সেডার বনের হাতছানি

সেডার বনের হাতছানি

‘সব বন্দোবস্তই করে ফেলেছি বাবা, এবারে তুমি ছুটি নাও—’

‘এ্যাঁ? স—ব বন্দোবস্ত?’— চমকে উঠলেন আর্থার ম্যাকলয়েড, ‘কী বন্দোবস্ত করে এলি, শুনি? আর ছুটি? এখন কি ছুটির কথা তোলা যায়? সালতামামির সময়! উদয়াস্ত খাটুনি এখন কেরানিদের!’

‘ও সব আমি শুনব না বাবা’— এমেলিয়ার সাফ জবাব, ‘সালতামামি বলে কি মারা পড়তে হবে তোমাকে? ছুটি তোমার পাওনা আছে, শরীর তোমার চলছে না। এ অবস্থায় অফিস তোমায় দু-মাসের জন্য ছেড়ে দিতে বাধ্য। আজই দরখাস্ত দাও।’

তা বন্দোবস্ত পাকাই করে ফেলেছে এমেলিয়া। কিছুমাত্র জানতে দেয়নি মিস্টার ম্যাকলয়েডকে। জানালেই তিনি বাগড়া দিতেন। হয়েছিল টাইফয়েড। দেড় মাস ভুগে কোনোরকমে খাড়া হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু এক্ষুনি অফিসে গিয়ে ফাইল নিয়ে বসবার মতো বল তিনি পাননি। ডাক্তার বলেছে— স্কটল্যান্ডের পাহাড়ে কোনো হ্রদের ধারে গিয়ে দুটো মাস অন্তত কাটিয়ে আসতে।

কিন্তু ওই একটি কাজ, যা ম্যাকলয়েডের চিরদিন অপছন্দ। ছুটি তিনি প্রাণান্তেও নেবেন না। যাকে বলে— অফিস-অন্ত প্রাণ! না-যেতে পারলে দস্তুরমতো ছটফট করেন। সত্যের খাতিরে বলতে হয়, হেড কেরানিও তিনি নন অফিসে। কিন্তু তাঁর মনে একটি ধারণা ঢের দিন থেকেই বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, তিনি উপস্থিত না-থাকলে কোম্পানির কাজ তালগোল পাকিয়ে যাবে একদিনেই। ইদানীং এই টাইফয়েডটার দরুন কামাই যা হয়েছে, তার চারা নেই। কিন্তু তার আগে কত বছরের ভিতর যে তিনি ছুটি নেননি, চেষ্টা করলেও তার হিসাব তিনি দিতে পারবেন না।

কিন্তু, ওই একটা ব্যাপারে যদিও ম্যাকলয়েড অত্যন্ত জেদি, অন্য সব দিকেই ভদ্রলোক তাঁর এই বড়ো মেয়ে এমেলিয়ার একান্ত বাধ্য। স্ত্রী মারা গিয়েছেন বহু দিন আগে। সংসার বলতে এখন তাঁর রয়েছে ওই দু-টি মাত্র মেয়ে— এমেলিয়া আর এথেনিয়া। চব্বিশ আর বাইশ দুই বোনের বয়স। মাত্র দুই বছরের তফাত।

মাত্রই দুটো বছর। কিন্তু একদিকে এমেলিয়া যেমন জেদি আর শক্ত মানুষ, অন্যদিকে এথেনিয়ার আবার তেমনিই স্বভাবটা আশ্চর্যরকম নরম। এতই নরম যে, তাকে ইচ্ছেমতো চালিয়ে নিয়ে বেড়ানো বা তার উপরে দরকার মতো হুকুম-হাকাম চালানোর ব্যাপারে এমেলিয়া কিছুমাত্র দ্বিধা বা অসুবিধায় পড়ে না। বাস্তবিক পক্ষে, চব্বিশ বছর বয়সেই এমেলিয়া পাকা গিন্নি, আর বাইশ বছরেও এথেনিয়া রয়ে গিয়েছে কচি খুকি।

শুধু ছোটো বোন কেন, দেখতে গেলে আধবুড়ো বাপটাও এ বাড়িতে এমেলিয়ার বশংবদ প্রজামাত্র। তার অবাধ্য হওয়ার চিন্তাও কখনো স্থান পায় না তাঁর মগজে। অবশ্য প্রয়োজনও কখনো হয় না অবাধ্য হওয়ার। বড়ো মেয়ের পক্ষপুটের আশ্রয়ে তিনি যেরকম নিরাপত্তার স্বাদ পাচ্ছেন গত কয়েক বৎসর ধরে, তা শৈশবে মায়ের বা যৌবনে পত্নীর স্নেহ-যত্নের ভিতরেও কোনোদিন পাননি। সুখে-অসুখে, শীতে-গ্রীষ্মে ওই এমেলিয়াই তাঁর অটুট ভরসার স্থল।

কাজে কাজেই, এমেলিয়া যখন জেদ করল যে বাবাকে ছুটি নিতেই হবে এবং দুই মাস কাল চরে বেড়াতেই হবে লক-লোভানের কূলে কূলে ঢেউ গুনে গুনে আর থ্রাশ-নাইটিঙ্গেলের সংগীত শুনে শুনে, তখন নিরুপায় হয়েই ম্যাকলয়েড ছুটির দরখাস্ত জমা দিলেন অফিসে আর ফাইলগুলোর গায়ে গায়ে শেষ বারের মতো পরম বাৎসল্যে হাত বুলিয়ে দিয়ে নিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলেন দুই মাসের জন্য। সত্যি কথাই বলতে হয়, দুই মাস পরে ফিরে এসে ওই অফিসকে যে তিনি প্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখতে পাবেন— এ কথা তিনি আন্তরিকভাবেই অবিশ্বাস করেন।

এমেলিয়া অতঃপর লাগেজ বেঁধে, বাপ আর বোনকে বগলদাবা করে নিয়ে একদিন গিয়ে উঠল লোভান হ্রদের কূলে লোভান-ভিউ গাঁয়ের এক ছোট্ট ভিলাতে। জায়গাটার সৌন্দর্য দেখে ভাবের আবেশে এথেনিয়া বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলল একরকম। এমন যে রুটিন ভক্ত বাস্তববাদী মানুষ ম্যাকলয়েড, তিনিও সকাল-সন্ধ্যে হ্রাদের ধারে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীল জলে সাদা মেঘের ছায়া পর্যবেক্ষণে মেতে গেলেন।

আর এমেলিয়া? ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। এখানে এসেও সে সংসার নিয়েই আছে। বরং সংসারের ঝামেলা এখানে এসে বেড়েই গিয়েছে তার। শহরে একটা চব্বিশ ঘণ্টার সাহায্যকারিণী ছিল। লক-লোভানে আসতে সে কোনোমতেই রাজি হয়নি। আশা ছিল, এখানেই মিলে যাবে কাজের লোক একটা, তা এখনও যায়নি। গরিব এ জায়গায় নেই তা নয়, কিন্তু তারা থাকে দূরের গ্রাম অঞ্চলে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সময়সাপেক্ষ।

কাজেই রান্নাবান্না, ধোয়া-মোছা এমেলিয়াকেই করতে হয় সব। ছোটো বোনটাও তাতে হাত লাগাতে আসে বই কী মাঝে মাঝে। কিন্তু দিনি এমনই তাকে ধমকে ওঠে, ‘যা যা, এসব তোর কম্মো নয়। তুই দুই-একখানা বই নিয়ে হ্রদের ধারে বসে থাক গিয়ে। পরীক্ষেটা দিতে হবে তো, না-কি?’

কী একটা পরীক্ষা সত্যিই দেবার কথা আছে এথেনিয়ার সামনের বছর।

অগত্যা এথেনিয়া একা একাই হ্রদের ধারে গিয়ে বসে। বই প্রায়ই নিয়ে যায় না। এই উদাস হাওয়া, ওই নানা তানের পাখির গান ঝোপে ঝাড়ে রোদে-ভরা প্রসন্ন আকাশে, তারই সঙ্গতে সৈকতে সৈকতে ড্যাফোডিলদের নিরলস নির্তন— এ কি পড়ায় মন দেবার উপযুক্ত পরিবেশ না কি?

আলাপ পরিচয় করবার মতো প্রতিবেশী দু-চার ঘর না-আছে তা নয়, আধ মাইলের ভিতরেই কিলপ্যাট্রিকেরা রয়েছে এপাশে, ওয়েলডনেরা রয়েছে ওপাশে। এথেনিয়ার সমবয়সি মেয়ে দুই বাড়িতেই আছে, দেখা সাক্ষাৎ হয়েছেও। তবে মুশকিল বেধেছে এক জায়গায়। ওই দুটো পরিবারই দস্তুরমতো ধনী, তাদের চালচলনই আলাদারকম। এমেলিয়া বোনকে বলে দিয়েছে, ‘হ্রদের ধারে যদি দেখা হয় তবে দেখা করবি। নেমন্তন্ন না-করলে ওদের বাড়িতে যাবি না।’

তা, এ যাবৎ কোনো নেমন্তন্ন আসেনি কোনো বাড়ি থেকে। আর এ তরফ থেকে নেমন্তন্ন পাঠানো?— একেবারেই অসম্ভব! একটা ঝি পর্যন্ত নেই যে বাড়িতে, সেখানে ওইসব লক্ষপতিকে ডাকা যায় কখনো?

এথেনিয়া একা একাই বেড়িয়ে বেড়ায়। হ্রদের ধারেই যে বেড়ায় শুধু, তাও নয়। ক্রমে ক্রমে তার চারণভূমির পরিধি বেড়েই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে খুদে পাহাড় জলের কোল ঘেঁষেই। সে সব পাহাড়ের মাথায় ওঠা শক্তও নয় এমন। এথেনিয়া ওঠে মাঝে মাঝে। পাহাড় তো নয়, স্বপনপুরী এক-একটি! কত রং-বেরং বুনো ফুল! পাইন আর সেডারের বনে বনে আলো-ছায়ার কী মনোরম লুকোচুরি! মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গুহাও চোখে পড়ে। তবে তাদের ভিতর দিকটা কেমন যেন অন্ধকার। এথেনিয়া সাহস করে কখনো গুহায় দেখেনি এ যাবৎ।

ভয় অন্য কিছুর নয়। বাঘ, ভালুক, অজগর— এসব নেই এ মুলুকে। আগেকার যুগে যেসব দুরন্ত ডাকাতের আনাগোনা ছিল এদিকে, তারাও নির্মূল হয়ে গিয়েছে কবে! সে সব কিছু নয়। তবে কিনা, আঁধার গুহার ভিতরে ঢুকলে একটা হোঁচটও তো খেতে হতে পারে! পা যদি ভেঙে যায়, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোনোই তো দায় হবে এথেনিয়ার পক্ষে! ডাকের মাথায় তো মানুষ নেই কোথাও।

ওই কথাটাই হয়তো সেদিন বলেছিল অ্যালান ছোকরা, ‘একা যদি বেড়াতে হয় ইয়ং লেডি, হ্রদের ধারই ভালো! পাহাড়ে ভয়ভীত থাকতে পারে।’ অ্যালান বারো মাইল দূর থেকে রোজ আসে ঘোড়ায় চেপে। দু-দুটো ঘোড়া নিয়ে আসে। একটাতে নিজে চেপে আসে, অন্যটার পিঠে বোঝাই করে আনে দুধ, ডিম, সবজি এই সব। হ্রদের ধারে ধারে বিশ মাইল ঘুরতে পারলে চল্লিশটা বাড়ি তো অন্তত পাওয়া যায়ই! সেই সব বাড়িতে ওই সব টাটকা জিনিস জোগান দেওয়াই অ্যালানের কাজ।

এরকম জোগানদার আরও আছে এদিকে। মেলক বুড়ো আনে টাটকা রুটি, মাংস নিয়ে আসে কোলব্র&ক। তবে ওরা দু-জন বড়ো একটা কথাবার্তা বলে না খদ্দেরের সঙ্গে। মালটি মেপে দিয়ে চটপট ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে যায়। মিশুক লোক হচ্ছে ওই অ্যালান। অন্তত এথেনিয়ার সঙ্গে সে মিশতে চায় যথাসম্ভব। উপযুক্ত দূরত্ব বজায় রেখেই অবশ্য। কারণটা হয়তো এই যে, বয়স তার এথেনিয়ার মতনই হবে। দু-এক বছর বেশি বা দু-এক বছর কম।

হ্যাঁ, সেই অ্যালানই একদিন পাহাড়ের উপরে এথেনিয়াকে দেখতে পেয়ে ওই কথা বলেছিল, পাহাড়ে ভয়ভীত থাকতে পারে।

হ্যাঁ, অ্যালান ছোকরা হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল— এ কথা ঠিক। আর হোঁচট খাওয়ার ভয়ও মনে মনে বিলক্ষণ আছে এথেনিয়ার। তবু—

তবু সেডার বনের হাতছানিকে উপেক্ষা করা সবসময় সম্ভব হয় না। মায়াময় নতুন জগৎ যেন ওই বনগুলো! ওর ভিতরে ঢুকলেই এমন একটা আনন্দের শিহরন জাগে দেহ-মনকে একসাথে দুলিয়ে দিয়ে, যার সঙ্গে তুলনা দেবার মতো অভিজ্ঞতা এথেনিয়ার আর কোথাও কখনো হয়নি। তাই সে এখনও পাহাড়ে ওঠে এক একদিন। তবে কোনো গুহায় সে ঢোকে না কখনো।

কিন্তু একদিন—

এমন চমৎকার দিন বুঝি লক-লোভানেও দুর্লভ। বাতাস যেন বাঁশি বাজিয়ে বনের কোণে কোণে আনাগোনা করছে। হলদে পাতা ঝরে পড়ছে টুপ-টাপ টুপ-টাপ। বনতল যেন লাল গালিচায় মুড়ে দিচ্ছে তারা অতিথি এথেনিয়াকে সমাদরে বরণ করবার জন্য। এথেনিয়া অলস মন্থর ভঙ্গিতে হেলেদুলে এগিয়ে চলল সেই গালিচায় পা ফেলে ফেলে। এত ভালো লেগেছে তার!

বনের এই টুকরোটা কিন্তু ছোটো। হঠাৎই তা শেষ হয়ে গেল, আর সমুখে দেখা গেল একটুখানি খোলা সমতল জায়গা। সেই সমলতলটুকুর ওপারেই আবার পাহাড়ের চড়াই একটা, বেশ খাড়া চড়াই। আর সেই চড়াইয়ের গায়ে একটা গুহা।

গুহায় এথেনিয়া ঢোকে না। কারণ ওর ভিতর দিকটা সাধারণত অন্ধকারই হয়। কিন্তু এ গুহাটা অন্যরকম। কোথাও এতটুকু আঁধার নেই এর ভিতর। বরং উলটো দিকে দেখা যাচ্ছে আরও একটা মুখ। বেশ দরাজ দরজা একটা। তাই দিয়েই অজস্র আলো এসে ঢুকছে গুহাতে। ওর ভিতর এক ইঞ্চি জায়গাতেও অস্পষ্ট কিছু নেই।

হোঁচট খাওয়ার কোনো ভয় নেই দেখে এথেনিয়া সোজা গিয়ে ঢুকল ওই গুহায় ওপিঠে আর কী নতুন জিনিস আছে, তা দেখে আসবে একবারটি।

নতুন জিনিসটি? সত্যিই নতুন জিনিস। ওদিককার দরজায় এসে দাঁড়াতেই এথেনিয়া দেখতে পেল ছোট্ট একখানি ফুলবাগান, আর তার পিছনে ছোট্ট একখানি সুন্দর বাড়ি। নতুন বাড়ি, ঝকঝকে বাড়ি। এ অঞ্চলের শৌখিন ভিলাগুলো যে এক বিশেষ ফ্যাশানে তৈরি হয়ে থাকে, ঠিক সেরকমটি না-হলেও দেখাতে ভারি চমৎকার এই বাড়িটা। কার বাড়ি এটা? এখানে এমন একটা বাড়ি রয়েছে, তা তো কেউ বলেনি এতদিন! অবশ্য বলবে আর কে? এক অ্যালান বললে বলতে পারত, কিন্তু তা বলেনি সে।

কার বাড়ি এটা? ওই যে বাড়ির গিন্নিকে বাগানেই দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ কেন দেখা যায়নি ওঁকে? হয়তো বাগানেরই কোনো গাছের আড়ালে বসেছিলেন, রোদ পোহাচ্ছিলেন হয়তো, বা ফুল গাছের গোড়া খুঁড়ে দিচ্ছিলেন। বাড়ি থেকে এইমাত্র বেরিয়ে আসেননি নিশ্চয়! তা হলে আসার সময় নজরে পড়তেন এথেনিয়ার।

বেশ মোটাসোটা অমায়িক চেহারা ভদ্রমহিলাটি। সুন্দরী না-হলেও মুখের হাসিখুশি ভাবটির জন্য ভারি মিষ্টি লাগছে তাঁর চেহারাটি। দুই হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে উনি এগিয়ে এলেন ফুলবাগানের কাঠের গেট পর্যন্ত। মিষ্টি সুরে ডাকলেন, ‘সুপ্রভাত! সুপ্রভাত! বেড়াতে বেরিয়েছেন? নতুন এসেছেন না কি লক-লোভানে?’

‘সুপ্রভাত! হ্যাঁ, নতুনই বটে। এই মাত্র দিন পনেরো। তেরো নম্বর ডর্মেট ভিলায় উঠেছি। এদিকটায় আজই প্রথম এলাম’— এথেনিয়াও জবাব দিল সমান মিষ্টি সুরে।

‘হ্রদের ধারে রোজ বেড়ান বুঝি? আমার তো বাড়ি থেকে বেরুনোই শক্ত। স্বামী অসুস্থ, বাড়িতে তিনি আর আমি দু-টি মাত্র লোক। তাঁকে একা রেখে কোথাও আমার যাওয়া চলে না—’

‘ওঃ, স্বামী অসুস্থ আপনার? আমাদের মতো আপনারাও তাহলে হাওয়া বদলের জন্যই এসেছেন? কতদিন এসেছেন?’

‘না, ঠিক হাওয়া বদলের জন্য নয়। আমরা বাসিন্দাই এখানকার। এ বাড়িটা আমাদেরই। আমার স্বামী, কী জানেন, যুদ্ধবিভাগে বেশ উঁচু পদেই ছিলেন। যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন, প্রায় মরার দাখিল। অবসর দিয়ে দিলে যুদ্ধবিভাগ। ডাক্তার বলে দিলে— খুব নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বাস করুন। কোনো গোলমাল হইচই যেন কখনো কানে না-আসে। আসে যদি, মাথার শিরা ছিঁড়ে যাবে আপনার। কামানের আওয়াজে ওই শিরাগুলো বেজায় জখম হয়েছে।’

‘ভয়ানক কথা তো!’— সহানুভূতি জানাল এথেনিয়া।

‘সেই থেকেই— হ্যাঁ, কী নাম ভাই আপনার? এখানে তো পরিচয় করিয়ে দেবার কেউ নেই! আমি হচ্ছি এমা ভগান, কর্নেল ভগানের স্ত্রী।’

‘আমি এথেনিয়া ম্যাকলয়েড। ম্যাকলয়েড আমার বাবার নাম। আর মজা দেখেছেন? আপনার নাম এমা, আমার দিদির নাম এমিলিয়া। বলতে গেলে এক নামই।’

‘ওমা! তাই নাকি?’ মহিলা উচ্ছ´সিত হয়ে উঠলেন, ‘তাহলে তো আমিও দিদিই হলাম আপনার।’

‘তা যখন হলেন, তখন আর আপনি বলছেন কেন?’ হেসে হেসে জবাব দিল এথেনিয়া।

‘না, আর বলব না। তাহলে এইবার এসো বোন, দিদির বাড়ির ভিতরে এসো।’ কাঠের গেট খুলে দিয়ে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন মিসেস ভগান।

হঠাৎ এথেনিয়ার একটা কথা মনে পড়ে গেল, ‘নেমন্তন্ন না-করলে যেও না কারও বাড়িতে—’

তা ইনি অবশ্য নেমন্তন্ন করছেন এথেনিয়াকে। খুব সমাদরেই করছেন নেমন্তন্ন। কিন্তু তাই কি যথেষ্ট? বাবা জানলেন না, দিদিকে কিছু বলা হল না, পথে-পাওয়া বন্ধুর কথামতো তার কি উচিত হবে একটা অজানা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়া?

এথেনিয়া নিজের অজান্তেই বুঝি এক পা পিছিয়ে গেল, ‘না দিদি, আজ থাক। অনেকক্ষণ বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। আর দেরি হলে দিদি ভয়ানক ভাববে। আমি বরং কাল এসে আপনার সঙ্গে বসে গল্পগুজব করব অনেকক্ষণ ধরে। দিদিকে বলে এলে আর তাড়া থাকবে না।’

মিসেস ভগানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, খুবই যেন নিরাশ হয়ে পড়েছেন ভদ্রমহিলা। সে নৈরাশ্য দেখে মায়াই হতে পারত এথেনিয়ার, যদি না হঠাৎ মিসেসের মাথার উপর দিয়ে ওর দৃষ্টি পড়ত বাড়িটার দিকে।

বাড়ির সমুখের জানালাগুলো সব খোলা, কেবল একটি জানালার একটা পাল্লা ছাড়া। সেই বন্ধ পাল্লাটার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একখানা মুখ। পুরো মুখখানাও নয়, বলতে গেলে আধখানা। একটামাত্র চোখ, এক পাশের লালচে দাড়ি। এক কানে লম্বা লম্বা লালচে চুল— সবে মিলিয়ে একটা কী যেন কিম্ভূত দৃশ্য!

বিশেষ করে ওই একচোখের দৃষ্টিটা! কী আছে ওতে? অপঘাত মরণের বিভীষিকা? নরকাগ্নির জ্বালা? সেই অমানুষিক দৃষ্টির ভিতর থেকে নিমেষে একটা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ যেন ছুটে এসে আছড়ে পড়ল এথেনিয়ার সর্বাঙ্গে। তার বুকের ভিতরে আগুনের বর্শা যেন বিঁধে গেল একখানা। এমন অসহ্য একটা যাতনা চিড়বিড়িয়ে উঠল সেখানে যে, ডান হাত দিয়ে সে চেপে ধরল তার বুক।

রাখেন ভগবান তো মারে কে? বুকে ওর ছেলেবেলা থেকেই ঝুলছে একখানা খুদে রুপোর ক্রশ। ডান হাতখানা সেই ক্রশের উপর পড়তেই এথেনিয়া মুঠো করে সেটা চেপে ধরল। অবাক কাণ্ড! জ্বালাটা কমে এল সঙ্গেসঙ্গে।

নিজের ভয় আর নিজের যন্ত্রণা নিয়ে এতখানি অস্থির না-হয়ে পড়লে মহিলাটির মুখের মুহুর্মুহু ভাবান্তর সে অবশ্য দেখতে পেত, আর দেখলেও চমকেও যেত নিশ্চয়ই। সে মুখে প্রথমে দেখা দিয়েছিল নৈরাশ্য, তার পরে দেখা দিল জয়োল্লাস, তার পরে আবার সেই নৈরাশ্য।

দেখেনি এথেনিয়া এসব। দেখবার জন্য আর সে দাঁড়াল না। জানালার দিকে আর একবার ভীতচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে পিছন ফিরল। জানালা থেকে সে আধখানা মুখ অন্তর্হিত হয়েছে ইতিমধ্যে।

অনেকখানি চলে আসবার পরে তার খেয়াল হল যে মিসেস ভগানের কাছে বিদায় নিয়ে আসা হয়নি। ছিঃ ছিঃ, চরম অভদ্রতা হয়ে গেল তো! ভদ্রমহিলা ভাববেন কী? ত্রুটিটা শুধরে নেওয়ার জন্য সে পিছন ফিরে তাকাল একবার, একটা মিষ্টি সম্ভাষণ ছুড়ে দেওয়ার জন্য।

আর পিছন ফিরে তাকিয়েই, এত ভয় সত্ত্বেও সে মূর্তির মতো নিথর হয়ে গেল একেবারে। কোথায় মিসেস ভগান? কোথায় সে ফুলবাগান? কোথায় সে সুন্দর ঝকঝকে নতুন বাড়ি?

কোথাও কিছু নেই। স্রেফ এলোমেলো পাথরে আকীর্ণ একটা খোলা জমি পড়ে আছে, তার শেষ মাথায় একটা শ্যাওলা-ধরা ইটের গাদা।

এথেনিয়া আর পারল না সইতে। নানা ধরনের এত উত্তেজনার আঘাত পরপর এসে পড়ার দরুন জ্ঞান হারিয়ে সেই গুহার দরজায় সে লুটিয়ে পড়ল একেবারে। আর সেইখানেই তাকে খুঁজে পাওয়া গেল পরদিনই সকালে। অজ্ঞান সে আর নয় তখন। কিন্তু প্রবল জ্বরে গা তার পুড়ে যাচ্ছে, আর থেকে থেকে আর্তনাদ করে উঠছে, ‘তুমি আমায় বোন বলে ডেকেছিলে। দোহাই, তুমি খেয়ে ফেলো না আমাকে। দোহাই তোমার!’

অগের দিন সারা বিকেল, সারা রাত লোভান ভিউ পল্লিটা আথালপাথাল করে খুঁজেছে ওয়েলডন আর কিলপ্যাট্রিক বাড়ির ছেলেরা। ম্যাকলয়েড তো পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন সারাক্ষণ। এমেলিয়া জেলে ডিঙি নামিয়েছে হ্রদের জলে। তার বিশ্বাস বোনটা ডুবে মরেছে নিশ্চয়।

সারারাত খুঁজেও কোনো হদিশ মেলেনি। সকাল বেলায় ঘোড়া নিয়ে এল অ্যালান। সব শুনেই সে বলল, ‘ভূতের বাড়ি খোঁজা হয়েছে?’

ভূতের বাড়ি? ভূতের বাড়ি আবার কী? কেউ তো ওর নামও শোনেনি!

অ্যালানই পথ দেখিয়ে ভূতের বাড়িতে এনেছে তাদের। পোড়ো জমিটার ওপাশে ইটের গাদা দেখিয়ে সে বলল, ‘ভূতের বাড়ি ওই যে। কর্নেল ভগানের বাড়ি ছিল বটে। মহাপাপিষ্ঠ লোক ছিল। কোথায় যুদ্ধে জিতে নাকি একটা গোটা শহরের লোককে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল। তারপর এখানে এসে বাস করছিল। মরে ভূত হয়ে আছে এখানেই। তার বউটা আবার ওই পাপিষ্ঠ স্বামীকে এত ভালোবাসত যে, মরেও তাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। সেও আছে পেতনি হয়ে।

মিস এথেনিয়াকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম যে, পাহাড়ে যেন না-ওঠেন। সব কথা খুলে বলিনি, ওঁর মনে ভয় ধরিয়ে দিতে চাইনি বলে। এখন দেখছি বললেই ভালো করতাম। প্রায় দু-শো বছর হল মরেছে ভগান। এই দু-শো বছরে কত মানুষ যে মেরে ফেলেছে ওই ভূতেরা, তার লেখা-জোখা নেই। ওদের বাড়ির গেটের ভিতর যে ঢুকবে, তার আর নিস্তার নেই। ভাগ্যিস ওই ক্রশটা ছিল মিস এথেনিয়ার বুকে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *