপু অতটা নিশ্চিত না।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা ছিল কেউ নালা দিয়ে লাশ ভেসে যেতে দেখেছে কিনা। উত্তর হল, কেউ দেখেনি। কিন্তু প্রশ্নটা শুনে সবাই একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।
“এই প্রশ্ন কেন করলে?” প্রত্যেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। তাদের সবার ধারণা আমি বোধহয় ভেতরের কোন খবর জানি। তা অবশ্য জানি। আমি ছাড়া ওরা কেউ তো নালা দিয়ে এক রুম থেকে আরেক রুমে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারছিল না। ওরা খালি পারছিল কল্পনা করতে। এরকম রুমে বন্দি থেকে কল্পনা করা ছাড়া সময় পার করার কোন উপায় নেই।
“পরে সব বলব।” তাড়াতাড়ি সবার উত্তর জানার জন্য আমি সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে পার পেতে চাচ্ছিলাম।
“এটা ঠিক না। আমি তোমাকে এভাবে যেতে দেব না। হয়ত যে গ্যাং আমাকে এখানে আটকে রেখেছে তুমি তাদেরই কেউ। অন্য আরো রুম আছে, সেখানে আরো মানুষ বন্দি আছে এই কথা আমি তোমার থেকে শুনে বিশ্বাস করব কেন?” প্রথম রুমের মেয়েটা আমাকে বলেছিল। নালার উপর দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে দেয়াল আটকে রেখেছিল যেন আমি যেতে না পারি।
আমার আর কোন উপায় ছিল না। তাই ওকে আগের রাতে শোনা পাগল মহিলার কথাগুলো বললাম। সব শুনে মেয়েটার মুখ কাগজের মত সাদা হয়ে গেল আর আমাকে নির্বোধ বলে বকাঝকা করল। সে বলল এই কাহিনী কোনভাবেই সত্যি হতে পারে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আমাকে যেতে দিল।
সবাই বলল তারা কোন লাশ ভেসে যেতে দেখেনি। আমার মনে হল সাত নাম্বার রুমের মহিলা তাহলে নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেসন কিংবা এরকম কিছুতে ভুগছিল। মহিলাটা বলেছিল সে নাকি প্রতিদিন একই সময়ে লাশের টুকরো ভেসে যেতে দেখে। কিন্তু অন্য মেয়েরা বলল তারা সেরকম কিছু দেখেনি। এই ধাঁধার কোন অর্থ বের করতে পারলাম না আমি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি দড়ি দিয়ে শরীর থেকে নোংরা তরলগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করলাম। আপু আর আমি মিলে আমার শার্ট আর প্যান্ট দিয়ে দড়িটা বানিয়েছি। এই কয়েকদিন আমি শুধু আমার আন্ডারপ্যান্ট পরে আছি। রুমটা যথেষ্ট উষ্ণ, যে কারনে ঠাণ্ডা লাগার চিন্তা নেই। দড়িটার এমনিতে আর কোন কাজ নেই, টাওয়াল হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া। অন্য সময় সেটা রুমের কোণায় পড়ে থাকে।
আমি মেঝেতে দলা পাকিয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কংক্রিটের মেঝে বুকের হাড়ে লেগে ব্যথা করছিল, কিন্তু কিছু করার ছিল না।
যদিও আমার তথ্যগুলো অবিশ্বাস্য, কিন্তু তারপরেও আমার মনে হল রুমগুলোতে গিয়ে গিয়ে সবার সাথে কথা বলা উচিত। তারা রুমে একা রয়েছে আর সবাই আতংকিত।
কিন্তু অন্যদিকে আমার সাথে কথা বললে ওরা আরো বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। আমি জানি না কাজটা ভাল হবে নাকি আরো খারাপ হবে।
আপু রুমের এক কোনায় বসে দেয়ালের দিকে একটানা তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সে খপ করে কিছু একটা ধরল।
“কোত্থেকে আমার মাথায় একটা চুল এসে পড়ল,” অবাক হয়ে দু আঙুলে একটা লম্বা চুল ধরে রেখেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না ও কি বলছে।
“দ্যাখ, কত বড় চুল!”
ও উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুলটা কত লম্বা সেটা মাপার চেষ্টা করল। আন্দাজে মনে হল পঞ্চাশ সেন্টিমিটারের মত হবে।
অবশেষে আমি বুঝতে পারলাম ও কি বলার চেষ্টা করছে। আমার বা আপুর কারো চুলই এত বড় না। তারমানে চুলটা অবশ্যই অন্য কারোর।
“তাহলে কি আমাদের আগে এই রুমে অন্য কাউকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল?”
আপুর মুখ শুকিয়ে গেল। মুখ দিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দ বেরিয়ে এল।
“তাহলে…তাহলে…অবশ্যই…না, না…হয়তো…হয়তো বোকার মত কথা…কিন্তু…তুই কি বুঝতে পারছিস কি বলতে চাইছি? সোতের বিপরীতের রুমগুলোর মানুষগুলো আমাদের চেয়ে বেশি সময় ধরে আছে। দুই নাম্বার রুমের থেকে এক নাম্বার রুমের মেয়েটা এক দিন বেশি আছে। তারমানে হল আমাদের সবাইকে সিরিয়ালি রাখা হয়েছে। প্রথম রুম থেকে।”
আপু মনে করিয়ে দিল প্রত্যেক রুমে কে কয়দিন ধরে আছে।
“তাহলে এখানে কে ছিল?”
“এখানে আর কেউ ছিল? এটা কি আগে খালি ছিল না?”
“হ্যাঁ খালি ছিল ঠিকই। কিন্তু তার আগে?”
আপু রুমের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। এক পাশ থেকে আরেক পাশে মাথা দোলাচ্ছে।
“ভেবে দ্যাখ, গতকাল আমাদের যখন ঘুম ভাংল, সেটা ছিল আমাদের দ্বিতীয় দিন। আমাদের পাশের পাঁচ নাম্বার রুমের মেয়েটার জন্য প্রথম দিন। ছয় নাম্বার রুমটা খালি ছিল, বা বলা যায় শুন্য দিন। কিন্তু সাত নাম্বার রুমের মহিলাটার জন্য কত নাম্বার দিন ছিল? সিরিয়ালি ধরলে মাইনাস এক দিন। তোদের কি স্কুলে নেগেটিভ নাম্বার শেখানো শুরু করেছে?”
“হ্যাঁ ওইটুকু আমি জানি।” কিন্তু সত্যি কথা হল ব্যাপারটা বুঝতে আমার কষ্ট হচ্ছিল।
“বুঝতে পারছিস না তাই না? মাইনাস একদিনে ওই রুমে কেউ ছিল। তারমানে, আমার ধারণা, গতকাল ওই মহিলার এখানে ষষ্ট দিন ছিল। সে নিশ্চয়ই এক নাম্বার রুমের মেয়েটার এক দিন আগে এখানে এসেছিল।”
“তাহলে সে এখন কোথায়?”
আপু পায়চারি থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। শকড। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে সে আমাকে ব্যাখ্যা করল। সম্ভবত ওই মহিলা আর এই দুনিয়ায় নেই। সম্ভবত সে এখন মৃত।
গতকাল যে উধাও হয়ে গিয়েছে তার জায়গায় আজকে নতুন মানুষ এসেছে। আমি যা দেখেছি তা নিয়ে চিন্তা করলাম। তথ্যগুলো আপুর কথার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।
“একেকটা দিন যায়, আর স্রোতের দিকে একটা করে রুম খালি হতে থাকে। শেষ মাথায় গিয়ে আবার প্রথম রুম থেকে শুরু হয়। সাতটা রুম। সপ্তাহের প্রতিদিনের জন্য একটা করে…”
একেক দিন একেকটা রুমের মানুষকে খুন করা হয় আর নালা দিয়ে তার লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়। পরের দিন সেই রুমে নতুন মানুষ আনা হয়।
খুন করা হয় আর সে জায়গা নতুন কাউকে দিয়ে পূরণ করা হয়।
গতকাল ছয় নাম্বার রুমে কেউ ছিল না। আজকে সেখানে নতুন একজনকে আনা হয়েছে। নতুন একজনকে কিডন্যাপ করা হয়েছে-শূন্যস্থান পূরণ করা হয়েছে।
গতকাল সাত নাম্বার রুমে একজন ছিল। আজকে সেখানে কেউ নেই, উধাও। কেটে টুকরো টুকরো করে নালা দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে।
আপু মেঝের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছিল। শুনে মনে হচ্ছিল কোন জাদুমন্ত্র পড়ছে। ওর দৃষ্টি নির্দিষ্ট কোন কিছুতে সীমাবদ্ধ ছিল না।
“সেকারনেই সাত নাম্বার রুমের মহিলাটা নালা দিয়ে লাশ ভেসে যেতে দেখেছে। রুমগুলোতে মানুষ এমনভাবে রাখা যে নালা দিয়ে কেউ ভেসে গেলে সোতের দিকের রুমগুলোর কারো দেখতে পাওয়ার কথা না। মহিলাটা ঠিকই দেখেছিল, হ্যালুসিনেশনে ভুগছিল না সে। শেষ রুমে থাকায় অন্য রুমের লাশগুলোকে সে ভেসে যেতে দেখেছিল।”
আর গতকাল সাত নাম্বার রুমের মহিলাটা খুন হওয়ায় তার লাশ কেউ দেখেনি। আপু আমাকে পুরোটা ব্যাখ্যা করে বোঝাল। পুরো ব্যাপারটা অনেক জটিল মনে হলেও আপ যা বলছিল তা আমি বিশ্বাস করলাম।
“আমাদেরকে এখানে আনা হয়েছে শুক্রবার। আমার মনে হয় ওই দিন পাঁচ নাম্বার রুমে যে ছিল তাকে খুন করে নালায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরেরদিন ছয় নাম্বার রুমের জনকে খুন করা হয় আর পাঁচ নাম্বার রুমে নতুন বন্দি আনা হয়। তুই যে সেদিন খালি রুম দেখলি, ওই রুমের বন্দিকে খুন করা হয়েছিল। তারপর রবিবারে সাত নাম্বার রুমের বন্দিকে খুন করা হয়। আমরা সারাদিন তাকিয়ে থাকলেও নালায় কিছু দেখতে পেতাম না কারন লাশ স্রোতের উল্টোদিকে যায় না। আজকে সোমবার…”
প্রথম রুমের বন্দিকে আজকে খুন করা হবে।
***
আমি ছুটে প্রথম রুমে গেলাম।
লাল চুলের মেয়েটাকে আপুর ব্যাখ্যা শোনালাম। কিন্তু সে আমাকে বিশ্বাস করল না। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল এরকম কোন কিছু কখনোই সত্যি হতে পারে না।
“কিন্তু কোনভাবে যদি সেরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে পালানোর উপায় খোঁজাই কি বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে না?”
কিন্তু আমাদের দুজনেরই কোন ধারণা ছিল না কি করা যেতে পারে।
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না!” সে ক্ষেপে গিয়ে আমার মুখের উপর চিৎকার করল। “আর এটাই বা কোন নরকে এসে পড়লাম?”
আমি নালা দিয়ে আমাদের রুমে ফিরে এলাম। আসার সময় আমাকে অন্য দুটো রুমও পার হতে হল। দু জায়গাতেই আমাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হল কোন খবর জানি কিনা। আমার কিছু বলা উচিত কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। তাই ঠিক করলাম আপাতত কিছু না বলাই ভাল। আমি শুধু বললাম যে শিগগিরি এসে জানাব।
আপু রুমের এক কোণায় হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসে ছিল। আমি নালা থেকে উঠতেই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, খেয়াল নেই যে আমি নোংরায় মাখামাখি হয়ে আছি। ওর ঘড়িতে তখন ছয়টা বাজে।
দুজনেই একসাথে খেয়াল করলাম যে নালার পানি লাল হয়ে উঠেছে। আমি আর আপু দুজনেই কথা হারিয়ে নালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ছোট ছোট সাদা সাদা জিনিস নালার চারকোনা গর্ত দিয়ে ভেসে আসতে লাগল। আমরা প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না ওগুলো কি। পরে মুখের নিচের পাটির একসারি দাঁত ভাসতে দেখলাম। আধ ডোবা অবস্থায় সেটা নালার এক মাথা থেকে ভেসে আরেক মাথায় চলে গেল। শিগগিরি কান, আঙুল, পেশী, হাড় সব পিছু পিছু ভেসে এল। একটা আঙুলে তখনো সোনার আংটি লেগে ছিল। একগাদা লাল চুল ভেসে গেল। ভালো করে তাকালে আমরা দেখলাম শুধু চুল না, চুলের সাথে মাথার তালুর কিছু অংশ লেগে ছিল।
আমি বুঝতে পারছিলাম এটা এক নাম্বার রুমের মেয়েটার লাশ। ঘোলাটে পানিতে ওর শরীরের অসংখ্য টুকরো ভেসে যেতে লাগল। ওগুলো দেখে মনে হচ্ছিল না কোন মানুষের শরীর। আমার কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল।
আপু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে গোঙাতে লাগল। এক কোণায় গিয়ে বমি করল। পেটে তো তেমন কিছু ছিল না, বমিতে কিছু বের হল না। আমি গিয়ে ওর সাথে কথা বললাম কিন্তু ও কোন উত্তর দিল না। চুপ করে থাকল।
আলাদা আলাদা কিউব আকৃতির রুমে আমাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। খুন করার আগে আমাদেরকে কিছু সময় দেয়া হয়েছে একাকী বসে চিন্তা করার জন্য।
“কোন নরকে এসে পড়লাম?” এক নাম্বার রুমের মেয়েটা আমার দিকে চিৎকার করে বলেছিল। তার খনখনে, কাঁপাকাপা কন্ঠ যেন আমার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, কোনভাবে মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। আমি উপলদ্ধি করতে পারছিলাম এই বন্ধ রুমগুলো শুধু আমাদেরকে আটকে রাখেনি, এরচেয়ে অনেক বেশি কিছু এর সাথে জড়িত। আমার মনে হচ্ছিল রুমগুলো হয়ত অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের জীবন, আমাদের আত্মাকে এখানে আটকে রেখেছিল। আমাদেরকে আলাদা করে ফেলেছিল। আমাদের ভেতর থেকে যেন আলো পর্যন্ত কেছু নিয়েছিল। এই জায়গাটা একটা জেলখানা, যা আমাদের আত্মাকে বন্দি করে রেখেছে। এই রুম আমাকে এমন এক একাকীত্ব শিখিয়েছে যা আমি আগে কখনো দেখিনি, আগে কখনো অনুভব করিনি। ভবিষ্যহীন, মুল্যহীন এক জীবন।
আপু নিজেকে বলের মত গুটিয়ে নিয়ে হাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসে ফোঁপাচ্ছিল। আমি নিজের মনে ভাবলাম অতীতে আসলে মানুষ কিরকম ছিল? যখন আমাদের জন্যও হয়নি, কিংবা ইতিহাস শুরুরও আগে? অন্ধকার একটা স্যাঁতস্যাঁতে বাক্সে বসে আমার বোন এখন যা করছে তা কি? আঙুলে গুনে দেখলাম খুন হওয়ার আগে আমাদের হাতে আর কদিন সময় আছে। ষষ্ঠ দিনে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টায় আমাদেরকে খুন করা হবে।
চতুর্থ দিন : মঙ্গলবার
কয়েক ঘন্টা পর নালার পানি থেকে লাল রঙ মিলিয়ে গেল। শেষের দিকে পানির মধ্যে সাবানের ফেনার মত ভাসছিল। যেন কেউ ধোয়ার কাজে নালাটা ব্যবহার করছিল। হয়ত কেউ প্রথম রুমটা পরিস্কার করছিল। কাউকে খুন করলে প্রচুর রক্ত বের হওয়ার কথা। সেগুলো তো কাউকে না কাউকে পরিস্কার করতে হবে তাই না?
আপুর হাতে ঘড়িতে বারোটা বাজল। মাঝরাত। মঙ্গলবারের শুরু। আমাদের এখানে আনার পর চতুর্থ দিন।
আমি নালায় নেমে এক নাম্বার রুমের দিকে গেলাম।
অন্য দুই রুমের দুজন মেয়েই আমাকে নালায় ভাসতে থাকা জিনিসগুলো নিয়ে প্রশ্ন করল। “পরে,” আমি তাদেরকে বললাম। তাড়াতাড়ি প্রথম রুমে যেতে হবে আমাকে।
যেমনটা ভেবেছিলাম। লালচুলো মেয়েটা নেই। রুমটা দেখে মনে হচ্ছিল হোস পাইপ দিয়ে থোয়া হয়েছে। কেউ একজন অবশ্যই রুমটা পরিস্কার করেছে। যদিও সে কে সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে সেই একই লোকই আমাদেরকে এখানে বন্দি করে রেখেছে।
আমি একই রকম নিশ্চিত যে আপু আমাদের রুমে যে লম্বা চুল খ পেয়েছিল তার মালিক আমাদের আগে আমাদের রুমে বন্দি ছিল। এবং খুন হয়েছিল। পরিস্কার করার সময় ওই চুলটা কোনভাবে রয়ে গিয়েছিল।
ভেবে অবাক লাগল কি ধরনের মানুষ হলে আরেক মানুষকে ধরে এনে এই রুমগুলোতে রেখে খুন করতে পারে। ছয়দিন একটা রুমে আটকে রেখে উপভোগ করছে তারপর এসে কেটে টুকরো টুকরো করছে।
আমরা এখন পর্যন্ত লোকটাকে দেখিনি। তার গলার আওয়াজ শুনিনি। কিন্তু আমরা নিশ্চিত যে সে আছে, প্রতিদিন দরজার সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করছে। প্রতিদিন নিয়ে আসছে পাউরুটি আর পানি। আর মৃত্যু। ওই লোকটা এই রুমগুলোর ডিজাইন করেছে, এগুলো তৈরি করেছে, আর সেই সাথে তৈরি করেছে এখানের মৃত্যুর নিয়মগুলোও।
আমরা না চাইলেও বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। এক সময় না এক সময় আমি আর আমার বোনও খুন হব! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই খুনির সাথে আমাদের দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
এই খুনি আসলে স্বয়ং মৃত্যু দেবতা। আপু, আমি, বাকি সবাই-এই উন্মাদ লোকটার ফাঁদে আটকা পড়ে আছি। আমাদের সবার মৃত্যু ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে।
***
আমি দুই নাম্বার রুমে ফিরলাম। ওই রুমের মেয়েটাকে বললাম ওর ছয়দিন বন্দিত্ব হয়ে গিয়েছে। আরো বললাম আপু যা যা আগেরদিন বলেছিল। এই মেয়েটা আমাকে নির্বোধ বলে গালি দেয়নি। ও নালা দিয়ে লাশের টুকরোগুলো ভেসে যেতে দেখেছে। ও বুঝতে পেরেছে ও এখানে একজন বন্দি। যে কিনা আর কোনদিন দুনিয়ার আলো চোখে দেখতে পারবে না। আমার বলা শেষ হওয়ার পর সে চুপ করে থাকল, ঠিক আপুর মত।
“আমি পরে আবার আসব,” বলে রুম নাম্বার তিনের দিকে গেলাম। সেখানে আমি একই কাহিনী আবারো বললাম।
তিন নাম্বার রুমের মেয়েটা খন হবে কালকে। এতদিন ওর কোন ধারণা ছিল না কতদিন পর্যন্ত এখানে বন্দি অবস্থায় থাকতে হবে। এখন স্পষ্ট ধারণা হল।
মেয়েটা যখন মুখে হাত চেপে কাঁদতে শুরু করল। আমি কেন জানি অবাক হলাম না।
আমি জানি না, ঠিক কোন সময়ে আপনি মরতে যাচ্ছেন তা জানতে পারা ভাল নাকি খারাপ। হয়ত কিছু না জানতে পারাই সব থেকে ভাল। তাহলে আপনি সেফ উদ্বিগ্ন হয়ে দিনের পর দিন নালা দিয়ে লাশ ভেসে যেতে দেখবেন। তারপর একদিন হঠাৎ দরজা খুলে যাবে এবং কোনদিন দেখেননি এমন কেউ এসে আপনাকে খুন করবে। আমার সামনে কান্নারত মেয়েটাকে দেখে আমার সাত নাম্বার রুমের মহিলাটার কথা মনে পড়ল। এদের সবার চেহারার অভিব্যক্তি একই রকমের ছিল।
আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে দিনের পর দিন এই চারকোনা কংক্রিটের ঘরগুলোতে আটকে রাখার ব্যাপারটা কারো কাছে খেলার মত। মৃত্যু দেবতা আসবে, আপনার নাম ধরে ডাকবে…পুরো ব্যাপারটাই বিচ্ছিরি রকমের ভীতিজনক।
সাত নাম্বার রুমের মহিলা প্রতিদিন নালা দিয়ে লাশের টুকরোগুলো ভেসে যেতে দেখত, আর পুরোটা সময় চিন্তা করত এরপরের শিকার সে হবে কিনা। ওর ভীতিগ্রস্থ মুখটা আমার চোখে ভেসে উঠল। বুকের ভেতর কোথায় যেন কষ্ট হতে লাগল।
পাঁচ আর ছয় নাম্বার রুমে গিয়েও আমি সব খুলে বললাম। সাত নাম্বার রুমে নতুন একটা মেয়ে এসেছে। আমাকে নালা থেকে উঠতে দেখে সে। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
***
চার নাম্বার রুমে আমি আমার বোনের কাছে ফিরে এলাম।
ওকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। সে একভাবে রুমের এক কোণায়। বসে ছিল। আমি ওর কাছে গিয়ে ঘড়ির সময় দেখলাম। ভোর ছয়টা বাজে।
দরজার বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। দরজার তলা দিয়ে এক পিস পাউরুটি চলে এল। পানির পাত্রে পানি ঢালার শব্দ পেলাম।
দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে সাদা আলো আসত। ওই জায়গার মেঝে ধুসরের চেয়ে একটু হালকা দেখাত। এক মুহূর্তের জন্য সেখানে একটা ছায়া পড়ল। ছায়াটা নড়ছিল। কেউ একজন সরাসরি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
দরজার বাইরের এই লোকটা না জানি কত মানুষকে খুন করেছে। এমনকি এখনো সে কয়েকজনকে খুন করার জন্য বন্দি করে রেখেছে। শুধু এটুকু চিন্তা করেই আমি দরজার এপাশ থেকে লোকটার অন্ধকার অশুভ ক্ষমতা অনুভব করতে পারছিলাম। আমার বুকের উপর কেমন যেন চাপ বাড়ছিল। নিশ্বাস নিতে পারছি না মনে হচ্ছিল।
আপু ধনুকের ছিলার মত তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে গিয়ে দরজার নিচের ফাঁকে মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, “দাঁড়ান!” ফাঁক দিয়ে ও হাত ঢুকানোর চেষ্টা করল কিন্তু হাত আটকে গেল। “প্লিজ! আমার কথা শুনুন! কে আপনি!?”
আপু গলার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করল, কিন্তু দরজার ওই পাশের লোকটার হাবভাব দেখে মনে হল না কিছু শুনতে পেয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে অন্যদিকে চলে গেল। তার পায়ের আওয়াজ আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল।
“শিট…শিট…” আপু বিড়বিড় করল। দরজার সাথের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। লোহার দরজায় কোন হাতল নেই। কজা দেখে মনে হচ্ছে দজা ভেতর দিকে খুলে। এরপর যেদিন দরজা খুলবে সেদিন আমাদের মরতে হবে।
“আমি মরতে যাচ্ছি,” আমি নিজেকেই নিজে শোনালাম। জীবনে অনেকবার কেঁদেছি বাসা থেকে দূরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কখনো মরতে হবে এই কথা ভেবে চোখের পানি ফেলা হয়নি।
খুন হওয়ার ব্যাপারটা কিরকম? বিষয়টা বুঝতে আমার সমস্যা হচ্ছিল।
কে আমাকে খুন করবে?
কোন সন্দেহ নেই অনেক কষ্টকর হবে ব্যাপারটা। মরে যাওয়ার পর আমার কি হবে? ভয় হচ্ছিল চিন্তা করতে। কিন্তু এরচেয়েও ভয়ের ব্যাপার সম্ভবত যে আপু আমার চেয়ে অনেক বেশি আতংকিত। ওকে অস্থিরভাবে রুমের ভেতর চোখ নাড়াতে দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত। আমার সাড়া শরীর কাঁপছিল।
“আপু…” বলে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আপু হাঁটু জড়িয়ে বসে ছিল। শূন্য চোখে আমার দিকে তাকাল।
“তুই কি এই সাত রুমের কাহিনী সবাইকে বলে দিয়েছিস?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম, কিন্তু মনে মনে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম।
“নিষ্ঠুর একটা কাজ করেছিস।”
“বুঝতে পারিনি,” আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আপু মনে হল না কিছু শুনছে।
আমি দুই নাম্বার রুমের দিকে এগুলাম।
***
দুই নাম্বার রুমের মেয়েটা আমাকে দেখে হাসল। মনে হল হাঁফ ছাড়ল। “আমি ভয় পাচ্ছিলাম তুমি বোধহয় আর আসবে না। বুঝতে পারছিলাম না কি করব।”
হাসিটা মলিন হলেও আমার ভেতরটা উষ্ণ করে তুলল। মনে হচ্ছিল কতদিন কাউকে হাসতে দেখিনি। তাই ওর হাসি যেন একই সাথে উষ্ণতা আর আলো ছড়াচ্ছিল।
কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুতও লাগছিল। আমি জানি না ও কিভাবে হাসতে পারছিল। ও তো জানে যে আজকে ওকে মরতে হবে।
“একটু আগে যে চিৎকার শুনলাম, তোমার বোনের নাকি?”
“হ্যাঁ। আপনি ওর কথা শুনতে পেয়েছিলেন?”
“শুনতে পেয়েছি কিন্তু বুঝতে পারিনি কি বলছিল। তাই ভাবছিলাম তোমার বোন কিনা।”
তারপর মেয়েটা আমাকে তার বাসার কাহিনী বলল। সে বলল আমি নাকি দেখতে তার ভাগ্নের মত। এখানে বন্দি হওয়ার আগে ও একটা
অফিসে কাজ করত, ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে যেত, ইত্যাদি।
“তুমি যখন বাইরে যেতে পারবে, আমি চাই তুমি এটা আমার পরিবারকে পৌঁছে দেবে।” ও গলা থেকে নেকলেস খুলে দ্রুত আমার গলায় পরিয়ে দিল। জিনিসটা একটা রুপার চেইন, সাথে ছোট্ট একটা ক্রুস। ওর কাছে কুসটা ছিল নিরাপত্তার প্রতীক। এখানে আসার পর প্রতিদিন ও ক্রুসটা মুঠোয় ধরে প্রার্থনা করত।
পুরোটা দিন মেয়েটার সাথে কাটালাম। আমরা একজন আরেকজনের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। রুমের এক কোনায় পাশাপাশি দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে সারাদিন গল্প করলাম। সেই মুহূর্তগুলোতে সিলিঙের ম্লান বাটা দেয়ালে আমাদের বড় ছায়া ফেলছিল।
রুমের একমাত্র শব্দটা ছিল নালা দিয়ে কুলকুল করে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ। হঠাৎ আমার মনে পড়ল নালা দিয়ে যাওয়া আসার কারনে আমার শরীরের বাজে গন্ধের কথা। তখন আমি একটু সরে বসলাম।
“কি হল সরে যাচ্ছ কেন?” সে হেসে বলল। “আমি নিজেও তো কতদিন গোসল করিনি। আমার নাক আর কাজ করছে না। এখানে পুরোটা সময় আমি ভেবেছি যে কখনো যদি বের হতে পারি তাহলে সবার আগে একটা ভাল মত শাওয়ার নিব। আবার পরিস্কার হওয়ার জন্য ছটফট করছি আমি।”
আমাদের কথার মাঝে মাঝে সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লাগছিল। “আজকে যদি তুমি মারা যাও, তাহলে কেন কাঁদছ না?” আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম। আমি নিশ্চিত আমার মুখে বিভ্রান্তিটা পরিস্কার ফুটে উঠেছিল।
সে এক মিনিট চিন্তা করে তারপর বলল, “কারন আমি ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছি।” ওকে দেখে মনে হচ্ছিল চার্চের সামনে রাখা কোন দেবীদের মূর্তির মত। একই সাথে দয়াশীল আবার একাকীও।
যাওয়ার সময় সে আমার হাত জড়িয়ে ধরল।
“খুব নরম,” সে বলল।
ছয়টা বাজার আগেই আমি রুমে ফিরে এলাম।
আপুকে যখন গলার নেকলেসের কাহিনী বললাম তখন ও শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর আবার নালার পানি লাল হতে শুরু করল। একটু আগে আমার সাথে বসে থাকা মেয়েটার চোখ আর চুল ভেসে যেতে দেখলাম।
নালা দিয়ে ওর আঙুল ভেসে যাচ্ছিল। আস্তে করে দু হাত দিয়ে সেটা পানি থেকে তুললাম। এটা সেই হাতের আঙুল যা আমি চলে আসার আগে আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল। আঙুলে সেই উষ্ণতার আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। জিনিসটা এখন স্রেফ এক টুকরো মাংস মাত্র।
আমার বুকের ভেতর নিদারুণ কষ্ট হতে লাগল। মাথার ভেতর সবকিছু যেন নালার পানির মত লাল বর্ণ ধারন করল। পুরো দুনিয়া লাল হয়ে, গরম হয়ে ফুটতে লাগল। ওই মুহূর্তে আর কোন কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না।
যখন খেয়াল হল তখন দেখলাম আমি আপুর বাহুর মধ্যে কাঁদছি। ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। নালার শক্ত পানিতে বারবার ভিজে আমার চুল সব শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
“আমি বাসায় যেতে চাই,” আপু বলল। ওর কণ্ঠটা কেমন মিষ্টি শোনাল, এই ধূসর কংক্রিটের জায়গাটার সাথে একদম খাপ খাচ্ছিল না।
আমি শুধু উত্তরে মাথা ঝাঁকালাম।
পঞ্চম দিন : বুধবার
কেউ খুন করে। কেউ খুন হয়। এই সাতটা রুমকে ঘিরে চলা নিয়মগুলো একদম শর্তহীন। সাধারনত যে খুন করে সেই একমাত্র নিয়মগুলো জানে। আমরা যারা খুন হব তাদের কিছু জানার কথা নয়।
কিন্তু এইবার একটু ব্যতিক্রম হল।
যে লোক আমাদেরকে এখানে ধরে এনেছে সে আমাকে আর আমার বোনকে একই রুমে রেখেছে। আমি যেহেতু এখনও একটা বাচ্চা ছেলে, আমাকে হয়ত সে একজন পুরো মানুষ হিসেবে গোনায় ধরেনি। হয়ত আপুকেও সে অর্ধেক মানুষ হিসেবে ভেবেছিল। হাজার হোক ও একজন টিনেজার। হয়ত খুনি ভেবেছে আপু আর আমি মিলে একজন পুরো মানুষের সমান হই-ভাই বোনের একটা সেট।
কিন্তু আমি যেহেতু ছোট মানুষ, আমার পক্ষে নালা দিয়ে অন্য রুমগুলোতে যাওয়া সহজ ছিল। আর সেভাবেই আমরা খুনির বানানো খেলার নিয়মগুলো একটু বদলে দিতে পেরেছি। খুনির কোন ধারণা নেই যে আমরা যারা খুন হতে যাচ্ছি তারা তার খুনের ছক আন্দাজ করে জেনে ফেলেছি।
অবশ্য কোন উপায় নেই যে ছক একদম উলটে ফেলা যাবে। এখানের মৃত্যুর নিয়মগুলো হয়ত দেবতাদের নিজেদেরই তৈরি করা, কে জানে।
কিন্তু আপু আর আমি একটা প্ল্যানের কথা ভাবছি যা দিয়ে হয়ত আমরা এখান থেকে জান নিয়ে বের হতে পারব।
***
আমাদের চতুর্থ দিন শেষ। পঞ্চম দিন, বুধবার শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় রুমের মানুষটা উধাও। তার জায়গায় নতুন একজন এসেছে।
সাত রুমের নিয়মগুলো এই প্যাটার্নে পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। আমরা জানি না এই পুনরাবৃত্তি কতদিন ধরে চলছে। কত মানুষের টুকরো টুকরো লাশ এই নালা দিয়ে ভেসে গিয়েছে।
আমি দেয়াল পার হয়ে গিয়ে সবার সাথে কথা বলতে পারি। স্বাভাবিকভাবে কেউই আনন্দে ছিল না। কিন্তু তারপরেও প্রতিবার আমি চলে আসার সময় তারা আমাকে আবার দেখতে চাইত। কেউই তাদের রুমে একা থাকতে চাইত না। কেউ চাইত না একাকী নিজের দুশ্চিন্তায় ডুবে যেতে বাধ্য হতে। সেভাবে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।
“কিন্তু তুই…তুই এক রুম থেকে আরেক রুমে যেতে পারিস। খুনি হয়তো কখনো তোকে ধরতে পারবে না,” আপু আমাকে বলল। আমি আবার নালার টানেলে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। “যে লোকটা আমাদের এখানে আটকে রেখেছে সে জানে না যে তুই এটা পারিস। কাল যদি এই রুমে আমি খুন হইও, তুই অন্য রুমে পালিয়ে যেতে পারবি। যতদিন তুই রুম থেকে রুমে পালিয়ে বেড়াতে পারবি ততদিন বেঁচে থাকবি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু এক সময় আমার শরীর বাড়বেই, তখন আর নালী দিয়ে যেতে পারব না। তাছাড়া খুনির নিশ্চয়ই মনে আছে যে এই রুমে সে দুজনকে বন্দি করে রেখেছিল। আমাকে যদি এখানে খুঁজে না পায় তাহলে সে অন্য জায়গায় আমাকে খুঁজবে।”
“তারপরেও,” আপু মরিয়া হয়ে বলল, “তুই আরো কিছুদিন তো বেঁচে থাকতে পারবি।” আমি ভাবলাম এই পরিস্থিতি আমাকে খুব কমই বাঁচার সুযোগ দেবে। কিন্তু আপু মনে করছে এটা আমার জন্য পালানোর একটা সুযোগ।
আমি নিশ্চিত ছিলাম, এখানে সুযোগ বলতে আসলে কিছু নেই। এখান থেকে জীবিত বের হওয়ার রাস্তা সব বন্ধ।
***
তিন নাম্বার রুমের মেয়েটা, যে কিনা একটু পর খুন হবে, আমার সাথে গল্প করছিল। ওর নামটা একটু অন্যরকম ছিল। প্রথম যখন সে তার নাম বলল আমি বুঝতে পারছিলাম না সেটার বানান কি হবে। ও পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করে বাল্বের ম্লান আলোতে আমাকে লিখে দেখিয়েছিল। নোটবুকের সাথে একটা ছোট পেন্সিল লাগানো ছিল। পেন্সিলটার লেজের দিকে দাঁত দিয়ে অসংখ্যবার কামড়ানোর চিহ্ন। শীষটাও ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিল শীষটা ক্ষয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা ঘষে ঘষে কাঠ উঠিয়ে বাকিটা বের করেছে।
“জানো, আমি শহরে থাকি বলে বাবা-মা সবসময় আমাকে খাবার পাঠাতেন। আমি একমাত্র সন্তান হওয়াতে তারা আমাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করতেন। কার্ডবোর্ডের বাক্স ভর্তি করে আমাকে আলু আর শসা পাঠাতেন। ডেলিভারিম্যান সেগুলো আমার কাছে নিয়ে আসত। আমি কাজে থাকতাম, বাসায় থাকতাম না বলে কখনো নিজে গিয়ে নিতে পারতাম না।”
তখনো সে এই ভেবে দুশ্চিন্তা করছিল যে ডেলিভারিম্যান ওর বাসার দরজার সামনে বাবা-মায়ের পাঠানো প্যাকেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিনা। ওর চোখ পড়ল নালার পোকামাকড় ভেসে যাওয়া পানির উপর।
“আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাড়ির কাছে ছোট একটা নদী ছিল। আমি সেখানে গিয়ে খেলতাম। নদীর পানি খুবই স্বচ্ছ ছিল। উপর থেকে তাকালে তুমি নিচের পাথরগুলো দেখতে পাবে।” ওর কথা শুনে আমার মনে হল আমি যেন নদীটাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। পুরো দৃশ্যটা স্বপ্নের মত। সূর্যের আলো এসে পানিতে পড়ছে। উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মাথার উপর বিশাল নীল আকাশ।
এই ছোট রুমগুলোতে আটকে থেকে আমি কেমন জানি একটু অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম। রুমগুলোর ধূসর কংক্রিটের দেয়াল আর নালা থেকে উঠে আসা পচা গন্ধ, আমি ভুলে যাচ্ছিলাম সাধারণ পৃথিবীর কথা যেখানে কিনা কিছুদিন আগেও বাস করতাম। বাইরের পৃথিবীর কথা চিন্তা করলে বিষণ্ণ লাগত, যেখানে বাতাস বইত আর বাতাসটাও কত্ত সতেজ ছিল।
আমি আবার আকাশ দেখতে চাই। জীবনে এত মরিয়াভাবে আর কিছু কখনো চাইনি। এখানে আসার আগে কখনো কেন মেঘ দেখার জন্য সময় ব্যয় করিনি?
মাত্র একদিন আগে আমি দুই নাম্বার রুমে মেয়েটার সাথে বসে একইরকম কথা বলছিলাম।
এই মেয়েটা তার প্রতি অন্যায়ের বিপক্ষে কোন কথা বলেনি, কোন অভিযোগ করেনি। সে শুধু বসে থেকে আমার সাথে কথা বলেছে। একদম স্বাভাবিকভাবে। যেন আমরা দুজন কোন এক বিকেলে পার্কের বেঞ্চে বসে গল্প করছিলাম। অল্প সময়ের জন্য হলেও মেয়েটা আমাকে এই নিষ্ঠুর ধূসর দেয়ালের ছোট রুমগুলোর কথা ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল।
আমরা দুজন একসাথে গানও গেয়েছিলাম। আমি এখনো বুঝতে পারছি না কেন আমার এই নতুন বন্ধুকে খুন হতে হবে। তারপর আমার মনে পড়ল আমি নিজেও তো খুন হতে যাচ্ছি এর পর।
আমার প্রশ্নগুলোর একটা যুক্তিযুক্ত উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালালাম। কিন্তু প্রতিবারই একই সমাপ্তিতে এসে পৌঁছলাম। আমি মরতে যাচ্ছি কারন যে লোক আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে সে আমাকে খুন করতে চায়।
নোটবুকটা আমার হাতে দিয়ে বলল মেয়েটা, “যদি তুমি এখান থেকে বের হতে পার, তাহলে এই নোটবুকটা আমার বাবা-মায়ের হাতে দেবে। প্লিজ।”
“কিন্তু…”
বের হতে পারলে? আমি কি কখনো সেটা আসলেই পারব? মাত্র আগেরদিনই দুই নাম্বার রুমের মেয়েটা আশা করছিল আমি এখান থেকে পালাতে পারব, আর ওর গলার চেইন আমার গলায় পড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের এরকম ভাবার আসলে কোন কারন নেই যে আমি এখান থেকে বের হতে পারব।
আমি মাত্র সেটা বলতে যাচ্ছিলাম এমন সময় টের পেলাম কেউ একজন দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
“ওহ না!” সে বলল, মখ শুকিয়ে গিয়েছে ওর।
ছয়টা বেজে গিয়েছে। আমার আরো আগে চলে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু সময়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মেয়েটার হাতে কোন ঘড়ি ছিল না, আর আমরা এত ভাল সময় কাটাচ্ছিলাম যে আমারও হুঁশ ছিল না।
“তাড়াতাড়ি পালাও এখান থেকে তাড়াতাড়ি!”
আমি লাফ দিয়ে উঠে নালায় ঝাঁপ দিলাম। সোতের বিপরীত দিকের চারকোনা গর্তটা কাছে হওয়ায় সেদিকে গেলাম। উল্টোদিকের গর্তটা দিয়ে আমাদের রুমে যেতে হবে। গর্তে ঢোকার সাথে সাথে ভারি লোহার দরজা খোলার শব্দ কানে এল। মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে হল মাথাটা যেন গরম হয়ে গেল।
যে লোকটা আমদের আটকে রেখেছে সে হাজির হয়েছে। আমি ইতিমধ্যে ধরে নিয়েছি লোকটার চেহারা একটা নিষিদ্ধ বিষয়। মরার আগে এই চেহারা কোনভাবে দেখা যাবে না। মৃত্যু দেবতার এরকম একটা ছবি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।
হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।
আমি টানেল দিয়ে ঢুকে দুই নাম্বার রুমে হাজির হলাম। যেমনটা ভেবেছিলাম, রুমটা খালি। আমি নালায় দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। আমাকে দেয়া নোটকটা মেঝের উপর রাখলাম।
এই মুহূর্তে যে লোকটা আমাদের রুমগুলোতে আটকে রেখেছে সে তিন নাম্বার রুমের মেয়েটাকে খুন করছে। হঠাৎ একটা চিন্তা আমাকে গ্রাস করল। আমার পুরো শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল। আমি যা চিন্তা করছিলাম তা অত্যন্ত বিপদজনক। কিন্তু আমাকে সেটা করতে হবে।
আমার বোন আর আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে। আমি মগজ চষে ফেলছিলাম কিভাবে সেটা করব। আবার আকাশ দেখতে চাইলে আমাকে এখনই কোন উপায় খুঁজে বের করতে হবে যাতে এখান থেকে বের হতে পারি।
আর সেটা করতে হলে আমাকে এই অন্ধকার ধাঁধার মধ্যে কিছু একটা দেখতে হবে, আর আপুকে জানাতে হবে কি দেখেছি। যে লোকটা আমাদের এখানে আটকে রেখেছে তাকে আমার দেখতে হবে। আমাকে জানতে হবে কিভাবে সে আমাদের খুন করতে যাচ্ছে। তার কাজ করার ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
তিন নাম্বার রুমে ফিরে যাওয়ার আগে প্রথমে নিজেকে শান্ত করলাম। ধরা পরে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে আমাকে চোখের পলক ফেলার আগেই হয়ত খুন করা হবে। আমার পরিকল্পনা হল নালার ভেতর বসে থেকে যতটুকু সম্ভব পর্যবেক্ষণ করা। এতটাই টেনশন হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরছিল। যদি লোকটা আমাকে দেখে ফেলে তাহলে হয়ত আমাকে খুন করার জন্য আর একটা দিন অপেক্ষা করতে যাবে না।
দুই নাম্বার রুমের দেয়ালের নিচে চারকোনা সরু গর্তটা দিয়ে তিন নাম্বার রুমে ঢুকতে হবে। আমি যেদিক থেকে মাত্র বের হলাম সেদিকে হাঁটু গেড়ে বসলাম। পানির স্রোত আমার পায়ের পেছন দিকে ধাক্কা দিলে চারকোনা গর্তটা আমাকে আস্তে করে নিজের দিকে টেনে নিল।
জোরে দম নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম, খেয়াল রাখলাম যেন কোন শব্দ হয়। পানির সোত হালকাই ছিল। যতক্ষণ আমি সতর্ক থাকছি ততক্ষন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। হাত-পা ব্যবহার করলে স্রোতের বিপরীতেও যেতে পারব। আগে বারবার যাওয়া আসার ফলে জানি। কংক্রিটের দেয়ালটা পিচ্ছিল, শ্যাওলা মাখা। আমাকে সাবধান হতে হবে।
চারকোনা টানেলের ভেতর পানির তল আর সিলিঙের মধ্যে খালি জায়গা খুবই কম। তিন নাম্বার রুমে কি হচ্ছে দেখতে চাইলে আমাকে। টানেল থেকে উঁকি দিয়ে পানির নিচ থেকে চোখ খুলে দেখতে হবে।
নোংরা পানি চোখে ঢুকবে এই চিন্তা মাথায় এলেও আমি চোখ খুললাম।
হাত আর পা দিয়ে রুমে ঢোকা থেকে নিজেকে থামালাম। পানি আমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। কিছু বুদবুদ ছাড়লেও হালকা আলো আমার চোখে পড়ল।
পানির স্রোতের ভেতর দিয়ে একটা মেশিনের শব্দ পাচ্ছিলাম।
পানি ঘোলাটে হওয়ায় ভাল মত দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে একজন লোকের নড়াচড়া চোখে পড়ছিল।
পোকামাকড়সহ এক গাদা পঁচা কিছু, আমার গালের পাশ দিয়ে ভেসে গেল।
ভাল করে দেখার জন্য আমি টানেলের আরেকটু কাছে গেলাম।
হাত ছুটে গেল। আঙুল পিছলে যাওয়ায় নালার দেয়ালের শ্যাওলায় খামচির মত দাগ পড়ল। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে আটকালাম। কপাল ভাল আমার শরীর থামল। তবে টানেল থেকে মাথা বেরিয়ে ঝুলছিল।
আমি তাকালাম।
যে মেয়েটার সাথে আমি একটু আগেও কথা বলছিলাম সে এখন এক দলা মাংস আর রক্তে পরিণত হয়েছে।
যে লোহার দরজা আমি এখন পর্যন্ত সবসময় বন্ধ দেখে এসেছি, সেটা হাঁ করে খোলা। দরজা ভেতরের দিকে খোলা থাকায় বাইরে লাগানো ছিটকিনি চোখে পড়ল। এই ছিটকিনি দিয়েই আমাদেরকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত।
আর দেখলাম…একজন লোক। লোকটা লাল একগাদা বস্তুর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল যেটাকে আর কোনভাবেই মৃতদেহ বলা যাবে না। সে আমার দিকে পেছন ফিরে ছিল। আমার দিকে মুখ করা থাকলে অবশ্যই এতক্ষণে আমাকে দেখে ফেলত।
আমি তার চেহারা দেখতে পারিনি কিন্তু লোকটার হাতে ধরা ইলেকট্রিক করাতটা ভয় ধরানোর মত শব্দ করছিল। আমি উপলদ্ধি করলাম এই শব্দটাই আমরা আমাদের রুম থেকে শুনতে পেতাম। লোকটা সোজা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, অনুভূতিবিহীন, সামনে রাখা বস্তুর দলার উপর নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। টুকরোগুলোকে আরো ছোট ছোট টুকরোতে পরিণত করছিল। মাংসের ছোট ছোট টুকরো বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়ছিল। পুরো রুমটা লাল রঙ ধারন করেছিল।
হঠাৎ করাতের শব্দ থেমে গেল। আমার আর লোকটার মধ্যে শুধুমাত্র পানির স্রোতের শব্দ ছাড়া আর কিছু ছিল না।
এমন সময় সে ঘুরতে শুরু করল।
আমি নখ দিয়ে টানেলের পেছন দেয়াল খামচে দ্রুত নিজেকে টানেলে ফিরিয়ে নিলাম। মনে হয় না লোকটা আমাকে দেখেছে, তবে আমি যদি আর এক মুহূর্ত দেরি করতাম তাহলে আমাদের মধ্যে চোখাচোখি হত।
তারপর দুই নাম্বার রুমে ফিরে গেলাম যেখানে কেউ ছিল না। যদিও নিজেকে আমার একদমই নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। নতুন কাউকে এখানে এনে রাখা হবে আর আমার জানার কোন সুযোগ নেই কখন দরজাটা খলবে। আমি নোটবকটা তুলে নিয়ে এক নাম্বার রুমের দিকে এগুলাম। তিন নাম্বার রুম পার হয়ে চার নাম্বারে, যেখানে আপু রয়েছে, সেখানে যাওয়ার আপাতত কোন উপায় নেই।
কংক্রিটের জেলখানায় বন্দি মহিলার পাশে গিয়ে বসলাম।
“তুমি কি দেখেছ?” সে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
আমার চেহারা দেখে নিশ্চয়ই কিছু বোঝা যাচ্ছিল। এই মেয়েটাকে গতকাল মাত্র এখানে আনা হয়েছে। বন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে নতুন। আমি তাকে এরই মধ্যে সাত রুমের নিয়ম জানিয়েছি। কিন্তু তারপরেও মাত্র কি দেখে এসেছি তা বলার মত অবস্থা আমার ছিল না।
আমি তিন নাম্বার রুমের মেয়েটার দেয়া নোটবকটা খুললাম। পানিতে ভিজে নোটবকটার পাতাগুলো একসাথে জোড়া লেগে গিয়েছিল। সেগুলো ছাড়াতে খানিকটা কষ্ট করতে হল। পাতায় ভাঁজ পড়লেও লেখাগুলো পড়া যাচ্ছিল।
ওর বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বিশাল একটা চিঠি লেখা ছিল। “আমাকে ক্ষমা করে দিও,” কথাটা বারবার লেখা ছিল।
ষষ্ঠ দিন : বৃহস্পতিবার
লোকটাকে দেখে আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে চার নাম্বার রুমে ফিরে যেতে পারছিলাম না। এক নাম্বার রুমে আমি সারারাত কাটালাম। মেয়েটা আমার সঙ্গ পেয়ে এতটা খুশি হয়েছিল যে ওর নাস্তার রুটির বেশিরভাগই আমাকে দিয়ে দিল। খেতে খেতে আমার মনে হল আপু নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করছে।
ধীরে ধীরে আমি আমাদের রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারলাম। আমি টানেলের মধ্যে দিয়ে দুই নাম্বার রুমে গেলাম। ওই রুমে একজন নতুন বন্দি এসেছে। বাকি সবার মতই সেও আমাকে নালা থেকে উঠতে দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগল।
তিন নাম্বার রুম খালি ছিল। রক্ত মাংস সব ধুয়ে পরিস্কার করে ফেলা হয়েছে। যে মানুষটা আগেরদিন আমার সাথে বসে গল্প করছিল তার উপস্থিতির সামান্য লক্ষণও পাওয়া যায় কিনা আমি সেখানে খুঁজলাম। কিন্তু কিছু ছিল না। স্রেফ একটা খালি কংক্রিটের রুম।
আমাদের রুমে ফিরতেই আপু আমাকে জড়িয়ে ধরল।
“আমি ভেবেছি সে তোকে ধরে ফেলেছে আর খুন করে ফেলেছে!”
তারপরেও ও পাউরুটিটা খায়নি, আমার আসার জন্য অপেক্ষা করছিল।
আজকে, বৃহস্পতিবার, আমাদের বন্দিত্বর ষষ্ঠ দিন। আজকে আমার বোন আর আমার খুন হওয়ার কথা।
আমি ওকে বললাম যে আমি এক নাম্বার রুমে ছিলাম আর ওই মেয়েটার খাবার ভাগ করে খেয়েছি। ওকে বললাম যে ও পুরো রুটিটা খেতে পারে, আমি যেহেতু খেয়ে এসেছি। কান্নাকাটি করার কারনে আপুর। চোখগুলো লাল হয়ে ছিল। ও আমাকে অনেক বকাঝকা করল।
আমি ওকে তিন নাম্বার রুমের মেয়েটার কথা বললাম। বললাম কিভাবে মেয়েটাকে খুন করা হয়েছে, কিভাবে আমি নালায় লুকিয়ে তা দেখেছি, অনেক চেষ্টা করেও খুনির চেহারা দেখতে পারিনি।
“কেন তুই এরকম বিপদজনক কিছু করতে গেলি?” ও ক্ষেপে উঠল আমার উপর। আমি ওকে দরজাটার কথা বললাম। শুনতে শুনতে ও ঠান্ডা হয়ে এল।
ও উঠে গিয়ে লোহার দরজাটার উপর হাত বুলাল। মুঠি দিয়ে কিল মেরেও দেখল। ধাতুর উপর ওর নরম হাতের বাড়ি প্রতিধ্বনি তুলে পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়ল।
“সত্যি?” ও অবশেষে বলল। “দরজার ওপাশে একটা ছিটকিনি আছে?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম। দরজার ভেতর ডান দিক থেকে ছিটকিনির কজার চিহ্ন আছে। দরজাটা রুমের মধ্যে পুরো ভোলা ছিল। টানেলের ভেতর থেকে আমি দরজার বাইরের অংশ পরিস্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। ছিটকিনিটা পুরাতন ধরনের, ভারি। আনুভূমিকভাবে লাগানো যায়। আমি আমাদের রুমের দরজাটার দিকে তাকালাম। ওটা দেয়ালের ঠিক মাঝখানে নয়, একটু বাম দিকে লাগানো।
আপুও ভয়ার্ত চোখে দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকল।
ওর হাতঘড়ি অনুযায়ী এখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। আর মাত্র ছয় ঘন্টা পর খুনি এসে আমাদের জবাই করবে।
আমি রুমের এক কোনায় বসে নোটবুকটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওই মেয়েটা ওর বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লিখেছিল। আমি আমার বাবা-মায়ের কথা ভাবতে লাগলাম। আমি নিশ্চিত তারা সবাই আমাদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। যেসব রাতে আমার ঘুম হয় না, আম্মু মাইক্রোওয়েভে গরম করে আমার জন্য দুধ নিয়ে আসত। আগেরদিন নোংরা পানিতে চোখ খুলে তাকানোর জন্য হয়ত, চোখগুলো অনেক জ্বলছিল। সহজেই অণু বেরিয়ে এল।
“আমি এভাবে সব শেষ হতে দিতে পারি না…কিছুতেই না!” আপু ফোঁপাচ্ছিল, ওর গলার স্বরে ক্রোধ টের পাচ্ছিলাম। ওর হাতগুলো ভীষণভাবে কাঁপছিল। ও যখন আমার দিকে ফিরল তখন ওর চেহারা যেন জ্বলছিল। ওর চোখের সাদা অংশগুলো থেকে যেন আলো ঠিকরে বের হচ্ছিল।
আগেরদিন দেখা অসহায় চোখগুলোর মত নয় ওগুলো। ওর চেহারায় মনে হচ্ছিল কোন ভয়ংকর, বিশাল কোন সিদ্ধান্ত লিখে রাখা হয়েছে।
আপু আবার আমাকে খুনি লোকটার শারীরিক গঠন আর ইলেকট্রিক করাত নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করল। আমি বুঝতে পারলাম, খনি যখন আমাদের জন্য আসবে তখন তার সাথে লড়াই করার চিন্তা করছে আপ।
খুনির ইলেকট্রিক করাতটা লম্বায় আমার অর্ধেক উচ্চতার হবে। আর ওটা যেভাবে শব্দ করছিল, মনে হচ্ছিল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। এরকম একটা অস্ত্রওয়ালা মানুষের বিরুদ্ধে আপু কিভাবে লড়াই করবে? কিন্তু আমাদের সামনে আর কোন উপায় তো নেই। আমরা যদি লড়াই না করি তাহলে সেফ মারা পড়ব।
আপু ওর ঘড়ি দেখল।
যখন সময় হবে, লোকটা ফিরে আসবে। ফিরে এসে আমাদের খুন করবে। আমরা এখন যেই দুনিয়ায় আছি তার নিয়ম এটা। এর ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই। মৃত্যু আমাদের নিশ্চিত।
আপু আমাকে বলল আরেকবার নালা দিয়ে গিয়ে সবার সাথে কথা বলতে।
সময় খুব বেশি বাকি নেই।
এই নালা দিয়ে কতজন মানুষের লাশ ভেসে গিয়েছে এখন পর্যন্ত? আমি নোংরা পানিতে নেমে সাঁতরে চারকোনা গর্ত দিয়ে অন্য রুমগুলোতে গেলাম।
আমি আর আপু ছাড়া আরো পাঁচজন মেয়েকে লোকটা বন্দি করে রেখেছে। ওদের মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের পরের তিন রুমের বন্দিরা নালা দিয়ে রক্ত মাংস ভেসে যেতে দেখেছে।
আমি ওদের রুমে গেলাম, ওদের সাথে কথা বললাম। ওরা সবাই জানে আজকে আমার আর আপুর শেষ দিন। তারা সবাই আমাদের জন্য কষ্ট পাচ্ছিল। একজন আমাকে বলল আমার উচিত অন্য রুমে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করা।
“এটা নাও,” পাঁচ নাম্বার রুমের মেয়েটা আমাকে ওর সাদা সোয়েটারটা দিল। এখানে গরম। আমার এটার কোন দরকার নেই।”
তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরল।
“তোমার আর তোমার বোনের ভাল হোক সেই প্রার্থনা করি,” সে। বলল। ওর গলা কাঁপছিল।
ছয়টা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই।
***
আপু আর আমি রুমের কোণায় বসেছিলাম। দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের কোনায়।
আমি একদম কোনায় বসেছিলাম। আপু বসেছিল আমার পাশে। দেয়ালের দিকে চেপে রেখেছিল। আমরা আমাদের পা ছড়িয়ে বসেছিলাম। ওর হাত আমার হাতে ঘষা খাচ্ছিল। আমি ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলাম।
“আমরা যদি এখান থেকে পালাতে পারি, প্রথম কাজ কি করতে চাস তুই?” আপু জানতে চাইল। “যদি আমরা এখান থেকে বের হতে পারি…” এই প্রশ্নটার অনেকগুলো উত্তর আমার কাছে।
“জানি না,” আমি বললাম, কিন্তু আসলে আমি আন্ধু-আম্মুকে দেখতে চাই। আমি বাইরের পরিস্কার বাতাসে গভীরভাবে নিশ্বাস নিতে চাই। চকলেট খেতে চাই। আমি করতে চাই এরকম জিনিসের সংখ্যা অসংখ্য। যদি আমার আশা পূরণ হয়, আমি হয়ত কেঁদে ফেলব। আমি যখন এসব আপুকে বললাম, সে এমন একটা চেহারা করল যার অর্থ হয়, “জানি তো।”
আমি মুহূর্তের জন্য ওর হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। আপু সিলিঙের ইলেকট্রিক বাটার দিকে তাকাল। আমিও তাকালাম ওটার দিকে।
এই রুমে বন্দি হওয়ার আগে পর্যন্ত আপু আর আমি নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি ছাড়া আর কিছুই করিনি। মাঝে মাঝে আমার এমনও মনে হয়েছে কেন আমার একটা বোন থাকতে হল। প্রতিদিন আমরা একজন আরেকজনকে যেভাবে পেরেছি অপমান করার চেষ্টা করেছি। আমাদের কারো কাছে চকলেট থাকলে আরেকজন সেটা চুরি করার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু এগুলো সবই এখন অতীত। ও এখন আমার পাশে আছে এই ব্যাপারটাই আমাকে অনেক সাহস দিচ্ছিল। ওর শরীরের উষ্ণতা প্রমাণ করে দিচ্ছিল যে এই দুনিয়ায় আমি একা নই।
অন্য রুমের মেয়েদের থেকে আপু অনেকটা আলাদা। আগে কখনো এভাবে চিন্তা করিনি, কিন্তু আপু আমাকে একদম বাচ্চাকাল থেকে চেনে। এই ব্যাপারটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
“আমার যখন জন্ম হল, তখন তুমি কি ভেবেছিলে?” আমি যখন প্রশ্নটা করলাম তখন ও আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাল। ও হয়ত ভাবছিল এই মুহূর্তের জন্য প্রশ্নটা খুবই অস্বাভাবিক ধরনের কিছু।
“এই জিনিসটা আবার কি? আমি এই কথাটা ভেবেছিলাম। প্রথমবার তোকে যখন দেখি তুই বিছানায় শুয়ে ছিলি। খুবই ছোট, কান্নাকাটি করছিলি। সত্যি বলছি আমার মনে হয়নি তোর সাথে আমার কোন মিল আছে।” আপু বলল।
তারপর আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। ব্যাপারটা এমন যেন আমাদের একে অপরকে বলার মত কিছু ছিল না। স্লান একটা ইলেকট্রিক বা কংক্রিটের একটা বাক্সের মধ্যে হালকা আলো ছড়াচ্ছিল, নালা দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছিল, আর আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার ভেতরে, অনেক গভীরে কোথাও যেন আমি আর আপু অনবরত কথা বলে যাচ্ছিলাম। মৃত্যু নামের বস্তুটা আমাদের উপর এসে নিশ্বাস ফেলছিল, কিন্তু আমাদের আত্মাগুলো একদম শান্ত হয়ে ছিল।
আমি ঘড়ি দেখলাম।
“তুই রেডি?” আপু জিজ্ঞেস করল। জোরে দম নিচ্ছে। আমি মাথা ঝাঁকালাম। টেনশন হচ্ছে। যে কোন সময় শুরু হবে। কান সতর্ক রাখলাম, পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ পাওয়া যায় কিনা শোনার জন্য।
এভাবে কয়েক মিনিট যাওয়ার পর মদু পায়ের শব্দ আমার কানে এল। আমি আপুর হাতে হাত রাখলাম। সময় হয়ে গিয়েছে।
আপু উঠে দাঁড়াল, আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
পায়ের শব্দ আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগল।
আপু আলতো করে আমার মাথায় হাত রাখল। নীরবে সংকেত দিল যে আলাদা হওয়ার সময় হয়েছে।
আপু আর আমি সিদ্ধান্তে এসেছি, আমরা যদি ইলেকট্রিক করাত ওয়ালা লোকটার সাথে লড়াই করি তাহলে শেষ পর্যন্ত জেতার কোন সম্ভাবনা আমাদের নেই। আমরা সেফ শিশু। আর লোকটা একজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ। ব্যাপারটা দুঃখজনক কিন্তু সত্য।
দরজার নিচের ফাঁকে একটা ছায়া দেখা গেল।
আমার বুক মনে হচ্ছিল যে কোন সময় ফেটে যাবে। শরীরের ভেতরের সবকিছু গলা দিয়ে উঠে আসতে চাইছিল। এখানে আটকা পড়া দিনগুলো সব একসাথে মনে পড়ল, সেই সাথে ফিরে এল খুন হওয়া মানুষগুলোর চেহারা আর কণ্ঠস্বর।
দরজা থেকে দূরে থাকার পরেও ছিটকিনি খোলার আওয়াজ কানে এল।
আপু পিছিয়ে রুমের সবচেয়ে দূরের কোনায় সরে গেল আর অপেক্ষা করতে লাগল। আমার দিকে তাকাল। মৃত্যু এসে হাজির হয়েছে।
ভারি লোহার দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। দরজার বাইরে একজন লোককে দেখা গেল। সে রুমের ভেতর ঢুকল।
লোকটার চেহারা আমি পরিস্কার দেখতে পেলাম না। আমার চোখে তাকে অস্পষ্ট দেখাল, অনেকটা ছায়ার মত। একটা বিশাল কালো ছায়া, মৃত্যুর প্রতিনিধি হয়ে এসেছে।
ইলেকট্রিক করাত চালু হওয়ার শব্দ হল। পুরো রুম মনে হল সেই ভীষণ শব্দে ভয়াবহভাবে কাঁপতে লাগল।
রুমের কোনায় আমার বোন তার হাতগুলো সামনে ছড়িয়ে দিল। আক্রমণকারীর থেকে মুখ লুকাবে না সে।
“তুমি আমার ভাইয়ের উপর একটা আঙুলও তুলবে না!” সে চিৎকার করল। কিন্তু ইলেকট্রিক করাতের ভীষণ শব্দের নিচে ওর চিৎকার প্রায় ঢাকা পড়ে গেল।
আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে চিৎকার করতে চাইছিলাম। মৃত্যুর সময় কি রকম ব্যথা অনুভব হতে পারে তা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। ঘুরন্ত ব্লেডটা যখন আমাকে দুটুকরো করে ফেলবে তখন আমার কিরকম লাগতে পারে?
লোকটা আপর পেছনে লুকিয়ে থাকা আমার পোশাক দেখতে পেল। সে করাতটা তুলে আমাদের দিকে এগিয়ে এল।
“খবরদার! সামনে এগুবে না!” আপু চিৎকার করল। হাতগুলো বাঁধা দেয়ার ভঙ্গি করে রেখেছে। ওর গলা এবারও করাতের শব্দে ঢাকা পড়ে গেল কিন্তু আমি জানি ও তাই বলছিল। কারন যাই হোক আপু এক পা বাড়াল কথাগুলো বলার জন্য।
লোকটা আরেক পা ওর দিকে এগিয়ে ওর বাঁধা দেয়া হাতের উপর করাতের দুরন্ত ব্লেড নামিয়ে আনল। এক মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে বৃষ্টির মত রক্ত ছিটকে উঠল।
আমি এসবের কোন কিছুই পরিস্কার দেখতে পাইনি। লোকটার আকার, আর আপুর হাত আলাদা হয়ে যাওয়ার পুরো দৃশ্যটাই আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল। কারন আমি ঘোলাটে পানির ভেতর থেকে দৃশ্যটা দেখছিলাম।
টানেলের লুকানো জায়গা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আমি ভোলা দরজার দিকে দৌড় দিলাম। বের হয়েই আমি সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ছিটকিনি টেনে দিলাম।
বন্ধ দরজাটা ইলেকট্রিক করাতের শব্দ কমিয়ে দিল। আমার বোন আর খুনিটা এখন রুমের ভেতর একা।
***
আপু যখন আমার মাথায় হাত রাখল, তখন বুঝলাম আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। আমি তাড়াতাড়ি স্রোতের বিপরীত দিকের টানেলে ঢুকে পড়লাম। ওইদিক থেকে দরজা কাছে ছিল।
এই জুয়া খেলাটা আপুর পরিকল্পনা ছিল। সে রুমের কোনায় আমার কাপড় চোপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এমন ভাব করবে যেন আমাকে পেছনে রেখে খুনির থেকে রক্ষা করতে চাইছে। সেই সুযোগে আমি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব। এই ছিল প্ল্যান।
আমরা আমার পোশাক সেভাবে সাজিয়েছিলাম। অন্য রুমের মেয়েদের কাছ থেকে কাপড় এনে সেটাকে ফুলিয়ে মানুষের রূপ দিয়েছিলাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম না টোপটা কাজ করবে কিনা, কিন্তু আপু বলেছিল কয়েক সেকেন্ড হলেও সময় পাওয়া যাবে। আপু ভান করবে যে আমাকে রক্ষা করছে। আসলে সে আমার কাপড়গুলোকে রক্ষা করছিল।
ও দাঁড়িয়ে ছিল দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের কোনায়। খুনি তার দিকে এগুলো এমনভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল যেন লোকটা আমাকে টানেল থেকে বের হতে না দেখতে পায়।
লোকটা যখন আপুর কাছে গিয়ে করাত দিয়ে হাতে আঘাত করল আমি সেই মুহূর্তে টানেল থেকে বের হয়ে খোলা দরজা দিয়ে..
দরজায় ছিটকিনি লাগানোর পর আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। আমি আমার বোনকে ফেলে রেখে এসেছি খুন হওয়ার জন্য। একা শুধু নিজে পালাতে পেরেছি। আমাকে পালানোর সুযোগটা দেয়ার জন্য আপু নিজে করাত থেকে পালানোর চেষ্টা করেনি। রুমের কোণায় দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করেছে।
দরজার ওপাশ থেকে করাতের শব্দ থেমে গেল।
কেউ একজন দরজায় কিল দিচ্ছিল। যেহেতু আপুর হাত নেই, আমি নিশ্চিত খুনি লোকটাই হবে।
অবশ্যই দরজা বন্ধ থাকল।
ভেতর থেকে আপুর হাসির শব্দ ভেসে এল। প্রাণ খোলা হাসি, যেন বিজয়ের আনন্দ ঘোষণা করছে। ও নিশ্চয়ই আনন্দিত জেনে যে তার ছোট প্ল্যানটা কাজ করেছে।
আমি জানি আপুকে লোকটা হয়ত টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ক্ষেপে গিয়ে হয়ত আরো নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নেবে। তারপরেও আপু খুনিকে বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দিয়ে আমাকে বাঁচার একটা সুযোগ করে দিতে পেরেছে।
ডানে বামে তাকালাম। কোন জানালা নেই, একটা লম্বা হলওয়ে দেখে নিশ্চিত হলাম, আমরা মটির নিচে কোন জায়গায় আছি। আমার সামনে সাতটা দরজা দাঁড়িয়ে আছে।
চার নাম্বার রুম ছাড়া বাকি সব রুমের দরজার ছিটকিনি খুলে দিলাম। জানতাম তিন নাম্বার রুমে কেউ নেই তারপরেও দরজাটা খুলে রাখলাম। অনেক মানুষ ওই রুমে খুন হয়েছে, সেজন্য মনে হল দরজাটা খুলে রাখা উচিত।
রুমগুলো থেকে বের হওয়া মেয়েরা আমার চেহারা দেখে কিছু বলল, শুধু নড করল। তাদের কেউই সত্যি সত্যি আনন্দিত নয়। আমি ওদেরকে আপুর প্ল্যান সম্পর্কে জানিয়েছিলাম। ওদের জানিয়েছিলাম যে আমি যখন পালাব আপু তখন রুমে একা আটকা পড়ে খুন হবে। আমরা সবাই এটা জানতাম।
পাঁচ নাম্বার রুমের মেয়েটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। তারপর আমরা সবাই একটা দরজার সামনে জড় হলাম।
ভেতর থেকে তখনো আপুর হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।
আবারো ইলেকট্রিক করাত চালুর শব্দ শুরু হল। আমরা বুঝতে পারছিলাম লোকটা ইলেকট্রিক করাত দিয়ে লোহার দরজাটা কাটার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা সবাই নিশ্চিত ছিলাম যে দরজাটা যথেষ্ট মজবুত, লোকটা কোনদিনও এই রুম থেকে বের হতে পারবে না।
মেয়েরা কেউ বলল না যে আমাদের উচিত দরজা খুলে আপুকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা। আপু আমাকে তার মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করে সবাইকে জানিয়েছে যে যদি আমরা রুম থেকে বের হতে পারি তাহলে আমাদের উচিত হবে দ্রুত এখান থেকে পালানো। নাহলে লোকটা আমাদের সবাইকে খুন করবে।
আর আমরা তাই করলাম। সবাই পালিয়ে এলাম। আপুকে মৃত্যু দেবতার সাথে চার নাম্বার রুমে একা ফেলে এলাম।
করিডর দিয়ে হলওয়ের শেষে গিয়ে উপরে যাওয়ার সিঁড়ি পাওয়া গেল। আমাদের স্বাধীনতা যেখানে আটকা পড়ে ছিল সেই বিষণ্ণ রুমগুলো থেকে আমরা অবশেষে মুক্তি পেলাম।
আমি আমার কান্না কোনভাবে আটকাতে পারছিলাম না। একটা ক্রুসসহ নেকলেস আমার গলায় ঝুলছিল। এক হাতে একটা নোটক ধরেছিলাম যেটায় এক মেয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছিল। আমার হাতে আপুর স্মৃতিঃ ওর ঘড়িটা। ঘড়িটা ওয়াটারপ্রুফ ছিল না। পানিতে যখন লুকিয়ে ছিলাম তখন ঘড়িটা নষ্ট হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায়।