সেবা – অনুবাদক: কমলা রায়

সেবা

দরতিয়ার মা দু’বার দরজা খুলে বলে গেছেন, ‘অত বেশি কথা বোলো না, উত্তেজিত হোয়ো না, জ্বর বাড়বে। সব সময়ই তুমি কথা বলছ… একা একাই খেলা করছ’…

ছোট্ট বিছানাটার উপর চারপাশে একগাদা বালিশ সাজিয়ে হেলান দিয়ে দরতিয়া বসে ছিল। সুন্দর সুন্দর অনেক পুতুল চারদিকে সাজানো— খেলার উত্তেজনায় তার হলদে রঙের চুলগুলো নীল সিল্কের টুপির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। চোখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে সে মা-র কথার জবাব দিল, ‘না, মা, আমি একা খেলছি না। নেনিও খেলছে।’

দরতিয়ার নার্সের ছোট্ট মেয়ে নেনি— সত্যি কথা বলতে কী নেনি কিন্তু এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি! দরতিয়ার মা যতবার দরজা খুলে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়েছেন ততবার ও ভয়ানক ভয় পেয়ে তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে। দরতিয়ার ঘরে যখন সে এসেছে, তারপর থেকে দু’ঘণ্টা নেনি যেন স্বপ্নলোকে ভেসে বেড়িয়েছে। প্রত্যেকবার দরজার হাতলের শব্দ, দরজা খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ, দরতিয়ার মা আর তাঁর কণ্ঠস্বর ওকে সেই স্বপ্নলোক থেকে ধাক্কা দিয়ে— আবার মাটির পৃথিবীতে ফেলে দিয়েছে। এতটা সময় সত্যি-সত্যিই যেন পরির রাজ্যে ছিল। শুধু একটি মাত্র ভয় বারবার জেগেছে তার মনে হয়তো যা সে দেখছে, যা কিছু সে হাত দিয়ে ছুঁতে পারছে— এ কিছুই সত্যি নয়।

পরনে সবুজ রঙের একটা ফ্রক— বছর দুয়েক ধরে সে এই একটা ফ্রকই পরছে। এত ছোট হয়ে গিয়েছে সে ফ্রক— যে গলার কাছে, হাতের তলায়, ঘাড়ের কাছে বেশ টান পড়ে; রীতিমতো কষ্ট হয়। মাথায় সিল্কের পুরনো রং-উঠে-যাওয়া রিবন— একরাশ ঘন কালো চুলের চাপে ক্রমশ খুলে যাচ্ছে। চুলগুলো তখনও ভিজে— দরতিয়ার বাড়ি আসতে হবে, সেইজন্য সে আসার আগে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আগাগোড়া ঘষে মেজে পরিষ্কার হয়ে এসেছে। নার্সারিতে প্রথম ঢুকে, গদি আঁটা দেয়াল, নীল রঙের সিল্কের পরদা আর অন্যান্য সব দামি দামি জিনিস দেখে নেনি এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে প্রথম প্রথম সে কিছু ভাল করে দেখতে বা শুনতেই পাচ্ছিল না। শরীরে মাংসের সঙ্গে যেমন চামড়া— নেনির খাটো-হাতা-জামাটা হাতের সঙ্গে ঠিক সেইরকম এঁটে আছে— ফলে হাতটা তার প্রায় ফুলে উঠেছিল। ঘরে ঢোকার একটু পরে খুব আস্তে আস্তে, কী যে করছে তা না জেনেই, নেনি তার হাতটা দরতিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর বিছানার এক পাশে বসে নরম চাদরটার উপর হাত বুলোতে বুলোতে হাঁ করে একমনে দরতিয়ার বকবকানি শুনতে লাগল।

দরতিয়া বেশ বুঝতে পারছিল যে এতক্ষণ কোনও কথা না বললেও নেনিই সত্যি সত্যি খেলছে। নেনি চুপ করে গোল করে সাজানো পুতুলগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে— তার এই একাগ্রতায় মনে হচ্ছে যেন পুতুলগুলোর সত্যি সত্যি প্রাণ আছে, তারা যেন বসেছে একসঙ্গে চা খেতে। নেনির অবস্থা দেখে পুতুলগুলোকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে কথা বলিয়ে দরতিয়াও আনন্দ পাচ্ছিল। এতদিন দরতিয়ার মনে হত যে তার পুতুলগুলো শুধু পুতুলই— প্রাণ ওদের নেই— শুধু কয়েকটা কাঠের টুকরোর উপর মোমের কি কাচের তৈরি মাথা, কাচের চোখ, পাটের চুল— শুধু পুতুল। আজ মনে হচ্ছে আর ওরা পুতুল নয়, ওদের প্রাণ আছে। আজ এমনভাবে ওরা প্রাণ পেয়েছে যে, তা যে কখনও সম্ভব হতে পারে এ কথা দরতিয়া কোনওদিন ভাবতেও পারেনি। বাড়ির একটা দাসীর ছোট্ট মেয়ের অবাক হওয়া প্রশংসা করার ফলে পুতুলগুলো যে সত্যিকার মানুষ হয়ে যেতে পারে এই দেখে ভারী অবাক লাগছিল দরতিয়ার। নেনিকে আরও অবাক করে দেবার জন্যে সে বড় বড় ভদ্রমহিলার মতো কথা কয়ে যাচ্ছিল— তার মায়ের বন্ধুরা যেমন কতরকম কেতাদুরস্ত কথা বলেন, সেইরকম কথা, ভাবখানা এই যেন পুতুলরাই কথা বলছে।

‘ওই পুতুলটা দেখছ নেনি? ওঁর নাম কাউন্টেস লুলু। উনি নিজেই নিজের মোটরগাড়ি হাঁকান, সোনা বসানো সিগারেট খান আর এইরকম করে আঙুল তুলে সবসময় বলেন, ‘মরিংগি! তুমি যদি আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাও, মরিংগি, তা হলে আমিও সব ছেড়ে-ছুড়ে পালিয়ে তোমার কাছে চলে যাব।’

মরিংগি যে কে নেনি তা জানে না। হয়তো কোনও জাদুকর, কিংবা দরতিয়ার মা-র কোনও বন্ধু, কিংবা হয়তো তাঁর সব মহিলাবন্ধুরই সে বন্ধু। দরতিয়া ওকে বলে দিয়েছে, মিসট্রেস বেটি নামে যে পুতুলটি, তার সঙ্গে মরিংগির বড় ভাব। তাই যতবার কাউন্টেস লুলুর কথা ও শুনছে ততবারই নেনির মনে হচ্ছে— মরিংগি বোধহয় কোনও জাদুকর।

‘All right thank you, আচ্ছা ধন্যবাদ।’

‘না, না, অমন করে হেসো না নেনি। মিস্ট্রেস বেটি সবসময় ইংরিজিতে কথা বলেন— আমার মা-র কাছে, সব্-বা-ইয়ের কাছে। সব সময় ঘোড়ায় চড়ে খটখট করে ঘুরে বেড়ান। ওঁর একটা খারাপ অভ্যেস আছে জানো নেনি— পুরুষ মানুষদের মতো এমনি পা ফাঁক করে উনি ঘোড়ায় চড়েন— এত বিশ্রী দেখায়! ঘোড়া থেকে পড়েনও তেমনি। একবার কী হয়েছিল জানো, কতগুলো নেকড়ে বাঘের পিছনে তাড়া করে যেতে যেতে পড়ে গিয়ে ওঁর গালে যা লেগেছিল! দেখো, এখনও দাগ রয়েছে! দেখতে পাচ্ছ? বেশ হয়েছিল উনি একদম ভাল না, জাতে আমেরিকান কিনা! পড়ে গিয়ে ওঁর বুকে, পিঠে, এমনকী পায়ে কোথায় কী চোট লেগেছে সেগুলো পর্যন্ত সবাইকে দেখিয়ে বেড়ান— লজ্জা নেই! যদি উনি তোমার হ্যান্ড-শেক করতে আসেন তা হলেই গেছ আর কী এমন লাগবে। All right, thank you, আচ্ছা ধন্যবাদ…

‘আর ওই পুতুলটার কথা বলছ? উনি ভারী মজার— হাসিয়ে হাসিয়ে একেবারে মেরে ফেলেন! ওঁর নাম হচ্ছে ডনা মারিয়ু। ওঁর কথা বলা শোনোনি তো!’ গলার স্বর বিকৃত করার চেষ্টা করে দরতিয়া বলে যেতে লাগল, ‘ওঃ, বাবারে বাবা! মাথাটা আমার গেল! মরিংগি ভুলে যেয়ো না, আমার হার্ট ভারী দুর্বল। একটু গম্ভীর হয়ে কথাবার্তা বলো। আমার শরীর নিশ্চয় খারাপ হবে… মরিংগি সত্যি সত্যি আর হাসতে পারছি না। মাথাটা প্রায় ফেটে যাবার জোগাড় হয়েছে। আর হার্টও যেরকম দুর্বল… দোহাই তোমার মরিংগি।— আর-একটা মজার কথা জানো নেনি, ডনা মারিয়ু ভাল করে সব কথা উচ্চারণ করতেও পারেন না। মরিংগি যেমন করে কথা বলে উনিও তেমনি ভাবে কথা বলার চেষ্টা করেন। ওঃ, ওকে দেখলেই এত হাসি পায়—’

এ সব কথা শুনে নেনির মাথা সত্যি সত্যিই ঘুরতে থাকে।

সে অবাক হয়ে ভাবে! একটা পুতুল সিগারেট খায়, আর-একটা পুতুল ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যায়— এ সব সত্যি নাকি? কিন্তু ওই পুতুলটার গালে সেই পড়ে যাওয়ার দাগটা তো ঠিক আছে। নেনি ভাবে, পুতুলগুলো যদি লেস-এর পাড় দেওয়া জামা পরতে পারে, মাথায় বো-বাঁধা রিবন বসাতে পারে, সিল্কের মোজা, মখমলের গার্টার, সোনার বোতাম লাগানো পেটেন্ট চামড়ার জুতো পরতে পারে, তা হলে হয়তো সত্যিই তারা ঘোড়ায়ও চড়ে, সিগারেটও খায়, আর ওই যে ইংরিজি না কী, যে কথা নেনি একদম বুঝতে পারে না, সেই ভাষায় কথাও কইতে পারে। এমন সুন্দর এই ঘরটি— যেন যে-কোনও অবাক কাণ্ড সত্যি হয়ে উঠতে পারে! নেনি প্রায় আশা করে আছে— ওই যে ছোট্ট ছোট্ট ঘোড়াগুলো— ওগুলো যেন যে-কোনও মুহূর্তে জ্যান্ত হয়ে উঠে ঘরজোড়া মখমলের মতো কার্পেটের উপর দৌড়ে দৌড়ে বেড়াবে, পুতুলগুলো তাদের পিঠে— তাদের পাতলা সুন্দর ঘোমটাগুলো উড়তে থাকবে বাতাসে। নিজের স্বপ্নে নেনি এত বিভোর যে দরতিয়ার কথাগুলো তার কানেই ঢুকছিল না বা ঢুকলেও কোনও মানে ঠিক বুঝতে পারছিল না। খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে দরতিয়া ঠিক করেছে নেনিকে একটা পুতুল একেবারে দিয়ে দেবে। সমস্যা এখন— কোনটি দেবে, আর তাই নিয়ে সে রীতিমতো চিন্তায় মগ্ন।

দরতিয়া বলছে, ‘ওইটা? উঁহু, ওটা দেব না তোমায়। একটা হাত নিয়ে বেচারা বড্ড ভুগছে— আমার কাছটিতে শুয়ে থাকা ওর ভারী দরকার। দেখো নেনি, আমি তোমাকে… আমি তোমাকে মিসট্রেস বেটিকেই দিয়ে দিলাম।… না, না, না, ওকেও তো দেওয়া চলবে না। ও নিশ্চয় তোমার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে… মিসট্রেস বেটির মতো এত দুষ্টু পুতুল আর হয় না… কড়া কড়া কথা বলে, আর তাও বলে ইংরিজিতে, তুমি তার একটি বর্ণও বুঝবে না। আচ্ছা তুমি এইটে নাও। এঁর নাম মিমি, তুমি কিন্তু ওঁকে সব সময় ‘মিলেডি’ বলে ডাকবে; উনি মার্শনেস কিনা। মার্শনেস কী তা বোঝো তো? ওঁর নাম মার্শনেস মিমি। ইনি কিন্তু বড্ড— বড্— ডো খুঁতখুঁতে মানুষ। রোজ সকালবেলা ঠিক সময়ে এঁর স্নানের ব্যবস্থা থাকা চাই, ব্রেকফাস্টের সময় চকোলেট চাইই, আর বিস্কুট… আর… আর তা ছাড়া… বুঝলে আর তা ছাড়া একবারে অনেকখানি খেতে পারেন না— মা যেরকম ছোট ছোট রুপোর পাতে মোড়া মিষ্টি কিনে আনে, সেইরকম মিষ্টি ছাড়া আর কিচ্ছুই খান না। মিষ্টিগুলো কোথায় পাওয়া যায় জানো তো? ওই যে গ্র্যান্ড হোটেলের উলটো ফুটপাতে যে বড় দোকানটা আছে, ওইখানে পাওয়া যায়। হ্যাঁ, মিমিকেই তোমায় দিয়ে দিলাম। এই নাও— ধরো। বুঝতে পারছ না— তোমাকে একেবারে দিয়ে দিচ্ছি। তুমি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারো… আচ্ছা দাঁড়াও, আহা চলে যাচ্ছে, আমি একবার আদর করে দিই।… নাও, এইবার তোমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো।’

নেনি যে কী করবে তা ভেবেই পেল না। এত অবাক হয়ে গিয়েছে সে যে পুতুল পাওয়ার আনন্দটুকু উপভোগ করার শক্তিটুকুও তার হারিয়ে গেছে… কেবলই মনে হচ্ছে পুতুলটা নেওয়া বোধহয় ওর উচিত হবে না। চলে যাবার জন্যে নেনি উঠে দাঁড়াল কিন্তু দরতিয়াও ছাড়বার মেয়ে নয়। সে পুতুলটাকে তার হাতের ভিতর গুঁজে দিল। নেনির চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায়— পুতুলটাকে যে হাত বাড়িয়ে নেবে সে ক্ষমতাও ওর নেই।

এইসময় ঘরে ঢুকলেন দরতিয়ার মা— পিছনে পিছনে ঢুকল নেনির মা। দরতিয়া যখন খুব ছোট তখন তাকে দুধ দেবার জন্যে নেনির মা এ বাড়িতে চাকরি নিয়ে এসেছিল, এখন দরতিয়া বেশ বড় হয়ে গেছে, তবু এখানেই সে রয়ে গেছে। দরতিয়ার মা-র পাশে ওর নিজের মা দাঁড়িয়ে— নেনি একবার মুখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে। ওর মনে হল, ওই সুন্দর পোশাকে, মাথায় নার্সদের টুপি আর গায়ে পরে সাদা এমব্রয়ডারি করা এপ্রন— এই আশ্চর্য বাড়িটার মতো ওর মাও যেন কোনও পরির দেশের লোক হয়ে গেছে। মা যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে নেই, দূর নীল আকাশের তারার মতো তার দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে। কী বলছে তার মা? দরতিয়াকে বারণ করছে নেনিকে পুতুলটা দিতে। বলছে এত সুন্দর পোশাক পরা, এমন ভাল জুতো, গ্লাভস আর টুপি পরা পুতুলটা নেনিকে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। আর নেনি পুতুলটা নিয়ে করবেই বা কী! বাড়িতে অনেক কাজ করতে হয় নেনিকে। ওর বাবার সব কাজ ও-ই করে। খেলাধুলোর সময় পর্যন্ত নেই বেচারার। রাত্তিরে ফিরে এসে যদি ওর বাবা দেখে সব ঠিকঠাক গোছানো নেই— তা হলে বড়ই মুশকিলে পড়তে হয় ওকে।

বাবা? কোথায় তার বাবা? এই মুহূর্তে নেনির মনে হল তার বাবা যেন অন্য এক জগতের মানুষ। বাবার কথা মনে করতেই ওর কেমন ভয় হয়, ঘেন্না হয়। মাতাল হয়ে ফেরে রোজ রাত্রে, এসে বকবক করে, শুধু শুধু ওকে মারে, কী ভীষণ জোরে যে ওর চুল ধরে টান লাগায়! হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে ওকে মারে আর চেঁচায়, ‘তার বদলে তুই মরলি না কেন?’…

ওর ছোট ভাইটি মারা গেছে— তার বদলে নেনি কেন মরেনি তাই নিয়ে বাবা ওকে রোজ খোঁটা দেয়। তার মা যখন দরতিয়াকে দুধ দেবার চাকরি নিল তখন নেনিই দেখত তার ছোট্ট ভাইটিকে। পাড়ার একটি মেয়ে মাসে কয়েকটা লিরার বদলে নেনির ভাইটিকে দুধ দিতে রাজি হয়েছিল। একদিন যখন ও ভাইটিকে কোলে করে বসে ছিল তখন ভাইটি মারা যায়। ও বুঝতেই পারেনি যে সে মরে গেছে— ঠান্ডা, ফ্যাকাসে, মরা দেহটাকেই কোলে করে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়িয়েছিল। সেই থেকে তার বাবা এইরকম উচ্ছৃঙ্খল, অমানুষ হয়ে গেছে— তার উৎপাতে নেনির মা আজকাল ওদের কাছে থাকেই না, এই বড় বাড়িতে দরতিয়াদের কাছে থাকে। নেনির বাবা বলে ওর মা নাকি এখন ‘বড়মানুষের বউ’ হয়েছে। সত্যি সত্যি ওর মাকে এখন দেখাচ্ছেও সেইরকম। তার হাসি, কথাবার্তার ভঙ্গি, চেহারা, চালচলন সব দরতিয়ার মা-র মতো সুন্দর— নেনির এখন আর মাকে নিজের মা বলে মনেই হচ্ছে না।

নেনি শুনল মা বলছে, ‘না না, মিস দরতিয়া তা হবে না। অত সুন্দর পুতুলটা নেনির মতো মেয়েকে আপনি কিছুতেই দিতে পারবেন না।’

দরতিয়ার মা কথায় কান দিলেন না। পুতুলটাকে মানে, মার্শনেস মিমিকে নেনির বুকের উপর রেখে ওর হাত দুটো একত্র করে দিলেন। নেনির মা বলে উঠল, ‘ছি, ছি, সামান্য ভদ্রতাও ভুলে গেছ, দুষ্টু মেয়ে। ধন্যবাদ দিতে হয় তা জানো না। উপহার পেলে কী বলতে হয় মনে নেই?’

সত্যিই সব ভুলে গেছে নেনি। কোনও কথাই তার মুখ দিয়ে বেরল না। বুকের কাছে মার্শনেসকে সে আঁকড়ে ধরে আছে— তার দিকে একবার সাহস করে তাকাতেও পারল না নেনি।

দরতিয়ার ঘর থেকে ও যখন বেরল তখন ওর ঘোর কাটেনি। ফ্যালফ্যাল করে সামনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, মা চুলগুলো ঠিক করে দেবার চেষ্টা করলেও লাল রিবনের ফাঁক দিয়ে সেগুলো আছে উঁচু হয়ে। কোনও দিকে কিছু না দেখে, কোনও শব্দ না শুনে নেনি সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে এল। ছোট্ট ভাঙা ওদের বাড়ি যেখানে বাপের সঙ্গে ও দিন কাটায়, সেখানে ফিরে এসে তবে যেন কিছুটা জ্ঞান ও ফিরে পেল। ওর মনে হল, যেন ওর নিজের আর এতটুকুও জীবনীশক্তি নেই— সমস্তটা যেন ওই সুন্দর পুতুলের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। পুতুলটা তখনও নেনি বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে আছে আর ভাবছে মার্শনেসের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে ওর নিজের কোনও ধারণাই নেই— অসুস্থ দরতিয়ার অনর্গল বকবকানির মধ্যে সেই জীবনের খানিকটা উজ্জ্বল ছবি ও শুধু দেখতে পেয়েছে। পুতুলটা যেসব কথা বলে মিস দরতিয়া বলছিল, সেসব কথা যদি ওর কাছেও পুতুলটা বলে তা হলে ও বুঝবে কী করে, এই ভেবেই নেনি দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। কী যেন কথাগুলো? ‘মরিংগি, মরিংগি, তুমি যদি আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাও, তা হলে আমিও সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে তোমার কাছে চলে যাব।’

এখন, এই ভাঙা বাড়িতে মার্শনেসের সঙ্গে দেখা করতে মরিংগি নিশ্চয় আসবে না— ওর মহিলাবন্ধুদের কথা ছেড়েই দাও। তারা সোনা বসানো সিগারেট আর রুপো বসানো গন্ধওলা মিষ্টি খায়। আর সত্যিকারের ঘোড়ায় চড়ে— জ্যান্ত ঘোড়া, ছোট্ট ছোট্ট ঘোড়া।

পুতুলটাকে নিয়ে ও যে খেলা করতে পারে এ কথা বেচারার কিন্তু একবারও মনে হল না। তার মনে হল— মার্শনেসের একজন দাসীর দরকার, সে সেই দাসী হতে পারে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় তা তো সে জানে না, কীরকম ভাবে দিন কাটানো তাঁর অভ্যাস সে সম্বন্ধেও তার কোনও ধারণা নেই। নেনি বেচারা মহাবিপদেই পড়ল। নিজের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে নেনির আর লজ্জার সীমা রইল না— নিজের জন্যে তার লজ্জা নয়, তার লজ্জা যে ছোট্ট মহিলাটিকে সে কোলে করে তার ঘরে নিয়ে এসেছে তাঁর জন্যে। এখানে তার সেই ছেঁড়া বিছানা, ভাঙা বেতের চেয়ার, আর স্কুলের পড়া করার সময় যে টুলটাকে টেবিল করে ও পড়াশুনো করত সেই টুলটা— এখানে কোথায় সে মার্শনেসকে রাখবে? এখনও পর্যন্ত পুতুলটার দিকে একবার তাকাতে সে সাহস করেনি। মার্শনেসের চোখদুটো কাচের— কী একটা বিশ্রী পচা জায়গায় তিনি যে এসে পড়েছেন তা তিনি নিশ্চয় দেখতে পারছেন না, কিন্তু অত সুন্দর ঘর থেকে এসে মার্শনেসের চোখ দিয়েই নেনি তার ঘরটিকে দেখছিল আর ভাবছিল, এখানে ও তাঁকে রাখবে কোথায়? অবশ্যি যতক্ষণ সে পুতুলটার দিকে চেয়ে দেখেনি, বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ততক্ষণ মার্শনেস মিমি কিছুই দেখতে পাননি বটে, কিন্তু যখন সে মনস্থির করে তাঁর দিকে তাকাবে তখন তো তিনি চারপাশের সব কিছু দেখতে পাবেন। নেনি ঠিক করল, প্রথম নজরে তাঁর যাতে খুব খারাপ ধারণা না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।

মনে পড়ল বিছানার তলায় তার ছোট্ট বাক্সটার মধ্যে মিস দরতিয়ার পুরনো নীল রঙের একটা ঘাগরা আছে। দরতিয়ার মা নেনির জন্যে ওটা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক বার কেচে কেচে ওটার রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, ছিঁড়েও গেছে কয়েক জায়গায়, তবু ওই বড় বাড়ি থেকেই তো ওটা এসেছে, একদিন মিস দরতিয়াই তো ওটা পরত— হয়তো মার্শনেস চিনতে পারবে।

পুতুলটাকে না নামিয়ে, একবারও তার দিকে না তাকিয়ে, নেনি নিচু হয়ে বাক্স থেকে ঘাগরাটি বার করল— তারপর সেটাকে টুলের উপর টেবিল ক্লথ করে পাতল— ছেঁড়াগুলো, অন্তত যেসব জায়গায় বেশি ছেঁড়া সেগুলো যাতে মার্শনেসের নজরে না পড়ে এমন ভাবে সেটাকে পাতল সে। এবারে সে তবু একটু আশ্বস্ত হল— পুরনো হলেও ঘাগরাটা বেশ পরিষ্কার আছে আর কাপড়টাও খুব ভাল— এটার উপর অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে পুতুলটাকে ও বসাতে পারবে।

আস্তে আস্তে পুতুলটাকে টুলের উপর বসাতে গিয়ে পাছে লাগে বা কাপড় চোপড় নোংরা হয়ে যায় এই ভয়ে ওর হাত কাঁপতে লাগল। এতক্ষণে ও পুতুলটার দিকে সাহস করে তাকাতে পারল। ওটার প্রশংসায় আর ওর জন্যে দুঃখে সে কাতর হয়ে পড়ল— মুখে এল ব্যথাতুর অনিশ্চয়তার ছায়া। আস্তে আস্তে হাঁটু ভেঙে বসে পুতুলটার চোখের দিকে ও তাকাল— মিস দরতিয়া তাঁর ঘরে বসে একে যে সুন্দর জীবন দিয়েছিলেন, তার ঘরে এনে সেই জীবনের প্রায় কোনও চিহ্নই ও দেখতে পেল না। নেনির মনে হল তার সামনে বসে পুতুলটা আগের মতো তার হারানো জীবন ফিরে পাবার আশা করছে— তার সুখের জীবন, মস্ত বড় একজন মহিলার জীবন। কিন্তু এখানে কী করে তা সম্ভব হবে? কতটুকুই বা তার ক্ষমতা। তাদের বাড়িতে যে কিছুই নেই। মিস দরতিয়া বলেছিলেন যে, দিনের মধ্যে অনেকবার পোশাক বদলানো তাঁর পুতুলদের অভ্যাস। মার্শনেস মিমিরই তো কত সুন্দর সুন্দর পোশাক ছিল— একটা লাল, একটা হলদে, একটা সবুজ রঙের, একটার উপর ছোট ছোট ফুলের ছাপ দেওয়া, আর একটার সঙ্গে আবার জাপানি ছাতাও ছিল। এখন এটা কী করেই বা আশা করা যায় যে সেই একই পোশাকে, একই জুতো পায়ে, একই টুপি, একই ব্রেসলেট, গলায় একই হার পরে মার্শনেস দিন কাটাবেন? গলার হারটার সঙ্গে সত্যিকার পালকের তৈরি ছোট্ট একটা পাখা ঝুলছে; মুখের সামনে নাড়লে ওইটুকু পাখা দিয়েও যে হাওয়া হয় তা বোঝা যায়— ছোট হলেও মার্শনেসের পক্ষে তা যথেষ্ট…

মিস দরতিয়ার বাড়িতে দরকারি সব জিনিসই ছিল, ছোট্ট সুন্দর বিছানা, নানারকম কাপড়চোপড় ভরা বাক্স— সেখানে যদি ওরা থাকত তা হলে খুশিমনে নেনি মার্শনেসের দাসীবৃত্তি করতে পারত। এখানে, এখানে সে কী করবে? পুতুলটা দেবার সময় মার্শনেসের বিছানা আর অন্তত কয়েকটা জামাকাপড় দিয়ে দেওয়ার কথা মিস দরতিয়ার তো মনে হওয়া উচিত ছিল। নেনি যে বেশি দামি কোনও উপহার চাইছে তা তো নয়; তবে যাতে পুতুলটা কষ্ট না পায়, নিজেও যাতে সে মার্শনেসের উপযোগী সেবা যত্ন করতে পারে, সেদিকেও তো মিস দরতিয়ার নজর দেওয়া উচিত ছিল। তার নিজের কিছুই নেই— পুতুলের প্রয়োজন সে মেটাবে কী করে? ও শুধু মার্শনেসের পেটেন্ট চামড়ার জুতোর উপর নিশ্বাস ফেলে ফেলে তারপর আঙুল বা রুমালের এক কোণ দিয়ে সাফ করে দিতে পারে, তা ছাড়া আর কী সে পারে? নেনি ঠিক করল, কালই সে পুতুলটাকে নিয়ে গিয়ে মিস দরতিয়াকে বলবে, ‘দেখুন, হয় যেমন ভাবে ওর থাকার অভ্যাস সেইরকম ভাবে থাকার জন্যে যা যা দরকার তা আমাকে দিন, আর তা না হয় আপনার পুতুল আপনার কাছেই রাখুন।’

কে জানে? হয়তো মিস দরতিয়া পুতুলটার যা যা দরকার সবই তাকে দিয়ে দেবেন। নেনি টুলটার সামনে বসে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলল। নিজের ঘরের চারদিকে একবার সে তাকাল— হঠাৎ মনে হল মার্শনেস মিমির সেই ছোট্ট ঘরটি যেন তার ভাঙা ঘরের এক কোণে এসে পড়েছে। ঘরটি বেশ বড়ই লাগছে নেনির— মেঝের উপর নরম নীল কার্পেট, কাঠের খাটটা সাদা রং করা, ধবধবে পরিষ্কার বিছানা, শুধু মশারিটি নীল সিল্কের, খাটের ওদিকে আয়না বসানো দেরাজ, সোনালি রঙের চেয়ার, দেয়ালে আর্শি… নেনি যেন নিজেকে দেখতে পেল, তার মা-র মতো সুন্দর পোশাক পরে একমনে তার খামখেয়ালি ছোট্ট মনিবটির সেবা করছে। বকুনি যাতে না খেতে হয় তার জন্যে আগেভাগে ও সব কাজ করে রাখছে। সবরকম সুবিধে তার কাছে থাকলেও, সবরকম বিলাসের জিনিস থাকলেও, বন্ধুবান্ধব তো আর থাকবে না আর তার জন্যে হবে মন খারাপ— তাই আগেভাগে সব কাজ সেরে রাখাই ভাল। মুশকিল হচ্ছে এই যে তাঁর মহিলা বন্ধুরা দেখা করতে আসবেন না, মরিংগির সঙ্গে দেখা হবে না, সকালবেলা ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো হবে না… নেনিকে নিশ্চয় এ সবের ঝক্কি পোয়াতে হবে।

‘আমার স্নানের জোগাড় করেছ?’

‘এই এক মিনিটের মধ্যে করে দিচ্ছি, মিলেডি।’

‘ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্নানের জোগাড় ঠিক রাখবে। কেন আমাকে শুধু শুধু বসিয়ে রাখছ? একটা কাজও যদি তোমাকে দিয়ে হয়! শিগগির আমার চকোলেট এনে দাও আর বিস্কুট। আর আমার কাপড়-চোপড়— শিগগির করো।’

‘কোন পোশাকটা পরবেন মিলেডি? লালটা? হলদেটা? না জাপানি ছাতাওলা পোশাকটা? কোনটা আনব?’

‘না, বেগুনিটা! কই সেটার নাম তো করলে না? ওটা জানো না বুঝি?’

‘আজ্ঞে জানি, মনে ছিল না মিলেডি— এই যে এনেছি, দেখুন।’… নেনি একদৃষ্টে ঘরের কোণের দিকে তাকিয়ে আছে যেন কোন জাদুর ছোঁয়ায় তার স্বপ্ন সত্যি হয়ে উঠছে। মার্শনেসের সঙ্গে সে জোরে জোরেই কথাবার্তা বলছিল— মার্শনেসের কথায় উচ্চস্বরে হুকুমের ভঙ্গি, আর নিজের কথা নিচু স্বরে, দাসীর যেমন হওয়া উচিত।

হঠাৎ মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার কেঁপে উঠল— সে দেখল একটা মোটা বিশ্রী হাত তার মাথার উপর দিয়ে এসে পুতুলটাকে ঝটকা মেরে টেনে নিল। তার মাথা ঘুরে উঠল, আস্তে আস্তে মাথাটা সে নামাল, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে আড়চোখে লোকটার দিকে একবার তাকাবার সাহস তার হল।

পিছনে দাঁড়িয়ে নেনির বাবা— কদাকার হাতের মুঠোয় তার সুন্দর পুতুলটা— সেটার দিকে তাকাতে তাকাতে তার মোটা কদর্য ঠোঁটের ফাঁকে একটা ঠাট্টার হাসি ফুটে উঠেছে। মাথা নেড়ে এইবার সে চিৎকার করে উঠল, ‘ও, বসে বসে এতক্ষণ এই বুঝি হচ্ছে তোর!’

মর্মান্তিক কষ্টে নেনির মন ভরে উঠল— সে দেখল, তার বাবা আর একটা হাত দিয়ে পুতুলটার টুপি ধরেছে। এক হ্যাঁচকা টানে মার্শনেস মিমির টুপিসুদ্ধ মাথাটা এল খুলে— অনেক কষ্টে নেনি নিজেকে দমন করে রাখল। তারপর পুতুলটাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল বাইরে। পরের মুহূর্তে প্রচণ্ড একটা লাথির চোটে ছিটকে দূরে পড়ে গিয়ে সে শুনল তার বাবার চিৎকার: ‘ওঠ শিগগির। ফের যদি এসব ন্যাকামি এখানে করবি তো মেরে তোকে ঠান্ডা করে দেব। এসব বড়মানষি চাল আমার বাড়িতে চলবে না বলে দিচ্ছি। শুনতে পাচ্ছিস?’…

—কমলা রায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *