৫
ডেকের রেলিংয়ের ওপাশে একটা লম্বা ছায়া এসে ভিড়ল অন্ধকারে। থামল আরশানের বেহালার সুর।
‘কাল তোমার একটু সময় হবে, ভাই?’ ফাহাদের প্রশ্ন। ‘কেন জানতে চাইছ?’ কাঁধ থেকে বেহালাটা নামিয়ে নিয়ে প্রশ্নের ওপর প্রশ্নের প্রলেপ আঁকে আরশান।
‘ফিলাডেলফিয়া যাচ্ছি সবাই। তুমি সাথে গেলে মম- ড্যাড খুব খুশি হবে।
আরশান একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, ‘তোমার সাথে কোথাও যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তোমার ডিয়ার ড্যাডিকে খুব বেশিক্ষণ চোখের সামনে সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না। মমি-ড্যাডিকে নিয়ে তোমরা ঘুরে এসো। আমি নাহয় অন্য কোনো সময় যাব।’
ফাহাদ কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ডেকের ওপর উঠে এলো। একটা ফুলহাতা সাদা সোয়েটার ওর গায়ে। অন্ধকারে সাদা রঙটা চোখে পড়ছে খুব। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বড়ো ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে।
‘তুমি কি ড্যাডকে কখনো ক্ষমা করবে না?’
আরশান উত্তর দিল না। অন্ধকার অন্তরীক্ষে হীরের টুকরোর মতো জ্বলতে থাকা অগণিত নক্ষত্রের দিকে চোখ ভিড়িয়ে নির্বিকার বসে রইল।
ফাহাদ তরল গলায় বলল, ‘ড্যাড আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে তোমাকেই সবচেয়ে ভালোবাসে।’
‘তাই?’ বিদ্রুপের হাসি হাসল আরশান।
‘হ্যাঁ, তাই। তুমি তো তাকে যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছ। এবার কি মাফ করা যায় না?’
আরশান স্তব্ধ হয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড কাটল নিঃশব্দে। একসময় শীতল কণ্ঠে বলল, ‘আমি তোমার ড্যাডকে সেদিনই ক্ষমা করতে পারব, যেদিন জানতে পারব আমার মা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।’
ফাহাদ ব্যথিত চোখে চাইল বড়ো ভাইয়ের তমসাচ্ছন্ন প্রস্তরীভূত মুখখানার দিকে।
‘সেটা কি কখনো সম্ভব?”
‘এই জন্মে সম্ভব নয়!’
ফাহাদ তাৎক্ষণিক কিছু বলল না। বিষণ্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। আরশান বলল, তুমি দুশ্চিন্তা করো না। এখন তোমার এসব নিয়ে ভাববার সময় নয়। তুমি যা চাইবে, যেখানে যেতে বলবে আমি যাব। শুধু ওই ভদ্রলোকের ছায়া থেকে একশো হাত দূরে থাকতে চাই।’
ফাহাদ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। আরশান আবার বলল, ‘তোমার ড্যাডি কিন্তু এবার ইয়ারলি মেডিকেল চেকআপ করায়নি। আমি খোঁজ নিয়েছিলাম। এই বয়সে এমন অবহেলা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। তুমি উনার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়ো।’
ফাহাদ হাসল। ‘এর থেকেই বোঝা যায় ইউ স্টিল কেয়ার অ্যাবাউট হিম।’
‘আই ডোন্ট কেয়ার এনিমোর।
ফাহাদ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছু সময়। তারপর ধীর গলায় বলল, ‘চলি তাহলে।
‘এসো।’
ফাহাদের প্রস্থানের পর আরশান আরো কিছুক্ষণ বসে রইল অন্ধকারে ডুব দিয়ে। শরীর জুড়ে রাজ্যের অবসাদ! জীবনের প্রতি এতটা নিরাসক্তি আগে কখনো আসেনি। সে বেঁচে ছিল নিজের জন্য, পৃথিবীর জন্য। প্রকৃতির সাথে আশ্চর্য এক মায়ার বুনোটে বাঁধা ছিল তার মন। নিছক প্রকৃতির সঙ্গই ভরপুর আনন্দে টালমাটাল করে দিত ওকে। সেই মন হারিয়ে গেছে, রয়ে গেছে শুধু বাহ্যিক খোলস।
এ বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় সঙ্গে নেওয়ার মতো বিশেষ কিছুই নেই। শুধু পেইন্টিংগুলো নিয়ে যাবে। এরিককে দিয়ে দেবে পেন্সিলভ্যানিয়ার আমিশ গ্রামের এক ফার্মে। ঘরের কোনো ফার্নিচার নিজের টাকায় কেনা নয়। ওগুলো এখানেই থাকবে। কাপড়-চোপড় যা আছে তা একটা বড়ো স্যুটকেসেই এঁটে যাবে। বেহালাটা নিতে হবে। ঘরের ভেতরে এসে হলুদ ল্যাম্প শেডের আলোয় নিজের আঁকা দেওয়ালময় পেইন্টিংগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল সে একদৃষ্টে। কখনো ভাবেনি বাবার জীবদ্দশায় এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। নিয়তি বড়োই আশ্চর্য জিনিস! কোত্থেকে কোথায় নিয়ে যায় মানুষকে!
কী মনে করে যেন অনেক দিন বাদে ওয়ালেটে ভাঁজ করে রাখা মায়ের চিঠিটা হাতে নিলো আরশান। চোখ রাখল গোটা গোটা অক্ষরে লেখা বাক্যগুলোর ওপর।
আরশান,
বাপধন আমার। কেমন আছ? তোমার বাবা বলল তুমি নাকি আমার সাথে দেখা করতে চাও না। শুনে কষ্ট পেয়েছি। তোমার কি নিজের মাকে একটাবার দেখতে ইচ্ছে করে না, সোনা? আমার যে চোখ জ্বলে যায়, মন পুড়ে যায় তোমার জন্য। বুকটা সব সময় খালি খালি লাগে। তুমি আমাকে ঘৃণা করো কেন? আমি গ্রামের গরীব ঘরের মেয়ে। বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারিনি। এটাই কি আমার একমাত্র দোষ? তোমার বাবা বোধহয় এই দোষের কারণেই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। গিয়ে তিনি ভালোই করেছেন। আমার মতো গেঁয়ো অশিক্ষিত মেয়ে তাঁর পাশে সত্যিই মানায় না। আমাকে ছেড়ে যাবার জন্য উনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আমার একমাত্র সন্তানকে কেন আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো, এই প্রশ্নের জবাব আমি চাই। আমার আর কিছুই নেই তুমি ছাড়া। তাঁর তো স্ত্রী আছে, শুনেছি সস্তান ও হয়েছে। আমি তো নিঃস্ব!
তোমার সৎ মা তোমাকে নিশ্চয়ই অনেক ভালোবাসে। এত বেশি ভালোবাসে যে আপন মায়ের অভাব ভুলিয়ে দিয়েছে! জানি তুমি ভালো আছ। ভালো থাকো এটাই চাই। তবুও বাপধন আমার, যদি পার একবার… অন্তত একটাবার সময় করে তোমার দুঃখিনী মাকে দেখে যেয়ো। আমি বেশিদিন বাঁচব না। মৃত্যুর পূর্বে তোমাকে চোখ ভরে একবার দেখতে না পেলে পরপারে গিয়ে শান্তি পাব না। তুমি আসো। দয়া করে আসো। এসে আমার প্রাণ জুড়াও।
—ইতি, তোমার মা।
আরশান একটা প্রলম্বিত গভীর শ্বাস টেনে নিয়ে স্বগতোক্তি করল, ‘আমি আসব, মা! তুমি যেখানেই থাকো না কেন। আমি ঠিক ঠিক একদিন তোমার কাছে পৌঁছে যাব।’
আচ্ছা! এই মুহূর্তে যদি ব্লুরিজ মাউন্টেনের চুড়ো থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মরে যায়, তবে কি মা’র সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে? মা কি ওপারে অপেক্ষা করছে তার জন্য? মৃত্যুর আগে পৃথিবীকে কিছু বলার আছে কি আরশানের? পৃথিবীকে কিছু বলার না থাকলেও সকালের কানে একটা কথা পৌঁছে দিতে খুব ইচ্ছে করছে। বাইরের আদিম অন্তরীক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে বুকফাটা চিৎকারে ভেঙে পড়ে বলতে ইচ্ছে করছে: আই হেইট ইউ, সকাল; আই হেইট ইউ টু দ্য কোর! এই বক্তব্য কি অতলান্তিকের ফেনিল জলরাশি পার হয়ে, হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে, বাংলাদেশের হেমন্ত ছোঁয়া নীল আকাশের উষ্ণ সকালে মিরপুরের দোতলা বাড়ির বেডরুমের জানালায় আনমনে বসে থাকা সকাল শেহজাদির কর্ণকুহরে গিয়ে পৌঁছুবে? হঠাৎ মনে হলো সকালকে সে যতটা ঘৃণা করে, বাবাকে যতটা ঘৃণা করে, তার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি ঘৃণা করে নিজেকে। হৃদপিঞ্জরের ভেতর মহলে লুকিয়ে থাকা সত্তাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতাই আজকাল তার সমস্ত অস্তিত্বকে কুরে কুরে খেয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। প্রকৃতিও আর টানে না আগের মতো। অথচ একটা সময় ছিল যখন অরণ্যের গভীর বুকে নিভৃতে বিচরণ করে, ছবি এঁকে, পাহাড় বেয়ে, আহত হরিণ কিংবা শেয়ালছানাকে পরম যত্নে বুকে তুলে নিয়ে যত্ন করার মাঝেই তারিয়ে তারিয়ে বেঁচে থাকার স্বাদ অনুভব করত। সেসব দিন হারিয়ে গেছে। এখন বুকজোড়া শুধু অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অপূর্ণতার গ্লানি। দুর্বিষহ এই পীড়া থেকে মুক্তির উপায় কী? শারীরিক কষ্ট কি মানসিক কষ্ট প্রশমনের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে? ভাবনাটা মাথায় টোকা দিতেই আরশান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল লিভিং রুমের ওয়াল ক্যাবিনেটের দিকে। অস্থির কাঁপা হাতে টুলবক্সটা নামিয়ে নিলো। ঢাকনা খুলে হাত বাড়াল লোহার হাতুড়ির দিকে। তারপর দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে বাম হাতের পাঁচ আঙুলে ঘটাং করে বসিয়ে দিল এক ঘা। মাঝের দুটো আঙুল থেঁতলে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। কনকনে তীব্র ব্যথা আঙুল বেয়ে উঠে এলো কব্জিতে। তারপর ছড়িয়ে যেতে লাগল বাহুর প্রতিটি শিরা-উপশিরায়। আরশান যন্ত্রণায় কাতর হলো না। ককিয়ে উঠল না। দম বন্ধ করে একদৃষ্টে চেয়ে রইল আহত, রক্তাক্ত, বিকৃত হাতটার দিকে। হাতটা যেন তাকে কিছু একটা বলতে চাইছে। বলতে চাইছে–আমাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। মনটা যেমন তোমার, শরীরটাও তোমার নিজের। ভারসাম্য টিকিয়ে রেখে দুটোকে বশে রাখার অবিরাম বিরতিহীন চেষ্টার অপর নামই জীবন!
চোখের আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগল। যন্ত্রণার ধারালো দাঁতের দংশনে অবশ হয়ে এলো চিন্তা শক্তি। চেতনা বিলুপ্তির পথে। রক্তমাখা হাতে টাওয়েল জড়িয়ে অবিন্যস্ত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। এক হাতে ড্রাইভ করে পৌঁছুল নিকটস্থ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি কেয়ারে।