ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

সেই রাত

সেই রাত

একটা কথা আছে, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়। আমার ঠিক তাই হল। একে শীতকাল, তায় থাকার জায়গার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। অফিসের এক অর্ডারে চলে এসেছি অযোধ্যা হিলসের ধারে পাণ্ডব বর্জিত এই জায়গায়। এখানে সব আছে। সুন্দর সমান্তরাল একটি পাহাড়। সুন্দর একটি বন, যদিও পত্রশূন্য গাছপালা কারণ সময়টা শীতের, বিশাল-বিশাল প্রান্তর, ছোট-ছোট আদিবাসী গ্রাম, অজস্র তুঁত গাছ। প্রতিটি গাছে লাক্ষা পোকা সব পাতা খেয়ে অদ্ভুত-অদ্ভুত আকৃতির জমাট জটলা তৈরি করেছে। পরে এর থেকে তৈরি হবে গালা। সন্ধ্যার আকাশপটে এই গাছগুলোকে দেখে গা আরও ছম-ছম করছে। একটি দুটি সাঁওতাল পরিবার এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, তাছাড়া সবই নির্জন। একটু পরে বাঘ না বেরোক দস্যু তস্করের আসতে কোনও আপত্তি নেই। যথাসর্বস্ব কেড়ে তো নেবেই, মেরে ফেলতেও পারে।

কী করব ভেবে না পেয়ে চুপ করে বসে আছি একটা পাথর খণ্ডে। পাশ দিয়ে চলে গেছে পথ। যা হয় হবে। দেখাই যাক না ভগবান কী করেন! সন্ন্যাসীরা তো এর চেয়ে অনেক দুর্গম স্থানে ভগবান ভরসা করে চলে যান। আমি সন্ন্যাসী না হলেও আত্মসমর্পণ তো করতে পারি!

দূর থেকে একটা ঝকঝকে সাদা মটোর গাড়ি আসছে। পেছনে তাড়া করে আসছে শীতে শুকনো পথের ধুলো। গাড়িটা হুস করে আমার পাশ দিয়ে চলে গিয়ে কিছুটা দূরে থামল। দেখি ব্যাক করে আমার দিকেই আসছে। আমি বসে আছি। এতই পরিশ্রান্ত যে ওঠার ক্ষমতা নেই।

চালকের আসন থেকে মুখ বাড়িয়ে সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার নাম কী পলাশ!’

এইবার ওঠে দাঁড়ালুম, ‘হ্যাঁ, আমার নাম পলাশ!’

‘আশ্চর্য! চিনতে পারছিস না! আমি সত্যেন!’

‘সত্যেন! স্কটিশের সত্যেন!’

‘স্কটিশের! মনে আছে, আমরা দুজন দশহরার দিন সাঁতরে গঙ্গা পার হয়েছিলুম।’

‘খুব মনে আছে, তবে তুই আগের চেয়ে অনেক মোটা হয়েছিস।’

‘তুই কিন্তু যেমন ছিলিস তেমনই আছিস। এখানে কী করছিস! নিশ্চিন্তে বসে আছিস! যেন, তোর বাড়ির বৈঠকখানা!’

‘কিছুই নয়, সামান্যই সমস্যা, রাতটা কোথায় কাটাব ভাবছি! এখানে হোটেল, গেস্টহাউস, রেস্টহাউস কিছুই নেই।’

‘উঠে আয় আমার গাড়িতে। ভাগ্যিস এলুম এই পথে নইলে, হয় তোকে বাঘে খেত, নয় মানুষে টুকরো করত। এটা ডাকাতে অঞ্চল! আর এক নজরে তোকে আমি ঠিক চিনতেও পেরেছি একই রকম আছিস বলে। একটুও পালটাসনি!’

গাড়িটা একেবারে ব্র্যান্ড নিউ। সত্যেন মনে হয় বড় মাপের ডাক্তার হয়েছে। ও লাইন চেঞ্জ করেছিল এইটুকু খবর আমি রাখতুম। গাড়ি চালাতে-চালাতে আমাকে প্রশ্ন করলে,

‘কী কাজে এসেছিস এখানে?’

‘গালার চাষ দেখতে। যারা চাষ করে তাদের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে বিক্রির কাজে সাহায্য করতে। এটা একটা প্রাোজেক্ট।’

‘আমি কী করছি জানিস!’

‘এইটুকু বুঝেছি, এমন একটা কিছু করছিস, যাতে মানুষ মোটা হয়, আর ঝকঝকে নতুন গাড়ি হয়।’

‘আজ্ঞে না, এই গাড়িটা আমাদের ফাউন্ডেসানের। এখানে বিদেশি টাকায় আমরা একটা হাসপাতাল করছি। আমি তার চার্জে আছি। এখনও অনেক কাজ বাকি। একটু-একটু করে সব হচ্ছে। বিল্ডিংটা হয়ে গেছে। যন্ত্রপাতি অনেক এসেছে, আরও অনেক আসবে।

কথা বলতে-বলতেই আমরা এসে গেছি। বিশাল একটা জায়গায় শেষ বিকেলের আলোয় ঝকঝকে একটা বাড়ি। আর কোথাও কিছু নেই। লোকজনের বসবাস, দোকানপাট সব আমরা ছেড়ে চলে এসেছি। রুক্ষ্ম জায়গা। গাছপালা, তেমন কিছুই নেই। এই একটা অঞ্চল, যেখানে খুব জলকষ্ট। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম।

সত্যেন বললে, ‘আগে চা খাওয়া যাক, তারপর সব দেখাব।’

আমার লোকজন এখনও খুবই কম। সব আসবে একে-একে।

এখানে একটা টাউনশিপ হবে। স্কুল হবে, রাস্তা হবে, পোস্টাপিস হবে। সব হতে আরও বছর পাঁচেক!

চা এল। সঙ্গে একটা করে রোল, খুবই সুস্বাদু। তারিফ করতেই সত্যেন বললে, ‘মোটা হওয়ার কারণটা বুঝলি! এর জন্যে দায়ী আমাদের এই গজেন্দ্র!’ গজেন্দ্র নিতান্তই যুবক। ফরসা সুন্দর চেহারা। সে হাসছে! সত্যেন বলল, ‘হাসিসনি। এত সাঙ্ঘাতিক ভালো রান্নার হাত, মোটেই ভালো নয়। হেলথ সেন্টারের হেলথ খারাপ করার তালে আছ! তোমার জন্যে আমার খাওয়া ডবল হয়ে গেছে। অন্য কোথাও গিয়ে খেতে পারি না। স্বাদ পাই না। শোনো, আমার অনেকদিনের দোস্ত এসেছে। কী খাওয়াবে!’

‘জব্বর শীত পড়েছে। ভাবছি খিচুড়ি করব সঙ্গে কিছু ফ্রাই।’

তোমার সেই অসাধারণ খিচুড়ি। ও:, ওয়ান্ডারফুল! ওটার কোনও জবাব নেই গজেন!’

সত্যেন আমাকে বললে, ‘এখানের জল মানুষের শত্রু! অ্যায়সা খিদে হয়! এই খাও, এই হজম! বিরক্তিকর ব্যাপার! পাশেই বিহার বেল্ট তো! তা গজেন, আর একটা করে রোল হবে!’

‘না স্যার! হলেও দেব না। এখন আর লোভ করবেন না। রাতেরটা আজ একটু হেভি হবে।’

‘দ্যাটস রাইট, দ্যাটস রাইট।’

সোয়েটার, শাল জড়িয়ে হনুমান টুপি চড়িয়ে, গোটা এলাকাটা ঘুরে এলুম। একরের পর একর জমি! মেন বিলডিং ছাড়া সবই আন্ডার কনস্ট্রাকসান! জায়গায়-জায়গায় লোহালক্কড়, বালি, পাথর ডাঁই হয়ে আছে। ফটফটে চাঁদের আলোয় সব পরিষ্কার। দূরে বাঘমুণ্ডি পাহাড়। দু-একটা বহু পুরোনো কনস্ট্রাকসান, একটা পুরোনো শেডও রয়েছে। কোনওকালে হয়তো এখানে একটা কিছু ছিল! এত নির্জন, এত ফাঁকা, আমাদের মতো শহরের লোকদের ভালো লাগে না। ভয়-ভয় করে।

রাত নটা, সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চুটিয়ে গল্প হল। পুরোনো দিনের, পুরোনো বন্ধুদের কলেজ জীবনের কথা। মাঝে একবার কফি হল। তারপর খাওয়া। কিমা, কড়াইশুঁটি দিয়ে এইরকম সুস্বাদু খিচুড়ি, এই আমার প্রথম খাওয়া। এই আমার শেষ খাওয়া। সঙ্গে ফিশফ্রাই। সেটাও মার-মার কাটকাট। গজেনটাকে মেরে ফেলা উচিত। একটু পরেই জানতে পারলুম গজেন একজন জুনিয়ার ডাক্তার। রান্নাটা তার হবি।

সত্যেন বললে, ‘তোর শয়নের ব্যবস্থা আমাদের নতুন সার্জিকাল ওয়ার্ডে করেছি। নতুন খাট, বালিশ, বিছানা, মশারি। অ্যাটাচড বাথ। সব নতুন।’

সত্যিই তাই। আমার ঘুমের অপারেসান দিয়ে কেবিনের উদ্বোধন। দেওয়াল নেই বললেই চলে। চারদিকে বড়-বড় কাঁচের জানলা। ঝকঝক করছে। নীল আকাশের অসীম ছেয়ে ছড়িয়ে গেছে চাঁদের আলো। নেটের মশারি গুঁজে আলো নিবিয়ে, দুর্গা বলে, শুয়ে পড়লুম। সবই কাঁচ। চাঁদের আলোয় পানসির মতো ভাসছি। বাঁপাশে খাট ঘেঁষে জানলা। ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। গ্রিল গরাদ, কিছুই নেই। শুয়ে শুয়েই দেখছি, ফাঁকা মাঠ, চাঁদের আলো, আর বহু দূরে সেই প্রাচীনকালের শেডটা। যত অন্ধকার, ঘাপটি মেরে আছে সেখানে।

সারা দিনের ছোটাছুটি, ঘুম এসে গেল।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। অদ্ভুত একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, বাঁ পাশের জানলাটা খুব কাঁপছে। ঝড় উঠল না কী! ফটফটে চাঁদের আলো, ঝড় এল কোথা থেকে! শুয়ে শুয়েই দেখছি। জানলাটা ছটফট করছে। তাকিয়ে আছি সেইদিকে। হঠাৎ দেখি জানলার নিচের টাওয়ার বোল্টটা হঠাৎ ওপর দিকে উঠে, ডান দিকে ঘুরে গেল। মশারির ভেতর থেকে তাড়াতাড়ি হাত বের করে পাল্লাটা বন্ধ করে দিলুম।

শুয়ে আছি। ঘুম চটকে গেছে। জানলার কাপুনি আবার। আড় হয়ে শুয়ে-শুয়েই দেখছি। নড়তে-নড়তে তলার ছিটকিনিটা ওপর দিকে উঠছে। ডানপাশে নিজের থেকে ঘুরে গেল, পাল্লাটা ঘড়াস করে খুলে গেল।

ভূতের ভয় আমার নেই, তবে বদমাইশ লোককে আমি সাজা দিতে চাই। উঠে পড়লুম। দুটো পাল্লাই খুলে দিলুম। কই, হাওয়া বাতাস তো কিছুই নেই। নিস্তব্ধ রাত, চাঁদের আলো, গোটা দুই বড়-বড় তারা। দূরে-দূরে শীতকাতুরে কুকুরের ডাক।

কোনও বদমাইশের কাজ। ভয় দেখাতে এসেছে। পাশে কোথাও লুকিয়ে আছে। উঁচু ভিতের ওপর বাড়ি। ফুট চারেক নিচে জমি। কিছু ঘাস, কিছু কাঁকর। মারলুম লাফ।

কোথায় কী! কেউ নেই। আমি আর আমার এই রাত। চারপাশ চাঁদের আলোয় ফটফট করছে। কোথাও একটা কুকুরও নেই। ছেলেবেলায় পড়েছিলুম—লুক বিফোর ইউ লুক। উত্তেজনায় সেই উপদেশ ভুলেছি। যে পথে নেমেছি, সে পথে আর ফেরা যাবে না। এখন আমাকে ঘুরে ফ্রন্ট এনট্রেনসে যেতে হবে, ডাকাডাকি করে ওদের ঘুম ভাঙাতে হবে।

এইসব ভাবতে-ভাবতে আমার কেমন একটা ঘোর লেগে গেল, চাঁদের আলো হয়ে গেল কুয়াশার মতো। জেগে আছি, ঘুমোচ্ছি, না স্বপ্ন দেখছি। বোধের বাইরে। কেউ আমাকে চালাচ্ছে হাঁটাচ্ছে। চলেছি সেই বিধ্বস্ত শেডটার দিকে। ক্রমশ অন্ধকার, আরও অন্ধকার। শেডটার ভেতরে চলে গেছি। ফাটা ফুটো দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকেছে। একপাশে অনেক ব্যারেল। কাঠকুটো। একটা কংক্রিট মিক্সার। ভাঙা ফারনিচার। কোনও কিছুই মানছি না আমি। কলের পুতুলের মতো এগোচ্ছি। কেউ যেন অনেক দম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। গেঞ্জি আর পাজামা পরে আছি, তাও আমার শীত নেই।

হঠাৎ দেখি, সামনে কেউ ঝুলছে।

ওপরের কাঠের বিম থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছে কেউ।

তার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত কালো কাপড়ে ঢাকা। শরীরটা অল্প অল্প ঘুরছে। আলো অন্ধকারে।

কে?

আর মনে নেই। যখন জ্ঞান এল,

সকাল, রোদ। সত্যেনের বিছানায় আমি। গায়ে কম্বল, পায়ে হট ব্যাগ। গজেন আমাকে গরম দুধে ব্র্যান্ডি খাওয়াবার চেষ্টা করছে। টেবিলের ওপর টোস্ট, ওমলেট।

ইতিহাসটা পাওয়া গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা ছিল আমেরিকান আর্মিদের বেস ক্যাম্প। তখন এখানে এক অফিসারকে জার্মান স্পাই সন্দেহে কোট মার্শাল করা হয়েছিল। পরে এখানকার অ্যামুনিসান ডাম্পে আগুন লেগে অনেক সৈনিক মারা গিয়েছিল, ছাউনি পুড়ে গিয়েছিল।

সত্যেন বললে, ‘এখন কেমন ফিল করছিস!’

—’একটু ঘোর আছে।’

‘ঠিক হয়ে যাবে। খুব বাঁচা বেঁচে গেছিস। নে, টোস্ট খা, গজেনের ডবল ডেকার ওমলেটেই চাঙ্গা হয়ে যাবি। তোর কী ভাগ্য পলাশ! আমরা শুধু শুনেইছি, তুই কেমন অতীতটাকে বর্তমানে দেখে ফেললি! গজেন্দ্র!’

‘ইয়েস স্যার!’

‘আজ আমার ফ্রেন্ডের অনারে!’

‘চেপে গেছে স্যার। কড়া মেনু।’

গজেন্দ্র! তোমার তুলনা শুধু তুমিই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *