সেদিন অক্টোবর – ৪

সকাল কথাটা তুলল ব্রেকফাস্টের টেবিলে। 

‘মা, নাবিলা টিকেট করে ফেলেছে।’ 

‘অ্যাঁ?’ রুটি চিবোতে চিবোতে থমকে গেলেন মা।

‘নাবিলা।’ 

‘কী হয়েছে নাবিলার?’ 

সকাল গলায় নির্বিকার ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল, ‘নাবিলা তো ইউএসএ যাবার টিকেট করে ফেলেছে। তোমার আর আমার।’ 

‘ইউএসএ যাব কেন?” 

‘নাবিলার বউভাত।’ 

মা কিছুক্ষণ আগুনচোখে তাকিয়ে রইল সকালের দিকে। তারপর ঘটল বিস্ফোরণ। 

‘ফাজলামোর আর জায়গা পাও না? এমন ভাবে বলছ যেন ঢাকা থেকে খুলনা যাবার বাসের টিকেট কেটেছে তোমার বান্ধবী। বউভাত খেতে যাবে আমেরিকা। শখ কত!’ 

সকাল এক গ্লাস পানি গিলে নিলো ঢকঢক করে। তার চোখের দৃষ্টি অসংলগ্ন। চোয়ালের পেশি শক্ত। 

মায়ের দিকে না তাকিয়ে সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘বেশ তো, তুমি যেতে না চাইলে যেয়ো না। আমি যাব।’

‘কোথাও যাবে না তুমি। আমি জানি কেন তুমি এসব করছ। ওই ছেলেটা নিশ্চয়ই তোমার ওপর জোর খাটাচ্ছে।’ 

‘উফ, মা! সব কিছুতে আরশানের দোষ দেওয়াটা তোমার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আমি যাব কারণ এই একঘেয়েমি জীবনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’ 

‘তাহলে চলো, কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসি। অত দূরে যেতে হবে কেন?’ 

‘নাবিলা চাইছে।’ 

‘নাবিলা চাইলেই হবে? নাবিলা কি তোমার অফিসের বস নাকি? 

সকাল হঠাৎ তীব্র আক্রোশের সাথে নাশতার প্লেটটা ঠেলে দিল দূরে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অধৈর্য গলায় বলল, ‘তোমার সব কিছুতে বাড়াবাড়ি। বাবা চলে যাবার পর থেকে আমার জীবনটা নরক হয়ে গেছে। তুমি…তুমি শুধু নিজের কথাই চিন্তা করো সব সময়। স্বার্থপর! বাবা এত কষ্ট করে তোমার ভিসাটা করিয়েছিল কেন? আমার সাথে যাবে বলেই তো, নাকি?” 

রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সকাল। মা ওর পিছু নিয়ে বললেন, ‘আগামী মাসের পঁচিশ তারিখে তোর বিয়ে। হাতে আর মাত্র কটা দিন আছে। এরকম সময়ে মানুষ নিজের বিয়ের আয়োজন না করে বান্ধবীর বিয়ে খেতে যায়?’ 

সকালকে উন্মাদিনীর মতো দেখাচ্ছিল। চোখে-মুখে রাত জাগার ক্লান্তি। ঠোঁট শুকনো। বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে সে গোঁয়ারের মতো বলল, ‘এক সপ্তাহের জন্য যাব। নাবিলার বউভাত খেয়েই চলে আসব।’ 

‘তানভীরের বাবা-মা কী বলবে এসব শুনে? তোর কি মাথা ঠিক আছে?’ 

সকাল অবুঝ কিশোরীর মতো উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিল। একটা বোবা কান্নায় বুক ভেঙে যাচ্ছে। যন্ত্রণার বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠছে শরীরের শিরা-উপশিরা। কালো চুল ছড়ানো পিঠ ফুলে উঠছে কান্নার দমকে। অস্থিরচিত্ত, খ্যাপা কন্যার দিকে কিয়ৎক্ষণ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থেকে মা কাঁচুমাচু কণ্ঠে স্বগতোক্তি করলেন, ‘কী হলো হঠাৎ, কিছুই তো বুঝলাম না!” 

সকাল কান্না ভেজা মুখ বালিশ থেকে তুলল, ‘তুমি বুঝবে না। কোনোদিন বুঝবে না!’ 

মা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বোকা হয়ে। তারপর পায়ে পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। সকাল সেদিন অফিসে গেল না, দুপুরে ভাত খেলো না। সারাক্ষণ পড়ে রইল বিছানায়। সন্ধ্যার দিকে মা গাল ফুলিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা যেতে দিতে পারি এক শর্তে। তুই কথা দে ওই ছেলেটার সাথে কোনো যোগাযোগ করবি না। কথা বলবি না। 

সকাল জলভাসি চোখ নিয়ে মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর ভাঙা স্বরে বলল, কথা দিলাম।’ 

মা দেখলেন সকালের কান্না ভেজা লালচে গালের চামড়ার নিচে সোনালি রঙের দ্যুতির আচমকা আস্ফালন। বুকটা কেঁপে উঠল সহসা। মেয়েকে কিছুতেই একা ছাড়া যাবে না। তিনি সঙ্গে যাবেন। তানভীরের পরিবারের সাথে বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে। এই কথার হেরফের হওয়া চলবে না। তিনি খুব একটা বুদ্ধিমতী নন। হওয়ার চেষ্টাও কখনো করেননি। সৎ, কর্মঠ এবং বিশ্বস্ত স্বামীর সংসার করেই সুখী ছিলেন। বাইরের দুনিয়ার সাথে তাঁর সম্পর্ক বরাবরই ক্ষীণ। স্বামীর জীবদ্দশায় নিজ হাতে বাজার পর্যন্ত করেননি কখনো। ব্যাংকে যাওয়ারও প্রয়োজন পড়েনি। আজ অবধি জানেন না এটিএম বুথ থেকে টাকা কী করে তুলতে হয়। সাংসারিক গণ্ডির ভেতরেই তাঁর জীবন আবদ্ধ। তবে তিনি আধুনিকমনা নন এমনটাও বলা যাবে না। একমাত্র কন্যাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। সফল যে হননি একেবারে তা না। বাবার মৃত্যুর পর সকালই সংসারের হাল ধরেছে। এই মেয়ে আরশানকে বিয়ে করে বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে গেলে তিনি একা-একা বাঁচবেন কী করে? ভাই-বোনরা সবাই নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও বাকি জীবন কাটানো সম্ভব না। তাঁর স্বামী তাঁকে রাজরানির সম্মান দিয়েছেন আজীবন। বুড়ো বয়সে সেই মানুষটার স্মৃতি জড়ানো ভিটা ছেড়ে মেয়ের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে পড়ে থাকার কথা ভাবতে গেলেও তাঁর গা কাঁটা দিয়ে ওঠে অপমানে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *