৬
পঁচিশ ঘণ্টার যাত্রাপথ এবার একটুও বিরক্তির উদ্রেক করল না। টানা অনেকগুলো দিন শুধু বাড়ি থেকে অফিস আর অফিস থেকে বাড়ি, এই এতটুকুতেই আবদ্ধ ছিল জীবন। তাই একঘেয়ে গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর ভালো লাগছিল সকালের। মায়ের চোখে মুখেও ভ্রমণ আনন্দের অল্পবিস্তর ছিটে লেগেছে। কেটে গেছে বিষণ্ণতা।
সকালরা ভার্জিনিয়া এসে পৌঁছুল নাবিলার বউভাতের ঠিক আগের রাতে। নেইবারহুডের বাড়িগুলোতে তখন হ্যালোইনের সাজ। কোনো উঠোনে ঝুলছে হাড্ডিসার কঙ্কাল, কোথাও আবার মাকড়সার জাল, কোথাও সাদা আলখাল্লা পরা ভয়ালদর্শন প্রেতাত্মা কিংবা অভিশপ্ত ডাইনি। কেবল আরশানদের বাড়িটাই ভূতের উপদ্রব থেকে পুরোপুরি মুক্ত। এই ভবনে বইছে আনন্দ ধারা। পুরো বাসস্থান ঝলমল করছে নানা রঙের, নানা ঢঙের বৈদ্যুতিক বাতিতে। স্ট্রিং লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে লন। মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে। হই-হই রই- রই আমেজে ডুবে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে যেন দোচালা ছাদের আড়াইতলা বাড়িটা। ফাহাদ গিয়েছিল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে, সকালদের পিকআপ করতে। নাবিলার দুহাত ভরতি কাঁচা মেহেদি। অনুষ্ঠানের আগের রাতে ঝামেলার শেষ নেই। ইচ্ছে থাকলেও বান্ধবীকে বরণ করে নিতে বিমানবন্দরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হলো না। বাড়ির লোকেরা সবাই লনে নেমে এসেছিল। সকাল চাচা-চাচিকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। টিলি ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। আর নাবিলা তো বান্ধবীর সারা মুখে চুমু টুমু খেয়ে অস্থির! কে বলে পৃথিবীতে মায়া নেই? মানুষে মানুষে হৃদ্যতা নেই? এই যে মানুষগুলো…এদের সাথে সকালের রক্তের সম্পর্ক নেই। বহু বছরের জানাশোনা নেই। তবুও যেন কত আপন, কত কাছের! জন্মসূত্রের আত্মীয়দের মাঝেও এত মায়া নেই আজকাল। সকালের চোখে কান্নার কুয়াশা নামছিল। স্নেহের উষ্ণ স্পর্শে কেটে যাচ্ছিল মনের জট। বছর দুয়েক আগে এ বাড়িতে প্রথম আসার দিনটি ছিল অন্যরকম। সকাল তখন অর্ধ-পরিচিতা এক অতিথি মাত্র। চোখে পর্যটকের কৌতূহল। অথচ আজ… আজ কেন যেন মনে হচ্ছে অনেকদিন বাদে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে আপনজনের কাছে।
বাড়ি ভরতি অতিথি থাকা সত্ত্বেও সকাল আর তার মায়ের জন্য একটা আলাদা রুম বরাদ্দ করা হয়েছে। অতিথিদের সবাই এই সুবিধা পাচ্ছে না। অনেকেই লিভিং রুমে ফ্লোরিং করে থাকবে। অনিকসহ আরো দুজন ছেলেকে আরশানের বেজমেন্টে পাঠানো হবে রাত্রিযাপনের জন্য। বসার ঘরে বাজনা বেজে চলেছে। নাচের প্র্যাকটিস করছে টিলির বন্ধুরা। অনেকদিন পর এমন আমুদে পরিবেশ পেয়ে সকাল একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল, তটস্থ হয়ে গিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর থেকে আমোদ-ফুর্তি তার জীবনে একরকম নিষিদ্ধ হয়ে উঠেছে। মায়ের মুখখানা বারংবার পরখ করছিল সে। পুরো জার্নিতে তার একমাত্র মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মা। মায়ের কষ্ট হলে, শরীর খারাপ হলে, মন খারাপ হলে…ভ্রমণের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে।
.
সকাল দেখছিল নাবিলাকে। আগের চাইতেও সুন্দর হয়েছে ও। একটা টিয়া রঙের সিল্ক জামদানি পরনে। দুই হাত ভরতি নকশা তোলা মেহেদি। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। সুখের ঝিকিমিকি আলপনা আঁশ মিটিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে তার মুখ নকল প্রসাধনীর আর কোনো প্রয়োজন নেই।
গোসল সেরে খাবার ঘরে এসে দেখা গেল, ডাইনিং টেবিলে সবার একত্রে বসা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সকালকে ফাহাদের খালারা এর মাঝেই ঘিরে ধরেছে। নানামুখী প্রশ্ন বাণে ক্রমাগত জর্জরিত করে তুলছে। বেচারির মুখ থেকে তটস্থ ভাবটা সরছেই না। কোনো আলোচনায় মন বসছে না তার। একটা ঘোর কাজ করছে। এই যে বাড়ি ভরতি, এত অতিথি সমাগম। এত আয়োজন, এত আড়ম্বর! এর মাঝে সেই মানুষটা কোথায়? কেউ কেন তাকে ডাকছে না? কেউ কেন তার কথা বলছে না? পাতাল ঘরে একলা বসে সেই মানুষটা কী করছে এখন? সকালের গলা দিয়ে খাবার নামল না। প্রাণান্তকর অস্বস্তিতে ঠেসে রইল ভেতরটা। কষ্টের আলপিন ফুটতে লাগল মনে। আর তখনই…ঠিক তখনই সে জানতে পারল…বুঝতে পারল…গভীর ভাবে অনুধাবন করতে পারল যে, হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে, স্বামীহারা বিষণ্ণ, অসহায় মায়ের ওপর জোর খাটিয়ে, বন্ধুর ধার করা পয়সায় প্লেনের টিকেট কেটে, মার্কিন মুলুকে উড়ে আসার পেছনের মূল কারণ আসলে ওয়ালিমার অনুষ্ঠান নয়, হাওয়া বদলের আবশ্যকতা নয়, এর কারণ শুধুমাত্র ওই মানুষটাকে এক নজর দেখতে পাবার দুর্নিবার আকুলতা! কিন্তু কোথায় সে? নেই তো!
নাবিলার বাবা-মা সকালের মাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন। নাবিলা আর সকাল স্কুল জীবনের বন্ধু। তাদের বাবা-মায়েদের মধ্যেও বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক আছে। তাই খাওয়ার টেবিলের আড্ডা শোবার ঘর পর্যন্ত গড়ালো। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা আজ অনেক রাত অবধি জাগবে। নাবিলা সকালকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে এসেছে। আলমারি খুলে দেখাচ্ছে ওয়ালিমার পোশাক, গয়না, জুতো। খানিক দূরে বসে ফাহাদ, টিলি আর অনিক কথার ফুলঝুরি ওড়াচ্ছে। কী নিয়ে যেন খুব হাসাহাসি হচ্ছে ওদের মধ্যে। সকাল ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখছিল। আগে ফাহাদের এই রুমটায় আসবাব বলতে তেমন কিছুই ছিল না। এখন ঘরের সাজসজ্জা পালটে গেছে। রমণীয় পরশে ঝকঝক করছে চারপাশ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ঘরের বাসিন্দাদের মনে ভালোবাসার বিচরণ আছে। সকালকে মা একা ছাড়তে নারাজ। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই তিনি নাবিলার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। বসে পড়লেন মেয়ের পাশে।
‘তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?
সকালের শুকনো মুখের দিকে চেয়ে আচমকা প্রশ্নটা করল নাবিলা।
‘শরীর খারাপ না…টায়ার্ড লাগছে, দোস্ত। জেটল্যাগ খুব সম্ভবত।’
নাবিলা একটু নিভল। ‘ওহ, আসলে এতটা পথ জার্নি করে এসেছিস। টায়ার্ড তো লাগবেই। তুই বরং শুয়ে পড়।’
বান্ধবীর উৎসাহে ভাটা পড়ুক এমনটা চায় না সকাল। তড়িঘড়ি করে বলল, ‘আরে না, শুবো না এখন। রাত না জাগলে বিয়ে বাড়ির মজা আছে নাকি?’
সেই সময় হঠাৎ উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে এক থোকা বাতাসের সাথে ভেসে এলো বেহালার করুণ মরমী সুর। এসে বিধল সকালের বুকের মধ্যিখানে।
The falling leaves drift by the window
The autumn leaves of red and gold
I see your lips, the summer kisses
The sun-burned hands I used to hold
মনের অনেক তলানিতে লুকিয়ে থাকা চুপি চুপি কান্নাটা বেরিয়ে এলো চোখের কার্ণিশ বেয়ে। ঝপ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সকাল। দৌড়ে গিয়ে নিজেকে আড়াল করল রেস্টরুমের দরজার ওপাশে।
Since you went away the days grow long
And soon I’ll hear old winter’s song
But I miss you most of all my darling
When autumn leaves start to fall
(Jacques Prévert)