১৬
বাড়ি ফিরে আসার পর এত দুর্বল লাগছিল যেন অনেক বড়ো একটা ঝড় বয়ে গেছে শরীরের ওপর দিয়ে। মাথার ভেতরটা ঝাপসা। চিন্তায় স্থিরতা নেই। মা ওকে দেখে এমন ভাবে দৌড়ে এলেন যেন হারানো পুতুল খুঁজে পেয়েছেন। জড়িয়ে ধরে কিশোরী বালিকার মতো খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন। ছেলেমানুষি গলায় বললেন, ‘তুই এসেছিস? আল্লাহ! বাঁচলাম। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
সকাল ফ্যাকাশে চোখে মায়ের আলুথালু চুলের পাগল পাগল মুখটার দিকে চেয়ে বলল, ‘ভয় পেয়েছ কেন? ভয়ের কী আছে? আমি একটু হাঁটতে গিয়েছিলাম।’
মা বড়োই দুঃখিত গলায় মিনমিন করে বললেন, ‘কী জানি। আজকাল কেমন যেন ভয় হয়। মনে হয় তুইও চলে যাবি আমাকে ছেড়ে।
‘আমি তো বলেছি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।’
মা একটু সময় চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমার ভয় হয় ওই ছেলেটা তোকে নিয়ে যাবে। কিংবা তুই ওর কাছে চলে যাবি।”
‘আমি যেখানেই যাই না কেন, তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যাব মা।’
‘কিন্তু আমি তো তোর বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। আমি আমার নিজের বাড়িতেই মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে চাই।’
‘হ্যাঁ, বুঝেছি।’
মা গলাটা খাদে নামায়, ‘তোকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আরশান কিন্তু আমাদের পরিবারের জন্য শুভ নয়। ওর সাথে সম্পর্কে জড়ালে আবার কোনো ক্ষতি হবে। বড়োসড়ো ক্ষতি।’
সকাল দিশাহারা হয়ে ওঠে, ‘চুপ করো, মা। প্লিজ চুপ কর! আমার মাথাটা খারাপ করে দেবে তুমি। হয় পাগল হয়ে যাব নয় মরে যাব!”
কথাটা বলে হনহন করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। হাত- পা কাঁপছে। ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথার রগ। ক্ষুধা-তৃষ্ণার বোধ লুপ্ত প্রায়। ফাহাদকে বসার ঘরে পাওয়া গেল। সকাল খুব জরুরি গলায় বলল, ‘ফাহাদ, লক্ষ্মী ভাই আমার। অ্যান্ড্রিয়ানার সাথে একবার দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবে?’
ফাহাদ সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সকালের মুখে কী যেন পড়ার চেষ্টা করল। তারপর সহজ গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, শিয়োর। কখন দেখা করতে চাও?’
‘আজকেই। কাল রাতে তো আমাদের ফ্লাইট। ফিরে যাচ্ছি দেশে।’
ফাহাদ পকেট থেকে ফোন বের করল ‘ঠিক আছে। আমি নক করে দেখি।’
.
অ্যান্ড্রিয়ানার সাথে দেখা হলো বার্ক লেকে। ফাহাদ গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল ওকে। এই সেই জায়গা, যেখানে আরশান সকালকে দুষ্টুমির ছলে লেকের পানিতে ফেলে দিয়েছিল। এইসব স্মৃতি মাখা স্থানে হয়তো আর কখনোই আসা হবে না। এই শেষ!
অ্যান্ড্রিয়ানা এলো মিনিট বিশেক সময় পরে। সবুজ ব্লাউজ আর কালো জিন্সের নীলাঞ্জনা শ্বেতাঙ্গিনি মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছিল যে সকাল দেখামাত্র কেমন বোকা বনে গেল। জিন্সের সাথে সাদা রঙের একটা টিশার্ট পরেছিল সকাল। তার ওপরে কালো উইন্ডব্রেকার। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। সুন্দরী অ্যান্ড্রিয়ানাকে দেখার পর নিজেকে খুবই ফকির ফকির লাগছে তার। এতক্ষণ সে নিষ্প্রভ ছিল, চুপচাপ ছিল, কিন্তু অ্যান্ড্রিয়ানার উদ্ভাসিত ঝলমলে উপস্থিতি যেন ওকে স্তব্ধ করে দিল পুরোদমে।
‘কেমন আছ?’ প্রশ্ন করল অ্যান্ড্রিয়ানা। ভাঙা বাংলায়।
সকাল হাসার চেষ্টা করল, ‘ভালো।’
‘কিছু বলতে চাও আমাকে? ডেকেছ কেন?’
কী বলতে চেয়েছিল তা বেমালুম ভুলে গিয়েছে সকাল। মেয়েটা এখানে আসার এক মুহূর্ত আগেও প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। মন চাইছিল ওকে আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে দেয়, চুলের মুঠি চেপে ধরে প্রশ্ন করে, আরশানের সাথে ওর কীসের সম্পর্ক। কিন্তু এখন, মেয়েটির সহাস্য, সুন্দর উপস্থিতি ভেতরকার প্রতিহিংসার আগুনে উপহাসের জল ছিটিয়ে দিল যেন। নিজেকে খুব ছোটো মনে হচ্ছে। নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। এত চমৎকার একটি মেয়ে যদি আরশানকে সত্যিই ভালোবাসে, আরশানও যদি তাকে চায়, তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। আরশান সুখে থাকুক এটাই তো সে কামনা করে এসেছে সবসময়। ওর চোখের কোণে জলের আভাস চিকচিক করছিল। আন্ড্রিয়ানা অত্যন্ত নরম গলায় আমেরিকান অ্যাক্সেন্টে টেনে টেনে বলল, ‘ইউ লুক পেল। হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
‘ক্যান আই আস্ক ইউ সামথিং?’
‘শ্যুট।’
‘তুমি কি আরশানকে ভালোবাসো?’
আন্ড্রিয়ানা চমকে গেল একটু। সাদা কপালে উড়তে থাকা সোনালি চুলের গোছা অস্থির হাতে সামলে নিয়ে বলল, ‘হি ইজ অ্যাট্রাক্টিভ, ইন্টেলিজেন্ট, ওয়েলস্পোকেন…যে কেউ ওকে পছন্দ করবে!’
‘আমি সেই পছন্দের কথা বলছি না। তোমাদের সম্পর্কের কথা জানতে চাইছি।’
‘অনেস্টলি স্পিকিং…আই ডু হ্যাভ ফিলিংস ফর হিম!’
সকাল ভয়ে…খুব ভয়ে ভয়ে করল প্রশ্নটা, ‘হোয়াট অ্যাবাউট আরশান? ডাজ হি ফিল দ্য সেম ওয়ে?’
‘নোপ, হি ডাজন্ট!’ অ্যান্ড্রিয়ানার নীল চোখে রুপালি রঙের জল ভাসল হালকা। সুন্দর দেখাল ওকে। সকাল ওই সুন্দর দুটি চোখের দিকে স্থির ভাবে চেয়ে থেকে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘তোমরা কি কখনো একসাথে রাত কাটিয়েছ?’
‘হি নেভার স্লেপ্ট উইদ মি। নেভার কিসড মি!…ইউ আর আ লাকি গার্ল! আই এনভি ইউ।’
সকালের চোখের কার্নিশে থমকে থাকা জলের ফোঁটা টপ করে গড়িয়ে পড়ল গালে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে হলো যেন অনেকক্ষণ পর বিকল হৃৎপিণ্ডটা সচল হয়ে উঠল।