সেজোমামার চন্দ্র-যাত্রা

সেজোমামার চন্দ্র-যাত্রা

আমার ছোটোকাকা মাঝে মাঝে আমাদের বলেন, এই যে তোরা আজকাল চাঁদে যাওয়া নিয়ে এত নাচানাচি করিস, সেকথা শুনলে আমার হাসি পায়। কই, এত খরচাপাতি, খবরের কাগজে লেখালেখি করেও তো শুনলাম না কেউ চাদে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে! তোরা আবার এটাকে বৈজ্ঞানিক যুগ বলিস, ছোঃ!

আমরা তখন বলি, তার মানে? কী বলতে চাও খুলে বলোনা।

ছোটোকাকা বলেন, তার মানেটা খুবই সোজা। চাঁদে যাওয়াটা কিছু-একটা তেমন আজকালকার ব্যাপারও নয়। পঞ্চাশ বছর আগে আমি নিজেই তো একরকম বলতে গেলে চাদে ঘুরে এসেছি।

আমরা তো অবাক! একরকম বলতে গেলে কী? গেছিলে, না যাওনি?

ছোটোকাকা বইয়ের পাতার কোনা মুড়ে রেখে পা গুটিয়ে বসে বললেন, তাহলে দেখছি সব কথাই খুলে বলতে হয়। বয়স আমার তখন বারো-তেরো হবে, পুজোর ছুটিতে গেলাম মামাবাড়িতে। সেজোমামা অনেক করে লিখেছেন। এমনিতেই আমি কোথাও গেলে সেখানকার লোকরা খুব যে খুশি হয় বলে মনে হয় না, আর সেজোমামা তো নয়ই। তা ছাড়া দিদিমা সারাক্ষণই এটা-ওটা দেন, খাওয়া-দাওয়া ভালো, পুকুরে ছিপ ফেললেই এই মোটা মোটা মাছ, গাছে চড়লেই ভঁসা পেয়ারা। না যাবার কোনো কারণই ছিল না।

সেখানে পৌঁছে দেখি সেজোমামা কোত্থেকে একটা লড়ঝড়ে মোটর গাড়ি জোগাড় করে আমাকে নিতে স্টেশনে এসেছেন। আমাকে দেখেই, মাথা থেকে পা অবধি চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আগের চেয়ে যেন একটু ভারী-ভারী লাগছে! হারে, তোর ওজন কত রে?

কিছুদিন আগেই ইস্কুলে সবাইকে ওজন করেছে। বললাম, আটত্রিশ সেরের সামান্য বেশি।

সেজোমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, আবার বেশি কেন? সে যাকগে, ওতেই হবে, এখন গাড়িতে ওঠ, চল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই, খুব ভালো খাওয়ায় তারা।

সেজোমামাকে গাড়ি চালাতে দেখে আমি তো অবাক, তুমি আবার গাড়ি চালাতে পার নাকি?

সেজোমামা বেজায় রেগে গেলেন, কী যে বলিস! আরে এই সামান্য একটা গাড়িও চালাতে পারব না? বলে কি না যে আমি– যাকগে, চল তো এখন।

সোজা নিয়ে গেলেন কুণাল মিত্তিরের রহস্যময় বাড়িতে। ও বাড়ির ভেতরে এখানকার কেউ কখনো যায়নি, কুণাল মিত্তিরের নাম সবাই জানে, তবে তাকে কেউ চোখে দেখেনি। একটা উঁচু টিলার ওপরেঅদ্ভুত বাড়ি, বাড়ির চারিদিকে দেড়-মানুষ-উঁচু পাঁচিল, তার ওপরে কাঁটাতারের বেড়া, দেয়াল কেটে লোহার গেট বসানো, সে সর্বদাই বন্ধ থাকে। শোনা যায় কুণাল মিত্তির নাকি নানারকম বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন, সেসব সাধারণের জন্য নয়, অতি গোপন ও গুহ্যভাবে করতে হয়।

প্রকাণ্ড টিলাটার গা বেয়ে যদি চড়া যায়, ওপরটা চ্যাপটা, সবটা ঘিরে পাঁচিল, আশেপাশে কোনো গাছগাছড়াও নেই যে তাতে চড়ে পাঁচিলের ভেতরে দেখা যাবে কিছু। তার ওপর মাঝে মাঝে ভেতর থেকে বাড়ি কাঁপানো গর্জন শোনা যায়, লোকে বলে নাকি দু-জোড়া ডালকুত্তা দিনরাত ছাড়া থাকে। মোট কথা, কেউ ওদিকে বড়ো-একটা যায় না। চারিদিকে দু-তিন মাইলের মধ্যে কারো বসতিও নেই। ফঁকা মাঠ আগাছায় ভরা।

সেইখানে তো গেলেন আমাকে নিয়ে সেজোমামা। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গাঁ গাঁ করতে করতে গাড়িটা তো টিলার ওপরে চড়ল। তারপর প্যাক-প্যাক করে হর্ন বাজাতেই লোহার দরজা গেল খুলে। আমরাও ভেতরে গেলাম। অবাক হয়ে দেখি চমৎকার ফুলবাগান, একতলা লম্বা একটি বাড়ি, তার বারান্দায় একটা বড়ো কালো বেড়াল সোজা হয়ে বসে সবুজ চোখ দিয়ে আমাদের দেখছে। একটা উঁচু দাঁড়ে নীল কাকাতুয়াও একদৃষ্টে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। আমাদের বলছি কেন, আসলে আমাকে দেখছে।

অমনি চারিদিক থেকে দলে দলে চাকরবাকর ছুটে এসে মহা খাতির করে আমাদের নামাল। বারান্দা থেকে একজন ভদ্রলোকও এগিয়ে এলেন, ফর্সা কোঁকড়া চুল, বেঁটে মোটা, বয়স বেশি নয়। সেজোমামাকে ফিসফিস করে বললাম, ওই নাকি সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কুণাল মিত্তির যাকে কেউ চোখে দেখেনি।

শুনতে পেয়ে ভদ্রলোক চটে গেলেন, কেউ চোখে দেখেনি কী, আমি বিলক্ষণ দেখেছি। বিশ্রী দেখতে।

সেজোমামা বললেন, আহা, বড়ো কথা বলিস। ওই তোর দোষ। কিছু মনে কোরো না, মনোহর-উনি কুণাল মিত্তির হতে যাবেন কেন, কুণাল মিত্তির ওঁর বাবা, ওঁর নাম মনোহর মিত্তির, আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়েছি। একদিন উনি ওঁর বাবার চেয়েও অনেক বেশি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবেন। জানিস তো, মিত্তিররা কীরকম চালাক হয়।

মনোহরবাবু তাই শুনে ছোটো গোঁফটাকে একটু নেড়ে বললেন, আর তুমিও তার চেয়ে খুব বেশি কম বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবে না। কী যেন নাম তোমার বললে?

বললাম, আগে বলিনি, এখন বলছি–ইন্দ্র।

খুশি হয়ে বললেন, ইন্দ্র? তা ইন্দ্রই বটে, চাঁদের মাটিতে প্রথম পা দেবার গৌরব হবে যার, সে ইন্দ্রের চেয়ে কোন দিক দিয়ে কম বলো দিকিনি।

চারপাশের লোকজনেরা বলতে লাগল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।

আমার তো চক্ষু ছানাবড়া। চাঁদে যাব নাকি আমি?

বললাম, সে আমার যেতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু একা যাব না। তা ছাড়া, আবার ফিরে আসব তো? ডিসেম্বরে আমার ক্রিকেট ম্যাচের সিট বলা আছে কিন্তু।

সেজোমামা আর মনোহরবাবুমুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। শেষটা মনোহরবাবু বললেন, তা হা– তা ফিরে আসবে বই কী, যাবে আর আসবে না, সে কি একটা কথা হল নাকি! কিন্তু আর দেরি কীসের জন্য? চলো তো দেখি ইন্দ্র, আমার সঙ্গে।

গেলাম বাগান পেরিয়ে একটা জায়গায়। তার মাথার ওপর দিয়ে লম্বা একটা কী বেরিয়ে রয়েছে, বিকেলের পড়ন্ত রোদে চিকচিক করছে, আগাটা ক্রমশ ছুঁচলো হয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে।  

বেড়ার দরজা চাবি দিয়ে খুলে মনোহরবাবু সরে দাঁড়ালেন, আমিই আগে ঢুকলাম।

 গিয়ে যা দেখলাম সে আর কী বলব। আগাগোড়া অ্যালুমিনিয়ামের মতো কী ধাতু দিয়ে তৈরি কী একটা বিশাল যন্ত্র, অবিকল উড়ুক্কু মাছের মতো দেখতে, তবে ডানাগুলো অনেক ছোটো আর পিছন দিকে বেঁকিয়ে বসানো। দেখলেই বোঝা যায় যে একবার ছেড়ে দিলেই অমনি সুড়ুৎ করে তিরের মতো ওপরে উঠে, নীল আকাশের মধ্যে সেঁদিয়ে যাবে। চাদে যাওয়া এর পক্ষে সেরকম কিছুই শক্ত হবে না।

নীচে একটা গোল প্ল্যাটফর্ম ওটাকে চারিদিকে ঘিরে আছে, সেটাই প্রায় একতলার সমান উঁচু হবে, তারো নীচে যন্ত্রটার আরও অনেকখানি রয়েছে। রুপোলি গায়ে কালো দিয়ে লেখা ধূমকেতু। আর এক জোড়া এই বড়ো বড়ো চোখ আঁকা। আশেপাশে কতরকম যন্ত্র দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা, বোঝা গেল– একবার সেইগুলো খুলে দিলেই আর দেখতে হবে না!

মনোহরবাবু চোখ ছোটো করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পকেটে কী? ওরকম ঝুলে আছে যে? ও হবে না, যতটা সম্ভব হালকা চাওয়া চাই। এই বেদে, দেখ তো ওর পকেটে কী।

বেদে বলে লোকটা এগিয়ে আসতেই বললাম, এই খবরদার, তাহলে কিন্তু চাঁদে যাব না বলে রাখলাম।

মনোহরবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও-রকম করিসনে বাপ, চাঁদে যাবি না কী রে? তুই না গেলে কে যাবে বল দিকিনি? কেউ রাজিও হবে না, তা ছাড়া তোর প্যান্টের মাপে সব তৈরি। এখন না গেলে যে আমার জীবনের সব কাজ ব্যর্থ হয়ে যাবে! বলছি আমার শালাকে বলে তোকে মোহনবাগান ক্লাবের লাইফ মেম্বর করে দেব।

ওঁর হাত ধরে বললাম, দেবে তো ঠিক? বাবা! সেজোমামা কত চেষ্টা করেও হতে পারেনি। শেষটা কিন্তু অন্যরকম বললে–

মনোহরবাবু রেগে উঠলেন, বলছি করে দেব, আবার অত কথা কীসের? ফিরে তো এসো আগে।

বেদে বললে, যদি আস!

মনোহরবাবুকে ধমক দিলেন, তোমাকে অত কথা বলতে কে বলেছে বাছা? যাও, নীচে গিয়ে পাওয়ার লাগাও দিকিনি, নইলে–।

বেদে অমনি একটা ছোটো সিঁড়ি দিয়ে যন্ত্রের তলায় চলে গেল।

সেজোমামা মনোহরবাবুকে বললেন, ফিরে আসার কলকজগুলো ওকে বুঝিয়ে দিয়ো, মনোহর।

মনোহরবাবু বললেন, ও কি ওর বাবা-মার একমাত্র সন্তান?

আমি বললাম, আরে না না, আমার দুটো ভাই দুটো বোন।–আচ্ছা, লাইফ-মেম্বর করে দেবেন তো? কারণ বাবা হয়তো চাদা দেবেন না।

মনোহরবাবু বললেন, তাই দেব। পকেটে কী আছে বের করে এইখানে রাখো তো দেখি।

মেশিনের তলা থেকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হল, তারপর কেমন শোঁ-শোঁ করতে লাগল। মনোহরবাবু একবার নিজের হাতঘড়িটা দেখে নিলেন। আমি পকেট থেকে লাট্ট লেত্তিইয়ো-ইয়ো রুমাল নীল গুলি রুমেনিয়ার দুটো ডাকটিকিট মনাদা দিয়েছিল– আধঠোঙা নরম ঝাল ছোলা ভাজা, টর্চ, আমার বড়ো গুলতিটা আর এক কৌটো শট বের করে রাখলাম। মনোহরবাবু তো অবাক!

এসব কিচ্ছু নেবার দরকার নেই, শুধু ওজন বাড়ানো। খালি এই নোট বই আর পেনসিলটা নেবে। কী দেখবে না দেখবে, শরীরে কেমন বোধ করবে, সব টুকে রাখবে। আর এই হাতঘড়িটা নেবে, এতে সেকেন্ডের কাঁটা, তারিখের কাঁটা সব দেওয়া আছে। সব লিখবে, কখন পৌঁছোলে ইত্যাদি, ও কী হল, চলে যাচ্ছ যে।

আমি বললাম, গুলতি শট না দিলে আমি যাব না।

সেজোমামা বললেন, থাকগে মনোহর, এখন মনে হচ্ছে তুমি বরং আর কাউকে দেখো।

মনোহরবাবুবললেন, বেশ, তা হলে আমার হাজার টাকা ফিরিয়ে দাও, আমি এক্ষুনি অন্য লোক দেখছি।

সেজোমামা চুপ। আমি বললাম, তাতে কী হয়েছে সেজোমামা? আমার গুলতি দিলেই আমি যাব। অবিশ্যি বড্ড খিদে পেয়েছে, তাই আগে খানিকটা খেয়েও নেব। আর বলছি তো–একা যাব না।

মনোহরবাবু চটে গেলেন, একা যাব না আবার কী? জানিস, ওই কাকাতুয়াটা আর বেড়ালটা দু-তিনবার একা গেছে, কিছু বলেনি।

বললাম, চাঁদ অবধি গেছে?

মনোহরবাবু বললেন, চাঁদ অবধি গেছে কি বুঝতে পারা যাচ্ছে না বলেই তো তোমাকে পাঠানো হচ্ছে। নিদেন তোমার খাতা পেনসিলটা ওই যে ছোটো হাউই-মতন দেখছ, ওটাতে পুরে ফেলে দিতে পারবে তো, নিজে যদি নেহাতই–আচ্ছা সে যাকগে, এখন এই বড়িটা খাও দিকিনি, কেমন পেট ভরে যায় দেখো।

বলে আমার মুখে কী-একটা হলদে বড়ি পুরে দিলেন, সে যে কী আশ্চর্য বড়ি আর কী বলব। খেতেই মনে হল আমি লুচি মাংস চপ কাটলেট ভেটকি-ফ্রাই চিংড়িমাছের মালাইকারি রাবড়ি কেক চকলেট ছাঁচিপান সব খাচ্ছি। একেবারে পেট ভরে গেল। সেই বড়ির শিশিটা আমার হাতে দিয়ে মনোহরবাবু বললেন, এই নাও এক মাসের খোরাক। একটার বেশি দুটো বড়ি কোনোদিন খেয়ো না, খেলেই পেটের অসুখ করবে, মোটা হয়ে যাবে, যন্ত্রের ভেতর আঁটবে না। এসো, এই আরাম কেদারাটাতে বসে পড়ো দিকিনি। হাওয়ার কোনো অভাব হবে না, এমন কল করেছি ভেতরে তোমার নিশ্বাসই আবার অক্সিজেন হয়ে যাবে।

বলে সেই লম্বা চোঙার মতন যন্ত্রটার গায়েয় একটা দরজা খুলে, আমাকে একটা চমৎকার হাওয়ার গদি-আঁটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন আর মাথার ওপর দিয়ে একটা অদ্ভুত পোশাক পরিয়ে দিয়ে কোমরে চেয়ারের সঙ্গে বগলেস এঁটে দিলেন। মুখের জায়গাটা বোধ হয় অভ্র দিয়ে তৈরি, সব দেখতে পাচ্ছিলাম। নাকের কাছে ছাদা, নিশ্বাস নিতে পারছিলাম। তারপর দেখি সেজোমামা তাড়াতাড়ি আমার জিনিসপত্র নিজের পকেটে ভরছেন। চেঁচিয়ে বললাম, গুলতি দিলে না? গুলতি না দিলে যাব না বলেছি-না!

অভ্রের মুখোশের ভেতর থেকে কথা শোনা গেল কিনা জানি না। কিন্তু সেজোমামার বোধ হয় একটু মন কেমন করছিল, কাছে এসে কী যেন বলতে লাগলেন, একবর্ণ শুনতে পেলাম না, যন্ত্রের শোঁ-শোঁ গোঁ-গোঁতে কান ঝালাপালা! দারুণ রেগে গিয়ে সেজোমামার কাছা আঁকড়ে ধরে চেঁচাতে লাগলাম, দাও বলছি, গুলতি না নিয়ে আমি কোথাও যাই না।

এদিকে মনোহরবাবু বার বার ঘড়ি দেখছেন, যন্ত্রটা কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে উঠছে, অথচ আমি এমন করে সেজোমামার কাছা আঁকড়েছি যে দরজাটা এঁটে দেওয়া যাচ্ছে না। শেষটা হঠাৎ রেগেমেগে ঠেলে সেজোমামাকে সুষ্ঠু ভেতরে পুরে দিয়ে মনোহরবাবু দরজা এঁটে দিলেন।

বাবা! দিব্যি ফাঁকা ছিল ভেতরটা, সেজোমামা ঢোকাতে একেবারে ঠেঠেসি হয়ে গেল, নড়বার চড়বার জো রইল না। দরজা বন্ধ করাতে বাইরের শব্দ আর কানে আসছিল না, সেজোমামা চিৎকার করতে লাগলেন, ও মনোহর, ফেরবার কল শিখিয়ে দিলে না যে, ফিরব কী করে?

 তা কে কার কথা শোনে। ভীষণ জোরে ফুলে উঠে বোঁ করে যন্ত্রটা আকাশে উড়ে গেল। একবার মনে হল চারদিকে চোখ ঝলসানো আলো, তারপরেই মনে হল ঘোর অন্ধকার।

যখন জ্ঞান ফিরে এল বুঝলাম চাঁদে পৌঁছে গেছি। যন্ত্রটা আর নড়ছে না চড়ছে না, কাত হয়ে পড়ে আছে, আমি বসে বসেই শুয়ে আছি, সেজোমামা আমার তলায় একটু একটু নড়ছেন-চড়ছেন। মুখ তুলে কানের কাছে বললেন, আমার ডান পকেটে তোর টর্চটা আছে, দেখ তো নাগাল পাস কি না।

বুঝলাম ওঁর নিজের হাত নাড়বার জায়গা নেই। হাতড়ে হাতড়ে ঠিক পেলাম। ভয়ে ভয়ে জ্বালালাম, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যন্ত্রের ভেতরটা ভালো করে দেখলাম, ভেতরকার কলকজা সব ঠিক আছে, যে-যার জায়গায় আটকানো। হাত দিয়ে আমার বাঁ-পাশের জিপ ফার খুলে মুখোশ নামিয়ে ফেললাম।

অমনি এক ঝলকা ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে লাগল। আঃ, চাঁদের বাতাসই আলাদা রে, এ পৃথিবীতে সে-রকমটি হয় না।

সেজোমামা বললেন, বেড়ে খাসা কল বানিয়েছে তো মনোহর। বলেইছিল যে নামবার সময় এতটুকু কঁকানি লাগবে না, এতটুকু ভাঙবে না, টসকাবে না।

আমি এদিকে টর্চ ঘুরিয়ে দেখি, পড়বার সময় কাত হয়ে যাওয়াতে দরজার বাইরের ছিটকিনি গেছে খুলে, দরজা এখন হাঁ!

বললাম সে কথা সেজোমামাকে, কিন্তু আমি না সরলে তার নড়বার উপায় নেই। তখন কোমরের বগলেস খুলে সেজোমামার পেটের ওপরে দুই পা রেখে এক লাফে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে পড়া আমার কাছে কিছুই নয়। পৃথিবীতে যখন থাকতাম এরচেয়ে কত উঁচু উঁচু জায়গা থেকে লাফাতে হয়েছে। সেজোমামা শুধু একটু কোঁৎ করে উঠলেন।

বেরিয়ে বুঝলাম বোধ হয় চাঁদের কোনো একটা নিভে-যাওয়া আগ্নেয়গিরির মুখের মধ্যে পড়ে গেছি। চারদিকে মনে হল নরম ঘাস। মাথার ওপর তারাও দেখতে পেলাম, আবার এক কোনা দিয়ে বোধ হয় আমাদের এই পৃথিবীটাকেই একবার একটু দেখতে পেলাম। ঠিক যেন আরেকটা চাঁদ। মনে হল আফ্রিকাটাকে যেন একটু একটু দেখতে পেলাম। তারপরেই আবার সেটা টুক করে ডুবে গেল।

তখন কানে এল যন্ত্রের ভেতর থেকে সেজোমামা মহা চেঁচামেচি লাগিয়েছেন, টর্চের আলো দেখা, আমিও নামব।

অনেক কষ্টে নেমে আমার পাশে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসেই বললেন, খিদেয় পেট জ্বলে গেল, সেই বড়ি একটা দেনা।

টের পেলাম আমারও বেজায় খিদে পেয়েছে, দুজনে দুটো বড়ি খেলাম, তারপর ঘাসের ওপর শুয়ে থেকে থেকে অন্ধকারটা একটু চোখ-সওয়া হয়ে এল। আমরা যে একটা বেশ বড়ো গর্তের মতো জায়গাতে শুয়ে আছি সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই, ঠিক যেন একটা বিরাট পেয়ালার মধ্যে রয়েছি। একটু একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল।

সেজোমামা বললেন, কী রে, উঠে একটু দেখবি না?

বললাম, ভোর হোক আগে।

সেজোমামা বললেন, আবার ভোর কী রে? এটা যদি চাঁদের উলটো পিঠ হয়ে থাকে তা হলে তো ভোরই হবে না।

এবারে উঠলাম। তাই-ই নিশ্চয় সেজোমামা। এ-পিঠটাতে তো সর্বদা আলো থাকে। দিনের বেলাও তাই দেখেছি, রাতেও দেখেছি।

–ফোঁস।

তিন হাত লাফিয়ে উঠলাম। ফোঁস করল কী? তবে কি চাঁদে হিংস্র জন্তুও আছে? বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। কিন্তু স্পষ্ট শুনলাম জন্তুটা কচর-মচর করে নরম ঘাসগুলোকে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

সেজোমামা বললেন, তবে কোনো ভয় নেই। ওরা নিরামিষ খায়।

আবার শুনলাম জোরে একটা ফোঁস ফোঁস। আমার মোটেই ভালো লাগল না। সেজোমামা কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, কী হবে রে?

কী আবার হবে? এক নিমেষে গুলতিতে শট লাগিয়ে শব্দ লক্ষ করে দিলাম ছেড়ে। অমনি সে যে কী চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল সে আর কী বলব। একটা কেন, মনে হল এক লাখ জানোয়ার একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে! সেই চেঁচানি শুনে চাঁদের মানুষেরা জেগে উঠে সব বড়ো বড়ো মশাল নিয়ে দেখি পেয়ালার একদিকের কানা বেয়ে নেমেছে। কী হিংস্র সব চেহারা!কী ষণ্ডা, পৃথিবীর মানুষদের চেয়ে তিনগুণ জোরালো। আর সে কী গর্জন, কান ফেটে যায়।

আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলাম না। তারা হয়তো ওই অন্ধকারে আমাদের দেখতে পেল না। পড়িমরি প্রাণপণ ছুটে অন্য ধারের ঘাসে ঢাকা ঢালু দেয়াল বেয়ে পিঁপড়ের মতো আমরা উঠে গেলাম। শরীরে আর এতটুকু ক্লান্তি বোধ করলাম না।

ওপরে উঠেই ছুট লাগালাম। আন্দাজে অন্ধকারের মধ্যে দু-পা না যেতেই চাঁদের পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুপ করে খানিকটা পড়েই গড়াতে লাগলাম।

সব সইতে পারি বুঝলি, শুধু ওই গড়ানিটা আমার সহ্য হয় না। তখুনি মুচ্ছো গেলাম।

 আবার যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখি সেজোমামা আমার মুখে-চোখে ঠান্ডা জল ছিটোচ্ছেন। আমি নড়ে উঠতেই বললেন, বাপ, বেঁচে আছিস তাহলে? দাঁড়া, গাড়িটা আনি, আর এখানে নয়, চল একেবারে ভোরের গাড়িটা ধরা যাক।

সেজোমামা গাড়ি আনতে গেলেন, আমি একটা পাথরে ঠেসান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলাম। আস্তে আস্তে মাথাটা খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এলে বুঝলাম কুণাল মিত্তিরদের টিলার নীচেই এসে পড়েছি। সেজোমামা গাড়ি আনতেই বললাম, কী আশ্চর্য, না সেজোমামা? যেখান থেকে চাঁদে গেলাম আবার ঠিক সেই একই জায়গায় এসে নামলাম।

সেজোমামা বললেন, আশ্চর্য বই কী। আমরা যে বেঁচে আছি সেটা আরও আশ্চর্য!

তাই তো, যন্ত্রটা চাদেই পড়ে আছে। পকেট হাতড়াতে লাগলাম। সেজোমামা বললেন, আবার কী?

–কেন সব লিখে রাখতে হবে-না? ওখানে ঠান্ডা বাতাস আছে, জন্তু মানুষ সব আছে।

সেজোমামা বললেন, সে আমি মনোহরকে বলে দেবখন। আর দেখ, এসব কথা খবরদার বাড়িতে বলবি নে।

বাবা-মারা আমাদের দেখে অবাক। এ কী, কাল গেলে, আজই ফিরে এলে?

সেজোমামা বললেন, সেখানে মহামারি লেগেছে। আমাকে আজই ফিরে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে আমি কাউকে কিছু বলতে পারছি না, পেট ফেঁপে মরি আর কী!

.

ছোটোকাকা থামলে আমরা বললাম, তবে কেন বললে একরকম বলতে গেলে চাঁদে গিছলে? ছোটোকাকা বললেন, তার কারণ এই ঘটনার মাস চারেক বাদে মা হাতে করে সেজোমামার একটা চিঠি নিয়ে বাবাকে বললেন, শোনো একবার কাণ্ড। ওই যে আমাদের কুণাল মিত্তিরের ছেলে মনোহর না, সে নাকি এক উড়োজাহাজ বানিয়ে, যেখানে কুণাল মিত্তিরের গবেষণা-গোরুরা চরছিল সেখানে নামিয়ে একাকার কাণ্ড করেছে। কুণাল মিত্তির দারুণ রেগে ওকে চাকরি দিয়ে বোম্বাই পাঠিয়েছেন।

বাবা বললেন, গবেষণা-গোরু আবার কী জিনিস?

মা বললেন, ওমা, তাও জান না? কুণাল মিত্তির একরকম বড়ি বানিয়েছেন, তাতে সবরকম পুষ্টিকর জিনিস আছে, সে খেলেই পেট ভরে যায়। ওই টিলার মাথায় খানিকটা জায়গাকে পুকুরের মতো করে কেটে, অবিশ্যি তাতে জল নেই, সেখানে গোরুগুলো ছাড়া থাকত ওই বড়ি খেত আর মন ভালো করবার জন্য একটু একটু ঘাসও চিবুত। বাইশ সের দুধ দিত এক-একটা। ব্যাটা লক্ষ্মীছাড়া মনোহর সেইখানে উড়োজাহাজ নামিয়েছে। ব্যস, আর যাবে কোথা, গোরুরা সব দুধ বন্ধ করে দিয়েছে। কুণাল মিত্তির রেগে টং! ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে, এখন বলে নাকি ছেলের কোনো দোষ নেই, চমৎকার উড়োজাহাজ করেছে, কিন্তু পাড়ার কয়েকটা দুষ্টু লোক মিলেই নাকি ওর মাথাটা খেল। শুনলে একবার কথা!

আমি আস্তে আস্তে সেখান থেকে উঠে গিয়ে গুলতিটা বের করে কাগদের মারতে লাগলাম।

–হ্যাঁ রে, তোরা এখনও বসে রয়েছিস যে, আমাকে কি বইটা শেষ করতে দিবি না? এই বলে ছোটোকাকা আবার পা মেলে দিয়ে বই পড়তে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *