সেদিন অক্টোবর – ১১

১১

নাবিলাকে সাজাতে একজন পাকিস্তানি মেকআপ আর্টিস্ট এসেছে। সাজগোজ হচ্ছে টিলির বেডরুমে। মেয়েরা দল বেঁধে কনের সাজ দেখছে। কেউ কেউ নিজেরাও সাজগোজ করছে বেডরুম পার্শ্ববর্তী ড্রেসিং রুমে। টিলি সাজসজ্জা নিয়ে বেশ মনোযোগী। সকালদের যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেই ঘরটিকেই নিজের সাজঘর বানিয়েছে সে। ওখানে আপাতত সবার প্রবেশ নিষেধ। অগত্যা সকাল এবং তার মা নাবিলার কাছে এসেই আশ্রয় নিয়েছে। সকাল অবশ্য ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানটায় বসে নেই। নাবিলার সাজ দেখতে ভালো লাগছিল তার। টুকটাক সাহায্যও করছিল। মতামত দিচ্ছিল। ফাহাদের মা সাংসারিক কাজের চাপে ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছেন না। এত এত অতিথি সামলানো কি চাট্টিখানি কথা? অতিথিরাও এখনো পুরোদস্তুর বাংলাদেশি রয়ে গেছে। প্রতি বেলায় ডাল ভাতের সাথে কতিপয় মুখরোচক পদ না হলে নিন্দা করার পাঁয়তারা করছে। এদের অনেকেই যথাসম্ভব সাহায্য করছে; কিন্তু মাথাটা যার, প্রকৃত ব্যথা তো সে-ই বুঝবে, তাই না? বাড়ির কর্ত্রী হয়ে তিনি তো আর অন্য লোকের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে হাত-পা ছেড়ে বসে থাকতে পারেন না। সকাল দেখছিল সবই। চাচির জন্য তার মায়াও হচ্ছিল কিঞ্চিৎ। একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারলে হয়তো তৃপ্তি পেত। কিন্তু মায়ের প্রখর দৃষ্টির সামনে পড়ে কোনো কাজই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে করা যাচ্ছে না। মা এখন পর্যন্ত চাচা-চাচির সাথে হেসে একটা কথা বলেননি। এমন ভাব ধরে আছেন যেন এ বাড়ির প্রতিটি মানুষের সাথে তাঁর প্রকাশ্য বৈরিতা বিদ্যমান। এরূপ অবস্থায় বাড়ির কাজ নিয়ে আদিখ্যেতা দেখালে মা নির্ঘাত চটে যাবেন। পারলে বলে বসবেন, ‘এত আদিখ্যেতা দেখাচ্ছ কেন, হ্যাঁ? এই বাড়ির বউ হতে চাও নাকি?’ 

এমন উৎসব মুখর পরিবেশের বদৌলতেও মন খারাপের বিশ্রী রোগটা সকালকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। পাথর হয়ে বসে ছিল বুকের ওপর। অন্তর জুড়ে বিষের জ্বালা। তার মন চাইছে…কেবলই মন চাইছে ওই মানুষটাকে একটু কাছ থেকে দেখে, কাছাকাছি চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। চোখে চোখে চেয়ে দুটো কথা বলে। এই অদম্য বাসনার উচ্ছৃঙ্খল অত্যাচারে হৃৎপিণ্ডে ঘনিয়ে আসছে ব্যথা। চোখে আসছে জল। মুখ থেকে কষ্টের চিহ্ন মুছে ফেলার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সে। কতটা সফল হচ্ছে জানে না। এমন সময়ে মায়ের সেলফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকানো মাত্র মায়ের মুখটা এ কান-ও কান হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। খুশিতে গদগদ হয়ে সকালের দিকে একবার দৃষ্টিক্ষেপ করে বললেন, ‘তানভীর ফোন করেছে!’ ফোন ধরে খুব বেশিক্ষণ কথা বললেন না মা। মিনিট না গড়াতেই সকালকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোর সাথে কথা বলবে।’ 

সকাল ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অবসাদ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘হ্যালো, তানভীর। কেমন আছ?’ 

‘ফোন ধরছিলে না কেন?” 

সকাল একটু অপ্রস্তুত ভাবে বলল, ‘ফোন…ওহ…ফোনে তো চার্জ নেই।’ 

‘চার্জ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করোনি তাই না?’ 

সকাল চুপ করে থাকে। তানভীর ঠেস মারা গলায় বলে, ‘তুমি তাহলে এখন তোমার এক্স-বয়ফ্রেন্ডের বাসায়। রাইট?’ 

সকাল এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দিল না। তার মনটা অসম্ভব রকমের খারাপ। মাথাটা পাগল পাগল। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। 

‘তুমি কি দেশে ফিরে আসবে আদৌ? 

এবার কিছু একটা না বললেই নয়। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে বলল, ‘কী আশ্চর্য! ফিরব না কেন?’ 

‘বাবা বিয়ের কার্ড প্রিন্টিং এর ব্যাপারে কথা বলছিল। তোমার কী মতামত? কার্ড ছাপিয়ে ফেলব?’ 

সকাল খা-খা করা খালি বুক নিয়ে বলল, ‘বিয়ের কার্ড? এখুনি?’ 

তানভীর শ্লেষের হাসি হাসল, ‘কেন তোমার কি ডিসিশন চেঞ্জ হবার সম্ভাবনা আছে? বিয়েটা করতে চাইছ না?” 

সকাল একটা বড়ো শ্বাস টেনে নিলো, ‘তানভীর, শোনো। এক সপ্তাহ পরেই তো আমি ফিরে আসছি। আসার পর প্ল্যান করি?’ 

.

ফোনটা রেখে মায়ের কাছে ফিরে এলো সে। কিছু বলল না। স্থাণু হয়ে বসে রইল বিছানার ওপর। নাবিলা একটা সময় বলল, ‘কী রে? তুই রেডি হস না কেন?’ 

ঘোর ভাঙা চোখ মেলে নাবিলাকে দেখল সকাল। দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেল। পেঁয়াজখসি-রঙা নেটের ওপর জরি সুতার কাজ করা চমৎকার একটা ল্যাহেঙ্গা পরেছে ও। মুক্তো খচিত কণ্ঠহার, মাথায় টায়রা। মুখে প্রসাধনীর কোনো আধিক্য নেই। ভীষণ মোলায়েম এবং স্নিগ্ধ। কী সুন্দর যে লাগছে ওকে! সকাল বিহ্বল হয়ে বলল, ‘ফাহাদ আজকে তোকে দেখে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে। 

নাবিলা ওর হাত চেপে ধরে একটু আড়ালে নিয়ে এলো। কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘পাগল তো হবা তুমি! অ্যান্ড্রিয়ানাকে দেখে!’ 

‘কেন?’ 

শাড়ি-টাড়ি পরে একদম ষোলো আনা বাঙালি সেজে এসেছে। শুধু এই নয়, পরিষ্কার বাংলায় আরশান ভাইকে বলেছে: সাদা শাড়ি পরেছি, অনলি ফর ইউ। 

‘আসলেই?’ সকাল বজ্রাহত। 

‘হ্যাঁ মানে…এরকমই কিছু একটা বলেছে।’

‘তুই ক্যামনে জানলি?’ 

‘টিলির কাছ থেকে জানলাম।’ 

সকালের কান ঝা ঝা করে উঠল। রক্তের কণায় কণায় বয়ে গেল ঝড়। মন খারাপের বিশ্রী ব্যামোটা যেন এবার গলা টিপে ধরতে চাইল। ফ্যাকাশে মুখে বলল, ‘ওই মেয়েটা কি এ বাড়িতে প্রায়ই আসে?’ 

‘আসে না আবার? ভাবগতিক দেখে মনে হয় এই জন্মে সে আরশান ভাইকে ছাড়বে না। পারলে মুসলিম হয়ে বিয়ে করে ফেলবে।’ 

সকাল আর্তস্বরে বলল, ‘কী বলছিস?’ 

‘ঠিকই বলছি। এখন ভ্যাবদার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে যাও, গিয়ে রেডি হও।’ 

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সকালের বুক চিরে। ম্লান মুখ নিয়ে নাবিলার কাছ থেকে সরে এলো। দেখল মা তাকিয়ে আছেন, সন্দিগ্ধ চোখে। সকাল সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হতে ইচ্ছে করছে না। সাজতে ইচ্ছে করছে না। সে জানে যতই সে সাজুক না কেন নীল চোখের ওই শ্বেতাঙ্গিনী তার চাইতে অনেক বেশি সুন্দর! সিঁড়িতে রহমান চাচার সাথে দেখা। 

‘কেমন আছ, মা?’ 

সকাল একটু ধাতস্থ করল নিজেকে। ‘এই তো, চাচা। আছি আলহামদুলিল্লাহ।’ 

ধুপধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওঠা নামা করছে ছেলে-মেয়েরা। সকাল রেলিং এর ধারে সরে দাঁড়ালো। রহমান সাহেব একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘ওই গাধাটার সাথে কথা হয়েছে?’ 

সকাল মুখ নিচু করল। ম্লান শোনাল তার গলা, ‘না চাচা।’ 

‘শোনো, মা, আমি জানি পৃথিবীতে যদি এমন কোনো মানুষ থেকে থাকে যার কথা আমার ওই গোঁয়ার ছেলেটা একটু হলেও গুরুত্ব দেবে, সেই মানুষটি তুমি। তুমি পারলে ওকে বুঝিয়ে বলো যে আমি তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আর সে যেন নিজের জীবনটাকে নিয়ে এরকম ছিনিমিনি না খেলে।’ 

‘জি, চাচা। আমি বলার চেষ্টা করব।’ 

‘তোমার মা কি কোনো কারণে আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন?’ 

সকাল খুব সংকোচে পড়ে গেল। মিনমিন করে বলল, ‘না না! তা কেন?” 

রহমান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, ‘তোমার বাবা চলে যাবার পর উনি খুব ভেঙে পড়েছেন। তাই না?’ 

‘ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। 

‘কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে!’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *