সেই মুখ – সমরেশ বসু
আবার সেই মুখ। সেই ঢুলু ঢুলু চোখ, যার আয়ত ক্ষেত্র অতিরিক্ত সাদা। মানুষের চোখের রঙ কি কখনো এত সাদা হয়? উন্নত নাসা, মোটা ভুরু, চওড়া কপালের ওপর রেশম-মোলায়েম কালো চুলে বাঁ-দিকে সিঁথি কাটা, এবং হেলিয়ে পিছন দিকে টেনে আঁচড়ানো। পাতলা গোঁফ ঠোঁটের দু-পাশ দিয়ে বেয়ে পড়েছে। বোঝা যায় ক্ষুর লাগানো হয় না, মাঝে মাঝে সযত্নে কাচি দিয়ে ছেঁটে দেওয়া হয়। চিবুকের মাঝখানে একটি রেখা।
সেই মুখ—যার শরীর আমি কখনো স্পষ্ট দেখতে পাই না, অথচ গলায় শার্টের হাইকলার এবং টাইয়ের নট স্পষ্ট দেখতে পাই। বাদবাকি মনে হয়, কালো রঙের স্যুট পরে আছে। মনে হয়, তার কারণ, আমি তার গোটা শরীর কখনো দেখতে পাই না, এবং নিরালায় আমি সে-মুখ কখনো দেখিনি। যখনই দেখি, সব সময়ই লোকজনের মধ্যে। হঠাৎ সেই মুখ ভেসে ওঠে।
মুখের যে বর্ণনা দিয়েছি, তাতেই মুখটির সব কথা বলা হয় না। মুখের রঙ বেশ ফর্সা। এমনিতে রুগ্ন মনে হয় না, কিন্তু ফর্সা রঙের মধ্যে একটা অত্যধিক শুভ্রতা বর্তমান, যেন রক্তহীন। বয়স তিরিশ-বত্রিশ হতে পারে। যখনই আমি সেই মুখ দেখি, তখনই দেখি তার চোখ ঢুলু ঢুলু বা সেই রকমই একটা কিছু এবং ঠোঁটের কোণে, নরম গোঁফের পাশে এমন একটি হাসি লেগে থাকে, সমস্ত অভিব্যক্তিটি যেন একটি বিশেষ অর্থপূর্ণ। মুখটি কখনোই সোজা থাকে না, ডাইনে বা বাঁয়ে একটু কাত করা। সেই হাসিভরা ঢুলু ঢুলু চোখ আর ঠোঁটের হাসি দেখলে মনে হয়, সে যেন আমাকে বিশেষ কিছু বলছে বা জিজ্ঞেস করছে।
কার মুখ, কে সে, আমি বুঝতে পারি না। মুখটি আমার মোটই পরিচিত নয়। মুখটি আমি অদ্ভুত অদ্ভুত অবস্থায় দেখতে পাই। কবে থেকে যে এ মুখ দেখছি ঠিক মনে করতে পারি না, এবং ভাবলে আমার শিরদাঁড়ার কাছে কেমন শিরশির করে ওঠে। কারণ আমি স্পষ্টতঃই বুঝতে পারি, সেই মুখের বাস্তব বা প্রত্যক্ষ কোন অস্তিত্ব নেই। ইদানীং কালে প্রায়ই আড়ষ্ট আর শক্ত হয়ে থাকি এই আশঙ্কায়, কখন হয়তো দেখব সেই মুখ একেবারে আমার সামনে, তার গরম নিশ্বাস পড়ছে আমার মুখে; অথচ আমি তার কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
সব থেকে আশ্চর্য, আর দশটা ভূতুড়ে ব্যাপারের মত সে-মুখ আমি কখনো অন্ধকারে নিরালায় মাঠে জঙ্গলে বা ফাঁকা জায়গায় দেখতে পাই না। যেমন এখন দেখতে পাচ্ছি। এখন আমি একটি ক্লাবে লাঞ্চ পার্টিতে রয়েছি। বেলা প্রায় দুটো, এখানে শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে সকলের হাতে হাতে পানীয়ের পাত্র। এখানে আজ বাংলা দেশের একজন মন্ত্রী মহাশয়কে লাঞ্চে আপ্যায়ন করা হচ্ছে, সেই উপলক্ষে আমি নিমন্ত্রিত। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন প্রবীণ কবির সঙ্গে কথা বলছিলাম। আশেপাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন, নানারকম কথাবার্তা হচ্ছে। মন্ত্রী মহাশয়ের হাতে কমলালেবুর রসের পাত্র। তিনি একজন প্রবীণ ভাষাবিদের সঙ্গে কথা বলছেন, এবং সেখানে আরো কয়েকজন তাঁদের কথা শুনছেন। কয়েক হাত দূরেই সুদীর্ঘ ডাইনিং টেবিলের সামনে একজন বিখ্যাত চিত্র-পরিচালক কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন, তাঁদের কাছে একজন চিত্রাভিনেত্রীও দাঁড়িয়ে আছেন। চিত্র-পরিচালকের পাশ থেকেই হঠাৎ সেই মুখ জেগে উঠল।
সেই মুখ, সেই ঢুলু ঢুলু চোখ। ঠোঁটের কোণে সেই হাসি। এবং ঘাড় বাঁ-দিকে কাত করা। কী এই হাসির অর্থ? ঢুলু ঢুলু চোখে কি আসলে বিদ্রূপ মাখানো? ঠোঁটের কোণের হাসিটাও এক সময় সেই রকম মনে হয়—যেন আমাকে বিদ্রূপ করছে, এবং বিদ্রূপ করে কিছু বলছে বা জিজ্ঞেস করছে। কখনো কখনো মনে হয়, সেই মুখ নীরবে আমাকে যেন জিজ্ঞেস করছে, ‘কী, মনে পড়ে? পড়ছে না? চেষ্টা করে দেখ না!’ অথবা ‘আবার এলাম, বেশ পানভোজন চলছে দেখছি। ভালই আছেন মনে হচ্ছে, তাই না?’
এখনো দেখছি সেই মুখ, সেই হাসি আর ঢুলু ঢুলু চোখের দৃষ্টি আমার চোখের দিকে। আমার হাতের গেলাস হাতেই থেকে গেল। মুখে তুলতে ভুলে গেলাম। সবাই যে-যাঁর কথা বলে যাচ্ছেন। আমার সামনে প্রবীণ কবি কথা বলে যাচ্ছেন; কিন্তু কী বলছেন, আমি আর তা শুনছি না। সেই চিত্র-পরিচালক কথা বলে যাচ্ছেন, এবং তাঁকে যাঁরা ঘিরে রয়েছেন তাঁদেরই আড়াল থেকে চিত্র-পরিচালকের মুখের পাশে সেই মুখ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। চিত্র-পরিচালক যে সে মুখ সম্পর্কে কিছুই জানেন না বা দেখতে পাচ্ছেন না, তা পরিষ্কার বোঝা যায়; কারণ তিনি সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। কেউ-ই সে-মুখের দিকে তাকাচ্ছেন না। কারণ সে-মুখ আর কেউ দেখতে পাচ্ছেন না।
প্রবীণ কবি বলে উঠলেন, তুমি হঠাৎ ফিল্ম ডাইরেক্টারের প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়লে কেন? উনি কি তোমার গল্প নিয়ে কথা বলছেন নাকি?
আমি শুনছি, কিন্তু কোন জবাব দিতে পারছি না—কারণ আপাতত আমি যেন পার্টি-রুমে নেই। আমার আশেপাশে কেউ নেই। এবং এই শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে আমি ঘেমে উঠছি। তথাপি আমার এটুকু বোধ আছে, আমি চিৎকার করে উঠতে পারি না, বা হাতের গেলাসটা ওই মুখের দিকে ছুঁড়ে মারতে পারি না। তা অন্য কারোর মুখে লাগার যথেষ্ট সম্ভাবনা। আর চিৎকার করলে তা হবে বিশ্রী একটা নাটকীয় ব্যাপার, নানান রকম সন্দেহ জাগবে সকলের মনে, বিশেষত আমার হাতে এখন পানপাত্র। অনেকে দ্রব্যগুণের বিকার ভেবে হাসাহাসি করতে পারে। কিন্তু এই অলৌকিক ব্যাপারও আমি সেকেণ্ডের পর সেকেণ্ড সহ্য করতে পারি না। আরো লক্ষ্য করেছি, আমি কিছুতেই সেই মুখের থেকে চোখ সরাতে পারি না। যেন সম্মোহিতের মত সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
দিনের বেলা এত মহিলা পুরুষের সামনে তেমন একটা আতঙ্ক অনুভব করি না, কিন্তু আমার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে যেন একটা অবসেশানের সৃষ্টি হয়, এবং আমি যেন একটা ভয়ঙ্কর কিছুর সঙ্কেত পাই। কে—এ কে? কার মুখ? কিসের হাসি? কী বলতে চায়?
হঠাৎ আমি সেই মুখের দিকে এগিয়ে গেলাম—যদি সে আমার সঙ্গে কথা বলে এই আশায়। আমি নিজেও তাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। কিন্তু কয়েক পা যেতেই সে মুখ অদৃশ্য হয়ে গেল। চিত্র-পরিচালক আমার দিকে ফিরে তাকালেন; হেসে বললেন, আসুন। এত তন্ময় ভাব কেন?
আমি খানিকটা সুপ্তোখিতের মত প্রশ্নসূচক শব্দ করলাম, অ্যাঁ!
সকলেই ঠোঁট টিপে হেসে উঠলেন। চিত্রাভিনেত্রী বললেন, কী, মাত্রা বেশি হয়েছে নাকি?
আমি সচেতন হয়ে উঠলাম, এবং স্বাভাবিক ভাবে হাসলাম। আমি জানি সে মুখ আর আমি দেখতে পাব না। বললাম, আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে?
পরিচালক বললেন, না, না, আসলে আপনি অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছিলেন বোধ হয়।
বললাম, ঠিক ধরেছেন।
আরো দু-চার কথার পরে আমি সেই প্রবীণ কবির দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি তখন একজন কলকাতার মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, আমার দিকে কষ্ট চোখে তাকালেন। জানি উনি আমাকে ভুল বুঝেছেন, হয়তো অভদ্র ভেবেছেন। কিন্তু আমি যে কত অসহায়, তা উনি জানেন না। আর ব্যাপারটা ওঁকে বলারও কোন মানে হয় না। বিশ্বাস করবেন না।
আজ পর্যন্ত আমি এ ঘটনা কাউকে বলিনি। কারণ আমি জানি, একথা কেউ বিশ্বাস করবে না। অন্য কারোর হলে আমিও বিশ্বাস করতাম না।
একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, যখন আমি বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে একটু আমোদ-প্রমোদের মধ্যে থাকি, তখনই এই মুখ আমি দেখতে পাই। এবং তা দু-এক মিনিটের বেশি কখনো স্থায়ী হয় না। হয়তো কোন হোটেলের লাউঞ্জ বারে বসে আছি, বা কোন ওপন এয়ার বারে, কিংবা এমনি কোন সাধারণ রেস্তোরাঁয়, তখনই হয়তো দেখলাম, আমার কাছ থেকে একটু দূরেই, দুজন অপরিচিতের মাঝখানে সেই মুখ, আমার দিকে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে হাসছে। দিনের বেলাও সে দেখা দেয়, রাত্রেও দেখা দেয়।
আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমার স্মৃতির গভীরে তন্নতন্ন করে হাতড়ে দেখেছি, সেই মুখের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় নেই। এমন কি পুরোন ফটোর অ্যালবাম খুলে দেখেছি।
সেই মুখ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় কী না। না, নতুন পুরোন, কোন অ্যালবামেই সেই মুখ আমি খুঁজে পাইনি। পাইনি, আর অসহায় একটা যন্ত্রণায় বারবার ভেবেছি, কে—কার মুখ ওটা? কেন সে আমাকে এরকম করে দেখা দেয়? অথবা, বাস্তবে আমি কোন মুখই দেখতে পাই না, এটা আসলে আমার অবচেতনের কোন উন্মাদনা। কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব? অবচেতনের উন্মাদনার মধ্যে একটা কোন বাস্তব ঘটনার যোগাযোগ থাকতেই হবে। এবং একটি বাস্তব চরিত্রও, যার মুখ আমার চেনা থাকা উচিত। সেরকম কিছু হলে, আমি অচিরাৎ কোন মনোবিজ্ঞানীর কাছে ছুটে যেতাম, এবং উন্মাদনা ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভের চেষ্টা করতাম। মাঝে কিছুদিনের জন্য দিল্লী যেতে হয়েছিল। সেখানেও একই ব্যাপার ঘটেছে। প্রেস ক্লাবে, হোটেলে, রেস্তোরাঁয়, সেই মুখ দেখা দিয়েছে, এবং সব সময়েই আমার সঙ্গে বন্ধু-বান্ধবীরা ছিল। আমি বুঝতে পারি না, কী করা উচিত। সেই মুখ নিয়ে যে আমি সব সময় ভাবছি, তা না। কিন্তু ভাবনাটা আমাকে কখনো ছেড়ে যায় না, সব সময়েই ছুঁয়ে থাকে। যেন জানিয়ে দেয়, সে আছে, এবং সময় হলেই সে দেখা দেয়।
আমি অতঃপর মনে মনে একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। দিনে বা রাত্রে, সমস্ত রকম পার্টি আড্ডা ক্লাব হোটেল রেস্তোরাঁ—বন্ধু-বান্ধবী কিছুদিনের জন্য একেবারে ত্যাগ করলাম। তার ফলও পেলাম। সেই মুখ আর আমি দেখতে পাই না। আশ্চর্য! মনে মনে বললাম, মুখটি আমার নৈতিক চরিত্র রক্ষা করছে নাকি? যখনই একলা হয়ে গেলাম, তখনই সে বেপাত্তা। যেন সেই মুখ আমাকে প্রমোদ আসরে যেতে দিতে চায় না। কিন্তু সে তো আমাকে ভয় দেখায় না। শুধু তাকিয়ে হাসে।
আমার এই একলা অবস্থাতেই, আমার এক বান্ধবী একদিন টেলিফোন করল। ঊর্মিলা ওর নাম। সরকারী কর্মচারী, চাকরিটা ভালই করে। বয়স তিরিশ অতিক্রান্ত। এখনো বিয়ে করেনি, করবে না এরকমই আমাদের বলে। থাকেও এক। স্বাস্থ্য ভাল, যৌবন এখনো অক্ষুণ্ণ, এবং মেজাজটিও প্রসন্ন, বেশ রসিকা। প্রেম নিয়ে কোন মাথা ব্যথা কখনো দেখিনি, চরিত্রের দিক থেকে স্বৈরিণী বলা যাবে না, সেরকম আচার আচরণ কখনো দেখিনি। কিন্তু আমার প্রতি ওর একটি বিশেষ প্রীতি আছে। যাকে প্রেম কখনোই বলা যাবে না, অথচ সম্পর্কটা পাতিয়েছি অনেকখানিই নিরাবরণ।
ঊর্মিলা টেলিফোনে বলল, কলকাতায় ওর ভাল লাগছে না। কাছে পিঠে কয়েকদিনের জন্য, কোথাও ঘুরে আসতে চায়, অবিশ্যিই যদি আমি সঙ্গে থাকি। ভাবলাম, মন্দ কী। সেই মুখের জন্য, এমনিতেই তো নিজেকে ঘরের মধ্যে নির্বাসিত করে রেখেছি। তার চেয়ে, কয়েকদিন একটু নিরিবিলিতে কোথাও ঘুরে আসি। দরকার নেই আমার পার্টি ক্লাব হোটেল রেস্তোরাঁয়। আমি ঊর্মিলাকে আমার সম্মতি জানালাম। ঊর্মিলা নেতারহাট যাবার প্রস্তাব করল, এবং ও নিজেই রাঁচিতে ট্রাক-কলে যোগাযোগ করে, পালামৌ বাংলোর একটি ঘর বুক করল।
নেতারহাটে টুরিস্ট লজ আছে। কিন্তু পালামৌ বাংলোর কোন তুলনা হয় না। বৃটিশ আমলের তৈরি এই বাংলো অপূর্ব। একেবারে যেন আকাশের গায়ে ঠেকানো। সামনে তাকালে, যেন সমুদ্রের মত ঢেউ তোলা পাহাড়ের পর পাহাড়। নিচে, অরণ্যের পরেই, বালুচরের মাঝখান দিয়ে, সর্পিল কোয়েল নদী চকচক করছে।
বেলা দশটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। ডবল বেডের রুম, অ্যাটাচড বাথ, ব্যবস্থা চমৎকার। আমি ঊর্মিলাকে বললাম, ‘আমরা কি এক ঘরেই থাকব?’
ঊর্মিলা বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আলাদা খাটে।’
‘একটু কি নীতিবিগর্হিত কাজ হচ্ছে না?’
‘হত, যদি আমি অসম্মত হতাম।’
বলে ও চৌকিদারকে ডেকে, চা দিতে বলে, খাটের ওপর শুয়ে পড়ল।
জানি, নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে কোন লাভ নেই, তুলতে হলে অনেক আগেই তোলা উচিত ছিল। আমি বাথরুমের দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখলাম, পিছনের দরজাটা খোলা। পিছনে ঝুপসি ঝাড়ের মধ্যে, জমি ঢালুতে নেমে গিয়েছে। আমি পিছনের দরজাটা বন্ধ করবার উদ্যোগ করতেই, ঝোপের ভিতর থেকে সেই মুখ ভেসে উঠল। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই হাসি। শরীরের বাকি অংশ ঝোপের আড়ালে। আমি সম্মোহিতের মত, সেই মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, এবং এই প্রথম একটি অদ্ভুত পরিবর্তন দেখলাম। ঢুলুঢুলু চোখ আস্তে আস্তে পুরোটা মেলে, আমার চোখের দিকে স্থির নিবদ্ধ হল, আর ঠোঁটের কোণের হাসিটা গেল মিলিয়ে। প্রায় মিনিট খানেক সে আমার দিকে স্থির অপলক চোখে তাকিয়ে রইল, তারপরে মিলিয়ে গেল। আমার গায়ের মধ্যে একটা শিহরণ খেলে গেল। আমি দু-হাত দিয়ে সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
শব্দটা নিশ্চয়ই খুব জোরে হয়েছিল, ঊর্মিলা ঘরের ভিতর থেকে বলে উঠল, ‘উঃ, এত জোরে শব্দ করছ কেন? চমকে উঠেছি।’
যে কারণে বাথরুমে গিয়েছিলাম, তা আর হল না। ঘরে ফিরে এলাম, ফিরে এসে ড্রেসিং টেবিলে সামনের আয়নার দিকে তাকালাম। মুখের পরিবর্তনটা আমাকে যেন কেমন চমকে দিয়েছে। আর একটা ভয়ের শিরশিরানি এনে দিয়েছে। এ মুখ পালামৌ বাংলোর ঝোপে কেন এল? আর এই প্রথম এই মুখ আমাকে একলা অবস্থায় দেখা দিল। কেন? এর তাৎপর্য কী?
ঊর্মিলা খাট থেকে বলল, ‘কী হল, নিজের মুখ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলে নাকি?’
আমি স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললাম, ‘না, দেখছি নিজের মুখের মধ্যে আর কোন মুখ দেখা যায় কিনা।’
ঊর্মিলা বলল, ‘তোমার তো অনেক মুখ, কোষ্টা দেখতে চাইছ?’
বললাম, ‘বুঝতে পারছি না।’
ঊর্মিলা বলল, ‘আমার কাছে এসো, একটা মুখ দেখিয়ে দিচ্ছি।’
মনে মনে ভাবলাম, সেই ভাল, ঊর্মিলার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকি। আমি ঊর্মিলার কাছে গেলাম। ও আমার হাত ধরে ওর পাশে বসিয়ে দিল; বলল, ‘আমার দিকে তাকাও, তাহলেই হবে।’ বলে টেনে ওর পাশে শুইয়ে দিল। আমি চোখ বুজে শুয়ে রইলাম। ও আমার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল।
একটু পরেই দরজায় খটখট শব্দ হল, চৌকিদারের গলা শোনা গেল: ‘চা লে আয়া।’
আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললাম, ‘লে আও।’
চৌকিদার ঘরে ঢুকে দরজার বাঁ-দিকের টেবিলে চায়ের ট্রে বসিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, ‘দুপহর মে খানা কেয়া বানায়েগা?’
ঊর্মিলা বলল, ‘চাওল ঔর দাল, ভাজি, চিকেন কারি।’
চৌকিদার ‘বহুত আচ্ছা বলে চলে গেল। আমরা টেবিলের সামনে গিয়ে, চেয়ারে বসে চা-পান করলাম।
ঊর্মিলা বাথরুমে স্নান করতে ঢুকল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনের বারান্দায় গেলাম।
সামনে মোরাম বিছানো ঘেরা উঠোন। আসলে বাংলোটি একটি পাহাড় শীর্ষে। উঠোনের নিচেই জঙ্গলময় খাদ নেমে গিয়েছে।
আমি উঠোনে নামলাম। চওড়া বানো হাঁটু সমান প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম, অপূর্ব দৃশ্য। সিগারেট শেষ কবে, ডান দিকে এগিয়ে গেলাম। নানারকম ফুলের গাছ, সুন্দর করে সাজানো।
পিছনে কয়েকটা ছোট ছোট ঘর। বোধ হয় চৌকিদার সপরিবারে থাকে। দেখলাম, একজন লোক পিছন ফিরে বসে, কিছু করছে। তার সারা গায়ে আলখাল্লার মত জামা। সামনেই একটি গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল ফুল ফুটে আছে। আমি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ ফুল কা নাম কেয়া হ্যায়?’
লোকটি কোন জবাব দিল না।
আমি আবার বললাম, ‘এ ভাই, এ ফুল কা কেয়া নাম হ্যায়?’
লোকটি আমার দিকে ফিরে তাকাল, আর আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, দেখলাম সেই মুখ। প্রায় তিরিশ সেকেণ্ড সে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। পুরো খোলা চোখ, ঠোঁটে হাসি নেই। তারপরেই দেখি সেখানে কেউ নেই, শুধু ফুল গাছের ছায়া পড়ে আছে।
আমার শরীরটা বারে বারে শিউরে উঠল, আমি তাড়াতাড়ি বারান্দার দিকে ফিরে গেলাম। দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে চৌকিদার হেঁটে যাচ্ছিল। আমি তাকে পিছন থেকে ডাকলাম। ‘চৌকিদার, শুনো।’
চৌকিদার আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠতে যাচ্ছিলাম, চৌকিদারের পোশাকে, সেই মুখ! এবং কয়েক সেকেণ্ড পরেই বারান্দা শূন্য। টবের ফুলগাছের পাতা বাতাসে কাঁপছে।
আমি প্রায় ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। ঊর্মিলা সেই মুহূর্তেই বাথরুমের দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। সায়া আর ব্রা ওর পরনে। আমাকে দেখে চমকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে তোমার চোখ মুখ এরকম দেখাচ্ছে কেন? কেউ তাড়া করেছে নাকি?’
‘তার চেয়েও মারাত্মক।’ বলতে বলতে আমি ঊর্মিলার একেবারে গায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওর হাত ধরে খাটের কাছে এসে বসলাম। বললাম, ‘তোমাকে একটা ঘটনা বলব, তোমাকে শুনতে হবে। এ কথা আমি কখনো কাউকে বলিনি। তোমাকেই প্রথম বলছি। তুমি শাড়ি পরে পোরে, আগে আমার কথা শোন।’
ঊর্মিলা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার হাত ধরে ওর পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘বল, আমি শুনছি।’
আমি সেই মুখের কথা আদ্যোপান্ত ঊর্মিলাকে বললাম। ঊর্মিলা মনোযোগ দিয়ে শুনল। সব শুনে আমাকে বলল, ‘মুখের বর্ণনাটা আবার বল তো?’
আমি সেই মুখের নিখুঁত বর্ণনা দিলাম। ঊর্মিলা খাট থেকে উঠে, ড্রেসিং টেবিলের পাশে, একটা টেবিলের ওপরে রাখা ওর সুটকেশ খুলল। খুলে তার ভিতর থেকে একটা খাম বের করল, খামের ভিতর থেকে একটা ফটো। আমার সামনে সেই ফটো দেখিয়ে বলল, দেখ তো, ‘এই মুখ কী?’
আমি চমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম, অবিকল সেই মুখ। সুট ও বুটেড সম্পূর্ণ দেহ, সেই মুখেরই ফটো। ফটোতে ঢুলুঢুলু চোখ এবং সেই ঠোঁটের কোণে হাসি। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই সেই। এ কে?’
ঊর্মিলা একটু গম্ভীর ও অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘এর নাম অরিন্দম সেন। তোমাকে কখনো বলি নি। এর সঙ্গে আমার পরিচয় স্কুলে পড়বার সময়। বড় হয়ে ও ইঞ্জিনীয়ার হয়েছিল, ভাল চাকরিও করত। আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমি করি নি। করি নি কারণ, আমার কখনো সে ইচ্ছা হয় নি। কিন্তু আমাকে নিয়ে ও অবসেশড হয়ে গেছল, বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তার আগে, এই ফটোটা আমাকে ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। লিখেছিল, অন্তত, এটা যেন আমি আমার কাছে রাখি, তাতে ও শান্তি পাবে।’
আমি ফটোটার দিকে আবার দেখলাম, আর সেই জীবন্ত মুখ আমার মনে পড়ে গেল। ঊর্মিলা ফটোটা খামে ভরে, সুটকেশ বন্ধ করল। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঊর্মিলার কাছে গিয়ে বললাম, ঊর্মিলা, আমি আর এখানে থাকব না। এ অবস্থায় থাকা যায় না, চলো ফিরে যাই।’
ঊর্মিলা কিছু বলল না, ফিরেও তাকাল না। বোধ হয় অরিন্দমের স্মৃতিতে অন্যমনস্ক। আমি আবার ডাকলাম, ‘ঊর্মিলা!’
ঊর্মিলা ফিরে তাকাল, আর আমার মস্তিষ্কে যেন সোঁ করে একটা হাউই উড়ে এসে লাগল। আমি দেখলাম, ঊর্মিলা না। সেই মুখ! এবং পরমুহূর্তেই সব শূন্য। পালামৌ বাংলার ঘরে আমি একলা।
আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল, শরীর টলে উঠল, তারপরে কি হল, আমি কিছুই জানি না।