সেদিন অক্টোবর – ১২

১২

সন্ধের মুখে মুখে অতিথিরা আসা শুরু করল। নেইবার হুডের স্ট্রিট পার্কিং ভরে গেল খুব দ্রুত। কেউ কেউ গাড়ি রাখার জায়গা পেল না। রাস্তার ওপারের শপিং মলে গাড়ি পার্ক করে রেখে হেঁটে হেঁটে বিয়ে বাড়িতে এলো। এর মাঝে কয়েকটা ফ্যামিলি, যেখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কিংবা ছোটো শিশু বিদ্যমান, তাদেরকে আরশান গাড়ি নিয়ে পিক করল শপিং মল থেকে। মেয়েদের পক্ষে ভারী শাড়ি গয়না, হিল জুতো পরে বেশিক্ষণ হাঁটা সম্ভব না। অতএব তাদের জন্যেও গাড়ি আবশ্যক। ভার্জিনিয়ার বাঙালি কমিউনিটি বেশ বিস্তৃত। সবার সাথে সুসম্পর্ক আছে এমন নয়, তবে বিয়েশাদির ক্ষেত্রে একই গণ্ডির সবাইকেই ভদ্রতা রক্ষার্থে নিমন্ত্রণ করতে হয়। তাই অতিথির তালিকা বড়ো হয়ে গেছে। ব্যাক-ইয়ার্ডেও কয়েকটা টেবিল পেতে অভ্যাগতদের সমাদরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো লনের সর্বত্র খেলছিল স্ট্রিং লাইটের মায়াবী আলো। গোল গোল টেবিলগুলো এর মাঝেই অতিথিরা দখল করে ফেলেছে। সাদা, নীল আর গোলাপি ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চটি এখনো ফাঁকা। বর-বধূ আসেনি। একটি ব্যান্ড দল কর্নারে দাঁড়িয়ে মৃদু ভলিউমে বাজনা বাজাচ্ছে। খাবারের মেনু ইন্ডিয়ান। আমেরিকায় জন্মানো বর্তমান প্রজন্মের বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েরা ঝাল মশলাযুক্ত বাঙালি খাবার খেতে পারে না। ইন্ডিয়ান রান্নায় মশলার আধিক্য থাকলেও মরিচের ঝাঁঝ কম। সব আইটেমেই প্রচ্ছন্ন মিষ্টি স্বাদ থাকে। শ্বেতাঙ্গদের কাছেও তাই ইন্ডিয়ান কুইজিন সর্বদা গ্রহণযোগ্য। 

বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে অ্যান্ড্রিয়ানা এবং রবার্ট ছাড়া অন্য কাউকেই নিমন্ত্রণ করেনি আরশান। এই দুজন ফাহাদের সুপরিচিত বলেই সামাজিকতা রক্ষা করা হলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাড়ির বড়ো ছেলে হিসেবে আরশান মনোযোগ সহকারে অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধানের চেষ্টা করছে। এই চেষ্টায় কোনো চাতুরী নেই। অতিথিদের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। আপ্যায়ন করছে। এই ছেলে যখন স্বাভাবিক সভ্য এবং বিবেচক মানুষ হয়ে ওঠে তখন হরেক মানুষের ভিড়ে তারার মতো ঝিকমিক করে। আজকে আত্মীয়মহল ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো; মুগ্ধ হলো, আপ্লুত হলো। কিন্তু সত্যটা অন্যরকম। আসলে হাজার চেষ্টা করেও সে স্থির হতে পারছিল না। মানবচক্ষুর অন্তরালে অবাধ্য মনটা বারংবার ব্রেক কষছিল। কাজ করতে গিয়ে খেই হারাচ্ছিল। ইচ্ছা-বিরুদ্ধ, অনভিপ্রেত এক উচাটন অনুভূতিতে মথিত হচ্ছিল হৃদয়। নিজের অজান্তেই মৃতপ্রায় দুটি চোখ খুঁজে যাচ্ছিল একজন বিশেষ মানুষকে। অথচ আরশান চাইছিল না তার কথা ভাবতে। মন থেকে, মস্তিষ্ক থেকে, চেতনা থেকে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেই মুখখানা তুলে ফেলার অবিরাম চেষ্টা করছিল। কতটা পেরেছিল জানে না, তবে নিজের সাথে লড়াই করার এই বীভৎস প্রক্রিয়া ক্রমেই তাকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল করে তুলছিল। তার আর কিছুই ভালো লাগছিল না। 

নাবিলা আর ফাহাদের আগমন হলো। উপস্থিত অতিথিরা উঠে দাঁড়িয়ে, হাততালি দিয়ে বরণ করে নিলো নব দম্পতিকে। ফাহাদ কালো রঙের স্যুট পরেছে। পরিচ্ছন্ন সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। উপস্থিত সবার দৃষ্টি যখন বর- বধূর দিকে নিবদ্ধ, আরশানের চোখজোড়া তখন আটকে গেল ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটি উদাস মুখের ওপর। ভরন্ত এই জনসভা ক্রমেই ছোটো হয়ে আসতে আসতে একটি মাত্র চেহারায় এসে থেমে গেল। এদিকে আরশানকে দেখেও না দেখার ভান ধরে আছে সকাল। না ধরেই বা আর উপায় কী? পাশে মা দণ্ডায়মান আছেন প্রহরীর মতো। কন্যার প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন। অবস্থা এমন জটিল যে সকালের মাঝে মাঝে নিশ্বাস নিতেও ভয় হচ্ছে। কারণ ওর প্রতিটি নিশ্বাসে আরশানের অস্তিত্ব একটু একটু করে মিশে আছে! মা সেটা টের পেয়ে গিয়ে যদি ফের রেগে যান? ফের কষ্ট পান? সেই ভয়ে সকাল এখন দাঁড়িয়ে আছে যন্ত্রের মতো। দম ফেলছে না, নড়ছে না, কিছু বলছেও না। শুধু অবাধ্য দুটি চোখের তারা না চাইতেও বারংবার ছুটে যাচ্ছে লেবু রঙের পাঞ্জাবি পরা লম্বা মানুষটার দিকে। ভিড়ের মধ্যে চারটা চোখ মিলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে আবার থেকে থেকে হারিয়েও যাচ্ছে! 

অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে অনিক। পরিবারের সব সদস্যকে একে একে ডেকে নিচ্ছে সামনে। টিলিটা এত মুখস্থ করার পরেও কথা গুলিয়ে ফেলল। কিছু পয়েন্ট মিস করে ফেলল। এর চেয়ে প্রিপারেশন না নিয়ে কথা বললেই হয়তো ফলাফল ভালো হতো। আরশান ছোটোবেলার স্মৃতিচারণ করল। কথায় কথায় বলে দিল…কেন যে বলতে গেল কে জানে! না চাইতেও বলেই ফেলল যে ফাহাদ আর টিলি ছাড়া ওর জীবনে এখন আর আপনজন বলতে কেউ নেই। পিতা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও পিতার সাথে সুসম্পর্ক নেই, সেই অত্যন্ত ব্যক্তিগত তিক্ততাপূর্ণ বিষয়টি অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। রহমান সাহেব জনসম্মুখে এমন ঘোষণার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ব্যথিত হলেন। লজ্জিত হলেন। 

কনে পক্ষের মানুষ কম। শুধুমাত্র নিজের বাবা-মা আর এক চাচা ছাড়া নাবিলার পরিবার থেকে আর কেউই আসতে পারেননি। এক খালা থাকেন টেক্সাসে। তিনি কোভিড আক্রান্ত। নাবিলার ছোটোবেলার বান্ধবী হিসেবে সকালের ডাক পড়ল। সকাল একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। একটু নার্ভাস হয়ে গেল। প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে নিয়ে দু-চারটা কথা বলা তেমন কঠিন টাস্ক নয়। এটা কোনো প্রতিযোগিতাও নয়। কেউ জাজ করতে আসবে না। করলেও সমস্যা নেই। আজকাল সে মানুষের জাজমেন্টের ধার ধারে না। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি অন্যরকম। ভিড়ের মধ্যে ওই সুন্দর চোখঅলা মিনসেটা ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাকে তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ্য করছে, এই অতি তুচ্ছ ঘটনার সত্যতা অনুধাবন করতে গিয়েই হাত পা কাঁপছে ভয়ে আর অস্বস্তিতে। কথা গুছিয়ে নিতে পারছে না। মাথায় মানসম্মত ইংরেজিও আসছে না ছাই! আরশান যদি অল্প সময়ের জন্য হলেও নিষ্কৃত হতো এখান থেকে, তাহলে হয়তো হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যেত। 

নাবিলার সাথে প্রথম দেখার দিনটির উল্লেখ করল সকাল। শোনাল ওদের বন্ধুত্বের গভীরতার কথা। হঠাৎ চোখ পড়ল সাদা শাড়ি পরা অ্যান্ড্রিয়ানার ওপর। আরশানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র মনে যেন দেশলাই কাঠির ঘষা লাগল। ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠল আগুন। খেই হারিয়ে ফেলল। কথা সংক্ষিপ্ত করে একটা খটোমটো ‘থ্যাংক ইউ’ ছুঁড়ে দিয়ে প্রস্থান করল দ্রুত। গলা শুকিয়ে কাঠ কোনোদিকে না তাকিয়ে পদব্ৰজে এগিয়ে গেল সর্ব দক্ষিণের লম্বা টেবিলটার দিকে। যেখানে খাবার সার্ভ করার প্রস্তুতি চলছে। কোথাও পানির বোতল বা ফিল্টার চোখে পড়ছে না। এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল দিশাহারার মতো। কেউ একজন চোখের সামনে একটা হাফ লিটার পানির বোতল তুলে ধরল। সকাল একটু অপ্রস্তুত ভাবে তাকাল সাহায্যকারীর দিকে। কিছু না বলেই বোতলটা হাতে নিলো। মানুষটা কাছে আসতেই বাতাসে আতরের সুগন্ধের বুদবুদ উঠেছে। কম্পিত হাতে পানির বোতলের ক্যাপ খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সকাল। আরশান বোতলটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো। ক্যাপ খুলল নিঃশব্দে। ফিরিয়ে দিল পুনরায়। সকাল চোখ তুলে চাইতে পারছিল না। এদিকে আরশান ওর মুখের ওপর থেকে চোখ সরাতেই পারছিল না। ও দেখছিল সকালের পারশিয়ান গ্রিন কালারের সার্টিন সিল্ক শাড়ি, দেখছিল নিরাভরণ কণ্ঠদেশে লেগে থাকা এমেরাল্ড স্টোনের লকেট, দেখছিল আরক্তিম মুখ আর আশ্চর্য সুন্দর নিখুঁত একজোড়া ঠোঁট! 

সকাল কয়েক ফোঁটা পানি গলায় ঢেলে নিয়ে বোতলটা ফিরিয়ে দিল। কোন ভূমিকা ছাড়াই বলল, ‘শাড়ি পরেছে কেন?’ 

আরশান অবাক। সবিস্ময়ে বলল, ‘বুঝলাম না!’ 

এদিকটায় ওয়েটাররা ছাড়া তেমন কেউ নেই এই মুহূর্তে। সবার মনোযোগ মঞ্চের দিকে। তবুও সকাল আশেপাশে একবার সচেতন ভাবে তাকাল। মা আবার কোন সময় ওকে খুঁজতে খুঁজতে সশরীরে আবির্ভূত হন, কে জানে! ভয় আর উত্তেজনায় বুকটা ধড়ফড় করছিল। কোনো রকমে বলল, ‘আপনার বান্ধবী শাড়ি পরেছে কেন? 

সকাল যে অ্যান্ড্রিয়ানাকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলছে তা এতক্ষণে বোধগম্য হলো আরশানের। অবিশ্বাসের চোখে একটু সময় চেয়ে রইল। যেন ঠিক এই প্রশ্নটা সে এই মুহূর্তে আশা করেনি। 

‘কেন? ও শাড়ি পরলে আপনার কী সমস্যা?’ 

‘আমার আবার কী সমস্যা? ওদেরকে এসবে মানায় না।’

‘আসলেই?’ 

‘আসলেই। পশ্চিমাদেরকে প্রাচ্যের বেশভূষায় মানায় না। উইয়ার্ড লাগে।’ 

‘কিন্তু অ্যান্ড্রিয়ানাকে তো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে!” 

‘ওরে বাবা!…তাই নাকি?’ ঝাঁঝ লেগে যায় সকালের কণ্ঠস্বরে। 

আরশান শ্রাগ করল। ‘আমার তো তাই মনে হচ্ছে!’ 

সকালের মনটা কেন যে এই ফালতু লোকটার ফালতু কথায় আজও অবুঝ বালিকার মতো হাহাকার করে ওঠে, জ্বলে ওঠে কাঠকয়লার মতো তা এক খোদা ছাড়া আর কেউ জানে না। নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল খুব। মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘বেশ তো! এতই যখন সুন্দর লাগছে তো ওর কাছেই যান না। এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’ 

আরশান ওর নিজস্ব কায়দায় মুখ বাঁকায়। কী যেন ভাবে ক্ষণিকের জন্য। ‘আপনি এখনো আগের মতোই আছেন। হিংসুটে!’ আলতো গলায় কথাটা ছুঁড়ে দিল আরশান। 

ফুঁসে উঠল সকাল। ‘আমি হিংসুটে?’ 

‘তা নয়তো কী? বেচারি মেয়েটা বাঙালি ঐতিহ্যকে সম্মান করে শাড়ি পরেছে। আপনার তো অ্যাপ্রিশিয়েট করা উচিত। তা না করে নিন্দা করছেন। স্ট্রেঞ্জ!’ 

সকালের মোমের মতো মসৃণ দুটি গালে আগুনের ছাপ পড়ল। ঠোঁটে লাগল কাঁপন। কী যেন একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। হারিয়ে ফেলল শব্দ। আরশান ওর কম্পিত ঠোঁটের দিকেই একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। চেয়ে থেকেই গম্ভীর ভাবে বলল, ‘এত রেগে যাচ্ছেন কেন?’ 

‘আমার ইচ্ছা।’ 

‘কেন এসেছেন? 

‘কী?’ 

‘আমেরিকায় কেন এসেছেন?” 

‘আমার ইচ্ছা।’ 

‘তানভীরকে বিয়ে করছেন কেন?’ 

সকাল চোখ সরিয়ে নিলো। ‘আমার ইচ্ছা।’ 

একটু থেমে আবার বলল ‘আপনি আমার টেক্সটের রিপ্লাই দেননি কেন?’ 

‘আমার ইচ্ছা,’ কাঠকাঠ শোনায় আরশানের গলা। 

‘আমার নম্বর ব্লক করেছেন কেন?’ 

‘হ্যাশট্যাগ আমার ইচ্ছা,’ কথাটা বলে শেষ করে ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল আরশান। চোখ সরু করে বলল, ‘হ্যাঙ্গ অন। বাই এনি চান্স আপনি কি আশা করেছিলেন যে আপনি তানভীরকে নাচতে নাচতে বিয়ে করবেন আর আমি কল ব্যাক করে, টেক্সট ব্যাক করে, হাতে-পায়ে ধরে ভিক্ষা চাইব যেন আপনি বিয়েটা না করেন। সিরিয়াসলি? এটাই আশা করেছিলেন আপনি? 

সকাল গর্জে উঠে বলল, ‘আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে এমন কিছুই করত। 

আরশান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। ‘রিডিকিউলাস! আপনি জেনে রাখুন, আমি সেইসব পুরুষের দলভুক্ত নই যারা ব্রেকআপের পর সুইসাইড অ্যাটেম্পট করে, মদ খেয়ে মাতলামো করে, কান্নাকাটি করে গার্লফ্রেন্ডের পায়ে পড়ে। আপনি যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হন তো ফাইন আই অ্যাম অ্যাবসোলিউটলি ওকে উইদ দ্যাট। গো অ্যাহেড অ্যান্ড এনজয় ইয়োর লাইফ।’ 

সকালের চোখ জ্বালা করছিল। বুকে ঘনিয়ে আসছিল তীব্র যন্ত্রণা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ভেতর থেকে উথলে ওঠা কান্নাটা আটকাতে চাইল সে। এদিকে সুস্পষ্ট বক্তব্য সঠিক স্থানে সঠিকভাবে পেশ করতে পেরে স্বস্তির একটা ঝরঝরে শ্বাস ফেলল আরশান। মঞ্চে তখন ওর ডাক পড়েছে। 

ভায়োলিন বাজানোর ডাক। কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তবে আরশান খুব একটা অপ্রস্তুতও হলো না। বেশ খোশ মেজাজেই ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাল উপস্থিত অতিথিদের। 

ও বাজিয়েছিল এড শেরানের পারফেক্ট। সেই বাজনার সাথে নেচেছিল ফাহাদ নাবিলা। আরশানের পারফরমেন্সের পর অ্যান্ড্রিয়ানা গান গেয়ে শুনালো। টিলি আর তার বন্ধুদের নৃত্য পরিবেশনে মুগ্ধ এবং উৎফুল্ল হলো নিমন্ত্রিত অতিথিগণ। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে গেল নির্বিঘ্নে। এক আকাশ ভরা নীলচে তারার নিচে, স্ট্রিং লাইটের টিমটিমে মায়াবী আলোর মাঝে, শতাধিক লোকের ফিসফিস গুঞ্জরন এবং উতরোল কোলাহলের ভিতর দিয়ে দুইজোড়া চোখের দৃষ্টি ঘনঘন ধাক্কা খাচ্ছিল একে-অপরের সাথে। অক্টোবরের হিমেল রাতের শৈত্যপূর্ণ বেষ্টনী বিদীর্ণ করে দৃষ্টির উত্তাপ ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওদের সমস্ত সত্তাকে। দৈবাৎ মুখোমুখি পড়ে যেতেই আরশান চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার? কিছু বলতে চান?’ 

সকাল কাষ্ঠ গলায় বলল, ‘জি না। কিছু বলতে চাই না।’

‘তাহলে আমাকে স্টক করছেন কেন? সেই তখন থেকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন।’ 

 ‘বাজে কথা বলবেন না। আমি মোটেও আপনাকে দেখছি না।’

আরশান ঠোঁট উলটে উদাস গলায় বলল, ‘তাহলে মনে হয় ট্যারা হয়ে গেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু দেখছেন অন্য কিছু। গ্রেট!” 

রাগে সারা শরীর রি-রি করে উঠল সকালের। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল ‘আর আপনি কী করছেন? আপনি আমার ঠোঁটের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন কেন? ফালতু একটা!’ 

আরশান নিভল। মনে পড়ল এই প্রশ্ন সকাল আগেও একবার করেছিল। বিবশ চোখে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। মৃদু গলায় স্বগতোক্তি করল, ‘প্রিয় জিনিসের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে।’ 

হই-হট্টগোলের মাঝে ওর চাপা স্বরে বলা কথাটা সকালের কর্ণকুহরে প্রবেশের আগেই যাত্রাপথে মৃত্যু বরণ করল। কান খাঁড়া করল সে। ‘কী?’ 

আরশান বড়ো একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ড্যামকেয়ার ভাবে বলল, ‘লিপস্টিকের কালারটা…. 

‘কী হয়েছে লিপস্টিকের কালার?” 

আরশান মুখ বাঁকায়। ‘ভালো না!’ 

‘ভালো না?’ চুপসে যায় সকাল। বোকা চোখে চেয়ে থাকে। আরশান আরেকবার উচ্চারণ করে শব্দটা, ‘ভালো না!” 

তারপর হেঁটে হেঁটে ভিড়ের মাঝে মিশে যায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *