১৮
কী করবে? কী করা যায়? কী করলে দু-দণ্ড শান্তি মিলবে? জানে না আরশান। অপ্রতিরোধ্য রাগে কাঁপছে সারা শরীর। চেহারায় দুর্যোগের পূর্বাভাস। বুকের ওপর যেন অপমানের সপাং সপাং চাবুক পড়ছে একের পর এক। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত এবং কণ্টকিত। সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে সকালের ওপর। মন চাইছে নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করে মেয়েটাকে। এই একটা কাজ করতে পারলেই হয়তো সত্যিকার অর্থে গায়ের জ্বালা জুড়োত।
কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না সে। ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় অবিন্যস্ত পায়ে পায়চারি করছিল। কতক্ষণ কেটেছে হিসেব নেই। হঠাৎ কেউ একজন লিভিং রুমের দরজায় ধাক্কা দিল। অস্থিরমতি আরশান এগিয়ে গেল দ্রুত পায়ে। স্লাইডিং ডোর টেনে ধরতেই সকাল ঢুকল ঘরের ভেতর।
‘কেন এসেছেন?” ধমকে উঠল আরশান।
‘ওমা! আপনিই তো বলেছিলেন আসতে।’ সকাল দেখল আরশানের মুখ তেজের আগুনে লালচে হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত। পরনে এখনো অফিসের ফর্মাল ফুলস্লিভ শার্ট, কালো প্যান্ট। পায়ের জুতোজোড়াও খোলা হয়নি। চেহারা শীর্ণ, চুল অবিন্যস্ত। উন্মাদের মতো চোখের চাউনি।
‘কী হয়েছে? এরকম করছেন কেন?’
আরশানের মাথায় এখন ঝড়। বাহ্য জ্ঞান সক্রিয় নয়। সে বেহেড গলায় বলল, ‘আপনি যান এখান থেকে।’
‘ধমক দিচ্ছেন কেন?’ বিশ্বের বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে সকাল।
‘আপনি দয়া করে বিদায় হন। আমি কিন্তু আপনার ক্ষতি করে ফেলতে পারি যেকোনো মুহূর্তে। আমার মাথা ঠিক নাই।’
‘কী ক্ষতি করবেন আপনি আমার? সরে দাঁড়ান। ভেতরে আসতে দিন। মা ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ফাঁকে আপনার সাথে একটু দেখা করতে এলাম। কাল তো চলে যাচ্ছি। আজকেই হয়তো শেষ দেখা। শেষের দিন এমন দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন?”
আরশান অধৈর্য ভাবে নিজের মাথাটা চেপে ধরে দুহাত দিয়ে। তিক্ত গলায় বলে, ‘আপনার সাথে কথা বলার রুচি নেই আমার।’
‘সব আমার দোষ?’
আরশান তীব্র চোখে তাকাল। ওই চাউনিতে নীরব হুঙ্কার। রাগের চোটে স্ফীত হয়ে উঠেছে কপালের নীল শিরা।
‘হ্যাঁ, আপনারই দোষ!
‘আপনি বুঝতে পারছেন না এখানে আমার কিছুই করার নেই।’
‘করার থাকবে না কেন? বিয়ে তো করছেন!’
সকাল তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু বলল না। চুপ করে ভাবল কী যেন। ওর চুলগুলো পিঠের ওপর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে। ল্যাম্পশেডের ফিকে আলোয় কামিজের রঙ ঠিকঠাক বোঝা যায় না। চোখের কোল ফোলা। গালে কান্নার দাগ। মুখে সুগভীর যন্ত্রণার চিহ্ন। আরশান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল। সকাল ধীর গলায় বলল, ‘আমি জানি ভালোবাসার মানুষদের ওপরেই আপনার রাগ সবচেয়ে বেশি। আপনার বাবার সাথেও রাগ করে আছেন কতদিন ধরে! নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন, বৃদ্ধ মানুষটাকেও কষ্ট দিচ্ছেন। এত রাগ পুষে রেখে কী লাভ, আরশান? চাচাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকেও ক্ষমা করে দিন।’
আরশান নিশ্চুপ। আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলন্ত অভিমান বুক জুড়ে বসে আছে এখনো শ্বাপদের ন্যায়।
বাবা চলে যাবার পর মা একদম কেমন পাগলের মতো হয়ে গেল। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকাকে লালন পালন করছি। বোধ-বুদ্ধি তার একেবারেই লুপ্ত হয়েছে। তার ধারণা আপনার সাথে আমার বিয়ে হলে আবারও খারাপ কিছু ঘটবে। এই বদ্ধমূল ধারণার পেছনে আত্মীয়-স্বজনদের উস্কানিও কম দায়ী নয়। কিন্তু আমার মনে হয় মূল কারণ এটা নয়। মূল কারণ হলো মা আমাকে চোখের আড়াল করতে চাইছে না। আপনাকে বিয়ে করলে আমেরিকা এসে থাকতে হবে। এতে মা একদম একা হয়ে যাবে। তাই মনের অজান্তেই সে আপনাকে শত্রু ভাবছে। আপনাকে সহ্য করতে পারছে না।’
আরশান রুষ্ট হেসে বলল, ‘আপনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। আমাকে বিয়ে করবেন না ঠিক আছে। কিন্তু জোর করে আপনাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়া হচ্ছে এটা মানতে পারলাম না। নিশ্চয়ই এই বিয়েতে আপনার মত আছে।’
‘আমার মত থাকা না থাকায় কিছু এসে যায় না।’
আরশান উঠে দাঁড়ালো। দেওয়ালের পেইন্টিং এর দিকে চোখ নিবদ্ধ করে লোহার মতো শক্ত গলায় বলল, ‘এর মানে আপনি কাঠের পুতুল ছাড়া কিছুই নন। যে যেভাবে নাচাবে সেভাবেই নাচবেন। আপনার সাথে কথা বলে লাভ কী বলুন? মানুষের সাথে কথা বলা যায়, নিষ্প্রাণ পুতুলের সাথে বলা যায় না।’
সকাল অস্ফুটে বলল, ‘তাহলে কি চলে যাব?’
‘যান।’
‘আপনার আর কিছু বলার নেই আমাকে?’
আরশান নাক উঁচু হাসি হাসে, কাষ্ঠ গলায় বলে, ‘সুখে থাকুন। ভালো থাকুন। স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি। আমার কাছ থেকে শত হাত দূরে থাকুন। তবেই আপনি এবং আপনার পরিবার নিরাপদে থাকবেন।’
সকাল ঝাপসা চোখে চেয়ে বলল, ‘আমার একটাই কষ্ট। আপনি আমাকে বুঝলেন না।’
আরশান ওর দিকে তাকাল না। দেওয়ালে চোখ ঠেসে রাখল।
‘সব শেষে একটা অনুরোধই করব। চাচাকে ক্ষমা করে দিয়েন। জীবনটা খুব ছোটো। আমার বাবা চলে যাবার পর হাড়ে হাড়ে এই সত্যটা টের পেয়েছি। কত কথা যে বলার ছিল! কত কিছু করার ছিল! সব এভাবে হুট করে থেমে যাবে কে জানত বলেন? আপনার হাতে এখনো সময় আছে। পরিবারের সাথে সম্পর্কটা ঠিক করে নিন…।’
‘লেকচার দেওয়া শেষ হলে প্লিজ বিদায় হন। আমার ফ্যামিলির সাথে আমি কী করব সেটা আমার ব্যাপার।’
সকালের দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। দুর্দমনীয় পাষাণভাৱে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল পাঁজরের হাড়। গলার কাঁপুনি আড়াল করার চেষ্টা করে হাঁফ ধরা গলায় বলল, ‘আপনার হাতটা একবার ধরতে পারি?’
আরশানের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল যেন। হুঙ্কার ছাড়ল, ‘প্লিজ লিভ!’
সেই মুহূর্তে সকাল দেখল আরশানের রক্তাভ চোখের ঘন পাপড়িতে কয়েক ফোঁটা জলের ঝিকিমিকি। বিশীর্ণ মুখে ক্রোধের ঝংকার। হঠাৎ ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বাতির স্ট্যান্ডটা লাথি মেরে ফেলে দিল আরশান। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল বাল্ব শেড। কাঠের দেওয়াল থরথর করে কেঁপে উঠল। ঘরময় নেমে এলো অন্ধকার। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল সকাল। কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আরশান ওর হাত চেপে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলো দরজার বাইরে। তারপর ডেকের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে ফুঁসতে ফুঁসতে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। আটকে দিল স্লাইডিং ডোর। বাইরে দিগদিগন্তব্যাপী মাতাল বাতাস বইছে। আকাশের অন্ধকার বুক খানিক বাদে বাদে চিরে দিচ্ছে নীল বিদ্যুৎ। ব্যাকইয়ার্ডে শুকনো পাতার দল ঘূর্ণি হয়ে পাক খাচ্ছে বাতাসে। অরণ্যের গাছে গাছে ধাক্কা খেয়ে হুহু করে কাঁদছে বাতাস। যেন আসন্ন ঝড়ের ভয়ে গুমরে গুমরে আর্তনাদ করছে। সকাল মেঘ থমথমে অন্ধকার রাতে ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে রইল স্ট্যাচু হয়ে। দুরন্ত হাওয়া ওর চুল উড়াচ্ছে। কেড়ে নিতে চাইছে গলায় প্যাঁচানো ওড়না। ওর চোখে এখন জল নেই। আছে দুনিয়া কাঁপানো বিস্ময়, ভয় এবং হতাশা। সে কানের কাছে এখনো ভাঙচুরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। একটা দুর্বিষহ অসহায় বোধে মথিত হচ্ছে হৃদয়। এই মানুষটা এত অদ্ভুত কেন? এ কি বুঝতে পারছে না যে আজকের পর আর কখনো ওদের দেখা হবে না? ওকে কাছে পাবার আকণ্ঠ পিপাসা বুকে নিয়েই কেটে যাবে যৌবনের সব দুরন্ত দিনগুলো। সূর্য উঠবে, অস্ত যাবে নিয়ম করে…এই পিপাসা মিটবে না। বসন্ত আসবে…ফুল ঝরবে…এই পিপাসা মিটবে না। বয়স বাড়বে। মুখের চামড়া ঝুলে গিয়ে বেলা শেষের ঘণ্টা বাজাবে…এই পিপাসা মিটবে না। তারপর একদিন মৃত্যু এসে চুকিয়ে দেবে জীবনের সমস্ত লেনদেন!
আরশান স্লাইডিং ডোরের নব ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। কাচের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল বাইরের ঝড়ো তাণ্ডব। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। নীল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে চারপাশ। বজ্রপাতের শব্দে কাঁপছে পৃথিবী। সকাল যায়নি এখনো, দাঁড়িয়ে আছে দিব্যি। ওর মোমে মাজা মসৃণ গালে বিদ্যুতের নীল বিভা চমকাচ্ছে। অস্থির আরশান দরজা খুলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গর্জে উঠে, ‘যাচ্ছেন না কেন?’
সকাল ক্লিষ্ট স্বরে বলে, ‘যাব তো! সমস্যা কী আপনার?’
‘এক থেকে তিন গুনব। এর মধ্যে যাবেন নইলে আর আপনার যাওয়া হবে না।’
‘মানে কী?’
‘মানে আপনাকে আর যেতে দেওয়া হবে না।’
সকাল বিস্মিত হয়। ‘যেতে দেবেন না?’
আরশান দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে, ‘না দেব না। খুন করে ফেলব।’
‘আপনি পাগল!’
‘হ্যাঁ, আমি পাগল।’
সকালের হঠাৎ মনে পড়ল সদর দরজা লক না করেই সে বেরিয়ে এসেছে। বাড়ির ভেতর দিয়েও বেজমেন্টে নামা যায় কিন্তু সেক্ষেত্রে যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। এখন কেউ দেখে ফেললে বাইরে হাঁটতে যাবার অজুহাত দেখাতে পারবে। কিন্তু মা জেগে উঠলেই সর্বনাশ 1 এই মহিলা সকালকে পাশে না পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে নির্ঘাত একটা অনর্থ ঘটাবেন। ভাবনাটা মাথায় আসতেই ব্যস্তভাবে বলল, ‘যাই তাহলে।’
আরশান নিশ্চুপ, মুখে রা নেই। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে ডেকের সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নেমে আসে সকাল। শুকনো পাতায় মচমচ শব্দ তুলে এগিয়ে যায় কয়েক পা। আরশান প্রলয়ঙ্করী দৃষ্টি মেলে ওর প্রস্থানের দৃশ্যটা দেখতে থাকে। বুক খা-খা করে। মনে হয় পৃথিবীটা ঠিক মাঝখান থেকে ভেঙে দুইভাগ হয়ে যাচ্ছে। বিদীর্ণ, খণ্ডিত, চূর্ণিত কাচের টুকরোর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধ্বংস হচ্ছে। সকাল একবার থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে বলে, ‘শুনুন, আপনি কিন্তু চাচার সাথে মিটমাট করে নিয়েন। আরেকটা কথা… অ্যান্ড্রিয়ানা খুব ভালো মেয়ে। আপনি ওকে বিয়ে করে নিলেই তো পারেন!’
আরশান কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোয়াল দুটো লোহার মতো শক্ত। হাত মুষ্টিবদ্ধ।
সকাল কান্না চাপানো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, ‘আপনাকে ভালোবাসে মেয়েটা। কষ্ট দিয়েন না ওকে। কেমন?’
কয়েকটা সেকেন্ড নীরবে কেটে যায়। কেউ কোনো কথা বলে না। বিদ্যুতের আলোর ঝলকে হঠাৎ হঠাৎ একে-অন্যের মুখ দেখতে পায়। সকাল বলল, ‘ইউএস এসেছি নাবিলার বিয়ে খেতে নয়, বরং আপনাকে শেষবারের মতো দেখব বলে।’
আরশান নেমে আসে উঠোনে। চন্দ্রাহত পায়ে এগিয়ে যায় সকালের দিকে। ঠিক সেই সময় বাড়ির ভেতর ভস করে জ্বলে ওঠে একটা ফকফকে বাতি। ওপর তলা থেকে ভেসে আসে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। চমকে ওঠে ওরা। বুকে ভূমিকম্প নিয়ে বিস্ফারিত নেত্রে তাকায় বাড়ির দিকে। কয়েকটা সেকেন্ড কেটে যায় নিঃশব্দে। তারপর হঠাৎ করেই মায়ের আতঙ্কিত কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘আমার মেয়ে কোথায়? কোথায় গেল আমার মেয়ে?’
সকালের হৃৎপিণ্ড তখন লাফ দিয়ে গলার কাছে চলে এসেছে। এত ভয় কোনোদিন পায়নি সে। কাঁপতে কাঁপতে আর্ত গলায় বলল, ‘মা, জেগে উঠেছে। হায় আল্লাহ! এখন কী হবে?’
আরশান শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেল অন্ধকার জঙ্গলের দিকে। সকাল নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। গায়ের জোরে পারল না। বাড়ির ভেতরের বেশ কটা আলো জ্বলছে এখন। সেই আলোর হালকা রেশ এসে পড়েছে ব্যাক-ইয়ার্ড সংলগ্ন জঙ্গলে। যেখানে একটা হৃষ্টপুষ্ট মেপল গাছের নিচে ওরা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের পিঠ ঠেকে আছে গাছের গায়ের সাথে। মুখ রক্তশূন্য। চোখে ভয়ের আঁকিবুকি। কম্পনরত গলায় কোনোরকমে বলল, ‘কী করব আমি? কী বলব আমার মাকে?
আরশান মুখে একটা শ’ কারান্ত শব্দ করে ওর ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল। চিবুক উঁচু করে তাকাল সকাল। দুইজোড়া চোখের দৃষ্টি লগ্ন হতেই সমস্ত ভয়, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা উবে গেল নিমেষে। প্রেতাত্মার নিশ্বাসের মতো ফোঁসফোঁস শব্দে দূর দূরান্ত থেকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে দামাল বাতাস। দোর্দণ্ড প্রতাপে উড়িয়ে দিচ্ছে গাছের পাতা আকাশে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। শুকনো পাতার দল শব্দের মিছিল তুলে ক্রমাগত প্রদক্ষিণ করে চলেছে ওদের। বাড়ির ভেতর চিৎকার, চেঁচামেচি, আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ ওদের কানে আসছে কিন্তু মস্তিষ্কে ধাক্কা দিচ্ছে না। ওরা নির্নিমেষ চেয়ে আছে পরস্পরের দিকে। আরশানের সুন্দর চোখের তারা উড়ে গিয়ে বসেছে সকালের সুন্দর দুটি ঠোঁটের ওপর। আশেপাশে কেউ নেই। কিছু নেই। শুধু বুকের মধ্যে একটা বিধ্বংসী প্রলয়। নিশ্বাসে উত্তাপ।
আরশান কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে অনেকটা কেটে কেটে বলে, ‘কী বলছিলেন আপনি? অ্যান্ড্রিয়ানাকে বিয়ে করতে হবে?’ সকালের বুক কাঁপে ধড়ফড় করে। ফর্সা গালে চকচক করে রক্তিমাভা। পৃথিবীর সমস্ত স্নিগ্ধতা ভর করে মুখের আনাচে কানাচে। ভারী সুন্দর, কোমল আর পবিত্র দেখায় ওকে। নিখুঁত দুটি ঠোঁট নেড়ে ও অস্ফুটে বলে, ‘হ্যাঁ।’
‘ভালোবাসতে হবে?’
আরশানের ধারঅলা চোয়ালে লাইটের প্রলেপ এসে পড়েছে। দৃষ্টিতে বিভ্রম। চোখের দীঘল পাপড়ির ছায়া পড়েছে গালে। সকালের মনে হলো আরশানের চোখজোড়া শুধু যে সুন্দর তাইই নয়, বরং অনেক বেশি বাঙময়। নিঃশব্দে নিভৃতে হরেক কথা বলে যায় ওই চোখ। সকাল ওর চোখের দিকে চেয়ে থেকে আবিষ্ট স্বরে ছোটো করে উত্তর দেয়, হুম!’ আরশান ওর কপালের চুল সরিয়ে আলতো করে একটা চুমু খায়, ‘আদর করতে হবে?’
সকালের মেরুদণ্ড শিরশির করে ওঠে। প্রতিবাদী স্বরে বলে, ‘না!’
‘কেন? বেচারিকে বিয়ে করব, ভালোবাসব আর আদর করব আপনাকে? এটা অন্যায়।’
‘কিছুই করতে হবে না। আপনি শুধু আমার হয়েই থাকুন।
বেজমেন্টে কেউ একজন নেমে এসেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে ডেকের আলো। টের পেয়ে সচকিত হয়ে উঠল সকাল। ফিসফিস করে বলল, ‘কী করব এখন?’
উত্তরে আরশান মাদক হাসি হাসল। সকাল বিস্মিত, ‘আপনি হাসছেন? আশ্চর্য…’
আরশান আচমকা ওর ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিয়ে কথা আটকে দিল। তৃষাতুর, গভীর, প্রলম্বিত একটি চুম্বনের পর ক্ষীণ অথচ তীব্র গলায় বলল, ‘আমি আমার সারা জীবনে আপনাকে যতটা চেয়েছি, তার চেয়ে বেশি আর কখনোই কিছু চাইনি। সেই আপনাকেই আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ইটস নট ফেয়ার…ইটস নট ফাকিং ফেয়ার!’
ওই আচমকা স্পর্শ সকালের বুকের জ্বালা মিটিয়ে দিয়েছে। রক্তে ঝিরঝির করে বইছে শিউলি ফুলের স্রোত। সে আচ্ছন্ন গলায় বলল, ‘আরশান, আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরুন। এমন ভাবে জড়িয়ে ধরুন যেন কেউ কখনো আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে না পারে।’ আরশান ওকে টেনে নিলো আরো কাছে। অজস্র কবোষ্ণ চুম্বনে ভরিয়ে দিল সারা মুখ। জড়িয়ে ধরল বুকের সাথে শক্ত করে।