1 of 2

সেই মুখ, সেই সুটকেস – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

সেই মুখ, সেই সুটকেস – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

ভিড় কম ছিল। তাই দুই বন্ধু দোকানে বসে গল্প করতে পারছিলাম। তা ছাড়া অবিনাশ তিনদিনের ছুটি নিয়েছে। কাজের মানুষ, ব্যস্ত মানুষ সে, দেখা পাওয়া ভার। কাজেই দেখা হয়ে যাওয়ার পর তাকে আর ছাড়তে ইচ্ছা করছিল না। হুঁ, তখন বেলা তিনটে। সারাদিন ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তায়, পার্কে বেরোনোর অসুবিধে ছিল। বসে গল্প করতে দুজন ধরমতলার চায়ের দোকানটা বেছে নিয়েছিলাম।

আবহাওয়া, বাজার-দর, আসাম, দিল্লি ইত্যাদি কোনও প্রসঙ্গ আমাদের আলোচনায় ছিল না—না সিনেমা, না খেলা! আমরা ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা বলে সুখ পাচ্ছিলাম। কেননা অবিনাশ আমার বাল্যবন্ধু। আমরা নিজেদের কথা, পরিবারের কথা বলে যত আনন্দ পাই অন্য কিছুতে তত আনন্দ পাই না। অথচ আমি একজন ডাক্তার, অবিনাশ পুলিশের লোক। ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন ছাড়া আমাদের অনেক কিছু পরস্পরের কাছে বলার ছিল, পরস্পরের কাছ থেকে জানবার ছিল। অদ্ভুত ঘটনা, আশ্চর্য কাহিনি, রোমাঞ্চকর সংবাদ—যা প্রায় প্রত্যেক ডাক্তারের, প্রত্যেক পুলিশ অফিসারের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে জমা থাকে। কিন্তু সেসব কোনওদিনই দুজনের মধ্যে আলোচনা হত না। সেদিনও হয়নি। এমন সময়—।

সিগারেট ধরাতে গিয়ে হঠাৎ আমার হাত কেঁপে উঠল। কাঠিটা নিভে গেল।

‘কী হল?’ অবিনাশ হাসল, কিন্তু সেইসঙ্গে আমার চেহারা দেখে, চোখ দেখে তার হাসি নিভে গেল।

দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় সিগারেট ধরালাম।

অবিনাশ চুপ করে রইল।

আমি আরও একবার ওধারের দেওয়ালের কাছের টেবিলটা দেখলাম। বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। লক্ষ করে অবিনাশ বলল, ‘কী হে, তোমার পরিচিত কেউ নাকি?’

আমি আস্তে মাথা নাড়লাম।

এমনভাবে মাথা নাড়লাম, যেন বন্ধুকে আশ্বাস দিলাম, ‘বলব, বলছি, আর-একটু অপেক্ষা করতে দাও।’

তাই অবিনাশ অপেক্ষা করল। নতুন সিগারেট ধরিয়ে সে আমার হাতের মেডিকেল জার্নালটা টেনে নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগল। আর আমি তাকিয়ে রইলাম দেওয়ালের কাছের টেবিলের দিকে। সাদা পরোটা আর কষা মাংসের অর্ডার দিয়েছে বলে মনে হল। ফাইবারের প্রকাণ্ড সুটকেসটা পাশের একটা শূন্য চেয়ারে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল ও চকচকে টাকের জল মুছছে। না, আমি অবাক হচ্ছিলাম, ভদ্রলোক কখন দোকানে ঢুকল দেখলাম না বলে, অথচ আমি ও অবিনাশ প্রায় দরজার কাছটায় একটা টেবিল নিয়ে বসেছিলাম। টাক, ফাইবারের সুটকেস এবং গায়ের আধময়লা টুইলের হাফ শার্ট একরকম আছে, কিছুই বদলায়নি, কাজেই আমার চিনতে কষ্ট হয়নি।

খাবার আসতে ভদ্রলোক গোগ্রাসে গিলতে আরম্ভ করল। যেন খুব খিদে পেয়েছে। অন্য কোনওদিকে দৃষ্টি নেই। খাচ্ছে আর পেঁয়াজ রঙের বড়-বড় চোখ দুটো মেলে ধরে প্লেটের পাশে রাখা মাংসের হাড়গুলি দেখছে—অর্থাৎ, যথেষ্ট চিবোনো হল কি না, এক-আধটু মাস-মজ্জা চর্বি হাড়ে থেকে গেল কি না, এমন একটা ভাব। হাসি পাচ্ছিল আমার। হাসলাম না যদিও। অবিনাশের ক্রমশ ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু উপায় নেই। আমি অপেক্ষা করছিলাম ফাইবারের সুটকেস হাতে ঝুলিয়ে ভদ্রলোক কখন দোকান থেকে বেরোবে। কেননা তার হাঁটা ও চলাটাই আমাকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে। কেননা তখনই যা-কিছু ঘটবার ঘটবে—অতীতে ঘটেছিল।

খাওয়া শেষ হল। গ্লাসের জলে হাত ডুবিয়ে হাত ধোয়া শেষ হল এবং ভেজা হাতটা ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে মুখ ধোওয়ার কাজ শেষ হল। তারপর রুমাল দিয়ে ঘটা করে মুখ ও হাত মোছা হল। বিল এসে গেল। বিল মেটানো হল। কিছু খুচরা ফিরিয়ে নিয়ে এল বয় পিতলের থালায় করে। যেন তাকে একটা দশ নয়া পয়সা বকশিশ দেওয়া হল। বয় খুশি হয়ে চলে গেল। ভদ্রলোক বাকি পয়সা পকেটে পুরে চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চেয়ারের শব্দ হল। দাঁড়িয়ে সুটকেসটা হাতে নিল, তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে দরজা পার হয়ে সোজা রাস্তায় নেমে গেল। আমি এতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে তার গতিবিধি দেখছিলাম। লোকটা রাস্তায় নেমে যেতে একটা হালকা নিশ্বাস ফেললাম। কিন্তু তখনও আমার দেখা শেষ হয়নি। রাস্তার ভিড়ে সেই টাক-পড়া মাথা ও প্রকাণ্ড সুটকেসটা হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমাকে তাকিয়ে থাকতে হল। কেননা আমার আশঙ্কা তখনও দূর হয়নি। বিশেষ, ভদ্রলোক যখন চলতে আরম্ভ করে তখনই তো যত গোলমাল—।

প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। আমায় চেয়ার থেকে রাস্তার লাইটপোস্টের ওপাশটা আর দেখা যাচ্ছিল না, অথচ ভদ্রলোক সেদিকে হেঁটে যাচ্ছে। আমি সামনের দিকে ঝুঁকে মাথাটা কাত করে ধরি।

‘কী ব্যাপার—’ অবিনাশ বোকা হয়ে গেছে আমার রকমসকম দেখে। হাতের ইশারায় তাকে চুপ করতে বললাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে—দেখলাম লাইটপোস্ট পর্যন্ত এগিয়ে ভদ্রলোক পেভমেন্ট থেকে নেমে রাস্তা ক্রস করছে, একটা ডবল ডেকার দুর্বার বেগে ছুটে আসছে—টাক-পড়া মাথাটা গুঁড়িয়ে দেবে নাকি—’গেল গেল গেল!’ অনেক মানুষের গলা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, একসঙ্গে উত্তেজনা ও আতঙ্ক আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। কাঠের মতো স্থির শান্ত ধীর আমি দাঁড়িয়ে আছি, তাকিয়ে আছি। না, টাক-পড়া ভদ্রলোকের হাতে সুটকেস ঝুলছে। নির্বিঘ্নে দ্রুত ধাবমান ডবল ডেকারের পাশ কাটিয়ে রাস্তার ওপারে পেভমেন্টের ওপর উঠে গেল। দুর্ঘটনা তাকে স্পর্শ করল না। তবে? প্রকাণ্ড একটা ঢোক গিললাম। চিৎকার শুনে অবিনাশও চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠেছিল।

‘কী হল?’

‘ট্রামের তার ছিঁড়েছে—।’

‘কারও গায়ে লাগল?’

‘না, লাগতে-লাগতে বেঁচে গেছে—’

দু-তিনজন রেস্টুরেন্টে ঢুকে কথা বলছিল : ‘ধর্মের ষাঁড় কিনা, তাই বেঁচে গেছে।

আর-একটু হলে—।’

আমি এবং অবিনাশ দুজনে শুনলাম। দুজন আবার নিশ্চিন্ত হয়ে চেয়ারে বসলাম।

‘তুমি মনে করেছিলে তোমার সেই পরিচিত ভদ্রলোক বুঝি চাপা পড়েছে?’ অবিনাশ প্রশ্ন করল।

আমি মাথা নাড়লাম।

‘পরিচিত ঠিক বলা যায় না, তবে তাকে এর আগে একদিন দেখেছিলাম বটে। আশ্চর্য লোক—তার মধ্যে একটা দৈবশক্তি লুকিয়ে আছে।’

‘কীরকম?’ অবিনাশ ভুরু কোঁচকাল।

‘ভদ্রলোক যখনই যেদিক দিয়ে যাবে একটা-না-একটা দুর্ঘটনা ঘটবেই—অথচ তাকে কোনওদিন দুর্ঘটনা স্পর্শ করে না।’

‘এ আবার কী কথা বলছ!’ পুলিশ অফিসার হাসল : ‘বিজ্ঞানের ছাত্র তুমি—দৈব-টৈব বিশ্বাস করো?’

‘করতে হচ্ছে—ওই মানুষটা করাচ্ছে।’

অবিনাশ হাসল।

‘তিনি যখনই যেখানে যাবেন দুর্ঘটনা ঘটবে—অথচ তিনি বেঁচে যাবেন—এই তো? তবে আর দৈবশক্তি বলছ কেন—বলো দানোর শক্তি তাঁর মধ্যে লুকিয়ে আছে।’

‘ওই একই কথা—মানে আমার-তোমার মধ্যে যা নেই।’ সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘বিশ্বাস করবে কি? তবে বলছি শোনো। আমি ট্রেনে করে সেদিন হাওই যাচ্ছি—আমার শ্বশুরবাড়ি সেখানে তুমি জানো নিশ্চয়—।’

‘জানি।’ অবিনাশ মৃদু মাথা নাড়ল : ‘তারপর?’

‘এই ভদ্রলোক আমাদের কামরায় ছিল। এক কামরায় কত মুখ থাকে কাউকে মনে নেই, এই মুখটি মনে আছে। কারণ অবশ্য তার মাথার টাক এবং হাতের প্রকাণ্ড সুটকেসটা তুমি বলতে পারো। কিন্তু টাক এবং সুটকেস ছাড়া আরও কারণ আছে তাকে মনে রাখবার। বলছি। কোলাঘাটের কাছাকাছি একটা স্টেশনে ট্রেন ধরল। ভদ্রলোক নামল। যেন তখন মনে পড়েছে গাড়ি তার গন্তব্যস্থান ছেড়ে যাচ্ছে। যা হোক তাড়াহুড়ো করে ভদ্রলোক যেমন নামতে গেছে কী নেমে পড়েছে, এমন সময় একটা ”গেল-গেল” চিৎকার কানে এল। আমরা চমকে উঠলাম। জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিলাম সবাই। কী ব্যাপার! কামরার সমস্ত যাত্রী আশঙ্কা করছিলাম ভদ্রলোক হয়তো ঠিকমতো নামতে পারল না, হয়তো পা ফসকে চাকার নীচে চলে গেল। না, তা নয়। দেখলাম সুটকেস হাতে ঝুলিয়ে ভদ্রলোক দিব্যি লাইনের ধারের সরু মাটির পথ ধরে হাঁটছে। একটা ছাগল কাটা পড়েছে শোনা গেল। কী করে ছাগল কাটা পড়ার কথাটা জানাজানি হয়ে গেল যাত্রীদের মধ্যে তা টের পেলাম না যদিও, কিন্তু জানলাম এবং নিশ্চিন্ত হলাম আমাদের কামরার সেই ভদ্রলোক চারটে হাত-পা নিয়ে দিব্যি হেঁটে চলেছে দেখে।’

অবিনাশ ঠোঁট কুঁচকে হাসল।

‘চার হাত-পা আর সুটকেসটা নিয়ে।’

বন্ধুর হাসির নমুনা দেখে বুকের ভিতর ঢিব করে উঠল।

‘কেন, সুটকেসটা সম্পর্কে তোমার হঠাৎ কিছু সন্দেহ হচ্ছে নাকি?’ প্রশ্ন করলাম।

‘না, তা নয়।’ অবিনাশ আর হাসল না, কিন্তু দৃষ্টিটা হঠাৎ সূক্ষ্ম করে ফেলল, তার কপালে একটা রেখা ফুটে উঠেছে লক্ষ করলাম।

‘তারপর বলছি, শোনো।’ আরম্ভ করলাম, ‘কী কারণে গাড়িটা কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, সম্ভবত সিগন্যালের গোলমাল ছিল, আর সেই দাঁড়ানো আধঘণ্টার ওপর। সামনে একটা ছোট নদী, একটা ব্রিজ, হয়তো ব্রিজের কোনও গোলমাল হয়েছে আমরা আশঙ্কা করছিলাম। যা হোক, মাঝ-পথে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকলে যাত্রীদের মনের অবস্থা কী হয় তোমার আইডিয়া আছে নিশ্চয়। আমরা ছটফট করছিলাম। কেউ-কেউ ট্রেন থেকে নেমে ঘাসের ওপর পায়চারি করছিল। কেউ-কেউ গার্ড সাহেবের গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ি কখন ছাড়বে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল—কিছু যাত্রী ইঞ্জিনের কাছে চলে গেছে। প্রচণ্ড গরম। আমি জানালার বাইরে গলা বাড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিলাম। এমন সময় যেন হঠাৎ কানে এল কাছের-দূরের অনেকগুলি গলা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল ”গেল-গেল।” কী ব্যাপার? চোখ তুললাম, এদিকে-ওদিকে তাকালাম। আমার এক সহযাত্রী কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ”ওই দেখুন, ওখানে নদীর দিকে তাকান, খেয়াটা মাঝামাঝি গিয়ে ডুবে গেল।” তাই দেখলাম। সাঁতার কেটে কিছু মানুষ তীরের দিকে আসছে, দুটো জেলে ডিঙ্গি ছুটে গেছে নিমজ্জমান নৌকোর কাছে—টেনে-টেনে যাত্রীদের তুলছে। হাওয়া ছিল না, নদীতে বড় ঢেউ ছিল না, অথচ—’ আমি চুপ করলাম।

‘তো এর সঙ্গে টাক-পড়া ভদ্রলোকের কী সম্পর্ক ছিল?’ অবিনাশ আমার চোখ দেখছিল।

‘ছিল।’ পোড়া সিগারেটের টুকরোটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, ‘যখন নৌকোটো ডুবছিল তখন সেই ভদ্রলোক লাইনের পাশ দিয়ে হাতে সুটকেস ঝুলিয়ে মাটির রাস্তা ধরে গুটিগুটি হেঁটে যাচ্ছিল।’

‘তাই নাকি!’ এবার শব্দ করে হেসে উঠল অবিনাশ : ‘মানে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকাতে হেঁটে তিনি তোমাদের ধরে ফেলেছিলেন।’

‘তাই।’ ঘাড় কাত করলাম : ‘কিন্তু আবার কখন তার দেখা পেলাম একবার চিন্তা করে দ্যাখো!’

‘যখন একগাদা যাত্রী নিয়ে মাঝ-নদীতে নৌকোটা ডুবছিল।’ অবিনাশ বলল, ‘হাওয়া ছিল না, কিন্তু ওভারলোডেড হয়েছিল বলে খেয়ার ওই দুরবস্থা হয়েছিল, ওরা অধিকাংশ সময় তাই করে—কলকাতার গঙ্গায় ওইভাবে কত খেয়া রোজ ডুবছে, স্টিমবোটগুলো পর্যন্ত তলিয়ে যায়!’

বললাম, ‘তা হবে, কিন্তু সেদিন একসঙ্গে দু-দুটো দুর্ঘটনা ও টাক-পড়া ভদ্রলোক দর্শনলাভের কী অর্থ হয় তুমি বলতে পারো? আজ আবার দ্যাখো, যখনই তার মুখটা দেখলাম, তখনই সে রাস্তা ক্রস করছিল, ঠিক তখনই ট্রামের তার ছিঁড়ে পড়ল—ভাগ্যিস—।’

‘না, কোনও মানুষ মারা পড়েনি—একটা ষাঁড় মরতে-মরতে বেঁচে গেছে।’ অবিনাশ এবার মেরুদণ্ড টান করে সোজা হয়ে বসল : ‘আমি কিন্তু তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।’

অবিনাশের চোখে গোয়েন্দা-পুলিশের সন্দেহ ঝিকিয়ে উঠেছে লক্ষ করলাম।

‘করো।’ আমি তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে তৈরি, এমনভাবে বন্ধুর মুখের দিকে তাকালাম।

যেন একটু সময় কী চিন্তা করল অবিনাশ, তারপর বললে, ‘লোকটা কোন স্টেশনে তোমাদের কামরায় উঠেছিল?’

‘বলতে পারব না। সে যখন ট্রেন থেকে নেমে যাবে তার মাত্র মিনিট-পনেরো আগে আমি আবিষ্কার করেছিলাম এমন একটি যাত্রী আমাদের মধ্যে আছে যার মাথায় প্রকাণ্ড টাক, সঙ্গে একটা সুটকেস আছে। ছাই রং। সম্ভবত ফাইবারের, তখন লক্ষ করেছ কি?’

অবিনাশ ঘাড় কাত করল।

‘আচ্ছা, যখন তুমি তাকে প্রথম দেখতে পেলে তখন ভদ্রলোক কী করছিল?’

‘চুপ করে বসেছিল।’

‘কারও সঙ্গে কথা বলছিল কি?’

‘না।’ ঢোক গিললাম : ‘অন্তত আমি যতটা সময় দেখেছি কারও সঙ্গে তাকে আলাপ করতে দেখিনি।’

‘সুটকেসটা কোথায় ছিল? বাঙ্কের ওপর?’

‘না, কোলের ওপর বসানো ছিল।’ একটু থেমে থেকে পরে বললাম, ‘হয়তো আগে বাঙ্কের ওপর কী নীচে রাখা হয়েছিল, নেমে যাবে বলে কোলে করে বসেছিল এমনও হতে পারে।’

‘কী হতে পারে, কী হতে পারে না আমার জানার দরকার নেই। তুমি নিজের চোখদুটো দিয়ে কী দেখেছিলে তাই আমাকে বলো।’

‘ওই তো, সেটা কোলের ওপর রেখে চুপ করে বসেছিল ভদ্রলোক।’

আবার একটু সময় চিন্তা করল অবিনাশ।

‘কোন স্টেশনে তার নামবার কথা ছিল? মানে, স্টেশনে গাড়িটা ধরল অথচ নামল না, পরে ট্রেন যখন ছেড়ে দেয় তখন নেমে পড়ে? তাই তো?’

‘হুঁ, খুব সম্ভব বাগনান স্টেশন ছিল ওটা।’

বন্ধু মোলায়েম করে হাসল।

‘একটা লোক তার গন্তব্য স্টেশনে নামবে বলে পনেরো মিনিট আগে তৈরি হয়ে বসে আছে, অথচ যখন স্টেশনে গাড়ি ধরল তখন তার খেয়াল নেই, ব্যাপারটা একটু কেমন মনে হয় না?’

‘তা হয়তো বলতে পারো তুমি। কিন্তু তার গাড়ি থেকে নামবার সঙ্গে-সঙ্গে ছাগল কাটা পড়া, হেঁটে নদীর কাছাকাছি গেছে সে এমন সময় নৌকাডুবি। আজ, একটু আগে ভদ্রলোক রাস্তা পার হচ্ছে যখন, অমনি টামের তার ছিঁড়ে পড়া—এ সবের কী উত্তর আছে আমায় বলো?’

‘কোইনসিডেন্স, এমন হয়,’ গম্ভীর হয়ে বন্ধু বলল, ‘লোকটার অনুপস্থিতিতেও দুর্ঘটনাগুলো ঘটতে পারত—।’

‘আবার ঘটতে না-ও পারত।’ কেমন যেন জিদের গলায় বললাম, ‘ভদ্রলোক যখন যেখানে যাবে দুর্ঘটনা সঙ্গে নিয়ে যাবে।’

‘মানে দুর্ঘটনার এজেন্সি নিয়েছে টাক-পড়া মানুষটা বলতে চাও?’

‘নিশ্চয়।’ হেসে বললাম, ‘তার সুটকেসে কী আছে, কী উদ্দেশ্যে সে চলতি গাড়ি থেকে নামে, কারও সঙ্গে কথা না বলার পিছনে কী কারণ লুকিয়ে আছে, বা আজ হঠাৎ এই রেস্টুরেন্টে ঢুকে গোগ্রাসে মাংস-পরোটা গিলতে এল কেন, এসব তোমরা পুলিশের লোকেরা সহজে খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্যরকম। এবং এই প্রশ্নের উত্তর তোমাদের পুলিশি শাস্ত্রে আছে বলে মনে হয় না।’

অবিনাশ হাসতে লাগল।

‘সংস্কার ছাড়তে পারছ না তুমি, অথচ তুমি একটা বি এসসি, এম বি, পুরোপুরি বিজ্ঞানের ছাত্র—।’

তার কথা শেষ করতে দিলাম না।

‘বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে সব সমস্যা, সব রহস্যের বিচার করা যায় আমার তো মনে হয় না—অন্তত এক্ষেত্রে করা যাবে বলে ভরসা পাচ্ছি না।’

দু-বন্ধু সেদিন এই নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করলাম। বৃষ্টি ধরে গিয়ে রোদের টিকি দেখা গিয়েছিল শেষ বেলায়। একটা পার্কে ঢুকে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ বেড়ালাম। আলোচনা শেষ করে অবিনাশ একসময় বলছিল সুটকেসটার মধ্যে রিভলবার বা বোমা আছে বলে সে মনে করে না, বা বেআইনি সোনা চালান দেওয়ার কারবার করে তাও না, তবে আফিং-গাঁজা যে নেই-ই নিশ্চয় করে বলা যায় না। সম্ভবত ওই জাতের কিছু চোরাই মাল লোকটা এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় বয়ে বেড়ায়। লোকটার গতিবিধি দেখে এবং আমার মুখে আগের ইতিহাসটুকু শুনে অবিনাশ এই সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত উপনীত হতে পেরেছিল। আর হেসে বলেছিল, ‘দৈব-টৈব নিয়ে তুমি মাথা ঘামাও, কিন্তু অত সব সূক্ষ্মতার মধ্যে আমরা পুলিশের লোকেরা বাঁচতে পারি না, আমাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।’ অর্থাৎ ঠাট্টা করছিল সে।

কিন্তু রাগ করিনি। অবিনাশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আমার বউবাজার স্ট্রিটের ডিসপেনসারিতে চলে গেলাম। সন্ধ্যার দিকে আবার ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। আপনারা কেউ-কেউ লক্ষ করে থাকবেন বৈঠকখানা বাজারে ঢুকবার গলির মুখে আমার ছোটখাটো ডিসপেনসারির সামনে দুটো ফলের দোকান। বৃষ্টির জন্যে ডিসপেনসারির দরজায় রীতিমতো একটা ভিড় জমেছিল। জলের হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই আমার ওখানে আশ্রয় নিয়েছিল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, দরজার কাছে একটু ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি হচ্ছে, যেন একজন কে ভিতরে ঢুকতে চাইছে, পারছে না। তারপর চেষ্টাচরিত্র করে ভিড়ের ভিতর দিয়ে মোটা দেহখানা গলিয়ে ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে একটা সুটকেস। জলে ভিজে টাকটা ইলেকট্রিক আলোর নীচে চকচক করছে। আমার মুখ শুকিয়ে গেল।

‘নমস্কার।’ আগন্তুক ঘাড় নাড়ল।

পাল্টা নমস্কার জানাতে আমিও থুতনিটা নাড়লাম। কিন্তু আমার বুকের ভিতর কাঁপছিল। সত্যি বলতে কী, ভদ্রলোককে চেয়ারে বসতে বলার আগে আমি আমার চারদিকটা দেখে নিলাম। পাখাটা ঠিকমতো ঘুরছে তো, ইলেকট্রিক লাইন-টাইন কিছু খারাপ নেই তো, এমনকী যে-চেয়ারে বসেছিলাম সেটা পর্যন্ত নেড়েচেড়ে দেখতে চাইছিলাম, স্ক্রু-পেরেক কোথাও খসে-টসে পড়েনি বা আলগা হয়ে যায়নি তো, চেয়ারটা ভেঙে পড়বে কি!

চেয়ার ভাঙল না, পাখা ছিঁড়ল না, ইলেকট্রিক লাইনে আগুন ধরবে এমন কোনও আশঙ্কাও দেখা গেল না। রুমাল দিয়ে টাক মুছে ভদ্রলোক হেসে বলল, ডিসপেনসারির জন্য কিছু ওষুধপত্রের দরকার আছে কি না। বুঝলাম এজেন্ট। এবং কোন কোম্পানির ফাইল স্যাম্পল-এ ফাইবারের সুটকেসটা বোঝাই হয়ে আছে ডালা খোলামাত্র তাও নজরে পড়ল। খুশি হলাম। কিছু অর্ডার রাখলাম। ভদ্রলোক খুশি হল। নোটবই ও পেনসিল পকেটে পুরল। সুটকেসের ডালা বন্ধ করল। ভদ্রলোক উঠে নমস্কার জানিয়ে যখন দরজার কাছে গেছে তখন আমার হাতের কাছে টেলিফোন গর্জন করে উঠল। যেন ‘গেল-গেল’ বলে টেলিফোনটাই চিৎকার করে উঠেছিল। হাত কাঁপছিল। রিসিভার তুললাম। বন্ধুপত্নী রেখার গলা এইমাত্র অবিনাশ ওয়েলিংটনের মোড়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তার মোটরবাইক একটা ডবল ডেকারের ফুটবোর্ডে লেগে ছিটকে পড়েছিল। পুলিশ হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অবিনাশকে। আমি যেন খবর পাওয়ামাত্র সেখানে বন্ধুকে দেখতে যাই।

রিসিভার নামিয়ে রেখে একটা গাঢ় নিশ্বাস ফেললাম। টাক-পড়া ভদ্রলোক ততক্ষণে দরজার ভিড়ের মধ্য দিয়ে মোটা শরীরটা টেনে-টেনে বেরিয়ে যাচ্ছে।

মাসিক রহস্য পত্রিকা

পুজো সংখ্যা, ১৯৬০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *