সেদিন অক্টোবর – ৯

গোসল সেরে বেরিয়ে সকাল দেখল, মা থমথমে মুখে বসে আছেন বিছানায়। চোখে জলের আভাস। চাপা রাগে ফেটে যাচ্ছে মুখের চামড়া। সকাল একটু ভড়কে যাওয়া গলায় বলল, ‘কী হয়েছে, মা?’ 

‘তুই কি আমাকে বোকা পেয়েছিস?’

‘বুঝলাম না।’ 

‘ধোঁকা দিচ্ছিস আমাকে?’ 

সকাল মাথার চুলে তোয়ালেটা ভালো মতো জড়িয়ে নিলো। এগিয়ে এসে বসল মায়ের পাশে। ‘এসব কী বলছ?’ 

মা আগুন ঝরা গলায় বললেন, ‘তুই ওই ছেলেটার সাথে দেখা করার জন্যই এসেছিস এখানে, তাই না? দুজন মিলে প্ল্যান প্রোগ্রাম করেই কাজটা করেছিস।’ 

সকাল চোখ নামালো, ‘কী বলছ এসব?’ 

‘ঠিকই বলছি। আমাকে বোকা বানানো এত সোজা না।’

‘হঠাৎ কী হলো?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্নটা করল সকাল।

‘ছেলেটা তো এখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। বহাল তবিয়তে।’ 

‘তার বাড়িতে সে ঘুরে বেড়াবে। এটাই কি স্বাভাবিক নয়?’ 

মায়ের কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে উঠল, ‘তা তুমি কি জানতে না যে এটা তার বাড়ি? যে ছেলের সাথে বিয়ে ভেঙে গেছে সেই ছেলের বাড়িতে কোন আক্কেলে এসেছ? নিজের তো লাজ শরম কিছু নেই। আমার মান-ইজ্জতেরও বারোটা বাজালে।’ 

সকাল নিরুত্তর। মাথা নিচু। গলায় কান্নার সুড়সুড়ি। 

‘এতই যদি তোমার শখ হয় একে বিয়ে করার তাহলে করে ফেলো। এখানেই থাকো। আমি কালকেই চলে যাব। আমার লাগবে না তোমার মতো মেয়ে। একাই থাকব, এটুকু বলে তিনি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘আমার স্বামী চলে গেছে। দুদিন পর আমিও চলে যাব। তোমার জীবনে আমি বাধ সাধতে আসব না। তুমি ওই অলক্ষুণে ছেলেকে বিয়ে করে এখানেই থাকো। বাপকে হারিয়েছ, এবার মা হারালেও তোমার কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হচ্ছে না।’ 

‘এভাবে বলো না, মা! আমার কষ্ট হয়!’ না চাইতেও আর্তনাদটা বুক চিরে বেরিয়ে এলো। 

মা কান্না ভেজা বড়ো বড়ো চোখ তুলে তাকালেন ওর দিকে, অপ্রকৃতস্থের গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে। তুই সুখে থাক। আমাকে বিদায় দে। আমি চলে যাব। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। 

সকাল মাকে জড়িয়ে ধরল। গলার স্বর বুজে এলো কান্নায়। অনেক কষ্টে বলল, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।’ 

মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ওই ছেলে ঘুরঘুর করছে কেন? মতলব কী? আমার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে আসছে, সালাম দিচ্ছে। মনে করেছে এসব করলেই আমি পটে যাব।’ 

সকাল একটু স্তম্ভিত হয়ে গেল। ‘তোমাকে সালাম দিয়েছে?’ 

‘দিল তো।’ 

‘তুমি উত্তর দাওনি?’ 

‘মাথা খারাপ! দিলেই তো মাথায় চড়ে বসবে।’ 

সকালের বুক মুচড়ে উঠল। ভয়ঙ্কর মন খারাপে ডুবে গেল মন। ‘একটা মানুষ তোমাকে সালাম দিল, সম্মান দেখালো। বিনিময়ে তুমি এমন অভদ্র আচরণ করলে?’ 

মায়ের চোখে সন্দেহ ঝিলিক দেয়, ‘তুই এত রিঅ্যাক্ট করছিস কেন?’ 

সকাল সরে এলো মায়ের কাছ থেকে। লুকিয়ে নিলো জল টলমলে চোখ। একটা বড়ো শ্বাস টেনে নিয়ে কান্নার ঢোঁক গেলার চেষ্টা করে ভাঙা গলায় বলল, ‘মা, শোনো, তোমার সব আদেশ আমি মানতে রাজি আছি। কিন্তু তুমি দয়া করে আর কখনো ওকে অলক্ষুণে বলে ডেকো না। আর এভাবে অপদস্থ করো না। নিজ থেকে কথা না বলতে চাইলে বলো না। কিন্তু সে বলতে এলে ভদ্রতার খাতিরে অন্তত রেসপন্স করো। বেচারার মা নেই। বাবার সাথেও সম্পর্ক ভালো না। সব জেনে-শুনে তুমি…’ সকাল বলতে বলতে হোঁচট খেলো। কণ্ঠস্বর ঢাকা পড়ল অদম্য কান্নার থকথকে কম্পনে। 

.

বাড়িতে অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে প্রায় একমাস যাবত। পিতা-পুত্রের স্বাভাবিক সম্পর্ক বিরাজমান থাকলে ছোটো ভাইয়ের বিয়ের আয়োজনে আরশানের নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকত। বাবাকে একটা প্রচ্ছন্ন শাস্তি দেওয়ার জন্য সে ইচ্ছে করেই নির্লিপ্ত থেকেছে। কিন্তু আজকে অনুষ্ঠানের ঠিক কয়েকঘণ্টা আগে, ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে, নতুন একটা কন্সট্রাকশন প্রজেক্ট প্রপোজালে আকণ্ঠ ডুবে যাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে মাথায় বারংবার একটি টুকরো ভাবনা ভাসমান মেঘের মতো এসে উপস্থিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাড়ির বড়ো ছেলে হিসেবে আজকের এই বিশেষ দিনে অল্পবিস্তর হলেও পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা উচিত। কিন্তু সংকোচের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে উদ্যম। এতদিন নিশ্চুপ নির্বিকার থেকে আজ হঠাৎ খুব যত্নশীল হয়ে উঠলে ছোটো ভাইবোনদের কাছেই হাসির পাত্র বনে যাবে। অতএব অবাধ্য অশান্ত মনটাকে আত্মাদরের বেড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধল সে। ঠিক করল আজ সারাদিন অফিসের কাজ করবে। শুধুই কাজ। 

দুপুরে টিলি এলো ওর ঘরে, হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে।

‘ভাইয়া, এটা তোমার। 

‘কী এটা?’ ভ্রুজোড়া সুচালো হলো আরশানের। 

‘পাঞ্জাবি। আমরা গত মাসে নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম বিয়ের শপিং করতে। তোমাকে তো কতবার বললাম সঙ্গে চলো, গেলে না। ওখান থেকেই কিনেছিলাম। আজকে এটা পরবে, কেমন? ছেলেরা সব পাঞ্জাবি পরছে। আর মাথায় লাল পাগড়ি। তোমার পাগড়িটাও নিয়ে এসেছি।’ 

আরশান জলদগম্ভীর মুখে বলল, ‘এসব পাগড়ি-টাগড়ি আমি পরব না।’ 

‘কেন? প্লিজ, ভাইয়া! ড্যাডকেও পরাচ্ছি। আজকের ফ্যামিলি পিকচারে তোমাদের দুজনের মাথায় একই রকম পাগড়ি থাকবে। কাজিনরাও সবাই পাগড়ি পরছে।’ 

‘আমি এসবের মধ্যে নেই। তুমি তো জানো আমি ছবি – টবি তুলি না।’ 

টিলি একটু রেগে গেল এবার, ‘সবসময় এরকম করো কেন? ভালো লাগে না কিন্তু!’ 

আরশান ছোটো বোনের দিকে নরম চোখে চাইল, নরম গলায় বলল, ‘আচ্ছা ছবি তুললেও তুলতে পারি। কিন্তু অদ্ভুত জিনিসটা মাথায় পরতে পারব না। সরি।’ 

টিলি কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ভাইয়ের দিকে। তারপর রুষ্ট স্বরে বলল, ‘এখানে বসে না থেকে ওপরে চলো।’ 

‘কাজ করছি।’ 

‘কাজ করতে হবে না। চলো ওপরে। 

‘কেন?’ 

‘নাচের রিহার্সাল হচ্ছে।’ 

আরশান শ্রাগ করল। ‘তো আমি কী করব?’ 

‘এসো তো, ভাইয়া! আমার স্পিচের স্ক্রিপ্ট রেডি করে দাও।’ 

আরশান একটু অবাক হলো। ‘স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে কেন? ভাইকে নিয়ে যা বলতে মনে চায়, তাই বলবে।’ 

টিলি কাঁচুমাচু হয়ে গেল। ‘প্রব্লেম হচ্ছে এত মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমার কিছুই মনে আসবে না। যা মনে আছে তাও ভুলে যাব। তাই মুখস্থ করতে হবে। 

আরশান হেসে ফেলল। 

‘তুমি লিখে দেবে না?’ 

‘এসব কাজ নিজেকেই করতে হয়, টিলি। যা যা বলতে চাও গুছিয়ে লিখে ফেলো।’ 

‘ঠিক আছে লিখব। কিন্তু তোমার সাহায্য প্রয়োজন।’

‘আমি কাজ করছি। ডিস্টার্ব করো না।’ 

টিলি মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘থাকো তুমি। সেলফিশ একটা!’ 

আরশান উঠে এলো শেষমেশ। টিলির গাল টেনে দিয়ে প্রশ্রয়ের গলায় বলল, ‘আমাকে বিরক্ত না করলে ভালো লাগে না, তাই না? 

‘না, লাগে না। তোমাকে বিরক্ত করা আমার ফেভারিট কাজগুলোর একটা,’ আহ্লাদী গলায় বলল টিলি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *