সেদিন অক্টোবর – ২

ব্যাংক থেকে বেরোনোর সময় ঘড়ির কাঁটা ছিল সাতটার ঘরে। দুই ঘণ্টার ট্র্যাফিক জ্যাম ঠেলে সকাল বাড়ি পৌঁছুলো ঠিক নটায়। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। ড্রয়িংরুমে তানভীর বসে ছিল। মা ডাইনিংয়ে। সকাল ঘরে ঢুকতেই জরুরি গলায় বললেন, ‘খাবার দিচ্ছি। হাতমুখ ধুয়ে আয়।’ 

তানভীর উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখে ঝকঝকে হাসি। সকাল নিঃস্পৃহ নেত্রে তাকাল। 

‘কী খবর?’ 

‘এই তো। খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে তোমাকে।’ 

‘হুম,’ ছোটো করে শব্দটা উচ্চারণ করল সকাল। মনে মনে বলল, দশটা ছয়টা অফিস করে রাজ্যের জ্যাম ঠেলে বাড়ি ফেরার পর মানুষকে টায়ার্ড দেখাবে না তো কি সিনেমার নায়িকা দেখাবে? ফাজলামো যত্তসব! বেডরুমের দিকে পা বাড়ালো সে। বাবা চলে যাবার পর থেকে বাড়িটা খুব ফাঁকা- ফাঁকা! ফ্ল্যাটের প্রতিটা ইট, কাঠ-পাথরে একাকীত্ব এবং বিষণ্ণতার ভয়াবহ আস্ফালন। অফিস যাবার পর মা বাসায় একলা থাকেন। একদম একা! বাবার স্মৃতি জড়ানো ঘরে একা একা দিন কাটাতে কেমন লাগে মায়ের? দম বন্ধ হয়ে আসে না? তানভীরদের বাড়ি খুব কাছে। এই বিয়েতে রাজি হবার পেছনে এটি একটি বিশেষ কারণ। ইচ্ছে হলেই সময়ে অসময়ে মায়ের কাছে চলে আসা যাবে। সকাল দেশান্তরী হলে মা একা একা বাঁচবেন কী করে? কে দেখবে তাঁকে অসুখে-বিসুখে? আরশান বেড়ে উঠেছে মার্কিন মুলুকে। তার মন মানসিকতায় পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব আছে। মাতৃভাষা বাংলায় চমৎকার দখল থাকা সত্ত্বেও আদতে সে ষোলো-আনা বাঙালি নয়। ঢাকা শহরের গরম, যানজট, ধুলোবালিতে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তেল-মসলাঅলা খাবারও সহ্য হয়নি। সেই ছেলেকে সকাল কোন মুখে সব ছেড়ে-ছুঁড়ে তাকে বিয়ে করে বাংলাদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ার প্রস্তাব দেবে? 

রোজ অফিস থেকে একাধিক বার বাড়িতে ফোন করে সে। সারাদিন দুশ্চিন্তায় গাঁট হয়ে থাকে মনটা। একলা অসহায় মাকে ফেলে রেখে চিরতরে পৃথিবীর উলটো পিঠে উড়াল দেবার কথা ভাবতে গেলেই গা শিউরে ওঠে। মাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বাবা বেঁচে থাকতেই ভিসা হয়ে গিয়েছিল দুজনের। টুরিস্ট ভিসা। মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ি ভ্রমণের সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন বাবা। স্বপ্ন দেখেছিলেন পুরো পরিবারের সাথে একত্রে বিদেশ যাত্রার। স্বপ্ন দেখেছিল সকালও। আরশান, বাবা-মা, রহমান চাচা, চাচি, ফাহাদ, নাবিলা, টিলি…সব্বাই একসাথে নায়াগ্রাফলস দেখতে যাবে। বাবার খুব ক্যাম্পিংয়ের শখ ছিল। সকাল ঠিক করেছিল একরাতে হরিণডাঙায় ক্যাম্পিং হবে। বারবিকিউ হবে। আরশান ভায়োলিন বাজাবে, নাবিলা গান গাইবে, টিলি হয়তো নাচবে…এরকম আরো কত মিঠা মিঠা স্নিগ্ধ স্বপ্ন যে এক টুকরো মনটায় ঘর বেঁধেছিল! স্বপ্ন দেখেছিল ব্লুরিজ মাউন্টেনের ধারেকাছে ওদের একটা কাঠের দোতলা বাড়ি হবে। খুব বেশি রাজসিক নয় বরং একটু রাস্টিক, বুনো আর মধ্যবিত্ত ঘরানার। বাড়ির সামনের লনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবে মেপল আর চেরি গাছ। বসন্তে চেরিগাছ মুক্তোদানায় ভরে যাবে আর অক্টোবরে মেপল লিফ সারা গায়ে আলতারঙ মাখবে। ছুটির দিনের মনোরম বিকেলগুলোয় আরশান ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বসবে গাছতলায়। নকশাকাটা টার্কিশ টিপট দিয়ে সকাল চায়ের টেবিল সাজাবে। আরশানের লম্বা, ঘন পল্লব ঘেরা সুন্দর চোখজোড়া যখন ছবি আঁকায় বিভোর হবে, সকাল তখন গরম চায়ের ধোঁয়া মেশানো বিকেল শেষের হলুদ আলোর ভেতর দিয়ে চুপটি করে চেয়ে চেয়ে দেখবে ওকে। আরশান হয়তো কাজ থামিয়ে তেরছা গলায় বলবে, ‘কী দেখছেন?’ 

‘আপনাকেই দেখছি।’ 

‘আমাকে তো রোজই দ্যাখেন।’ 

‘এত দেখি, তবু কেন শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে বলেন তো? এই সমস্যার সমাধান কী?’ 

এসব লুতুপুতু কথা শুধু কল্পনাতেই বলা যায়। ফোনালাপের সময় সকাল কখনোই মনের কথা গুছিয়ে পেশ করতে পারেনি মানুষটার সামনে। অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্য ওরা কেউই শতভাগ দায়ী নয়। দুজনের মধ্যকার জড়তা এবং দূরত্ব কাটিয়ে ওঠার উপযুক্ত বা পর্যাপ্ত সময় কখনোই আসেনি। পিতার মৃত্যুর পরবর্তী কয়েকমাস সকাল কেমন অপ্রকৃতস্থ আচরণ করত। ফোন ধরত না। ধরলেও ঠিকঠাক কথা বলত না। পিতৃবিয়োগের চার মাসের মাথায় সে একটু ধাতস্থ হয়ে উঠতেই আরশান বলেছিল, ‘সকাল, আন্টিকে নিয়ে চলে আসেন ইউএস।’ 

‘চলে আসব?’ 

‘হুম। আসবেনই তো। হরিণডাঙার রাজত্ব আমি আর কতদিন সামলাবো? এবার নিজ দায়িত্ব বুঝে নিন।’ 

করোনা মহামারির মধ্যে ইউএস-এ উড়াল দেওয়া খুব একটা উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ছিল না। তবুও আরশানের প্রস্তাবটা সকালকে ভেতর ভেতর চঞ্চল করে তুলেছিল। পরদিন ডিনারের টেবিলে প্রসঙ্গটা তুলেছিল সে। মা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। যেন এত অদ্ভুত কথা তিনি জীবনে কোনোদিন শোনেননি। উত্তর দিলেন না। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অন্ধকার ঘরে খুব নিচু গলায় বললেন, ‘সকাল জানিস, তোর চাচা-চাচিরা বলছে আরশানের সাথে তোর বিয়েটা না হওয়াই ভালো।’ 

এসব কথা আগেই কানে এসেছে। তবুও মায়ের মুখনিঃসৃত বাক্যটা ওর হৃৎপিণ্ডে শেলের মতো বিঁধল। 

‘কেন, মা? ভাগ্যে যা লেখা ছিল তাই ঘটেছে। এখানে আরশানের কী দোষ?’ 

‘দোষ-গুণ বুঝি না। তবে বিয়ের আগের রাতে মেয়ের বাবার মৃত্যু ভালো লক্ষণ নয়। খোদা আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।’ 

বুক মোচড় দিয়ে উঠল কষ্টে। কী ভীষণ খারাপ যে লাগল কথাটা শুনতে! এমন কিছু শোনার আগে তার মৃত্যু হলো না কেন? অপ্রতিরোধ্য যন্ত্রণায় গুঁড়িয়ে যেতে লাগল পাঁজরের হাড়। কিছু বলতে পারল না সে। শুধু কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। মা বললেন, ‘কাঁদছিস কেন? তোর কাছে কি নিজের বাবা-মায়ের জীবনের চাইতে ওই ছেলের দাম বেশি? প্রথমে তোর বাবার জীবন খেয়েছে ছেলেটা। এরপর দেখবি মায়ের জীবন ধরে টান দেবে।’ 

সকাল কান চেপে ধরল দুহাত দিয়ে, ‘প্লিজ, চুপ করো!” 

মা শোয়া থেকে উঠে বসলেন। সকালের কাঁধ ধরে একটা সজোর ঝাঁকুনি দিয়ে পাগলের প্রলাপ বকার মতো বললেন, ‘যেই বিয়ের আগের দিন তোর বাপের জীবন চলে গেল, সেই বিয়ে করার জন্য তুই দুদিন বাদেই পাগল হয়ে গেলি? তুই কি আমার মেয়ে? তোকে আমি পেটে ধরেছি?’ 

‘যা হয়েছে তা শুধুমাত্র একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া কিছুই নয়। অশিক্ষিত লোকের মতো কথা বলছ কেন?’ 

মা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘আমাদের প্রথমেই সম্মতি ছিল না এই বিয়েতে। আমি নিষেধ করেছিলাম তোমাকে এই সম্পর্কে জড়াতে। বাবা-মায়ের অবাধ্য হলে এরকমই হয়। এখন শিক্ষা হয়েছে? ছেলেটার মা ছিল দুশ্চরিত্রা। এমন মহিলার ছেলে ভালো হবে কী করে?’ 

সকাল দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘চুপ করো! প্লিজ চুপ করো! আরশানের মা নির্দোষ ছিল। তুমি তো সব জানো। সব কিছু বলা হয়েছে তোমাকে। তবুও এসব বিশ্রী কথা কেন বলছ?’ 

‘বলছি কারণ তোমার আক্কেলের অভাব হয়েছে। এর সাথে বিয়ে হলে হয় আমি মরব নয় তুমি মরবে। আমি কিছুতেই এমন অপয়া পরিবারে মেয়ে দেব না। 

সকাল কাঁদতে লাগল। ‘যা হয়েছে তাতে আরশানের কোনো ভূমিকা নেই। বোঝার চেষ্টা করো।’ 

মাকে অপ্রকৃতস্থ উন্মাদিনীর মতো দেখাচ্ছিল। খসখসে, চাপা এবং অসংলগ্ন গলায় বললেন, ‘তাহলে এতদিন তোর বাপ মরে নাই কেন? বিয়ের আগের দিনই কেন মরল?’ 

রক্তে বিষের ছোবল টের পাচ্ছিল সকাল। তারছেঁড়া পাগল পাগল কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করল সে। তারপর বারুদময় তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি তাহলে আর কোনোদিন বিয়েই করব না। যেহেতু আমার বিয়ের আগের দিনই আল্লাহ আমার বাবাকে নিয়ে গেলেন। এর মানে উনি চান না আমার বিয়ে হোক।’ 

হঠাৎ একটা শক্তিশালী চড় এসে পড়ল বাঁ-গালে। স্তম্ভিত সকাল কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাকে বলতে শুনল, ‘চুপ কর! একদম বাজে বকবি না! বেয়াদব!’ 

সকাল গালে হাত চেপে ধরে নিজের এত বছরের পুরনো মায়ের দিকে বিস্ফারিত লোচনে তাকিয়ে রইল। থরথর করে কাঁপতে লাগল ওর সুন্দর, সুগঠিত, নিখুঁত দুটি গোলাপি রঙের ঠোঁট। বাবা বেঁচে থাকলে মা এই কাজটা করতে পারতেন? সকাল তো বাবার প্রিন্সেস ছিল। বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন সকাল শেহজাদি। ওই মানুষের উপস্থিতিতে তার শেহজাদির গায়ে একটি আঁচড় দেওয়ারও সাহস ছিল না কারো। বাবা জানতেন সকাল তার প্রিন্স চার্মিং-কে খুঁজে পেয়েছিল, খুঁজে পেয়েছিল হরিণডাঙার রাজ্য। একবার বাবাকে নিয়ে হরিণডাঙায় যাবার বড়ো সাধ ছিল ওর। হলো না…কিছুই হয় না কেন যেন মনের মতো করে…মানুষের জীবনে রূপকথার রাজ্যের মতো হ্যাপিলি এভার আফটার বলে কিছু নেই…মানুষের জীবনের পুরোটাই ধোঁকা…ফাঁকা…আর মিথ্যে গল্পে ঠাঁসা। 

পরদিন মা আরশানকে সরাসরি বলে বসলেন, ‘তুমি আমার মেয়েকে আর ফোন করবে না।’ 

স্তম্ভিত, ভগ্নহৃদয় আরশান কোনোরকমে বলতে পেরেছিল, ‘কেন? আমার অপরাধটা কী জানতে পারি?’ 

‘আমি বাপু এত কৈফিয়ত দিতে পারব না। তোমাকে আমি আমার মেয়ের জীবনে চাই না, এটাই শেষ কথা!’ 

অগত্যা, নিরুপায় সকালকে একটা গোপন ফোনের ব্যবস্থা করতে হলো। রাতে মা ঘুমিয়ে পড়ার পর লুকিয়ে লুকিয়ে কল করত সে আরশানকে। কথা হতো খুব অল্প সময়। তাও গুরু-গম্ভীর সব আলোচনা। মহাশয়ের ভাবটা এমন যেন সভ্য পৃথিবীতে ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা মন খুলে বলতে নেই। ওসব সস্তা ন্যাকামো। ভালোবাসলে নাকি এমনিই টের পাওয়া যায়, বলতে হয় না বারে বারে। বরং কথা বলতে থাকো পৃথিবী নিয়ে। সিরিয়ান সিভিল ওয়ার, ইকোনমিক রেসিশন, কলোম্বিয়ান কনফ্লিক্ট আর প্যান্ডেমিক হিস্ট্রি নিয়ে। যে মানুষ প্রকৃতি-প্রেমিক, যার বুকে একটা শিল্পীর মন আছে, সে কেন প্রেয়সীর সাথে সর্বদা খটোমটো বৈষয়িক বা বৈশ্বিক আলাপ করবে তা এক দুর্বোধ্য রহস্য। সকাল অবশ্য স্বচ্ছন্দে অংশগ্রহণ করত আলোচনায়। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও তার নিজস্ব জানাশোনার বিস্তার সংকুচিত নয়। আড্ডা জমে যেত। কখনো কখনো মনে হয়েছে মায়ের হুমকি শোনার পর থেকেই আরশান নিজেকে একটু গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। সকাল চুরি করে তার সাথে কথা বলছে, যোগাযোগ করছে, বিষয়টা একজন বিবেচক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তার মেনে নিতে হয়তো কষ্ট হচ্ছিল। এই গাম্ভীর্য সবসময় ভালো লাগত না। মন চাইত সাধারণ আদর্শ প্রেমিকের মতো আরশানও কখনো ভালোবাসার কথা বলুক, প্রশংসা করুক, সরাসরি না হলেও গানে কিংবা কবিতায়। বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে কিন্তু বলেছিল, ‘আপনাকে আমি ভালোবাসার চাইতেও বেশি ভালোবেসেছি।’ তা এখন সেই ভালোবাসা কোন দরজা দিয়ে পালিয়েছে? টেক্সট পাঠানো হয়েছে নয় ঘণ্টা আগে। জানানো হয়েছে তার প্রেমিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অন্যত্র। জানার পরেও দাম্ভিক ছেলেটা একটা ফোন পর্যন্ত করেনি! ওর জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ হলে এতক্ষণে দুনিয়া উলটে দিত। ভালোবাসার নারীকে জয় করার জন্য, নিজের করে পাবার জন্য পুরুষমানুষ জীবন বাজি রাখতেও দ্বিধা করে না। খালাতো বোন রুমকির বয়ফ্রেন্ড সেদিন খালা-খালুর সামনে বুক চিতিয়ে বলে গেছে—’আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি। ওর অন্য কোথাও বিয়ে দেওয়ার কথা ভুলেও ভাববেন না!’ কী সাহসী ছেলে! কী দারুণ কনফেশন! পরিবারের মুরুব্বিরা ছেলেটাকে বেয়াদব বলে আখ্যায়িত করলেও সকালের কিন্তু বেশ লেগেছে। প্রেমিক হলে এমনই হতে হয়। অকপট, নির্ভীক আর বেপরোয়া। আরশানের মতো নাকউঁচু, ডাঁটিয়াল ছেলেরা আর যাই হোক না কেন, কখনো সত্যিকারের প্রেমিক হতে পারে না। স্বার্থপরের রাজা একটা! শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রাগে গজগজ করছিল সকাল। মুখে অসন্তোষের কুঞ্চিত রেখা। ঠোঁটে বিরক্তি। ছেলেটা এমন কেন? এত বড়ো ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ শোনার পরেও কী করে এমন নির্বিকার নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে? এই নীরবতার অর্থ কী? ইশ…কোন দুঃখে যে এই অহংকারী লোকটাকে ভালোবাসতে গিয়েছিল সকাল! ফাহাদ আর নাবিলাকেই দ্যাখো না… কত্ত সুখী ওরা। সত্যি ফাহাদের মতো ছেলে হয় না। বলতে নেই, আজকাল ওদের দুজনকে দেখে সকালের একটু একটু হিংসে হয়। না না…ঠিক হিংসে বা ঈর্ষা নয়। প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে কি ঈর্ষা করা সম্ভব? আর ফাহাদকেও তো সে ছোটো ভাই হিসেবেই মেনে নিয়েছে। ঈর্ষা নয় গো, ঈর্ষা নয়! সকাল অতটাও নিকৃষ্ট আর ইতর হয়ে উঠতে পারেনি এখনো। ভাবতে ভাবতে ভাবনার পালে অন্যরকম হাওয়া এসে লাগে। মনটা ভয়ঙ্কর খারাপ হয়ে যায়। নাবিলাকে সে সত্যিই ঈর্ষা করে না বা করতে চায় না। তবে অকাট্য সত্য হলো আজকাল ওদের নিরন্তর, নিশ্ছিদ্র, নিখুঁত সুখের গল্পগুলো সকালকে বারেবারে নিজের অতৃপ্তি এবং অপ্রাপ্তির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ফাহাদ তো বড়ো ভাইয়ের আগেই বিয়ে করল। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে প্রায় বছর দেড়েকের জন্য থমকে ছিল গোটা বিশ্ব। কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক। ফাহাদকে আর ঠেকানোর সাধ্য আছে কার? নিজ উদ্যোগে দু- মাস আগে দেশে এসে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করল। আরশান ব্যতীত পরিবারের অন্য সব সদস্যই উপস্থিত ছিল এই বিয়েতে। আগামী সপ্তাহে ফাহাদ নাবিলার রিসিপশন পার্টি হবে ভার্জিনিয়ায়, স্প্রিংফিল্ডের বাড়িতে। ফাহাদ সাহসী এবং আদর্শ প্রেমিক। ও যা পারে, আরশান তা পারে না। আরশানের ধাতটাই যেন কেমনতর। শুধুমাত্র নিজের আত্মসম্মান বোধটুকু ছাড়া বাদবাকি সব পার্থিব বস্তু তার কাছে মূল্যহীন। ওই যে ড্রয়িং রুমে বসে আছে কৃশকায় দেখতে ভদ্রগোছের তানভীর, সেও সকালের জন্য অনেক অসাধ্য সাধন করতে রাজি আছে যা কিনা আরশানের কাছে মনে হবে ভণ্ডামি বা ন্যাকামো। তানভীর কিন্তু পাত্র হিসেবে বেশ উপযুক্ত। কার্ডিয়াক সার্জন। অ্যাপোলোতে লাখ টাকা বেতনের চাকরি করে। বাবা-মা আর দুই ভাই-বোনের ছিমছাম পরিবার। সকাল বিয়ের পর সুখ না পেলেও নিঃসন্দেহে সুনিশ্চিত এবং সম্মানিত এক জীবন পাবে। মায়ের কাছাকাছি থাকতে পারবে। তবুও জানে না কেন ব্যাটাকে দেখলেই একটা তিতকুটে বিরক্তি ভাব পা থেকে মাথা পর্যন্ত চিড়বিড়িয়ে ওঠে। আরশান কেন চুপ করে আছে? কেন সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে এসে তানভীরের সাথে ঠিক হওয়া বিয়েটা ভেঙেচুরে খান খান করে দিচ্ছে না? কেন জোর করে, বলপ্রয়োগ করে সকালকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না? এলোমেলো ভাবনাগুলো মাথায় ছোবল মারতে মারতে একসময় থমকে যায়। বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সকাল। আরশানের আসলে দোষ নেই। মা কী করে যেন গোপন ফোনটার হদিস পেয়ে গেলেন। অভিমানী কিশোরী বালিকার মতো কেঁদেকেটে বললেন, ‘তুমি এখুনি চলে যাও আমেরিকা। আমাকে এভাবে ধোঁকা দিলে? তোমার মতো মেয়ে আমার প্রয়োজন নেই। আমি একাই থাকব।’ 

ওদিকে আরশানও একটু একটু করে বুঝতে পারছিল যে সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে। সাত-পাঁচ ভেবে দেশে আসার এয়ার টিকেট বুক করার চেষ্টা করল। দুর্ভাগ্যবশত সেই সময়েই বাংলাদেশ সরকার করোনা ভাইরাসের কারণে ইংল্যান্ড, চীন, হংকং, থাইল্যান্ড ছাড়া সব দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছিল। দেশে আর আসা হলো না। এদিকে সকালের গোপন ফোনটাও আর আগের মতো ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছিল না। মায়ের চোখ কান গোয়েন্দার মতোই সন্দিগ্ধ এবং সজাগ সর্বদা। যেন আরশানই তার জীবনের একমাত্র শত্রু। এভাবেই দিন কাটতে লাগল। খুব একটা যোগাযোগ হতো না দুজনের মধ্যে। ভোরে অফিস থাকার কারণে সকাল রাত জাগতে পারত না। দুই দেশের টাইমজোনও ভিন্ন। হয়তো সকাল ফোন দিয়েছে এমন সময় যখন আরশান ব্যস্ত অফিসের কাজ নিয়ে। ঘণ্টাখানেক পরে মিসড কল পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে কল ব্যাক করেছে। কিন্তু সকালের তখন গভীর রাত। ফোন সুইচ অফ করে মায়ের পাশে শুয়ে পড়েছে সে। এভাবেই যোগাযোগ ক্ষীণ হতে লাগল। কথা হয় না, দেখা হয় না! তবুও মনে পড়ে সারাক্ষণ! মনে পড়ার যন্ত্রণায় সকাল নিশ্বাসটুকুও ঠিকঠাক নিতে পারে না মাঝে মাঝে। অগ্নিদগ্ধ মনটা কেবলই নারকীয় এই জীবন থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। শেষবার ফোনে কথা হলো ফাহাদ- নাবিলার বিয়ের আগে। টিলির নম্বর থেকে ফোন করেছিল আরশান। 

সেলফোনটা বেজে যাচ্ছিল ঝনঝন করে। ভাবনায় ছেদ পড়ল সকালের। ধরতেই ওপাশ থেকে নাবিলার উদ্বেগ মিশ্রিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। 

‘কী রে? থাকিস কই? কতবার ফোন করলাম।’ 

‘শাওয়ার নিচ্ছিলাম। কী খবর তোর?’ ক্লান্ত শোনাল সকালের গলা। 

‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালোই। তুই কেমন আছিস? আরশান ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে এর মাঝে?’ 

সকাল লাউড স্পিকার অন করে ফোনটা রাখল ড্রেসিং টেবিলের ওপর। আয়নার সামনে টুলের ওপর বসে ভেজা চুলে ঝাড়ন দিতে দিতে কিছুটা নিঃস্পৃহভাবে বলল, ‘কথা হোক বা না হোক, কী আসে যায়?’ 

‘তুই টিকেট করেছিস?’ 

‘তোর মাথাটা গেছে, নাবিলা।’ 

‘আমার মাথা ঠিকই আছে। তোকে আসতেই হবে আমার ওয়ালিমায়। তুই না আসলে কোনো অনুষ্ঠান হবে না।’ 

সকাল ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়ল। ‘মা বাসা থেকেই বের হয় না। দেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ 

‘বাসা থেকে বের হয় না কেন?’ 

‘বাসায় থাকলে তার মনে হয় বাবা কাছে আছে। তাছাড়া কোভিডের ভয় যায়নি এখনো। তার ধারণা বাইরে বেরোলেই করোনা হবে।’ 

‘কোভিডের ভয় নিয়েই এখন বাঁচতে হবে। এই জিনিস দুনিয়া থেকে সহজে যাবে না। দেড়টা বছর তো আমরা সবাই ঘরবন্দি হয়ে থাকলাম। জীবন থেকে অনেকগুলো সময় চলে গেল। আর কত ভয় পাবো। তুই ফোনটা আন্টিকে দে আমি বুঝিয়ে বলছি। 

‘বাদ দে দোস্ত।’ 

‘তোকে আসতেই হবে।’ 

‘বিয়ে খেতে আমেরিকা যাবার মতো শৌখিনতা আমাদেরকে এখন মানায় না! অনেস্টলি স্পিকিং, ফিন্যানশিয়াল অবস্থা খুব একটা ভালো না। বাবা আমাদের জন্য শুধু এই বাড়িটাই রেখে যেতে পেরেছেন। ব্যাংক ব্যালেন্স আছে অতি সামান্য। একটু গুছিয়ে নেই। তারপর আসব ইনশা-আল্লাহ।’ 

নাবিলা খানিক সময় চুপ করে রইল। তারপর কণ্ঠস্বর অন্য স্তরে নিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘আরশান ভাইকে দেখলে অনেক খারাপ লাগে জানিস? একদম মুষড়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলে না। একসাথে খাবার খায় না। আমার শ্বশুরের চোখে চোখে তাকায় না। শ্বশুর আব্বা কষ্ট পান ঠিকই, কিন্তু চুপচাপ মানুষ তো কিছু বলেন না।’ 

সকাল বুকে একটা চাপ অনুভব করল। বাবা মারা যাবার পর থেকে মন অনেক বেশি দুর্বল হয়ে গেছে। কষ্টের কথা সহ্য করতে পারে না। হাঁসফাঁস লাগে। শ্বাসরুদ্ধ গলায় বলল, ‘আরশান সব সময়ই এরকম। একরোখা, জেদি, ইন্ট্রোভার্ট। নিজের বাবাকেই ক্ষমা করতে পারছে না। অন্য লোকের সাথে ঘর করবে কী করে বল? এই ছেলের কিছুই হবে না। এভাবেই থাকবে। নিজে জ্বলবে, আপনজনদেরকেও জ্বালাবে।’ 

‘এত নিষ্ঠুর হোস না, দোস্ত। তুই উনার পাশে থাকলে এরকম হতো না।’ 

‘আমি পাশে থাকলে ছাই হতো। যেই লাউ সেই কদু। এই ব্যাটা পালটাবে না,’ থামল সকাল। সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘তোর আরশান ভাইয়ের কোনো গার্লফ্রেন্ড হয়নি?’ 

নাবিলা হাসে। ‘হলে তো তুই জানতি।’ 

‘এখন তো কথাই হয় না সেভাবে। জানব কী করে?’

‘উনার একটা ব্লন্ড কলিগ আছে না? কী জানি নাম? ওই ছেমড়ি তো সারাক্ষণ আশেপাশে ঘুরে। ডিসিতে দেখেছি।’ 

সকাল উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। ‘কী দেখেছিস? কী করছিল?’

নাবিলা ফিচেল গলায় বলল, ‘চুমু খাচ্ছিল।’

আঁতকে উঠল সকাল। ‘কী?’ 

‘কী আবার! বললাম তো।’ 

‘সত্যি?’ সকালের কণ্ঠস্বর ফাটা বাঁশির মতো বেসুরো শোনাল। 

‘হুম।’ 

একদম চুপ হয়ে গেল সকাল। যেন শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। 

‘থাম্বু খাইলি ক্যান? মিথ্যা বলেছি। চুমু খাচ্ছিল না, ভ্যাপিয়ানোর পাস্তা খাচ্ছিল।’ 

‘মিথ্যা বললি কেন?’ অনেকক্ষণ ধরে আটকে থাকা নিশ্বাসটা স্বস্তি হয়ে বেরিয়ে এলো সকালের বুক চিরে। 

‘তোর রিঅ্যাকশন দেখলাম।’ 

‘বেশ তো। কেমন লাগল? মজা পেয়েছিস?’ 

নাবিলা হাসতে হাসতে বলল, ‘তোর তো আরেকটু হলেই স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছিল। এখনো ভালোবাসিস। ভাব ধরিস কেন হুদাই?’ 

দরজায় টোকা পড়ল। ভেসে এলো মায়ের কণ্ঠস্বর, ‘খেতে আয়। তানভীর অপেক্ষা করছে।’ 

‘তানভীর বলদটা এত রাতে কী করে তোর বাসায়?” ফুঁসে উঠল নাবিলা। 

সকাল স্থিরতার সাথে বলল, ‘তানভীরের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী মাসের পঁচিশ তারিখ।’ 

‘হায় খোদা! তুই কি পাগল হয়ে গেছিস, সকাল?’

‘পাগল হওয়ার কী আছে? কোভিডের জন্যই তো বিয়েটা স্থগিত ছিল এতদিন। নইলে কত আগেই হয়ে যেত।’ 

‘ওই হারামজাদার পাছায় লাথি মেরে বাসা থেকে বের করে দে এখুনি।’ 

‘বাজে বকিস না। ফোন রাখি।’ 

‘আচ্ছা আন্টি এরকম করছে কেন? উনার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে?’ 

‘মায়ের ধারণা আরশানকে বিয়ে করলে আবার কোনো বিপদ হবে।’ 

‘কী উইয়ার্ড! কী অ্যাবসার্ড!” 

‘আসল ব্যাপার কি জানিস? বাবা চলে যাবার পর মা তো অনেক একা হয়ে গেছে। তাই কোনোভাবেই আমাকে বিয়ে দিয়ে আমেরিকা পাঠাতে চাইছে না। মুখ ফুটে বলছে না তবে আমি জানি এটাই মেইন রিজন।’ 

‘আন্টিকেও তো নিয়ে আসবি। উনি দেশে একা কীভাবে থাকবে?’ 

‘মা দেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। এ বাড়িতে বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে স্বামীর বাড়িতেই থাকতে চায়।’ 

নাবিলা চিন্তিত স্বরে বলল, ‘তাহলে তো ঝামেলা হয়ে গেল রে, দোস্ত!’ 

‘হুম,’ আনমনে শব্দটা উচ্চারণ করল সকাল।

‘আচ্ছা শোন।’ 

‘বল।’ 

‘একটা বার এসে ঘুরে যা। হয়তো আন্টির মন পরিবর্তন হলেও হতে পারে। আমি টিকেট করে দিচ্ছি।’ 

 ‘পাকামো করিস না, নাবিলা। টিকেটের এখন অনেক দাম।’

‘হোক দাম। সমস্যা নাই। 

‘তুই টাকা পাবি কোথায়?” ‘ফাহাদের কাছ থেকে ধার নিব।’ 

‘দরকার নাই।’ 

‘দরকার আছে। আমার জব হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। তখন ঋণ শোধ করে দেব। আর শোধ না করলেও নো প্রব্লেম। বরের কাছে একটু ঋণী থাকা ভালো। 

‘রাখি।’ 

‘আংকেলের মৃত্যুর পর দেড় বছর কেটে গেছে। এখন তোদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা উচিত। আন্টিকেও বুঝতে হবে যে উনার অ্যাবনরমাল আচরণ তোর জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।’ 

সকাল আর কথা বাড়ালো না। একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে ফোনের লাইন কেটে দিল। দপ করে বিন্দুবাসিনীর মুখটা ভেসে উঠল হাওয়ায়। 

‘শেহজাদি! আপনার সখী ভুল কিছু বলেননি। আপনি উনার দাওয়াত কবুল করে নিন। ঘুরে আসুন আমেরিকা থেকে।’

সকাল নিশ্চুপ। 

‘বহুদিন হয় আপনাকে হাসতে দেখি না। বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে আপনার জীবন। হাওয়া বদল আবশ্যক।’ 

সকাল থম ধরা গলায় বলল, ‘আজকাল কোনো কিচ্ছুতেই আনন্দ খুঁজে পাই না, বিন্দু! বাবা চলে যাবার পর থেকে আমার জীবনে কোনো আনন্দ নেই।’

বিন্দুবাসিনী নম্র পায়ে এগিয়ে আসে। সকালের কাঁধে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে, ‘আপনি আপনার মনকে প্রশ্ন করুন শেহজাদি। জেনে নিন সে কী চায়।’ 

মাঝরাতে নাবিলার টেক্সট এলো। 

দোস্ত, টিকেট বুক করে ফেলছি। লিঙ্ক পাঠালাম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *