সেকুলার স্টেট
১
সেকুলার স্টেট-এর বাংলা কী?
যে দু-একজন মন্ত্রী সরকারি নথিপত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে থাকেন তাঁদের একজনকে লিখতে দেখা গেল—ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুগ্ধ হলুম তাঁর ভাষাপ্রেম লক্ষ করে। নিজে কিন্তু ইংরেজিতে লিখলুম সেকুলার স্টেট।
কেন? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কী দোষ করল? অন্তত লৌকিক রাষ্ট্র তো খবরের কাগজের দৌলতে বাজার-চলতি হয়ে গেছে। এর কোনোটা পছন্দ না হলে হাতের কাছে টেলিফোন তো ছিল, রাজশেখর বসু মহাশয়কে টেলিফোনে স্মরণ করলে খাপসই একটা পারিভাষিক শব্দ পেতে কতক্ষণ লাগত? সংস্কৃত ভাষার অন্তহীন ধ্বনিভান্ডারে শব্দের অভাব কবে ঘটল?
চেষ্টা করলে যেকোনো বিদেশি শব্দকে স্বদেশি ভাষায় অন্তরিত করা যায়। কিন্তু শব্দ যেখানে আসল নয়, অর্থ যেখানে আসল, আইডিয়া যেখানে আসল, সেসব জায়গায় বিদেশির বদলে স্বদেশি ব্যবহার করলে ভাষান্তরের সঙ্গে সঙ্গে ভাবান্তর ঘটা বিচিত্র নয়। বিশেষত শব্দের পিছনে যদি বহু শতকের সংগ্রামের বা সংঘাতের ইতিহাস থাকে তবে তো প্রতিশব্দের মধ্যে সেই ঘাত-প্রতিঘাতের আভাসটুকুও মেলে না।
সেইজন্যে আমি সেকুলারের বাংলা ধর্মনিরপেক্ষ বা লৌকিক লিখতে রাজি নই। তা ছাড়া আরও কারণ আছে। খোদ সেকুলার কথাটি আমাদের কাছে নতুন। পাঁচ বছর আগে জওহরলাল একদিন সেটি ব্যবহার করলেন, দেশবিভাগের পূর্বাহ্নে। দেশবিভাগের পরে গান্ধীজিকে সেটি ব্যবহার করতে দেখা গেল। এতদিন আমরা শুনে আসছিলুম যে স্বরাজ বলতে বোঝাবে রামরাজ্য। শুনলুম রামরাজ্য নয়, সেকুলার ডেমোক্রেসি বা সেকুলার স্টেট। রামরাজ্যের পালটা রহিমরাজ্যের চেহারা দেখে আমাদের নেতাদের তাক লেগে যায়। কে জানে রামরাজ্য হয়তো দু-দিন পরে হনুমদ রাজ্যে পরিণত হত। তাই রাতারাতি সেকুলার বিশেষণটি উড়ে এসে জুড়ে বসল। অভিধানে এর সঙ্গে আমাদের মুখ চেনা ছিল। কিন্তু জীবনে পরিচয় ছিল না। এই নবাগতের সঙ্গে আমাদের কীসের প্রয়োজন তাও আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়নি। এর তাৎপর্য নিয়ে যখন তর্ক উঠল তখন এক একজন এক একরকম ব্যাখ্যা দিলেন। গান্ধীজি তখন নেই। তাঁর এক বিশিষ্ট অনুচর নিজস্ব অভিমত জানিয়ে বললেন, ইংরেজিতে সেকুলার শব্দের অর্থ যা-ই হোক-না কেন আমরা তো ও-শব্দ অন্য অর্থে ব্যবহার করতে পারি।
এইখানেই বিপদ। ইংরেজিতে ডেমোক্রেসি শব্দের অর্থ যা-ই হোক-না কেন স্টালিন তা অন্য অর্থে ব্যবহার করছেন। মাও সে তুং করছেন অন্য অর্থে। তেমনি আমাদের সম্পাদক ও রাজনীতিকরা যদি সেকুলার শব্দের অন্য অর্থ করেন তাহলে আশ্চর্য হব না। কিন্তু শঙ্কিত হব। কারণ সেকুলার শব্দটি খামোকা আসেনি। ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে এর প্রবেশ যদিও অকস্মাৎ তবু আকস্মিক নয়। হিন্দু-মুসলমানের মাথাকাটাকাটি কি কেবল দেশবিভাগের দ্বারা এড়াতে পারা যায়? এর স্থায়ী সমাধান হচ্ছে সেকুলার মনোভাব। যে মনোভাব ইউরোপে এসেছে বহু শতকের রক্তাক্ত সংঘর্ষের ফলে। যার অন্য অর্থ নেই।
কিন্তু কী এর প্রকৃত অর্থ?
এর উত্তর দিতে হলে দু-তিন হাজার বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে হয়। প্রথমত, পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাস মায় আমেরিকার ইতিহাস। দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষের ইতিহাস।
পশ্চিম ইউরোপের লোক যখন খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে তখন ধর্মগুরু ও ধর্মসংঘের প্রতি তাদের সকলের আনুগত্য দেখে খ্রিস্টেনডম বা খ্রিস্টরাজ্য নামক ধারণাটি মানুষের মনে বসে যায়। রাজা একাধিক, কিন্তু পোপ এক। রাষ্ট্র একাধিক, কিন্তু চার্চ এক। প্রত্যেক দেশেই পোপের অধীনস্থ ধর্মযাজকের দল একজোট হয়ে কাজ করে যায়, এক দেশ থেকে আরেক দেশে বদলি হয়, ল্যাটিন ভাষায় উপাসনা করে, ল্যাটিন ভাষায় নাম রাখে। চার্চের তুলনায় রাষ্ট্র অনেকটা ক্ষীণবল, রাজা অনেকসময় চার্চের হাতের পুতুল। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চার্চ তার নিজের আদালত বসায়, বিচার করে, দন্ড দেয়, আগুনে পোড়ায়, খাজনা আদায় করে। এমন এক সময় আসে যখন দেখা যায় পোপের হাতে কেবল নৈতিক বা সামাজিক ক্ষমতা নয়, রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষমতাও এসে পড়েছে। কেউ যদি বিধর্মী হয় তাকে তিনি কেবল সমাজচ্যুত করে ক্ষান্ত হবেন না, ধনে-প্রাণে ধ্বংস করবেন। পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘুরছে কেউ যদি এই তত্ত্ব অস্বীকার করে বলে সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে তাহলে আর রক্ষা নেই। অমনি বিধর্মী হয়ে গেল। চিন্তার স্বাধীনতা, বাক্যের স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা, সব কিছু ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এবং ধর্ম বলতে বোঝায় ধর্মগুরু ও ধর্মসংঘ। এবং তাঁদের হাতে ইহলোকের পরলোকের সবরকম যন্ত্রণার যন্ত্র।
হাজার বছর ধরে এই অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট চলল। এর ভালো দিক যে ছিল না তা নয়। মধ্যযুগের অসভ্যতার অন্ধকারে সভ্যতার দীপ জ্বালিয়ে রেখেছিল চার্চ, যদিও তাতে অন্ধকার যায়নি। বহুচারী ক্ষত্রিয়দের এক বিবাহে বাধ্য করাও সামান্য কীর্তি নয়। প্রায় দু-হাজার বছর আগে রোমান চার্চ যা পেরেছে প্রায় দু-হাজার বছর পরেও দিল্লির কংগ্রেস সরকার তা পারছেন না। হিন্দুরাজ, মোগলরাজ, ব্রিটিশরাজও পারেননি। করাচির নয়া মুসলিমরাজ তো তার কাছ দিয়েও যাচ্ছেন না। কাজেই রোমান চার্চের কৃতিত্বের প্রশংসা করতেই হয়। তা সত্ত্বেও পশ্চিম ইউরোপের অর্ধেক দেশ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে সামাজিক মানসিক বাচনিক স্বাধীনতার অভাবে। রেনেসাঁস তাদের চোখ ফুটিয়ে দেয়। রেনেসাঁসের ন্যায়সঙ্গত পরিণতি রিফর্মেশন। পোপের বিরুদ্ধে, রোমান চার্চের বিরুদ্ধে, ল্যাটিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। পোপের রাজকীয় ক্ষমতাই তাঁর কাল হল। গুরুমহারাজ যদি সত্যিকারের মহারাজ হয়ে ওঠেন তাহলে সত্যিকারের মহারাজের দল কি তা সহ্য করতে পারেন? ইংল্যাণ্ডের অষ্টম হেনরি যে প্রজাবন্ধু ছিলেন তা নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থেই তিনি পোপের শত্রু হন। তাঁর প্রজারা তবু তাঁকে সমর্থন করে। ইংল্যাণ্ডের খ্রিস্টানরা দেখতে দেখতে প্রোটেস্টান্ট হয়ে যায়। ক্যাথলিকরা হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অবাক কান্ড! কেবল ইংল্যাণ্ড নয়, জার্মানি, হল্যাণ্ড, নরওয়ে, সুইডেন ইত্যাদি বহু দেশ পোপের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। নিজেদের এক-একটা চার্চ খাড়া করে। সেখানেও শেষ নয়। সরকারি চার্চ প্রায় রোমান চার্চের মতো হস্তক্ষেপকারী বলে সরকারি চার্চ থেকেও বহু লোক নাম কাটিয়ে নেয়। তাদের ছোটো ছোটো সম্প্রদায় না মানে গুরুমহারাজকে না মানে রাজা মহারাজকে; অবশ্য ধর্মের ক্ষেত্রে।
এসব একদিনে হয়নি, বিনা দ্বন্দ্বেও হয়নি। ঘোরতর মারামারি কাটাকাটি ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে চলে। আমরা আর কতটুকু রক্তারক্তি করেছি। মানুষের মাংস তো আর খাইনি। জার্মানরা না-কি তাও করে দেখেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই স্থির হল যে ইংল্যাণ্ডের মতো দেশে পোপের চেয়ে রাজা বড়ো, রাজার চেয়ে প্রজা বড়ো। প্রথম চার্লসের মাথা কেটে ও দ্বিতীয় জেমসকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে ইংল্যাণ্ডের লোক কেবল পোপকে নয়, রাজাকেও সমঝিয়ে দেয় যে সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই। প্রজাপ্রভাবিত রাষ্ট্রই হল চার্চের চেয়ে বড়ো। প্রজাদের রাষ্ট্র ধীরে ধীরে অলক্ষিতে সেকুলার স্টেট হয়ে ওঠে। এক শতক পরে যখন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তার মূলনীতি হয় সেকুলারিজম। তার কিছুদিন পরে যখন ফরাসি বিপ্লব ঘটে তখন সেকুলারিজমের জয়জয়কার। ইংল্যাণ্ডে যা প্রচ্ছন্ন ছিল ফ্রান্সে তা প্রকট হল। প্রজারা যদি নাস্তিক হয়, ধর্ম বলে কিছু না মানে, তাহলেও তারা রাজ্যের অধিকারী। রাষ্ট্র তাদের চিন্তায়, বাক্যে ও আইনসঙ্গত কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করবে না। চার্চ থাকতে পারে, কিন্তু কোনোরকম পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করবে না, বিশেষ অধিকার প্রত্যাশা করবে না। প্রজাদের কার কী ধর্ম, আদৌ কোনো ধর্ম আছে কি না, এ প্রশ্ন উঠবে না। ধরে নিতে হবে যে, ধর্ম তাদের ঘরোয়া ব্যাপার। পাবলিক নয়, প্রাইভেট ব্যাপার। যার কোনো ধর্ম নেই সেও সরকারি চাকরি করতে পারে, সেনাপতি হতে পারে, সেও নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে, প্রেসিডেন্ট হতে পারে, সেও দেশশাসন করতে পারে, প্রধানমন্ত্রী হতে পারে।
ফরাসি বিপ্লবের পর আরও এক শতক লাগল এ নীতি বলবৎ করতে। ফরাসিদের দেশে দ্রেফু নামে এক ইহুদি মিলিটারি অফিসার ছিলেন, তাঁর একমাত্র অপরাধ তিনি ইহুদি। ওই অপরাধে তাঁকে সৈন্যবিভাগ থেকে বিদায় করা যায় না। মিথ্যা মামলা সাজানো হল, তাও প্রকাশ্য আদালতে দায়ের করার মতো সৎসাহস ছিল না, সামরিক আদালতের বিচারে বা অবিচারে দ্রেফুর হয়ে গেল দ্বীপান্তর। দুনিয়ার লোক জানল বিশ্বাসঘাতকের উপযুক্ত দন্ড হয়েছে। কিন্তু ফ্রান্সের যাঁরা বিবেকী ব্যক্তি তাঁরা ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারলেন নিরপরাধের সাজা হলে কেউ নিরাপদ নয়, নিরপরাধ এক্ষেত্রে ধর্মভেদের জন্যে দন্ডিত, সুতরাং সেকুলার স্টেট বিপন্ন। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এমিল জোলা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে অপরিচিত এক ইহুদি অফিসারের পক্ষ নিয়ে বিশ্বের জনমতের সামনে নিজের দেশের রাষ্ট্রনায়কদেরই অভিযুক্ত করলেন, তখন রাগের চোট পড়ল জোলার ওপরে। জোলার আত্মত্যাগ ব্যর্থ গেল না। শিক্ষিত ফরাসি মাত্রেই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। যেন একটি মানুষের প্রতি সুবিচার-অবিচারের ওপর একটি জাতির সুনাম-দুর্নাম নির্ভর করছে। বারো বছর ধরে অবিরাম আন্দোলন চলে। দ্রেফুকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করা হয়।
দ্রেফু যদি ইহুদি না হয়ে ক্যাথলিক হয়ে থাকতেন তাহলে ব্যাপার এতদূর গড়াত না। বিপ্লবের দেশ ফ্রান্স, সেখানেও মানুষের ধর্ম সম্প্রদায় বিচার করে মামলার বিচার হয়। এই বারো বছরে ফ্রান্স তার আত্মাকে আবিষ্কার করল। ফ্রান্সের দৃষ্টান্ত অন্যান্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করল। সেকুলার স্টেট এই অগ্নিপরীক্ষায় সীতার মতো উত্তীর্ণ হল। পশ্চিম ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ এদিক দিয়ে জয়ী হয়েছে। রুশ বিপ্লবের পর রুশ পরিচালিত সোভিয়েত ইউনিয়নেও। আমেরিকার তো কথাই নেই। ফরাসি বিপ্লবের আগে আমেরিকার স্বাধীনতা, গোড়া থেকেই সেখানে সেকুলার স্টেট। নিছক ধর্মবিশ্বাসের দরুন সেখানকার কোনো প্রজা রাষ্ট্রের দরবারে ছোটো বা বড়ো নয়, ধর্মাধিকরণে তো নয়ই। কে ক্যাথলিক, কে প্রোটেস্টান্ট, কে ইহুদি এসব বাছবিচার ঘরে চলতে পারে, বাইরে চলে না। বর্ণবিদ্বেষ অবশ্য আছে, কিন্তু সেটা অপ্রাসঙ্গিক।
২
এবার ভারতবর্ষের ইতিহাস। পশ্চিম ইউরোপে যেমন এককালে একটি মাত্র ধর্ম ছিল, একজন মাত্র ধর্মগুরু ছিলেন, একটি মাত্র ধর্মসংঘ ছিল, এদেশে তেমন নয়। কোনোকালেই নয়। সাধারণত যাকে হিন্দু ধর্ম বলা হয়ে থাকে তা একাধিক ধর্মের সমবায় বা সমন্বয় সেই আদি যুগ থেকে। হিন্দু পোপ বা হিন্দু চার্চ কোনোদিন কেউ কল্পনাও করেনি, তবে হিণ্ডুডম বলে একটা ধার-করা বুলি কিছুদিন আগে শোনা যাচ্ছিল বটে।
ইসলামেও পোপের অনুরূপ বা চার্চের অনুরূপ নেই, তবে খলিফা বলে একজন ছিলেন, কিন্তু ভারতের সুলতান ও বাদশাহদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এত কম ছিল যে সংঘর্ষের উপলক্ষ্য কোনোদিন ঘটেনি।
পোপ বা চার্চ না থাকলেও আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, উলেমা ছিলেন। এঁদের প্রভাব কেবল আধ্যাত্মিক বা পারলৌকিক ব্যাপারে নিবদ্ধ ছিল না, জীবনের প্রত্যেকটি ব্যাপারে প্রসারিত ছিল। এমন কোনো হিন্দু রাজার নাম জানিনে যিনি ব্রাহ্মণপ্রাধান্য অস্বীকার করেছিলেন, এমন কোনো বৌদ্ধ নরপতির নাম জানা নেই যিনি শ্রমণপ্রাধান্য উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন। আকবরই বোধ হয় একমাত্র মুসলমান সম্রাট যিনি উলেমাপ্রাধান্য কাটিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই একটা নতুন ধর্ম প্রবর্তন করে পোপ হয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। এর নাম সেকুলার স্টেট নয়।
অপরপক্ষে আমাদের রাজারাজড়াদের সংযত করাও আমাদের ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, উলেমাদের সাধ্যের অতীত ছিল। তাঁরা যা-খুশি করতে পারতেন, যাকে খুশি হত্যা করতে পারতেন, যটা খুশি বিয়ে করতে পারতেন। তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতা ছিল অবাধ অপ্রতিহত। পোপ বা চার্চ থাকতে পশ্চিম ইউরোপে এই পরিমাণ স্বেচ্ছাচারিতা সহজ ছিল না। এদেশের প্রজাশক্তিও রাজশক্তিকে নিয়মন করতে জানত না। ভারতের প্রজাশক্তি সম্প্রতি এই রাজশক্তির সঙ্গে লড়াই করে জিতেছে।
বস্তুত সেকুলার স্টেট-এর আদর্শ রাজতন্ত্রী আদর্শ নয়, ধর্মতন্ত্রী আদর্শ তো নয়ই। এটা ধর্মতন্ত্র ও রাজতন্ত্র উভয়ের পতনের ওপর বা নিয়মনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় উভয়ের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিলে তবেই সেকুলার স্টেট-এর প্রশ্ন উঠে। তর্কের খাতিরে উলেমাদের ব্রাহ্মণ ও সুলতানদের ক্ষত্রিয় বলে ধরে নিচ্ছি। ব্রিটিশ আমলের আগে আমাদের দেশে সেকুলার স্টেট-এর নামগন্ধ ছিল না। ইংরেজের নিজের দেশে প্রজাশক্তির অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে একপ্রকার সেকুলার মনোভাব আসে, ইংরেজ এদেশে তার পত্তন করে। লাটসাহেবদের সঙ্গে একদল যাজক এসেছিলেন বটে, কিন্তু শাসনের ব্যাপারে তাঁদের সংস্রব ছিল না। তাঁদের ইচ্ছা অনুসারে আইন তৈরি বা আইন রদবদল হত না। তাঁদের মুখ চেয়ে আদালতের বিচারকার্য হত না। তাঁদের কথায় কেউ ফাঁসি যায়ও নি, কারও ফাঁসি বন্ধও হয়নি। তাঁদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম বা একমাত্র ধর্ম এমন কোনো নীতি তাঁরা ব্রিটিশ শাসকদের দিয়ে চালু করাতে পারেননি। সব ধর্মের সমান অধিকার এটা ব্রিটিশ শাসনেরই বিশেষত্ব। তার আগে দু-একজন হিন্দু রাজা বা মুসলমান সুলতান ব্যক্তিগতভাবে এ নীতি অনুসরণ করলেও রাষ্ট্রের দ্বারা এ নীতি ব্যাপকভাবে অনুসৃত হবার সংবাদ আমি রাখিনে। একই অপরাধের জন্যে শূদ্র ফাঁসি যাচ্ছে বামুন ছাড়া পাচ্ছে বা অল্প সাজা পাচ্ছে এইটেই ছিল নিয়ম। উলেমা বা ফকির হলে তার সাতখুন মাফ। হ্যাঁ, ইংরেজই সর্বপ্রথম এ নিয়ম উলটে দেয়।
সেকুলার স্টেট-এর বুনিয়াদ তাহলে দুটি। এক, প্রজাশক্তির অভ্যুদয়। দুই, সব প্রজার সমান অধিকার। প্রজাদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি এনে তাদের দুর্বল করা চলবে না। দুঃখের বিষয় ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে সাম্রাজ্য বাঁচানোর জন্যে ইংরেজ এই ভেদনীতির আশ্রয় নিয়েছিল, কিন্তু আইনে আদালতে নয়। সেদিক থেকে ব্রিটিশ শাসন বরাবর সেক্যুলার ছিল।
ব্রিটিশ শাসন যখন শেষ হবার মুখে তখন একদল লোক হাঁক ছেড়ে বলল, আমরা চাই পাকিস্তান, তার মানে ইসলামি রাষ্ট্র। তা শুনে আরেক দল লোক তাল ঠুকে বলল, আমরা চাই হিন্দুস্থান, তার মানে হিন্দু রাষ্ট্র। কোথায় গেল গান্ধীজির রামরাজ্য। রামরাজ্য যে হিন্দু রাষ্ট্র নয়, ইংরেজি ‘কিংডম অফ গড’-এর ভাষান্তর, কে একথা বোঝে, কেই-বা বোঝায়! বিদেশি শব্দের স্বদেশি প্রতিশব্দ যে কেমন বিপজ্জনক গান্ধীজির রামরাজ্যই তার সেরা দৃষ্টান্ত। টলস্টয়ের বই থেকে গান্ধীজি ওটি নিয়েছিলেন, তুলসীদাসের পুথি থেকে নয়। কিন্তু যারা টলস্টয় পড়েনি, তুলসীদাস পড়েছে, তারা রামরাজ্য বলতে বুঝবে অযোধ্যার বর্ণাশ্রমী রাজ্য রামচন্দ্রের রাজত্ব। কোথায় কিংডম অফ গড আর কোথায় রামচন্দ্রের রাষ্ট্র!
রামরাজ্যের স্বপ্ন গান্ধীজির মন থেকে মিলিয়ে গেল হিন্দু-মুসলমানের খুনোখুনি দেখে। ভালোই হল। কিংডম অফ গড প্রতিষ্ঠা করার সাধ মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম নয়। খ্রিস্টধর্মের আদিপর্বের তাৎপর্য তো কিংডম অফ গড প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। কিংডম অফ গড থেকে একধাপ নেমে খ্রিস্টেনডম, তার থেকে একধাপ নেমে পোপ সাম্রাজ্য ও মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি চিন্তা-বাক্য সব স্বাধীনতার দ্বারে অর্গল। হাজার বছর কেউ টুঁ শব্দটি করেনি, পাছে কিংডম অফ গড প্রজাপতির মতো উড়ে পালিয়ে যায়। তারপরে প্রতিবাদের ভাব জাগে। হঠাৎ একদিনে নয়। ধীরে ধীরে পাঁচশো বছর সময় নিয়ে পাঁচশো বছর ধোঁয়াতে ধোঁয়াতে অবশেষে জ্বলে ওঠে আগুন। এই অকরুণ অভিজ্ঞতার পর পশ্চিম ইউরোপের লোক আর কিংডম অফ গড-এর স্বপ্ন দেখে না। গত কয়েক বছরে হিন্দু-মুসলমানের পিশাচমূর্তি দেখে আমাদেরও সে-স্বপ্ন ভেঙেছে। ভাঙা স্বপ্ন জোড়া লাগে না। তার বদলে পাওয়া গেল সেকুলার স্টেট-এর আদর্শ।
সেকুলার স্টেট-এর সূত্রপাত ব্রিটিশ আমলেই হয়েছিল। তবে আমাদের মনের ওপর নয়। আমরা ওর মর্ম বুঝিনি, ওকে আপন করে নিইনি। এখন ইতিহাস আমাদের দুখানা হাত কেটে নিয়ে আমাদের সমঝিয়ে দিয়েছে সেকুলার স্টেট কেন মূল্যবান। সবাই সমঝেছে তা নয়, তবু যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে সেটুকুর জন্যে কৃতজ্ঞ হতে হয়। পাকিস্তানেও এর ঢেউ পৌঁছেছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনটা পশ্চিম ইউরোপের ল্যাটিনবিরোধী আন্দোলন ছাড়া আর কী? ওইভাবেই রিফর্মেশন শুরু হয়। শেষ যখন হবে তখন দেখা যাবে ইসলামি রাষ্ট্রের দালান ধসে পড়েছে। ভগ্নস্তূপের নীচে থেকে উঁকি মারছে সেকুলার স্টেট-এর বটবৃক্ষ। তুর্কি যে পথে গেছে পাকিস্তানও যাবে সেই পথে।
তাহলে সেকুলার স্টেট-এর বাংলা কী? বস্তুটা কী আমি যতদূর বুঝি বোঝাতে চেষ্টা করলুম। নামটা কী হবে তা আপনারাই স্থির করুন। নামকরণের ভার আমার ওপর নয়। যাঁদের ওপরে তাঁরা যেন অভিধান মন্থন না করে ইতিহাস তল্লাস করেন।