সেকেলে পশ্চিমে ডাকাত (প্রথম অংশ)

সেকেলে পশ্চিমে ডাকাত 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

১৮৩৭ খৃষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল তারিখে উত্তর পশ্চিম প্রদেশের লেফটেনেণ্ট গবর্ণর স্যার চার্লস মেট্‌কাফ (Sir Charles Metcalfe) ডাকাইতি দমনের একটি বিভাগ সৃষ্টি করেন। বঙ্গীয় সিভিলিয়ান মিষ্টার হিউ ফ্রেজার (Mr. Hugh Fraser) সেই নব বিভাগের প্রধান কর্ম্মচারী নিযুক্ত হন। তাঁহাকে কি কি কার্য্য করিতে হইবে, তাহার বিস্তৃত উপদেশ ওই মাসের ২২ শে তারিখের সেক্রেটারী সাহেবের লিখিত পত্রে প্রদত্ত হয়। 

ওই পত্রে এইরূপ লিখিত হয় যে, এই দেশে যে সকল ব্যক্তি একত্রে দলবদ্ধ হইয়া রাত্রিযোগে ভয়ানক ভয়ানক ডাকাইতি ও আবশ্যক হইলে হত্যা ও রক্তপাত করিতেছে, যাহারা ঘটনাস্থল হইতে বহুদূরে অবস্থিতি করা সত্ত্বেও অনায়াসে দূরের সংবাদ সংগ্রহ করিয়া, এই কার্য সম্পন্ন করিতেছে, যাহারা হঠাৎ উপস্থিত হইয়া, মুহূর্তের মধ্যে আপন কার্য্য সমাধা পূর্ব্বক, সরকারী কর্ম্মচারিগণের চক্ষে ধূলি প্রদান করিয়া সেই স্থান হইতে অন্তর্দ্ধান হইতেছে, পুলিস-কৰ্ম্মচারী ও বিচারকগণ যাহাদিগের হঠাৎ আক্রমণ রোধ করিতে অসমর্থ ও যাহাদিগকে বিচারাধীনে আনিতে এখনও সম্পূর্ণরূপে অপারগ, তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অনুসরণ করিতে ও তাহাদিগকে ধৃত করিয়া বিচারাধীনে আনিয়া যাহাতে এই সকল ডাকাতি বন্ধ হয়, তাহার নিমিত্তই এই বিভাগের সৃষ্টি। 

এই সময়ে প্রায় নিত্যই ডাকাইতি হইত, কিন্তু কাহারা যে ডাকাইত, কোথা হইতে তাহারা আসিয়া ডাকাইতি করিত ও অপহৃত দ্রব্যাদি লইয়া কোথায় গমন করিত, তাহা এ পর্য্যন্ত কোন মাজিষ্ট্রেট বা কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী জানিতে পারে নাই। তবে কেবল এই মাত্র অবগত হইতে পারা গিয়াছিল যে, উহাদিগের অধিকাংশই অযোধ্যা রাজার অধিকারভুক্ত চম্বল নদীর ধারে গোয়ালিয়ার রাজপুতানা আলোয়ার রোহিলখণ্ড প্রভৃতি স্বাধীন রাজ্যের অন্তর্গত স্থান সকলে এবং গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী প্রদেশে অবস্থিতি করে। 

১৮২২ খৃষ্টাব্দের ১২ই নভেম্বর তারিখে গবর্ণমেন্ট গোরকপুর জেলার মাজিস্ট্রেট মিস্টার আর, এম. বার্ডকে (Mr. R. M. Bird) ভর্ৎসনা করিয়া এক মন্তব্য প্রকাশ করেন ও কহেন যে, তাঁহার কর্তৃত্বাধীন সময়ে অর্থাৎ ১৮২১ খৃষ্টাব্দে তাঁহার শাসনাধীনে ডাকাইতি অতিশয় বৃদ্ধি পাইয়াছে। 

১৮২২ খৃষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে তিনি নিজের স্কন্ধ হইতে সমস্ত দোষ অযোধ্যা রাজের উপর অর্পণ করেন ও লেখেন, তাঁহার নিজের কর্তৃত্বাধীন প্রদেশে ওই সকল ডাকাইত বাস করে না, উহারা অযোধ্যা রাজার রাজ্যে বাস করে ও সেই স্থান হইতে এই প্রদেশে আসিয়া ডাকাইতি করিয়া চলিয়া যায়, সুতরাং ইংরাজ অধিকারভুক্ত স্থানের পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ তাহার কিছুই করিয়া উঠিতে পারেন না। ওই দেশে ইংরাজ রাজের কর্ম্মচারীর সংখ্যা এত অল্প যে, তাহারা একত্রে দলবদ্ধ এক শত, দেড় শত অস্ত্রধারী ডাকাইতের সম্মুখীন হইতে কোন প্রকারেই পারেন না। তিনি আরও লিখেন যে, মাজিষ্ট্রেট বা স্থানীয় পুলিসের দ্বারা এই সকল ডাকাইতি কোনরূপেই দমন হইবে না। ইহার নিমিত্ত গবর্ণমেন্টের স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত করা আবশ্যক। 

১০ই ডিসেম্বর বার্ড সাহেব গবর্ণমেন্টে আবার রিপোর্ট করেন, যে ৫ই ডিসেম্বরে এই ডাকাইত সম্বন্ধে তিনি গবর্ণমেণ্টকে লিখিয়াছিলেন, সেই ৫ই ডিসেম্বরে ১ জন করপোরেল (Corporal) ৪ জন সিপাহী ও ৪ জন অশ্বারোহী সৈনিক অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া, সরকারের ১২,০০০ বার হাজার মুদ্রা, বদরূ ণা কলেক্টারের নিকট হইতে গোরকপুরে লইয়া যাইতেছিল। সেই দিবস সুর্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে একদল ডাকাই বন্দুক ও বর্শা লইয়া উহাদিগকে রাস্তার মধ্যে আক্রমণ করে, ও প্রধান কর্ম্মচারীকে গুলি দ্বারা হত করিয়া ও তাহার অনুচরবর্গকে সম্পূর্ণরূপে পরাভব পূর্ব্বক ওই দ্বাদশ সহস্ৰ মুদ্রা গ্রহণ করিয়া অবলীলাক্রমে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। কাপ্তেন মার্টিন (Captain Martin) যিনি সেই সময় আপন সৈন্য সামন্তের সহিত সেই প্রদেশ রক্ষা করিতে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি এই সংবাদ পাইবামাত্র, তাঁহার অধীনস্থ সমস্ত পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যের সহিত, স্থানীয় পুলিসের সাহায্যে ওই ডাকাইত দলের অনুসরণ করেন। বার্ড সাহেব যতদূর সম্ভব পুলিস সংগ্রহ করিতে পারেন তাহাদিগকে লইয়া বটুলের ভূতপূর্ব্ব রাজার সহিত ওই ডাকাইত দলের অনুসরণের চেষ্টা করেন। যেখানে যেখানে পথ আছে, যেখানে যেখানে বন প্রবেশের পথ আছে, সেই সকল স্থানে সিপাহী ও পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণকে স্থাপিত করেন; কিন্তু কেহই কিছু করিয়া উঠিতে পারেন নাই, একজন ডাকাইতও ধৃত হয় নাই, বা একটি মাত্র মুদ্রাও পাওয়া যায় নাই। 

এই ডাকাইতি উপলক্ষ করিয়া বার্ড সাহেব গবর্ণমেন্টকে এই ডাকাইতি নিবারণের নিমিত্ত একটি বিশেষরূপ বন্দোবস্ত করিবার উপদেশ প্রদান করেন, ও কিরূপ উপায়ে বা কিরূপ বন্দোবস্ত করিলে এই সকল ডাকাইতি নিবারণ হইতে পারে, তাহাও বলিয়া দেন; কিন্তু গবর্ণমেন্ট সেই সময় তাঁহার প্রস্তাবের পোষকতা করেন নাই, বা বিশেষ কোনরূপ বন্দোবস্তও করেন নাই। 

পূর্ব্বে যে ডাকাইতের কথা উল্লিখিত হইয়াছে, পরে জানিতে পারা যায়, ওই ডাকাইতি অযোধ্যা রাজ্যের অন্তর্গত জঙ্গলবাসী বুধকজাতীয় ডাকাইতের দ্বারা সম্পন্ন হয়। সেই সময় ওই ডাকাইত দলের দুইজন সর্দ্দারের কর্তৃত্বাধীনে ওই ডাকাইতি সম্পন্ন হয়। ওই দলের সর্দারের নাম “গরিবা” ও “লুল্লি”। গরিবা ১৮৪০ খৃষ্টাব্দে ধৃত হইয়া শ্লিমেন (Sleeman) সাহেবকে যাহা বলিয়াছিল, তাহাতেই এই কথা প্রকাশিত হয়। 

গরিবা বলিয়াছিল; “প্রায় আঠার বৎসর অতীত হইল, লুটী জমাদার তাহার একজন বিশ্বাসী লোক দ্বারা আমায় এই সংবাদ পাঠাইয়া দেয় যে, আমি তাহার সহিত একটি অভিযানে যোগ প্রদান করি। এই সংবাদ পাইয়া আমি জগদেও ও টোকাকে সঙ্গে লইয়া তাহার সহিত গমন করি। আমরা সেই স্থানে উপস্থিত হইলে, প্রথম দিবস আহারাদি ও আমোদ-প্রমোদে অতিবাহিত হই। সেইদিবস যে উদ্দেশ্যে আমরা সেই স্থানে গিয়াছিলাম, সে সম্বন্ধে কোন কথাই হয় নাই। পরদিবস তিনি আমাকে বলেন যে, পিপরোল হইতে গোরকপুরে গবর্ণমেন্টের টাকা প্রতি মাসেই প্রেরিত হয়, এইরূপ অবস্থায় একটু চেষ্টা করিলেই ওই টাকার কিয়দংশ আমরা অনায়াসেই উপভোগ করিতে সমর্থ হই। আরও জানিতে পারা গিয়াছে যে, চারিজন অস্ত্রধারী অশ্বারোহী সৈন্য ও ১০/১২ জন অস্ত্রধারী সিপাহীর পাহারায় ওই অর্থ প্রেরিত হয়। ওই টাকা লইয়া যাইবার সময় যদি আমরা আক্রমণ করি, তাহা হইলে ওই অর্থের কিয়দংশ যে আমাদিগের হস্তগত হইতে পারে, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু ওই আক্রমণে আমাদিগের দলস্থিত কোন কোন ব্যক্তিকে যে শমন-সদনে গমন করিতে হইবে ও কেহ কেহ যে ধৃত হইবে, তাহাও নিশ্চিত। কারণ অশ্বারোহী সৈন্যগণের যদি আমরা গতিরোধ করিতে না পারি, তাহা হইলে তাহারা দ্রুতবেগে অশ্ব চালনা করিয়া গোলমাল বাধাইয়া দিতে পারে; সুতরাং উহাদিগের গতিরোধ করিতে হইবে। কিন্তু ওই কার্য্য করিতে আমাদিগের বিশেষ ক্ষতি হইবার সম্ভবনা। 

অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, যে রাস্তা দিয়া ওই অর্থ আনীত হয়, তাহার একস্থান দুর্গম জঙ্গলের মধ্য দিয়া গমন করিয়াছে। ওই স্থানের ওই রাস্তার উত্তর পার্শ্বের জঙ্গল এত ঘন যে, তাহার মধ্য দিয়া কোন ব্যক্তি অশ্বারোহণে গমন করিতে পারে না। 

পরিশেষে আমরা ইহাই সাব্যস্ত করিলাম যে, ওই স্থানেই আমরা ধনবাহীগণকে আক্রমণ করিব। আরও স্থির হইল, অশ্বারোহী সৈন্যগণের গতিরোধ করিবার জন্য সম্মুখে রাস্তার একস্থানে উভয় পার্শ্বের বৃক্ষের সহিত দৃঢ় রজ্জু সকল এরূপ ভাবে বাঁধিতে হইবে যেন, কোন অশ্বারোহী বা শকট-চালক সহজে ওই স্থান দিয়া গমন করিতে না পারে। আরও স্থির হইল যে, যেমন উহারা জঙ্গলের রাস্তায় প্রবেশ করিবে, অমনি তাহাদিগে পশ্চাতে রাস্তার দুই পার্শ্বস্থিত বৃক্ষের সহিত এরূপ ভাবে দৃঢ় রজ্জু সকল বাঁধিয়া ওই রাস্তা বদ্ধ করিতে হইবে যে, অশ্বারোহীগণ হঠাৎ ওই পথে পশ্চাৎপদ হইতে না পারে। কার্য্যের সুবিধার নিমিত্ত ইহাও স্থিরীকৃত হইল যে, রাস্তার যেদিক দিয়া উহারা জঙ্গলময় স্থানে প্রবেশ করিবে, সেই স্থানে রাস্তার এক পার্শ্বের বৃক্ষে রজ্জু সকলের এক প্রান্ত পূর্ব্ব হইতেই বাঁধিয়া রাখিতে হইবে। যেমন উহারা ওই স্থানে উত্তীর্ণ হইয়া যাইবে, অমনি ওই সকল রজ্জুর অপর প্রান্ত রাস্তার অপর পার্শ্বের বৃক্ষের সহিত শীঘ্র বাঁধিয়া ওই রাস্তা অবরোধ পূর্ব্বক উহাদিগকে আক্রমণ করিতে হইবে। 

এই সমস্ত বন্দোবস্ত স্থির করিয়া ওই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার নিমিত্ত আমরা কেবলমাত্র ৪০ জন শিক্ষিত লোক সমভিব্যাহারে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমাদিগের সহিত ১০টি বন্দুক, ১০খানি তরবারি, এবং ২৫খানি বর্শা ছিল। দুই তিন ক্রোশ গমন করিয়া দুইজন লোককে পেপরোলে পাঠাইয়া দিলাম, তাহাদিগের উপর এই আদেশ রহিল যে, সেই স্থান হইতে যেমন টাকা লইয়া সিপাহীগণ বাহির হইবে, অমনি তাহারা সংবাদ প্রদান করিবে। আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে ক্রমাগত চলিয়া যে রাস্তা দিয়া ওই অর্থ লইয়া যাইবে, সেই রাস্তায় আসিয়া উপনীত হইলাম। আমরা সেই স্থানে একদিবস অতিবাহিত করিলাম কিন্তু অর্থবাহীগণের কোন রকম সংবাদ পাইলাম না। পরদিবস আমরা আর একজন লোককে যেদিক হইতে অর্থবাহীগণের আসিবার সম্ভাবনা, সেইদিকে পাঠাইয়া দিলাম। তাহার উপর এই আদেশ রহিল যে, যেমন সে অর্থবাহীদিগকে দেখিতে পাইবে, অমনি সে ফিরিয়া আসিয়া আমাদিগকে সংবাদ প্রদান করিবে। সে কিছুদূর গমন করিয়াই উহাদিগকে আসিতে দেখিল, ও ফিরিয়া আসিয়া আমাদিগকে সেই সংবাদ প্রদান করিল। সন্ধ্যার পর আমরা আমাদিগের পূর্ব্বের বন্দোবস্ত অনুযায়ী ওই রাস্তা রজ্জু দ্বারা বন্ধ করিয়া, রাস্তার দুই পার্শ্বে স্থানে স্থানে, জঙ্গলের ভিতর বসিয়া ওই ধনবাহীগণের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। সমস্ত রাত্রি এইরূপে অতিবাহিত হইয়া গেল। ভোর পাঁচটার সময় একজন “আল্লার” নাম করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল। বুঝিলাম, আমাদিগের শিকার সন্নিকটবর্তী। কিছুক্ষণ পরে আর একজন কহিল “ওই আসিতেছে।” তখন আমরা প্রস্তুত হইলাম। পাঁচজনকে সম্মুখের দিকে পাঠাইয়া দিলাম। উহাদিগের হস্তে বন্দুক ছিল, ওই সকল বন্দুকে গুলি না পুরিয়া, “ছা” পোরা হইল। কারণ আমাদিগের ইচ্ছা ছিল, যতদূর সম্ভব মনুষ্য হত্যা না করিয়া, তাহাদিগকে জখম পূৰ্ব্বক আপনার কার্য্য উদ্ধার করিব। যেমন অশ্বারোহীগণ, পদাতিকগণ, এবং অন্য সকলে আমাদিগের নিকটবর্তী হইল, অমনি তাহাদিগের পশ্চাৎবর্ত্তী রাস্তা পূর্ব্ব বন্দোবস্ত অনুযায়ী রজ্জুর দ্বারা বদ্ধ হইয়া গেল, ও চতুৰ্দ্দিক হইতে আমরা তাহাদের উপর গুলি বর্ষণ আরম্ভ করিলাম। পদাতিকগণ অর্থ সকল সেই স্থানে ফেলিয়া রাস্তার পার্শ্ববর্ত্তী জঙ্গলে প্রবেশ পূর্ব্বক পলায়ন করিল। রাস্তার সম্মুখ ও পশ্চাৎ অবলম্বন করিয়া অশ্বারোহীগণ পলাইবার ইচ্ছায় রজ্জু সকল উন্মোচনের চেষ্টা করিল, কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারিল না। 

উহাদিগের নিকট বার সহস্র মুদ্রা ছিল। ওই সমস্ত অর্থ আমরা গ্রহণ করিয়া দ্রুতগতি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। আমাদিগের প্রস্তুত ফাঁদে যাহারা পতিত হইয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ হত হইয়াছিল কি না জানি না, তবে এই মাত্র বলিতে পারি যে, যে পর্য্যন্ত সমস্ত অর্থ আমাদিগের হস্তগত না হয়, সেই পর্যন্ত আমরা তাহাদিগের উপর বন্দুক ছুড়িতে ত্রুটি করি নাই।” 

গরিবা যাহা বলিয়াছিল, সত্য কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত মাজিষ্ট্রেটকে এক পত্র লেখা হয়। মাজিষ্ট্রেট সাহেব ওই পত্রের উত্তরে ১৮৪০ খৃষ্টাব্দের ১৬ই জুন তারিখে লেখেন যে, বার হাজার পাঁচ শত সরকারী টাকা বিদরনা হইতে গোরোকপুর পাঠান হয়। পাঁচজন অশ্বারোহী সৈন্য ও ২৩ নম্বরের রেজিমেন্টের অবতি সিং নামক একজন করপোরাল ও একদল সৈন্য, ওই টাকার রক্ষকরূপে গমন করে। ১৮২২ খৃষ্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর তারিখে উহারা বরওইচ নামক স্থানে বিশ্রাম করতঃ রাত্রি ১২টার সময় সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। তাহারা ওই রাস্তার জঙ্গলময় স্থানে উপস্থিত হইলে, দুইজন অশ্বারোহী কিছু অগ্রে অগ্রে ও তিনজন তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে থাকে। অবতি সিং ও তাহার সৈন্যগণ ওই অর্থবাহীগণকে বেষ্টন করিয়া যাইতে থাকে। জঙ্গলময় রাস্তার কিছুদূর গমন করিয়াই তাহারা বুঝিতে পারে যে, তাহারা ফাঁদে পড়িয়াছে। তখন চতুর্দিক হইতে তাহাদিগের উপর গুলি বৃষ্টি হয় ও ভীষণ চীৎকারের সহিত একদল ডাকাইত তাহাদিগের উপর পতিত হয়। অবতি সিং হত, দুইজন অশ্বারোহী আহত ও একজন অশ্বারোহীর অশ্ব সেই স্থানে চিরশয্যায় শয়ন করে। ডাকাইতগণ সমস্ত অর্থ লইয়া প্রস্থান করে। থানার কর্মচারিগণ ও সৈন্যের প্রধান কর্তা ওই ডাকাইত দলের অনেক অনুসন্ধান করেন, কিন্তু কোন ফলই ফলে নাই। 

এই সময় ভারতবর্ষের প্রায় সর্ব্বস্থানে এইরূপ ডাকাইতি হইত। ব্রহ্মপুত্র ও নম্বদার মধ্যবর্তী প্রদেশ সকল সটলেজ নদী ও হিমালয় পর্বত শ্রেণীর মধ্যস্থিত স্থান সকল ডাকাইতদিগের অত্যাচার হইতে বহির্ভূত ছিল না। ধনী ও জমীদারগণ উহাদিগের ভয়ে একরাত্রির নিমিত্তও সুখে নিদ্রা যাইতে পারিত না। সরকারী অর্থের উপরই উহাদিগের লোভ অধিক ছিল, একস্থান হইতে অন্য স্থানে সরকারী খাজানা যাইবার সময় উহারা প্রায়ই উহা লুট করিয়া লইত। যাহাতে ওই সকল খাজনা লুট না হয়, তাহার নিমিত্ত সরকার হইতে বিশেষরূপে বন্দোবস্ত হয়। অধিক পরিমিত সৈন্যের পাহারায় ও অশ্বারোহী পুলিসের সাহায্যে পরিশেষে খাজানা সকল প্রেরিত হইতে থাকে, কিন্তু তাহার মধ্য হইতেও অনেকবার ওই সকল খাজানা লুণ্ঠিত হয়, তাহাদিগের মধ্যে কেহই ধৃত হয় না, বা ওই অর্থ লইয়া তাহারা যে কোথায় চলিয়া যায়, তাহারও কিছুমাত্র ঠিকানা হয় না। 

১৮২২ খৃষ্টাব্দে লেফটেনেন্ট কর্ণেল ডব্লিউ, এইচ, শ্লিমান সাহেব যখন নর্ম্মদা বিভাগের নরসিংহপুর জেলার কর্তা ছিলেন, সেই সময় একটি শোচনীয় ডাকাতি সংঘটিত হয়। একদিবস সন্ধ্যার সময় কেবল মাত্র ৩০ জন লোককে এক একগাছি ছড়ি হস্তে সৈন্যদিগের ছাউনির নিকটে দেখিতে পাওয়া যায়। সিপাহীগণ উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করে, উহারা কাহারা? উত্তরে তাহারা এইমাত্র বলে যে, তাহারা গরুর সওদাগর, তাহাদিগের গরু সকল পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছে। এই বলিয়া তাহারা অগ্রবর্ত্তী হয়। অতি অল্পদূর মাত্র গমন করিয়াই কয়েকজন ধনশালী মহাজনের বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া উপনীত হয়। দেখিতে দেখিতে তাহারা কতকগুলি মশাল জ্বালিয়া ফেলে, এবং যে সকল ব্যক্তি তাহাদিগের কার্য্যের ব্যাঘাত জন্মাইতে বা গোলযোগ করিতে চেষ্টা করিতেছিল, তাহাদিগকেই অস্ত্রাঘাত করিতে আরম্ভ করে। দেখিতে দেখিতে মহাজনদিগের বাড়ী উহারা লুণ্ঠন করিতে আরম্ভ করিল, ও দশ মিনিটের মধ্যে উহারা কার্য্য উদ্ধার করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। তাহারা প্রস্থান করিলে দেখিতে পাওয়া গেল যে, ১২ জন স্থানীয় লোক হত ও আহত হইয়া সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। যেস্থানে ডাকাইতি হইল, ওই স্থান হইতে একদিকে বিংশতি হস্ত ব্যবধানে অনেকগুলি পুলিসও অপর দিকে প্রায় শত হস্ত ব্যবধানে অধিক সংখ্যক সিপাহীর ছাউনি ছিল। উভয় দলই ডাকাইতদিগকে ডাকাইতি করিতে দেখিল, কিন্তু কেহই অগ্রবর্ত্তী হইল না। ডাকাইতগণ ডাকাইতি করিয়া প্রস্থান করিবার পর, তাহারা উহাদিগের অনুসন্ধানে বাহির হইয়াছিল, কিন্তু ধৃত করিতে পারে নাই বা তাহারা যে কোন দিকে প্রস্থান করিল, তাহারও কোন সন্ধান করিতে পারে নাই। এই ঘটনার ২০ বৎসর পর যখন কোন কোন সর্দ্দার ধৃত হয়, সেই সময় তাহাদিগের প্রমুখাৎ অবগত হইতে পারা যায়, এই ডাকাইতি কাহাদিগের দ্বারা সংঘটিত হইয়াছিল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

১৮১৮ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রায় ৮০ জন ডাকাইত দলবদ্ধ হইয়া অযোধ্যার পূর্ব্ববর্ত্তী বলরামপুর পরগণার জঙ্গল হইতে বহির্গত হয়। ওই দলের সঙ্গে তাহাদিগের দুইজন প্রধান নায়ক ছিল, একজনের নাম নেকা। ইনি বিখ্যাত সর্দ্দার কনন্দরের পুত্র। অপর নায়কের নাম মেদিয়া। বরোচের নিকটবর্ত্তী আসিয়া তাহারা জানিতে পারে যে, ওই স্থান হইতে দুইখানি শকট বোঝাই করিয়া ছাব্বিশ সহস্র রৌপ্য মুদ্রা ও চারি শত সুবর্ণ মোহর সরযূ নদী পার করিয়া লক্ষ্ণৌ অভিমুখে ৩০ জন সৈনিক পুরুষের পাহারায় প্রেরণ করা হইতেছে। ওই সমস্ত অর্থ সরকার বাহাদুরের। 

এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া সরযূ নদীর যে ঘাটে ওই সকল অর্থ পার হইয়াছিল, সেই ঘাটে উহারাও পার হইয়া ওই শকটদ্বয়ের অনুসরণ করিল ও পরিশেষে উহারা জানিতে পারিল যে, ধন বোঝাই শকট ওই স্থান হইতে প্রায় ২৫ ক্রোশ পথ অগ্রবর্ত্তী হইয়া পড়িয়াছে; ও রাজা সুরত সিংহের রামনগর ঘুমরির বিখ্যাত গড়ে উপস্থিত হইয়া সেই গড়ের ফটকের সম্মুখে বিশ্রাম করিতেছে। 

নেকা তাহার পিতার ন্যায় সাহসী ও কৌশলী দলপতি; সে ওই গড়ের ফটকের অবস্থা উত্তমরূপে অবগত ছিল, আরও জানিত যে, ওই গড়ের ফটকের বাহিরে দুইটি কামান রক্ষিত আছে। ওই কামানের সাহসে সৈনিক পুরুষগণ সেই স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। সংবাদ পাইবামাত্র দলপতিদ্বয় আপন দলবল সহ দ্রুতপদে সেই দিকে চলিতে লাগিল। যাইবার সময় পথিমধ্যস্থ কোন লৌহকারের নিকট হইতে ওই গড়ের দরজার মাপ অনুযায়ী একটি শিকল ও দুইটি বৃহৎ পেরেক সংগ্রহ করিয়া লইল। ক্রমে তাহারা সেই স্থানে উপনীত হইয়া কেল্লার উত্তর পশ্চিম অংশে কিছুদূরে আপনাপন পরিধেয় বসন ও অস্ত্রাদিতে সুসজ্জিত হইয়া কেল্লার সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। উহাদিগের মধ্যে ২০ জন লোক ওই শিকল সেই কেল্লার ফটকের বাহিরে পেরেকের দ্বারা এরূপে বদ্ধ করিয়া দিল যে, ওই কেল্লা হইতে ফটক খুলিয়া কোন সৈন্য হঠাৎ বহির্গত হইতে না পারে। এইরূপে ফটক বন্ধ করিয়া তাহারা সশস্ত্রে ওই ফটকের পাহারায় নিযুক্ত রহিল। ফটকের বাহিরে যে দুইটি কামান রক্ষিত ছিল, তাহা ওই ধনরক্ষার নিমিত্ত পূর্ব্ব হইতে তোপ ভরিয়া রাখা হইয়াছিল। ২০ জন সশস্ত্র দস্যু ওই কামানদ্বয় অধিকার করিয়া বসিল। তাহাদিগের কার্য্য-কেহ আসিয়া ওই কামান চালাইতে না পারে। অবশিষ্ট সেই ৪০ জন সেই ধন-রক্ষক ৩০ জন সৈনিক-পুরুষকে সবেগে আক্রমণ করিয়া তাহাদিগকে পরাস্ত করিয়া ওই সমস্ত অর্থ হস্তগত পূৰ্ব্বক দ্রুতবেগে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। ইহাতে চারিজন সৈনিক-পুরুষ হত ও আহত হয়। উহাদিগেরও দুইজন মাত্র আঘাতিত হইয়াছিল। তাহারা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া পুনরায় সরযূ নদী পার হয়, ওই নদীর অপর পার্শ্বে একটি স্থানে বিশ্রাম করিতে আরম্ভ করে। কিন্তু রাত্রিযোগে সেই প্রদেশীয় দুইজন দোৰ্দ্দণ্ডশালী জমীদার ভাবনী বক্স ও ইন্দ্রজিৎ একত্রিত হইয়া প্রবল বাহিনীর সহিত উহাদিগকে আক্রমণ করে। ওই আক্রমণে সর্দ্দারদ্বয় তাহাদিগের দলের সহিত পরাভূত হয়, ও সমস্ত অর্থ ওই জমীদারদ্বয়ের হস্তগত হয়। ডাকাইতের দল নিতান্ত ক্ষুণ্নমনে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। 

ওই সময়ে ওই জেলার শাসনকর্তা ছিলেন মেহুদি আলি খাঁ। তিনিই ওই অর্থ লক্ষ্ণৌয়ে প্রেরণ করিয়াছিলেন। উপরি কথিত সংবাদ পাইয়া তিনি উভয় জমীদারকে ধৃত করেন, ও একদল সিপাহী ওই ডাকাইত দলের অনুসরণ করিতে পাঠাইয়া দেন। উহারা জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিয়া অনেক কষ্টে প্রায় ৬০ জনকে ধৃত করিতে সমর্থ হয় ও প্রধান সর্দ্দার নেকাও সেই সঙ্গে ধৃত হয়। জমীদারদ্বয়, সর্দ্দার নেকা ও তাহার ৬০ জন অনুচর ছয় বৎসর করিয়া কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। উহারা সকলেই সীতাপুরের জেলে আবদ্ধ থাকে। 

জমীদার দুইজনকে অব্যাহতি দিবার নিমিত্ত সরকারের বিশেষ আগ্রহ জানিতে পারিয়া, সেই প্রদেশের শাসনকর্তা কিছু দিবস পরে উহাদিগকে অব্যাহতি প্রদান করেন। উহাদিগকে বিনা স্বার্থে যে একবারে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাহা নহে। যে ২৬০০০ হাজার মুদ্রা ও ৪০০ শত সুবর্ণ তাহারা ডাকাইতদিগের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা, ও তদ্ব্যতীত আরও ২০০০০ সহস্র মুদ্রা তাহাদিগকে প্রদান করিতে হয়। দলপতি নেকাও এ সুযোগ পরিত্যাগ করেন নাই, সেও তাহার বন্ধু বান্ধবদিগের নিকট হইতে দশ সহস্র মুদ্রা সংগ্রহ পূর্ব্বক সরকারকে অর্পণ করিয়া অনুচরবর্গের সহিত আপনিও বাহির হইয়া আসেন। 

১৮১৯ খৃষ্টাব্দের ১৮ই মে তারিখে অপর দুই দল একত্রিত হইয়া একটি ডাকাইতি হয়। অযোধ্যাখণ্ডের পশ্চিম পার্শ্বের একদল। এ দলের অধিপতি দেয়া জগদীশপুরের তারা, অপর দল পূর্ব্বদিকের। উহার দলপতি গোরা বলরামপুরের রতিরামের পুত্র বক্সি। এই দুই দল একত্রিত হইয়া সেই সময়ে ভারতবর্ষের মধ্যবর্তী একজন প্রধান ধনী লক্ষ্ণৌ সহরের বিহারীলাল সাহার বাড়ীতে ডাকাইতি করে। 

ডাকাইতি করিবার সময় উভয় দলপতি একত্রিত হইয়া কিরূপ অংশে অপহৃত দ্রব্য সকল বিভাগিত হইবে, তাহা স্থিরীকৃত হয়, ও যে সকল নিয়ম বিধিবদ্ধ হয়, সেইমত কার্য্য করিবার নিমিত্ত পরস্পর প্রতিজ্ঞাসূত্রে আবদ্ধ হয়। এই ডাকাইতিতে কেহই হত, আহত বা ধৃত হয় নাই, কিন্তু ৪২০০০ সহস্র মুদ্রা অনায়াসে হস্তগত করিয়া তাহারা প্রস্থান করে। বনগড় জেলার অন্তর্গত খয়রাবাদ নামক স্থানের জঙ্গলে উপস্থিত হইয়া তাহাদিগের পূর্ব্ব প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়, ও ওই অর্থের অংশ লইয়া উভয় দলপতির মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয়। 

উভয় সর্দ্দারের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হইবার কারণ এই যে, যে সময়ে তাহাদিগের মধ্যে উপরি কথিত কর্ম্মের বন্দোবস্ত হইতেছিল, সেই সময় বক্সির ধর্ম্মভাই ভূষণ তারার ভগ্নীকে বাহির করিয়া লইয়া যায়। পূৰ্ব্ববর্ণিত ধন সকল বণ্টনকালে তারা এই কথা জানিতে পারে, সেই সময় উভয়ের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয়, ও সেই বিবাদের ফল পরিশেষে এই হয় যে, বক্সি তাহাকে তাহার ন্যায্য অংশ প্রদানে অসম্মত হয়। 

বক্সির ধর্ম্মভাই—ভূষণের কার্য্যে তারা একে বিশেষরূপে অবমানিত হয়, তাহার উপর অঙ্গীকার সত্ত্বেও আপনাদের ন্যায্য অংশ প্রাপ্ত না হইয়া সে একেবারে ক্রোধে প্রজ্বলিত হয়। এই অবমানের প্রতিশোধ লইবার মানসে সে একেবারে লক্ষ্ণৌ গমন করিয়া আগা মিরকে এই সমস্ত কথা বলিয়া দেয়। তিনি ওই জেলার শাসনকর্তা মেহুদি আলি খাঁর নিকট এই সংবাদ প্রেরণ করেন। তিনি উহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত কালবিলম্ব না করিয়া অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের একটি প্রবল বাহিনী প্রেরণ করেন। যখন ওই প্রবল বাহিনী গিয়া উহাদিগের বাসস্থানে উপস্থিত হয়, তখন পৰ্য্যন্ত উহাদিগের মধ্যে তারার ভগ্নীকে বাহির করা ও অপহৃত অর্থের বণ্টন লইয়া গোলযোগ চলিতেছিল। ওই প্রবল বাহিনী হঠাৎ উপস্থিত হইয়া স্ত্রী পুত্রের সহিত মোট দুই শত লোককে ধৃত করে। তাহাদিগের মধ্যে বক্সির পিতা রতিরাম, বৃদ্ধ মাতা ও পাঁচটি ভ্রাতাও ধৃত হয়। বক্সি ও তাহার ষষ্ঠ ভ্রাতা ও অপরাপর ব্যক্তি ধৃত হয় নাই। যাহারা ধৃত হইয়াছিল, তাহাদিগের সকলকেই লক্ষ্ণৌতে লইয়া যাওয়া হয়। কাপ্তেন পেটন ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে বৃদ্ধ রতিরাম ও তাহার স্ত্রীকে ছাড়িয়া দেন। সেই সময় রতিরামের বয়ঃক্রম এক শত বৎসর। এই এক শত বৎসর বয়ঃক্রমকালে তাহার স্মরণশক্তি এত প্রবল ছিল যে, ৬০/৭০ বৎসর পূর্ব্বে তিনি যে সকল কার্য্য করিয়াছিলেন তাহার কিছুমাত্রও তখন পৰ্য্যন্ত বিস্মৃত হন নাই! 

এই দলের যে সকল ব্যক্তি জেলে আবদ্ধ ছিল, তাহাদিগের মধ্যে ২০ জন ১৮৩৪ খৃষ্টাব্দে জেলের কর্তৃপক্ষীয়দিগকে আক্রমণ করে ও তিন জনকে হত ও দুইজনকে সাংঘাতিক রকমে আহত করিয়া ওই জেল ভাঙ্গিয়া প্রস্থান করে। অবশিষ্ট যাহারা জেলের ভিতর আবদ্ধ ছিল, ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে রতিরামের সহিত তাহাদিগকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

১৮১৮ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে মেহেরবান, তাহার ভাই ছেটী ও তাহার পিতৃব্য পাসি ৫০ জন অনুচরের সহিত অযোধ্যার অন্তর্গত সমস্ত বন্দোবস্ত শেষ হইলে, দশটি ছাগ মারিয়া উহাদিগের আহারাদির বন্দোবস্ত করা হয়। সদারগণ ও দলের অপরাপর ব্যক্তিগণ ওই ছাগ-রক্তে আপন আপন হস্ত রঞ্জিত করিয়া প্রতিজ্ঞা করে যে, কেহ কোনরূপে বিশ্বাসঘাতকতার কার্য্য করিবে না, ও আপনাপন ক্ষমতা অনুযায়ী তাহাদিগের কত্তব কার্য্য সম্পন্ন করিবে। এইরূপ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়া সকলে একত্র মদ্য পান ও মাংস ভোজন করিয়া, পরদিবস পর্য্যন্ত সেই স্থানে অবস্থিতি করে। পরিশেষে মেহেরবান আর ৪০ জনের সহিত নিকটবর্ত্তী একটি স্থানে আপনাদিগের সঙ্কল্পিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া, কালীর উপাসনায় প্রবৃত্ত হয়। উপাসনা শেষ হইলে তাঁহার নিকট সকলে যোড়হস্তে এইরূপ প্রার্থনা করে যে, ‘মা কালি! যদি আপনার অভিরুচি হয়, তাহা হইলে যাহাতে আমাদিগের কার্য্য উদ্ধার হয়, তাহা করুন। যে সকল অন্ধ, খঞ্জ, বিধবা ও অনাথ বালক বালিকা, আপনার প্রদত্ত অর্থের দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া থাকে, তাহাদিগকে মঙ্গলার্থে আমাদিগের কার্য্য সুসিদ্ধ করুন, কারণ তুমিই তাহাদিগের অন্নদাত্রী, আমরা উপলক্ষ মাত্র। এই কথা যদি আপনার অভিরুচি হয়, তাহা হইলে শৃগালীর ডাক শুনিতে পাইলেই আমরা বুঝিতে পারিব যে, এই কার্য্যে আপনার সম্পূর্ণ অভিমত আছে।” 

এইরূপ প্রার্থনা করিবার পর সকলে জানু পাতিয়া স্থির ভাবে শৃগালীর ডাকের অপেক্ষায় নীরবে সেই স্থানে বসিয়া রহিল। কিয়ৎক্ষণ পরে বামপার্শ্ব হইতে তিনবার শৃগালীর ডাক শুনা গেল। তখন সকলে বুঝিতে পারিল যে, মহামায়া তাহাদিগের উপর সদয় হইয়াছেন, সুতরাং তাহারা আপন কার্য্যে গমন করিতে প্রস্তুত হইল। 

মেহেরবানের সাতটি স্ত্রী, প্রথমা স্ত্রীর নাম মণিয়া। সে কখন দলের সহিত এই সকল কার্য্যে গমন করিত না। তাহার দ্বিতীয় স্ত্রী সুজুনিয়া। সে মেহেরবানের সহিত সকল কার্য্যেই গমন করিত। মহামায়ার আদেশে সকলেই অতিশয় পুলকিত হইয়াছিল। মেহেরবান ৫ জনকে একখানি উৎকৃষ্ট পালকি খরিদ করিয়া আনিবার নিমিত্ত প্রেরণ করিল। কারণ তাহার স্ত্রী সুজুনিয়াকে এরূপ ভাবে লইয়া যাইতে হইবে যে, সকলেই যাহাতে জানিতে পায় যে, কোন বড় লোকের স্ত্রী গমন করিতেছে। লোক ভুলাইবার ইহা তাহাদিগের একটি উপায়। 

উহারা সকলে ওই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া বারাণসীধামে আসিয়া উপস্থিত হয়। তাহারা ভিন্ন ভিন্ন তিন স্থানে অবস্থিত করিয়া ওই সহরের নানাস্থানে ভ্রমণ ও নানা দেবতার পূজা দিয়া সরকারী বা বড় বড় মহাজনের টাকা কোন স্থানে প্রেরিত হইবে তাহারই অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে থাকে। পরিশেষে তাহারা জানিতে পারে যে, একখানি গড়ি করিয়া সরকারী খাজনা সিপাহীদিগের পাহারায় পশ্চিমে প্রেরিত হইতেছে। এই সংবাদ জানিতে পারিয়া ৪ জনকে গোয়েন্দা স্বরূপ উহাদিগের সঙ্গে প্রেরণ করা হয়। অবশিষ্ট দলবল অল্প অল্প করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে থাকে। 

এলাহাবাদ জেলার অন্তর্গত “যোশী” নামক স্থানে উপনীত হইয়া খাজনাবাহীগণ একটি সরাইয়ের আশ্রয় গ্রহণ করে। মেহেরবানের দলবল যাহারা পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছিল, তাহারা চারি মাইল ব্যবধানে একটি জঙ্গলের মধ্যে লুক্কায়িত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর তারিখের রাত্রে তাহাদিগের অব্যবহার্য্য দ্রব্য সকল এবং পালকি সেই জঙ্গলের ভিতর রাখিয়া উহারা সেই সরাই অভিমুখে যাত্রা করে। রাত্রি ১২টার সময় তাহারা সেই স্থানে উপস্থিত হয়। সরাইয়ের দরজা খোলা ছিল। উহাদিগের মধ্যে কয়েকজন সেই দরজা রক্ষার ভার লইল, কয়েক জন পুলিস প্রহরীদিগের উপর নজর রাখিল, অবশিষ্ট সকলে ওই ধনরক্ষকগণকে আক্রমণ করিল। তাহাদিগের সহিত যে ২০ সহস্র স্পেনদেশীয় ডলার ছিল, তাহা অধিকার করিল। ওই রাত্রে কায়েম খাঁ নামক একজন সাহসী বলিষ্ঠ মহাজন সেই সরাইয়ে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই অবস্থা দেখিয়া তিনি তরবারি হস্তে ওই দলের সম্মুখীন হইলেন ও বিশেষ পারদর্শিতার সহিত অসি চালনা করিয়া উহাদিগকে একরূপ পশ্চাৎপদ করিলেন। উহারাও ওই অপহৃত অর্থ সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া তাহার সম্মুখীন হইল। কিন্তু বলবান কায়েম খাঁ তরবারি আঘাতে দুইজন আহত ও সাত আটটি সড়কি কর্তন করিয়া সেই স্থানে পাতিত করিলেন, কিন্তু অপর কেহই তাঁহাকে সাহায্য করিতে সাহসী হইল না। এই সাবকাশে মেহেরবানের একজন পারিষদ লুক্কায়িত ভাবে কায়েম খাঁর পশ্চাৎ ভাগে গমন করিয়া তাহাকে এমন এক আঘাত করিল যে, তাহাতেই তিনি আহত হইয়া পরলোকগমন করিলেন। অন্যান্য আরও কয়েকজন আহত হইল। আক্রমণকারীগণ ২০ তোড়া ডলার লইয়া প্রস্থান করিল। অবশিষ্ট ৫৭৮৭ ডলারের তোড়া সেই স্থানে পড়িয়া রহিল। পরদিবস মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট ওই সকল অর্থ প্রেরিত হয়, তিনি উহা বেণারসে পুনঃ প্রেরণ করেন। কায়েম খাঁর বীরত্বে সকলেই মোহিত হইয়াছিলেন, ও তাঁহার মৃত্যুতে সকলেই দুঃখিত হইয়াছিলেন। দস্যুগণ ওই সকল অস্ত্র লইয়া ও আহত দ্বয়কে স্কন্ধে উঠাইয়া লইয়া যতদূর সম্ভব দ্রুতপদে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। পরিশেষে উহাদিগকে পালকি করিয়া লইয়া যাওয়া হয়। ক্রমে উহারা অযোধ্যার জঙ্গলের মধ্যে মেহেরবানের দুর্গের ভিতর গিয়া উপনীত হয়। সেই স্থানে ওই সকল অর্থ পূর্ব্বের নিয়মানুযায়ী বিভাগিত হয়। কেবল যে দুইজন আহত হইয়াছিল তাহারা এক শত টাকা করিয়া তাহাদিগের অংশ অপেক্ষা অধিক প্রাপ্ত হয়। 

১৮১৯ খৃষ্টাব্দের ২৬শে মে তারিখে মেহেরবানের ভ্রাতা ছেদী আর একটি দলের অধিপতি হইয়া আর একটি কার্য্য সম্পন্ন করেন। বেণারসের গঙ্গাপ্রসাদ ও হরজীবনদাস নামক দুইজন বণিক একখানি শকট বোঝাই করিয়া কিছু অর্থ বেণারস হইতে পশ্চিমে প্রেরণ করেন। শকট যখন মৃজাপুর জেলার অন্তর্গত গোপীগঞ্জ নামক স্থানে আসিয়া উপস্থিত হয়, সেই সময় ছেদী ওই ধনবাহী শকট আক্রমণ করে ও নয় সহস্র মুদ্রা আত্মসাৎ করিতে সমর্থ হয়। এই আক্রমণে ওই ধনরক্ষাকারীদিগের মধ্যে পাঁচজন হত ও চারিজন আহত হয়। মেহেরবান সেই সময় তাহার নিজের বাড়ীতে ছিল। মেহেরবানের দলভুক্ত সকলে, তাহার ভাই ছেদীর এই কার্য্যে মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হয়। কারণ ওই কার্য্য তাহারা কেহই অংশীদার হইতে পারে না। মেহেরবানের বন্ধু গরিবা আর একটি দলের অধিপতি হইয়া ওই জঙ্গলের অপর স্থানে বাস করিত, সে পরে মেহেরবান সম্বন্ধে ওই সময়ের ঘটনা যাহা বলিয়াছিল, তাহা এইরূপ—”মেহেরবান একজন বিশেষ প্রশংসনীয় ব্যক্তি ও একজন অদ্বিতীয় সর্দ্দার কিন্তু তাহার কার্য্যের বারবার কৃতকাৰ্য্যতা হেতু তাহাকে পরিশেষে একটু অলস হইতে হইয়াছিল। তিনি যখন আপন বাড়ীতে বসিয়া কেবল আমোদ-আহ্লাদে নিরত থাকিতেন ও কেবলমাত্র ক্রীড়াদি করিয়া দিন অতিবাহিত করিতেন, সেই সময় তাহার বহুসংখ্যক স্ত্রী ও তাহার অনুচরগণ অসন্তুষ্ট হইত, কারণ সেইসময় একে তাহাদিগের অর্থের বিশেষরূপ অনটন হইত, তাহার উপর তাহাদিগের স্বাভাবিক উৎসাহ ক্রমে অনুৎসাহে পরিণত হইত। একদিবস মেহেরবান যখন তাহার দুইটি স্ত্রী মুনিয়া ও সুজানিয়াকে লইয়া আমোদ প্রমোদে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় তাহারা তাহাকে কহে যে, তুমি এত দীর্ঘকাল আপন কাৰ্য্য ভুলিয়া কেবল বসিয়া বসিয়া আমোদ প্রমোদ করিতেছ, কিন্তু তোমার ভাই তাহার অনুচরবর্গকে ও পরিবারদিগকে নানারূপ অর্থ দান করিতেছে। সুজানিয়া তাহাকে আরও বলিয়াছিল, “গত দশ মাস পর্য্যন্ত তুমি তোমার গৌরবের উপযুক্ত সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া কেবল আমোদে রত আছ। ইহাতে যে তুমি সুখী হইতেছ তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহাতে আমার কি সম্মান বা অর্থ প্রাপ্ত হইতেছে? আর তোমার অনুচরবর্গ, যাহারা জন্মগ্রহণ করিয়া তোমার অধীনতা স্বীকার করিয়াছে, তাহারা তাহাদিগের পরিজনের অন্ন বস্ত্রের চিন্তায় ক্রমে ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িতেছে ও তাহাদিগের অকুতো সাহস ও অসাধারণ লীলা ক্রমে অন্তর্হিত হইতেছে। তোমার অনুচরবর্গের নিকট ইহাও শুনিতে পাওয়া যাইতেছে যে, কলিকাতা হইতে এক নৌকা সোণার ডলার আসিতেছে, যদি তুমি নিজে গমন করিয়া উহা আত্মসাৎ করিতে ইচ্ছা না কর, তাহা হইলে তোমার নিকট আমাদিগের এই প্রার্থনা যে, তোমার শানিত তরবারি আমাদিগকে প্রদান কর, আমরা একবার চেষ্টা করিয়া দেখি যে, তোমার অনুচরবর্গের দুঃখ আমরা কোনরূপে দূর করিতে পারি কি না?” তাহার স্ত্রীর এইরূপ ভর্ৎসনায় তিনি আরও মর্ম্মাহত হইলেন, কিন্তু কোনরূপ উত্তর না করিয়া পুনরায় তিনি তাহার অনুচরবর্গকে সমবেত করিলেন ও তাহার প্রধানা স্ত্রী মুনিয়াকে গৃহে রাখিয়া মেহেরবান পুনরায় বাহির হইলেন। সুজানিয়া তাহার সঙ্গে রহিল। তিনি কোন প্রধান রাজার ন্যায় সাজ-সজ্জা ও অনুচরণগণ লইয়া তীর্থ পর্যটন করিবার ভাণে গমন করিতে লাগিলেন। চারি মাস পরে তাহারা প্রায় চল্লিশ সহস্র সোণার ডলার লইয়া প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন। কতকগুলি লোককে মেহেরবান প্রায়ই নিযুক্ত করিয়া রাখিতেন, তাহাদিগের প্রধান কার্য্য এই ছিল যে, বর্ষাকালে তাহারা নগরের প্রধান প্রধান বাণিজ্য স্থানে কেবল ঘুরিয়া বেড়াইত। কোন স্থান হইতে কত টাকা, কিরূপ উপায়ে কোথায় প্রেরিত হইতেছে, কিরূপ ও কি পরিমিত প্রহরী ওই সকল ধন লইয়া গমন করিতেছে, কোন পথ অবলম্বন করিয়া উহারা গমন করিবে, এই সকল সংবাদ সংগ্রহ করিয়া যত শীঘ্র সম্ভব মেহেরবানের নিকট প্রেরণ করিত। বর্ত্তমান ঘটনার বিষয়, তাহার ওইরূপ প্রেরিত কোন ব্যক্তি কলিকাতা হইতে প্রত্যাগমন করিয়া মেহেরবানকে সংবাদ প্রেরণ করিল যে, কলিকাতা হইতে নৌকাযোগে অনেক পরিমিত স্পেনদেশীয় ডলার বেণারসে শীঘ্র প্রেরিত হইবে। এই সংবাদ পাইয়া ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রায় দুই শত অনুচর সমভিব্যাহারে মেহেরবান তাহার বাসস্থান পরিত্যাগ করিলেন। তাহার সহিত কতকগুলি স্ত্রীলোকও ছিল। তিনি একজন হিন্দু রাজপুত্র, অনুচরগণের সহিত তীর্থযাত্রায় গমন করিতেছিল, সর্ব্বসাধারণকে এই পরিচয় দিয়া তিনি গমন করিতে লাগিলেন। বেণারস হইতে বহির্গত হইয়া, সাসেরাম, হাজারিবাগ এবং বাঁকুড়া অতিক্রম করিয়া শ্রীরামপুরের সন্নিকটে বৈদ্যবাটী নামক স্থানে আসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। সেই স্থান হইতে কালী, টোরী ও অনান্য কয়েকজন অনুচরকে সংবাদ সংগ্রহের নিমিত্ত কলিকাতায় প্রেরণ করিলেন। তাহাদিগের উপর এই আদেশ রহিল যে, তাহারা কলিকাতায় গিয়া ব্রজবাসী দরোয়ানদিগের নিকট সংবাদ সংগ্রহ করিবে যে, কি লাগাইত নৌকাযোগে সোনার মুদ্রা প্রেরিত হইবে। ব্রজবাসীগণ প্রায়ই মথুরাবাসী এবং কলিকাতার লোকগণ প্রায় উহাদিগকে দরোয়ানি কার্যে নিযুক্ত করেন, ও প্রায়ই উহাদিগের পাহারায় ধনাদি অপর স্থানে প্রেরিত হয়। এই সকল ব্রজবাসী দরোয়ানদিগের মধ্যে অনেকেই দস্যুদলের অধিপতির সহিত সদ্ভাব রাখিত, এবং সময় সময় তাহাদিগকে বিশেষরূপে সাহায্য করিত। বলা বাহুল্য যে, অপহৃত অর্থের অংশ লইতেও তাহারা পরাঙ্মুখ হইত না। 

মেহেরবানের প্রেরিত লোক সকল শীঘ্রই কলিকাতা হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া সংবাদ দিল যে, ধন বোঝাই নৌকা কলিকাতা হইতে রওনা হইয়া গিয়াছে ও এতক্ষণ পর্য্যন্ত শ্রীরামপুর ছাড়াইয়া চলিয়া গিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া মেহেরবান সেই স্থান হইতে গঙ্গার নিকটবর্ত্তী রাস্তা দিয়া সদলবলে প্রত্যাবর্তন করিলেন। কালনা ও মুর্শিদাবাদ অতিবাহিত করিয়া ক্রমে মুঙ্গেরে গিয়া উপনীত হইলেন। সেই স্থান হইতে সোজা রাস্তা দিয়া ওই নৌকা ধরিবার মানসে ১৮২০ খৃষ্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি তারিখে মুকরে নামক স্থনে গিয়া উপনীত হইলেন ও নিকটবর্ত্তী একটি আম্র কাননের মধ্যে দিবাভাগে বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। রাত্রিকালে দ্রব্যাদি সকল ও স্ত্রীলোকদিগকে সেই স্থানে রাখিয়া অনুচরবর্গের সহিত গমন করিয়া ওই নৌকা আক্রমণ করিলেন। ওই আক্রমণে একজন সিপাহী হত ও দশজনকে আহত করিয়া মেহেরবান ২৫০০০ পঁচিশ হাজার স্পেনীয় ডলার ও ২৬০০ দুই সহস্র ছয় শত সরকারী মুদ্রা আত্মসাৎ করেন। যাহারা ওই সকল অর্থ বহন করিয়া লইয়া চলিল, তাহারা সেই স্থান হইতে সোজা দরিয়াবাদের রাস্তা ধরিল। মেহেরবান ও অপরাপর অনুচরবর্গ সেই আম্রকাননে প্রত্যাবর্তন করিলেন। সেই স্থানে ২৭শে ফেব্রুয়ারির রাত্রি অতিবাহিত করিয়া দ্রব্যাদি ও স্ত্রীলোকগণকে লইয়া ২৮ শে তারিখের প্রত্যূষে দ্বীপনগর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। সেই স্থানে উপনীত হইয়া দুই দিবস কাল সেই স্থানে অবস্থিতি করিয়া সেই স্থানেই রাজার ন্যায় হোলী পূজা সমাপন করিলেন। সেই স্থান হইতে তাহারা গয়ার নিকটবর্ত্তী রামপুর নামক স্থানে উপস্থিত হইলেন ও সেই স্থানে দুই তিন দিবস অতিবাহিত করিলেন। এইস্থানে বাহকদিগকে বিদায় দিয়া, রাণী ও অপরাপর স্ত্রীলোকদিগকে বহন করিয়া সাসারামে পৌঁছাইয়া দিবার নিমিত্ত অপর বাহকগণকে নিযুক্ত করিলেন। সাসারামে উপনীত হইয়া, রামপুরের বেহারাদিগকে বিদায় দিয়া সেই স্থান হইতে আজিমগড়ে পৌঁছাইয়া দিবার নিমিত্ত অপর বেহারা লইলেন। সাসারাম হইতে প্রায় ৩ মাইল দুরে শিউসাগর নামক স্থনে একজন মালিকে কিছু অধিক পরিমিত অর্থ প্রদান করিয়া তাহাকে কহিলেন, এই পুষ্করিণীর ধারে এমন বৃক্ষ নাই, যাহার ছায়ায় উপবেশন করিয়া সৈনিকগণ ক্লান্তি দূর করিতে পারে। সুতরাং ইহার চারিধারে আম্রবৃক্ষ রোপণ করা আবশ্যক। ওই অর্থ দ্বারা মালি, অযোধ্যার অন্তর্গত গৌর নামক স্থানের রাজা মেহেরবান সিংহের নামে ওই বৃক্ষ সকল রোপণ করিবে। পুনরায় তাহার আগমনকালে, মালির কার্য্য দেখিয়া যদি সন্তুষ্ট হন, তাহা হইলে তাহাকে আরও অধিক অর্থ প্রদান করিবেন। আজিমগড়ে তিনি তাহার সাসারামের বেহারাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া সেই স্থান হইতে আর একদল বেহারা গ্রহণ করিলেন, তাহারা উহাদিগকে আপন স্থানে পৌঁছাইয়া দিল। সেই স্থানে ওই সকল অর্থ বিভাগিত হইল। আমোদ আহ্লাদ ও নৃত্য গীত করিয়া তাহারা গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল অতিবাহিত করিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

পূর্ব্ববর্ণিত ডাকাইতির সংবাদ গবর্ণমেন্টের নিকট পৌঁছিবার পরই গবর্ণমেন্ট হইতে মুঙ্গেরের মাজিষ্ট্রেট মেকফারলেন (Mr. Macfarlan) সাহেবের উপর এই আদেশ হইল যে, তিনি মুরে গমন করিয়া তাঁহার সাধ্যমত ওই ডাকাইত দলকে ধৃত করিবার বিশেষ চেষ্টা করেন। আদেশ পাইবার পর তিনি ওই স্থানে উপস্থিত হইয়া নিকটবর্তী গ্রামবাসীদিগের নিকট হইতে জানিতে পারিলেন যে, অযোধ্যা প্রদেশীয় জনৈক রাজা প্রায় দুই শত অনুচর সমভিব্যাহারে তীর্থ হইতে প্রত্যাগমনকালীন ওই গ্রামের নিকটবর্ত্তী একটি আম্র বাগানে ডাকাইতির একদিবস পূর্ব্বে অবস্থিতি পূৰ্ব্বক বিশ্রাম করিয়াছিলেন ও পরদিবস প্রত্যূষে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করেন। সেইদিবস প্রত্যূষে কয়েকটি বালক গোচারণ অভিলাষে গমন করিবার কালীন মুরে গ্রামের প্রায় এক ক্রোশ দূরে বড় রাস্তার উপর এক তোড়া ডলার প্রাপ্ত হয়, ওই তোড়ার উপর বৈদ্যনাথ নামক এক ব্যক্তির মোহর ছিল। এই বৈদ্যনাথই কলিকাতা হইতে ওই সকল ডলার পাঠাইয়াছিলেন। বারের থানাদার ওই রাস্তার উপর একটি ডলার ও একখানি বল্লমের অংশ প্রাপ্ত হন, তিনি উহা মেকফারলেন সাহেবের নিকট পাঠাইয়া দেন। এই সকল অবস্থা জানিতে পারিয়া মেকফারলেন সাহেব এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ওই রাজাই ডাকাতের সর্দ্দার ও তাহার অনুচরগণই ডাকাইত। আরও স্থির করেন যে, যে পথে ওই সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছে, তাহারা ওই পথ দিয়াই গমন করিয়াছে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া তিনি দরিয়াপুর পর্যন্ত গমন করেন ও জানিতে পারেন যে, ওই স্থানে তাহারা এক রাত্রি যাপন করিয়াছিল। তাহার পর তিনি রামপুরে গিয়া অবগত হন যে এই স্থানে তাহার একদল বেয়ারা ভাড়া করিয়া সাসারামে গমন করিয়াছে। রামপুর ও সাসারামের মধ্যবর্তী দাউদনগর পর্যন্ত তিনি গমন করিয়াছিলেন, কিন্তু আর অধিক অগ্রবর্ত্তী না হইয়া সেই স্থান হইতে তিনি মুঙ্গেরে প্রত্যাবর্তন করেন। 

মুঙ্গেরে শুভাগমন করিয়া সেই স্থানের থানাদার শ্যামলাল ঘোষকে তিনি ওই কার্য্যে নিযুক্ত করেন। তিনি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া জানিতে পারেন যে, ওই দল সাসারামে বিশ্রাম করিয়াছিল। আর যেস্থানে মেহেরবান আম্রবৃক্ষ রোপণ করিবার বন্দোবস্ত করিয়া আসিয়াছিলেন, তাহাও তিনি জানিতে পারিলেন। ক্রমে তিনি আজিমগড়ে আসিয়া উপস্থিত হন ও যে সকল বেহারা স্ত্রীলোকদিগকে তাহাদিগের অযোধ্যা জঙ্গলের বাড়ীতে পৌঁছিয়া আসে, তাহাদিগকে প্রাপ্ত হন। 

এই সমস্ত সংবাদ শ্যামলাল ঘোষ জোনপুরের মাজিষ্ট্রেট ক্রাফ্ট (Mr. Cracroft) সাহেবকে প্রদান করেন। তিনি ওই সকল বেহারাদিগকে আনাইয়া তাহাদিগের এজাহার গ্রহণ করেন। ওই সকল বেহারাদিগের মধ্যে সৌদানি নামক একজন মেহেরবানের অতিশয় পুরাতন বেহারা ছিল, সে মুকরের কার্য্যের সময় ওই দলের সঙ্গে ছিল, সুতরাং তাহার নিকট মাজিষ্ট্রেট সাহেব সমস্তই অবগত হইতে পারিলেন। তিনি এই দল উচ্ছেদ করিবার নিমিত্ত গবর্ণমেণ্টে লিখিলেন, তিনি আরও লিখিলেন, সিক্রোরা নামক স্থানে গবর্ণমেন্টের যে সৈন্যের ছাউনি আছে, তাহার অধিনায়ককে আদেশ প্রদান করা হয় যেন, তিনি সসৈন্যে সেই স্থানে গমন করিয়া ওই দলের উচ্ছেদ করেন। 

তিনি যেরূপ লিখিয়াছিলেন, গবর্ণমেন্ট সেইরূপই করিলেন। মেহেরবানকে সদলবলে ধরিবার নিমিত্ত কাপ্তেন আকুইটলের (Captain Anquetil) কর্তৃত্বাধীনে ৪ চারি দল সৈন্য প্রেরিত হয়। মুঙ্গেরের থানাদার শ্যামলাল ঘোষ জোনপুরের মাজিস্ট্রেটের মুনসি এবং সুদানী বেহারা তাহাদিগের পথ-প্রদর্শক হইয়া গমন করিতে থাকেন। ওই জঙ্গলের সীমা গণ্ডায় গিয়া তাহারা উপনীত হন। সেই স্থানে ১৮২০ খৃষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর তারিখে তাঁবু সংস্থাপিত করিয়া মেহেরবানকে আক্রমণ করিবার বন্দোবস্তে লিপ্ত হন। বিসওয়ে নদীর দুনতলি নামক পারঘাটায়, সৈন্য পার করিবার সময় পাছে মেহেরবান উৎপাত ঘটায়, এই ভয়ে একজন কাপ্তেনের অধীনে একদল সৈন্য গিয়া ওই পারঘাটা অধিকার করিয়া বসেন। কাপ্তেন সাহেবের ইচ্ছা ছিল যে, তিনি হঠাৎ গিয়া মেহেরবানের দলকে আক্রমণ করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ যখন সৈন্য সকল ওই নদী পার হইতেছিল, সেই সময় উহার কিয়ংদশ পার হইয়াই অগ্রগামী হইয়া পড়ে। উহাদিগের সহিত শ্যামলাল ও মুনসি ছিলেন। তাঁহারা হঠাৎ গিয়া মেহেরবানের ভ্রাতা ছেদীর এলাকাধীনে উপস্থিত হন। এই ছেদী পাঁচ শত ব্যক্তির নেতা হইয়া, মেহেরবান হইতে স্বতন্ত্র ভাবে স্বতন্ত্র স্থানে বাস করিত। সৈন্যগণ সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াই তাহাদিগের উপর আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিল। উহারা সৈন্য আগমনের সংবাদ পূৰ্ব্ব হইতেই পাইয়াছিল, সুতরাং তাহারাও উত্তমরূপে প্রস্তুত হইয়াছিল। তাহারা কয়েকজনমাত্র অস্ত্রের প্রত্যুত্তর দিতে আরম্ভ করিল। অবশিষ্ট সকলে জঙ্গল আশ্রয় করিয়া উত্তর দিক হইতে কাপ্তেন সাহেবের প্রধান বাহিনীর উপর গুলি বৃষ্টি করিতে প্রবৃত্ত হইল। এই অবস্থায় কাপ্তেন সাহেব মহা বিব্রত হইয়া দ্রুতপদে ছেদীর সীমানা অতিক্রম করিয়া মেহেরবানের দুর্গের দিকে অগ্রগামী হইলেন। মেহেরবানের এই ক্ষুদ্র দুর্গের চতুষ্পার্শ্বে খাদ, ওই খাদের মৃত্তিকা দিয়া, উহার চতুষ্পার্শ্বে মৃন্ময় প্রাচীর নির্মিত হইয়াছে। এই ক্ষুদ্র দুর্গটি দৈর্ঘ্যে ১২০ হস্ত প্রস্থে ৮০ হস্ত। ইহার ভিতর মেহেরবান বন্দুকধারীগণকে লইয়া বাস করিতেন। এই দুর্গের চতুর্দিক তাঁহার অধিকারভুক্ত। সৈন্যগণ যেমন আসিয়া ওই দুর্গ আক্রমণ করিল, অমনি মেহেরবান তাহাদিগের উপর প্রথমতঃ অবিশ্রান্ত গুলি বর্ষণ করিয়া পরিশেষে ওই দুর্গস্থিত সমস্ত ঘরে অগ্নি লাগাইয়া দিয়া দুর্গের অপর দিকের প্রাচীর উল্লম্ফন পূৰ্ব্বক সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। ইহার পর ছেদীর ও মেহেরবানের দুই দল একত্রিত হইয়া নিবিড় জঙ্গলের মধ্য হইতে ইংরাজ সৈন্যের উপর চতুৰ্দ্দিক হইতে অকুতোভয়ে গুলি নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিল। 

কাপ্তেন সাহেব দেখিলেন, এরূপ অবস্থায় ওই দুর্গ অধিকক্ষণ অধিকারভুক্ত রাখিয়া কোন লাভ নাই। ইহাতে সকলকেই সেই স্থানে নিপাতিত হইতে হইবে, অথচ যে জঙ্গল হইতে গুলি আসিয়া পড়িতেছে, সেই জঙ্গলের ভিতর সৈন্যগণের প্রবেশ করিবার ক্ষমতা নাই। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, কাপ্তেন সাহেব দুই প্রহরের সময় ওই দুর্গ পরিত্যাগ পূর্ব্বক সসৈন্যে ওই নদী পার হইয়া একেবারে ৭ ক্রোশ দূরে শিবির সন্নিবেশিত করিলেন। নদী পার হইবার সময় বিপক্ষ গুলিতে একজন সৈন্যকে হারাইতে হইয়াছিল। 

মেহেরবান ও সেই প্রদেশীয় অপরাপর সদারগণ সকলে মিলিত হইয়া কাপ্তেন সাহেবকে চতুৰ্দ্দিক হইতে আক্রমণ করিলেন। কাপ্তেন সাহেব আর কোন উপায় না দেখিয়া, সদলবলে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া আপন জীবন রক্ষা করিলেন। 

কাপ্তেন সাহেব প্রাণ লইয়া প্রত্যাগমন পূর্ব্বক গবর্ণমেন্ট এইরূপভাবে একটি রিপোর্ট প্রেরণ করিলেন—”মেহেরবানের বন্দোবস্ত অতি সুন্দর। কলিকাতা, বেণারস, পুণা, আগ্রা, দিল্লী ও লাহোর প্রভৃতি স্থানে তাহার অনেক লোক আছে। ওই সকল স্থান হইতে অধিক পরিমিত অর্থ কোন স্থানে প্রেরিত হইলে সেই সংবাদ তিনি প্রাপ্ত হন ও কোন দেশীয় রাজার ভাগে সদলবলে সেইদিকে গমন করিয়া সেই সকল অর্থ লুণ্ঠন করিয়া লন। উহারা গভীর শাল বনে বাস করে সুতরাং সেই স্থানে সৈন্য লইয়া গিয়া তাহাদিগকে ধরা যায় না। অধিকন্তু ওই জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিলে অধিক সংখ্যক সৈন্য সামান্য কয়েকজন মাত্রের নিকট পরাভূত হইয়া জীবন হারায়।” 

কাপ্তেন সাহেবের এই সংবাদ বেণারস ও বেহারের মাজিষ্টেটের নিকট প্রেরণ করা হয় ও তীর্থ ভ্রমণকারী রাজাদিগের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিবার উপদেশ প্রদান করা হয়। 

এবার মেহেরবান যখন সদলবলে বহির্গত হইবেন, সেইসময় আরও বিশেষরূপ আড়ম্বরের সহিত যাহাতে গমন করিতে পারেন, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া প্রবৃত্ত হইলেন। গবর্ণমেন্টের ভূতপূর্ব্ব সিপাহী সুরত সিংকে আপনার অধীনে রাখিয়া তাঁহার অনুচরবর্গকে ইংরাজী ধরণে উত্তমরূপে ডিল শিক্ষা দিতে লাগিলেন। 

মেহেরবানের একজন অনুচর হিরা সিংহ। তাহার স্ত্রী অতিশয় সুশ্রী ছিল। সুরত সিংহের নিকট ড্রিল শিক্ষা করিবার সময় সে হিরার স্ত্রীর রূপে মোহিত হয় ও কোনরূপ উপায়ে তাহাকে বাহির করিয়া লইয়া যায়। হিরা ইহা জানিতে পারিয়া তাহার স্ত্রীর অনুসন্ধান করে, কিন্তু কোনরূপে তাহার সন্ধান না পাইয়া তাহার দলপতি মেহেরবানের নিকট সুরত সিংহের নামে নালিশ করে, কিন্তু মেহেরবান তাহার কথায় কর্ণপাত করেন না। হিরা ইহাতে অতিশয় দুঃখিত হয়, পরিশেষে সেই প্রদেশীয় প্রত্যেক দলপতির নিকট উপস্থিত হইয়া, সুরত সিংহের বিরুদ্ধে নালিস করে, কিন্তু কেহই তাহার স্ত্রীকে পুনঃ প্রাপ্ত হইবার কোনরূপ উপায় করেন না। তখন সে প্রতিশোধ লইবার মানসে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, কিন্তু স্পষ্ট কাহাকেও কিছু না বলিয়া স্থিরভাবে মেহেরবানের অধীনে কার্য্য করিতে থাকে। 

মেহেরবান হিন্দু রাজার ন্যায় তাঁহার শিক্ষিত সিপাহীগণকে সঙ্গে লইয়া বেণারস হইতে সেরঘাটী অভিমুখে যাত্রা করেন। হিরা সিং ওই সিপাহীগণের মধ্যে একজন। এইবার সে তাহার প্রতিহিংসা পূর্ণ করিতে যত্নবান হইল। 

বিহারের মাজিষ্ট্রেট স্মিথ সাহেব (Mr. C. W. Smith) পূৰ্ব্বকথিত আদেশ প্রাপ্তে সতর্ক ছিলেন। জানিতে পারিলেন, একজন হিন্দুরাজা অনেকগুলি সিপাহী সমভিব্যাহারে সেরঘাটীতে গমন করিতেছেন ও গাজিপুরের অপর পারে মোহনীয়া নামক স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। স্মিথ সাহেব বুঝিতে পারিলেন, ইনিই সেই দস্যু সর্দ্দার। 

উহাদিগকে বলপ্রয়োগ পূর্ব্বক ধৃত করিতে তিনি সাহসী না হইয়া কয়েকজন লোককে প্রচ্ছন্ন ভাবে তাহাদিগের দলের সহিত মিশাইয়া দিলেন। তাহাদিগের উপর এই আদেশ রহিল যে, তাহারা যেন কোন গতিকে ওই দলকে সেরঘাটী হইতে তীর্থ ভ্রমণের ভাণে গয়ায় আনিবার চেষ্টা করে। তিনি আরও সেরঘাটীর মাজিষ্ট্রেটকে লিখিলেন, যদি ওই দল গয়া অভিমুখে না আইসে, তাহা হইলে যেরূপে হউক তিনি যেন উহাদিগকে ধৃত করেন। মেহেরবান বুঝিতে পারিলেন, সরকার বাহাদুর তাহাদিগের উপর সন্দেহ করিয়াছে। এই ভাবিয়া তিনি সেরঘাটীর সাত ক্রোশ দূর হইতে তাঁহার অনুচরবর্গের ভার মনসা নামক আর একজন সদারের হস্তে অর্পণ করিয়া তিনি কয়েকজন মাত্র অনুচরের সহিত সিপাহীর বেশ ধরিয়া বড় রাস্তা দিয়া গমন করিতে লাগিলেন। তিনি যখন সেরঘাটীতে উপস্থিত হইলেন, সেই সময় দুইজন সরকারী চাপরাশি আসিয়া তাহাদিগের সঙ্গে মিশিল ও তাঁহাকে কহিল যে, তাহারা সরকার হইতে তাঁহাদিগের সঙ্গে গমন করিতে নিয়োজিত হইয়াছে, তাহারা তাঁহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে মিশিয়া দেখিবে যে, তাঁহারা যে যে স্থানে গমন করিবে, সেই সেই স্থানের সরকারী ডিউটী বা টেক্স তাঁহারা সরকারী নিয়মমত প্রদান করে কিনা? মেহেরবান এই কথায় বিশ্বাস করিয়া তাঁহার সর্দ্দার মুসাকেও এই সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। মনে আর কোনরূপ সন্দেহ না করিয়া সকলেই গয়ায় উপনীত হইলেন ও একটি আম্রবাগানে নিশ্চিন্ত ভাবে বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। অনন্তর পুলিস আসিয়া সকলকে এই বলিয়া স্মিথ সাহেবের নিকট লইয়া গেল যে কষ্টম ডিউটীর নিয়ম অনুসারে সাহেব নিজে তাহাদিগের সকলের দ্রব্যাদি অনুসন্ধান করিয়া দেখিবেন। এই কথা উহারা বিশ্বাস করিল, কারণ এরূপ ঘটনা তাহাদিগের প্রায়ই ঘটিয়া থাকে। তাহারা অধিক আর কিছু সন্দেহ না করিয়া, স্মিথ সাহেবের নিকট গিয়া যেমন উপস্থিত হইল, অমনি তাহারা সেই স্থানে ধৃত হইল। 

হিরা তাহার স্ত্রীর নিমিত্ত সারদিগের উপর প্রতিশোধ লইবার যে সঙ্কল্প করিয়া মেহেরবানের সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছিল, এখন সে তাহার প্রতিশোধ গ্রহণ করিল। সে মাজিষ্ট্রেটের নিকট গিয়া যাহা যাহা জানিত সমস্ত বলিয়া দিল। ইতিপূর্ব্বে মুরে নামক স্থানে উহারা যে কার্য্য করিয়াছিল, তাহাও সমস্ত প্রকাশ করিয়া দিল। আরও বলিল, এবার কলিকাতার ব্রজবাসী দ্বারবানদিগের নিকট হইতে সংবাদ আসিয়াছে যে, পুনরায় আর এক নৌকা ধন বেণারসে প্রেরিত হইবে। ইহার সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত কয়েকজন লোক পূৰ্ব্বেই কলিকাতায় প্রেরিত হইয়াছে ও এই দলও সেই কার্য্য উদ্ধার করিবার নিমিত্ত বহির্গত হইয়াছে। 

এই সংবাদ প্রাপ্তে ওই দলের সমস্ত লোকের উপর মুরে নামক স্থানের ডাকাইতি ও হত্যার মোকদ্দমা রুজু হইল। অপরাপর সাক্ষীগণের মধ্যে প্রধান সাক্ষী হিরা সিং, মেহেরবানের ড্রিল শিক্ষক সুরত সিং। এই মোকদ্দমায় মেহেরবানের ফাঁসির হুকুম হইল, অবশিষ্ট ১৬০ এক শত ষাট জনের মধ্যে কেহ কেহ চির নির্বাসিত হইল ও কেহ কেহ কারাগারে প্রেরিত হইল। 

এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে নিজামত আদালত হইতে ১৮২১ খৃষ্টাব্দে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, তাহাতে সংস্থিষ্ট ইংরাজ কর্মচারীর ভূয়সী প্রশংসা বাহির হয়, কিন্তু বাঙ্গালী থানাদার শ্যামলাল ঘোষের নাম গন্ধও ইহাতে নাই। 

সম্পূর্ণ 

[ মাঘ, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *