সেদিন অক্টোবর – ১৭

১৭

প্রত্যাখ্যানের মর্মযাতনার স্বরূপ সম্পর্কে আরশান এতকাল সম্যক রূপে জ্ঞাত ছিল না। জীবনের কোনো স্তরে কোনো পরীক্ষায়ই সে বাতিল প্রতিপন্ন হয়নি। কিন্তু সকাল আজ দ্বিতীয়বারের মতো তাকে প্রত্যাখ্যান করল। এই প্রত্যাখ্যান সুস্পষ্ট এবং জোরালো। ভালোবাসার উপস্থিতি থাকলে সামাজিক রীতিনীতির বেষ্টনী খুলে, কারাগার ভেঙে বেরিয়ে আসা মানুষের জন্য খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। সকাল কেন পারছে না সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে শুধুমাত্র আরশানকেই বেছে নিতে? কেন বারবার সমাজটাই তার কাছে প্রাধান্য পায়? যত দিন যাচ্ছে আশেপাশের মানুষের নিকৃষ্টতা ততই প্রবল হয়ে ধরা পড়ছে চোখে। আরশান কী করবে? কোথায় যাবে? কাকে নিয়ে বাঁচবে? নিজের জন্মদাতা পিতার প্রতারণা ভুলতে পারেনি হাজার চেষ্টা করেও, এখন সেই সাথে যোগ হলো জীবনের একমাত্র ভালোবাসার নারীর প্রবঞ্চনা এবং প্রত্যাখ্যান। পৃথিবীর মায়াও কি কেটে গেল? অক্টোবরকে হয়তো আর কখনোই আগের মতো ভালো লাগবে না। পাতা ঝরার এই মায়াবী দিনগুলোতে গাঢ় নীল আকাশের দিকে চোখ তুলে চাইলেই একটি মেয়ের টোল পড়া গালের আশ্চর্য সুন্দর হাসি মনে পড়বে। হেমন্তের সমস্ত মহিমাকে ভেঙে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে সেই সর্বনাশা হাসি আরশানের বুকের মধ্যে দাউদাউ করে বিরহের আগুন জ্বালাবে। ভেতর থেকে হঠাৎ ডাক ছুটে আসে, তুমি কি হেরে গেলে? তোমার জীবন নিয়ে খেলা করার অধিকার কী করে পায় অন্য লোকে? এমন তো হবার কথা ছিল না। তুমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, একা বাঁচবে, একাই টিকে থাকবে এবং ভালো থাকবে! মোহ কাটিয়ে জেগে ওঠো। জেগে ওঠো এখনই! 

আরশান বড়ো একটা শ্বাস টেনে নেয়। মাথার ভেতরের এলোমেলো জট পাকানো চিন্তা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সংসারে হয়তো আর কোনোদিন মন ফিরবে না। কিন্তু কাজে তো ফিরতেই হবে। সব মানুষের দুটা মন থাকে। একটা আসল অপরটা নকল। নকল মনটা কখনোই আসল মনের মতো সক্রিয় হয় না। কিন্তু যেসব দুর্ভাগা মানুষের মৌলিক মন হারিয়ে যায়, তাদের কৃত্রিম বা নিষ্ক্রিয় মন দিয়েই কাজ চালাতে হয়। আরশানের নকল মনটা সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যে বারে বারে ব্রেক কষছিল। বৈষয়িক অভিনিবেশ হার মানছিল আবেগের প্রাবল্যের কাছে। আর মাত্র কয়েকটা দিন পরে সকালকে চিরতরে তার জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে অন্য এক পুরুষ। আরশান যখন একাকীত্বের গুরুভারে পিষ্ট হবে, নিঃস্ব হবে, সর্বসান্ত হবে… সকাল হয়তো তখন পরম নিশ্চিন্ত চিত্তে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমোবে! 

অগোছালো ভাবনাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে সে। অফিস শেষে বাস্কেট বল খেলতে যায়। কলিগের বাসার লেট নাইট পার্টিতে যায়। ডিনারের পর হালকা পাতলা মদ্যপান করে। বাড়ি ফিরে আসার পর মনে হচ্ছিল মানসিক ভারসাম্য অনেকখানিই ফিরে এসেছে। পারবে সে…পারবে বেঁচে থাকতে সকালকে ছাড়া…পরিবার ছাড়া। ছোটো জীবন। কেটে যাবে! 

গাড়ি পার্ক করে ব্যাক-ইয়ার্ডে যাবার সময় কী মনে করে প্যাটিয়োর সামনে একবার দাঁড়ালো। ভেতর থেকে হাস্যমুখর কথাবার্তা ছুটে আসছে। সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক বাজনা বেজে চলেছে বাড়ির ভেতর। এই বাজনা আরশানকে ছোঁয় না বহুদিন। আর কখনো ছোঁবে ও না। তবুও আরশান দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ, এক হাতে জ্যাকেট ঝুলিয়ে, অপর হাত প্যান্টের পকেটে পুরে। কতক্ষণ কাটল কে জানে, একটা সময় সে বাড়ির ভেতর ঢুকল নিঃশব্দে। ডাইনিংয়ে বসে আছে সবাই। হয়তো ডিনার করছে। পারিবারিক মজলিশে অনাহূতের মতো হানা দেওয়ার কোনো সংকল্প ছিল না। কিন্তু মনটা তো বজ্রমুষ্টিতে নেই। বিবেক হরহামেশা নিষ্পেষিত হচ্ছে প্রবৃত্তির অত্যাচারে। একবার…শুধু আরেকবার শেষবারের মতো সকালকে দেখবে বলেই রিক্তহস্ত ভিক্ষুকের মতো সংসারের দ্বারপ্রান্তে এসে আবারও কড়া নাড়ল সে! 

ওর উপস্থিতিতে সবাই চমকে গেল সেকেন্ডের জন্য। বিব্রত আরশান অপ্রতিভ চোখ মেলে তাকাল পরিবারের সদস্যদের দিকে। কী বলবে খুঁজে পেলো না। লজ্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। ফাহাদই কথা বলল সবার প্ৰথমে। 

‘হোয়াসসাপ, ব্রো? দাঁড়িয়ে কেন? এসো বসো!” একটা খালি চেয়ার এগিয়ে দিল ফাহাদ ওর দিকে। আরশান বিষাদগ্রস্ত চোখে একবার তাকাল সকালের দিকে। চার চোখেতে মিলন হলো। আজ্ঞাবহ ভৃত্যের মতো ফাহাদের এগিয়ে দেওয়া চেয়ারটায় বসল আরশান। তার মুখে একটা বিহ্বল ভাব খেলছে। ঠোঁট শুকনো, চোখের দৃষ্টি মৃত। সকাল একটা চিনেমাটির প্লেটে সামান্য ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। আরশানের উপস্থিতি তার স্পৃহাশূন্য ফ্যাকাশে মুখে রক্তের সঞ্চারণ করেছে। বেড়ে গেছে হৃদযন্ত্রের গতি। বুকটা এত জোরে ধুকপুক করছে যে মনে হচ্ছে আশেপাশের লোকজন নিমেষে টের পেয়ে যাবে হৃদয়ের উত্তেজনা। হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাত হলো। সকালের মা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন চকিতে। মেয়ের দিকে চেয়ে কঠোর গলায় বললেন, ‘ভেতরে চলো।’ 

সকাল স্তম্ভিত! নিশ্চল, জড়ীভূত চোখ নিয়ে কিয়ৎক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে রইল মায়ের দিকে। মা ধমকে উঠলেন, ‘কথা কানে যায় না?’ 

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সকাল। প্রস্থানের আগে একবার শুধু আরশানের দিকে তাকাতে পারল। কষ্টে মুচড়ে উঠল বুক। মনে হলো এত যন্ত্রণাবিদ্ধ চেহারা সে জীবনে আর কোনোদিন দেখেনি। 

আরশান স্থাণুবৎ হয়ে বসে ছিল। শরীরে সাড় নেই। এইমাত্র ঘটে যাওয়া অপমানজনক ঘটনাটা তার ভেতরকার সমস্ত স্পন্দন কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে দিয়েছে। পরিবারের ছোটো-বড়ো সব সদস্যের সামনে মাথা হেঁট করে কিছু সময় অপরাধীর ভঙ্গিতে বসে থেকে একটা ফ্যাকাশে হাসি হাসার চেষ্টা করল সে। কষ্টে-সৃষ্টে বলতে পারল, ‘সরি…আমার আসলে এখানে আসা উচিত হয়নি।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *