৩
ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্ট আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনীর ইভেন্ট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। আজকের প্রদর্শনীর কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই। কয়েকটি চিত্রে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের দরিদ্র রিকশাঅলার জীবন, পাটশিল্পের ঐতিহ্যসহ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত চিত্রকর্মের নাম ‘দ্য আননোন’ (The unknown ) যে ছবিতে আরশান অজানাকে এঁকেছিল। যা ও দেখেনি কখনো, শোনেনি কখনো। নিজের ভেতরের যে অন্ধকার সত্তাকে বোঝেনি কখনো, সেই ধরা-ছোঁয়ার বাইরের কাল্পনিক অস্তিত্বের চিত্ররূপখানি বিজ্ঞজনের ঢের সমাদর কুড়িয়ে নিলো।
জনাকয়েক সাংবাদিকসহ পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল সন্ধ্যাটা। আরশান কথা বলছিল খুব কম। কোণঠাসা হয়ে বসে ছিল একটি টুলে। গম্ভীর গলায় সাংবাদিক এবং উৎসুক দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। তার মাথার চুল উসকোখুসকো। শার্টের তিনটে বোতাম খোলা। চোখে ক্লান্তির রেশ। তবু তাকে নিষ্প্রভ বা ম্লান দেখাচ্ছে না। উপস্থিত দর্শনার্থীরা চিত্রকর্মের পাশাপাশি এই কন্দর্পকান্তি চিত্রশিল্পীকেও মুগ্ধ নয়নে নিরীক্ষণ করছিল।
অ্যান্ড্রিয়ানা এলো শেষ মুহূর্তে। কোনো ভূমিকা ছাড়াই তীরের মতো ছুঁড়ে দিল প্রশ্নটা: ‘ডিড ইউ কুইট ইয়োর জব টুডে?’
হলভরতি অপরিচিত মানুষের সামনে হঠাৎ ছুটে আসা ব্যক্তিগত প্রশ্নটি আরশানকে অপ্রতিভ করে তুলল। ‘উইল টক লেটার,’ পাশ কাটানো প্রত্যুত্তর করল সে।
অধৈর্য অ্যান্ড্রিয়ানা হার মানলো না। আরশানের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো কিঞ্চিৎ নিরালায়। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘অ্যানসার মি। রাইট নাও!’
আরশান একটু অপ্রস্তুত ভাবে বলল, ‘আই অ্যাম লিভিং ভার্জিনিয়া।’
অ্যান্ড্রিয়ানার নীল চোখ থেকে ঠিকরে বেরোল বিস্ময়।
‘হোয়াট? ইউ আর লিভিং ভার্জিনিয়া?’
‘ইয়াপ…মুভিং টু স্যানডিয়াগো।’
‘ও, বয়! ইউ আর মেল্টিং মাই ব্রেইন! হোয়াই আর ইউ ডুইং দিস শিট?’
আরশান জানে তার শুষ্ক-কাষ্ঠং নির্জন পৃথিবীর কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীর মধ্যে এই মেয়েটি অন্যতম। কিন্তু আজ জীবনের এমন এক স্টেশনে সে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বন্ধুর উপদেশ বা সান্ত্বনা-বাণীটুকুকেও নিছক বিষাক্ত ছোবল বই অন্য কিছু মনে হচ্ছে না। অ্যান্ড্রিয়ানার চোখে করুণা গিজগিজ করছে। এই করুণা সহ্য হচ্ছে না। সে রুষ্ট চোখে খানিক সময় চেয়ে রইল। থেমে থেমে ধীর গলায় বলল, ‘নাথিং সিরিয়াস…আই থিংক…আই জাস্ট নিড আ ব্রেক, ইউ নো? আই নিড টাইম…টু ফিগার এভ্রিথিং আউট।’
অ্যান্ড্রিয়ানার সাদা মুখের চামড়ায় ব্যথার প্রলেপ পড়ল, ‘ওয়েইট…আর ইউ ট্রাইং টু হাইড সামথিং ফ্রম মি?’
একজন সুপরিচিত ভদ্রলোকের উপস্থিতি ওদের কথোপকথনে বাধ সাধল। অ্যান্ড্রিয়ানাকে উপেক্ষা করার উপায় পেয়ে গেল আরশান। সত্যি বলতে কি, সকালের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার পর থেকে অ্যান্ড্রিয়ানার চোখের দিকে তাকাতে তার অদ্ভুত এক সংকোচ বোধ হয়। মনে হয় যেন মেয়েটির নীল চোখজোড়া অষ্টপ্রহর ভর্ৎসনার সুরে কটাক্ষ করে যাচ্ছে, গঞ্জনা দিয়ে বলছে: আমার ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করে খুব তো গিয়েছিলে অন্য নারীর কাছে। এখন কী হলো? কী পেলে আমাকে অবহেলা করার বিনিময়ে? হয়তো সবটাই আরশানের হীনম্মন্যতা। হয়তো এসব নচ্ছার ভাবনার ছিটে- ফোঁটাও মেয়েটির মনের মধ্যে নেই। তবুও আরশানের আজকাল কুণ্ঠা হয়। মনটা ছোটো হয়ে থাকে। একবারই তো ভালোবেসেছিল। জীবনের আটাশটা বসন্ত কেটে যাবার পর খুঁজে পেয়েছিল সেই বিশেষ মানুষীকে, যার হাতে হাত রেখে একসাথে বৃদ্ধ হবার পরিকল্পনা আঁটা যায়। স্বপ্ন দেখা যায়। বলতে সংকোচ হয়, তবুও একথা সত্য যে, সকালকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নটা ভেঙে গেছে। এসব স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প তার কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। যেভাবে বলতে ইচ্ছে করেনি মাতৃহীন শৈশবের একাকীত্বের কথা। এমনকি নিজের জন্মদাতা পিতার বিশ্বাসঘাতকতার গল্পটাও নিজ মুখে কারো সামনে আজ অবধি প্রকাশ করতে পারেনি। আর এখন… এখন সকাল যে তাকে ব্যবহৃত কাগজের মতো দুমড়ে মুচড়ে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনে পা রাখতে যাচ্ছে, সেই অপমানের গল্প, ব্যর্থ প্রেমের গল্প অ্যান্ড্রিয়ানাকে বলবে কোন সাহসে?
চাকরি ছেড়ে দেবার দরখাস্ত দেওয়া সত্ত্বেও এই মাস পুরোটাই কাজ করতে হবে। আগামী সপ্তাহে ফাহাদ নাবিলার রিসিপশন পার্টি আছে। দুমাস আগে ঢাকায় সম্পন্ন হয়েছিল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। আরশান যায়নি। যেতে পারেনি। যে শহরে তার নব জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর খোদাই হবার কথা ছিল, যে শহরে ঠিক বিয়ের আগের দিন হবু স্ত্রীর বাবা সম্পূর্ণ বিনা নোটিশে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, এবং সেই আকস্মিক মৃত্যুর দায়ভার অনেকাংশেই এসে পতিত হয়েছিল তার ঘাড়ে, যে শহরে হারিয়েছে সে তার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা, সেই শহরে…হ্যাঁ, ঠিক সেখানেই ছোটোভাইয়ের বিয়ের বরযাত্রী হয়ে আনন্দযজ্ঞে শামিল হবার মতো উদার আরশান হতে পারল না। এসব ঘটনা মনে পড়লে নিজেকে কপর্দকশূন্য নিকৃষ্ট জীব বলে মনে হয়। সকালকে পাবার জন্য একরকম পাগলই হয়ে গিয়েছিল। রোজ নানা ইঙ্গিতে নানা ভাবে বলতে চাইত সেই কথাটা যে কথাটা হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে যেত অনায়াসে, কিন্তু ঠোঁটের কিনারে পৌঁছনো মাত্র কোনো এক আশ্চর্য অবিদিত কারণে বারংবার থমকে যেত। সকালকে যে সে ভীষণ ভাবে চায় সেই ব্যাকুলতা, সেই টান প্রকাশ করার মতো উপযুক্ত শব্দ বুঝি নেই পৃথিবীর তাবৎ ডিকশনারিতে। বিশেষ করে যে মেয়েটির বাবা মারা গেছে কদিন আগে, যে মেয়ে পিতৃশোকে কাতর, সে মেয়েকে নির্লজ্জের মতো বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কৌশল তার অজানা ছিল। তবুও মুখ ফুটে বলে ফেলল ফাহাদের বিয়ের মাসখানেক আগে।
‘সকাল, আপনি আন্টির সাথে কথা বলেন। বার বার ছুটি ম্যানেজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এবার দেশে গেলে আপনাকে নিয়ে আসব।’
সকাল হাসে। ‘বিয়ে তো নাবিলার হবে, আমার না।’
আরশান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। শান্ত অথচ গভীর গলায় ধীরে ধীরে বলে, ‘আপনি তো জানেন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম…এখনো চাই!’
সকাল কোনো যুতসই প্রত্যুত্তর করল না। মিউমিউ স্বরে কী যেন একটা বলে লাইন কেটে দিল। পরদিন আরশান আবারও বেহায়ার মতো প্রসঙ্গটা তুলল, ‘কথা বলেছেন আন্টির সাথে?’
সকালের কণ্ঠস্বর ভারী শোনাল, ‘কথা বলার কিছু নেই আসলে।’
‘বুঝলাম না।’
‘মায়ের ধারণা আপনার সাথে বিয়ে হলে আবার কিছু একটা অঘটন ঘটবে। হয় মা মরে যাবে, নয় আমি মরে যাব। নইলে আমাদের মরা বাচ্চা হবে।’ কথাটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মতো চিলিক কেটে গেল আরশানের মেরুদণ্ডে। বুকের রুক্ষ শুষ্ক জমিনে চিরচির করে ফাটল ধরার আওয়াজ শুনতে পেলো সে। ওদিকে সকাল অপ্রকৃতস্থের মতো হাসছে। হাসিতে হোঁচট খাওয়া কণ্ঠে বলছে, ‘কী ভয়ঙ্কর রকমের বোকা আমার মা, তাই না?’
আরশান বাড়ি ফিরল রাত নটায়। রহমান সাহেব প্যাটিয়োতে বসে ছিলেন। আরশানের কালো রঙের টয়োটা কনভার্টিবল লনে এসে থামতেই মোশন সেন্সর লাইট জ্বলে উঠল চারপাশ আলোকিত করে। আড়চোখে পিতাকে লক্ষ্য করল সে। ঠান্ডা মাথায় গ্যারেজে গাড়ি রাখল। রহমান সাহেব চুপচাপ বসে থেকে পুত্রের অস্তিত্ব অনুভব করলেন। বাড়ির ভেতর থেকে গান বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। নতুন বউ আসার পর থেকে বাড়ির পরিবেশ বেশ উৎফুল্ল থাকে। বউয়ের বাবা-মা এসেছে বাংলাদেশ থেকে, রিসিপশন পার্টিতে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে। সামনের সপ্তাহে অনুষ্ঠান। ফাহাদের মা ছেলের বউভাতে জাঁকজমকের কমতি হতে দেবে না। বর্ণাঢ্য আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। অনিকের এখন সেমিস্টার ব্রেক। দুদিন হলো এ বাড়িতে এসেছে সে। ছুটিটা এখানেই কাটাবে। টিলির বান্ধবীরা নাচের প্রাকটিস করে রোজ। অনুষ্ঠানের আগ দিন পর্যন্ত চলবে এই অনুশীলন। নতুন বউয়ের সাথে টিলির বেশ খাতির হয়েছে। সারাদিন ফুসুর ফাসুর গল্প করে। শপিংয়ে যায়। রাত জেগে নানারকম গেইম খেলে ওরা চারজন। ফাহাদ, নাবিলা, টিলি আর অনিক। অফুরান আড্ডায় ঘর মুখর হয়ে থাকে। কদিন বাদে নিউইয়র্ক থেকে ফাহাদের মার আত্মীয়-স্বজনরা চলে আসবে ভার্জিনিয়ায়। এই ভরা সংসার ভালো লাগে রহমান সাহেবের। স্ত্রী, পুত্র-কন্যার সুখে তিনিও সুখী হতে চান। কিন্তু আরশানের অমানবিক নিঃসঙ্গতা তার ভেতরটাকে বীভৎস কীটের মতো কুরে কুরে খায়। ছেলেটা তাকে আজও ক্ষমা করেনি। কখনো সামনে এসে এক দণ্ড দাঁড়ায় না। চোখে চোখ রাখে না। প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না। বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সাথেও তার সম্পর্ক এখন মৃতপ্রায়। সারাক্ষণ বেজমেন্টের বদ্ধ ঘরে একলা বসে থাকে, জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। আজকাল অফিসও নাকি কামাই করে যখন-তখন। ছেলেটা তাঁর চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বাবা হয়ে কিছুই করতে পারেন না। এক ভয়ঙ্কর অসহায়ত্ব তাঁকে দগ্ধ করে চলে দিবা রাত্রি।
ভেতর থেকে ইংরেজি গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। ছেলে-মেয়েরা হইচই করছে। বাইরে অক্টোবরের হিমগন্ধি রাত। আকাশে সবুজ খইক্ষেতের মতো ফুটে আছে অজস্র নক্ষত্র। রহমান সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। ধূমপানের অভ্যাস বর্জন করেছিলেন সুস্বাস্থ্যর খাতিরে। কদিন হলো পুরনো অভ্যাস ফিরে এসেছে। মৃত্যুর ঘণ্টা যখন বাজার আপনাআপনিই বাঁচবে। সচেতনতায় মৃত্যু প্রহর থমকে থাকে না। তাঁর বন্ধু অর্থাৎ সকালের আব্বা বড়োই স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। লাভ কী হলো? চলে গেলেন অসময়ে। বড়ো বেশি অসময়ে! ভুল মুহূর্তে।
সাদা আর বাদামি চামড়ার একদল তরুণ-তরুণী হইচই করে বেরিয়ে এলো সদর দরজা ঠেলে। এদের কেউ গাড়ি নিয়ে এসেছে, কেউ এসেছে সাইকেল চালিয়ে। হাস্য- কোলাহল মাখা পরিবেশে হঠাৎ ভেসে এলো ভায়োলিনের করুণ সুর। ছেলে-মেয়েরা সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল।
কে যেন বলল, ‘হু ইজ প্লেইং ভায়োলিন? সো বিউটিফুল!’
‘মাই ব্রাদার…ইটস মাই ব্রাদার…!’ গর্বিত টিলি উত্তর দিল।