সেদিন অক্টোবর – ১৯

১৯

মাঝরাতে যেন ডাকাত পড়ল বাড়িতে। হইচই-চেঁচামেচি ছেলে-মেয়েদেরকেও বাধ্য করল বিছানা ছেড়ে উঠে আসতে। বাড়ির চতুর্দিকে জ্বালানো হয়েছে বাতি। সকালের মা লিভিং রুমের কাউচে বসে হাত পা ছড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদছেন। দোতলার সিঁড়িসংলগ্ন হলওয়েতে ঘুমকাতুরে ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে নাবিলা আর টিলি। ফাহাদ বেজমেন্টে নেমেছে সকালের খোঁজে। রহমান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী সকালের মাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। লাভ কিছুই হচ্ছে না। ভদ্রমহিলার হা হুতাশ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময় ফুঁসে উঠে তিনি রহমান সাহেবকে বললেন, ‘আপনার ছেলেই আমার মেয়েকে সরিয়েছে। আমি আপনার ছেলের বিরুদ্ধে কেস করব। ছেড়ে দেব না। কিছুতেই ছেড়ে দেব না। ওই অসভ্য ছেলে প্রথমে আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে, এখন আমার মেয়েকে কেড়ে নিলো। ওকে আমি ছাড়ব না কিছুতেই!’ বলতে বলতে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর চুল উন্মাদিনীর মতো ফেঁপে আছে। চোখের দৃষ্টি ছিটগ্রস্ত। শুকনো খড়খড়ে ঠোঁটের কোণে উথলে উঠেছে সাদা ফেনা। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা মেন্টাল পেশেন্ট। রহমান সাহেব অত্যন্ত বিচলিত এবং ব্যথিত হয়ে পড়লেন। বড়ো পুত্র সম্পর্কে তাঁর একটা সুপ্ত গরিমা ছিল এতকাল। কেউ কখনো আরশানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেনি। এই প্রথম কেউ ছেলেটাকে নিয়ে মুখের ওপর কটু কথা বলল। তাও সাধারণ কোনো অভিযোগ নয়, এই অভিযোগ গুরুতর। তিনি সকালের মায়ের হম্বিতম্বির সামনে একটা কথাও বলতে পারলেন না। অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে বসে রইলেন। কিন্তু ফাহাদের মা সহজে দমবার পাত্রী নন। তিনি কোমর বেঁধে নামলেন রণাঙ্গনে। আরশান তাঁর পেটের সন্তান না কিন্তু স্বামীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাছাড়া সতীনের গর্ভের সন্তান হওয়া ব্যতীত আপাতচোখে আরশানের আর কোনো দোষ নেই। তিনি জানেন বর্তমান যুগে বাঙালি সমাজে ওর মতো ভদ্র, সুশীল, যোগ্য ছেলে কতটা দুষ্প্রাপ্য। সকালের মায়ের চ্যাটাং চ্যাটাং কথা তাঁর কিছুতেই সহ্য হলো না। বিষাক্ত সাপের ন্যায় ফণা তুলে বললেন, ‘আমাদের ছেলের বিরুদ্ধে এত কথা বলছেন তা আপনার মেয়েটা কী এমন ধোয়া তুলসী পাতা শুনি? সে এত রাতে বেরিয়েছে কোন আক্কেলে? কার না কার সাথে ভেগেছে আপনি এখন আমাদের ছেলের দোষ দিচ্ছেন। এটা তো ঠিক না।’

আমার মেয়ে ভেগেছে মানে? মুখ সামলে কথা বলেন আপনি। ভদ্রলোকের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেন না?” 

‘আমি ঠিকই বলছি। আপনিই যা তা বলে যাচ্ছেন সেই তখন থেকে। আপনার স্বামীকে নাকি আমাদের ছেলে কেড়ে নিয়েছে। মাথা ঠিক আছে? নাকি পুরাই পাগল হয়ে গেছেন? মূর্খের মতো কথা বলেন কেন আপনি?’ 

এমন সময় সদর দরজা ঠেলে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর মতো ভেতরে ঢুকল সকাল। অগোছালো চুলে দুটা সোনালি পাতা চোখে অগাধ ভীতির ঢেউ। নিশ্বাস আটকে আছে। উথালপাথাল! 

‘কোথায় গিয়েছিলি?’ সুতীব্র হুঙ্কারটা ঘরের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটায়। আঁতকে ওঠে সবাই। সকাল কোনো প্রত্যুত্তর করে না। কম্পিত বক্ষ নিয়ে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। দরজাটা আবারো খুলে যায়। আরশান প্রবেশ করে নিঃশব্দে। সকাল মায়ের বিস্ফারিত রক্তচক্ষুর দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। গর্জন ছুটে আসে আবারও, ‘কথা বলছিস না কেন? বল কোথায় গিয়েছিলি আমাকে ফাঁকি দিয়ে?’ 

সকালের ঠোঁটজোড়া কাঁপতে থাকে। চোখের কার্নিশে টলমল করে অশ্রুবিন্দু। বড়ো বড়ো নিশ্বাস পড়ে। একটা সময় স্খলিত কণ্ঠে বলে, ‘মা! আরশানকে ছাড়া আমি বাঁচব না!” 

কিছু হিমায়িত কালক্ষেপণের পর মর্মান্তিক একটা চড় এসে পড়ে ওর ডান গালে। আঘাতের প্রাবল্যে শরীর বেঁকে যায়। ভারসাম্য হারিয়ে যায়। রহমান সাহেব এগিয়ে এসে ওকে ধরে ফেলেন। দৃশ্যটা আরশানের বুকে নির্মম যন্ত্রণার উদ্রেক করে। রক্তে তোলপাড় হয়। সকালকে এভাবে আঘাত করার অধিকার কারো নেই। কিন্তু আঘাতক ব্যক্তিটি ওর মা বলেই আরশান প্রতিবাদ করতে পারে না। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। সকাল দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। ঘরে এসে চুপচাপ অন্ধকারে বসে থাকে মূর্তির মতো। উৎকট একটা জ্বালা হৃৎপিণ্ডের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সরীসৃপের মতো বিচরণ করতে থাকে। মা এলেন আরো মিনিট দশেক পর। সকাল নড়ল না। কিছু বললও না। ঘড়ির কাঁটা এগোতে লাগল টিকটিক করে। মা শুয়ে পড়লেন বিছানায়। কাঁদতে লাগলেন বাচ্চা মেয়ের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। খোলা জানালা দিয়ে পাগলের মতো ধেয়ে আসছে মাতাল হাওয়া। পথ ভুল করে হঠাৎ হঠাৎ উড়ে আসছে সোনালি রঙের মেপল পাতা। কিছুক্ষণ পর বেহালা বেজে উঠল। বৃষ্টির ঝমঝম আর কান্নার স্বরের সাথে বেহালার করুণ সুর মিশে গিয়ে গভীর রাতের নৈঃশব্দ্যতাকে ভেঙে চুরমার করে দিল। ওই সুর সকালের সমস্ত চৈতন্যের পরতে পরতে বিরহের ব্যথা জাগ্রত করে তুলল। বুকের মধ্যিখানে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত আর্তি জানাল। 

Will you love me like you loved me in the October rain? 

২০

সেদিন অক্টোবর! ক্যালেন্ডারের পাতা বলছে আঠারো তারিখ। সারা রাত বৃষ্টির পর সকাল বেলার অলৌকিক নীল আকাশে রাজকীয় চালে ভেসে বেড়াচ্ছে রুপালি প্রাচীর বেষ্টিত পেঁজাতুলো মেঘ। কমলা রঙের একটা মিঠা মিঠা অপার্থিব আলো ছড়িয়ে আছে বর্ষণসিক্ত অরণ্যের আনাচে কানাচে। সকাল গোসল সেরে বেরিয়েছে মাত্র। মাথায় ভেজা তোয়ালে জড়ানো। মা স্যুটকেসে কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছেন মনোযোগ সহকারে। এমন সময় টিলি এসে দাঁড়ালো দরজায়, সকালকে বলল, ‘নাবিলা ভাবি ডাকছে তোমাকে।’ 

সকাল মাথার চুলে কয়েকটা ঝাড়ন দিয়ে তোয়ালেটা সরিয়ে রাখল। ঘর থেকে বেরোনো মাত্র টিলি ফিসফিস করল, ‘আরশান ভাইয়া ওয়েইট করছে। নিচে যাও।’ 

বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল সকাল। টিলি কথা না বাড়িয়ে সটকে পড়ল মুহূর্তের মাঝে। সকাল ত্রস্ত এবং ভীত পায়ে প্যাটিয়োতে এসে দাঁড়ালো। অক্টোবরের প্রফুল্ল সোনালি রোদ্দুর গায়ে মেখে আরশান দাঁড়িয়ে আছে শুকনো পাতা ছড়ানো রঙিন উঠোনে। সাদাকালো চেকের একটা স্লিমফিট হুডেড শার্ট ওর গায়ে। বুনো ফুলের মাতাল সুগন্ধি ছড়ানো ঝিরিঝিরি বাতাসে কপালের ছোটো চুল উড়ছে। চোখে আর নাকে স্বর্ণালী রোদের ফুলঝুরি। একটা লাল পাখনার কার্ডিনাল ওকে ঘিরে নেচে বেড়াচ্ছে, ডেকে যাচ্ছে টিউ টিউ স্বরে। দৃশ্যটায় চোখ পড়া মাত্র সকালের ভালো লাগল। কেন যে এত ভালো লাগল কে জানে! ভালো লাগায় বুঁদ হয়ে সে ঝলমল হেসে বলল, ‘গুডমর্নিং!’ 

আরশান তাৎক্ষণিক ভাবে কোনো প্রত্যুত্তর করল না। ভেজা চুল থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল সকালের টোল পড়া হাস্যোজ্জ্বল গালে। রোদের প্রলেপ লাগায় চিকচিক করছিল হীরের টুকরোর মতো। আরশান সেদিকে কয়েক নিমেষ চেয়ে থেকে অন্যরকম গলায় বলল, ‘শেহজাদি! আপনার হাসিটা অক্টোবরের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর!’ 

সকাল লাল হলো লজ্জায়। খুশি ঝিলিক দিল চোখে। অর্ধ নিমীলিত নেত্রে সলজ্জ কণ্ঠে বলল, ‘কেন ডেকেছেন?’ 

আরশানের যেন সম্বিৎ ফিরল এতক্ষণে। ব্যস্ত গলায় বলল, ‘চলেন!’ 

‘মানে কী? কই যাব?’ 

আরশান এগিয়ে এসে ওর হাত ধরল। গাড়িটা ড্রাইভ ওয়েতেই ছিল। আরশান কোনো কথা না বলে সকালকে টেনে নিয়ে এলো গাড়ির কাছে। 

‘গাড়িতে উঠুন।’ 

‘কেন?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে সকাল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে এই পাগলটা? 

আরশান জোরজার করে গাড়িতে বসিয়ে দিল ওকে। সকাল কড়া গলায় প্রশ্ন করল, ‘কাহিনি কী? কোথায় যাচ্ছি?’ 

আরশান ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। সকালের দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘মসজিদে যাচ্ছি।’ 

‘হঠাৎ মসজিদে কেন?’ সকাল অবাক। 

আরশান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিল, ‘বিয়ে করব!” 

বিস্ময়ের প্রবল ধাক্কায় বোবা হয়ে গেল সকাল। কয়েক সেকেন্ড ওর গলা দিয়ে কোন স্বর বেরলো না। এক সময় হাঁপধরা গলায় বলতে পারল, ‘কী বলছেন এসব? বিয়ে…মানে এভাবে…কী করে সম্ভব?’ 

‘হুম এভাবেই। এভাবে না হলে আর জীবনেও হবে না।’ সোজা-সাপটা মন্তব্য আরশানের। 

‘কিন্তু মাকে কী বলব?’ 

‘সেটা পরে দেখা যাবে।’ 

এরপর সকাল আর কোনো কথা বলতে পারল না। কথা বলল না আরশানও। টয়োটা কনভার্টিবল এগিয়ে যেতে লাগল নেইবারহুডের রঙিন পাতা বিছানো পথের ওপর দিয়ে। রাস্তার দুধারে সোনালি রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হ্যালোইনের সাজে সজ্জিত ছোটো বড়ো নানা আকারের বাড়িঘর। ফিরোজা রঙের মসৃণ আকাশে পলকা মেঘের ভেলা ভাসছে। সিডার গাছের ফাঁকে ফাঁকে আয়নার মতো চমকাচ্ছে সূর্যরশ্মি। ফুরফুরে হাওয়ায় ভর দিয়ে সারা রাস্তাজুড়ে মিছিল করছে মেপল লিফের দল। ওদের দুজনের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। বুকে বড্ড দাপাদাপি! কেউ কারো দিকে সরাসরি তাকাতে পারছে না। চোখ চোখ পড়ে গেলে বিব্রত হয়ে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। সকাল আকাশী রঙের তাঁতের সাধারণ সালওয়ার কামিজ পরেছে। তার মুখে কোনো প্রসাধন নেই। এমনকি কাজল পর্যন্ত টানা হয়নি চোখে। এভাবে নাকি মানুষ বিয়ে করে! হায় খোদা! দুর্ভাবনা, অস্থিরতা আর ব্যাকুলতায় দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। আশ্চর্য এই যে, ঋণাত্মক সব অনুভূতির সম্যক উপস্থিতি ছাপিয়ে ভালো লাগার একটা রেশমি বৃষ্টি ঝুরঝুরিয়ে মনের ওপর ঝরে যাচ্ছিল নিঃশব্দে। সেই সাথে সকালের খুব লজ্জা করছিল। দুর্দমনীয় লজ্জায় শিউরে উঠছিল গা। 

মসজিদের সামনে ফাহাদ, নাবিলা আর অনিক দাঁড়িয়ে ছিল। সকালদের দেখামাত্র হইহই করে উঠল সবাই। আরশান বিচলিত। যদিও ঠোঁটে এখনো উপচে পড়ছে স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য। সকালের চোখে ঘোর। চেতন অবচেতনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে তার সত্তা। পা মাটিতে স্থির নেই। শূন্যে ভাসছে সবকিছু! 

নাবিলা কাছে এসে ওর হাত ধরল, ‘সবকিছু রেডি। এখন শুধু কবুল বলবি আর সাইন করবি। আমরা সেই ভোরবেলায় এসেছি এখানে। তোর ব্যাগ থেকে চুরি করে পাসপোর্ট নিয়ে এসেছি।’ 

সকাল অস্ফুটে বলল, ‘কী হচ্ছে এসব, নাবিলা? আমার খুব ভয় হচ্ছে!’ 

‘আরে, ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহ ভরসা। যা হচ্ছে একদম ঠিক হচ্ছে। তুই মনে সাহস রাখ, দোস্ত।’ 

মসজিদের ভেতরে ঢুকে হলরুমের মেঝেতে বসল ওরা। কার্পেটের ওপর। সব মিলিয়ে জনা দশেক লোক হবে। ইমাম সাহেব প্রথমে কোরআন তেলাওয়াত করলেন। খুতবা দিলেন। তারপর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। কবুল বলার সময় আর সাইন করার সময় সকাল খুব কাঁদছিল। কেন কাঁদছিল জানে না সে। আনন্দ, ভয়, সংকোচ, দুশ্চিন্তা এই সমস্ত অনুভূতি ঘুরপাক খেয়ে উথলে উঠছিল ভেতরে। আরশান ওর চাইতে অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে ভালো মতো লক্ষ্য করলে বোঝা যায় মনের অস্থিরতাটুকু ওর চোখের আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বিয়ের পর ওরা সবাই মিলে লাঞ্চ করতে গেল টেক্সাস রোডহাউজে। বর-বধূ নীরবতা পালন করে যাচ্ছিল। বাকিরা হইচই করে গোটা রেস্টুরেন্ট মাথায় তুলছিল। এই বিয়েটা যে সাধারণ কোনো আনন্দঘন বিয়ে নয় তা যেন ওরা বুঝেও বুঝে উঠতে পারছে না। কত অপেক্ষা, কত নির্ঘুম রাত, কত অশ্রু বিসর্জন আর কত শত বাধা পেরিয়ে, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে আজ ওরা একে-অন্যকে কবুল করে নিয়েছে। এই সংগ্রাম এবং ত্যাগের কষ্ট হয়তো ওরা দুজন যেভাবে বুঝবে সেভাবে অন্য কেউ কোনোদিনই বুঝবে না। তাই তো হাসি ঠাট্টায় যোগ দিতে পারছিল না ওরা। একটু বাদে বাদে পরস্পরকে পলক তুলে দেখছিল শুধু গভীর চোখে। 

বাড়ি ফেরার সময় সকালের মনে হলো সামনে যেন একটা গভীর খাদ! আরেক পা এগোলেই অতল সেই খাদে পা ফসকে পতিত হবে সে। তলিয়ে যাবে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। খুব ভয় করছিল! ভয়ের বিষ শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে ছোবল মারছিল। খবরটা শুনে মায়ের যদি স্ট্রোক হয়ে যায়? বাবার মতো মাও যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন কী হবে? 

আরশান এতক্ষণ সকালের সাথে একটা কথাও বলেনি। বাড়ি পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমেই ওর ডান হাতটা ধরল। দৃঢ় ভাবে বলল, ‘নো ওরিজ। এভ্রিথিং উইল বি অলরাইট।’ 

আজ ছুটির দিন। লিভিং রুমে রহমান সাহেব বসে ছিলেন নিউজ পেপার হাতে নিয়ে। ডাইনিং টেবিলের সামনে সকালের মা দাঁড়িয়ে আছেন। চায়ের কাপে টুংটাং চামচ নেড়ে চিনি মেশাচ্ছেন। ছেলে-মেয়েরা বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পদশব্দ এবং ফিসফাস কণ্ঠস্বরে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। সকালের মা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন লিভিং রুম সংলগ্ন সদর দরজার দিকে। ফাহাদের মা হেঁটে হেঁটে দৃশ্যপটে উপস্থিত হয়েছেন তখন। আরশান সকাল ভেতরে ঢুকেছে সবেমাত্র। হাতে হাত রেখেছে দুজনে। চোখেমুখে অটল গাম্ভীর্য। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছেন। উত্তেজনায় নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছেন। আরশান পিতার দিকে তাকাল। বড়ো একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ডাকল আকুল কণ্ঠে, ‘বাবা!” 

রহমান সাহেব চমকে গেলেন ভেতরে ভেতরে। আজ কত্তদিন পর ছেলেটা তাঁকে বাবা বলে ডাকল! বাৎসল্যের আবেগে তাঁর কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো। ঝাপসা চোখে তিনি পুত্রের দিকে চেয়ে রইলেন শুধু। কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন না। সকালের মা হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এসেছেন সামনে। তাঁর চোখের দৃষ্টি বুদ্ধিভ্রষ্ট। চেহারায় পাগলামির গাঢ় চিহ্ন। সকাল চোখ নামিয়ে নিয়েছে। তাঁর বুক কাঁপছে অস্বাভাবিক ভাবে। আরশান ফাহাদের মায়ের দিকে তাকাল এবার, ‘মাদার!’ 

‘বলো, বাবা! কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ 

আরশান চোখ ঘুরিয়ে নিলো পিতার মুখের ওপর। বলিষ্ঠ গলায় বলল, ‘বাবা, আমরা বিয়ে করেছি।’ 

কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘরের মধ্যে নেমে এলো পিন – পতন নীরবতা। ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতি যেমন ভ্যাপসা গুমোট বায়ুতে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে, ঠিক সেরকম গুমোট আবহাওয়ায় থমকে রইল ঘরটা। মায়ের মুখটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছে। যেন কেউ আগুনের শলা দিয়ে বিঁধে যাচ্ছে তাঁকে। সকাল এক পা এগিয়ে গেল। মা ঘুরে দাঁড়ালেন। হনহন করে পাগলের মতো এগিয়ে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। সকাল স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। পা নড়বড়ে। মনে হচ্ছে এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। টালমাটাল পায়ে মায়ের পেছন পেছন এগিয়ে গেল। ঘরে এসে দেখল মা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্থবির হয়ে। সকাল তাঁকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল, ‘সরি…আমি ভীষণ সরি, মা! প্লিজ, আমাকে মাফ করে দাও! এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বিশ্বাস করো!’ 

আরশান এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পেছনে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল সে। তারপর বলল, ‘আন্টি, এখানে সকালের কোনো দোষ নেই। আপনি প্লিজ ওর সাথে রাগ করবেন না। যা বলার আমাকে বলুন। আমি দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি।’ 

মা কিছু বললেন না। চোখ দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। সকাল মায়ের পিঠের সাথে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে। আরশান পাশে এসে দাঁড়ালো। জানালার সামনে। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘সকালকে আমি ভালো রাখব। আপনি আমার ওপর একবার ভরসা করে দেখুন। আই ওন্ট লেট ইউ ডাউন। আই প্রমিজ।’ 

মা কিছু বললেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন চিত্রার্পিত। সকাল কাঁদল, কত অনুনয় বিনয় করল, ক্ষমা চেয়ে চেয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলল তবুও তিনি রা করলেন না। কেটে গেল সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা! একটা সময় সকালও চুপ হয়ে গেল। তিন মূর্তি নিশ্চল নিবৃত্ত হয়ে যে যার জায়গায় স্থির হয়ে রইল। 

ঘড়িতে তখন কয়টা বাজে কে জানে! দুপুরের অলস রোদ শুয়ে আছে জানালার কার্নিশে। ঘুঘু ডাকছে মন কেমনের গলায়। মা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ফ্লাইট কয়টায়?’ 

সকাল অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মিনমিন করে বলল, ‘রাত দশটায়।’ 

মা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘তোর বাবাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম আজ ভোরবেলায়। বলছিল মেয়েটাকে যেন এখানেই রেখে যাই। আমার নাকি একলা ফিরে যাওয়াই উত্তম। এখন বুঝতে পারছি কেন এমন স্বপ্ন দেখেছি।’ 

সকাল দিশাহারা হয়ে বলল, ‘কিন্তু মা, তোমাকে তো একা যেতে দেব না আমি। কিছুতেই না।’ 

মা ওর কথা শুনেও না শোনার ভান করলেন। নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে বিছানার ওপর বসলেন। আরশান বলল, আর কয়েকটা দিন থেকে যান, আন্টি। এ মাসের শেষে আমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি। ভাবছি আমিও কিছুদিন বাংলাদেশে গিয়ে থাকব। আপনাদের সাথে। 

মা পলক তুলে চাইলেন। একটা সুপ্ত আশা ঝিলিক দিল তাঁর চোখে, ‘তুমি বাংলাদেশে যাবে?’ 

‘কেন নয়?’ আরশান সকালের দিকে একবার তাকাল আড়চোখে। মুখ বাঁকালো নিজস্ব কায়দায়। তারপর একটু হেসে বলল, ‘আপনি চাইলে আমরা বছরের ছয়মাস বাংলাদেশে থাকব, বাকি ছয়মাস আমেরিকায়। নো বিগ ডিল!’ 

মা আর কোনো কথা বললেন না। এমন ভাবে চুপ করে গেলেন যেন বলার মতো তাঁর ঝুড়িতে আর একটি বাক্যও নেই। সারা জীবনের সব কথা তিনি বলে ফেলেছেন। এখন শুধু নীরব থাকার ব্রত পালন করবেন। সকাল আরশান অনেকক্ষণ অবধি তাঁর পাশে বসে রইল। বেলা গড়িয়ে যেতে লাগল চোখের ওপর দিয়ে। একটা সময় তিনি অধৈর্য হয়ে বললেন, ‘তোমরা এখানে বসে আছ কেন?’ 

সকাল মিউমিউ স্বরে বলল, ‘তোমার রাগ কমেছে, মা?’

‘না কমেনি। যে অপরাধ করেছ তার কোনো ক্ষমা হয় না। এখন যাও এখান থেকে।’ 

ধমক খেয়ে আরশান উঠে দাঁড়ালো। সে বুঝতে পারছে এখানে থেকে আর কাজ নেই। নতমস্তকে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ শুনতে পেলো মা বলছেন, ‘বছর দেড়েকের মধ্যে নাতি-নাতনির মুখ দেখতে পারলে হয়তো ক্ষমা করলেও করতে পারি। তার আগে ক্ষমার প্রশ্নই ওঠে না।’ 

সকাল ঝুপ করে ভিজে গেল একরাশ লজ্জায়। আরশানের চোখের লম্বা পাপড়িতেও লজ্জার রেশ এসে লাগল। শক্তপোক্ত মুখখানা লালচে হয়ে উঠতেই অন্যরকম সুন্দর দেখালো ওকে। ওরা কেউ কারো চোখের দিকে তাকাতে পারল না। মায়ের দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য বেরিয়ে এলো ঘরের বাইরে। দরজার ওপাশে দস্যু বাহিনী ওঁত পেতে ছিল। বেরোতেই চিৎকারে কান ঝালাপালা করে দিল, ‘ভাবিইইইইইইই!’ 

আবারও এক ঝাঁক কুণ্ঠা সজোরে আক্রমণ করল সকালকে। ফাহাদ বলল, ‘তোমরা এখানেই থাকো। আমরা যাচ্ছি তোমাদের ঘর সাজাতে। এখন ওখানে কেউ যাবে না।’

আপত্তি জানালো আরশান, ‘কোনো দরকার নেই এসবের।’ 

নাবিলা ফোড়ন কেটে বলল, ‘কোনো দরকার নাই মানে? বিয়েটা তো করে ফেললেন খুব সহজে। এখন বাসর ঘরও সাজাবেন না। আপনি আমার ফ্রেন্ডকে পেয়েছেন কী?’

নাবিলার আক্রমণে একটু থতমত খেয়ে গেল আরশান। ওরা সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামি নামি করছে। জানালার পর্দা উড়ছে বাতাসে। খোলা জানালা দিয়ে সূর্যরশ্মি নেমে এসেছে বাঁকা হয়ে। ছুঁয়েছে কাঠের মেঝে। কিচেনে গরুর মাংস রান্না করছেন ফাহাদের মা। মশলার সুন্দর গন্ধে ভুরভুর করছে বাতাস। রহমান সাহেব ডাইনিংয়ে বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিলেন। ছেলে-মেয়েদের ঠাট্টা-তামাশার কাঁটা ছেঁড়া কিছু অংশ তাঁর কানে আসছে। তাঁর মনটা আজ বড়োই শান্ত। চারিদিকে প্রগাঢ় প্রশান্তির জান্নাতি হাওয়া বইছে। সংসারটা পরিপূর্ণ লাগছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে সহস্র শুকরিয়া আদায় করলেন তিনি। 

এদিকে আরশান গোবেচারা গলায় বলছে, ‘ঘর সাজানোর দরকার নেই আসলে…’ 

নাবিলা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘শোনেন, আরশান ভাই, আজকে থেকে কিন্তু আপনি শুধু আমার ভাসুরই নন। দুলাভাইও বটে। শালীর কথা শুনতে হবে। শালী মানে জানেন তো? শালী আধি ঘারওয়ালি।’ 

আরশান কী বলবে খুঁজে না পেয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। নাবিলা সকালের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘দ্যাখ না, আমার হ্যান্ডসাম দুলাভাই লজ্জা পাচ্ছে। কী কিউট!’ 

‘কিউট না ছাই! বাসরঘর সাজাতে বারণ করছে কেন? বেরসিক একটা!’ 

‘এসব বলিস না তো। আমার দুলাভাই অনেক জোশ! তুই হিংসা করিস কেন?” 

সকাল তারিয়ে তারিয়ে বলল, ‘হিংসা তো করবি তুই! তোর কাছে তো আছে…আমার হ্যান্ডসাম দ্বিতীয় বর। মানে দেবর! মনে রাখিস কিন্তু। দ্বিতীয় বরের ওপর আমার অধিকার আছে।’ 

নাবিলা ঠোঁট বাঁকাল, ‘ইশ! কয়টা বর লাগে তোমার? একটা বর পেতে না পেতেই আবার দ্বিতীয় বরের শখ!’ 

সকাল হেসে ফেলল। দুই বান্ধবীর খুনসুটির মধ্যে বাধ না সেধে আরশান আর ফাহাদ এগিয়ে গেল সামনে। রহমান সাহেব দুই পুত্রকে ডেকে পাঠালেন। বড়ো পুত্রের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বিয়ে তো করেই ফেলেছ, কিন্তু সামাজিক রীতিনীতি বলে তো একটা বিষয় আছে। আত্মীয়-স্বজনদের জানাতে হবে। লোকজন খাওয়াতে হবে। নতুন বউ ঘরে তোলার আগে বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে।’ 

মাদার বললেন, ‘বউ নিয়ে বেজমেন্টের ওই একটু খানি ঘরে তো থাকা যাবে না। তোমরা বরং দোতলার গেস্টরুমে চলে যাও।’ 

আরশান ছোটো করে বলল ‘দেখা যাক।’ 

‘দেখা যাক মানে? তুমি আবার অন্য কোথাও মুভ করার কথা চিন্তা করছ না তো? আমি কিন্তু দুই ছেলের বউকে নিয়ে একসাথে সংসার করতে চাই বলে দিলাম। কোনো হাংকি — পাংকি চলবে না।’ 

আরশান চুপ করে রইল। বিয়েটা করার সাথে সাথেই একগাদা সামাজিক দায়িত্ব মাথায় এসে পড়েছে। এসব অনর্থক সামাজিকতা সর্বদা এড়িয়ে চলতে চেয়েছে সে। তার নিভৃতে থাকতে ভালো লাগে। সমাজ সংসারের মিছে জাঁকজমক আর আড়ম্বর কখনোই পছন্দ ছিল না। তবে কোনো এক বিচিত্র কারণে এসব সাংসারিক খুঁটিনাটি এখন অতটাও খারাপ লাগছে না। আজকে এই অক্টোবরের সোনা ঝরা সকালে ঠিক যেই মুহূর্তে সকালকে সে চিরদিনের জন্য নিজের করে পেয়ে গেল, সেই থেকে সবকিছু সুন্দর, শান্ত আর স্নিগ্ধ! তার তমসাচ্ছন্ন একাকী পৃথিবীটা প্রত্যুষের পবিত্র আলোয় ভরে গেছে। 

রহমান সাহেব হঠাৎ অন্য সুরে বললেন, ‘তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছ, বাবা?’ 

আরশান অপ্রতিভ হলো। ছোটো ভাই এবং সৎ মায়ের সামনে খোলামেলা ভাবে কথা বলার মতো প্রসঙ্গ এটা নয়। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল সে। তারপর জড়তা কাটিয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘আমি হয়তো আপনাকে সেদিনই ক্ষমা করতে পারব, যেদিন আমার মা আপনাকে ক্ষমা করবে। এখন শুধু এতটুকুই বলতে চাই যে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আগের মতো নেই। অনেকখানিই কমে গেছে। তবে ভালোবাসাটা আগের মতোই আছে। একটুও কমেনি।’ 

কথাটা বলে শেষ করে আরশান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কারো দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল বাইরে। সেই যে গেল, এরপরের কয়েকঘণ্টা মহাশয় নিরুদ্দেশ। সকাল ফোনের পর ফোন দিয়ে যাচ্ছিল। মোবাইল সুইচড অফ। রাগে, দুঃখে আর অপমানে কাদা হয়ে গেল সকাল। নাবিলা আর টিলি ওকে সাজানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। নাবিলার কাছে বেশ কয়েকটা নতুন শাড়ি আছে। তার মধ্যে থেকেই একটা বেছে নিয়ে সকালকে পরাতে চাইছিল। কিন্তু আরশানের স্বেচ্ছাচারী, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ সকালকে এতটাই মুষড়ে দিল যে সাজগোজে আর কোনো আগ্রহই অবশিষ্ট রইল না। বিয়ের দিন মানুষ নতুন বউ ফেলে এভাবে উধাও হয়ে যায়? আজিব কারবার! নাবিলারা শখ করে ঘর সাজাতে চাইল। সেটাও নিষেধ করল। অথচ ফাহাদ- নাবিলাকে দ্যাখো, কত রোমান্টিক, কত শৌখিন! সকালের কপালটাই আসলে খারাপ! রসকষহীন বেরসিক একটা মানুষ এসে জুটেছে ভাগ্যে। সর্বনাশা বিষাক্ত রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছিল সকালের। নাবিলা বলছে, ‘এত রাগ করিস না। ফিরে আসবে এখুনি। উনি তো একটু অন্যরকম, বুঝিস না? হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছেন।’ 

সকাল রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘বিয়ের প্রথম দিনই যদি এরকম করে তো সারা জীবন কী করবে? কীভাবে এই পাগলের সংসার করব আমি?’ 

‘ঠিক হয়ে যাবে, দোস্ত। আস্তে আস্তে সবই ঠিক হয়ে যাবে। তুই আসছিস না? তুই সব ঠিক করে ফেলবি। এখন সাজগোজ কর। এমন সাজ দে যেন তোকে দেখে আরশান ভাইয়ের মাথা ঘুরে যায়।’ 

সকাল প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। মলিন মুখে বসে রইল। তারপর নাবিলা আর টিলির জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে নতুন একটা শাড়ি পরল। হালকা বেগুনি রঙের জারদৌসি কাজ করা অর্গঞ্জা শাড়ি। সাথে মুক্তো বসানো দারুণ একটা জরোয়া সেট। সবকিছুই নাবিলার। সকালের তো বিয়ের সাজ সাজার মতো কিছুই নেই আপাতত। এমনকি স্বামীটিও লাপাত্তা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে রুপার থালার মতো সুডৌল একটি চাঁদ ঝুলে আছে। বাড়ির সব সদস্যের মনে চাপা উত্তেজনা খেলছে। কিন্তু আসল মানুষটির খবর নেই। এমন অদ্ভুত ঘটনা কেউ কোনোদিন শুনেছে? 

দেওয়ালেরও কান থাকে। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ কেউ বিয়ের খবর জেনে গেছে ইতোমধ্যে। বাঙালি কমিউনিটিতেও খবরটা চাউর হয়েছে। হয়তো মসজিদ থেকেই অনেকে জেনে গেছে। রহমান সাহেবকে ফোন করে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তিনি মিথ্যে বলেননি। সত্যটা স্বীকার করে নিয়েছেন। নতুন বউ দেখতে চলে এসেছেন কিছু সহৃদয়, শিষ্টাচার-সম্পন্ন, আলাপী ব্যক্তিবর্গ। নতুন বউ বাড়িতে উপস্থিত আছে কিন্তু বরটি নেই এই ঘটনা অনেকেই বাঁকা চোখে দেখছে। রহমান সাহেব বলেছেন খুব জরুরি কাজে আটকে গেছে ছেলে। কিন্তু ছুটির দিনে যে তেমন কোনো জরুরি কাজ থাকার কথা না এটা সবাই কম-বেশি বোঝে। আরশানের ভবঘুরে সমাজবিরুদ্ধ স্বভাবের কথাও কারো অজানা নেই। সবার ঠোঁটেই একটি চাপা বিদ্রুপের হাসি খেলছে। ভাবটা এমন যে বিয়ের গরজটা সকালেরই বেশি ছিল। আরশান কোনোমতে কবুল বলেই পালিয়েছে লেজ গুটিয়ে। ওদের তামাশা-প্রত্যাশী মন আড়ালে আবডালে বিনোদনের স্বাদ পাচ্ছে। একজন মধ্যবয়সি মহিলা, যিনি সম্পর্কে ফাহাদের মামি হন, কুশলী গলায় বললেন, ‘কীভাবে পটালে আমাদের ছেলেটাকে? কত চেষ্টা করলাম একটা বিয়ে দেওয়ার। করলই না। আমার বোনের মেয়েটা এত কোয়ালিফাইড ছিল। পিএইচডি করা মেয়ে। ওর বাবার দিকের ফ্যামিলির সবাই ডাক্তার। সেই সোনার টুকরো মেয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলাম, কিন্তু আরশান রাজিই হলো না! সে ঘোষণা দিয়েছিল বিয়েই করবে না। তুমি কী এমন জাদু-মন্ত্র করলে বলো তো?’ 

সকালের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে একদম। অপমানের চাবুক পড়ছে শরীরে। অনিশ্চয়তায় দুলছে বুক। কী সংকোচটাই না লাগছে বাড়ির লোকজনের সামনে! কেন যে এমন পাগল মতিচ্ছন্ন একটা মানুষকে সে ভালোবাসতে গেল! তার কপালটা এত খারাপ কেন? মা কী ভাবছে মনে মনে সে জানে। ভাবছে খুব তো লাফিয়ে লাফিয়ে বিয়ে করলে, প্রথম দিনই তো ছেলের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় পাওয়া গেল। এবার ভুগতে থাকো মায়ের আদেশ অমান্য করার পরিণাম। 

দেখতে দেখতে ডিনারের সময় হয়ে এলো। আরশান আসেনি। মা এতক্ষণে মুখ খুললেন, ‘জামাই কোথায় গেল? আত্মীয়-স্বজনরা এসে বসে আছে। দেখা সাক্ষাৎ করবে, দোয়া নিবে, এটাই তো নিয়ম। তুই ফোন করছিস না কেন?’ 

সকাল ম্লান এবং দুর্বল কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘ফোন বন্ধ।’ 

গলা দিয়ে খাবার নামল না সকালের। নতুন বউয়ের নিষ্প্রভ, অপ্রসন্ন মুখ দেখে অতিথিদের কেউ কেউ আফসোস করতে লাগলেন। সেই সময় হঠাৎ ডাক ছুটে এলো উঠোন থেকে। 

‘শেহজাদি!’ 

চমকানো বুক নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সকাল। বশীভূত পায়ে বেরিয়ে এলো। প্যাটিয়োতে এসে দাঁড়াতেই ভস করে জ্বলে উঠল দেওয়ালে লাগানো মোশন সেন্সর লাইট। সেই আলোয় হৃষ্টপুষ্ট তাজা শরীরের এরিককে দেখা গেল। পিঠের ওপর চমৎকার একটা রাজকীয় আসন। আরশান দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে, কালো রঙের উইন্ড ব্রেকার গায়ে দিয়ে। সকালের পিছু পিছু আরো অনেকেই প্যাটিয়োতে এসে দাঁড়িয়েছে। আরশান এত লোকসমাগম আশা করেনি। সে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ বোধ করছে। উপস্থিত মানুষজনের ফিসফাস ভেসে উঠেছে হাওয়ায়, কোথায় গিয়েছিল? ঘোড়া কোত্থেকে পেলো? ঘোড়ায় চড়ে যাবে কোথায়? 

আরশান কাউকেই তেমন একটা গ্রাহ্য করল না। স্তম্ভিত সকালের দিকে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা হাত ধরল। তারপর টেনে নিয়ে এলো এরিকের কাছে। উঠোনের মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে জিনের সিঁড়িটা এগিয়ে দিল সকালের পায়ের দিকে। সকাল বিস্ময়ে বোকা বনে গিয়েছিল। মাথাটা ফাঁকা 1 মস্তিষ্ক জড়ীভূত। শুধু টের পাচ্ছিল বুকের মধ্যে সুখের একটা দ্রিমদ্রিম বাজনা বেজে যাচ্ছে। সেই বাজনার প্রাবল্যে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, বোধবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। নাবিলা, টিলি আর ফাহাদ দৌড়ে এলো। ধরে-বেঁধে চড়িয়ে দিল ওকে ঘোড়ার পিঠে। আরশান উঠে বসে রাশ টেনে ধরল। সকাল বন্দি হলো ওর দুবাহুর বেষ্টনীর মধ্যে। ‘তোমরা যাচ্ছ কোথায়?’ ফাহাদের প্ৰশ্ন। 

আরশান সকালের দিকে একবার তাকাল। নাকউঁচু, হামবড়া হাসিটা হেসে বলল, ‘হরিণডাঙা।’ 

ফাহাদের ভ্রু কুঁচকে গেল, ‘কী দাঙ্গা?” ফাহাদের বাঙলাটা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে তবুও ডাঙা শব্দটা ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারল না। আরশান প্রত্যুত্তরে শুধু হাসল। বলল না কিছু। এরিক টুকটুক করে এগিয়ে গেল বাড়ির পশ্চাৎভাগের জোছনা ডোবা জঙ্গলে। ছেলে-মেয়েদের দল হইহই করে উঠল পেছন থেকে। শিস বাজিয়ে, সিটি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল। 

হিমবর্ষী আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। নীল জোছনার ঢেউ লেগেছে পলকা মেঘের পরতে পরতে। দিগদিগন্তে ছড়িয়ে আছে রুপোর জরিঅলা মিহি ফিতে। এরিক হাঁটছে শুকনো পাতায় মচমচানি তুলে, আগাছা আর আশশ্যাওড়ায় শনশন আঘাত হেনে। সকাল বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল অনেকটা সময় ধরে। সামনে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসেছিল ও। নিষ্পাপ মুখশ্রীতে খেলছিল হতভম্ব একটা ভাব। সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। রুপালি চন্দ্রালোকে মনে হচ্ছিল যেন আকাশ থেকে নেমে আসা জলজ্যান্ত এক পরী। পৃথিবীতে নেমে এসে যার ডানা হারিয়ে গেছে। এখন সেই হারানো ডানার খোঁজে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরিক হেলে-দুলে হাঁটছে। হাঁটার দমকে দুলছে ওরা। 

‘এরকম করলেন কেন?’ নিঃশব্দ বনস্থলীতে হঠাৎ উৎপন্ন হওয়া মানুষীর স্বর যেন বিদ্যুতের মতো চমক তুলে দেয়। ঝোপঝাড়ের ভেতরে নড়ে ওঠে বন্য জন্তু। একটা প্যাঁচা ডেকে ওঠে চকিত স্বরে। 

‘আমি আবার কী করলাম?’ আরশান অবাক। 

‘সেই বিকেল থেকে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন? ফোন বন্ধ ছিল কেন?’ 

‘ওহ…ফোনে তো চার্জ দিতেই ভুলে গেছি।’ 

‘সিরিয়াসলি? এতটাও ক্যালাস হয় মানুষ? ‘হলাম তো!’ 

‘ছিহ, সবাই কী ভাবল! ‘ 

‘কী ভাবল?” 

আরশানের বুকের ওপর মাথাটা হেলিয়ে দিল সকাল। আফটার শেভের সুন্দর একটা ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। মৃদু স্বরে বলল, ‘আমাকে না বলে আর কখনো কোথাও যাবেন না।’ 

‘এই তো আমার ফ্রিডমের বারোটা বেজে গেল। আমি কখন কোথায় যাব, কী করব, সব আপনাকে বলতে হবে?’ 

‘হ্যাঁ, হবে,’ আহ্লাদী গলায় বলে সকাল, ‘আমি আপনার স্ত্রী। আপনার সম্পর্কে সবকিছু জানার অধিকার আমার আছে।’ 

‘সবকিছু?’

‘সবকিছু!’ 

‘তাহলে তো আপনার সম্পর্কেও আমার সবকিছু জানতে হবে।’ 

‘জানেন-ই তো!’ 

‘তাহলে বলুন তানভীরের সাথে আপনি কী করেছেন?” সকাল হাসতে লাগল, আহারে বেচারা তানভীর। সত্যিই ভালোবেসেছিল আমাকে।’ 

আরশান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘খুব আফসোস হচ্ছে এখন?’ 

‘হচ্ছে তো!’ 

‘সে বলেছে আপনাদের ফিলিংস রেসিপ্রোকাল ছিল। ‘আপনার সাথে আবার কখন কথা হলো?’ 

‘ফোন করেছিল।’ 

‘কী আশ্চর্য! কেন?’ 

‘আপনি তাকে ভালোবাসেন, এই কথা জানাতে।’ 

‘মিথ্যে কথা!’ 

‘কেন বলল মিথ্যেটা?’ 

‘জানি না…বিয়ে করতে চেয়েছিল আমাকে…এইজন্যেই মিথ্যে বলেছে মনে হয়।’ 

‘সবাই আপনাকে বিয়ে করতে চায় কেন? সমস্যা কী?’

‘কী আবোলতাবোল বলছেন!’ 

‘ঠিকই তো বলছি… আমার ভাই, অনিক, তানভীর…এই 

বলছি…আমার লিস্ট আসলে কত লম্বা? আমি জানতে চাই।’ 

সকাল দুষ্টুমির গলায় বলল, ‘লিস্ট তো অন্নেক বড়ো! নাম বলা শুরু করলে শেষ হবে না!’

চোখে হঠাৎ আলোর ঝলকানি এসে লাগল। সামনে তাকাতেই দৃশ্যমান হয়ে উঠল আলো ঝলমলে হরিণডাঙা। 

সকাল স্তম্ভিত, নির্বাক এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়! নিমিষহারা নয়নে চেয়ে রইল শুধু। ওক গাছের ডালে স্বপ্নের মতো ঝুলছে হলুদ ল্যান্টার্ন। মেপল গাছের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ বাতির জোনাকি। আর পর্ণকুটিরের পাশের গাছটা ঢেকে আছে রেইন শাওয়ার লাইটে। যেন আলোর বৃষ্টি হচ্ছে। সেই আলোর বন্যায় কুটিরের ছাদ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট ভাবে। সাদা আর লাল গোলাপ দিয়ে ছাদ ঢাকা। ভার্জিনিয়া রুবেলসের ঝালরঅলা দ্বারের সম্মুখে বিছানো হয়েছে একটি লম্বাটে রেড কার্পেট। কার্পেটের দুপাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাঙের ছাতার আকৃতির সোলার গার্ডেন লাইটস। এরিক থামল। নেমে পড়ল আরশান। নামল সকালও। আবেগ প্লাবিত গলায় বলল, ‘এগুলো সব আপনি সাজিয়েছেন?’ 

‘ডেকোরেটর এসেছিল।’ 

কথা বলতে বলতে আরশান এরিককে ওর ঘরে পৌঁছে দিল। এদিকে খুশিতে পাগল পাগল লাগছিল সকালের। আনন্দে ঝুমঝুমিয়ে উঠে বলল, ‘আমার লাইফের বেস্ট সারপ্রাইজ এটা। থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ!’ 

আরশান ওর টোল পড়া টুলটুলে গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘থ্যাংক্স টু ইউ!’ 

‘আমাকে আবার থ্যাংক্স কেন?’ 

‘আমার ছন্নছাড়া নিঃসঙ্গ জীবনে আশীর্বাদ হয়ে প্রবেশ করার জন্য ধন্যবাদ শেহজাদি!’ 

‘আজকে পাগলামোর বশে আমাকে বিয়ে করে ফেলার জন্য আপনাকেও অগণিত ধন্যবাদ! আপনি এত সাহসী জানতাম না তো!’ 

‘আজ থেকে শুরু করে প্রতিদিন আপনি আমার। শুধুই আমার। ব্যাপারটা মজার না?’ বিবশ গলায় বলল আরশান। 

সকাল চোখ নামালো নিচে। ওর পায়ের তলা শিরশির করছে। রক্তে শিস দিয়ে উঠছে উন্মত্ত শিহরণ। আতরের ঘ্রাণ ভাসছে হাওয়ায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে ওক গাছের ডালে ঝুলতে থাকা ল্যান্টার্নগুলোর ওপর অস্থির দৃষ্টি ন্যস্ত করল সে। আরশান কয়েক পা এগিয়ে এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। খোলা চুল সরিয়ে নিয়ে চুমু খেলো গ্রীবায়। তারপর কোলে তুলে নিয়ে ভার্জিনিয়া রুবেলসের ঝালর সরিয়ে ঢুকে পড়ল ছাউনির ভেতর। 

.

অক্টোবরের স্নিগ্ধশীতল অন্ধকার আকাশের বুকে নিশ্চিন্তে ভেসে ভেসে হেসে যাচ্ছিল সোনার থালার মতো গোলগাল সুখী চাঁদটা। চমকলাগা কিন্নরকণ্ঠে খানিক বাদে বাদে ডেকে উঠছিল রাতচরা পাখি। একজোড়া র‍্যাকুন ওক গাছের নিচে ছুটোছুটি করছিল দুরন্ত ভাবে। 

‘আপনি আসলেই ওয়েইট গেইন করেছেন।’ 

‘এরকম একটা বাজে কথা আপনি বলতে পারলেন?’

‘কী আজিব। সত্য বলা যাবে না?’ 

‘এটা মোটেও সত্য না। আপনার কোন আইডিয়া আছে লাস্ট দেড় বছর আমার ওপর দিয়ে কী গেছে?’ 

‘কী গেছে? ডিড ইউ মিস মি?’ 

‘কাজ নাই আর!’ 

‘মিস করেননি আমাকে?” 

দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে ওঠে দল বেঁধে। একটা শিঙাল হরিণ ছাউনির কাছে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায়। লাল গালিচাটা মুখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে পরখ করে। ঘাস চিবোয়। 

‘আপনি কি বাই এনি চান্স লজ্জা পাচ্ছেন, আরশান রহমান?’ 

‘লজ্জা পাচ্ছি না … লিটল নার্ভাস।’ 

‘নার্ভাস হলে আপনাকে কিউট লাগে।’ 

‘নাহ… আমি কিউট না আই অ্যাম সো ড্যাম হট! হাসছেন কেন? সিরিয়াসলি! আই উইল প্রুভ ইট টু ইউ 

…ইশ! লিপস্টিক কেন দিয়েছেন?’ 

‘আজকে আমার বিয়ে! সাজগোজ করব না? 

‘এটা ছাড়া সাজা যায় না?’ 

হিহি… আপনার গালে আর ঠোঁটে লিপস্টিক লেগে গেছে …রেগে যাচ্ছেন কেন? এখানে এত রাগের কী হলো?’ 

‘আর কখনো এসব বাজে জিনিস ইউজ করবেন না!’

‘কেন? আমার বুঝি সাজতে ইচ্ছে করে না?’ 

‘সাজতে হবে না। আপনার ঠোঁট এমনিই পারফেক্ট। আমার ফেভরিট!’ 

কুটিরের ছাদে ঝরা পাতার বৃষ্টি হয়। একটা কাঠবিড়ালি মেপল গাছের ডাল থেকে ঝপ করে লাফিয়ে পড়ে ছাদের ওপর। 

‘চাচার সাথে কথা বলেছিলেন?’ 

‘এখন ওসব কথা থাক।’ 

‘ভয় করছে আমার।’ 

‘ভয় কেন?’ 

‘শব্দ হচ্ছে কীসের?’

‘বাতাসে ছাদ নড়ছে।’ 

‘কী ভয়ঙ্কর! ভুত-টুত আসবে না তো?’ 

‘ভুত তো আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। বেজমেন্টের ভুত!’

‘বেজমেন্টের ভুতটা আমার খুব প্রিয়!’ 

‘তাই?’

‘হুম।’ 

‘কতটা প্রিয়?’ 

‘অনেক অনেক অনেক বেশি প্রিয়।’ 

‘ভুতটারও আপনাকে পছন্দ। জানেন নাকি?’ 

‘আপনার হাতে কী হয়েছে আরশান?’ 

‘হ্যামার দিয়ে স্ট্রাইক করেছিলাম।’ 

‘কী আশ্চর্য! কেন?’ 

গাছের ডালের ফাঁকে নিশাচর পাখি ডানা ঝাপটায়। বোকা হরিণটা মায়াবী চোখে ফুল আর লতাপাতায় ছাওয়া কুটিরের দিকে তাকিয়ে থেকে দুটি মানুষের ছায়া পর্যবেক্ষণ করে। উদাস ভাবে ঘাস চিবোয়। বাতাসে দোল খায় ছাদে আটকে থাকা গোলাপ গুচ্ছ। পাপড়ি ওড়ে এদিক সেদিক। ভেতর থেকে নিচু গলার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। 

‘চুপ করে আছেন কেন?’ 

‘আপনাকে মিস করছিলাম। কিছুই ভালো লাগছিল না… তাই …’ 

‘তাই নিজের হাতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করবেন? আপনি কি পাগল?’ 

‘পাগল ছিলাম না। আপনি আমাকে পাগল বানিয়ে ।ছেড়েছেন।’ 

‘আর কখনো নিজেকে কষ্ট দেবেন না। হাসছেন কেন?’

‘ভাবছি আবারও আঘাত করব নিজেকে 

‘কী পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে ভাই! কেন করবেন এসব?’ 

‘করব …কারণ এসব করলে আপনি আবারও এভাবে আদর করবেন এখন যেভাবে করলেন!” 

‘এরপর মাইর দিব। আস্তে … কী হচ্ছে? লাইট অফ করেন।’ 

‘লাইট থাকুক। আমি আপনাকে দেখতে চাই।’ 

মায়াবী চোখের হরিণটা ধীরে ধীরে সরে আসে। চিঁহি করে একবার ডেকে ওঠে এরিক। অকারণে নড়েচড়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। ছোট্ট কাঠের ঘরটা মড়মড়িয়ে ওঠে। 

‘আপনি এত সুন্দর কেন, শেহজাদি?’

‘আপনি সুন্দর।’ 

‘আপনি সবচেয়ে সুন্দর।’ 

‘সবচেয়ে সুন্দর তো বেজমেন্টের ভুত!’ 

‘সবচেয়ে সুন্দর হরিণডাঙার শেহজাদি! অক্টোবরের চেয়েও সুন্দর! …ঝরা পাতার বৃষ্টি হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছেন?’

‘পাচ্ছি। সেই সাথে আরো কিছু শুনতে পাচ্ছি।’

‘কী?’ 

‘আপনার হার্টবিট। 

‘ইট বিটস ফর ইউ, সকাল! ইউ মেক মাই হার্ট বিট ফাস্টার।’ 

‘আরশান!’ 

‘হুম?’ 

‘আপনাকে ভালোবাসি!” 

‘আমিও আপনাকে ভালোবাসি সকাল! ভালোবাসার চাইতেও বেশি ভালোবাসি!’ 

হুহু করে হাওয়া বয়ে যায়। পাতা খসে যায় গাছের গা থেকে। তারপর সেইসব পাতারা কবিতার মতো স্নিগ্ধ ছন্দে ভেসে ভেসে, সারা গায়ে কুচি কুচি জোছনা মেখে, প্রেমে পড়ার মতো করেই নিঃশব্দে নিভৃতে মাটির বুকে উড়ে এসে পড়ে! দুটি মানব হৃদয়ের সহস্র আকুলিবিকুলি স্পন্দনের সাক্ষী হয়ে শীতগন্ধি মায়াবী রাতটা গভীর থেকে গভীরতর হয়। গোলগাল সুখী চাঁদ গলন্ত রুপা ছড়িয়ে দেয় অরণ্যের হিমেল বুকে। কাঁচা ফুলের ঘ্রাণ আর শুকনো পাতার হিমহিম মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে বাতাস! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *