সেই বেলুনের কাহিনী
আকাশচারী স্যার জর্জ ক্যালি আর মি. হেসনের দু-দুটো সাম্প্রতিক ব্যর্থতার জন্য আকাশপথে সমুদ্র পাড়ি দেবার ব্যাপারটায় সাধারণ মানুষের উৎসাহ-আগ্রহে যথেষ্ট পরিমাণে ভাটা পড়েছে।
কেবলমাত্র সাধারণ মানুষই নয়, বৈজ্ঞানিকরাও মি. হেনসনের আকাশপথে ভ্রমণের পরিকল্পনাটাকে গোড়ার দিকে খুবই কার্যকরী বলে ভেবে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিচার করে দেখা গেল, মি. হেসনের পরিকল্পনাটার গোড়ায় গলদ রয়ে গিয়েছিল। পরে স্যার জর্জ ক্যালি পরিকল্পনাটার গলদটুকু ঝেড়ে মুছে ফেলে দিয়ে গলদটুকু শুধরে দিয়ে বেলুন-যন্ত্রটার খোলটাকে পালটে নিলেন। আর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনের মডেল পরীক্ষাও করলেন। কিন্তু হায়! এতকিছু করার পরও তিনি পরিকল্পনামাফিক বেলুনটাকে আকাশে ওড়াতে পারলেন না। দারুণভাবে ব্যর্থ হলেন তিনি।
শেষপর্যন্ত যা ঘটল, স্যার জর্জ কেলির পরিকল্পনাটা পুরোপুরি মাঠে মারা গেল।
উপরোক্ত ঘটনারাই ঠিক সমসাময়িককালেই মি. মংক ম্যাসন বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানি আর্কিমিডিসের সূত্র অবলম্বনের মাধ্যমে একটা বেলুন তৈরি করে সেটাকে উইলিসের কক্ষেনির্ববাদে চালিয়ে দেখালেন। সার্থক প্রয়াস। তারপর তিনি এডিলেড গ্যালারি তে মডেলটাকে নিয়ে গেলেন।
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, স্যার জর্জ কেলি ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে যখন নাসাউ নামক বেলুনে চেপে ডোভার থেকে উইলবার্গে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন। চারদিকে রীতিমত হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। তুমুল হৈচৈ শুরু হবার মতো ব্যাপার তো অবশ্যই। বেলুনে চেপে ডোভার থেকে একেবারে উইলবার্গ–কম কথা!
স্যার জর্জ কেলির বেলুনটা যেমন ডিম্বাকৃতিবিশিষ্ট ছিল, ঠিক একই রকম আকৃতির আরও একটা বেলুনও ছিল। সেটার দৈর্ঘ্য ছিল তেরো ফুট দুইঞ্চি আর ছয়ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতা। এডিলেড গ্যালরিতে সে মডেলটাকেও দিব্যি চালিয়ে দেখানো হলো।
আর সে যন্ত্রটা ঘন্টায় পাঁচ মাইল বেগে উড়ে গেল।
কিন্তু অবাক কাণ্ড! যন্ত্রটার প্রতি উপস্থিত দর্শকরা কিছুমাত্র আগ্রহও দেখাল না। কেন এমনটা হল? আকাশে সেটার গঠন প্রকৃতি সাদামাটা যে, কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো ক্ষমতা তার ছিল না। অতএব তার কাজকর্মের প্রতি কারো উৎসাহ-আগ্রহ জাগার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। তবে মি. ম্যাসন নিজের আবিষ্কার দেখে যারপরনাই খুশি হলেন, আর মনে মনে গর্ববোধও কম করলেন না।
এবার তার মনে প্রবল ঝোঁক চাপল, এমন একটা বেলুন তিনি তৈরি করবেন যেটা হবে অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন। আর সেটা চেপে যাতে নাসাউ বেলুনের মতোই অনায়াসে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে দিতে পারবেন।
মি. ম্যাসন পরিকল্পনাটা নিলেন কিন্তু এমন একটা কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ তো আর তার একার পক্ষে সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তবে উপায়? অনেক ভেবে চিন্তে তিনি মি. অসবোর্ণ আর স্যার এভারার্ড ব্রিংহাস্টের সাহায্য সহযোগিতা নেবার কথা মনস্থ করলেন। যথারীতি তাদের দুজনের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তারা সানন্দে তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
ব্যস, মি. ম্যাসন এবার নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি নিঃসন্দেহ, ও-রকম দুজন কৃতী ব্যক্তির সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা পেলে তিনি যে সাফল্য লাভ করবেনই।
মি. অসবোর্ণ পরামর্শ দিলেন, বেলুন তৈরির ব্যাপারটা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে জনসাধারণের কাছে গোপন রাখতে হবে। মি. ম্যাসন আর স্যার এভারার্ড ব্রিংহাস্ট পরামর্শ অনুযায়ী গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
কাজে হাত দেবার আগে থেকেই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সবাই যন্ত্রটার তৈরির নকশার ব্যাপারটা সম্বন্ধে গোপনীয়তা রক্ষার প্রাণান্ত প্রয়াস চালাতে লাগলেন। কেবলমাত্র তারাই ব্যাপারটা সম্বন্ধে কম-বেশি জানতে পারল, যাদের ওপর উড়ান যন্ত্রটার বিভিন্ন অংশ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া ছিল।
মি. ম্যাসন, স্যার এভারার্ড ব্রিংহাস্ট, মি. হল্যান্ড আর মি. অসবোর্ণ প্রভৃতির ওপর যন্ত্রবিদদের তত্ত্বাবধানে যন্ত্রটা তৈরির কাজের দায়িত্ব বর্তাল। আর সেটা তৈরির কাজ মি. অসবোর্ণের বাড়িতে পুরোদমে চলতে লাগল। তার বাড়িটা ওয়েলস-এর। অন্তগর্ত পেটুথালের অদূরবর্তী এক নিরালা পরিবেশে অবস্থিত।
এই তো গত শনিবারের কথা। সেদিন মি. হেন্সন্ তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু মি. আইন্সওয়ার্থকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে খুবই গোপনে সদ্য তৈরি বেলুনটাকে দেখালেন। তবে এও সত্য তাঁকে জায়গামত হাজির করার পূর্ব মুহূর্তে ব্যাপারটার গোপনীয়তা সম্বন্ধে সচেতন করে দিতে ভোলেননি। মি. আইনসওয়ার্থ শেষপর্যন্ত কথা রেখেছিলেন। যা-ই হোক, মি. আইন্সওয়ার্থ দীর্ঘসময় ধরে গভীর উৎসাহের সঙ্গে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। খুশিই হলেন।
শেষপর্যন্ত মি. আইন্সওয়ার্থ এ বেলুন ভ্রমণে সঙ্গি হবার ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন। আসলে এমন অপূর্ব সুযোগ হাতছাড়া করতে তিনি উৎসাহি হলেন না, হবার কথাও নয়।
এ ভ্রমণে কেন যে দুজন নাবিককে সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল, তা আর যে বা যারাই জানুক আমার অন্তত জানা ছিল না। তবে কথা দিচ্ছি, দু-একদিনের মধ্যেই এ অসাধারণ ভ্রমণের বৃত্তান্ত পাঠক পাঠিকাদের জানিয়ে দেব।
আমাদের পরিকল্পনার আসল লক্ষ্য ছিল ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা। আর সে সঙ্গে পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল প্যারিস শহরের যত কাছে সম্ভব বেলুনটাকে নামানো।
আমাদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য, যাত্রীরা সবাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ইওরোপের ছোট বা বড় যে কোনো দেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। আর এরই ফলে অভিযাত্রীরা আইনের বাধাধরা ছক থেকে, নির্দিষ্ট ফাঁদগুলো থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিল। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যাকে বলে। শেষপর্যন্ত এত কষ্ট স্বীকার করে পাসপোর্ট সংগ্রহ করা পুরোপুরি বিফলেই গেল। আসলে কতগুলো অভাবনীয় ঘটনার জন্যই এমনটা ঘটেছিল। যা-ই হোক, অভিযাত্রীদের পাসপোর্টগুলো কোটের পকেটেই রয়ে গেল, কোনো কাজেই লাগল না।
বর্তমান মাসের ৬ তারিখ শনিবার। সেদিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই উত্তর ওয়েলসের পেট্রুথশ থেকে প্রায় মাইল খানেক দূরবর্তী মি. অসবোর্ণের উইল ভর হাউস নামক বাড়ির সম্মুখস্থ প্রান্তরে জোরকদমে বেলুনে বাতাস ভরার কাজ শুরু হয়ে গেল। সে যে কী উৎসাহ, উদ্যম তা ভাষার মাধ্যমে কারো মধ্যে ধারণা সঞ্চার করানো সম্ভব নয়। সব কাজ মিটাতে এগারোটা বেজে গেল আর এগারোটা বেজে সাত মিনিটের মধ্যে যাবতীয় কাজ চূড়ান্তভাবে মিটিয়ে বেলুনের বাঁধন কেটে যাত্রা শুরু করা হলো।
ব্যস, বাঁধনমুক্ত হয়েই অতিকায় বেলুনটা কিছুটা ওপরে উঠে তর তর করে সোজা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করল। যাত্রা শুরু করার পর গোড়ার দিকে আধঘণ্টা নিজের স্বাভাবিক গতিতে বেলুনটা শূন্যে ভেসে যেতে লাগল। ফলে হাল বা স্ত্র কোনোটাই ব্যবহার করতে হলো না।
এবার আমরা অগ্রসর হতে লাগলাম মি. ফরসাইথের ডায়রির পাতায় যেখানে তিনি মি. আইন্সওয়ার্থ আর মি. মংক ম্যাসনের যৌথ ভাবে লেখা পাণ্ডুলিপিকে অবিকল অনূদিত করেছেন। ভাষান্তরিত বিবরণীয় সাহায্য নেওয়া ছাড়া আমাদের তো গতিও নেই। ডায়েরিটা মি. ম্যাসন নিজে হাতে লিখেছেন। আর প্রতিদিনই মি. আইন্সওয়ার্থ তার পাতায় পুন: উল্লেখ করে কিছু-না-কিছু সংযোজন করেছেন।
কেবলমাত্র এ-ই নয়, তার সঙ্গে তিনি এ সমুদ্রযাত্রার একটা বিস্ময় সষ্টিকারী মনোজ্ঞ বিবরণও তৈরি করে ফেলেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, সে বিবরণীয় পাঠ করলে অতি বড় নীরস পাঠক-পাঠিকার মন-প্রাণ পুলকানন্দে মেতে ওঠারই কথা। আর অত্যল্পকালের মধ্যেই আমরা সে অনন্য বিবরণী সর্বসাধারণের হাতে তুলে দিতে পারব বলেই বিশ্বাস রাখি।