সেই মৃত্যুটা
ছোটো কালভার্টটায় ক-দিন আগেই সাদা রঙের একটা পোঁচড়া লাগিয়েছে পিডব্রুডি। আর সেই সাদা জামাটির ওপর কে যেন পেনসিল দিয়ে খুদে খুদে হরফে কীসব লিখে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত যোগ করে লিখেছে, বকেয়া তেইশ টাকা এগারো পয়সা।
দেখে মোনা মিয়ার হঠাৎ খুব মজা লাগে। চিন্তাহরণ ওরফে চিন্তাকে আঙুল দিয়ে একটা খোঁচা মারে সে। আঙুলের নখ বেড়ে গিয়েছিল, চিন্তাহরণের একটা আঁচড়ের মতো লাগে। ভারি বিরক্ত হয় সে।
এঃ, আঁচড়াচ্ছিস কেন বেড়ালের মতো? চামড়া ছড়ে গেল যে।
এতেই চামড়া ছড়ে গেল? এমন ফিনফিনে বাবুয়ানি চামড়া তোর হল কবে থেকে?
মোনা মিয়া আর একটা খোঁচা দেওয়ার উদ্যোগ করতে দু-হাত লাফিয়ে সরে যেতে চায় চিন্তা।
কী আরম্ভ করলি বল তো মোনা? আমি মরছি নিজের জ্বালায়।
আর আমি বুঝি সুখের দরিয়ায় নাও ভাসিয়েছি? মোনারও এবার বিরক্তি লাগে।
তাই বলে হাঁড়িপানা মুখ করে বসে থাকব নাকি রাতদিন? তাকিয়ে দ্যাখ-না এই পুলটার গায়ে।
কী দেখব, দেখবার কী আছে?
হিসেব লিখেছে যে, অনেক ভেবে ভেবে মাথা খাঁটিয়ে হিসেব করেছে। বকেয়া তেইশ টাকা এগারো পয়সা, হি-হি-হি।
চিন্তা ভুরু কুঁচকে তাকায় মোনার দিকে।
লিখেছে বেশ করেছে, তাতে হাসির কী আছে, শুনি?
কীরকম ঝানু লোক দেখছিস, কাগজের খরচ বাঁচিয়েছে। হি-হি।
খামোকা হাসতে তোর ভালোও লাগে?
চিন্তা বিরক্ত হয়ে কালভার্টটায় ওপর বসে পড়ে। তোর পয়সাকড়ি থাকে তুইও হিসেব লেখ-না। বিস্তর জায়গা রয়েছে, বারণ করছে কে?
আরে হিসেব লিখতে পারলে আর এ দশা হয় নাকি? মগজে আঁক-ফাঁক কিছু ঢুকল না বলেই তো মৌলবি রেগেমেগে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিলে। ধীরে-সুস্থে চিন্তার পাশে বসতে বসতে মোনা বলে, অবিশ্যি তিন মাসের মাইনেও বাকি পড়েছিল।
হুঁ, সেইটেই বল। চিন্তে গম্ভীর হয়।
বুঝলি, কিচ্ছু ক্ষেতি হয়নি। মৌলবিসাহেবও টের পেয়েছিল—কোনোদিন আমার পয়সাও জুটবে না, হিসেবও লিখতে হবে না। খুব এলেম ছিল লোকটার।
আমি খুব ভালো আঁক জানতুম। চিন্তা তেমনি গম্ভীর হয়ে বলে।
বেশি গুল দিসনি আমার কাছে। মোনা ফাঁস করে ওঠে, আমি কিছু জানিনে না? ভালো আঁকই যদি কষবি তাহলে পাঠশালার সেই শুটকে পন্ডিত তোর দু-হাতে ইট দিয়ে তোকে রোদুরের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখত কেন রে? আমি দেখিনি?
যেতে দে ওসব। চিন্তা অস্বস্তি বোধ করে, বিড়িটিড়ি আছে নাকি সঙ্গে? দে তাহলে।
দাঁড়া দেখি। হাফ শার্টের পকেট হাতড়ায় মোনা, আছে দু-তিনটে। এই একটা দিলুম, কিন্তু আর চাসনে তা বলে দিচ্ছি।
না, চাইব না। কিন্তু মাইরি, ব্যাপারটা কী বল দিকি? বিড়ির দাম যে সিগ্রেটকে ছাড়িয়ে উঠল।
মোনা একটা মুখভঙ্গি করে, শালার মুড়ির কেজিই চার টাকা উঠল তো বিড়ি।
দুজনে বিড়ি ধরায়। পাশাপাশি চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। মাথার ওপরে একটা কাঠবাদাম গাছের পাতা হাওয়ায় কাঁপে, অথচ খচখচ করে শব্দ ওঠে। একটি নতুন বউ যেন কাপড়ের আওয়াজ তুলে চুপিসাড়ে পালিয়ে যাচ্ছে এমনই মনে হয়। কালভার্টের নীচে একরাশ ঘোলাজল থমকে আছে, কয়েকটা সোনা ব্যাং ড্যাবা-ড্যাবা চোখ তুলে চার-পা ফেলে ভাসছে তার ভেতরে। হাতের বিড়িটায় গোটা কয়েক টান দিয়ে মোনা একটা ব্যাংকে লক্ষ করে ছুড়ে দেয় সেটা। ব্যাংটা খলাৎ শব্দে ডুবে যায়, তারপর আবার হাত তিনেক দূরে চার-পা ছড়িয়ে ভেসে ওঠে।
সেইটে লক্ষ করে মোনা বলে, জানিস, সায়েবেরা ব্যাং খায়!
হুঁ, তোর কানে কানে বলে গেছে।
মাইরি, বানিয়ে বলছি না। রজ্জবচাচার এক ছেলে কলকাতার হোটেলে চাকরি করে, সে…
বাধা দিয়ে চিন্তা জিজ্ঞেস করে, সেও ব্যাং খায় বুঝি?
তোবা তোবা! মোসলমানের ব্যাটা না?
রেখে দে, বারফট্টাই করিসনি।
চিন্তা ঠোঁট বাঁকায়। আধখানা খেয়ে তার বিড়িটা নিবে গিয়েছিল, সেটাকে সাবধানে কানের ওপর খুঁজতে খুঁজতে বলে, কলকাতায় গেলে হিন্দু-মোসলমান কিছু থাকে না।
তা যা বলেছিস। মোনা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
ঠিক তখন চিন্তার চোখ পড়ে, নীচে বাঁ-দিকে কালভার্টের জলের কোল ঘেঁষে জোলো ঘাসে-ছাওয়া এক টুকরো ছোটো জমির ওপর পা ছড়িয়ে পড়ে আছে লাল-সাদা গোরুটা।
ওটা কী রে?
মোনাও তাকিয়ে দেখে। একটু চুপ করে যায়। থেকে থেকে এক-একটা ঢেউয়ের মতো শ্বাস দুলে যাচ্ছে গোরুটার পাঁজরাসার শরীরের ওপর দিয়ে। এখান থেকেও ছাই ছাই রঙের একটা চোখ দেখা যায়, জলের মতো একটা রেখা নেমেছে তা থেকে, বিনবিন করে ওনকি উড়ছে একরাশ। কালো লম্বা জিভটা বেঁকে বেরিয়ে এসেছে, মুখে ময়লা ফেনা জমেছে, ল্যাজের দিকটা গোবরে একাকার।
মোনা প্রায় চুপি চুপি বলে, মরে যাচ্ছে গোরুটা।
কার গোরু রে?
কে জানে?
এখানে মরতে এল কেন?
কোথায় মরবে, বল? একটা জায়গা তো চাই।
ইস, একেবারে চোখের সামনে।
চোখটা কোথায় সরাবি চিন্তা? মরণ কোথায় নেই?
তা বটে। মাথার ওপর বাদাম গাছটায় একটা কাক ডেকে ওঠে। অদ্ভুত শোনায় তার আওয়াজটা। মোনার শরীরটা শিউরে যায় এক বার।
কীরকম বিচ্ছিরি করে ডাকল রে কাগটা।
ওরা নানারকম করে ডাকতে পারে। ওদের সব ডাকের একটা মানে থাকে।
মোনা ঘাড় বাঁকিয়ে এক বার চেয়ে দেখে চিন্তার দিকে, তুই আবার কাগ-চরিত্তির শিখলি কোত্থেকে?
আমি শিখব কেন? লোকে বলে।
আবার সেইভাবে ডেকে ওঠে কাকটা। ডাল-পাতা নড়বার শব্দ পাওয়া যায়, এক ডাল থেকে আর এক ডালে উড়ে বসল বোধ হয়। একটা শুকনো পাতা হাওয়ায় পাক খেতে খেতে নীচের ঘোলাজলের মধ্যে গিয়ে পড়ে সবচেয়ে বড়ো ব্যাংটার নাকের সামনে। ব্যাংটা নড়ে না, ড্যাবডেবে চোখ মেলে পাতাটার দিকে চেয়ে থাকে কেবল।
মোনা মাথা নাড়ে, হুঁ, নিশ্চয় কিছু বলছে কাগটা।
কী বলছে বল তো?
আমি জানব কী করে? তুই কাগ-চরিত্তির জানিস, তুই-ই বল।
চিন্তার দৃষ্টি গোরুটার ওপর আটকে থাকে। ছাই ছাই রঙের চোখের পাশ দিয়ে একটা জলের রেখার মতো দেখা যাচ্ছে। মরবার আগে গোরুটা কেঁদেছে। কে কাঁদে না?
আবার কর্কশ রব তোলে কাকটা। কেমন আধো আধো আহ্লাদে ভঙ্গিতে বলে, গ-গ-গ। হঠাৎ বিশ্রী রাগ হয়ে যায় চিন্তার। পিছন দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে একটা নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে দেয় মাথার ওপর।
ভাগ শালা, ভাগ।
ঝটপট করে কাক উড়ে পালায়, দূর থেকে তার আপত্তি শোনা যায়, কা-কা-কা। ঢিলটা আকাশে অনেকখানি ছুটে গিয়ে কালভার্টের জলে ঝপাং করে নেমে আসে। খলাৎ খলাৎ করে ডুব দেয় চমক-খাওয়া ব্যাংগুলো—আবার চার পা ছড়িয়ে ভেসে ওঠে।
বেশ করেছিস। মাথা নেড়ে সায় দেয় মোনা, ভারি জ্বালাচ্ছিল।
চিন্তা আবার আগের মতো সোজা হয়ে বসে। গোরুটার দিকে চেয়ে থাকে একভাবে।
কাগটা কী বলছিল জানিস মোনা?
কী বলছিল?
গোরুটা তো মরছে। এবার গিয়ে ওর চোখ দুটো ঠুকরে খাই। শালা!
গো-মড়কে তো ওদেরই পাব্বন।
আর শেয়ালের।
আর মুচির। এখনও টের পায়নি। পেলেই ছুরি-ছোরা নিয়ে হাজির হবে।
এতক্ষণ পরে চিন্তা হেসে ওঠে। বাদামের পাতার মতো একটা শুকনো খসখসে আওয়াজ ওঠে তার গলায়। ভুরু দুটো একসঙ্গে জুড়ে যায় মোনার।
হাসলি যে?
ভাবছি, মুচি আসবে কোত্থেকে! সেই এক ঘর ছিল না গাঁয়ে? না খেয়েই তো মরল তার সব কটা। শেষে সেই বুড়ো কিষ্টোদাস একদিন গলায় ফাঁস বেঁধে ঝুলে পড়ল চালের আড়া থেকে।
হুঁ, মনে পড়েছে। স্মৃতিটা মোনার অস্বস্তি জাগায়, আমিও দেখতে গিয়েছিলুম। জিভটা আধ হাত ঝুলে গিয়েছিল—ইয়া আল্লা।
একদম ওই গোরুটার মতো।
একদম।
আর নাক-মুখ-কান দিয়ে রক্ত নেমেছিল।
তখনও ওইটুকুই রক্ত ছিল গায়ে। ইচ্ছে করলে বুড়োটা আরও ক-দিন বেঁচে থাকতে পারত।
তা পারত। ঘরেও তখনও খাবার ছিল।
ছিল? মোনা আশ্চর্য হয়, খাবার আবার কোথায় দেখলি তুই?
কেন, একরাশ শুকনো জামের আঁটি পড়ে থাকতে দেখিসনি দাওয়ায়? ওইগুলো সেদ্ধ করে ঘেঁচে নিয়ে—হি-হি-হি।
মোনার বিশ্রী লাগে। বিরক্ত হয়ে বলে, মানুষের মরণ নিয়ে হাসি-মশকরা করিসনে চিন্তা।
ওসব ভালো না।
ভালো না কেন রে? এখন থেকে তৈরি হয়ে নিচ্ছি। দ্যাখ-না আর দু-এক মাস বাদে কী হয়। তোর-আমার বরাতে জামের আঁটিও জুটবে না।
আরও খারাপ লাগে কথাটা, কিন্তু মোনা জবাব খুঁজে পায় না। একটু পরে চিন্তাই আবার বিড়বিড় করে ওঠে।
গোরুটা কিন্তুক না খেয়ে মরেনি। দুজনে আবার গোরুটার দিকে তাকায়। বিকেলের একঝলক লাল আলোয় গোরুটার মৃত্যুকে আরও করুণ, আরও নিষ্ঠুর দেখায়।
না, অসুখ করেছিল।
কী অসুখ করেছিল? আলতোভাবে জানতে চায় চিন্তা।
আমি কী করে জানব? মোনা ব্যাজার হয়, আমি গো-বদ্যি নাকি?
তোর বাপ তো অনেক ঝাড়ফুক জানত।
সে মানষের, গোরুর নয়।
গোরু আর মানুষে ফারাক আছে নাকি? দুই-ই মরে।
কিন্তু গোরু না খেয়ে মরে না।
না খেয়ে মরে না! চিন্তার স্বর ঝাঁ করে ওঠে, ভারি পন্ডিত এলেন উনি। খরা হয়ে মাঠের সব ঘাসপাতা শুকিয়ে গেলে তখন? তোর যদি খোল-জাবনা কেনার পয়সা না থাকে তখন?
এই গোরুটা কিন্তুক বুড়ো হয়ে মরেছে।
বলেছে তোকে।
চিন্তা শব্দ করে একরাশ থুতু ছুড়ে দেয় ব্যাংগুলোর দিকে। খাবার ভেবে দুটো ব্যাং একটু এগিয়ে আসে, তারপর বোধ হয় বিরক্ত হয়েই চিন্তার দিকে তাকিয়ে থমকে যায়।
চিন্তা আবার হেসে ওঠে। মোনা চোখ তোলে।
হাসলি যে?
একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল।
কথাটা কী?
গোরুর গলায় দড়ি থাকে, কিন্তু না খেয়ে মরলেও গোরু কখনো গলায় দড়ি দিতে পারে না। হি-হি।
বকিসনি।
কিছুক্ষণ চুপ। বাদাম গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ হয়। একটা ফিঙে লাফাতে লাফাতে গোরুটার পাশে গিয়ে বসে, তারপরেই আবার কোথায় উড়ে চলে যায়। দুটো বোলতা মারামারি-জড়াজড়ি করতে করতে জলের কাছ পর্যন্ত গিয়ে আলাদা হয়ে যায়। একটা পালায়, আর একটা তাকে তাড়া করে। বিকেলের রাঙা আলোয় খুশি হয়ে এদিকে-ওদিকে গোটা কয়েক পোকা কিটকিট কিরকির করে ডাকে।
ঝুনঝুন ঠিঠিন করে আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে দূর থেকে। একটুক্ষণের জন্যে গোরুটাকে ভুলে গিয়ে সেদিকে চোখ তোলে দুজন।
তিন জন লোক আসছে আধছোটার ভঙ্গিতে। মালকোঁচা করে পরা ধুতি, কোমরে লাল গামছা বাঁধা, কাঁধে ঘুঙুর-লাগানো ভারে দু-তিনটে করে ছোটো ছোটো তামা-পেতলের ঘটি। সেই আধছোটার ভঙ্গিতে তারা এগিয়ে আসে, চিন্তা আর মোনাকে ছাড়িয়ে চলে যায়— ফিরেও তাকায় না তাদের দিকে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাদের ভার থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা যায়, চোখে পড়ে তাদের কোমরে বাঁধা লাল গামছা, তাদের পিঠের ছোটো ছটো পুটলি দোল খায়, তামা-পেতলের ছোটো ঘটিগুলো বিকেলের রোদে ঝিকমিক করে।
মোনা বলে, চিনিস? চিন্তা জবাব দেয়, না।
ভিনগাঁয়ের লোক।
সে তো দেখাই যাচ্ছে।
তারকনাথের মাথায় জল ঢালতে চলল, না?
হুঁ।
কী হবে তাতে?
পুণ্যি।
ধ্যাত্তোর পুণ্যি!
মোনা নাক কোঁচকায়, পুণ্যিতে পেট ভরে নাকি? বাবা তারকনাথ চালের কিলো নামিয়ে দিতে পারে বারো আনায়? ছ-টা বিড়ি দিতে পারে পয়সায়?
অ্যাই, অ্যাই।
রাগ করার ভঙ্গিতে চিন্তা শাসায়, হিদুর ধম্মকম্ম নিয়ে কথা বলিসনি।
ঘোড়াড্ডিম ধম্মকম্ম। আমি কাউকে ডরাইনে। পির-নবি-আল্লা সকলকে হক কথা শুনিয়ে দিতে পারি। জমিরুদ্দিন মোল্লা তো জমি বলদ বেচে হাজি হয়ে ফিরে এসেছিল, কী হল শেষটায়? পোকামারা বিষ খেয়ে মরে বাঁচল।
চুপ কর মোনা, ভালো লাগে না।
মোনা একবার ঠোঁট কামড়ায়, ভালো কি আমারই লাগে নাকি? কিন্তুক এইসব দেখলে…
ওরা বিশ্বাস করে যদি সুখ পায় তাতে তোর-আমার ক্ষেতিটা কী বল দিকি?
তা যা বলেছিস। বিশ্বেস করতে পারলে আমরাও বেঁচে যেতুম।
আবার চুপচাপ। মাঠের বাতাসটা যেন থেমে যায় হঠাৎ। রাঙা আলোর বিকেলটাকে আশ্চর্যরকম শান্ত আর নিঝুম মনে হয়। এতক্ষণে ওদের কানে ফোঁসানির মতো একটা আওয়াজ উঠে আসে। গোরুটার শ্বাস উঠছে, ঢেউ খেলে যাচ্ছে পাঁজরাসার শরীরের ওপর দিয়ে। ছাই ছাই চোখের সামনে ওনকির ঝাঁক আরও কালো হয়ে উঠেছে। কয়েকটা ডাঁশ উড়ছে—ওরা শেষ খাওয়া খেয়ে নিতে চায় বোধ হয়।
গোরুটা বেশ সুলক্ষণে ছিল রে। মোনা-ই কথা শুরু করে আবার।
কী করে জানলি?
কপালে কেমন চাঁদ রয়েছে দেখছিস না!
চিন্তা হাসে। বাদামের পাতার মতো শুকনো হাসিটা খস খস করে।
আমি যখন জন্মেছিলুম, তখন আমার ঠাকুরমা কী বলেছিল, জানিস?
কী বলেছিল?
বলেছিল, আমি খুব ভাগ্যিমানী হব। নিজের হাল-গোরু হবে, দশ-বিশ বিঘে জমি হবে।
হয়নি? মোনা মুখ টিপে হাসে।
জ্বালাসনি।
চিন্তা নিজেও একটু হাসতে চেষ্টা করে, আসলে বুড়ি বোধ হয় নাতিকে ঠাট্টা করেছিল একটুখানি। কিন্তু বাবা ছিল ভারি ক্যাবলাটে ভালো মানুষ, সেই কথায় পেত্যয় করে আমার হাতে দু-তিনটে তাবিজ-কবচ বেঁধে দিয়েছিল—হি-হি-হি!
গোরুটার কিন্তু কপালে…
ওটা ভগবানের ঠাট্টা, বুঝলি? কী করে রাস্তার ধারে বেঘোরে মারা যাচ্ছে দ্যাখ। একটু পরে রাত হবে, তখনও হয়তো মহাপ্রাণটা বেরিয়ে যাবে না—আর সেই সময়ে শেয়ালেরা এসে জ্যান্ত ছিঁড়ে খাবে। গোরুটা নিজের গলায় দড়ি দিতে পারলে বেশ হত, না রে?
মোনা জবাব দেয় না। বিকেলের রোদে ছায়া পড়েছে—এতক্ষণ একমুঠো সোনার মতো জ্বলছিল, এখন পুরোনো তামার মতো রং ধরেছে। সেই ছায়া মোনার মনের ভেতরেও একটু একটু করে ছড়াতে থাকে। দিনের আলোটা বেশ ভালো—তবু কোথায় একটা ভরসা থাকে, মনে হয় যাহোক করে চলে যাবে, চালিয়ে যাব। কিন্তু সন্ধে হলেই…
চিন্তা শুরু করে, আমার মামারবাড়ির দেশে আর একটা গলায় দড়ি দেখেছিলুম। ফুটফুটে একটা অল্পবয়সি বউ…
তুই থাম দিকিনি। মোনা এবার সত্যি সত্যিই ধমক দেয় চিন্তাকে, কী আরম্ভ করলি তখন থেকে? একটা ভালো কথাও মনে আসছে না?
আসছে না রে। চোখের সামনে গোরুটাকে মরতে দেখে…
তবে উঠে যা এখান থেকে, উঠে যা তুই। মোনার স্বর কড়া হয়ে ওঠে, এখানে বসে থাকবার জন্যে তোকে দিব্যি দিয়েছে কে?
চিন্তা চুপ করে। মোনা বিকেলের তামাটে রোদের ভেতর অনেক দূরে চোখ মেলে দেয়।
রমজানেরই রোজার শেষে এল খুশির ইদ হঠাৎ গুনগুনিয়ে বেসুরো গলায় গান শুরু করে মোনা।
হেসে উঠতে গিয়েও চিন্তা হাসে না। তার বদলে জিজ্ঞেস করে, ইদ এলে বুঝি খুব খাওয়া-দাওয়া করবি?
হুঁ, কচুঘণ্ট।
তবে যে গান জুড়েছিস বড়ো?
খাওয়া-দাওয়ার কথা ভাবতেও ভালো লাগে। মনে কর ভালো গোস্ত, পোলাও-বিরিয়ানি, তিন রকমের কাবাব…
ইস-ইস! ঘরে একেবারে নবাবের বাবুর্চিখানা!
মিটমিট করে তাকায় চিন্তা, ভাত খেয়েছিস কবে?
মঙ্গলবার।
এই ক-দিন?
গম-টম।
টম কাকে বলে?
কিচ্ছু জানিসনে না? তুই আমি দুজনেই তো খেতমজুর। টম বুঝতে পারিসনে?
বিলক্ষণ। আজই তো এক বোঝা কলমি শাক তুলেছিল বউ। ক-টা কুচো চিংড়ি ছিল তার ভেতরে আর একমুঠো গুগলি। দিব্যি খাওয়া হয়ে গেল।
দু-দিন পরে আর কলমিও থাকবে না।
তা থাকবে না।
তখন কী খাবি?
এই গোরুটা যা খাচ্ছে এখন। খাবি।
নিজের রসিকতায় হাসতে যায় চিন্তা, কিন্তু আবার তাকে ধমক দেয় মোনা। গোরুটার কথা আর বলবিনে, খবরদার।
আচ্ছা বলব না।
দুজনের চোখ আবার দূরে সরে যায়। বিকেলের রোদ আরও কালচে হয়ে এসেছে। খানিকটা সামনে দু-তিনটে বাবলা গাছ জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। নীচের গুঁড়িপানার ওপর ঝুরঝুর করে ফুল ঝরছে তাদের, যেন সবুজ চাদরের ওপর হলুদের নকশা কাটছে। আর একটু এগিয়ে জলে-ভরা ধানের খেত। ছায়া নুয়ে পড়েছে তার ওপর, তবু দেখা যায়। সাদা জলের সঙ্গে কী বাহারই দিয়েছে নতুন ধানের! কোথাও ফিকে হলুদের রং-মাখা নতুন শীষের সার, কোথাও আর একটু বড়ো হয়ে চমৎকার শ্যামলা, কোথাও চোখ-জুড়োনো ঘন সবুজ। তাকিয়ে থাকলে আর পলক পড়ে না। জল আর সেই ধানের ওপর এখন শেষ বেলার রাঙা মেঘের একখানা অদ্ভুত আভা পড়েছে, চেয়ে থাকতে থাকতে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে।
একটু পরে ধরা গলায় চিন্তা বলে, খুব ভালো ধান হবে এবার।
হুঁ।
গত দু-বছর এমন ফলন হয়নি।
হুঁ।
দেখে প্রাণ ঠাণ্ডা হয়।
ওই প্রাণই ঠাণ্ডা হোক। পেটে পড়বে ক-দানা?
চিন্তার একটা মস্তবড়ো দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে।
আচ্ছা, কোথায় ধানগুলো যায় বল দিকিনি?
কিচ্ছু জানিসনে, ন্যাকা একেবারে!
পেছনের পথটা দিয়ে আওয়াজ আর ধুলোর ঘূর্ণি তুলে জিপগাড়ি বেরিয়ে যায় একটা। নেমে আসা হালকা সন্ধ্যায় একটা লাল আলো অনেকটা দূর পর্যন্ত দপ দপ করে। সেই আলোটা থেকে চোখ সরিয়ে এনে ওরা দেখে সামনে সন্ধ্যার তারাটা উঁকি দিয়েছে।
কী ঝপ করে বেলাটা ডুবে গেল!
আর বেলা ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধানের খেতটাও যেন সুদূর হয়ে যায়। রাঙা মেঘটাকে কে যেন হাত বাড়িয়ে মুছে নেয়, তখন মনে হয় ওই ফিকে হলুদ, ওই শ্যামলা, ওই ঘন সবুজ রঙের ধানগুলো সামনের এই জলের ওপারে নয়, একটা প্রকান্ড নদীর ওধারে সরিয়ে দিয়েছে কেউ। গুঁড়িপানার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাবলা গাছগুলোকে কয়েকটা ভূতুড়ে মূর্তির মতো মনে হয় তখন।
একটা অর্থহীন অকারণ বিদ্বেষে দাঁতে দাঁতে কসকস করে চিন্তা।
ভোটের সময় অনেক জিপগাড়ি এসেছিল এ তল্লাটে।
মোনা বলে, হু এসেছিল। কেন আসবে না? পাকা সড়ক হয়েছে কীজন্যে? গাড়ি আসবে। বলেই তো।
তখন অনেক কথা শুনেছিলুম।
কান আছে, শুনবি বই কী।
চেঁচিয়েছিলুম।
শোর তোলবার জন্যেই আল্লা গলা দিয়েছেন। বোবা হয়ে কী লাভ?
ছায়া কালো হয় চারিদিকে। মোনার ভয় করে এখন। পেটের গম-টমগুলো কখন নিশ্চিহ্ন। একটা যন্ত্রণা পাক দেয় সেখানে। হঠাৎ একটা-কিছু আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে তার, এই রাত্রির স্রোতে নিরুপায় হয়ে ভেসে যাবার সময় আলোর মতো, ডালের মতো একটা-কিছু।
কে যেন বলছিল পাঁচ কাঠা করে জমি দেবে আমাদের।
পেয়ে নে।
আবার চুপচাপ। দুজনের ভেতরে যেন সন্ধ্যার একটা আড়াল নামে এখন। নিতান্ত বলবার জন্যেই মোনা বিড়বিড় করে যায়, আমার মেয়েটা বোধ হয় মরেই যাবে, বুঝলি।
আমার বউটাও। বিকৃতভাবে চিন্তা বলে, কিছু ভাবিসনি।
না, ভাবনার কিছু নেই। মোনা নির্ভাবনা হতে চেষ্টা করে। চিন্তার হিংস্রভাবে মনে হয়, দূরের ওই ধানখেতটার ওপর অমন করে সন্ধ্যার আলোটা না পড়লেও পারত। তা না হলে সে বেশ ছিল, এত খারাপ তার লাগত না।
গোরুটার শ্বাসের শব্দ শোনা যায়। এখনও মরতে পারেনি। আবছা অন্ধকারে তার শরীরের রেখাটা অন্যরকম দেখায় এখন। আচমকা ওটাকে মানুষ বলে ভুল হয়ে যেতে পারে।
মোনা আস্তে আস্তে বলে, একটু পরে শেয়াল এসে ছিঁড়ে খাবে ওটাকে।
চিন্তা মাথা তোলে। তার চোখ জ্বলে।
কী করতে চাস?
ইচ্ছে করছে একটা লাঠি হাতে নিয়ে সারা রাত…
সারা রাত শেয়াল তাড়াবি? ক-টা শেয়াল তাড়াবি রে? হা-হা করে খানিটা বেয়াড়া রকম হাসি শুরু করে চিন্তা। আরও ভয় পায় মোনা। বাদাম গাছের ছায়ায় চারদিকটা তাদের অস্বাভাবিক কালো। কালভার্টের জলে খলাৎ করে একটা ব্যাং লাফ দেয়, সেই শব্দটা চিন্তার হাসির সঙ্গে মিশে গিয়ে তাকে চমকে দেয়, খিদের যন্ত্রণাভরা পেটের ভেতরটা কেমন গুরগুর করে ওঠে।
হাসি থামিয়ে মোনার কাঁধে গাঁট-বের-করা শক্ত আঙুলে একটা চাপ দেয় চিন্তা।
আর পাগলামি করতে হবে না, বাড়ি চল এখন।
জোলো-ঘাসে-ছাওয়া ছোটো ডাঙাটার ওপরে লাল-সাদা গোরুটা শ্বাস টানে। মরতে মরতেও মরতে চায় না। হয়তো শেয়ালে এসে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যেই অপেক্ষা করে।