সেকেলে পশ্চিমে ডাকাত (দ্বিতীয় অংশ)

সেকেলে পশ্চিমে ডাকাত (দ্বিতীয় অংশ)

প্রথম পরিচ্ছেদ 

পূর্ব্ববর্ণিত ঘটনার পর মেহেরবানের স্ত্রী মুনিয়া আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিয়া নিজেই দলপতির পদ গ্রহণ করিল। 

১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মুনিয়া একটি অভিযানে গমন করিলেন। নেপালের সহিত ইংরাজ রাজের ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে যে যুদ্ধ হয় ওই যুদ্ধ সম্বন্ধীয় কিয়ৎ পরিমাণ অর্থ ইংরাজ-রাজ কর্তৃক নেপাল রাজের নিকট কাটমুণ্ডে ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রেরিত হয়। ওই অর্থ আত্মসাৎ করিবার মানসে মুনিয়া তাঁহার বাসস্থান হইতে কয়েকশত মাইল পূর্ব্বে জনকপুর নামক স্থানে গমন করেন। মেহেরবানের স্ত্রী মুনিয়া, জহুরি, লাচী, গরিবা ও প্রসিদ্ধ কুলন্দরের পুত্র পালোয়ান; এই পাঁচজন দলপতি পাঁচটি দলের কর্তৃত্ব ভার গ্রহণ করিয়া এই কার্য্যে নিযুক্ত হন। কুলন্দর অযোধ্যার অন্তর্গত হাইদার গড় নামক স্থানের ডাকাইতিতে হত হইয়াছিল। 

নিয়মিত প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়া বাছা বাছা ৮০ জন লোকও ৭ জন স্ত্রীলোক এই কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন ও আপনাপন দলপতির অধীনে পৃথক পৃথক ভাবে জনকপুর অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। জনকপুর হইতে চারি ক্রোশ ব্যবধানে জংপুর নামক স্থানে জহুরির দল উপনীত হইলে দেখিতে পাইল যে, ৮০ জন গুরখা সৈন্যের পাহারায় ১৫টি বলদে ধন বহন করিয়া লইয়া যাইতেছে। উহারাও ছদ্মবেশে ওই দলের সহিত মিলিয়া গমন করিতে লাগিল ও জানিতে পারিল যে, কালেক্টরি হইতে ৬৪ হাজার টাকা তাহারা নেপালের রাজধানীতে লইয়া যাইতেছে। জহুরি ওই দলের সহিত নিজের কেবল দুইজন মাত্র অনুচর রাখিয়া, নিজে ও অপরাপর সকলে অন্যান্য দলপতিগণের সহিত পরামর্শ করিবার মানসে জংপুরে প্রত্যাগমন করিল, কারণ ওই স্থানে সকলে আসিয়া একত্রিত হইবার কথা ছিল। সেই স্থানে গিয়া সকল দলপতির সহিত সাক্ষাৎ হইলে কিরূপ উপায়ে ওই ধনভাণ্ডার হস্তগত হইতে পারিবে, তাহারই পরামর্শ করিতে লাগিল। 

জহুরি কহিল, যতগুলি অনুচরবর্গ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, উহাদিগকে লইয়াই ওই ধনবাহীগণকে আক্রমণ করা যাউক। অপরাপর সদারগণ কহিল, যে পৰ্য্যন্ত সমস্ত লোক আসিয়া সমাগত না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা কর্তব্য নহে। কারণ ধনভাণ্ডার আক্রমণ করিতে গেলেই সিপাহীগণের নিকট হইতে তাহারা প্রতিবন্ধকতা প্রাপ্ত হইবে, ও খুন জখম যে না হইবে তাহাও নহে। এইরূপ অবস্থায় অধিক লোক ভিন্ন এ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা কোন মতেই বিধেয় নহে। কেহ কেহ আরও কহিল, এবার যদি আমরা ওই অর্থ হস্তগত করিবার সুবিধা বিবেচনা না করি, তাহা হইলে পরবর্ত্তী মাসে যে অর্থ নেপালে প্রেরিত হইবে তাহাই আক্রমণ করিব। 

এ প্রস্তাবে জহুরি সম্মত হইল না। সে কহিল, যে পক্ষী আপনা হইতে উড়িয়া আসিয়া আমাদিগের হাতে পড়িয়াছে, তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া অনিশ্চিত পক্ষী ধরিবার উদ্দেশ্যে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়ান কৰ্ত্তব্য নহে। 

এইরূপ অনেক তর্ক বিতর্কের পর পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, যতগুলি লোক উপস্থিত হইতে পারিয়াছে, তাহাদিগকে লইয়াই ওই ধনভাণ্ডার আক্রমণ করিতে হইবে। এইরূপ স্থিরীকৃত হইলে জহুরি ৩০ জন লোকের সহিত ও গরিবা ২০ জনের সহিত এ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইল ও দূরে থাকিয়া ওই অর্থবাহীদিগের অনুসরণ করিতে লাগিল। যে দুইজন ওই দলের সহিত গমন করিতেছিল, তাহারা তীর্থযাত্রী পরিচয়ে তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতে লাগিল। ওই দুই ব্যক্তি যখন দেখিল, ওই অর্থবাহীগণ পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি গিরিপথের মধ্যে প্রবেশ করিল, তখন একজন তাহাদিগের সহিত থাকিল আর একজন আসিয়া জহুরিকে এই সংবাদ প্রদান করিল। ওই স্থান জংপুর হইতে প্রায় ৬ ক্রোশ ব্যবধানে। এই সংবাদ পাইয়া উহারা সকলে ভুগালি নামক একটি গ্রামে সন্ধ্যার সময় উপনীত হইল। কিরূপ অবস্থায় ধনরক্ষকগণ অবস্থিতি করিতেছে, তাহা স্বচক্ষে দেখিবার মানসে জহুরি, চারিজন মাত্র অনুচর সমভিব্যাহারে সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিল যে, অর্থ সকল যেস্থানে রক্ষিত হইয়াছে, তাহার চারিদিকে প্রাচীর, ওই প্রাচীরের বাহিরে একটি খাদ। প্রায় চারি শত ব্যবসায়ী কেহ বা পাহাড় হইতে নামিয়া, কেহ বা পাহাড়ে উঠিবার নিমিত্ত ওই খাদের চতুর্দ্দিকে বিশ্রাম করিতেছে। 

এই সকল অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া জহুরি আপন স্থানে পত্যাগমন করিল ও জঙ্গল হইতে কাষ্ঠ সংগ্রহ করিয়া দুখানি লম্বা সিঁড়ি প্রস্তুত করতঃ উহার সহিত সকলে সেই রাত্রেই সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল, ও দেওয়ালের উপর সিঁড়ি লাগাইয়া তাহার সাহায্যে যেস্থানে ওই অর্থ রক্ষিত হইয়াছিল, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই সময় রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর; আকাশ পরিষ্কার, চন্দ্রালোকে চতুর্দিক আলোকিত। তথাপি ইহার ভিতর প্রবেশ করিয়াই উহারা মশাল প্রজ্বলিত করিয়া ওই ধনরক্ষকগণকে আক্রমণ করিল। উহারা সাধ্যমত বাধা দিল সত্য, কিন্তু কিছুই করিয়া উঠিতে পারিল না। আক্রমণকারীগণ ওই ৬৪ হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, উহাদিগের মধ্যে একজনও হত বা আহত হইল না। 

অনন্তর তথা হইতে বহির্গত হইয়া দ্রুতপদে উহারা দুই তিন মাইল পথ গমন করিল, কিন্তু তাহাদিগের পক্ষে ভার অধিক বোধ হইয়াছ, একটি জঙ্গলের মধ্যে ১৭ হাজার টাকা প্রোথিত করিয়া অবশিষ্ট ৪৭ সহস্ৰ মুদ্রা সঙ্গে লইয়া, জঙ্গলে জঙ্গলে দ্রুতপদে আপন স্থানাভিমুখে প্রস্থান করিল। 

এই সংবাদ নেপালের কেন্টনমেন্ট জলেশ্বর নামক স্থানে পৌঁছিলে সেই স্থান হইতে আদেশ হইল যে, অপরিচিত লোক দেখিলেই যেন ধৃত করা হয়। এই আদেশ অনুযায়ী মুনিয়া ও পালোয়ানের কতকগুলি অনুচর ধৃত হইল। তাহাদিগের উপর বিশেষ উৎপীড়ন ও তাহারা উহা সহ্য করিতে না পারিয়া, স্ব স্ব পরিচয় প্রদান করিল। কহিল যে, জহুরি ও গরিবার দলস্থিত লোকদিগের দ্বারা নিশ্চয়ই এই কার্য সম্পন্ন হইয়া থাকিবে, কারণ, তাহারাও ওইরূপ উদ্দেশ্যে দলবল লইয়া উহাদিগের অগ্রে অগ্রে গমন করিয়াছে। 

এই সংবাদ পাইয়া দুই দল সৈন্য যাহারা সেই সময় বালেশ্বরে উপস্থিত ছিল, তাহারা জহুরি ও গরিবার দলের অনুসন্ধানে পশ্চিম দিকে জঙ্গলের ভিতর দিয়া প্রেরিত হইল। কারণ উহারা ওইদিক দিয়া প্রস্থান করিয়াছে, এই কথা ধৃত ব্যক্তিগণ প্রহারের যন্ত্রণায় প্রকাশ করিয়াছিল। 

ওই দুই দল সৈন্য ওইরূপে গমন করিতে করিতে, একস্থানে ৩১ জনকে দেখিতে পাইল ও উহাদিগকে হঠাৎ আক্রমণ করিয়া উহাদিগের ২৯ জনকে ধৃত করিল। অবশিষ্ট ২ জন ওই আক্রমণে সেই স্থানে হত হইল। উহাদিগের নিকট হইতে ৩৫ হাজার টাকা পাওয়া গেল। সৈন্যগণ সেই জঙ্গলের ভিতর রাস্তা হারাইয়া ফেলে, সুতরাং অপর ব্যক্তিগণের আর অনুসরণ করিতে পারিল না। 

যাহারা ধৃত হইল তাহাদিগের উপর ও পূর্ব্বের ন্যায় ব্যবহার চলিতে লাগিল, তাহারা সে অসহ্য যন্ত্রণা কোনরূপে সহ্য করিতে না পারিয়া, যে জঙ্গলে ১৭ হাজার টাকা পোঁতা ছিল, তাহা দেখাইয়া দিল। সিপাহীগণ ওই ২৯ জনকে ৫২ হাজার টাকার সহিত কেন্টনমেন্টে উপস্থিত করিল। এদিকে জহুরি ও গরিবা তাহাদিগের অবশিষ্ট দল ও ১২ হাজার মুদ্রার সহিত আপন স্থানে প্রস্থান করিল। 

যাহারা ধৃত হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ নিম্নলিখিত ডাকাইতিতে সংমিলিত ছিল বলিয়া স্বীকার করিয়াছিল। কুলন্দর সর্দ্দার— 

১। লোধী সর্দ্দারের দলে মিলিত হইয়া রামনগর নামক স্থানে সরকারী ৩২০০০ টাকা লুটিয়া লইয়াছিল। ২। মুটিয়াবাদে এক মহাজনের বাড়ী লুটিয়া ৩০০০ টাকা প্রাপ্ত হয়। 

৩। অযোধ্যার অন্তর্গত বিসোয়া নামক স্থানে একজন মহাজনের বাড়ীতে লুট করিবার সময় দুইজন অনুচর হত 

হয় ও কিছু লইতে না পারিয়া প্রত্যাগমন করে। 

৪। অযোধ্যার অন্তর্গত জারুল নামক স্থানে নায়েক সর্দ্দারের অধীনে একজন মহাজনের বাড়ী লুট করে। 

৫। ওই নায়েক সর্দ্দারের অধীনে বরোচ নামক স্থানে একজন কুঠারির বাড়ী লুটিয়াছিল, নগদ টাকা কিছুই পায় নাই, কেবল ১০ বাণ্ডিল কাপড় লইয়া প্রস্থান করে। 

৬। অযোধ্যার অন্তর্গত হায়দারগড় নামক স্থানে একজন মহাজনের বাড়ী আক্রমণ করে, ইহাতে তাহার পিতা প্রসিদ্ধ কুলন্দর সর্দ্দার হত হয়। 

মাদারি- 

১। নায়েক সর্দারের অধীনে কানপুরে জনৈক মহাজনের বাড়ী লুটিয়া ২৪০০০ টাকা প্রাপ্ত হয়। 

২। নায়েক সর্দ্দারের অধীনে মৌ জেলার অন্তর্গত গোলাম হোসেন নামক একজন মহাজনের বাড়ী লুণ্ঠন করিয়া এক লক্ষ টাকা প্রাপ্ত হয়। অপর চারি ব্যক্তি ও মাদারি ধৃত হইয়াছিল, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই কারাগার হইতে মাদারি পলায়ন করে। 

৩। কুলন্দর সদ্দারের অধীনে গোয়ালিয়র নগরীতে সরকারী দুই লক্ষ সুবর্ণ-মুদ্রা হস্তগত করে। 

৪। কুলন্দর সর্দ্দারের অধীনে মারহাট্টা দেশে হাঁসি সহর নামক স্থানে এক মহাজনের বাড়ী লুট করিয়া ৫০০০ প্রাপ্ত হয়। 

৫। নায়েক সর্দারের অধীনের তামাচাবাদ সহরে একজন তেলীর বাড়ী লুণ্ঠন করিয়া ৬০০০ টাকা প্রাপ্ত হয়। ৬। নায়েক সদারের অধীনে আতরৌলি সহরে বুলন্দ সিংহের বাড়ী লুণ্ঠন করিয়া ১০০০০ টাকা প্রাপ্ত হয়। ৭। নায়েক সর্দ্দারের অধীনে বংগওয়া নামক গ্রামে ধনিয়া সিং রাজপুতের বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া ২৪০০০ টাকা হস্তগত হয়। 

জংলি— 

১। মনসুর সর্দ্দারের অধীনে ফতেপুরের অন্তর্গত গোয়ানগড় নামক স্থানে একজন ভাটের বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া 

কেবল দুই বাণ্ডিল কাপড় ও নগদ তিন শত টাকা পাওয়া যায়। 

২। ছেদী সর্দারের অধীনে তামাচাবাদ সহরে সরকারী খাজনা ১০০০০ টাকা লুণ্ঠন করিয়া লয়। 

৩। ছেদী সর্দ্দারের অধীনে ত্রিহত জেলার মধ্যে একটি বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া ১০০০০ টাকার পয়সা ও ২০০ টাকাব সিকি পাওয়া যায়। 

৪। নায়েক সর্দ্দারের অধীনে ডুমুরিয়াগজ নামক স্থানে ডাকাইতি করিয়া কেবল চারি বান্ডিল কাপড় পাওয়া যায়। ৫। নায়েক সর্দারের অধীনে পাটন নামক স্থানে একজন মহাজনের বাড়ীতে কেবল দুইখানি বড় বাসন পাওয়া যায়। 

৬। নায়েক সর্দ্দারের অধীনে লংগড়া নামক গ্রামে একজন তুলা-ব্যবসায়ীর বাড়ী লুঠিয়া ৬০০০ টাকা পাওয়া যায়। ৭। নায়েক সর্দ্দারের অধীনে নিবুয়া নামক স্থানে একজন মহাজনের বাড়ী লুটিয়া কেবলমাত্র তিন বাণ্ডিল কাপড় পাওয়া যায়। 

বুধুয়া- 

১। মোনসা সর্দ্দারের অধীনে বদলপুর নামক স্থানে একজন মহাজনের বাড়ী লুঠিয়া ৩২০০০ টাকা পাওয়া যায়।

২। সাবিত সর্দ্দারের অধীনে তৌসা নামক স্থানে এক মহাজনের বাড়ীতে ডাকাইতি করা হয় সত্য, কিন্তু কিছু‍ই হস্তগত হয় নাই, বাধা পাইয়া দ্রুতপদে সেই স্থান হইতে পলায়ন করিতে হয়। 

৩। লোধী সর্দ্দারের অধীনে গোরামা নামক স্থানে, সরকারী অর্থ আক্রমণ করে, কিন্তু কিছুই লইতে সমর্থ হয় নাই। লোধী ধৃত হয়, অপর সকলে প্রস্থান করে। 

৪। নায়েক সর্দ্দারের অধীনে গরৌরি নামক স্থানে সরকারী অর্থের মধ্যে কেবল ১০০০ টাকা হস্তগত হয়। 

৫। বানেলী সর্দ্দারের অধীনে বেটুরে এক মহাজনের বাড়ীতে কেবল পাঁচখানি কাপড় পাওয়া যায়। 

৬। ইসমাইল সর্দারের অধীনে পিণ্ডারিন নামক স্থানে এক ডাকাইতিতে কেবল ৮০০ টাকা নগদ ও ৬০০ টাকা মূল্যের অলঙ্কার পাওয়া যায়। 

তুলা – 

১। ছেদী সর্দ্দারের অধীনে রসুলি নামক স্থানে একজন মহাজনের বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া কেবলমাত্র ৫০০ টাকা 

প্রাপ্ত হয়। এই ডাকাইতিতে ৬ জন ডাকাইত হত হইয়াছিল। 

২। সিউয়া সর্দ্দারের পুত্রের অধীনে বঙ্কা সহর নামক স্থানে একজন ব্যবসায়ীর গৃহে ডাকাইতি করিয়া কেবলমাত্র ৪০০ মুদ্রা প্রাপ্ত হয়। 

৩। লুটি সর্দ্দারের অধীনে লালগঞ্জ নামক স্থানে এক মহাজনের বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া ৮০০ প্রাপ্ত হয়। ওই ডাকাইতিতে মহাজনের চারিজন লোক ও একজন ডাকাইত হত হয়। 

৪। মেহেরবান সর্দ্দারের অধীনে ঝাঁসি সহরে জনৈক মহাজনের বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া দুই সহস্র মুদ্রা প্রাপ্ত হয়। ৫। লুটি সর্দ্দারের অধনে ভোকাপুর নামক স্থানে একজন মহাজনের বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া কেবলমাত্র এক শত মুদ্ৰা নগদ ও কিছু কাপড় প্রাপ্ত হয়। ইহাতে মহাজনের দুইজন লোক হত হইয়াছিল। 

রাম সিং- 

১। নিউয়াগি সর্দ্দারের অধীনে জয়পুর নামক স্থানে একটি ডাকাইতিতে সহস্র মুদ্রা পাওয়া যায়, কিন্তু যে মহাজনের বাড়ীতে ডাকাইতি হইয়াছিল, তাঁহার ৩ জন লোক হত হয়। 

২। নোয়াজি সর্দ্দারের অধীনে হাতাবাস সহরে এক মহাজনের বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া কেবলমাত্র ৫০০ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু মহাজনের তিনজন লোক ও দুইজন ডাকাইত ওই ডাকাইতিতে হত হইয়াছিল। 

৩। লাহর নামক স্থানে নোয়াজি সর্দ্দারের অধীনে একটি মহাজনের বাড়ী আক্রমণ করা হয়, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় নাই। 

৪। লছমন সদারের অধীনে কানপুরে একজন মহাজনের বাড়ী লুট করিয়া কেবলমাত্র দুই শত টাকা পাওয়া যায়। 

ছিরুয়া– 

১। এটোয়া নামক স্থানে মেহেরবান সর্দ্দারের অধীনে একজন মহাজনের বাড়ী লুঠিয়া ৫০০০ টাকা পাওয়া যায়। ২। রুন্দন সর্দ্দারের অধীনে লালগঞ্জ নামক স্থানে একজন ব্যবসায়ীর বাড়ীতে কেবলমাত্র পাঁচ শত টাকা পাওয়া যায়। ভবানী দীন- 

১। লুটি সর্দ্দারের অধীনে লালগঞ্জ নামক স্থানে একটি ব্রাহ্মণের বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া কেবলমাত্র চারি শত মুদ্রা পাওয়া যায়। উহাতে দলের ৪ জন হত হইয়াছিল। 

২। ওই সর্দ্দারের অধীনে অযোধ্যায় একজন ব্রাহ্মণের বাড়ীতে তিনজন ব্রাহ্মণকে হত্যা করিয়া কেবলমাত্র দুই শত মুদ্রা হস্তগত হয়। 

৩। ওই সর্দ্দারের অধীনে গোরক্ষপুর নামক স্থানে দুইজন সিপাহীকে হত্যা করিয়া ইংরাজ রাজের ১২০০০ মুদ্রা হস্তগত হয়। 

তারণ ইতিপূর্ব্বে কেবল দুইটি ডাকাইতি করিয়াছিল। একটি লুটি সর্দ্দারের অধীনে বেণারসের পশ্চিম ফুলপুর নামক স্থানে কোন মহাজনের চারিজন লোককে হত্যা করিয়া ৬০০০ সহস্র টাকা হস্তগত করে। আর একটি ওই সর্দারের অধীনে অযোধ্যা একজন হালাইকের বাড়ী আক্রমণ করে, কিন্তু কিছুই লইতে পারে নাই, লাভের মধ্যে পাঁচজন ডাকাইত হত হয়। 

নন্দরাম কেবল একটি ডাকাইতি করিয়াছিল। ওই লুটি সদারের অধীনে মহারাজগঞ্জ নামক স্থানে একজন ব্যবসায়ীর বাড়ীতে কেবলমাত্র ২০০ শত টাকা মূল্যের অলঙ্কার প্রাপ্ত হয়। 

ডুগাও ইতিপূৰ্ব্বে কেবল একটি ডাকাইতিতে গমন করিয়াছিল। ওই ডাকাইতিতে সদার ছিল লুটি ও জোয়াহর, তাহারা পাঁচজন সিপাহীকে হত্যা করিয়া ইংরাজ রাজের ১২০০০ সহস্র মুদ্রা হস্তগত করে। 

বালগবিন—ইতিপূর্ব্বে ছেদী সর্দ্দারের অধীনে আজিমগড় নামক স্থানে কোন মহাজনের তিনজন লোককে হত্যা করিয়া ৭০০ টাকা প্রাপ্ত হয়। 

জগদেওয়ান—-চান্দা সর্দ্দারের অধীনে গৌনগড় নামক স্থানে এক মহাজনের বাড়ী হইতে কেবলমাত্র ৩০০ তিন শত টাকা আত্মসাৎ করে। 

সাবিত—মেহেরবান সর্দ্দারের অধীনে আলমচাদ নামক স্থানে একজন মহাজনের বাড়ী লুট করিয়া ৫০০০ পাঁচ সহস্র মুদ্রা একবারে হস্তগত করিয়াছিল। 

ভোলা—দুইটি ডাকাইতি করিয়াছিল। একটি কুলন্দর সর্দ্দারের অধীনে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে এক মহাজনের বাড়ীতে। উহাতে ১০০০ মুদ্রা প্রাপ্ত হয়। অপরটি জোয়াহর সর্দ্দারের অধীনে আলিগঞ্জ নামক স্থানের কোন মহাজনের বাড়ী আক্রমণ করে, কিন্তু কিছুই লইতে পারে নাই। 

এই সমস্ত লোক ধৃত হইবার পর যখন অবশিষ্ট সকলে জানিতে পারিল যে, তাহাদিগের মধ্যে অনেকের নাম প্রকাশিত হইয়াছে, এখন তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই তাহাদিগের বাসস্থান পরিত্যাগ করিয়া, অযোধ্যার পূর্ব্ব সীমানায় সাজাহানপুর জেলার অন্তর্গত কোটারের বাজার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া তাহারই এলাকার মধ্যে বাস করিতে আরম্ভ করিল। মেহেরবান সিংহের দলের লোক যাহারা গয়ায় ধরা পড়িয়া কারারুদ্ধ হইয়াছিল, তাহাদিগের অনেককেই কোটারের রাজা জামিন হইয়া খালাস করিয়া লন। 

সেই সময় সরকারী টাকাই অধিকাংশ লুট হইত। সুযোগ পাইলেই সরকারী ধনরক্ষকগণকে আক্রমণ করিয়া ধন সকল লুট করিতে কিছুমাত্র ত্রুটী করিত না। এই সময় যে সকল সরকারী অর্থ অপহৃত হইয়াছিল, তাহার যতদূর সংগ্রহ করিতে পারা গিয়াছে, তাহার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হইল। 

১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে জোনপুর জেলার অন্তর্গত বাদলাপুর নামক স্থানে ৩২০০০ হাজার সরকারী টাকা অপহৃত হয়।

১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে গোরকপুর জেলার অন্তর্গত ভদরিক নামক স্থানে সরকারী অর্থ আক্রমিত হয়। ওই আক্রমণে একজন হত ও দশজন সিপাহী আহত হয়, কিন্তু কি পরিমিত অর্থ যে অপহৃত হয়, তাহা ঠিক জানিতে পারা যায় নাই। 

ওই ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে জোনপুর জেলার অন্তর্গত বাদসাপুর নামক স্থানে পাঁচজন ধনরক্ষককে হত্যা করিয়া ২২০০০ হাজার টাকা লইয়া যায়। 

ওই ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় সরকারী টাকা আক্রমণ করিয়া কয়েক জনকে হত ও আহত পূর্ব্বক ১০০০ সহস্র মুদ্রা অপহরণ করে। 

১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে জোনপুর জেলার অন্তর্গত মছলি সহরে সিপাহীদিগকে পরাস্ত করিয়া ৫০০০ সহস্র টাকা লইয়া যায়। 

ওই ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে গোরকপুর জেলার অন্তর্গত নাগর নামক স্থানে কালেক্টরি হইতে প্রেরিত অর্থ আক্রমণ পূর্ব্বক পাঁচজন ধনরক্ষককে হত্যা করিয়া ১৩০০০ তের সহস্র টাকা অপহরণ করে। 

১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি তারিখে ফতেপুর নামক স্থানে সরকারী খাজনা আক্রমণ করিয়া, একজনকে হত, ৮ জনকে আহত পূৰ্ব্বক ৩২৩১ টাকা অপহরণ করিয়া লইয়া যায়। 

১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরক্কাবাদের অন্তর্গত পাতিয়ালি নামক স্থানে সব-কালেক্টারের প্রেরিত অর্থ আক্রমণ করে, ওই আক্রমণে একজন হত ও ৭ জন আহত হয় ও ১১০০০ এগার সহস্র টাকা লইয়া যায়। 

১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জুলাই তারিখে এলাহাবাদের অন্তর্গত ফুলহর নামক স্থানে, দুইজনকে হত ও ১৫ জনকে আহত করিয়া সরকারী অর্থ লইবার চেষ্টা হয়, কিন্তু কেবলমাত্র ১৪টি টাকা ভিন্ন আর কিছুই লইতে সমর্থ হয় নাই। বোধ হয়, ইহার বিশ গুণ ডাকাইতি ওই সময়ে ধনবান ও মহাজনের বাটীতে হইয়াছিল, ও সেই পরিমিত লোকহত্যা ও অর্থ অপহৃত হয়। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দ হইতে ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই সকল ডাকাইতের দল ধ্বংস করিবার নিমিত্ত ইংরাজ গবর্ণমেন্ট অযোধ্যা রাজার সহায়তায় যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছিলেন। দলে দলে সৈন্যসামন্ত প্রেরিত হইয়া ইহাদিগের বাসস্থান আক্রমণ ও উহাদিগের অনেককে ধৃত করিলেও ওই সকল দল একেবারে উচ্ছেদিত হয় নাই। 

ওই সকল দলের দ্বারা এই কয়েক বৎসরের মধ্যে যতগুলি ডাকাইতি হইয়াছিল, ও যত টাকা মূল্যের অর্থ অপহৃত হইয়াছিল, তাহার একটি তালিকা যতদূর সম্ভব সংগ্রহ করিয়া নিম্নে প্রদত্ত হইল। ইহা দেখিলেই পাঠকগণ সেই সময়ের অবস্থা কতক পরিমাণে অবগত হইতে পারিবেন। 

সমস্ত ঘটনা যে এই তালিকাভুক্ত হইয়াছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। দলপতিগণের মুখ হইতে যে সকল কথা জানিতে পারা গিয়াছিল, ও স্থানীয় মাজিষ্ট্রেটকে লিখিয়া যে সকল ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হইয়াছে, কেবল সেইগুলিই এই তালিকায় সন্নিবিষ্ট হইল। 

পাঠকগণ বলিতে পারেন, অত অর্থ হস্তগত করিয়া উহারা ওই সকল অর্থ কি করিল? কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হইবে না, কারণ সকলই অবগত আছেন যে, অর্থ যেরূপে উপার্জ্জিত হয়, তাহার ব্যয়ও সেইরূপ কাৰ্য্যেই হইয়া থাকে। 

সরকার হইতে এত যত্ন করিয়া যে ডাকাইতি একেবারে বন্ধ করিতে পারিয়াছিলেন তাহা নহে। নিম্নের বিবরণগুলি দেখিলেই পাঠকগণ তাহা অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন। 

১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বক্সি নামক একজন দলপতি তাহার কয়েকজন মাত্র অনুচর সমভিব্যাহারে গঙ্গাজল-ভারবাহীরূপে অযোধ্যার জঙ্গল প্রদেশ হইতে বহির্গত হয়। তাহারা তাহাদিগের গন্তব্য পথ দিয়া আপনাদিগের উদ্দেশ্য সাধন করিবার মানসে ধীরে ধীরে গমন করিতে থাকে। রাত্রিকালে নিকটবর্ত্তী জঙ্গল আশ্রয় করিয়া বিশ্রাম করিতে করিতে চলিতে আরম্ভ করে। তাহাদিগের মধ্যে ৩ জন গঙ্গা পার হইয়া সংবাদ সংগ্রহ করিবার মানসে প্রস্থান করে, আর একজন কোন ক্ষুদ্র গ্রাম হইতে একখানি ভাল নৌকা খরিদ করিবার নিমিত্ত গঙ্গার বামদিক অবলম্বন করিয়া চলিতে থাকে। এইরূপে গমন করিতে করিতে যখন তাহারা কানপুর জেলার অন্তর্গত সুরসোল পুলিস থানার অপর পারে একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হয়, সেই সময় উহাদিগের একজন আসিয়া সংবাদ দেয় যে, জনৈক মহাজন মৃজাপুর হইতে ফরক্কাবাদে এক গাড়ি অর্থ পাঠাইয়াছে, ওই গাড়ি সেই দিবস সুরসোলে পৌঁছিলে সকলে থানার নিকট বিশ্রাম করিতেছে। 

এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াই উহারা সেই রাত্রেই ওই ধন আক্রমণের ইচ্ছা করিল। তাহারা যে নৌকা খরিদ করিয়াছিল, তাহা দ্বারা গঙ্গা পার হইল ও ১০/১২ মাইল চলিয়া রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল ও কিছুমাত্র বিলম্ব না করিয়াই ধনবাহীগণকে আক্রমণ পূৰ্ব্বক সাত জনকে আহত করিয়া ধনপূর্ণ বাক্স সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিল ও উহার মধ্যে হাজার টাকা করিয়া ২৫টি তোড়া লইয়া, দ্রুতবেগে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

যখন তাহারা গঙ্গাতীরে আসিয়া উপনীত হইল, তখন সূর্যোদয় হইয়াছিল, সুতরাং ওই অবস্থায় আর অধিক দূর গমন করা নিরাপদ নহে বিবেচনা পূর্ব্বক গঙ্গার ধারে বালুকা মধ্যে ওই সকল অর্থ প্রোথিত করিয়া বিচ্ছিন্ন ভাবে নিকটবর্তী গ্রাম সকলের ভিতর প্রবেশ করিয়া কোন না কোন উপায় অবলম্বন করিয়া দিন অতিবাহিত করিতে লাগিল। রাত্রিকালে সকলে পুনরায় সেই স্থানে প্রত্যাগমন করিয়া, প্রোথিত অর্থ সকল গ্রহণ পূর্ব্বক নদী পার হইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল ও ক্রমে আপনাপন স্থানে উপনীত হইয়া ওই অর্থ খরচ করিয়া হোলীর আমোদ আহ্লাদে প্রবৃত্ত হইল। 

পর বৎসর নভেম্বর মাসে বক্সি তাহার দল লইয়া পুনরায় বহির্গত হইল। তাহার একজন বন্ধু বুধন সিং বক্সির আহ্বানমতে দলসহ মজফর নগর হইতে আসিয়া তাহার সহিত মিলিত হইল। ইহাদিগের দলের ৪০ জন মাত্ৰ লোক এই কার্য্যে সমবেত হইল। 

চাঁদা নামক একজন সর্দ্দার আপন কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া বেরেলির মাজিস্ট্রেট সাহেবের গুপ্ত গোয়েন্দারূপে নিযুক্ত হইয়াছিল। কিন্তু সেই কার্য্য তাহার আর ভাল লাগিল না, সে পুনরায় আপন দল সৃষ্টি করিয়া ৩২ জনের নেতৃত্ব গ্রহণ পূর্ব্বক বক্সির সহিত আসিয়া মিলিত হইল। 

এই তিনজন দলপতি একত্রে কার্যক্ষেত্রে উপনীত হইবার মানসে পৃথক পৃথকরূপে গঙ্গাজলবাহীর বেশে বহির্গত হইল। উহাদিগের দল হইতে নিয়মিতরূপে কেহ কেহ সংবাদ সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইল। বক্সির আদেশমত তাহাদিগের সেই নৌকা এলাহাবাদে নীত হইল। এই স্থানে ওই সমস্ত লোক একত্রিত হইয়া গঙ্গা যমুনার সঙ্গম প্রয়াগ তীর্থে স্নান করিয়া সেই স্থানের প্রয়াগী ব্রাহ্মণদিগকে দানাদি দ্বারা সন্তুষ্ট করতঃ তাহাদিগের নিকট হইতে অভীষ্ট কার্য্যের কৃতকার্য্যের নিমিত্ত আশীর্বাদ গ্রহণ করিল; কিন্তু ব্রাহ্মণগণ জানিতে পারিল না যে, তাহাদিগের অভীষ্ট কার্য্য কি? 

উহারা এলাহাবাদে কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা যুক্তিসঙ্গত নহে বিবেচনা করিয়া সেই স্থান হইতে ব্যবসায়ের প্রধান স্থান মৃজাপুরে আগমন করিল। কিন্তু মুজাপুরে অপেক্ষা না করিয়া গঙ্গা পার হইয়া বিন্ধ্যাচলের অপর পার্শ্বে একখানি গ্রামে তাহারা বিশ্রাম করিতে লাগিল। সেই সময় সংবাদ আসিল যে, মৃজাপুরের একজন মহাজনের বাড়ীতে অনেক অর্থ আছে। এই সংবাদ পাইয়া তাহারা সেই বাড়ীতেই ডাকাইতি করা সাব্যস্ত করিল। 

নৌকা উহাদিগের সঙ্গেই আসিয়াছিল, ওই নৌকার সকলে পার হইয়া, বিন্ধ্যাচলে উপনীত হইল, ও সেই স্থানে বিন্দুবাসিনী দেবীকে পূজা করিয়া সন্ধ্যার পর সেই স্থান হইতে মৃজাপুর অভিমুখে বহির্গত হইল। এক ক্রোশ রাস্তা অতিবাহিত করিয়া তাহারা তাহাদিগের ছদ্মবেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক, কার্য্যের উপযোগী বেশ ধারণ করিয়া যেমন অগ্রসর হইতে লাগিল, অমনি আর একজন সংবাদ লইয়া আসিল যে, রাত্রি ৯টা পর্যন্ত মৃজাপুরের রাস্তায় যেরূপ জনাকীর্ণ থাকে, তাহাতে ওই সময়ের মধ্যে কার্য্যসিদ্ধি করা নিতান্ত সহজ হইবে না। এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া তাহারা এক স্থানে উপবেশন করিয়া রাত্রি ৮টা পর্যন্ত বিশ্রাম করিল ও পরিশেষে সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া আপনাদিগের অভীষ্ট সিদ্ধির মানসে গমন করিতে লাগিল। 

যে বাড়ীতে ডাকাইতি করিবে, সেই স্থানে উপনীত হইয়া উহাদিগের নিয়মানুযায়ী রাস্তা ও বাড়ীর নিকটবর্ত্তী স্থান সকল যেরূপে রক্ষা করিতে হয়, সেইরূপ ভাবে ওই কার্য্যে তাহাদিগের উপর ভার দিয়াছিল, তাহারা সেই কার্য্য সম্পন্ন করিতে নিযুক্ত হইল। সেই সময় মহাজনের বাড়ীর দরজা খোলা ছিল, ওই মুক্তপথে অনেকে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া অনেকগুলি লোককে হত ও আহত করিয়া, বাক্স পেটরা সমস্ত ভাঙ্গিয়া চুরিয়া, ৪০/৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ পূৰ্ব্বক, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া, যে স্থানে ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়াছিল, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল ও সেই স্থানে পূর্ব্বের ন্যায় ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া, তাহাদিগের নৌকায় গঙ্গা পার হইয়া তাহাদিগের আপন স্থানে উপনীত হইল। এই কার্য্যে উহাদিগের একজনও হত বা আহত হয় নাই। 

উহারা নির্বিকার কার্য শেষ করিয়া চলিয়া আসিল সত্য, কিন্তু ওই অর্থ বণ্টনের সময় এক গোলযোগ উত্থিত হইল; কারণ ওই মহাজনের বাড়ী আক্রমণ করিবার পূর্ব্বে বক্সি বলিয়াছিল যে, এই কার্য্যে যে পরিমিত অর্থ পাওয়া যাইবে, তাহার এক পঞ্চমাংশ তাহার পিতা রতিরাম ও তাহার মাতার উদ্ধারের নিমিত্ত একেলা গ্রহণ করিবে। ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে রতিরাম ও তাহার স্ত্রী ধৃত হয়, উহারা এখনও লক্ষ্ণৌ জেলে আবদ্ধ আছে। প্রার্থিত মত টাকা প্রদান করিতে পারিলে, উহাদিগের অব্যাহতি হইবার সম্ভাবনা ছিল। অপর দলপতিদ্বয় প্রথমে ওই অংশ দিতে কোনরূপেই সম্মত হয় নাই, বক্সি উহাদিগের মধ্যে পরাক্রান্ত দলপতি। সে নিজের বলের উপর নির্ভর করিয়া কহিল, তাহার প্রার্থিত মত অর্থ যদি তাহাকে না দেওয়া হয়, তাহা হইলে সমস্ত অর্থই নিজে গ্রহণ করিবে, উহাদিগকে এক পয়সাও প্রদান করিবে না। অগত্যা, অপরাপর সদারগণ বক্সির প্রস্তাবেই সম্মত হইল। 

পিতামাতাকে কারাগার হইতে মুক্ত করিবে বলিয়া বক্সি আট সহস্ৰ মুদ্রা আলাহিদা লইল। সে সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ দলপতি, সুতরাং তাহার নিজের অংশ আরও সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করিল। অবশিষ্ট যাহা রহিল, তাহা সকলের মধ্যে নিয়মিতরূপে বিভাগিত হইল। 

বক্সির অনেক গুলি স্ত্রী ছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই সন্তুষ্ট করিতে, ওই সমস্ত অর্থই ব্যয়িত হইয়া গেল। বুদ্ধ পিতামাতাকে আর জেল হইতে খালাস করা হইল না, তাহারা জেলের মধ্যেই পচিতে লাগিল। 

বক্সি যখন পূৰ্ব্ববর্ণিত কার্য্যে গমন করিয়াছিল, সেই সময় হেমরাজ সিং, তাহার ভ্রাতা মঙ্গল সিং ও তাহদিগের ভাইপো ধরণু, ৪০ জন অনুচর সমভিব্যাহারে আর একদিকে গমন করিয়া ক্রমে কলিকাতার রাস্তায় সেরঘাটীতে আসিয়া উপনীত হয়। উহাদিগের উদ্দেশ্য—কলিকাতা হইতে যে অর্থ বেণারস প্রভৃতি স্থানে প্রেরিত হইবে, তাহার অনুগমন করা ও সুযোগমতে ওই সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করা। 

এই দলের অজানিত আর একটি দল সেই সময় বাহির হইয়াছিল। ওই দলের দলপতি ছিল বরিয়ার নামক এক ব্যক্তি ও তাহার ভাগিনা গরিবা। বরিয়ার ২৫ জনের ও গরিবা ১৪ জনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া বহির্গত হয়। এই গরিবার পিতা নসিবা, বেরেলি জেলার একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী ছিলেন। রাস্তা হইতে এই সারদ্বয় আপনাপন লোকজন লইয়া দুইদিকে গমন করে। বরিয়ার গয়ার রাস্তা অবলম্বন করে, গরিবা গ্রেট ট্রাঙ্ক রোড অবলম্বন পূর্ব্বক সেহের ঘাটীতে আসিয়া উপনীত হয় ও সেই স্থানে মঙ্গল সিংহের দলের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয়। বরিয়ারের সেই সময় উহাদিগের দলের সহিত মিলিত হইবার আশা না থাকায়, গরিবা, মঙ্গল সিংহের দলের সহিত মিলিত হইয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার প্রস্তাব করে। কিন্তু মঙ্গল সিং প্রথমত সেই প্রস্তাবে সম্মত হয় নাই। তাহাতে গরিবা মঙ্গল সিংহকে ধরাইয়া দিবে এইরূপ ভয় প্রদর্শন করায়, পরিশেষে মঙ্গল সিং ওই প্রস্তাবে সম্মত হয়। কিন্তু বলে যে, বরিয়ার যে পৰ্য্যন্ত আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হইতে না পারিবে, তাহার ভিতর কোন কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গেলে বরিয়ার বা তাহার দলস্থিত কোন ব্যক্তি কোনরূপ অংশ প্রাপ্ত হইবে না। 

গরিবা কহিল যে, বরিয়ার বা তাহার কোন অনুচর কোন কার্য্যের সময় উপস্থিত হইতে না পারিলেও, তাহারা নিয়মিতরূপ অংশ প্রাপ্ত হইবে; কারণ—আমাদিগের সকলেরই ইচ্ছা যে, কলিকাতা হইতে যে অর্থ আসিতেছে, সেই অর্থ আত্মসাৎ করা ও এই নিমিত্তই তাহারা সকলে সেইদিকে গমন করিতেছে। এই বিষয় লইয়া যখন উহাদিগের মধ্যে তর্ক বিতর্ক চলিতেছিল, সেই সময় মঙ্গল সিংহের একজন অনুচর আসিয়া সংবাদ প্রদান করিল যে, প্রায় এক শত অস্ত্রধারী পুরুষের রক্ষণাধীনে অর্থ আনীত হইতেছে। এই সংবাদ পাইয়া তাহারা নিয়মিতরূপে শপথ আদি করিয়া ওই কার্যে নিযুক্ত হইল। 

সেইদিবস তাহারা সেহেরঘাট হইতে রওনা হইয়া একটি নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় লইল। পরদিবস আর একজন আসিয়া সংবাদ দিল যে, ধনপূর্ণ শকট সকল আগামী কল্য পাহাড় হইতে অবতরণ পূর্ব্বক বনগাঁও নামক স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইবে এবং সেই স্থানে সকলে বিশ্রাম করিবে। এই সংবাদ পাইয়া মঙ্গল সিং, গরিবা, বধুয়া ও আরও ছয়জন লোক প্রায় ৬০টি বল্লম, ৪টি কুঠারি ও ৩টি মশাল লইয়া গমন করিল। এই সকল দ্রব্য ওই গ্রামের প্রায় তিন মাইল দূরে প্রোথিত করিয়া সেই রাত্রি সেই স্থানে অতিবাহিত করিল। পরদিন প্রাতে ওই ছয়জন লোক ওই স্থান হইতে প্রত্যাগমন করিয়া হেমরাজ ও ধনুকে দলবল সহ সঙ্গে লইয়া পুনরায় সেই স্থানে আসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল। এদিকে মঙ্গল সিং গরিবা ও বধুয়া ওই অর্থবাহী দলের সহিত মিলিত হইবার অভিপ্রায়ে সেই পাহাড় আরোহণ করিতে আরম্ভ করিল। দূর হইতে যেমন দেখিতে পাইল যে, অর্থবাহী দল অগ্রসর হইতেছে, অমনি তাহারা একটু অন্তরালে গিয়া উহাদিগের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। উহারা নিকটে আসিলে উহাদিগের সহিত মিলিত হইল ও কহিল যে, উহারা যেদিক হইতে আসিতেছে, তাহারাও সেইদিক হইতে আসিতেছে। ওই দলের সহিত অর্থ বোঝাই আটখানি শকট ছিল। উহারাও ওই দলের সহিত মিলিত হইয়া গমন করিতে লাগিল। যখন দেখিল যে উহারা রাত্রিতে বিশ্রাম করিবার স্থান স্থির করিয়া বিশ্রাম করিতে প্রবৃত্ত হইল, তখন তাহারা ওই স্থানের অবস্থা উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিয়া যেস্থানে তাহাদিগের দলবল ছিল, সেই স্থানে প্রত্যাগমন করিল। ধনবাহীগণ যে স্থানে বিশ্রাম করিতে প্রবৃত্ত হইল, সেই স্থান পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বে একজন করপোরাল ও চারিজন সিপাহীর রক্ষাধীনে এক সহস্র মুদ্রা ওই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। উহা গবর্ণমেন্টের টাকা, সেহেরঘাটী হইতে হাজারিবাগে, রাস্তা মেরামতের খরচের জন্য প্রেরিত হইয়াছিল। যে স্থানে এ আট গাড়ি অর্থ ও তাহার রক্ষীগণ ছিল, তাহার প্রায় বিংশতি হস্ত দূরে এই সরকারী অর্থবাহীগণও বিশ্রাম করিতে লাগিল। সদারগণ ইহা দেখিয়া আপন দলবলের নিকট প্রত্যাগমন করিল। 

রাত্রি দশটার সময় এই সকল অর্থবাহীগণকে আক্রমণ করিবে, এইরূপ স্থির করিয়া সকলে প্রস্তুত হইয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। গরিবা ও তাহার বাছা বাছা কয়েকজন লোকের উপর ইহার ভার পড়িল। গরিবা ওই সরকারী সিপাহীদিগকে আক্রমণ করিয়া করপোরাল ও চারিজন শাস্ত্রীকে হত্যা করিয়া তাহাদিগের তরবারি বন্দুক প্রভৃতি আত্মসাৎ করিল। ওদিকে অপর সদারগণ মশাল জ্বালিয়া সদলবলে একেবারে ওই এক শত ধনরক্ষীগণকে আক্রমণ করিল। তাহারা একজন সিপাহী ও একজন দোকানদারকে হত্যা ও ১৬ জন সিপাহীকে গুরুতররূপে আহত করিয়া তাহাদিগকে পরাস্ত পূর্ব্বক তিনখানি গাড়ি হইতে কেবলমাত্র ২৮ তোড়া মুদ্রা গ্রহণ করিল। উহার প্রত্যেক তোড়ায় দুই হাজার পাঁচ শত করিয়া টাকা ছিল। ইহার অধিক বহন করিয়া নিরাপদে পলায়ন করিবার ক্ষমতা না থাকায়, উহারা অধিক অর্থ গ্রহণ করিল না। 

ইহারা যে স্থান হইতে ওই রাত্রিতে সেই স্থানে গিয়াছিল, সেই স্থানে প্রত্যাগমন করিল। এই আক্রমণে গরিবা তাহার নিজের দলের কোন লোকের অসাবধানতার সামান্য আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছিল, তৎ ব্যতীত আর কেহই হত বা আহত হয় নাই। 

এই ঘটনা ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখের রাত্রে সংঘটিত হয়। 

ওই স্থানে প্রত্যাগমন করিয়া উহারা দেখিল যে, উহারা ৭০০০০ সত্তর হাজার টাকা আনিতে সমর্থ হইয়াছে। মঙ্গল সিং ও হেমরাজ তাহাদিগের নিজের অংশ গ্রহণ করিয়া, অবশিষ্ট গরিবাকে লইতে কহিল, ও বলিল, তুমি তোমার অংশ গ্রহণ কর ও বরিয়ার ও তাহার পঁচিশজন অনুচরের অংশ তুমি বহন করিয়া লইয়া গিয়া তাহাকে দিও। গরিবা কেবলমাত্র দুই তোড়ায় পাঁচ হাজার টাকা গ্রহণ করিল ও কহিল, বরিয়ারের ও তাহার নিজের অবশিষ্ট অংশ তোমরা বহন করিয়া লইয়া গিয়া তাহাকে দিও। 

মঙ্গল সিং এই প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায়, উহাদিগের মধ্যে একরূপ মনোবিবাদ বাধিল। পরিশেষে উহাদিগের অংশ ত্রিশ হাজার টাকা মঙ্গল সিং সেই স্থানে প্রোথিত করিয়া আপন অংশ লইয়া প্রস্থান করিল। গরিবাও বরিয়ারের অনুসন্ধানের নিমিত্ত বহির্গত হইল ও গয়ার দক্ষিণ টিকারী নামক স্থানে অনুচরবর্গের সহিত তাহার সাক্ষাৎ পাইল। 

রহিলখণ্ডের মধ্যস্থিত সাজাহানপুর জেলার অন্তর্গত কোটার নামক স্থানের রাজা সিয়াল সিং সেই সময় তীর্থ ভ্রমণার্থে গয়ায় আসিয়া উপনীত হইয়াছিলেন। ইহাকে মেহেরবান সিংহের ন্যায় রাজা জ্ঞান করিয়া গয়ার মাজিষ্ট্রেট তাঁহার লোকজনের সহিত তাঁহাকে ধৃত করিয়া কিছুদিবস পর্য্যন্ত কয়েদ করিয়া রাখিলেন ও পরিশেষে যখন জানিতে পারিলেন যে, ইনি ডাকাইতের সর্দ্দার নহেন, প্রকৃতই কোটার নামক স্থানের রাজা, তখন তাঁহাকে সসম্মানে অব্যাহতি দেওয়া হইল। 

বরিয়ার আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিয়া আপনার অংশ প্রার্থনা করিল। মঙ্গল সিং সেই সময় তাহাকে দুই সহস্র মাত্র অর্থ প্রদান করিয়া অবশিষ্ট প্রোথিত অর্থ আনিবার নিমিত্ত বরিয়ার ও অপরাপর লোকের সহিত সেই মাসের শেষে বহির্গত হইল। গরিবা সেই সময় পীড়িত হইয়া শয্যাগত হইয়া পড়িয়াছিল। যে স্থানে ওই অর্থ প্রোথিত করিয়া রাখিয়াছিল, সেই স্থানে গমন করিয়া ওই অর্থ বাহির করিল, কিন্তু দেখিল যে, উহার মধ্য হইতে দ্বাদশ সহস্র মুদ্রা নাই। বরিয়ার মঙ্গল সিংহের উপর দোষারোপ করিয়া কহিল, ওই দ্বাদশ সহস্র মুদ্রা প্রোথিত করিবার সময় মঙ্গল সিং চুরি করিয়াছে। মঙ্গল সিং, ওই অর্থের কথা কিছুমাত্র অবগত নহে। সুতরাং যাহা পাওয়া গেল, তাহাই লইয়া সকলে প্রত্যাগমন করিল। ইহাতে উভয়ের মধ্যে যে মিটমাট হইয়া গেল তাহা নহে, উহাদিগের মধ্যে অনেক বাদানুবাদের পর তাহাদিগের সকলের পৃষ্ঠপোষক ডেরা-জগদীশপুরের রাজা গঙ্গা সিং ও তাঁহার মন্ত্রী চন্দন সিংহের নিকট বরিয়ার গিয়া নালিস করিল, ও তাঁহাকে ধৰ্ম্মতঃ বিচার করিতে কহিল। মঙ্গল সিং পীড়িত বলিয়া তাঁহার নিকট গমন করিল না, কিন্তু তাহার সহিত যাহারা গমন করিয়াছিল, ও যাহারা ওই অর্থ প্রোথিত করিয়াছিল, তাহাদিগের অনেককেই বরিয়ার, রাজার নিকট হাজির করিল। 

রাজা এই বিচারের ভার দেবতার হস্তে অর্পণ করিলেন; ও এইরূপ সাব্যস্ত হইল যে, যাহারা ওই অর্থ প্রোথিত করিয়াছিল, তাহারা লৌহনিৰ্ম্মিত জ্বলন্ত গোলক হস্তে লইয়া কিয়ৎ দূর গমন করিবে, ইহাতে যাহার হস্ত পুড়িয়া যাইবে, সাব্যস্ত হইল যে, সেই চোর, তাহাকে ওই দ্বাদশ সহস্র অপহৃত মুদ্রা ও পাঁচ শত টাকা সরকারী জরিমানা প্রদান করিতে হইবে। মঙ্গল সিংহের যে সাতজন লোক অর্থ সকল প্রোথিত করিয়াছিল, তাহারাও এই প্রস্তাবে সম্মত হইল অর্থাৎ জ্বলন্ত লৌহ গোলক হস্তে লইয়া নিৰ্দ্ধারিত স্থান পৰ্য্যন্ত যাইতে সম্মত হইল। রাজা কহিলেন, এইরূপ উপায়েই বিচার ঠিক হইবে। কারণ ঈশ্বর সর্ব্বজ্ঞ, কাহার দ্বারা এই কার্য্য হইয়াছে, তাহা তিনিই জানেন, সুতরাং তিনি তাহারই হাত পুড়াইয়া দিবেন ও নির্দোষীকে নিশ্চয়ই রক্ষা করিবেন। 

এইরূপ সাব্যস্ত হইবার পর একজন কামার ডাকাইয়া একটি লৌহ গোলক প্রস্তুত করা হইল, ও উহা অগ্নির উপর গরন করিয়া একটি বড় চিমটার দ্বারা উহাদিগের প্রত্যেকের হস্তে পর পর প্রদান করা হইল। হাতের উপর যেমন একটি একটি বটপত্র রহিল, উহার উপর ওই উত্তপ্ত লৌহ গোলক ধারণ করিয়া যে কয় পদ গমন করিবার স্থিরতা হইয়াছিল, সেই কয় পদ গমন করিতে লাগিল। ইহাতে কাহারও হস্ত পুড়িল না, কেবল বধুয়া ও নন্দরাম নামক দুই ব্যক্তির হস্ত পুড়িয়া গেল। সুতরাং ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, উহারাই ওই অর্থ অপহরণ করিয়াছে, উহাদিগের নিকট হইতে জরিমানা পাঁচ শত টাকা আদায় করা হইবে। বরিয়ারের উপর আদেশ হইল যে, যেরূপে হউক, সে উহাদিগের নিকট হইতে ওই টাকা আদায় করিয়া লইতে পারে। 

বরিয়ার উহাদিগকে আপন স্থানে লইয়া গিয়া ওই টাকার নিমিত্ত কয়েক মাস কয়েদ করিয়া রাখিল। পরিশেষে টাকা সংগ্রহ করিয়া প্রদান করিলে উহারা অব্যাহতি পাইল। 

এই বধুয়া পরিশেষে একজন সদাররূপে পরিগণিত হইয়াছিল। এই ঘটনার প্রায় ৮ বৎসর পরে যখন সে ধৃত হয়, তখন তাহার হস্তে সেই পোড়ার দাগ বিদ্যমান ছিল। সেই সময় সে শ্লিমেন সাহেবকে আপনার হস্ত দেখাইয়া বলিয়াছিল যে, সেই সময় দেবতা যে বিচার করিয়াছিলেন, তাহা ঠিকই করিয়াছিলেন। তাহারাই উহা উঠাইয়া লইয়াছিল। কিন্তু অপর দু হাজার টাকা যে কি হইল তাহা তাহারা অবগত নহে। 

ওই ডাকাইতগণ কর্তৃক আর যে কোথাও ডাকাইতি হয় নাই তাহা নহে। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর তারিখে গোরকপুর জেলার অন্তর্গত আমোদা নামক স্থানে সরকারী টাকা আক্রমণ করিয়া চারিজনকে হত ও নয়জনকে আহত পূৰ্ব্বক ওই টাকা আত্মসাৎ করে। 

১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারি তারিখে মইনপুরী জেলার অন্তর্গত সাকিত নামক স্থানে দুইজনকে হত ও বারজনকে আহত করিয়া ১৭৪১৪ টাকা লইয়া প্রস্থান করে। 

১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি তারিখে হমিরপুর জেলার অন্তর্গত মোদা নামক স্থানে একজন হত ও পাঁচজনকে আহত করিয়া ৩২৬৮ সরকারী টাকা অপহরণ করিয়া লয়। 

১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে গোরকপুর জেলার অন্তর্গত সিপারিয়া নামক স্থানে সরকারী টাকা আক্রমণ করে, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারে নাই। ইহাতে কেবল একজন মাত্র হত হয়। 

১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারিতে উহারা মইনপুরী জেলার অন্তর্গত গাড়োয়াল নামক স্থানে একজনকে হত ও ১০১ জনকে আহত করিয়া সরকারী ১৪৬১১ টাকা লইয়া প্রস্থান করে। 

১৮৩৬ সালে উহারা মৃজাপুর জেলার অন্তর্গত কাচুয়া নামক স্থানে দুইজনকে হত ও আট জনকে আহত করিয়া কালেক্টারের প্রেরিত ৯১০ টাকা লইয়া যায়। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

গত অভিযানে কৃতকাৰ্য্য হইয়া বক্সি ও তাহার অনুচরবর্গ এইরূপ মনস্থ করিলেন যে, গঙ্গার দক্ষিণ পার্শ্বে কানপুরের পল্টনের ছাওনির সন্নিকটে বিথোর নামক স্থানে ভূতপূর্ব্ব পেযোয়া বাজি রাওয়ের যে সমস্ত সঞ্চিত সুবর্ণ-মুদ্রা আছে, তাহার কিয়দংশ আত্মসাৎ করিতে হইবে। এইরূপ স্থির করিয়া, তাহার উপযুক্ত বন্দোবস্ত করতঃ ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ ভাগে, একটি প্রকাণ্ড দল লইয়া বহির্গত হইলেন ও ক্রমে গগাও নামক পল্লীর অল্প দূরে লালবাগ নামক স্থানের জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। 

মৃজাপুর ডাকাইতিতে বক্সি যেরূপ অন্যায় আচরণ করিয়াছিল, পুনরায় যাহাতে সেইরূপ আচরণ করিতে না পারে, এই নিমিত্ত ওই লালবাগ নামক স্থানে পুনরায় সকলে কঠিন প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয় ও সেই স্থানে ইহাও স্থিরীকৃত হয় যে, কোন্ কোন্ ব্যক্তি কি পরিমাণে অংশ প্ৰাপ্ত হইবে। 

এই সমস্ত স্থিরীকৃত হইলে বক্সির প্রথম পুত্র মহাজিৎ, রামলাল ও চারি পাঁচজন সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া কানপুর ও বিথোরের সংবাদ উত্তমরূপে সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত প্রস্থান করেন। যে কেহ যে কোন স্থানে গমন করুক না কেন, নেউলগঞ্জ নামক স্থানে সকলে একত্রিত হইবে, এই কথা রহিল। ক্রমে সকলেই যথাস্থানে একত্রিত হইল। 

ইহাই সাব্যস্ত হইয়াছিল যে, তাহাদিগের নিজের একখানি নৌকা ও কিছু হাতিয়ার ভিন্ন এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা উচিৎ নহে, সুতরাং বক্সি তাহার পুত্রকে এক শত টাকা প্রদান করেন, উহার ৫০ টাকা দিয়া একখানি ক্ষুদ্র নৌকা ও অবশিষ্ট ৫০ টাকার দ্বারা ছয়টি বন্দুক, একটি পিস্তল এবং বল্লমের হাতলের নিমিত্ত কয়েকখানি বাঁশ কামার হইতে সংগ্রহ করিয়া ওই নৌকাযোগে ৩ জন লোক মারফৎ উহা প্রেরণ করা হয়। 

এতদূর পর্য্যন্ত বক্সির স্ত্রী তাহার সঙ্গেই ছিল, কিন্তু কার্য্যের সমস্ত নিকটবর্ত্তী দেখিয়া তাহাকে বাটীতে ফেরৎ পাঠান হয়। 

ক্রমে বক্সি তাহার দলবল লইয়া বিথোরের ছয় মাইল দূরবর্তী একটি স্থানে গিয়া উপস্থিত হয়। তাহার পুত্র মহাজিৎ, নৌকা ও অস্ত্রাদির সহিত ইতিপূর্ব্বে সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। ওই স্থানে উপস্থিত হইয়া তাহাদিগের কাপড় ও গঙ্গাজল বহন করিবার ঝুড়ি প্রভৃতি সেই স্থানে দুইজনের নিকট রাখিয়া অবশিষ্ট সকলে সন্ধ্যার পর, ওই নৌকায় গঙ্গা পার হইল। 

১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারি রাত্রি ১০টার সময় উহারা ভূতপূর্ব্ব পেযোয়ার আবাস স্থলে আসিয়া তাঁহার ২৭৫০০০ টাকা লুট করিল। 

এই কার্য্য সমাপন করিয়া তাহারা ওই নৌকাযোগে পুনরায় গঙ্গা পার হইয়া উহা গভীর জলে ডুবাইয়া দেয়। অনন্তর যেস্থানে তাহারা গঙ্গাজল বহনের দ্রব্যাদি রাখিয়া আসিয়াছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া আপন আপন দ্রব্যাদি গ্রহণ করিয়া গঙ্গাজলবাহীরূপে পুনরায় গমন করিতে আরম্ভ করে। এইরূপে ১৪ মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া, তাহারা একটি জঙ্গলে গিয়া উপনীত হয়। সেই স্থানে তাহারা ৩০,০০০ টাকা প্রোথিত করিয়া রাখিয়া অবশিষ্ট অর্থ সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। ছয় দিবস কাল অনবরত চলিয়া ক্রমে তাহারা রাজা মহম্মদ হোসেনের রাজ্য, মহমদীর অন্তর্গত, জালালপুরের নিকটবর্ত্তী ভোতা নামক গ্রামে গিয়া উপস্থিত হয়। সেই স্থানে লালা হুলাসি নামক এক ব্যক্তির নিকট ওই সকল গঙ্গাজল বহনের দ্রব্যাদি রাখিয়া দেয়। ওই ব্যক্তি বক্সির সমস্ত হিসাবপত্র রাখিত। পরদিবস চিয়ারায়তি নামক স্থানে একটি পুষ্করিণীর তীরে বসিয়া ওই অপহৃত অর্থের কিয়দংশ সকলের মধ্যে বিভাগিত হয়, অবশিষ্ট পরে বিভাগ করিয়া লওয়া হইবে এই স্থির হওয়ায় উহা অবিভাগিত অবস্থাতেই থাকে। পরদিবস উহারা আপনাদিগের বাসস্থান জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিলে সেই স্থানের সমস্ত স্ত্রীলোকগণ একত্রিত হইয়া বিজয়-গীতি গাহিতে গাহিতে উহাদিগকে অভিনন্দন করিল। তাহারাও ওই সকল স্ত্রীলোক ও বালকদিগকে সন্দেশ খাইবার নিমিত্ত ১৫টি সুবর্ণ ও ২০টি রৌপ্য মুদ্রা প্রদান করিল। এইরূপে সকলে আপনাপন বাড়ীতে উপনীত হইবার পর অবশিষ্ট অর্থ সকলের মধ্যে বিভাগিত করিয়া লইল। 

সম্পূর্ণ 

[ ফাল্গুন, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *