সেদিনের চুম্বনের পরে
কেউ বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবে আমার হাতে এ ব্যাপারে অনেক সাক্ষী আছে।
আমার এই উদ্ভিন্ন বার্ধক্যে সেদিন এক নৈশ আসরের অবসানে প্রায় মধ্যরাতে আড্ডা থেকে বেরনোর মুখে সিঁড়িতে আমাকে আলিঙ্গন করে এক প্রমত্তা যুবতী নিবিড় ভাবে চুমু খেয়েছিল। সেই আসরে যুবজনের খুব অভাব ছিল না। নবীন প্রৌঢ়দের সংখ্যাও অনেক, তার মধ্যে প্রাচীনতম এই ব্যক্তিটিকে বরণ করে নেওয়ায় আমি অবশ্যই একই সঙ্গে আনন্দিত এবং গৌরবান্বিত বোধ করেছিলাম।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে প্রথমেই সেই চুমুর কথা মনে পড়ল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক দিন পরে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে দেখলাম। গত রজনীর চুম্বনাভিষিক্ত ঠোঁট দুটোয় আলতো করে হাত বোলালাম।
সহসা আয়নায় ছবিতে দেখি ঘরের ওপাশে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে শ্রীযুক্তা মিনতি। ওষ্ঠদ্বয় সমেত আমার সম্পূর্ণ মরদেহের এবং অমর আত্মার যিনি যদিদং হৃদয়ংয়ের সূত্রে চিরকালীন লিজগ্রহীতা।
মিনতিদেবী মৃদু হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? ঠোঁটে হাত বোলাচ্ছ কেন? কেউ ঠোঁটে কামড়ে দিয়েছে?’ আমি বললাম, ‘কামড়াবে কেন? চুমু খেয়েছে। কাল শ্রীমতী আমাকে একটা চুমু খেয়েছে।’
মিনতি বললেন, ‘একটা নয় অনেকগুলো।’
আমি বললাম, ‘সর্বনাশ।’
মিনতি বলল, ‘সর্বনাশ কেন? সিঁড়ির নীচে অন্ধকারে শ্রীমতীর বর দাঁড়িয়েছিল। আমি তাকে জাপটে ধরে বেশ কয়েকটা চুমু খেয়েছি।’
আমি বললাম, ‘চমৎকার।’
এই চমৎকার পর্বে কল্যাণীয়া দেবযানীর প্রবেশ, সে আমাদের নতুন বন্ধু কিন্তু একেক সময় এমন ভাব করে যেন জন্ম-জন্মান্তর থেকে চেনে।
গতকাল মধ্যরাতে আমাকে সিঁড়ি দিয়ে হাত ধরে নামিয়ে আনছিল, সেই সময়ে শ্রীমতী তাকে অতিক্রম করে আমাকে চুমুতে চুমুতে ছেয়ে দেয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় দেবযানী দ্রুত নীচে নেমে আসে, সেখানে এসে সে আরও তাজ্জব বনে যায়। শ্রীমতীর বরকে মিনতি বউদি অক্লেশে একের পর এক চুমু খেয়ে যাচ্ছে।
শ্ৰীমতী দেবযানী নতুন যুগের নবীনা রমণী, সে তো ভাল করে এখনও চেনে না আমাদের। অগ্নিযুগের কবি এবং কবি ঘরণীর সম্পর্কে কে আর কতটুকু জানে। তাকে বলতে পারতাম, আমাদের দু’জনকে কয়েকটা করে চুমু খাও। তা বলিনি, কারণ তার যদি চুমু খাওয়ার নেশা হয়ে যায়।
ব্যক্তিগত কথা আপাতত থাক। সাহিত্যের কথা একটু বলি।
বাংলা সাহিত্যে চুম্বনের ছোঁয়া কদাচিৎ লেগেছে। সঙ্গম বা যৌনতা অনেক ছোট বড় মাঝারি লেখক বুঝে কিংবা না বুঝে গল্পে উপন্যাসে ঢুকিয়েছেন।
কিন্তু চুম্বন কোথায়?
শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্রে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হবে। তবু রবীন্দ্রনাথ আছেন অন্তত রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। তাঁর কবিতার অর্ধপঙ্ক্তি দিয়ে এই নিবন্ধের নামকরণ। জীবনানন্দে চুম্বন নেই। তাঁর কাজ অতীন্দ্রিয়। তবে বুদ্ধদেববাবু চুম্বনের ভক্ত ছিলেন, তাঁর প্রথম যুগের কবিতায় ভালভাবেই চুম্বনের স্পর্শ আছে। আর আমাদের সুনীল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় তাঁর নায়িকা অরুন্ধতী (জীবন সর্বস্ব), সেই মেয়ের আলজিব ছোঁয়া চুম্বনের প্রগাঢ় আশ্লেষ অবিস্মরণীয়। সুনীলই ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশ্যে লিখেছিল, তোমার ওই শুকনো ঠোঁট কতদিন সেখানে চুম্বন পড়েনি। সমরেশ বসু, সমরেশ মজুমদার এবং বুদ্ধদেব গুহের কামনামদির গল্প-উপন্যাসেও চুম্বনের ছোঁয়া আছে।
মহানায়ক উত্তমকুমার একদা এক সাক্ষাৎকারে এক ছলবলে মহিলা রিপোর্টারকে নাকি বলেছিলেন, ‘আমি সবচেয়ে ভালবাসি যে দুটো জিনিস, তা হল চুমু এবং গলদা চিংড়ি।’
সাহসিকা রিপোর্টার তরুণী এর পর যোগ করেছিলেন, ‘শাবাশ! এর চেয়ে ভাল জিনিস আর কী হতে পারে?
চুম্বনপর্ব এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু দুটো গল্প না বলে উপায় নেই।
একটি তরুণ তার বান্ধবীকে বলেছিল, ‘জানো, তোমাকে না ছুঁয়ে চুমু খেতে পারি।’
বান্ধবী অবাক হয়ে বলে, ‘সেটা কী করে সম্ভব?’ ছেলেটি বলে, ‘খুবই সম্ভব। দশ টাকা বাজি রাখবে?’ মেয়েটি রাজি হল, ‘হ্যাঁ, দশ টাকা বাজি।’ সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি তাকে জাপটিয়ে ধরে চুমু খেল। মেয়েটি কোনও রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ওটা কী হল?’
ছেলেটি বলল, ‘কী আর হবে? আমি হারলাম। এই নাও বাজির দশ টাকা’ বলে পকেট থেকে একটা দশটাকার নোট বার করে মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিল।
দ্বিতীয় গল্পটি কিন্তু বেদনাময়। মিসেস সান্যাল তাঁর বরকে বললেন, ‘ওগো, সামনের ফ্ল্যাটের মিসেস ভক্তকে মিস্টার ভক্ত দৈনিক অফিস যাওয়ার আগে চুমু খেয়ে যান। তুমিও তো ও রকম করতে পারো।’
একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিড়ম্বিত কণ্ঠে মিস্টার সান্যাল বললেন, ‘তা তো পারি, কিন্তু মিসেস ভক্ত কি রাজি হবেন? শেষে একটা গোলমাল না হয়ে যায়।’
রবীন্দ্রনাথ শিরোধার্য করে এই চপল রচনা শুরু করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শেষ করি— ‘অধরের কানে যেন অধরের ভাষা, / দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে—/ গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালবাসা / তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সঙ্গমে।’