সেকালিনী
হলুদপুরের কবিরাজ শ্রীহরিহর শর্মার কন্যা শৈল আমাদের কাহিনীর নায়িকা। কিন্তু আজকাল গল্পের নায়িকাদের যেসব অসমসাহসিক প্রগতিপূর্ণ কার্য করিতে দেখা যায় তাহার কিছুই সে পারিবে বলিয়া বোধ হয় না। শৈল নিতান্ত সেকালিনী।
হলুদপুর স্থানটির এক পা শহরে এক পা গ্রামে। তবে সামনের পা শহরের দিকে। গত কয়েক বছরে সে বেশ লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া নাগরিক সভ্যতার দিকে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। এতদূর অগ্রসর হইয়াছে যে, হলুদপুরে দুটি স্কুল পর্যন্ত হইয়াছে— একটি ছেলেদের একটি মেয়েদের। তা’ছাড়া লাইব্রেরি আছে, নাট্য- সমিতি আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে শ্রীহরিহর শর্মাও আছেন।
দু’বছর আগে পর্যন্ত হরিহর কবিরাজ হলুদপুরের একমাত্র চিকিৎসক ছিলেন, সারা হলুদপুরের নাড়ি তাঁহার মুঠোর মধ্যে ছিল। মরিতে হইলে হলুদপুরের রোগী হরিহর কবিরাজের হাতে মরিত, বাঁচিতে হইলে তাঁহার হাতেই বাঁচিত। কিন্তু সম্প্রতি তাঁহার একচ্ছত্র আধিপত্যে বিঘ্ন ঘটিয়াছে, মেডিক্যাল কলেজের নূতন পাসকরা এক ডাক্তার তাঁহার পাশের বাড়িতে আসিয়া প্র্যাক্টিস্ শুরু করিয়াছে।
হরিহর কবিরাজ একনিষ্ঠ সেকেলে মানুষ। সেকালের সহিত একালের ভেজাল দিয়া একটা বর্ণসঙ্কর জীবন-প্রণালী গঠন করিবার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না; হলুদপুরের দ্রুত অগ্রগতি তিনি প্রসন্নতার সহিত গ্রহণ করিতে পারেন নাই। প্রথমটা বাধা দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য না হইয়া শেষে নিজের গৃহেই সেকালত্বের একটি ঘাঁটি নির্মাণ করিয়াছিলেন। কন্যা শৈল স্কুলে পড়িতে যাইতে পায় নাই; দশ বছর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহার ঘরের বাহির হওয়া বন্ধ হইয়াছিল। গৃহিণী হৈমবতী শেমিজ ব্লাউজ পরিতেন না। সংসারে সাবানের পাট ছিল না; প্রয়োজন হইলে মেয়েরা ক্ষার খৈল দিয়া গাত্র মার্জনা করিবে। বেশি কথা কি, বাড়িতে পাথুরে কয়লা ঢুকিতে পাইত না, চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী কাঠ-কয়লা ও ঘুঁটের দ্বারা রন্ধনাদি কার্য নির্বাহ হইত। রাত্রে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলিত।
এইরূপ আবহাওয়ার মধ্যে শৈল বাড়িয়া উঠিয়াছিল। সুতরাং সে যে পরিপূর্ণরূপে সেকালিনী হইবে তাহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। গৃহস্থালীর সকল কর্মে সে নিপুণা হইয়াছিল, এমন কি কবিরাজ মহাশয়ের পাচনাদি রন্ধনেও তাহার যথেষ্ট পটুত্ব জন্মিয়াছিল; কিন্তু লেখাপড়ার দিক দিয়া ‘ক’ অক্ষরটি পর্যন্ত কেহ তাহাকে শেখায় নাই। মাতা হৈমবতী শক্ত মেয়েমানুষ ছিলেন; স্বামীর কঠিন সেকালত্ব সম্বন্ধে মনে মনে তাঁহার সম্পূর্ণ সায় ছিল কিনা বলা যায় না কিন্তু তিনি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সহিত স্বামীর ইচ্ছা পালন করিয়া চলিতেন। শৈল যখন বড় হইয়া উঠিল তখন তিনি সর্বদা তাহার উপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিতে লাগিলেন এবং রাত্রে তাহাকে লইয়া এক শয্যায় শয়নের ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু শৈল শেমিজ বা ব্লাউজ পরিবার অনুমতি পাইল না। কেবল রাঙা-পাড় শাড়ি পরিয়াই সে যৌবনে উপনীত হইল।
শৈল মেয়েটি দেখিতে ছোটখাটো এবং অত্যন্ত নরম; বস্তুত তাহাকে দেখিলে ঐ নরম শব্দটাই সর্বাগ্রে মনে আসে— সে সুন্দরী কি চলনসই তাহা লক্ষ্যের মধ্যেই আসে না। চোখের দৃষ্টি, মাথার চুল, লালপেড়ে শাড়িতে সযত্নে আবৃত দেহটি— সবই যেন নরম তুল্তুল্ করিতেছে। স্বভাবটিও তাই; মুখের কথা মুখে মিলাইয়া যায়, নরম হাসিটি কিশলয়পেলব অধরপ্রান্তে লাগিয়া থাকে। বয়স যদিও ষোলো পূর্ণ হইতে চলিল তবু দেখিলে চৌদ্দ বছরেরটি বলিয়া মনে হয়।
তাহার সত্যকার চৌদ্দ বছর বয়স হইতে হরিহর তাহার জন্য পাত্র খুঁজিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন; কারণ, যতই সেকেলে হউন আইন ভঙ্গ করায় তাঁহার আপত্তি ছিল। কিন্তু নানা অনিবার্য কারণে সুপাত্র যোগাড় হইতে বিলম্ব হইয়াছিল। হরিহর যে-ধরনের সুপাত্র চান, বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকের বাংলা দেশে সেরূপ পাত্র একান্ত বিরল। তিনি চান সংস্কৃত শিক্ষাপ্রাপ্ত সুদর্শন অবস্থাপন্ন পাল্টি ঘরের ছেলে। কার্যকালে দেখা গেল, যদি বর মেলে তো ঘর মেলে না, ঘর-বর মেলে তো কোষ্ঠী মেলে না। এইরূপে দেরি হইতে লাগিল।
ইতিমধ্যে আর একটি ব্যাপার ঘটিয়া হরিহরের মন হইতে কন্যাদায়ের চিন্তা কিছু দিনের জন্য লুপ্ত করিয়া দিল। কলেজে পাসকরা ছোকরা ডাক্তার অজয় গাঙ্গুলী বাহির হইতে আসিয়া যখন তাঁহার পাশের বাড়িতেই ডাক্তারী আরম্ভ করিল তখন হরিহর এইরূপ ব্যবহারকে ব্যক্তিগত শত্রুতা বলিয়া মনে করিলেন। কিন্তু অজয় ছেলেটি অতিশয় বিনয়ী ও বাক্পটু। সে আসিয়া প্রথমেই তাঁহার সহিত দেখা করিল এবং এমনভাবে কথাবার্তা বলিল যেন সে হরিহরের অধীনেই আশ্রয় লইতে আসিয়াছে। হরিহর মনে মনে একটু নরম হইলেও অনুরাগ-বিরাগ কিছুই প্রকাশ করিলেন না। কিন্তু ক্রমে যখন দেখা গেল, হলুদপুরের যেসব লোক এতদিন তাঁহার উপরেই জীবন-মরণের ভার অর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত ছিল তাহারা অধিকাংশই এই নবীন ডাক্তারের দিকে ঝুঁকিয়াছে, তখন হরিবরের অন্তঃকরণ তাঁহার স্বহস্তে প্রস্তুত পাচনের মতোই তিক্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু করিবার কিছু ছিল না, অগত্যা তিনি স্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পাশের বাড়িতে বাইরের লোক এসেছে; দক্ষিণ দিকের জানালাগুলো যেন বন্ধ থাকে।’
ফলে বাড়ির দক্ষিণদিকের তিনটি জানালা বন্ধ হইয়া গেল।
দশ বছর বয়সে শৈলর জীবন যখন বাড়ির চারিটি ঘর ও পাঁচিল-ঘেরা উঠানের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল, তখন হইতে এই জানালাগুলিই ছিল বহির্জগতের সহিত তাহার প্রধান যোগসূত্র। জানালা দিয়া দক্ষিণের বাতাস আসে, খোলা মাঠের গন্ধ আসে, পাশের বাড়িটাও দেখা যায়; একটু তেরছাভাবে দৃষ্টি প্রেরণ করিলে পথের লোক চলাচল চোখে পড়ে। নির্জন দ্বিপ্রহরে জানালায় দাঁড়াইয়া শৈল ঘরের সহিত বাহিরের ক্ষণিক সংযোগ স্থাপন করিত। আকাশে নীল রঙের ঘুড়ি উড়িতেছে, পরিষ্কার স্বচ্ছ আকাশে তাহাদের সূতাগুলি পর্যন্ত দেখা যাইতেছে; রাস্তা দিয়া বিচালি-বোঝাই গরুর গাড়ি নিশ্চিন্ত মন্থরতায় চলিয়া যাইতেছে; পাশের বাড়ির কার্নিসে একটা পায়রা গুমরিয়া গুমরিয়া কাহার উদ্দেশে অভিমান ব্যক্ত করিতেছে। — রাত্রে শয়নের পূর্বে সে শয়নঘরের জানালাটিতে গিয়া দাঁড়াইত। অন্ধকার ঘর, বাহির হইতে কিছু দেখা যায় না; শৈল গায়ের কাপড় একটু আলগা করিয়া জানালার গরাদ ধরিয়া দাঁড়াইত। বাহিরের অন্ধকার ঝিঁঝিপোকার ঝঙ্কারে পূর্ণ হইয়া থাকিত, গাছের পাতায় পাতায় জোনাকির পরী-আলো জ্বলিত আর নিভিত; দক্ষিণা বাতাস গায়ে লাগিয়া হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিত—
কিন্তু জানালাগুলি যখন বন্ধ হইয়া গেল তখন শৈল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল না, তাহার মুখের হাসিও ম্লান হইয়া গেল না। রাত্রে শয়নের পূর্বে সে কেবল একবার বন্ধ জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইত; পুরানো জানালার তক্তায় একটা চোখ উঠিয়া গিয়া একটি ফুটা হইয়াছিল, সেই ফুটায় চোখ দিয়া সে বাহিরে দৃষ্টি প্রেরণ করিত, তারপর বিছানায় গিয়া শয়ন করিত। মা কাজকর্ম শেষ করিয়া আসিয়া দেখিতেন শৈল ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।
সে যাহোক, হরিহর কবিরাজ প্রতিদ্বন্দ্বী-সংঘর্ষের প্রথম ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া আবার যথারীতি কাজকর্মে মনোনিবেশ করিলেন। তিনি দেখিলেন প্রতিদ্বন্দ্বীর আগমনে তাঁহার ক্ষতি হইয়াছে বটে, কিন্তু ক্ষতি মারাত্মক নয়। বিশেষত দীর্ঘ একাধিপত্যের সময় তিনি যথেষ্ট সঞ্চয় করিয়াছিলেন। সুতরাং তিনি আবার কন্যার জন্যে পাত্রের সন্ধানে মন দিলেন। শৈলর বয়স তখন চতুর্দশী পার হইয়া পূর্ণিমায় পা দিয়াছে।
কয়েকমাস খোঁজাখুঁজির পর কাছেপিঠে হালুইপুর গ্রামে একটি পাত্র পাওয়া গেল। পাত্র ভালই অর্থাৎ হরিহর যাহা চান তাহার ষোলো আনা না হোক চৌদ্দ আনা বটে। হরিহর বিবাহ স্থির করিয়া ফেলিলেন। মেয়ে দেখাদেখির কোনও কথা উঠিল না, কারণ দুই পক্ষই গোঁড়া— ঠিকুজি কোষ্ঠী যখন মিলিয়াছে তখন অন্য কিছু দেখিবার প্রয়োজন নাই। আশীর্বাদ-পর্বটাও বর যখন বিবাহ করিতে আসিবে তখনই সম্পন্ন হইবে।
আষাঢ়ের শেষের দিকে বিবাহের দিন। উদ্যোগ-আয়োজন সমস্তই প্রস্তুত, আত্মীয়-কুটুম্বেরা এখনও আসিয়া পৌঁছিতে আরম্ভ করেন নাই, এমন সময় বিবাহের ঠিক সাত দিন আগে একটি ব্যাপার ঘটিল। স্নান করিবার সময় শৈলর হাত পিছলাইয়া জলভরা ঘটি তাহার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের উপর পড়িল। আঙ্গুলটা থেঁতো হইয়া নখ প্রায় উড়িয়া গেল। রক্তারক্তি কাণ্ড!
হরিহর অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। বিবাহের মাত্র সপ্তাহকাল বাকি, এই সময় মেয়েটা এমন কাণ্ড করিয়া বসিল! সাত দিনের মধ্যে ঘা শুকাইবে বলিয়াও মনে হয় না। ক্ষতযুক্তা কন্যাকে তিনি পাত্রস্থ করিবেন কি করিয়া?
হরিহর বরপক্ষকে দুর্ঘটনার কথা জানাইলেন এবং বিবাহ কিছুদিন পিছাইয়া দিবার প্রস্তাব করিলেন। বরপক্ষ বিরক্ত হইলেন, হয়তো কন্যার সুলক্ষণ সম্বন্ধে সন্দিহান হইলেন। দুই পক্ষে একটু কথা কাটাকাটি হইল। তারপর বরপক্ষ অপ্রসন্নভাবে জানাইলেন যে তেসরা শ্রাবণ একটি বিবাহের দিন আছে, সেই দিনের মধ্যে যদি বিবাহ সম্ভব হয় তবেই তাহারা বিবাহ দিবেন নচেৎ সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া যাইবে; যেখানেই হোক, শ্রাবণ মাসের মধ্যে পাত্রের বিবাহ দিতে তাঁহারা বদ্ধপরিকর।
হরিহর তেসরা তারিখের মধ্যে ঘা সারাইবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। কিন্তু ‘বুড়ির গোপান’ প্রভৃতি ডাকাতে ঔষধ প্রয়োগ করিয়াও ঘা সারিল না। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের ঘা সারা সহজ কথা নয়; বিশেষত মেয়েরা খালি পায়ে থাকে, চলিতে ফিরিতে পায়ে হোঁচট লাগে, আরোগ্যোন্মুখ ঘা আবার আউরাইয়া উঠে। তেসরা শ্রাবণ তো এমন অবস্থা হইল যে, শৈলকে শয্যা লইতে হইল। আঙ্গুলের ঘা বারবার অতর্কিত আঘাত পাইয়া বিষাইয়া উঠিয়াছে।
বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল।
শৈলর ঘা কিন্তু তবু সারে না, মাঝে মাঝে উন্নতি হয় আবার বাড়িয়া যায়। সারা শ্রাবণ মাসটাই এইভাবে কাটিল। হরিহর ঔষধ প্রয়োগ করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। মেয়ে শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল। হৈমবতীর মায়ের- প্রাণ আকুলি-বিকুলি করিতেছিল, শেষে আর থাকিতে না পারিয়া তিনি স্বামীকে বলিলেন— ‘ওগো, ঘা তো কিছুতেই সারছে না; শেষে কি মেয়েটা জন্মের মতো খোঁড়া হয়ে যাবে!— একবার ঐ ডাক্তার ছেলেটিকে খবর দিলে হয় না?’
হরিহর অনেকক্ষণ মেরুদণ্ড শক্ত করিয়া বসিয়া রহিলেন, তারপর সংক্ষেপে বলিলেন, ‘বেশ, খবর পাঠাও।’
খবর পাইয়া অজয় ডাক্তার তৎক্ষণাৎ আসিল। হরিহর কোনও কথা না বলিয়া তাহাকে ভিতরে লইয়া গেলেন; শৈল দালানের মেঝেয় বসিয়া ছিল, নীরবে তাহার পায়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন। অজয় শৈলর পায়ের বন্ধন খুলিয়া ক্ষত পরীক্ষা করিল; শৈল পাশের দিকে মুখ ফিরাইয়া নতনেত্রে বসিয়া রহিল।
এতটুকু আইবুড়ো মেয়েকে সম্ভ্রম দেখানো অজয়ের অভ্যাস নাই; সে স্থানটি টিপিতে টিপিতে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি খুকি, লাগছে?’
শৈলর মুখ একটু বিবর্ণ হইল; একবার অধর দংশন করিয়া সে তেমনি পাশের দিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল, কেবল মাথা নাড়িয়া জানাইল— না।
অজয় তখন হাইড্রোজেন পেরকসাইড দিয়া ক্ষতস্থান ধৌত করিল, তারপর তাহাতে টিঞ্চার আয়োডিন ঢালিতে ঢালিতে মুচকি হাসিয়া বলিল, ‘এবার জ্বালা করছে তো?’
শৈল এবারও মাথা নাড়িয়া জানাইল— না। তাহার মুখখানি কিন্তু আরও একটু পাংশু দেখাইল।
মলম লাগাইয়া ভাল করিয়া ব্যান্ডেজ করিয়া অজয় উঠিয়া দাঁড়াইল, হরিহরকে বলিল, ‘তিন দিন পরে ব্যান্ডেজ খুলবেন, বোধ হয় ততদিনে শুকিয়ে যাবে। বেশি নড়াচড়া কিন্তু বারণ। খুকি, দৌড়োদৌড়ি কোরো না।’
এবার শৈলর মুখের বিবর্ণতা ভেদ করিয়া একটু অরুণাভা দেখা দিল। সে নীরবে একবার অজয়ের দিকে আয়ত দৃষ্টি হানিয়া আবার মাথা হেঁট করিল। অজয়ের হঠাৎ মনে হইল মেয়েটাকে সে যতটা খুকি মনে করিয়াছিল বোধ হয় ততটা খুকি নয়। সে একটু অপ্রস্তুত হইল।
বাহিরের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া হরিহর ট্যাঁক হইতে দুটি টাকা বাহির করিয়া অজয়কে দিতে গেলেন, অজয় হাত জোড় করিয়া প্রত্যাখ্যান করিল, ‘আমরা দু’জনেই ডাক্তার। আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে পারি না।’ দ্বার পর্যন্ত গিয়া সে ফিরিয়া আসিল— ‘একটা কথা এতদিন বলবার সাহস হয়নি, যদি অনুমতি দেন তো বলি।’
হরিহর ঘাড় নাড়িয়া অনুমতি দিলেন, অজয় তখন বলিল, ‘আমার মা অনেক দিন থেকে অম্বলে ভুগ্ছেন। কিন্তু তিনি বিধবা মানুষ, ডাক্তারী ওষুধ খেতে চান না। তা ছাড়া আমার ওষুধে কাজও কিছু হচ্ছে না। এখন যদি আপনি ব্যবস্থা করেন।’
হরিহরের মনের গ্লানি অনেকটা কাটিয়া গেল; তিনি বুঝিলেন অজয় তাঁহাকে ঋণী করিয়া রাখিতে চায় না। বলিলেন, ‘বেশ, আজ বিকেলে আমি তোমার বাড়ি যাব।’
বৈকালে অজয়ের মাকে পরীক্ষা করিয়া হরিহর ঔষধের ব্যবস্থা দিলেন, — পাচন, গুলি ও অবলেহ। ঔষধ ব্যবহারের বিধি বুঝাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘এক হপ্তা এই চলুক, আশা করি দোষটা কেটে যাবে।’
তিন দিনের দিন শৈলর ব্যান্ডেজ খুলিয়া দেখা গেল ঘা শুকাইয়া গিয়াছে। ওদিকে অজয়ের মা সপ্তাহকাল ঔষধ সেবন করিয়া দিব্য চাঙ্গা হইয়া উঠিলেন।
এইরূপে দুই পরিবারের মধ্যে প্রথম স্বার্থ-সংঘাতের উষ্মা অনেকটা প্রশমিত হইল, হয়তো পরস্পরের প্রতি একটু শ্রদ্ধাও জন্মিল; কিন্তু উহা বেশি দূর অগ্রসর হইতে পাইল না। স্বার্থের ঠোকাঠুকি যেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক, সেখানে আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা হওয়া বড়ই কঠিন। হরিহর ও অজয়ের সম্পর্ক দেঁতো হাসি ও মিষ্ট কথার পর্যায়ে উঠিয়া আটকাইয়া রহিল।
এদিকে শ্রাবণ মাস ফুরাইয়া ভাদ্র মাস আরম্ভ হইয়াছে। শৈলর শরীরও সারিয়াছে। মাঝে আর দুটি মাস বাকি, অঘ্রাণ মাসে মেয়ের বিবাহ দিতেই হইবে। হরিহর আবার সবেগে তত্ত্ব-তল্লাস আরম্ভ করিয়া দিলেন।
কার্তিক মাসের শেষে একটি পাত্র পাওয়া গেল, হরিহর আর বিলম্ব না করিয়া দিন স্থির করিয়া ফেলিলেন। পাত্রটি এবার অবশ্য তেমন মনের মতো হইল না, হরিহর যাহা চান তাহার আট আনা মাত্র। কিন্তু উপায় কি। মেয়ের ষোলো বছর বয়স পূর্ণ হইতে চলিল, আর বিলম্ব করা চলে না। আবার বাড়িতে বিবাহের উদ্যোগ-আয়োজন আরম্ভ হইল।
বিবাহের সাত দিন আগে, দুপুরবেলা হরিহরের উঠানে প্রকাণ্ড উনানের উপর প্রকাণ্ড মাটির হাঁড়িতে কোনও একটি রসায়ন তৈরি হইতেছিল। এরূপ কবিরাজী ঔষধ নিত্যই বাড়িতে তৈয়ার হয়। শৈল একলা দাঁড়াইয়া হাঁড়িতে কাঠি দিতেছিল। বহু গাছ-গাছড়া ও গুড়ের মতো একটি বস্তু একত্র সিদ্ধ হইয়া বেশ একটি স্বর্ণাভ গাঢ় পদার্থে পরিণত হইয়াছে, বড় বড় বুদ্বুদ উদ্গীর্ণ করিয়া টগ্বগ্ করিয়া ফুটিতেছে।
উঠানে কেহ কোথাও নাই, শৈল একাকিনী দাঁড়াইয়া হাতা নাড়িতেছিল এবং মাঝে মাঝে এক হাতা তুলিয়া আবার হাঁড়ির মধ্যে ছাড়িয়া দিয়া দেখিতেছিল কতখানি গাঢ় হইয়াছে। শীতের রৌদ্র তেমন কড়া নয়, কিন্তু আগুনের আঁচে তাহার মুখখানি রাঙা হইয়া উঠিয়াছিল। আর, নরম ঠোঁটে একটুখানি গোপন মিষ্ট হাসি ক্রীড়া করিতেছিল।
এক হাতা ফুটন্ত পদার্থ তুলিয়া লইয়া শৈল সন্তর্পণে চারিদিকে তাকাইল। কেহ নাই; মায়ের ঘরে দরজা খোলা রহিয়াছে বটে, কিন্তু তিনি এখন কাঁথা মুড়ি দিয়া একটু ঘুমাইয়া লইতেছেন। শৈল সুমিষ্ট হাসিতে হাসিতে নিজের বাঁ হাতের কব্জির উপর ফুটন্ত হাতা উপুড় করিয়া দিল।
একটা চাপা চিৎকার—! কিন্তু শৈল চিৎকার করে নাই, চিৎকার আসিল ঘরের ভিতর হইতে। হৈমবতী ছুটিতে ছুটিতে বাহির হইয়া আসিলেন। তাঁহার আর্তোক্তিতে শৈলর বোধ হয় হাত কাঁপিয়া গিয়াছিল, সবটা পদার্থ তাহার কব্জিতে না পড়িয়া মাটিতে পড়িল।
আগুনখাকীর মতো হৈমবতী আসিয়া মেয়ের সম্মুখে দাঁড়াইলেন; তাঁহার বিস্ফারিত চক্ষুর সম্মুখে শৈল চক্ষু নত করিয়া রহিল। হৈমবতী যে সমস্তই দেখিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহ নাই; তিনি সহসা কথা খুঁজিয়া পাইলেন না, বয়লারে বাষ্পাধিক্য ঘটিলে যেরূপ শব্দ করিয়া বাষ্প বাহির হয় তিনি সেইরূপ ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন।
তারপর সহসা শৈলর একটা হাত চাপিয়া ধরিয়া তাহাকে ঘরের দিকে টানিয়া লইয়া চলিলেন। ঘরে গিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া শৈলকে খাটে বসাইলেন, একটি তালের পাখা শক্ত করিয়া হাতে ধরিয়া বলিলেন, ‘ইচ্ছে করে পায়ে ঘটি ফেলেছিলি। আবার আজ হাত পুড়িয়েছিস। হারামজাদি, কি চাস তুই বল।’
শৈল উত্তর না দিয়া মায়ের কোলের মধ্যে মাথা গুঁজিল; ক্রুদ্ধা হৈমবতী তাহার পিঠে পাখার এক ঘা বসাইয়া দিলেন।
অতঃপর মাতা ও কন্যার মধ্যে কি হইল তাহা আমরা জানি না। আধঘণ্টা পরে হৈমবতী ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন এবং স্বামীর ঘরে গিয়া দ্বার বন্ধ করিলেন।
সন্ধ্যাবেলা হরিহর অজয়ের বাড়ি গেলেন। অজয় রোগী দেখিতে বাহির হইতেছিল, তাহাকে বলিলেন, ‘তুমি একবার শৈলিকে দেখে যেও, সে আবার হাত পুড়িয়ে ফেলেছে।’
অজয় চলিয়া গেল। তখন হরিহর অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহার মাতার সহিত কথা কহিলেন।
ইহার পর হলুদপুরের রোগীরা লক্ষ্য করিল, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চিকিৎসকের মধ্যে একটা আশ্চর্য রকমের রফা হইয়া গিয়াছে। অজয় রোগীকে বলে— ‘আপনার রোগ ক্রনিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনি বরং কবিরাজ মশায়কে দেখান।’ হরিহর নিজের রোগীকে বলেন, ‘তোমার দেখছি চেরা-ফাড়ার ব্যাপার আছে, তুমি বাপু অজয়ের কাছে যাও।
কথাটা এখনও প্রকাশ হয় নাই, কিন্তু অজয়ের সহিত শৈলর বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে। আগামী মাঘ মাসে বিবাহ। আশা করা যাইতেছে, এবার আর কোনও রকম দুর্ঘটনা ঘটিবে না, সেকালিনী মেয়ে শৈলর বিবাহ নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হইবে।
২৭ আষাঢ় ১৩৫২