সেদিন অক্টোবর – ৮

কফি শেষ করে আরশান ফিরে এলো বাড়ির ভেতর। লিভিং রুমের কাউচে বসল। সকাল নেই এখানটায়। আশ্চর্য এই যে, কিয়ৎক্ষণ আগেও এই জন-সমাবেশ থেকে সে মনে-প্রাণে নিষ্কৃতি চাইছিল। অবান্তর যুক্তিহীন বিরক্তিতে ছেয়ে ছিল মন। এখন তার চোখে মুখে বিরক্তির লেশমাত্র নেই। রাগ, ক্রোধের চিহ্ন নেই। একটা হতভম্ব ভাব ছড়িয়ে আছে মুখের আনাচে- কানাচে। যে মানুষগুলোকে একটু আগে অসহ্য বোধ হচ্ছিল, তাদের এখন দিব্যি সহ্য করা যাচ্ছে। কেউ প্রশ্ন করলে রাগ হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে আরো কিছুক্ষণ এখানে বসে থেকে মানুষ-জনের অহেতুক প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাওয়াটা অতটাও কঠিন কাজ নয়। তার মন বলছে সকাল এদিকে আবারও আসবে। যে কোনো মুহূর্তে আসবে। একটু সংকোচ বোধ হচ্ছে এই ভেবে যে উপস্থিত লোকজন হয়তো তার অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনটা টের পেয়ে মনে মনে বিদ্রুপের হাসি হাসছে। কয়েকহাত দূরে মাদার দাঁড়িয়ে আছেন। আরশানের চোখে চোখ পড়তেই তিনি এগিয়ে এলেন। 

‘তুমি নাশতা করেছ, বাবা?’ 

আরশান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। রহমান সাহেব স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। পুত্রের আহত হাতের দিকে চেয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার হাতে কী হয়েছে?’ 

আরশান পিতার চোখে চোখে চাইল না। মাথা নিচু করে এমনভাবে হাত ঘড়িটা দেখল যেন তার কানে কোনো প্রশ্ন এসে ভিড়েনি। দ্বিতীয়বার ছুটে এলো কথাটা। বসা থেকে ওঠার আগে আরশান দুটো শব্দ উচ্চারণ করল ক্ষীণ কণ্ঠে, ‘কিছু হয়নি।” 

সকালের মা ডাইনিংয়ে ঢুকতেই চোখাচোখি হলো আরশানের সাথে। তাঁর গোলগাল ফর্সা বোকা বোকা মুখখানা চকিতে কঠোর হয়ে উঠল। কুটিল হয়ে উঠল চোখের দৃষ্টি। আরশান অপ্রতিভ ভাবে সালাম দিল। তিনি সালামের উত্তর না দিয়ে হনহন করে নাশতার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আরশান টেবিলের পাশেই ছিল। বিনীত ভাবে একটি চেয়ার এগিয়ে দিল। সকালের মা এই সেবাটুকু গ্রহণ করলেন না। কঠোর ভাবে অগ্রাহ্য করলেন। আরশানের এগিয়ে দেওয়া চেয়ারে না বসে নিজ উদ্যোগে অন্য একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। আরশানের মুখে অপমানের ছায়া পড়ল। তার আত্মসম্মানবোধ সদা জাগ্রত। এই ভদ্রমহিলা সকালের মা না হয়ে অন্য কেউ হলে এতক্ষণে কড়া কথা শুনিয়ে দিত। ইচ্ছে যে হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু ইচ্ছের মুখে কুলুপ এঁটে মেঘাচ্ছন্ন মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে। একটা সময় নিঃশব্দে হেঁটে সরে এলো জায়গাটা থেকে। তার মনটা বড়োই সংকুচিত হয়ে আছে। নিজেকে নিকৃষ্ট এবং হীন জীব বলে মনে হচ্ছে। ভিক্ষুক মনে হচ্ছে। কী দরকার ছিল মহিলার সাথে স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে কথা বলতে যাবার? সে কি ভেবেছিল, উনি তাকে মাথায় তুলে নাচবেন? জামাই আদর করবেন? ওরা কেন এসেছে এখানে? ফাহাদ-নাবিলার ওয়ালিমায় যোগ দেবার জন্য? নাকি আরশানকে আবার নতুন উদ্যমে অপমান করার জন্য? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *