১৫
একটি মায়াবী চোখের চৌশিঙা হরিণ যখন ওক গাছের নিচে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো, ঠিক তখনই শেহজাদি সকাল আর বিন্দুবাসিনী বুনো গাছের ঝোপ ঝালর ডিঙিয়ে রাজ্যে প্রবেশ করল। নীল রঙের এক জোড়া ব্লু জে পাখি টিউ টিউ সুর তুলে ওদের মাথার ওপর দিয়ে ডানা ঝাপটে উড়াল দিল দূরের বনে। সূর্য সবেমাত্র উঁকি দিয়েছে পূর্বাকাশে। ভোরের সুষমা মাখা পবিত্র আসমানে নিরুদ্দেশ উড়ে বেড়াচ্ছে আলতা পরা মেঘের দল। রঙিন পাতার ফাঁক গেলে স্বর্ণালী আলোক রশ্মি তেরছা ভাবে নেমে এসে ছুঁয়ে দিয়েছে হরিণডাঙার মাটি। গাছে গাছে ঘুম ভাঙানিয়া পাখিরা বেলা শুরুর গান গাইছে। ঝরা পাতা ছড়ানো ফুরফুরে হলদে বনে এদিক সেদিক খোশ মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু কাঠবিড়ালি, ববক্যাট আর কায়োটি। অক্টোবর এলেই গোটা হরিণডাঙা রঙে রঙে ছেয়ে যায়। আকাশ থেকে যৌবনের রঙিন মখমল নেমে এসে পৃথিবীকে নিবিড় আলিঙ্গন করে। প্রকৃতিতে এত লাবণ্য, এত লালিত্য বছরের অন্য কোনো সময় চোখে পড়ে না। যত দূর চোখ যায় শুধু চোখ ধাঁধানো রঙ! গাছের গায়ে গায়ে, ঝোপে ঝোপে রঙবাহারি আলপনা। চৌশিঙা হরিণটি শেহজাদির দিকে নিরীহ চোখ তুলে তাকাল। সেই মুহূর্তে কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল এরিক। ডেকে উঠল চিঁহি চিঁহি।
‘আরে…এরিক তো এখনো আছে। ওকে বিদায় করেনি তো!’
বিন্দুবাসিনী বিনম্র গলায় বলল, ‘আপনার অনুমতি ছাড়া ওকে বিদায় করার প্রশ্নই আসে না, শেহজাদি!’
সকাল ছুটে গেল এরিকের কাছে। ওর নরম কেশরঅলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পরম স্নেহের সাথে বলল, ‘হ্যালো, এরিক। কেমন আছ তুমি?’
আরশান ছাউনির পাশে শুকনো পাতার লাল গালিচায় বসে হ্যামার আর স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে একটা কাঠের টেবিলের পায়া মেরামত করছিল। টেবিলটা অনেকদিন হলো অবহেলায় পড়ে আছে। আজ ভোররাতে ঘুম ছুটে যাবার পর থেকেই কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কী করবে? ছবি আঁকতে ইচ্ছে করছে না। প্রজেক্টের কাজে হাত দেওয়ার মতো মানসিক স্থিরতা নেই। ভোর ছটার সময় এক পাক দৌড়ে এলো। টের পেলো শরীর অসম্ভব দুর্বল, হাতে পায়ে অবসাদ। ইচ্ছের বিরুদ্ধে ব্রেকফাস্ট করল। তারপর জঙ্গলে এসে আর কাজ না পেয়ে বসে পড়ল পুরনো টেবিল মেরামতের কাজে। একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর ওর কাজে বিঘ্ন ঘটালো। চোখ মেলে দেখল লাল সালওয়ার কামিজ পরা সকালকে। মাথায় ওড়নাটা জড়ানো আলতোভাবে। কপালজুড়ে নেচে বেড়াচ্ছে কয়েক গাছি চূর্ণকুন্তল। নাকের ভাঁজে আর সুচালো চিবুকে খেলছে নরম রোদের ঝিকিমিকি। পাতার গালিচার ওপর আনমনে স্খলিতপদে এগিয়ে এসে ওক গাছের ডালে বাঁধা হ্যামকে বসল সে। স্বপ্নাতুর দুটি চোখ মেলে তাকাল আকাশের দিকে। এ কান-ও কান হাসিতে প্রসারিত হলো ঠোঁট। টোল পড়ল গালে। আরশানের ছন্নছাড়া, ফেরারি হৃদয় মুহূর্তের মাঝে গ্রেপ্তার হলো ওই অনিন্দ্য সুন্দর টোল পড়া হাসির স্বর্গীয় হাতকড়ায়। নিষ্প্রভ চোখের তারা জীবিত হয়ে উঠল। বদলে গেল পৃথিবী। চোখের সামনে যেন খুলে গেল থিয়েটারের পর্দা, উদ্ভাসিত হলো মোহমত্ত এক বিশুদ্ধ দ্যুতিমান ভোর। অক্টোবরের অলৌকিক সব সৌন্দর্য, পায়রার ডানা ঝাপটানোর শব্দে ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে এলো ওর বুকের মধ্যে। মদিরদৃষ্টি দুটি চোখ মেলে নির্নিমেষ চেয়ে রইল সে দৃশ্যটার দিকে। অনেক নিষ্ক্রিয় অবসরে চুপ করে বসে ভেবেছে সকালের মধ্যে কী এমন বিশেষত্ব আছে যা অন্য কোনো মেয়ের মধ্যে নেই? কেন ওকে এত ভালো লাগে? ভালো লাগার হাজারটা কারণ খুঁজে পেলেও মূল কারণটা যেন ধোঁয়াশাতেই রয়ে যায় সব সময়। প্রস্ফুটিত হয় না। আজ মনে হচ্ছে সকালকে ভালো লাগে কারণ ওর নামের মতো, প্রত্যুষের আলোরই মতো স্নিগ্ধ আর পবিত্র ওর সমস্ত সত্তা!
‘কেমন আছেন?’ আচমকা ছুটে আসা প্রশ্নটায় ঘোর ভাঙল। চোখ নামিয়ে নিলো আরশান। উত্তর না দিয়ে কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল। সকালের বেশ শীত করছিল। বেরোনোর সময় তাড়াহুড়োয় গরম কাপড় সঙ্গে নেওয়া হয়নি। মা ঘুমোচ্ছেন। নাবিলাকে মায়ের পাশে পাহারাদার হিসেবে বসিয়ে রেখে এসেছে। জেগে উঠলেই যেন ফোন করে সতর্ক করে দেয়।
‘এই যে, শুনছেন?’ আরেকবার ডাকল সকাল।
আরশান নিরুত্তর। সকাল ভেঙচি কেটে বিন্দুবাসিনীকে বলল, ‘ভাব দেখাচ্ছে এখন বিরক্তিকর ছেলেটা।’
আরশান নিবিষ্ট মনে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকছে চেয়ারের গায়ে। একটা বাদামি চামড়ার রোগা শেয়াল ঝোপের আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখছিল ওকে। দেখছিল সকালও…আচ্ছন্ন চোখে! দেখছিল হাফস্লিভ ব্ল্যাক টিশার্ট, গালভরতি অবহেলার খোঁচা দাড়ি, ছিপছিপে সবল চেহারা, নাকউঁচু অহংকারী মুখভঙ্গি…চওড়া কাঁধ…নিটোল পেশি। দেখতে দেখতে নিশ্বাসে কম্পন টের পেলো সে। ঘন শ্বাস পড়ল। রাগে, শোকে, সুখে, দুঃখে… সর্বাবস্থায় এই মানুষকে দেখতে তার ভালো লাগে। এর প্রতি এক দুর্বার অতল গভীর আকর্ষণ অনুক্ষণ তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নেশার মতো বাজতে থাকে। সব কথা সব সময় বলা হয় না। সব কথা বলা যায় না। না বলা কথাগুলো ভালোবাসা নামক বাহনে আরোহণ করে কখনো কি গন্তব্যে ঠিকঠাক পৌঁছবে না? এই পথে এত বাধা কেন আসে? কোত্থেকে আসে?
বিন্দুবাসিনী শাড়ির আঁচল সামলে বসল পাশে। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘উনি মনে হয় আপনার ওপর রেগে আছেন কোনো কারণে।’
‘উনার কাজই হচ্ছে রেগে থাকা। এই একটা কাজে উনি খুব পারদর্শী।’
বিড়বিড় করতে শুনে ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল আরশান। সকাল হ্যামকে শুয়ে আছে। ওর ঠিক মাথার ওপরেই ওক গাছের লালচে পাতার সুনিবিড় ছাউনি। ডালে ডালে দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে কমলা রঙের স্কারলেট ট্যানেজার। লাল ঝুঁটি কাঠঠোকরা গাছের গুঁড়িতে বসে ঠুকঠুক শব্দে কাঠ ঠুকরে যাচ্ছে। মসৃণ নীল আকাশের বুক চিরে নেমে এসেছে সোনা গলানো নরম রোদ্দুর। চিকচিক করে ঝিকোচ্ছে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে। সেই রোদ্দুরের রেশ পড়ছে শেহজাদির গালে, ঠোঁটে আর চিবুকে। একটা শুকনো পাতা উতলা বাতাসে উড়ে এসে বসেছে ওর ঘন কালো সিল্কি চুলে।
‘এসব কেন করছেন? আপনি কি কাঠমিস্ত্রি? আমি তো জানতাম আপনি আর্কিটেক্ট।’
আরশান অদ্ভুত মুখভঙ্গি করল যেন এরূপ বিচিত্র কথা সে আগে কখনো শোনেনি।
‘কাঠমিস্ত্রি হতে যাব কেন?”
‘তাহলে কাঠের টেবিল মেরামত করছেন কেন?’ আরশান গম্ভীর গলায় বলল, ‘এ দেশে সবকিছু নিজের হাতেই করতে হয়।
‘কে বলেছে? আমার মামার বাসায় গেলাম নিউইয়র্কে। বাড়িতে পার্ট টাইম কাজের লোক আছে।’
‘বাড়িতে কাজের লোক রাখার মতো শৌখিন জীবনের প্রতি আমার আগ্রহ নেই। সামর্থ্যও নেই। আমি নিজের কাজ নিজে করতে ভালোবাসি।
‘শুনলাম আপনি নাবিলা আর ফাহাদের ইউরোপ ট্রিপ স্পনসর করছেন।’
প্রত্যুত্তরে ছোটো করে ‘হুম’ বলল আরশান। অনেক চেষ্টা করেও স্বাভাবিক হতে পারছে না। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, অপমান এবং সন্দেহের প্রাবল্যে বুকটা এখনো ভার হয়ে আছে। তানভীরের বলা কথাগুলো এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি বিগত কদিন যাবত।
‘আপনার হাতে কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘আপনি কি আমার সাথে কথা না বলার প্রতিজ্ঞা করেছেন?’
আরশান হাতের কাজ থামিয়ে ধারালো নেত্রে তাকাল। ঠোঁট টিপে ভাবল কী যেন। বিন্দুবাসিনী হঠাৎ বলল, ‘উনি সত্যি রেগে আছেন খুব।’
‘তাই তো দেখছি।
আরশান বিরক্ত হলো। ‘আপনার ইমাজিনারি ফ্রেন্ড… কী যেন নাম…সে কি এখানেই আছে?’
‘হ্যাঁ। আমার পাশে বসে আছে।’
আরশান চোখ ফেলল সকালের পার্শ্ববর্তী শূন্য স্থানটির দিকে। কয়েকটা শুকনো পাতা ছাড়া কিছুই নজরে এলো না।
‘ক্যান উই গেট সাম প্রাইভেসি? আপনার ফ্রেন্ডকে একটু যেতে বলবেন?’
সকাল নিভল। যেন বিন্দুবাসিনী সত্যিই তার রক্ত- মাংসের বাস্তবিক বন্ধু। তাকে বিদায় করে দেওয়াটা বুঝি ভদ্রতাসূচক কোনো আচরণ নয়। নিরুপায় হয়ে বিরস গলায় বলল, ‘বিন্দু, তুমি এখন যাও।’
‘গেছে?’ প্রশ্ন করে আরশান। সে চায় না সকালের চেতন অবচেতনের কোন পর্যায়েই এই মুহূর্তে তৃতীয় কোনো কাল্পনিক বা বাস্তবিক ব্যক্তিসত্তার উপস্থিতি বিরাজ করুক।
‘হুম,’ উত্তর দিল সকাল। হ্যামকে দোল খেতে খেতে।
আরশান আড়চোখে দেখলো। বিদ্রূপপূর্ণ গলায় বলল, ‘এত নড়াচড়া করলে হ্যামক ব্রেক ডাউন করবে।’
‘মানে কী? আপনি বলতে চাইছেন আমি এতই মোটা যে আমার ভার সইতে না পেরে হ্যামকটাই পড়ে যাবে?’
আরশান ফাটল ধরা কাঠের গায়ে উডঙ্গু লাগাচ্ছিল। বিরস গলায় বলল, ‘হুম, সেটাই মনে হচ্ছে।’
‘কী?’ উঠে বসল সকাল। নাকের পাটা ফুলে উঠল রাগে, ‘কী বললেন আপনি?
‘যা বলার একবারই বলেছি।’
সকাল এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে থ হয়ে গেল। অপমানের নিষ্ঠুর আক্রমণে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। রাগে অন্ধকার হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি। এক সময় গর্জে উঠে বলল, ‘আমি একটুও মোটা না। আমি ফিট। তানভীর বলেছে একদম পারফেক্ট আছি।’
আরশান নত মস্তকে কাজ করতে করতে উপহাসের হাসি হাসল। ‘আপনার তানভীরের হয় মাথা খারাপ, নইলে চোখ খারাপ।
‘ওর মাথা ঠিক আছে, চোখও ঠিক আছে। আপনারই সব কিছু আওলায় গেছে। গন কেস একটা!’
‘পারফেক্ট বলতে সে কী বুঝিয়েছে? কোনদিক দিয়ে পারফেক্ট আপনি?’ ধারালো ছুরি দিয়ে যেন কেটে কেটে কথাগুলো বলল আরশান। সকালের নরম নরম ফর্সা দুটি গাল রাগে লাল হয়ে উঠেছিল। চোখে চাপা তেজের ঝিলিক। সে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিল, ‘সবদিক দিয়েই পারফেক্ট। আমার চেহারা, ফিজিক, ক্যারিয়ার…এভ্রিথিং!’
আরশান মুখে স্বভাবসুলভ নাকউঁচু হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘বেশ তো! এর মানে আপনাদের প্রেম জমে গেছে। সেই বেচারা আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বলেই আপনাকে স্বর্গের অপ্সরা মনে করেছে। প্রেমের ঘোর ভাঙলে রিয়েলিটি দেখতে পাবে।’
ওই হামবড়া, অহংকারী হাসি মনের মধ্যে তুষের আগুন ধরিয়ে দিল। সকাল ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘প্রেমের ঘোর কখনোই ভাঙবে না। আর বেচারা বলছেন কেন ওকে? সে মোটেই বেচারা নয়। পাত্র হিসেবে এ গ্রেড। কত বড়ো ডাক্তার, আপনার কোনো আইডিয়া আছে?’
একটা ম্যাচের কাঠি খসখস করে ঘষা খেলো বুকে। বারুদের ধোঁয়া উঠল হাওয়ায়। কিন্তু আগুনটা জ্বলতে দিল না আরশান। দাঁতে দাঁত চেপে হজম করল রাগটা। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে।
‘সে কত বড়ো ডাক্তার বা কত বড়ো জোকার সে সম্পর্কে জানার কোনো আগ্রহ নেই আমার।’
‘জোকার তো নয়ই, বরং অনেক হ্যান্ডসাম। দেখতে চান?’
সকাল এগিয়ে এলো কয়েক পা। দাঁড়ালো মুখোমুখি। সেলফোনটা ওর চোখের সামনে মেলে ধরল। আরশান তাকাল। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল ছোটো একটা শব্দ, ‘হুম।’
‘সুন্দর না?’
আরশান মুখ বাঁকাল তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। গলায় নির্বিকারত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল, ‘এর গালে দাগ কীসের?’
‘বাৰ্থ মার্ক।’
‘বার্থ মার্ক না। কেটে ছিঁড়ে গেছে মনে হচ্ছে।’
‘কেটে যায়নি। এটা জন্মদাগ। একই রকম স্কার ও পিঠেও আছে।’
‘তাই?’ আরশানের কণ্ঠস্বর পালটে গেল চকিতে।
‘হ্যাঁ, তাই।’
‘আপনি কী করে জানলেন?’
সকাল আড়চোখে তাকাল। আরশানের মুখে এখন তেজের দাপাদাপি। ঠোঁটের কোণে থমথমে কাঠিন্য। চোখে খেলছে বিদ্যুতের ঝংকার। হাসিটা উধাও। মনে মনে হাসল সকাল। ওর ঈর্ষাটা কিন্তু দারুণ লাগে! এবার তুমিও একটু জ্বলো মশাই। সকাল একাই কেন জ্বলবে?
‘জানি!’ উদাস শোনায় সকালের গলা।
‘কীভাবে?’
‘কীভাবে আবার?’
‘সে বলেছে আপনি পারফেক্ট, পারফেক্ট ইন এভ্রি ওয়ে, সে আপনার ফিগার নিয়ে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে। আপনি জানেন তার কোথায় কোথায় বার্থ মার্ক আছে। হাও ফার হ্যাভ ইউ গন উইদ হিম?’ আগুনঝরা কণ্ঠস্বরটা সকালকে একটু চমকে দিল। একদফা লাফিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ড। ভয় লাগল এই মুহূর্তে ওর চোখে চোখে তাকাতে। উত্তর দিতে পারল না সে। ঘুরে দাঁড়ালো। আরশান পেছন থেকে ওর বাহু খামচে ধরল। মুখোমুখি টেনে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘ডিড ইউ স্লিপ উইদ হিম? অ্যানসার মি।’
খুব খারাপ লাগল প্রশ্নটা। এত বেশি খারাপ লাগল যে সকাল বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। থমকানো চোখে চেয়ে রইল শুধু। কিছু বলতে পারল না। কোথাও জনমানুষের কোলাহল নেই। হাওয়ার তোড়ে সরসর শব্দে শুকনো পাতা উড়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। ধারে কাছে থপ থপ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে কোনো বন্য প্রাণী। একটা ঘুঘু ডাকছে অলস স্বরে। বাতাসে উড়ছে সকালের খোলা চুল। চন্দন রঙের স্নিগ্ধ মুখে ছড়িয়ে আছে রোদ্দুরের স্বর্ণকুচি। এই মেয়েটা আরশানকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। সে চাইলেই উদ্দাম অদম্য আকর্ষণের টানে গা ভাসিয়ে দিতে পারে। ছিনিয়ে নিতে পারে ভালো লাগার সম্ভার। কিন্তু বিবেকের চোখ রাঙ্গানিকে উপেক্ষা করা যায় না। যে মেয়েটি দুদিন পর অন্য পুরুষের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবে, সংসার করবে, সেই মেয়ে কোনোভাবেই তার নিজস্ব হতে পারে না! রক্তক্ষরা বঞ্চিত হৃদয় নিয়ে আরশান আজ দারুণ ভাবে উপলব্ধি করে, পৃথিবীতে বিবেকনিষ্ঠ এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকাটাই বোধহয় সবচাইতে কঠিন কাজ।
‘আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না, এটা কি আমার ব্যর্থতা?’ অনেকটা সময় পরে কাঁপা কণ্ঠে কথাটা বলতে পারল সকাল।
‘না…ব্যর্থতা আমার। আমি বারবার আপনাকে বিশ্বাস করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি।’
কথাটা শেলের মতো বিধল বুকে। চিলিক দিয়ে উঠল যন্ত্রণা।
‘আমি কখনও আপনাকে মিথ্যে বলিনি। আগে যা বলেছি, এখন যা বলছি এর কোন অংশই মিথ্যে নয়।’
‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। শুয়েছেন ওর সাথে? ঘেন্নায় মুখ বাঁকায় সকাল, ‘এমন একটা প্রশ্ন আপনি আমাকে করতে পারলেন? ছিহ্!’
‘তাহলে দুজন দুজনের সম্পর্কে এতকিছু জানেন কী করে?’
‘বন্ধু হয়েও অনেক কিছু জানা যায়।’
‘ইউ আর সাচ অ্যা হিপোক্রেট! দুইদিন পর ছেলেটার সাথে আপনার বিয়ে হতে যাচ্ছে আর এখন বলছেন সে আপনার বন্ধু!’
সকালের মাথাটা ঘোলাটে লাগে। ভেতরটায় ভাঙচুর হয়।
.
অনেক খুঁজে খুঁজেও বলার মতো যুতসই শব্দ খুঁজে পায় না। অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে, থেমে থেমে বলে, ‘বিয়েটা করতেই হচ্ছে। আর কোনো উপায় নেই আমার। বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি কখনোই আমাকে বোঝেন না।’
‘ব্যাপারটা হয়তো এমন যে আপনি বিয়ে করবেন একজনকে, ভালোবাসবেন আরেকজনকে। কিংবা একই সাথে একাধিক মানুষকে। এই ধরনের অনুভূতির সাথে আসলে আমি পরিচিত নই। অ্যাকচুয়েলি ইউ আর রাইট। আই উইল নেভার আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ।’
সকাল প্রলাপ বকার মতো এলোমেলো গলায় বলল, ‘আমি শুধু একজনকেই চেয়েছিলাম। শুধু একজনকে। আর সেই একজন কে, কী তার পরিচয় তা আপনি ভালোমতোই জানেন।
আরশান অধৈর্য হয়ে ওঠে। ‘আপনি প্লিজ চলে যান। এসব হিপোক্রেসি আর সহ্য হচ্ছে না। আর আপনার তানভীর যেন কখনো আমার চোখের সামনে এসে না দাঁড়ায়। আমার হাতে ওর খুন হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।’
সেলফোনটা বেজে ওঠে সেই সময়। নাবিলার ফোন। নার্ভাস ভাবে ফোনটা রিসিভ করে সকাল।
‘হ্যালো।’
‘আন্টি উঠে গেছেন। চলে আয় এখুনি।’
সকাল ফোনের লাইন কেটে দিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, ‘আমি যাই।’
আরশান বাধা দিল না। নীরবে সরে দাঁড়ালো ওর সামনে থেকে। সকাল এগিয়ে গিয়েছিল কয়েক পা। হঠাৎ ডাকটা ছুটে এলো পেছন থেকে, ‘শুনুন।
সকাল ঘুরে তাকাল। ‘বলুন।’
আরশান পাতার গালিচার ওপর বসে পড়ে টেবিল মেরামতের কাজে লেগে পড়ে বলল, ‘আপনি এতদিন আমাকে সব সত্য কথা বলেছেন, মিথ্যে আশ্বাস দেননি এটার প্রমাণ দিতে পারবেন?’
‘কী প্রমাণ চাই আপনার?’ সকাল বিস্মিত।
‘আজ রাতে বেজমেন্টে আসবেন। যদি সাহস থাকে।’ কথাটার নিগুঢ় অর্থ সহজেই উন্মোচিত হলো না সকালের এলোমেলো অবশ মস্তিষ্কে। কিছুক্ষণ থম ধরে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ এক অনির্বচনীয় সংকোচ এবং লাঞ্ছনার বিষাক্ত ছোবলে মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শিউরে উঠল। ক্রোধ ঝলসে উঠল চোখে।
‘এখন আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে?
‘যা বলার একবারই বলেছি।’
‘আপনি একটা ফালতু।’
‘জানি।’
‘আসলে আপনার মতলব খারাপ। সব পুরুষই একই রকম। কামুক আর লোভী।’
‘আপনিই তো বললেন আপনি আমাকে চেয়েছিলেন। বলেননি?’
‘চেয়েছি। কিন্তু এভাবে তো নয়!’
‘কীভাবে চেয়েছেন? বিয়েশাদি, বাচ্চা কাচ্চা, সামাজিক স্বীকৃতি। প্রকৃত ভালোবাসায় এসব না থাকলেও চলে। অ্যান্ড্রিয়ানাও তো আমাকে ভালোবাসে। ও তো কখনো বিয়ে করতে চায়নি।
‘এই কথাটা কেন বললেন?’
‘প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে বলেই বললাম।’
‘বিয়ে করতে চায় না কিন্তু লিভ টুগেদার করতে চায়, তাই তো?’
আরশান চুপ করে রইল।
‘কীসের সম্পর্ক ওর সাথে আপনার? সারাক্ষণ আপনার পিছে পিছে ঘুরঘুর করে কেন? আর কোনো কাজ নাই ওই মেয়ের?’
‘নান অফ ইয়োর বিজনেস। এক্সট্রিমলি পারসোনাল।’
সকাল দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘বেশ তো ওসব বাজে মেয়েদের সাথেই থাকেন আপনি। আমি অত সস্তা নই।’