সেদিন অক্টোবর – ১০

১০

সকাল চুপচাপ বসে ছিল জানালার ধারে। বাইরে ঝুম দুপুর। খোলা জানালা দিয়ে জনমানুষের কোলাহল ভেসে আসছে। গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। শুধুমাত্র এই একটা ঘর বাদে বাড়ির প্রতিটি ইট কাঠ পাথরে উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে যেন। কতক্ষণ কেটেছিল জানে না সকাল। হঠাৎ মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘চললাম আমি।’ 

চমকে উঠল সকাল। মা স্যুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের মধ্যিখানে। যেন বাইরে ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে। এখনই বেরিয়ে না পড়লে ট্রেন মিস হয়ে যাবে। উন্মত্ত চোখের চাউনি। গালে কান্নার দাগ। সকাল হতভম্ব গলায় বলল, ‘মানে কী?’ 

মা চোখ মুছলেন আঁচল দিয়ে। ‘চলে যাচ্ছি। তোর বাবাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। আমার নিজের বাড়িতে থাকলে মনে হয় সে আমার পাশেই আছে। মনে হয় চুপচাপ নামাজ পড়ছে নইলে বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। এখানে আমার দম আটকে আসছে। তুই থাক। আমি বরং যাই।’ 

সকাল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল। অপরিজ্ঞাত শঙ্কায় বুক কাঁপছে তার। শিউরে উঠছে গা। এখন সে শতভাগ নিশ্চিত যে এই মানুষ আর স্বাভাবিক নেই। ইনি মানসিক বৈকল্যের শিকার। সামনে দাঁড়ানো বিকারগ্রস্ত মহিলাটি কোনো ভাবেই তার আবাল্য চেনাজানা পুরনো সেই মা নন। ইনি অন্য কেউ। 

‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’ 

‘বাংলাদেশ।’ 

হঠাৎ হিংস্র আক্রোশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। গর্জে উঠল সকাল, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বাংলাদেশ কীভাবে যাবা তুমি? উড়ে উড়ে? নাকি ফাহাদ তোমাকে গাড়ি করে সোজা বাসায় নামায় দিয়ে আসবে? তোমার ফ্লাইট আরো এক সপ্তাহ পরে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ প্লেনে করে যেতে কম করে হলেও তেইশ থেকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় লাগে। তুমি কি এসব জানো না?’ 

মা অবুঝ বালিকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল। কাঁপা গলায় বললেন, ‘চিৎকার করছিস কেন?’ 

সকাল এগিয়ে গিয়ে স্যুটকেসটা সরিয়ে রাখল এক পাশে। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি কেন এমন করছ? আমি তো আছি তোমার সাথে। বাবা যেখানেই আছে আমার বিশ্বাস সে আমাদের দেখছে। তুমি এরকম মন খারাপ করে থাকলে বাবাও কষ্ট পাবে। প্লিজ, মা! স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো।’ 

দরজায় ধাক্কা পড়ল। সকাল একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ করল নিজেকে। মায়ের চোখের জল মুছে দিল ওড়না দিয়ে যত্নের সাথে। তারপর দরজা খুলে দেখল নাবিলা দাঁড়িয়ে আছে। 

‘তুই কি ঘরের ভিতর বসে থাকার জন্য আসছিস? আজিব!’ 

সকাল হাসার চেষ্টা করল শুধু, বলল না কিছু। নাবিলা গলা বাড়িয়ে দিল ঘরের ভেতর, ‘আন্টি! আম্মা তো আপনাকে খুঁজছে সেই তখন থেকে।’ 

ছেলে-মেয়েরা জড়ো হয়েছে লিভিং রুমে। ওখানে নাচের ফাইনাল রিহার্সাল হচ্ছে। পারফর্মাররা ছাড়াও আরও জনা দশেক ছেলে-মেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে সাতশো স্কয়ারফিটের লম্বাটে ঘরটায়। নাচনেঅলারা প্রত্যেকেই টিলির বন্ধু। আর দর্শক সারিতে কাজিনদের সংখ্যা বেশি। এই ঘরের দুটো দরজা। একটি ডাইনিংয়ের সাথে, অপরটি বেজমেন্ট যাবার করিডোরের সাথে লাগোয়া। সকাল যখন ডাইনিং পার হয়ে লিভিংয়ে এসে দাঁড়ালো, ঠিক সেই সময় আরশানও উপস্থিত হলো বিপরীত দিকের দরজায়। চোখে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হলো দুজনে। চমকে গেল… থমকে গেল… চোখ সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। মা পাশে এসে দাঁড়াতেই সকাল ব্যতিব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। হাত পা কাঁপছে। হৃৎপিণ্ড মথিত হচ্ছে অবিদিত যন্ত্রণায়। মনে হচ্ছে এখানে আসাটা অনেক বড়োসড়ো ভুল হয়ে গেছে। এত কাছে থেকেও যে একটা মানুষের বিরহে এমন জ্বলে পুড়ে খাক হওয়া যায়, সকাল তা আগে কখনো জানত না। মানুষটাকে শুধু এক নজর দেখবার জন্যই তো এসেছিল এখানে, কিন্তু দেখে দেখে তো আঁশ মেটে না। বুকের আগুনেও ঠান্ডা জল পড়ে না। এই আগুন কখনো নিভবার নয়। এই দহন চিরায়ত। এমনই দুর্মোচ্য, অতৃপ্ত নারকীয় যন্ত্রণায় আজন্ম দগ্ধ হবে দেহ-মন- আত্মা! 

.

সকালের আচমকা প্রস্থান একটা নাড়া দিয়ে গেল বুকে। চোখে চোখ পড়ামাত্র এভাবে চলে যাওয়ার মানে কী? এ তো দ্ব্যর্থহীন এক প্রত্যক্ষ অপমান! রাগে দপদপ করছিল মাথার রগ। প্রতিশোধের লেলিহান আগুনে পুড়ছিল হৃদয়। মন চাইছিল এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, দূরে…বহুদূরে। একজন প্রবঞ্চক, শঠ, ফক্কর মেয়েমানুষের জন্য জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। কেন ভাই একটা মানুষকে দেখা মাত্রই তোমার লেজ তুলে পালাতে হবে? সেই মানুষ কি চিবিয়ে খাবে তোমাকে? নিজেকে তুমি কী ভাবো মেয়ে? 

রাগ, প্রতিহিংসা এবং অপমানের সাংঘাতিক সংক্রমণে ক্রমেই তার ভেতরটা দূষিত হয়ে উঠছিল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছিল চারপাশ। তবুও ছোটো ভাই-বোনের মুখের দিকে চেয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। দাঁত-মুখ খিঁচে নাচের রিহার্সাল দেখল। টিলির স্ক্রিপ্ট লেখায় সাহায্য করল। অনিকের সাথে বসে অতিথিদের সিটিং চার্ট তৈরি করল। সেই চার্ট প্রিন্ট করে ঝুলিয়ে দিল বিয়ে বাড়ির প্রবেশমুখে। বিকেলে অ্যান্ড্রিয়ানা তাকে দারুণ চমকে দিল! সাদা জামদানি শাড়ি, কপালে লাল টিপ। হাত ভরতি রেশমি চুড়ি। আরশানকে অবাক করে দিয়ে পরিষ্কার কণ্ঠস্বরে, ভাঙা বাংলায় বলল, ‘আমি জানি তুমি সাদা পছন্দ করো। কেমন লাগছে আমাকে?’ 

আরশান বিস্ময়াবিষ্ট গলায় বলল, ‘তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে!’ 

অ্যান্ড্রিয়ানা কথাটা পুরোপুরি বুঝল না। ঠোঁট উলটে ‘অসম্ভব’ শব্দটা উচ্চারণের অসম্ভব রকমের ব্যর্থ চেষ্টা করে হার মানা গলায় বলল, ‘হোয়াট ডাজ ইট মিন?’ 

আরশান হেসে ফেলল এবং হঠাৎ করেই আবিষ্কার করল বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা অন্ধ বিভীষণ রাগের তেজ অনেক খানি কমে গেছে। অ্যান্ড্রি আসাতে ভালোই হলো। সকাল দেখুক পৃথিবীতে এখনো আরশানের প্রকৃত বন্ধুরা টিকে আছে। তারা সকালের মতো ঠক, জোচ্চোর এবং প্রতারক নয়। তারা মানুষকে ভালোবাসতে পারে সত্যিকার অর্থে, নিঃস্বার্থ ভাবে। সকাল আরো দেখুক যে আরশান ফেলনা নয়, একা নয়, 

এমনকি সকালের বিরহে বিন্দুমাত্র কাতরও নয়! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *