১
শুকনো পাতার লাল গালিচা মোড়া রঙিন অরণ্যের বুক চিরে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে যাচ্ছিল মেটে রঙের হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়াটা। ঘোড়সওয়ারি শক্ত হাতে চেপে ধরেছে লাগাম। একটা কালো ফুলস্লিভ পুলওভার তার গায়ে। ধূসর জিন্স। ঠোঁটের কোণে খেলছে থমথমে গাম্ভীর্য আর ঘন পল্লবঘেরা মনোহর দুটি চোখে গহন বিষণ্ণতা! শাণিত বাতাসে কাঁপছে ছোটো ছাঁটের অসিত বরণ চুল।
পাকদণ্ডী পথে খুরের আঘাত হেনে, ধুলো উড়িয়ে, টগবগিয়ে ছুটতে ছুটতে হরিণডাঙায় এসে পৌঁছুল এরিক। চিঁহি চিঁহি হ্রেষাধ্বনিতে কাঁপিয়ে দিল চারপাশ। তারপর সামনের পাজোড়া শূন্যে নিক্ষেপ করে গাড়ির ব্রেক কষার মতো নিজের গতিরোধ করল। আরশান সেলফোনের পর্দায় সময়টা দেখে নিলো—ভোর ছয়টা। সময় দেখার ছলে আরো একটি বিষয় মনের অজান্তেই পরখ করল সে। ভ্রুকুটিবক্র কপাল নিয়ে দেখল সকালের নম্বর থেকে কোনো বার্তা এসেছে কি না। আসেনি। শেষ বার্তাটা গতরাতের। সকাল লিখেছে, ‘মা আজ তানভীরের বাসায় গিয়েছিল। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। আগামী মাসের পঁচিশ তারিখ।’
আরশান বার্তাটা আরেকবার পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে গেল শ্বাসনালী বেয়ে। এরিকের পিঠ থেকে নেমে ওর বাদামি রঙের রেশমি কেশরে হাত বুলিয়ে আদর করল। তারপর রাশ টেনে ধরে ঢুকিয়ে দিল কাঠের ঘরে। আকাশে চাঁপা ফুল রঙের একটা আশ্চর্য আলো সাঁতরে বেড়াচ্ছে। রঙিন পাতা ভরা ওক গাছের ঝাঁকড়া মাথায় উড়ে এসে বসেছে এক ঝাঁক কার্ডিনাল। ডাকছে টিউ টিউ শব্দে। আরো কত পাখি যে উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে হলুদ, বাদামি আর লালচে পাতার বনে! পাখিদের কলকাকলিতে মুখর চারপাশ। খর বাতাসে আরশানের পর্ণকুটিরের ছাদ কাঁপছিল থরথর করে। সোনালি রঙের শুকনো পাতা মচমচ শব্দ তুলে উড়ছে হাওয়ায়। অক্টোবরের এমনই সোনারঙা আদিগন্ত ভালোলাগার মোহিনী দিনগুলোতে সকাল এসেছিল তার জীবনে। অক্টোবরেই চলে গেল। আজকের পর থেকে আরশানের জীবনে আর কোনো অক্টোবর থাকবে না।
গত বছর জানুয়ারিতে ওদের বিয়ের তারিখ পড়েছিল। বাংলাদেশে গিয়েছিল আরশান, সকালকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসার পরিকল্পনা নিয়েই। আজীবন স্রোতের বিপরীতে ছুটতে থাকা ছন্নছাড়া, লাগামহীন, আত্মম্ভরি মনটাকে শুধুমাত্র ওই একজন মানবীর পায়ের তলায় খাঁচা বন্দি পাখির মতো সঁপে দেওয়ার দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তে বদ্ধপরিকর ছিল সে। সকাল পালটে দিয়েছিল ওকে…ওর ভেতরকার সত্তাকে, অস্তিত্বকে…সর্বোপরি গোটা জীবনটাকে পুরোদস্তুর আপসাইড- ডাউন করে দিয়ে মেয়েটা নিজেই বদলে গেল শেষমেশ! আশ্চর্য মানুষের জীবন! জীবনের কাছে আরশান হারতে চায়নি কখনো। অথচ কী এক ডাকিনী সুকৌশলে জীবন তাকে হারিয়ে দিচ্ছে বারংবার। এই হার বরণ করে নেওয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় নেই! কারণ অন্যের বিরুদ্ধে লড়তে জানলেও, নিজের বিরুদ্ধে লড়াই করার পন্থা তার জানা নেই।
অবশ্য সকালেরই বা দোষ কী? ভাগ্যাকাশের তারকা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তো বিধাতা মানুষকে দেননি। মানুষ আদতে কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, আজীবন অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়াই তার নিয়তি। বিয়ের ঠিক আগের রাতে সকালের বাবার হঠাৎ তৃতীয় বারের মতো হার্ট অ্যাটাক হলো। এবারেরটা ম্যাসিভ। হাসপাতাল অবধি যাওয়া পর্যন্ত টিকলেন না। সকালের তখন হাতভরতি মেহেদি, গায়ে কাঁচা হলুদ, সারা বাড়িতে বিয়ের সাজ-সাজ রব। এমন আনন্দঘন মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত আকস্মিক মৃত্যু সংবাদটা অভিশপ্ত কুহকী কালোজাদুর মতো পুরো পরিবারকে স্তব্ধ করে দিল। পাত্রীর বাবার মৃত্যুর পরদিন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হবে না এটা জানা কথা। আরশান নিজ উদ্যোগে বিয়ে স্থগিত করল। ভালোবাসার মানুষের এমন দুর্বিষহ বিপদের দিনে পাশে থেকে সান্ত্বনা দেবার সর্বাত্মক চেষ্টা করল। কিন্তু পিতৃবিয়োগের মতো মর্মান্তিক শোকের কোনো ক্ষতি পূরণ হয় না। আরশানের সমস্ত প্রয়াস বৃথা গেল। সকালকে কোনো উপায়েই আশ্বস্ত করা গেল না। প্রথম তিনদিন সে কারো সাথে বাক্য বিনিময় করল না। সদ্য স্বামীহারা বিধবা মায়ের সাথেও না। খাবার স্পর্শ করল না, চুলে চিরুনি বুলালো না, এমনকি গায়ে হলুদের শাড়িটা পর্যন্ত পালটালো না। প্রস্তরীভূত মূর্তির মতো স্তম্ভিত হয়ে রইল। আরশান, ফাহাদ, নাবিলাসহ অন্যান্য আত্মীয়- স্বজনরা নানা ভাবে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করল। ফলাফল শূন্য। চলন-বলন এবং শ্রবণশক্তি রহিত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বালিকার মতো স্তব্ধ হয়ে রইল সকাল। ইহলোকের সাথে যেন তার কোনো যোগ নেই। সবার অলক্ষ্যে ঘরের দরজায় খিল দিয়ে আরশান ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। শ্বাসে শ্বাস মিশিয়ে ভীষণ কোমল স্বরে বলল, ‘বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে। আমি আমার মাকে কখনো দেখিনি, তবুও মায়ের মৃত্যু সংবাদের শোক সহ্য করা আমার জন্য ইম্পসিবল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পৃথিবী তো কারো চিরস্থায়ী ঠিকানা নয় শেহজাদি! আজ আমার মা, আপনার বাবা যেখানে আছেন, সেখানে একদিন আমরাও যাব। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে আবারও দেখা হবে। সেই পুনর্মিলনির অপেক্ষায় আমাদের বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। বাঁচতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না!’ এসব কথায় শোকের উপশম হলো না বিন্দুমাত্র। তবে বক্ষপিঞ্জরে আটকে থাকা কান্নার ডেলাটা অনেক ঘণ্টা বাদে বাধ-ভাঙা ঢেউয়ের মতো অর্গল খুলে বেরিয়ে এলো। আরশানের বুকে মুখ ডুবিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল সকাল।
এদিকে আরশান আর ফাহাদের ছুটি ফুরিয়ে আসছিল দ্রুত। ফাহাদ রিমোট ওয়ার্ক করছিল, কিন্তু আরশান কিছুতেই কাজে কনসার্ট্রেট করতে পারছিল না। সকালের শুকনো ফুলের পাপড়ির মতো মিইয়ে যাওয়া মেঘাচ্ছন্ন মুখখানা অষ্টপ্রহর শেলের মতো বিঁধছিল ওর বুকে। এদিকে করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। এরমাঝেই একাধিক দেশের সাথে বাংলাদেশের বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অগত্যা পৃথিবী পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাবার আগেই নিজ স্থানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। সকাল তখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। আরশান বুঝেছিল এবার বাদবাকি কাজটা করবে ‘সময়’। সময়ের সাথে সাথে মানুষ আপনজনের মৃত্যুশোকও ভুলে যায়। তবে ঘটনা শুধু এতটুকু হলে মনে কোনো খেদ থাকত না। জন্ম-মৃত্যুর ওপর মানুষের হাত নেই। পিতৃবিয়োগের পর একমাত্র আদরের কন্যা শোক পালন করবে এই ঘটনা স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যার উৎপত্তি হলো অন্যদিকে। আত্মীয়-স্বজনরা গুঞ্জন রটাতে লাগল, এই বিয়েটা নাকি সকালের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলকর হবে না। হবে না বলেই বিয়ের ঠিক আগের দিন এমন ভয়ঙ্কর অশুভ ঘটনা ঘটল। জামাইটা বিশেষ পয়মন্ত নয়। প্রথমেই যেহেতু এত বড়ো বাধা এলো, দ্বিতীয় দফায়ও এই বিয়ে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। অপমান নাকি অভিমান জানে না আরশান, এক অবিদিত অদ্ভুত যন্ত্রণায় তার বুক ভার হয়ে উঠেছিল। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল সকালের নির্বিকারত্ব দেখে। আত্মীয়দের এসব কুসংস্কার ভরা ভ্রান্ত কটূক্তির বিরুদ্ধে সে একটা কথাও বলেনি। এমনকি ফিরে আসার দিনেও ওর নিঃস্পৃহ আচরণ নির্দয়ভাবে আঘাত করেছে মনে। যেন আরশানের থাকা না থাকায় তার কিছুই এসে যায় না। আরশান নিজেকে বুঝিয়েছে নানাভাবে। মেয়েটা মাত্র বাবা হারিয়েছে। এই ভয়ঙ্কর শোক কাটিয়ে উঠতে অল্প-বিস্তর সময় তো লাগবেই। তবুও অবাধ্য মনটা, অবুঝ অভিমানে বার বার মুষড়ে গেছে। সকাল কেন প্রতিবাদ করেনি? তবে কি তার কাছেও আরশানকে দুর্লক্ষণযুক্ত নিছক এক ঋষ্ট উপদ্রব বলে মনে হয়েছে? হতে পারে…হতেও পারে! এই ভাবনায় তেমন দোষের কিছু নেই অবশ্য। আপনজনদের হারিয়ে ফেলাই তো আরশানের নিয়তি। মাতৃহীন শৈশব, পরিবারহীন, নারী-বর্জিত তারুণ্য এবং যৌবন, তারপর জীবনের একমাত্র ভরসার মানুষ, নিজের পিতার বিশ্বাসঘাতকতা…এই সমস্ত কিছুর পেছনে হয়তো তার অপয়া, পোড়া ভাগ্যই দায়ী। নিজের সাথে বিস্তর বোঝাপড়ার পরে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। বিয়েটা শেষমেশ ভেঙে গেল। হতে পারে এই ঘটনা কোনো বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে। হয়তো তার মতো ভবঘুরে, মতিচ্ছন্ন, ছিটিয়াল লোকের সংসারী হবার বাস্তবিক কোনো যোগ্যতা নেই। হয়তো সকালের জীবনে তার উপস্থিতি সত্যিই অমঙ্গলজনক। হয়তো তার অনুপস্থিতিতেই সকাল ভালো থাকবে। কুসংস্কারে আরশানের বিশ্বাস ছিল না কখনো, এবারে টান পড়ল আত্মবিশ্বাসেও! অনেক ঠেকে ঠেকে…ভয়ে ভয়ে… খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভালোবাসতে শিখেছিল সে। যে ভালোবাসা একদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে প্রদীপ জ্বালিয়েছিল মন গহিনে, আজ সেই ভালোবাসাই সম্পূর্ণ রূপে নিঃশেষ করে দিল জীবন লিপ্সা। ছাউনির ভেতরে এসে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা ছবিগুলো উন্মুক্ত করল আরশান। আজ বিকেলে ডিসিতে একটা সলো আর্ট এক্সিবিশন আছে ওর। এতগুলো ছবি একার পক্ষে জঙ্গল পেরিয়ে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। হোজে এসে সাহায্য করার কথা ছিল। আদৌ আসবে কি না, কে জানে।
সকালের স্বপ্ন ছিল আরশানের একদিন নিজের আঁকা ছবির একক প্রদর্শনী হবে। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হবার পথে। কিন্তু সকাল নেই পাশে। থাকবে না কোনোদিন! কী আশ্চর্য! কী অবিশ্বাস্য! এই একজন মাত্র মানুষকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিল আরশান। সেই নির্জলা বিশ্বাসের যথার্থ প্রতিদান মিলল।
যন্ত্রণাময় কিছু একটা কান্নার মতো সুড়সুড়ি দিল গলায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের ওজন বাড়ল। গোটা পৃথিবীটাকে অর্থহীন বলে মনে হতে লাগল। সকালের ওই নরম কোমল নিষ্পাপ মুখটা চেতন-অবচেতনের প্রতিটি স্তর থেকে ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলতে ইচ্ছে করল। কাঁপা হাতে লাইটারে আগুন জ্বালালো সে। এসব ছবি, ছাউনি সমস্ত কিছুই পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। এরিককেও রাখবে না আর। সকালের জন্যেই তো এই দেড় বছর আগলে রেখেছিল সবকিছু। এবার সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে অন্য কোথাও পাড়ি জমাবে। যেখানে সকালের স্মৃতি মস্তিষ্কে ছোবল কাটার দুঃসাহস করবে না। ভালোই হলো। আরশান এবার বাকি জীবনটা কাটাবে ঠিক সেভাবে… যেভাবে কাটানোর কথা ছিল। আবাল্য একা থাকার অভ্যাস তার। একটা সময় বাবা ছিল, আজ দেড় বছর হলো বাবার সাথেও কোনো যোগ নেই। অতএব…তার আর কোনো পিছুটান রইল না। এবার থেকে সে মুক্ত। লাইটারের আগুনটা ছবির গায়ে না লাগলেও হৃৎপিণ্ডের শিরা-উপশিরায় মুহূর্তের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল দাউদাউ করে। ভেতর থেকে কেউ একজন হুঙ্কার ছাড়ল হঠাৎ। এভাবে হেরে গেলে চলবে না। বেঁচে থাকতে হবে। ভালো থাকতে হবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পৃথিবীর ঋণ শোধ করে যেতে হবে! সাধারণ…অতি সাধারণ এক মেয়ের বিরহে জীবন নাশ করার মতো রোমান্টিক আহাম্মক সে নয়। হাসি পাচ্ছে…একটা বিভীষণ ডাকাতিয়া হাসিতে হেসে কুটিকুটি হতে মন চাইছে। সকাল জানে না যে ওর মতো বিশ্বাসহন্ত্রী বেইমান মেয়েকে ভুলে যাওয়া আরশানের জন্য আঙুলে তুড়ি বাজাবার চেয়েও সহজ কাজ। আচ্ছা…ওর পাঠানো শেষ বার্তাটায় একটা হাহা রিঅ্যাক্ট দিলে কেমন হয়?
‘মা আজ তানভীরের বাসায় গিয়েছিলেন। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। আগামী মাসের পঁচিশ তারিখ।’
কী সাংঘাতিক! কী উইয়ার্ড! মেয়েটা নিজেকে ভাবে কী? খবর শোনামাত্র আরশান ফোন করে কান্নাকাটি করবে? ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে কাঙালের মতো প্রেম প্রার্থনা করবে? হাতের রগ কেটে সুইসাইড করবে? মদ খেয়ে মাতাল হবে?
হবে না…এসব কখনোই হবে না, সকাল! তোমাকে ভালোবেসে আমি মরে যেতে রাজি আছি, কিন্তু হেরে যেতে রাজি নই! জীবনের কোনো অপ্রাপ্তি বা প্রতিকূলতাই আমাকে ভিখিরি বানাতে পারবে না। তোমার বুকের জমিনে ঠাঁই না পেলেও পৃথিবীর জমিনে যতদিন আমার আশ্রয় আছে ততদিন আমি নিঃস্ব হবো না। আমি টিকে থাকব, বেঁচে থাকব, তোমাকে ভুলে গিয়ে তোমাকেই একদিন ঠিক ঠিক হারিয়ে দেব। দেখে নিয়ো তুমি!
লাইটারের আগুন নিভল। সেলফোন হাতে নিয়ে এলোমেলো অবিন্যস্ত আঙুলে আরশান সকালের ফোন নম্বর ব্লক করল। বেরিয়ে এলো ছাউনি থেকে। অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যাবে। আজকের পর থেকে কোনো দুর্বলতা বা অলসতার স্থান নেই জীবনে। দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় শুরু করল দৌড়। লাল গালিচার নিবিড় জঙ্গলের উঁচু-নিচু সুঁড়িপথ বেয়ে, ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে, আগাছা মাড়িয়ে, তীরের বেগে ছুটতে লাগল ওর ছয়ফিট লম্বা ঝরঝরে সুঠাম শরীর। সোনালি সূর্য-রশ্মি আকাশের নীল শামিয়ানা ভেদ করে তেরছা ভাবে লুটিয়ে পড়তে লাগল পায়ের কাছে। একজন সাইকেল আরোহী টুংটাং ঘণ্টা বাজিয়ে বুনো পথ অতিক্রম করছিল। আরশান থামলো না। সাইকেলের নাক বরাবর ছুটে গেল বন্দুকের গুলির মতো। খেপল আরোহী পেছন থেকে ভেসে এলো কর্কশ ইংরেজি গালাগাল। আরশান থামলো না। অসাবধানতাবশত কাঁটাগুল্মতে পা কেটে গেল। আরশান তবুও থামলো না। ছুটতে লাগল পাগলা ষাঁড়ের মতো। থামল মূল রাস্তায় উঠে এসে। হাঁটুতে দুহাত চেপে কিছুটা ঝুঁকে শরীর বাঁকিয়ে, বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে লাগল। হাঁপাতে লাগল। ভালো লাগছে না…কোনো এক বিচিত্র কারণে কিছুই আর ভালো লাগছে না আগের মতো করে! কেন এমন হলো? কেন তার সাথেই এমন হয়? সকালকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না! ক্ষমা করেনি নিজের জন্মদাতা পিতাকেও! ক্ষমা জিনিসটা তার ভেতর থেকে উঠে গেছে, মুছে গেছে, পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে খাক হয়ে গেছে!