সেদিন বেঙ্গল ক্লাবে
বেঙ্গল ক্লাবের আমি সদস্য নই। বেঙ্গল ক্লাব কেন, দুয়েকটা ঘরোয়া ক্লাব বা পাড়ার ক্লাব বাদ দিলে, তেমন মান্যগণ্য কোনও ক্লাবের সদস্যপদ আমার নেই। তবুও বন্ধুবান্ধব এবং আপনজনের দৌলতে বেঙ্গল ক্লাব সহ অনেক ক্লাবেই আমার প্রবেশাধিকার ঘটে।
বেঙ্গল ক্লাব খুবই প্রাচীন এবং অভিজাত সংস্থা। ব্রিটিশ উপনিবেশ সংস্কৃতির শেষ চিহ্নগুলির একটি। এই জাতীয় সাহেবি ক্লাব পৃথিবীতে ক্রমশ বিরল হয়ে যাচ্ছে।
সে যা হোক কয়েক দিন আগে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে সন্ধ্যায় বেঙ্গল ক্লাবে এক জমজমাট আড্ডা দিয়ে এলাম। আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন ক্ষুরধার, বঙ্কিম বুদ্ধি গদ্যকার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। ইনিই সেই ব্যক্তি, যাঁকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘ভাল?’ তিনি বলেন, ‘হাতে সময় আছে তো, আপনার প্রশ্নের উত্তর একটু ভেবে বলতে হবে।’
বঙ্কিম পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এখন আবার আধা-সাংবাদিক। কিন্তু সাংবাদিক বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারা বেশ একটু ব্যতিক্রমী। তিনি একটা সাংঘাতিক গল্প বললেন।
রেললাইনের লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে ভীষণ ভিড়। কী ব্যাপার? কে একজন এই মাত্র রেলে কাটা পড়েছে।
হাতের কাছে এমন টাটকা খবর পেয়ে সাংবাদিক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তিনি অকুস্থলে প্রবেশের চেষ্টা করলেন, কিন্তু ভিড় ঠেলে এগোয় কার সাধ্যি।
তখন ভদ্রলোক একটা সাংবাদিকসুলভ চালাকি করলেন। তিনি ভিড় ঠেলে এগোবার চেষ্টা করতে করতে উদভ্রান্তের মতো বলতে লাগলেন, ‘আমার বাবা রেলে কাটা পড়েছেন, দয়া করা আমাকে একটু সামনে যেতে দিন।’
একথা শুনে ভিড়ের মধ্যে একটা সংকীর্ণ পথ তৈরি হয়ে গেল, সাংবাদিক যখন রেললাইনের কাছে পৌঁছলেন, সামনের সারির এক ব্যক্তি সাংবাদিককে বললেন, ‘এই দেখুন আপনার বাবার কী অবস্থা হয়েছে।’ স্তম্ভিত সাংবাদিক দেখলেন রক্তে-চর্বিতে মাখামাখি একটা বড় শুয়োর রেলে কাটা পড়েছে।
কোনও নৈশ আড্ডার গল্প এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় না।
আমাদের ওভাল টেবিলের সুদূর পশ্চিম দিগন্তে এক মারাঠি মহিলা, মিসেস তলোয়ারকর একদা মহারাষ্ট্র সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। এখন স্বামীর সুবাদে এবং দৌলতে সরকারি চাকরি ছেড়ে তথ্য-প্রযুক্তির দুই নম্বর কোম্পানির এক নম্বর জনসংযোগ আধিকারিক। বাঁকা সিঁথি, বুদ্ধি ভরা চোখ-মুখ, শীর্ণা, লম্বা মহিলাটি বললেন, ‘এক গেলাস রাম পেলে একটা গল্প বলি।’ সবাই হুইস্কি খাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি বেয়ারাকে ডেকে রাম আনা হল।
ভদ্রমহিলা পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে সামান্য এক চুমুক রাম খেয়ে বললেন, …অল্প কিছুদিন আগে আমি চাকরিতে ঢুকেছি। তখনও প্রশাসন আর বিচার বিভাগ আলাদা হয়নি। তখনকার বোম্বাইয়ের একটা নিম্ন ফৌজদারি আদালতে আমি ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেট, লঘু পাপে লঘু দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা।
একদিন স্থানীয় পুলিশ সি ভিউ নাকি ওসেন ভিউ নামের এক হোটেল থেকে এক গাট্টাগোট্টা ব্যক্তিকে আমার আদালতে চালান দিল। অভিযোগ, এই আসামি গতকাল রাতে হোটেলের ঘরে তার বউকে বেধড়ক পিটিয়েছে।
আমি অভিযোগ শুনে আসামিকে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ হাজতে চালান দিলাম। পরবর্তী বিচারের দিন দু’সপ্তাহ পরে।
আমার আদেশ শুনে লোকটি হাতজোড় করে বলল, ‘ম্যাডাম, এটা ভাল করলেন না। হানিমুনের সময় বউ থাকবে হোটেলে একা, আর স্বামী থাকবে পুলিশ হাজতে?’
হানিমুনের সময় বউকে মারধর করা উচিত কি না, এ নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা চলছে, সন্দীপন বললেন, ‘ওহে তারাপদ, তুমি চুপ কেন, তুমি কিছু বল।’
আমি আর কী বলব?
এ রকম আড্ডায় গল্পের ধারাবাহিক রক্ষার কোনও নিয়ম নেই। আমার মাথায় আজ কিছুদিন হল একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই প্রশ্নটা সবাইকে করলাম—
‘আমরা যেসব পাখির ডিম খাই, যেমন হাঁস, মুরগি সেগুলো প্রায় নিয়মিত প্রতিদিন ডিম পাড়ে, কিন্তু যেসব পাখির ডিম আমরা খাই না, যেমন কাক, চড়ুই, শালিক, ঘুঘু বছরে একবার মাত্র একজোড়া ডিম পাড়ে। এর কি কোনও ব্যাখ্যা আছে?’